বুধবার, ২৭ জুন, ২০১৮

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


        শেয়ার করেছেন                                     প্রণব কুমার কুণ্ডু


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭তম জন্মজয়ন্তী ও আবদুস শাকুরের রবীন্দ্রজীবন সংক্ষিপ্ত পাঠ

***
আজ সোমবার, পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭তম জন্মজয়ন্তী।

(১)
কবির ভাষায়, ‘আকাশভরা সূর্যতারা/বিশ্বভরা প্রাণ…’। সেই বিশ্বভরা প্রাণের উচ্ছাসে আজ সোমবার গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হবে কবিগুরুকে তারই লেখা গানে, কবিতায়, নাটকে। আলোকের ঝরনাধারায় সৃজনশীল এক বিস্ময়কর মনীষীর স্মৃতিতে অবগাহনে মেতে উঠবে রবীন্দ্রপ্রেমীরা। আজ থেকে ১৫৭ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ এবং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে (বাংলা বর্ষপঞ্জি পরিবর্তনে এখন বাংলাদেশে ৮ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

(২)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির। সেবার সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি। এই সময়পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

(৩)
অন্যদিকে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ঢাকায় - অর্থাৎ কবিগুরুর প্রয়াণের প্রায় ১৪ বছর পর ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) এই একাডেমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন-পরবর্তী কালের প্রেক্ষাপটে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন "বর্ধমান হাউজ"-এ এই একাডেমির সদর দপ্তর স্থাপিত হয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি ২০১০ সাল থেকে এ পুরস্কার প্রবর্তন করে। রবীন্দ্রসাহিত্যের গবেষণা ও সমালোচনা এবং রবীন্দ্রসংগীতের আজীবন সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ প্রথম ৫৫ বছরেও এই প্রতিষ্ঠানটি কবিগুরুর কোন জীবনী প্রকাশ করতে ব্যার্থ হন যার প্রায়শ্চিত্ত হয় ২০১২ সালে প্রকাশিত আবদুস শাকুরের "রবীন্দ্রজীবন" প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

(৪)
রবীন্দ্রজীবন-এর পরিধি প্রসঙ্গে আবদুশ শাকুর (১৯৪১-২০১৩) বলেছেন : ‘প্রথম খণ্ডে গ্রন্থিত হয়েছে বিস্ময়বালক রবীন্দ্রনাথের চারশত বৎসরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বংশগতির বিবরণসহ সর্বপ্রাথমিক-কিন্তু-সার্বিক প্রস্তুতিপর্ব সংবলিত প্রথম পনেরো বছরের বৃত্তান্ত। আর দ্বিতীয় খণ্ডে গ্রন্থিত হয়েছে তাঁর সৃজনপর্বের প্রথম পালায় সমৃদ্ধ দ্বিতীয় পনেরো বছরের বিবরণ।’ গ্রন্থটি নিয়ে আমরা দুটো বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করতে পারি, এক. বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় পার করে হলেও বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত ব্যক্তিকে দিয়ে রবীন্দ্রজীবন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে- যা আমাদের চিরায়ত ও আধুনিক সংস্কৃতি-চেতনার উৎসমুখের দায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, দুই. আবদুশ শাকুরের বক্ষ্যমান গ্রন্থটির ইতিহাসগত দিক, যা বাঙালি মুসলমান-রচিত রবীন্দ্রজীবন, এবং এই স্বাধীন ভূখণ্ড ও জনমানুষের রবীন্দ্র-আস্থা এবং প্রেরণার নৈতিক স্বীকৃতি পুনর্গঠিত হয়েছে। গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে অনুসরণীয় এবং অবশ্য পাঠযোগ্য। যদি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রশান্ত পাল বা প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র জীবনী আমলে নিই, সেখানে আবদুশ শাকুরের গ্রন্থটির ভিন্নতর বিশেষত্বও পাওয়া যায়। অকাট্য যুক্তি, মেধাবী পর্যবেক্ষণ, তীক্ষ্ণ উইট, সূক্ষ্ম রসিকতা আর সুবিন্যস্ত পরিকল্পনায় এটি সুখপাঠ্য, অসামান্য। কোনো আবেগ বা উদ্দেশ্য গ্রন্থটিকে ভারাক্রান্ত করেনি। কোনো আতিশয্য বা আবেগের প্রলেপে এটি ‘ভক্তিসংহিতা’ হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের এবং দোষে-গুণে-চাঞ্চল্যে-চাপল্যে মর্ত্যের মনুষ্যরূপে উপলভ্য হয়ে উঠতে পারেন।

(৫)
রবীন্দ্রজীবন-এর পরিধি প্রসঙ্গে আবদুশ শাকুর (১৯৪১-২০১৩) বলেছেন : ‘প্রথম খণ্ডে গ্রন্থিত হয়েছে বিস্ময়বালক রবীন্দ্রনাথের চারশত বৎসরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বংশগতির বিবরণসহ সর্বপ্রাথমিক-কিন্তু-সার্বিক প্রস্তুতিপর্ব সংবলিত প্রথম পনেরো বছরের বৃত্তান্ত। আর দ্বিতীয় খণ্ডে গ্রন্থিত হয়েছে তাঁর সৃজনপর্বের প্রথম পালায় সমৃদ্ধ দ্বিতীয় পনেরো বছরের বিবরণ।’ গ্রন্থটি নিয়ে আমরা দুটো বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করতে পারি, এক. বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় পার করে হলেও বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত ব্যক্তিকে দিয়ে রবীন্দ্রজীবন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে- যা আমাদের চিরায়ত ও আধুনিক সংস্কৃতি-চেতনার উৎসমুখের দায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, দুই. আবদুশ শাকুরের বক্ষ্যমান গ্রন্থটির ইতিহাসগত দিক, যা বাঙালি মুসলমান-রচিত রবীন্দ্রজীবন, এবং এই স্বাধীন ভূখণ্ড ও জনমানুষের রবীন্দ্র-আস্থা এবং প্রেরণার নৈতিক স্বীকৃতি পুনর্গঠিত হয়েছে। গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে অনুসরণীয় এবং অবশ্য পাঠযোগ্য। যদি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রশান্ত পাল বা প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র জীবনী আমলে নিই, সেখানে আবদুশ শাকুরের গ্রন্থটির ভিন্নতর বিশেষত্বও পাওয়া যায়। অকাট্য যুক্তি, মেধাবী পর্যবেক্ষণ, তীক্ষ্ণ উইট, সূক্ষ্ম রসিকতা আর সুবিন্যস্ত পরিকল্পনায় এটি সুখপাঠ্য, অসামান্য। কোনো আবেগ বা উদ্দেশ্য গ্রন্থটিকে ভারাক্রান্ত করেনি। কোনো আতিশয্য বা আবেগের প্রলেপে এটি ‘ভক্তিসংহিতা’ হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের এবং দোষে-গুণে-চাঞ্চল্যে-চাপল্যে মর্ত্যের মনুষ্যরূপে উপলভ্য হয়ে উঠতে পারেন।
রবীন্দ্রজীবনী প্রথমখণ্ডের সূচি : ভূমিকা, সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক, সারদাসুন্দরী দেবী, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বরী দেবী, মৃণালিনী দেবী, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিভাসুন্দরী দেবী, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী, অভিজ্ঞা দেবী, প্রাতিস্বিক। এভাবে প্রধান শিরোনাম চিত্রার্পিত হলে, এর ভেতরে অনেক উপ-শিরোনাম পরিস্থিতি মোতাবেক সুপ্রযুক্ত হয়। এর ভেতরেই রবীন্দ্রজীবনী তখন প্রসাদময় পুনর্গঠন পায়। আবদুশ শাকুর তথ্য-বাহুল্য ঘটাননি কখনো, মৌলিকত্বে বক্তব্যের প্রযত্নকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তথ্যের আকর শুধু নয়, পূর্বাপর রবীন্দ্র-শিক্ষায় তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রভূত তথ্যভাবনাকেও নিজস্ব চিন্তনে যুক্ত করেন- যা বর্ণময়তা পায়, অতুল্য আলোকপ্রভায় হয়ে ওঠে সুলভ্য। এতে শাকুর-পর্যবেক্ষণ নির্মাণ প্রাবল্য পেলেও- বিন্দুমাত্র পাঠ-নির্ভরতা বা আরোপিত উদ্দেশ্য প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, উইট ও প্রজ্ঞার লাবণ্য, যা গ্রন্থটিকে বিশেষ প্রযুক্ততা দান করে। এ প্রয়াসে বক্তব্যটি পরিষ্কার করা যায় নিচের উদ্ধৃতিতে :
আজ আমরা পেছনে তাকালে দেখি, না-জেনেবুঝে হলেও, সশস্ত্র বিদেশি লুটেরাদের শোষণ-শাসনের শিকড় গাড়ার জন্যে উর্বরতম জমির জোগানদাতা হয়ে গেলেন কবিগুরুর বিত্তসন্ধানী বিচক্ষণ পূর্বপুরুষগণ… সম্ভবত এসব কারণেই ঠাকুরবংশের এ ধরনের শিকড়গুলি উপড়ে ফেলতে চাইতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- নিদেনপক্ষে তাঁর জীবনীগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত না করে বিস্মৃতির পথ ধরিয়ে দিতে।
উপর্যুক্ত প্রসঙ্গ ধরে আবদুশ শাকুরের রবীন্দ্রজীবনীর সনিষ্ঠ প্রবণতাটি পুনরায় খেয়াল করি :
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রাখাঢাকা-লুকোছাপার গরজে গড়ে তোলা রূপকথার মতো এ ধরনের উপকথা, অতিকথার সযত্ন লালন অনেককাল ধরেই চলেছে- একালে যে সবের উৎপাটন একান্তই প্রয়োজন। সেজন্যই এ বিষয়ে আমরা প্রয়োজনে বাগবিস্তার করব স্থানে স্থানে। তাতে মূলগ্রন্থের গতি শ্লথ হলেও পাঠককে বুঝতে হবে যে এও অন্যতম কারণ উপস্থিত গ্রন্থটির উদ্ভবের।

(৬)
রবীন্দ্রজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড ‘রবীন্দ্রনাথের ষোলো থেকে ত্রিশ বছর বয়সের রকমারি রচনা … তাঁর সৃজনপর্বের প্রথম পালায় সমৃদ্ধ দ্বিতীয় পনেরো বছরের বিবরণ’। ১৮৭৭ সাল, যখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ১৬, মেঘনাদবধের সৃষ্টির হেতু ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা এবং ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রচনা। ১৮৭৭-উত্তর সময়ের রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-উদ্‌গম এবং ক্রমশ ফুল ও ফলে মুকুলিত। আবদুশ শাকুর একটি সময়রেখায় তাঁর সাহিত্যকে পুষ্ট করান, প্রচুর তর্ক ও যুক্তিতে পৌণপুনিক পরীক্ষা করে নেন, রচনাসমূহ- কড়ি ও কোমল, প্রভাতসঙ্গীত, মানসীর কিছু স্বনামখ্যাত কবিতা, সাল-তারিখের ভেতরে “প্রাণ”, “অহল্যার প্রতি”, “স্তন”-এর পর্যাবৃত্ত গড়ে তোলেন, বয়স ধরে তার বোধ ও পরিবৃত্তের ক্রম-উচ্চতা মাপা যায়, এ পর্বে শাকুর খুব উৎসাহের সঙ্গে রবীন্দ্রসাহিত্যর উদ্‌গম অভিপ্রায় করে তোলেন- জীবনীর আধাররূপে; কবির উপলভ্য অসামান্য, সমাজ-পরিবার আধারের অনুরক্তিতে; সে নির্বাচনে খ্যাতিমান সমালোচক-পণ্ডিতগণের স্বীকৃতিও যখন মেলে- তখন কৈশোরোত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথের প্রত্যুষ-পর্ব সুচিহ্নিত হয়ে ওঠে।

(৭)
আবদুশ শাকুরের রবীন্দ্রজীবনী পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায়, এর ত্রুটিগুলো সম্পর্কে বলা দুরূহ। প্রথম খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের ভেতর দিয়ে যে কয়েকশ বছরের সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতির যৌক্তিক পরিবেশটি বিপুল তথ্যপ্রমাণসমেত লেখক সমুপস্থিত করেন, তার রীতি-প্রকৌশল সম্পর্কে মতান্তর করা না গেলেও, রবীন্দ্রনাথের রক্ত-মাংস শীলিভূত পূর্বাপর বৃত্তান্ত ইতিহাস-সাক্ষ্যরূপে অমোচনীয়ভাবেই হাজির হয়, পাঠক সম্মুখে। মনে হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তার দাদা-পরদাদার বংশ-ঠিকুজী অতিরিক্ত টানা হয়েছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ গৌণ মনে হয়; কিন্তু সেটি সত্য নয়, রবীন্দ্রনাথ কী এবং কেন তার উত্তরটুকু ওই ইতিহাসের চূড়ায় সুলিখিত ছিল- গ্রন্থকার সে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে শাঁসটুকু বের করে এনেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাতে চর্বিতচর্বন নয়, নৈর্ব্যক্তিক পাদপীঠে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরের খণ্ডটিতে লেখক রবীন্দ্রনাথের ক্রমোন্মোচিত স্বরূপ প্রতিষ্ঠিত। তাতেও প্রচুর তথ্য-যুক্তির ক্রস আছে- খ্যাতনামা পণ্ডিতগণের পাঠও অনায়াসে উঠে আসে, ফলে লেখক রবীন্দ্রনাথকে পরিপূর্ণরূপে অনুধাবনের পথটি স্পষ্ট হয়।

(৮)
গত দশকের শুরুর দিকে সদ্যপ্রয়াত কথাশিল্পী আবদুশ শাকুরের অনবদ্য স্মৃতিকথা ‘কাঁটাতে গোলাপও থাকে’ পাঠের মধ্য দিয়েই মূলত তাঁর লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তাঁর রচনার শিল্পগুণ এত বেশি মুগ্ধ করে যে, তাঁকে আরো বেশি করে জানতে সচেষ্ট হই। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর বিচিত্র রচনাবলি পাঠ করতে করতে, তাঁকে জানতে জানতে দশকের শেষের দিকে এসে তাঁর সান্নিধ্য লাভের গৌরব অর্জন করি।
আবদুশ শাকুর ছিলেন প্রজ্ঞানিমগ্ন একজন লেখক। তিনি প্রথমত একজন কথাশিল্পী। গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা, প্রবন্ধ ও নাটকে শব্দ দিয়ে এমন কারুকাজ করতেন, যা প্রকৃতার্থেই শিল্প হয়ে উঠেছে। স্বস্তা বিনোদনের জন্য, পাঠককে নিছক আনন্দ দেওয়ার জন্য তিনি কখনোই লিখেননি। কথাকে কীভাবে শিল্পে রূপান্তর করা যায়, সেই প্রয়াস ছিল সব সময় তাঁর লেখায়। ভারতের বঙ্গবাসী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. বিষ্ণু বেরা আবদুশ শাকুর সম্পর্কে তাঁর এক লেখায় লিখেছিলেন : “অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন কথাশিল্পী শাকুর তাঁর রচনাসাহিত্যে নিজেকে এবং তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ ও পরিবর্তমান বাঙালি সমাজকে বিশশতকের উত্তাল বিশ্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নানা রঙে নানা ভঙ্গিমায় স্থাপন করেছেন। মনন ও অভিজ্ঞতায় এই লেখক প্রকৃত অর্থেই একজন বিশ্বনাগরিক। বাংলাদেশের নাগরিক বৃত্তের উচ্চমহল সম্বন্ধে বিশদ ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তাঁর জীবনপাত্র উছলে উঠে এক স্বতন্ত্র মাধুরীর ছবি ফুটিয়ে তুলেছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে, বিশেষত রমণীয় রচনার ছোটগল্পরূপ উপস্থাপনায়। মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা, সংসারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাকে গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে অসামান্য তাৎপর্যময় করে তোলা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপনার নির্মোহ দার্শনিকতা তাঁর রচনাকে একান্তই নিজস্ব করে তুলেছে।”
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায়, “আজ আমাদের চারপাশে অযত্ন আর অবহেলায় লেখা শিথিল গদ্য ভাষার যে ‘অলীক কুনাট্যরঙ্গ’ মাথা উঁচিয়ে উঠেছে―আবদুশ শাকুরের গদ্য চিরায়ত গদ্যের পক্ষ থেকে তার শক্তিমান প্রতিবাদ... জ্ঞান, মেধা এবং মননের সমবায় তাঁর বৈদগ্ধ্যকে এমন এক পরিশীলিত শ্রী এবং উপভোগ্যতা দিয়েছে যার কাছাকাছি জিনিশ চিরায়ত বাংলাসাহিত্যের ভিতরেই কেবল খুঁজে পাওয়া যাবে।”
লেখালেখিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন মৃত্যুর আগপর্যন্ত। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি মৃত্যুর দিন দুপুরেও লেখার জন্য তিনি কম্পিউটারটি ওপেন করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শরীরে কুলাচ্ছিল না বলে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়েন। মৃত্যুর দুদিন আগেও তিনি লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনী রচনার কাজটি করছিলেন বেশ কমাস ধরে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশের জন্য মোট ছয় খণ্ডে তিনি রবীন্দ্রজীবনী রচনার কাজে হাত দিয়েছিলেন। দুই খণ্ড লিখে শেষ করে পাণ্ডুলিপি জমাও দিয়েছেন একাডেমিতে। রবীন্দ্রজীবনের ৩০ বছরের নানা বিষয় এই দুই খণ্ডে আলোচিত হয়েছে।
কবিগুরুর জন্মদিনে এই রবীন্দ্রসাধককেও জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Khalid Iftekhar

৮মে ২০১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন