বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

চৈতন্যদেব ( অষ্টম পর্ব )


     চৈতন্যদেব ( অষ্টম পর্ব )

     ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু

তারেই খুঁজে বেড়াই : অষ্টম পর্ব
সেবার একটানা বেশ কিছুদিন ছিলাম পুরীর রাধাকান্ত মঠ বা গম্ভীরায়। তখন কার্ত্তিক মাস চলছে। দামোদর মাসের ব্রত পালনের জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ ভীড় জমিয়েছেন পুরীতে। গম্ভীরাকেই মনে হচ্ছে একটা মিনি ভারতবর্ষ। কতরকম ভাষা, সম্প্রদায়, পোশাক, ব্রত পালনের আচার, সাধনার ধারা। খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশার সুযোগ হল বিভিন্ন ধরনের বৈষ্ণব সাধুসম্প্রদায়ের সঙ্গে। যারা শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে গবেষণা করেছেন তাদের অনেকেই শুধু ইতিহাসের মধ্যেই আবদ্ধ থেকে অবহেলা করে গেছেন সেই সময়ের জীবন্ত ইতিহাসের ধারক ও বাহক ভারতবর্ষের এক বিশাল এলাকায় বিস্তৃত বৈষ্ণব ও সহজিয়া সাধকসমাজকে এবং আজও প্রবহমান তাদের সাধনার ধারাকে। সত্যের মূর্তিমান ব্যঞ্জনা শ্রীচৈতন্যের জীবনের সত্য কি শুধুই সামান্য কিছু লিপিবদ্ধ তথ্যের মধ্যে দিয়ে জানা সম্ভব? তাঁর প্রকাশ্য বা গুপ্ত সাধনা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে, তাঁকে অনুভবের মধ্যে দিয়ে জানার চেষ্টা না থাকলে সেই মহাজীবন কেন ধরা দেবেন?
আবার ফিরে আসি গম্ভীরার কথায়। সেই সময় ওখানে থাকা বৈষ্ণব সাধক ও ভক্তগণ প্রতিদিন ব্রাক্ষমুহূর্তে মঙ্গলারতি ও কীর্তনের পর একটি পরিক্রমায় বেরোতেন। তা এতই ভালো লাগতো যে আমরাও জুড়ে যেতাম ওনাদের সঙ্গে। তখনও অন্ধকারের পর্দা ওঠেনি, ঘুমিয়ে রয়েছে পুরী শহরের জনহীন রাস্তা; খোল করতাল সহ উদাত্ত গলায় সংকীর্তন করতে করতে এগিয়ে চলেছেন সাদা ধুতি ও উত্তরীয় গায়ে বৈষ্ণবজন। "শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ......" যেন মুছে যাচ্ছে পাঁচশো বছরের সময়ের ব্যবধান। হয়তো আজও সামনে তিনিই রয়েছেন। একটু একটু করে ফুটছে ভোরের আলো আর আমরা যেন ক্রমশ মিশে যাচ্ছি সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের মধ্যে। এই পথের ধূলিকণায়, পুরীর আঁকে বাঁকে আজও তো তাঁরই স্পর্শ। স্বর্গদ্বার হয়ে পরিক্রমার পথ চললো সমুদ্রের ধার দিয়ে। সানরাইজ দেখতে জড়ো হওয়া ভীড়ও সরে গিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। সমুদ্রের জল আমরা ছিটিয়ে নিলাম মাথায়। তারপর চললাম হরিদাস ঠাকুরের সমাধিমন্দিরে।
এখানে দেখলাম আরও একটি অদ্ভুত ঘটনা। সমাধিমন্দিরে ঢোকার দরজার ঠিক ৮-১০ মিটার আগে, সমুদ্রের দিকে যাবার রাস্তার ওপরেই একটি ভাঙাচোরা, তালা দেওয়া ঘরের দরজার সামনে দেখতাম ছোট মোহন্ত মহারাজ থেকে শুরু করে সকল পরিক্রমাকারীই প্রতিদিন মাথা ঠেকাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করায় বললেন, "গুরুস্থান"। এখন প্রশ্ন হলো কে এই গুরু? গম্ভীরায় গিয়ে জানলাম ওনাদের প্রথম মোহন্ত গোপালগুরু গোস্বামী থেকে শুরু করে বাকী সব গুরু মোহন্তদের সমাধি রয়েছে ওখানে। এখানেও উঠে আসে অনেকগুলো প্রশ্ন। যে কোনো সম্প্রদায়ের কাছেই তাদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সমাধি অত্যন্ত আদরের হওয়া উচিত। আর তা মঠের মধ্যে বা পাশাপাশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সেগুলো এতটাই অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে কেন? ওই রকম একটি ছোট্ট ঘরে এত জনের সমাধি? নাকি সকলকেই অপ্রকট বলে প্রচার করার জন্য সমাধি এরকমই দূরে কোথাও রাখা প্রয়োজন? ব্যাপারটি একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে না? ঘরটি বাজারের মধ্যে, আশপাশে দোকান ও হোটেল। সেই দোকানদারেরা জানালেন ভিতরে সত্যি সমাধি আছে এবং হরিদাস মন্দির থেকে সেখানে পূজা হয়। হরিদাস ঠাকুরের সমাধিমন্দিরের কয়েকজনের কাছে এই বিষয়ে খোঁজ নিয়েও কোনো তথ্য পেলাম না। ঘরটি তালা দেওয়া থাকায় ভিতরে ঢুকে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে এই সমাধিক্ষেত্র যদি হেঁজি পেঁজি কারো হতো তাহলে এতজন বৈষ্ণব ওখানে মাথা ঠেকাতেন কি? তাহলে কার সমাধি? এই প্রসঙ্গে পুরীর টোটা গোপীনাথ মন্দিরের এক প্রাচীন সাধক জানালেন ওটি হল মহাপ্রভুর ঘনিষ্ঠ পার্ষদ স্বরূপ দামোদরের সমাধি। খুবই চমকে দেওয়ার মতো তথ্য।এর আগে পর্যন্ত স্বরূপ দামোদরের সমাধির কোথাও কোনো উল্লেখ পাইনি। ঘরটি তালাবন্ধ থাকায় ভিতরটা দেখতে পাই নি। সময়াভাবে এই রহস্যময় সমাধিগৃহটি নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানেরও সুযোগ পাই নি। কারও যদি এই বিষয়ে কিছু জানা থাকে, দয়া করে জানালে খুবই উপকৃত হবো।
হরিদাস ঠাকুরের সমাধিমন্দিরে সংকীর্তনের পরে পরিক্রমাকারীরা যেতেন টোটা গোপীনাথ মন্দিরে। এই মন্দিরে রহস্যও কিছু কম নেই যার কিছুটা আমি আগের একটি পর্বে আলোচনা করেছি। সাধুসঙ্গে সুযোগ হলো গোপীনাথের চরণদর্শনের। অপূর্ব সে বিগ্রহ। যারা এই মন্দিরে গেছেন অথচ চরণদর্শন করেননি তারা সত্যিই একটা অসাধারণ কিছু miss করে গেছেন। টোটা গোপীনাথ মন্দিরের পর মহাপ্রভুর স্মৃতিবিজড়িত চটক পর্বত, যমেশ্বর শিব ইত্যাদির পাশ দিয়ে ঘুরে এসে আমরা পরিক্রমা করতাম জগন্নাথ মন্দির। ভোরের বেলা অপেক্ষাকৃত নির্জন মন্দিরে এই পরিক্রমাকারীদের সঙ্গে সংকীর্তনে না এলে হয়তো জানতেই পারতাম না যে জগন্নাথ মন্দিরের compound এর মধ্যে মোট তিনটি চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দির রয়েছে।
বেশ কিছুদিন এই সাধুসঙ্গে থাকায় একটা একাত্মতা অনুভব করছিলাম এনাদের সঙ্গে। তারপর চৈতন্য মহাপ্রভুর অযাচিত কৃপায় দেখার সৌভাগ্য হল তাঁর নিজের গোপন রহস্যময় সাধনক্ষেত্র। গম্ভীরায় রাধাকান্ত মন্দিরের সামনে দিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে ভিতরের দালানে ঢুকে পড়লে বাঁ দিকেই একটা তালাবন্ধ বড় কাঠের দরজা চোখে পড়বে। আমাকে ওই দরজা দিয়েই ভিতরে ঢোকানো হয়েছিল। গম্ভীরায় যে মহাপ্রভুর ঘরটি আমরা দেখে থাকি এটি ঠিক তার পিছনের দিক। ভিতরে একটা কিরকম গা ছমছম করা, থমথমে পরিবেশ, যেন প্রচণ্ড serious একটা পরিস্থিতির মধ্যে এসে পড়েছি। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে খুব সরু একটি passage যার এক পাশে রয়েছে একটা ধ্যানঘর। একজন মানুষ তার ভিতরে বসলে আশপাশে ও মাথার ওপর অল্প জায়গাই ফাঁকা থাকে। সামনের ছোট কাঠের দরজা বন্ধ করে দিলেই জগৎ সংসারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বাতাস চলাচলের জন্য দেওয়ালের গায়ে রয়েছে খুব সরু সরু ফাঁক। শ্রদ্ধায় মাথা আপনিই নেমে এল সুপ্রাচীন ওই তপস্যাস্থলের কাঁকুরে মেঝেতে। একের পর এক আরও কত চমক অপেক্ষা করছে তখন। দেখলাম কিছুটা দুরত্ব অন্তর অন্তর রয়েছে ছোট ছোট ধ্যানঘর। সেই সঙ্কীর্ণ passage টাই L shape এর মতো ঘুরে তিন চারটি ধ্যানকক্ষকে যুক্ত করে এসে মিশেছে একটি ঘরে। ঐ ঘরের পাশেই যে ধ্যানঘরটি রয়েছে সেটা তুলনামূলক বড় ও মাথাটা একটু চূড়া মতো করা। কে জানে, হয়ত এটাই নির্দিষ্ট করা ছিল মহাপ্রভুর জন্য। নিস্তব্ধ নিঃঝুম ঘ‍রটির সর্বত্রই যেন রয়েছে সেই রহস্যময় মানুষটির অস্তিত্ব । এই ঘরেরই দেওয়ালে, মেঝেতে প্রচণ্ড বিরহ যণ্ত্রণায় নাক মুখ ঘষে রক্তাত্ব হয়েছেন তিনি। দেওয়ালে রয়েছে আঙুলের স্পর্শ। আরও চমকে গেলাম, ওই ঘরেরই মেঝে ভেদ করে একটা ছোট চার চৌকো গর্তের মধ্যে দিয়ে নেমে গেছে একটি কাঠের সিঁড়ি। এবার যেন সত্যি সত্যিই উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। একের পর এক বিস্ময় চোখের সামনে। নেমে পড়লাম ওই সিঁড়ি দিয়ে। মাটির নীচের ওই অংশে বেশ খানিকটা জায়গা একটু চওড়া। একটা সরু ঘরের মতই বলা যায়, যেখানে পাশাপাশি বসতে পারবেন দুজন। একটা কাঠের আসন চোখে পড়লো। জানি না, হয়তো ওনারই। হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম সেটি। সেই ঘ‍রটিরও অন্য দিকটি ক্রমশ সরু হয়ে গিয়েছে। শেষ প্রান্তে দেওয়ালে পাশাপাশি লাগানো রয়েছে দুটো পাথর। মাঝখানে যেটুকু ফাঁক রয়েছে তার মধ্যে দিয়ে কোনভাবে গলে যেতে পারে একটা মানুষ। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সেটা একটা সুড়ঙ্গের মুখ। কৌতুহল, উত্তেজনা চেপে রাখা আর সম্ভব হচ্ছিল না। চেষ্টা করলাম ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে ঢুকতে। কিন্তু ঢোকার চেষ্টা করে বুঝতে পারলাম অন্য দিকটা এখন বন্ধ করা রয়েছে। ফিরে এসে একটু বসলাম ভুগর্ভের ওই রহস্যময় ঘরটিতে। সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা এক ইতিহাসের, এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি। সেই সময়কার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে যেন ঢুকে গিয়েছিলাম। পাঁচশো বছরের বিরাট ব্যবধান পার হয়ে যেন পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের মধ্যে। এই ঘোর কাটেনি আজও। যেন এক মাতালের মতই বুঁদ হয়ে, হয়তো বা একটু টলতে টলতেই ফিরে এসেছিলাম আমার ঘরে। আস্তে আস্তে মনে জমতে শুরু করলো হাজারো প্রশ্ন। কেন এইসব গুপ্তকক্ষ? কি প্রয়োজনে ব্যবহার হত সেগুলো? যা দেখে এলাম তাতে স্পষ্টই বুঝতে পারছি অন্তত পাঁচ সাতজন মানুষ ওর ভিতরে ঢুকে থাকলেও কাকপক্ষীতে টের পাওয়া সম্ভব নয়। কি হত ওখানে? কোনো গুহ্য সাধনা? এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজতে লাগলাম তারপর। আস্তে আস্তে সামনে আসতে লাগলো ইতিহাসের লুকিয়ে রাখা দিকগুলো। এক nonconventional গোপন সাধনা যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সপার্ষদ চৈতন্য মহাপ্রভু। সেই অজানা ইতিহাসের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে চৈতন্য মহাপ্রভুর রহস্যময় অন্তর্ধান ও তার পরবর্তী অধ্যায়।
- স্নেহাশিস
পারুল আশ্রম




ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়


     ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়


     ফেসবুক থেকে              শেয়ার করেছেন            প্রণব কুমার কুণ্ডু


##ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়(১৮৬১-১৯০৭)

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিককার কথা। সিমুলিয়ার বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ কৃষ্ণচন্দ্র নান তাঁর এমএ পরীক্ষার্থী পুত্র কার্তিকচন্দ্রের গৃহশিক্ষক হিসেবে পেলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক তেজী শিক্ষককে। সে যুগের রীতি অনুসারে, গৃহশিক্ষক ভবানীচরণ ছাত্রের বাড়িতে থেকেই তাকে পড়াশোনা করাতেন। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ছিন্ন হয়নি ওই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। সে দিনের সেই শিক্ষক হলেন স্বদেশি যুগের সাংবাদিক-সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। শুধু সেই ছাত্রই নয় তাঁর উত্তরপুরুষরা নিজেদের উদ্যোগে ব্রহ্মবান্ধবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন পাথরের ফলক বসিয়ে। ব্রহ্মবান্ধবের বিশাল কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়িটি।
ব্রহ্মবান্ধবের পৈত্রিক নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম হুগলি জেলার খন্যান গ্রামে ১৮৬১-র ১১ ফেব্রুয়ারি (ওই একই বছরে জন্মগ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার)। গ্রামের পাঠশালা ও হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলের পাঠ শেষ করে কলকাতার জেনারেল অ্যাসেম্বলিস ইনস্টিটিউশনে (এখনকার স্কটিশ চার্চ কলেজ) ভর্তি হয়ে সহপাঠা হিসেবে পেলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তকে। কিন্তু কলেজের গণ্ডী ভাল লাগলো না ভবানীচরণের। সৈনিক হবার বাসনায় গেলেন গ্বালিয়রে। বাড়ির লোক জানতে পেরে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে ভর্তি করে দিলেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে (এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ)।
জন্মসূত্রে হিন্দু ভবানীচরণের ধর্ম সম্পর্কে অসীম কৌতুহল ছিল। পড়াশোনার পাঠ শেষ হতে না হতে কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে ভবানীচরণ নববিধান ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন। পরে একে একে প্রোটেস্ট্যান্ট ও রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের এই দুই শাখাতেই দীক্ষিত হয়ে ধর্মপ্রচারের কাজে যুক্ত হন। নিজের দেওয়া নতুন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় নামেই পরিচিত হন তখন থেকে। ঘুরে বেড়ান সিন্ধু প্রদেশ, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে। ১৯০০-এ কলকাতায় ফিরে প্রাক্তন ছাত্র কার্তিকচন্দ্রের সহায়তায়, তাঁর ১৮ বেথুন রো-এর বাড়ি থেকে নতুন করে প্রকাশ করলেন ক্যাথলিকদের মুখপত্র ‘সোফিয়া’ পত্রিকা। সেখানে একটি সংখ্যায় ব্রহ্মবান্ধব প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ (‘World-Poet’) আখ্যা দেন। প্রকাশ করেন ‘টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি’ নামে আরও একটি পত্রিকা। ওই বাড়িতেই স্থাপন করলেন ‘আয়তন’ নামে এক গুরুকুল। ওই সময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় রবীন্দ্রনাথের, পরে তা পরিণত হয় গভীর সখ্যে।
১৯০১-এ স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাবে আবার হিন্দুধর্মে ফিরে এসে ইউরোপে যান বেদান্তধর্ম প্রচার করতে। সেখান থেকে ফিরে, তিনি গেলেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, ব্রহ্মচর্য আশ্রম গঠনের কাজে যুক্ত হতে। শান্তিনিকেতনে গিয়ে তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ অভিধায় সম্বোধিত করেন। কিছু কাল সেখানে অধ্যাপনা করার পর আবার কলকাতায় ফিরে উঠলেন বেথুন রো-এর বাড়িতেই। সেই সময়ে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সারা বঙ্গদেশ উত্তাল। শিক্ষকতা ছেড়ে দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করলেন ব্রহ্মবান্ধব।
১৯০৪ থেকে তিনি পাকাপাকিভাবেই কলকাতায়। ১৮ বেথুন রো-র বাড়ি তখন ব্রহ্মবান্ধবের কার্যালয়। ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ঠিকানা থেকে প্রকাশ হল ‘সন্ধ্যা’ নামে এক পত্রিকা। তার পর ‘করালী’। সেগুলিতে একেবার সহজবোধ্য ভাষায় দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুললেন তিনি
ব্রহ্মবান্ধব ব্রিটিশদের ‘ফিরিঙ্গি’ বলতেন। তাঁর তীব্র ফিরিঙ্গী-বিরোধী বিভিন্ন প্রবন্ধের ফলে রাজরোষে পড়ল সন্ধ্যার প্রেস ও কার্যালয়। তার পর থেকে সন্ধ্যার প্রেসের ঠিকানা পরিবর্তন হয় বেশ কয়েকবার। আস্তানা পাল্টে ব্রহ্মবান্ধবও গিয়ে উঠলেন ৮ শিবনারায়ণ দাস লেনে ‘রাজমন্দির’ বাড়ির (এখন সেটি বিদ্যাসাগর কলেজের মাঠ হিসেবে পরিচিত) মেসে। বাড়িটি ছিল স্বদেশিদের আস্তানা। কিছু কাল পরে আবার উঠলেন কার্তিকচন্দ্রের বাড়িতে। সেই শেষ। অল্প দিন পরেই ‘এখন ঠেকে গেছি প্রেমের দায়’, ‘সিডিশনের হুড়ুম দুড়ুম ফিরিঙ্গির আক্কেল গুড়ুম’ ও ‘বাছা সকল নিয়ে যাচ্ছেন শ্রীবৃন্দাবন’ প্রবন্ধ তিনটির জন্য রাজদ্রোহের মামলা আরম্ভ হল। বিচার চলাকালীন হার্নিয়া রোগে আক্রান্ত হন তিনি। বেথুন রো-এর বাড়ি থেকেই তাঁকে ভর্তি করা হল ক্যাম্পবেল হাসপাতালে (এখনকার নীলরতন সরকার হাসপাতাল)। অস্ত্রোপচারের পর ১৯০৭-এর ৭ অক্টোবর সেখানেই মারা যান তিনি।

লেখক:গৌতম বসুমল্লিক


উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


      উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


      ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন                 প্রণব কুমার কুণ্ডু


আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং ভারতীয় কংগ্রেসের প্রথম ও অষ্টম সভাপতি
উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্মঃ- ২৯ ডিসেম্বর, ১৮৪৪ - মৃত্যুঃ- ২১ জুলাই, ১৯০৬) (সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান অনুযায়ী)
১৮৬৫ সালে দাদাভাই নওরোজির সহায়তার লন্ডনে তিনি ভারতীয়দের জন্যে ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠন করেন। পরে ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থাপনে তিনি তাঁর বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাহায্য করেন। এটি ছিল ভারতবর্ষের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫) প্রতিষ্ঠায়ও তিনি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এর প্রথম এবং অষ্টম সভাপতি মনোনীত হন। তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক কাউন্সিলেরও সদস্য ছিলেন ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত। রাজনীতিতে দারুণ উৎসাহী ছিলেন বলে ১৮৯৮ সালে তিনি লিবারেল দলের প্রার্থী হিসেবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন।
উমেশচন্দ্র ছিলেন উদারনৈতিক এবং স্ত্রীশিক্ষার উৎসাহী সমর্থক। সেজন্যে তিনি বিলেত থেকে ফিরেই তাঁর স্ত্রী হেমাঙ্গিনীকে আধুনিক শিক্ষা দিয়ে তাঁকে আধুনিকা করে তোলেন। তিন সন্তান সহ তাঁকে তিনি বিলেতে পাঠান ১৮৭৪ সালের প্রথম দিকে। ১৮৮৮ সালে উমেশচন্দ্র লন্ডনের দক্ষিণ শহরতলীতে একটি বাড়ি কেনার পর হেমাঙ্গিনী তাঁর সন্তানদের নিয়ে স্থায়ীভাবে লন্ডনে বাস করতে থাকেন। এই বাড়িটি কার্যত প্রবাসী ভারতীয়দের রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়। উমেশচন্দ্রের পুত্র এবং কন্যারা অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।
জন্ম
তাঁর জন্ম কলকাতার খিদিরপুরে। তাদের আদি নিবাস ছিল বাগাণ্ডা, হুগলি। তাঁর পিতা গিরীশ চন্দ্র অ্যাটর্নি ছিলেন। উমেশচন্দ্র ১৮৬৪ সালে রুস্তমজী জামশেদজী জিজিবাই বৃত্তি পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে আইন অধ্যয়ন করতে যান। ১৮৬৭ সালের জুন মাসে তিনি ব্যারিস্টার হন এবং তার প্রায় দেড় বছর পরে কলকাতায় ফিরে ১৮৬৮ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা হাইকোর্টে আইন-ব্যবসা আরম্ভ করেন। কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর উমেশচন্দ্র ১৯০২ সাল থেকে স্থায়ীভাবে লন্ডনে বাস করেন এবং ১৯০৬ সালে ওখানেই মারা যান।
……………