বৃহস্পতিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৮

হিন্দু সংবাদ


     হিন্দু সংবাদ

     ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন          প্রণব কুমার কুণ্ডু



Rupok Roy


এই নির্বোধ মহিলা যদি জানতো যে মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে অতীতে কী আচরণ করেছে, তাহলে সে নিশ্চয় এই মূর্খামি করতো না। বাঙ্গালি মুসলমানরা হিন্দুদের প্রতি যে অত্যাচার করেছে, তার কিছু ইতিহাস আজ তুলে ধরলাম, বাকিটা পাবেন দ্বিতীয় পর্বে-
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে ১ মাসে ৫০ লক্ষ হিন্দু বিতাড়নের নৃশংস ইতিহাস- ১ :

মুসলমানদের দ্বারা লিপিবদ্ধ ইতিহাসে বাংলাদেশ তথা পর্ববঙ্গের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে।

কিন্তু ১৯৪৭ এর পর থেকে '৫২ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে কী ঘটনা ঘটলো, কেনো এই ৫ বছরে পূর্ববঙ্গের হিন্দু ২৯% থেকে ২২% এ নেমে এলো, তার ইতিহাস আপনি কোথাও পাবেন না। কোনো মুসলমান, সেই ইতিহাস লিখবে না; কেননা, তাহলে তো আয়নায় নিজের মুখ দেখা হয়ে যায়। কিন্তু হিন্দুদের সেই ইতিহাস জানা দরকার। তাই অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে তুলে এনেছি সেই সব কাহিনী; যা জানলে আপনার গা শিউরে উঠবে, বুঝতে পারবেন আপনার প্রতিবেশী মুসলমানদের প্রকৃত চরিত্র। ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিলো সেই সব ঘটনা। কিন্তু শুরু করছি শুরু থেকেই....

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবী উত্থাপনের পর ১৯৪৬ সালের ১৬ থেকে ১৯ আগস্ট, মুসলমানরা পাকিস্তান আদায়ের জন্য কোলকাতায় ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে পালন ক'রে প্রায় ২০ হাজার অসহায় নিরস্ত্র হিন্দুকে হত্যা করে, হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগ-ভাংচুর-লুঠপাট করে এবং অসংখ্য হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করে; হিন্দুদেরকে প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে বা প্রাণে বাঁচানোর লোভ দিয়ে ধর্মান্তরেরও চেষ্টা করে।
এরপর মুসলমানদের আক্রমণ শুরু হয় বৃহত্তর নোয়াখালিতে, সেখানে নৃশংসভাবে খুন করা হয় প্রায় ১ হাজার হিন্দুকে, ধর্ষণ করা হয় ১২ থেকে ৪২ এর প্রায় সব হিন্দু মেয়েকে, জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা হয় প্রায় সবাইকে। নানামুখী চাপে পড়ে অবশেষে জন্মভিটা থেকে বিতাড়িত হয় প্রায় বেশির ভাগ হিন্দু।
হিন্দুদের এই রক্তপাতের উপর দেশ ভাগ হলো, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে প্রাণ গেলো প্রায় ২০ লাখ হিন্দু ও শিখের, ধর্ষিতা হলো প্রায় ১ লক্ষ মেয়ে, উদ্বাস্তু হলো কয়েক কোটি হিন্দু ও শিখ। কিন্তু এত কিছু করে এবং দেশ পেয়েও মুসলমানরা খুশি হলো না। তাদের আরও চাই, চাই বাকি হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, জমি-জমা সব কিছু। এজন্য হিন্দুদেরকে মারতে হবে, কাটতে হবে, মেয়েদেরকে ধর্ষণ করতে হবে, তাদেরকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে; পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের সংখ্যা যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে এনে ওদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে হবে।
উপরের এই পরিকল্পনা থেকেই শুরু হয়েছিলো ১৯৫০ এর হিন্দু বিতাড়ন। অনেকেই এটাকে বলে ১৯৫০ এর দাঙ্গা। কিন্ত তারা ভুলে যায় দাঙ্গা মানে দুই দলের মারামারি। এই ধরণের দাঙ্গা বাংলায় কখনো হয় নি। এখানে যা হয়েছে তা সবসময়ই হিন্দু নির্যাতন। এর কারণ, ১৯৪৬ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের হিন্দুরা শুধু মুসলমানদের হাতে মারই খেয়েছে, একজন মুসলমানকেও হিন্দুদের হাতে প্রাণ দিতে হয় নি বা মার খেতে হয় নি। তাই কোন যুক্তিতেই এই হিংসাগুলোকে দাঙ্গা বলা যায় না ? প্রকৃতপক্ষে এসব ঘটনাকে দাঙ্গা নাম দিয়ে মুসলমানদের অত্যাচার নির্যাতনকে কিছুটা যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করা হয় মাত্র। ব্যাপারটা এমন, ওরাও মেরেছে, আমরাও মেরেছি, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বাংলায় কখনো হিন্দু মুসলমান মারামারি হয় নি, মুসলমানরা সবসময়ই মেরেছে আর হিন্দুরা মার খেয়েছে।
অসহিষ্ণুতা শুরু হয়েছিলো ১৯৪৬ সাল থেকেই, আর এই অসহিষ্ণুতার বলি হয়েছিলো বৃহত্তর নোয়াখালি, কুমিল্লা ও ঢাকার হিন্দুরা। পরবর্তী হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাগুলো '৪৬ এর অসহিষ্ণুতারই সম্প্রসারিত রূপ মাত্র। অনেকেই ভেবেছিলো দেশ ভাগ হয়ে গেলে, মুসলমানরা নিজেদের একটি দেশ পেলে, এই সমস্যাগুলো এমনিই মিটে যাবে। কিন্তু যারা এটা ভাবতো, তাদের, মুসলমানদের মানসিকতা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না। তাদের এই অজ্ঞানতার করণেই, বার বার, বাংলার হিন্দুদের হতে হয়েছে মুসলমানদের আক্রমনের শিকার এবং এখনও হতে হচ্ছে।
১৯৪৬ সালে, কোলকাতা ও নোয়াখালির পর, আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটানো হয় এই ১৯৫০ সালে।'৪৬ এর ঘটনা, ঘটানোর জন্য যেমন ১৯৪০ সাল থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিলো এবং ক্ষেত্র প্রস্তত করা হচ্ছিলো, ঠিক তেমনি, '৫০ সালের ঘটনা ঘটানোর জন্যও ১৯৪৮ সাল থেকে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে ঘটে নিচের এই ঘটনাটি :
বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার দীঘারকুল গ্রাম। একজন হিন্দু নদীতে মাছ ধরছিলো। সেই সময়, সেখানেই আর একজন মুসলমান নৌকা বেয়ে এসে তার সামনেই জাল ফেলার প্রস্তুতি নেয়। এতে হিন্দুটি মুসলমানটাকে বাধা দেয় এবং তার মাছ ধরার স্থানে জাল ফেলতে নিষেধ করে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এতে এক আল্লা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করা মুসলমানটি মনে করে তার জেদ বজায় থাকছে না এবং এক হিন্দুর কাছে তার মাথা নত হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিকটবর্তী মুসলমান গ্রামে গিয়ে ঐ মুসলমানটি রটিয়ে দেয় যে, হিন্দুরা, তার নৌকায় থাকা এক মুসলমান মহিলাকে আক্রমণ করে অসম্মান করেছে। ঐ সময় গোপালগঞ্জের এস.ডি.ও, নৌকাযোগে ওখান দিয়েই যাচ্ছিলো, এই অভিযোগটি তার কানেও যায় এবং সে কোনো রূপ তদন্ত না করে মুসলমান ব্যক্তির ঐ অভিযোগটিকে সত্য বলে ধরে নেয় এবং হিন্দুদেরকে শায়েস্তা করার জন্য ওখানে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পাঠায়। পুলিশ এলে স্থানীয় মুসলমানরাও পুলিশের সাথে যোগ দিয়ে হিন্দুদের বাড়ী ঘরে হামলা করে এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে নির্মমভাবে প্রহার করার পর বাড়ীর সব মূল্যবান দ্রব্য লুট করে নিয়ে যায়। এই নির্মম প্রহারের ফলে ঘটনাস্থলেই এক গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় হিন্দুদের উপর মুসলমানদের এই পৈশাচিক অত্যাচার বিশাল এলাকা জুড়ে হিন্দুদের মনে ভয়ংকর ত্রাস ও ভীতির সঞ্চার করে।
এর পরের ঘটনাটি ঘটে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানায়। এখানকার ইউনিয়ন বোর্ডে, হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটি সমস্যা হয়। এর মধ্যে কিছু হিন্দু ছিলো কমিউনিস্ট সমর্থক, যে কমিউনিস্টরা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষেই ছিলো। কিন্তু কমিউনিজম তো ইসলাম তথা মুসলমানদের চিরশত্রু, তাই পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই শুরু হয়েছিলো পূর্ববঙ্গ থেকে কমিউনিস্টদের বিতাড়ন। মুসলমানদের এই তাড়া খেয়েই পূর্ববঙ্গের সব হিন্দু কমিউনিস্ট পশ্চিমবঙ্গে হিজরত করে এবং পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয় বামেদের রমরমা।
যা হোক, ওখানে হিন্দুদেরকে শায়েস্তা করার জন্য এই কমিউনিস্ট সূত্রকেই কাজে লাগানো হয়। গৌরনদী থানার উপর কমিউনিস্টরা আক্রমন করতে পারে এই গুজব ছড়িয়ে চারেদিকে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয় এবং বরিশাল সদর থেকে গৌরনদী থানায় সশস্ত্র বাহিনী পাঠানো হয়। তারা ঐ অঞ্চলের বহু হিন্দু বাড়ী লুঠ করে মূল্যবান জিনিস পত্র নিয়ে চলে যায়। এমনকি যেসব বাড়ির মালিক কমিউনিস্ট হওয়া তো দূরের কথা, রাজনীতিও করে না, এমনকি বাড়িতেও থাকে না, সে সব বাড়িও আক্রমন করে লুঠ করা হয়। এছাড়াও ঐ অঞ্চলের বহু হিন্দুকে গ্রেফতার করা হয় এবং স্কুল কলেজের বহু হিন্দু ছাত্র-শিক্ষককেও কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে অযথাই হয়রানি করা হয়। এ ব্যাপারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে লিখিত আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পান নি।
এরপর বৃহত্তর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমায় আর একটি ঘটনা ঘটানো হয়। তুচ্ছ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মুসলমান ও পুলিশ মিলে হিন্দুদের বাড়ী-ঘরে হামলা করে মূল্যবান জিনিসপত্র লুঠ করে নিয়ে যায় এবং এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার নামে মিলিটারী চৌকি বসানো হয়। এই মিলিটারি চৌকিতে খাবার সরবরাহ করতে বাধ্য করা হয় এলাকার হিন্দুদের; শুধু তাই নয়, রাতের বেলা হিন্দু মেয়েদেরকেও ক্যাম্পে পাঠাতে বাধ্য করতো মিলিটারীরা।
এরপর ঘটে রাজশাহী জেলার নাচোলের ইলা মিত্রের সেই বিখ্যাত ঘটনা। যেখানে কমিউনিস্টি দমনের নাম পুলিশের সাথে স্থানীয় মুসলমানরা মিলে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করে এবং তাদের সম্পত্তি লুঠ করে। এরপর ওখানকার সাঁওতালরা সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়।
১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বর, খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার মোল্লারহাট থানার কালশিরা গ্রামে মুসলমানরা ঘটায় আর একটি ভয়ংকর ঘটনা। কালশিরা থেকে তিন মাইল দূরে ঝালরডাঙ্গা গ্রামে, কমিউনিস্টদের খুঁজে বের করার জন্য পুলিশ এক অভিযান চালায়। ফলে এই গ্রাম থেকে কিছু যুবক পালিয়ে গিয়ে কালশিরা গ্রামে জনৈক জয়দেব ব্রহ্মের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। শেষরাতে পুলিশ জয়দেবের বাড়িতেও হানা দেয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে যুবকরা আবার পালিয়ে যায়। পুলিশ কাউকে না পেয়ে জয়দেবের স্ত্রীকে মারতে শুরু করে। জয়দেবের স্ত্রীর চিৎকার শুনে ঐ যুবকরা আবার বাড়ি ফিরে আসে এবং উল্টো পুলিশকেই মার দিতে শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলেই এক পুলিশ মারা যায় এবং অন্যরা আহত হয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ খুন হওয়ায় জয়দেব এবং তার কিছু প্রতিবেশি ঘটনা আঁচ করতে পেরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং অন্য সাধারণ গ্রামবাসী, যারা নিজেদেরকে নির্দোষ মনে করেছিলো, তারা গ্রামেই রয়ে যায়। পরদিন বিকালে খুলনার পুলিশ সুপার একদল সৈন্য এবং সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে ঐ গ্রামে যায় এবং সবাই মিলে গ্রামের হিন্দুদের পাইকারিদরে প্রহার করা শুরু করে এবং প্রতিবেশি মুসলমানদেরকে হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠ করে নিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। এতে লুঠ হয় হিন্দুদের সম্পত্তি, মারা যায় বেশ কয়েক জন হিন্দু, অনেক নারী ও পুরুষকে জোর করে মুসলমান বানানো হয়, মন্দিরের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং নানা উপায়ে মন্দিরকে অপবিত্র করা হয়। পুলিশ মিলিটারী এবং স্থানীয় মুসলমানরা অনেক হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করে।
১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, এই গ্রামটি পরিদর্শনে যান, পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। তিনি গিয়ে দেখেন, গ্রামটি জনশুন্য ও বিধ্বস্ত; ৩৫০টি বাড়ির মধ্যে মাত্র ৩টি বাড়ি অক্ষত অবস্থায় আছে, বাকি সব বাড়ি গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হিন্দুদের নৌকা, গরু-ছাগল সব লুঠ করে নেওয়া হয়েছে। কালশিরার এই সব অত্যাচারিত, গৃহহীন হিন্দুরা এক দিনে পথের ভিখিরিতে পরিণত হয়ে কোলকাতায় পালিয়ে আসে এবং অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হয় এবং তাদের এইসব কাহিনী সংবাদপত্রে প্রকাশ হলে পশ্চিমঙ্গেও কিছু সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই সাম্প্রাদায়িক উত্তেজনার খবর পূর্ববঙ্গের পত্রিকাগুলিতে অতিরঞ্জিত করে ছাপানো হয়, যদিও পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর পুলিশ-মুসলমানের যৌথ আক্রমনের সময় পত্রিকাগুলো চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো।
কালশিরা ও নাচোলের ঘটনার জন্য পূর্ববঙ্গ বিধানসভার হিন্দু বিধায়করা সংসদে একটি প্রস্তাব এনে আলোচনা করতে চান, কিন্তু সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়া হয়, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হিন্দু বিধায়করা সংসদ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে। হিন্দু সাংসদদের এই ওয়াক আউটে, মুসলিম লীগ সরকার বেশ ভালো রকম রুষ্ট হয় এবং ১৯৪৬ সালের পর হিন্দুদেরকে আরেকবার শায়েস্তা করার জন্য প্ল্যান তৈরি করে ফেলে। কোলকাতার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে পূর্বববেঙ্গর পত্রিকাগুলোর অপপ্রচার এবং উস্কানি তো ছিলোই, এর সাথে ১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ঘটানো হয় আরেক ঘটনা; যা মুসলমানদেরকে, হিন্দুদের আক্রমন করতে উস্কানি দেয়; ঘটনাটি এরকম:
একজন মহিলার কাপড়ে লাল রং মাখিয়ে তাকে ঢাকার সচিবালয়ে ঘোরানো হয় এবং প্রচার করা হয় যে, ঐ মহিলার দুটি স্তন কোলকাতার হিন্দুরা কেটে নিয়েছে। এই প্রচারণায় বিশ্বাস করে সচিবালয়ের সমস্ত মুসলিম কর্মচারী কাজ ফেলে হিন্দুদের উপর বদলা নেওয়ার জন্য শ্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। অথচ নির্বোধ মুসলমানরা এটা চিন্তা করে দেখলো না, কোলকাতায় কারো স্তন কেটে নিলে তার পক্ষে সুস্থ ভাবে ঢাকায় এসে হাঁটা সম্ভব নয় এবং তা থেকে তাজা রক্ত ঝরাও সম্ভব নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার এত উন্নতির পরে কোলকাতা-ঢাকার বাস দূরত্ব প্রায় ৮ঘন্টার; ১৯৫০ এ এটা ছিলো প্রায় ২৪ ঘন্টার। তাহলে কোলকাতায় স্তন কেটে নিলে কিভাবে কারো স্তন থেকে ২৪ ঘন্টা পরও তাজা রক্ত ঝরে ? কিন্তু কথায় আছে, দূরাত্মার ছলের অভাব হয় না। মুসলমানদেরও হয় নি, সচিবালয় থেকে শুরু হওয়া হিন্দু বিরোধী মিছিল বড় হতে হতে প্রায় ১ মাইল দীর্ঘ হয় এবং তা ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে দুপুর ১২টায় একটি বিশাল জনসভায় রূপ নেয়। ঐ জনসভায় মুসলিম লীগের নেতারা হিন্দু বিরোধী বক্তব্য দিয়ে উপস্থিত মুসলমানদেরকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আরো ক্ষেপিয়ে তুলে এবং জনসভা শেষ হতে না হতেই পুরো ঢাকা শহরে হিন্দুদের উপর আক্রমন শুরু হয়ে যায়।
শহরের সবখানেই হিন্দুদের ঘর-বাড়ি ও দোকানে অগ্নি সংযাগ ও লুঠপাট শুরু হলো। যে যেখানে পেলো, সেখানেই হিন্দুদেরকে খুন করতে লাগলো। উচ্চপদস্থসহ সকল পুলিশ কর্মকর্তারা এই লুটতরাজ, খুন, অগ্নিসংযোগকে শুধু নীরব দর্শকের মতোই দেখলো না, তারা দাঙ্গাকারীদেরকে বুদ্ধি দিয়ে, কৌশল শিখিয়ে এইসব কাজে মুসলমানদেরকে আরও উৎসাহ দিতে লাগলো।
পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এই দিন করাচী থেকে ঢাকায় পৌঁছেন এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে হিন্দুদেরকে রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু তার কথায় কোনো কর্ণপাত করা হয় নি। উল্টো হিন্দু নির্যাতন চলতেই থাকে। এই সময় সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, "ঢাকায় ৯ দিন অবস্থানকালে আমি ঢাকা ও তার পার্শ্ববতী এলাকার প্রায় সব দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করি। ঢাকা-নারায়নগঞ্জ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে শত শত নিরপরাধ হিন্দুর হত্যালীলার সংবাদ আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করে।"
ইসলামের জিহাদ সবসময়ই একটি লাভজনক ব্যাপার। কারণ, এর সাথে গনিমতের মাল অর্থাৎ লুঠের সম্পত্তির বিষয়টি জড়িত। ঢাকায় যখন হিন্দুদের উপর এসব হত্যালীলা, অগ্নি সংযোগ ও তাদের ধন-সম্পত্তি লুঠ চলছে এবং এভাবে ঢাকার মুসলমানরা লাভবান হচ্ছে, তখন বরিশালের মুসলমানরা এই লাভ থেকে পিছিয়ে থাকবে কেনো ? তাই বরিশালেও ঘটানো হয় আরেক ঘটনা। সেই সময় মুসলিম লীগের আরেক নেতা এবং পাকিস্তান আদায়ের এক বলিষ্ঠ নায়ক এ. কে. ফজলুল হক, কোলকাতায় তার ঝাউতলা রোডের বাড়ি বিক্রি করার জন্য কোলকাতায় অবস্থান করছিলো। হিন্দুদের উপর মার এবং লুঠপাট তো শুরু করতে হবে, কিন্তু এর জন্য তো একটা ইস্যু দরকার। বরিশাল শহরে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হলো যে, কোলকাতায় হক সাহেবকে হিন্দুরা খুন করে ফেলেছে। রং মাখানো কাপড়কে যে মুসলমানরা স্তন কাটা রক্ত ধরে নিয়ে ঢাকা এবং তার আশে পাশের শহরে হাজার হাজার হিন্দুকে খুন করতে পারে, তাদের সম্পত্তি লুঠ করতে পারে, বাড়ি-ঘর দোকানে আগুন দিতে পারে, মেয়েদের ধর্ষণ করতে পারে, সেই মুসলমানদের কাছে হক সাহেব বেঁচে আছে, না সত্যিই মারা গেছে, তার সঠিক তথ্যের তো কোনো দরকার নাই। তাই শুরু হয়ে গেলো বর্তমানের বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালি ও পিরোজপুর, বরগুনা জেলায় খুন-ধর্ষণ- অগ্নি সংযোগ এবং এর সাথে লুঠপাট। এই চার জেলায় খুন করা হলো প্রায় ৭ হাজার হিন্দুকে। এর সাথে ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুঠপাটের বিষয়টি কল্পনা করে নিন।
ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে হত্যা-ধর্ষণ-লুঠ-অগ্নিসংযোগ আগে থেকেই চলছিলো, বরিশালের সাথে সাথে তা আবারও সম্প্রসারিত হয় কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালি,সিলেট, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর জেলায়। এই সবগুলো জেলা মিলিয়ে ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারি মাসেই খুন করা হয় প্রায় ৫০ হাজার হিন্দুকে। আবারও অনুরোধ করবো, এর সাথে ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ-লুঠপাট এবং ধর্মান্তরের চেষ্টাকে কল্পনা করে নিতে।
বরিশাল শহরের এরকম পরিস্থিতির খবর পেয়ে বাড়ি বিক্রি করা বন্ধ রেখে ফজলুল হক, তড়ি ঘড়ি করে বরিশাল ফিরে এবং শহরে ও তার আশে পাশে ১৬ টি জায়গায় জনসভা করে বলে, "তোমরা দেইখ্যা যাও, আমি মরি নাই। কিন্তু তোমরা এইটা কী করলা ?" কিন্তু কে শোনে কার কথা ? জিহাদের সময় মুসলমানদের কাছে কোরান পোড়ানোও ফরজ। এটা আমি বলছি না, ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় কোরান পোড়ানোর সময় এই যুক্তিই দিয়েছিলো। তাই ঐ সময় ফজলুল হকের কথা শুনে এ্যাকশন বন্ধ করার চেয়ে হিন্দুদের মেরে লুঠের মাল হস্তগত করা ছিলো নীতিহীন মুসলমানদের কাছে বেশি জরুরী। এজন্য ফজলুল হক স্বশরীরে বরিশালে উপস্থিত হয়েও হিন্দুদেরকে হত্যা করা থেকে মুসলমানদেরকে নিরস্ত করতে পারে নি। যদিও এই সময় হিন্দু হত্যা বন্ধে তার ফজলুল হকের সদিচ্ছা ছিলো, এজন্য সে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, হক ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির একজন একনিষ্ঠ সমর্থক, যে পাকিস্তানের জন্যই হিন্দুদের এত রক্ত ঝরিয়েছিলো মুসলমানরা। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ফজলুল হকই প্রথম পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী তোলে; ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর, সে ছিলো একজন নীরব সমর্থক এবং ১৯৪৬ সালে নোয়াখালির ঘটনায় যে দু' চারজন মুসলমানকে এ্যারেস্ট করা হয়েছিলো, ফজলুল হক তাদেরকে ছেড়ে দেবার জন্য সুপারিশ করেছিলো।
যা হোক, বরিশালের এই সংবাদ পেয়ে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ঢাকা থেকে বরিশাল যান। সেখানাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, "ইং ২০ ফেব্রুয়ারি, (১৯৫০) আমি বরিশাল পৌঁছলাম এবং সেখানকার দাঙ্গার ঘটনাবলী শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই জেলার শহরে প্রচুর হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক হিন্দুকে খুন করা হয়েছে। এই জেলার প্রত্যেকটা দাঙ্গা-বিধস্ত এলাকা আমি পরিদর্শন করি। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না, কী করে জেলা শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল পরিধির মধ্যে মোটর রাস্তা দ্বারা কাশীপুর মাধব পাশা এবং লাখুটিয়ার মতো স্থানেও মুসলিম দাঙ্গাবাজরা বিভৎস তাণ্ডব সৃষ্টি করতে পারে। মাধব পাশার জমিদার বাড়িতে প্রায় ২০০ জনকে হত্যা ও ৪০ জনকে আহত করা হয়। মুলাদী নামক একটি স্থানে নরকের বিভীষিকা নামিয়ে আনা হয়। একমাত্র মুলাদীতেই ৩০০ জনের বেশি লোককে খুন করা হয়েছে। মুলাদী গ্রাম পরিদর্শন কালে আমি স্থানে স্থানে মৃত ব্যাক্তিদের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। দেখলাম নদীর ধারে কুকুর-শকুনেরা মৃতদেহগুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমি জানতে পারলাম, সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে পাইকারি হারে খুন করার পর- সব যুবতী নারীকে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়েছে। রাজাপুর থানার অন্তর্গত কৈবর্তখালি গ্রামে ৬৩ জনকে একদিনে হত্যা করা হয়। ঐ থানা অফিসের কাছেই অবস্থিত হিন্দু বাড়িগুলি লুট করে জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে কেটে ফেলা হয়। বাবুগঞ্জ বাজারের সমস্ত হিন্দুর দোকান প্রথমে লুঠ করে পরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিস্তারিত বিবরণ যা এসেছে, তা থেকে খুব কম করে ধরলেও একমাত্র বরিশাল জেলাতেই খুন করা হয়েছে ১০ হাজার হিন্দুকে। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের দাঙ্গার বলির সংখ্যা মোট ৫০ হাজারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে। গভীর দুঃখে আমি কাতর হয়ে পড়লাম। প্রিয়-পরিজন হারানো, স্বজন হারানো নারী-পুরুষ ও শিশুদের সব হারানো কান্না-বেদনা-বিলাপে আমার ভগ্ন হৃদয় হাহাকার করে উঠলো। আমি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, "ইসলামের নামে কী আসছে পাকিস্তানে ?"
1950 এর সিলেট গনহত্যা ও লুটপাট :
সিলেটে অসহায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর চালানো বর্বর হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের বীভৎসতা এক দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করে 1950 সালে। ২০৩ টি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলে মুসলিমরা এবং ৮০০ টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ফেলে তারা। ধামাই, বারাধামি, পুবঘাট, বরইতলি গ্রামের ৫০০টি মনিপুরী পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিমদের আক্রমণের ফলে।
সিলেটে যখন গণভোট হয় তখন থেকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হয় যে, হিন্দুরা যেহেতু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে তাই তারা পাকিস্তানের শত্রু। ১৯৫০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাজ্ঞে ট্রাইব্যুনাল (Bagge Tribunal) রায় ঘোষণা করে। সিলেটের মুসলিমরা আশা করেছিল আসামের করিমগঞ্জ পাকিস্তানের অংশ হবে কিন্তু তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিলেট বার এ্যাসোসিয়েশনের কিছু আইনজীবী এবং করিমগঞ্জের কিছু মুক্তার হুমকি দেয় সেখানে তারা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। ১৯৫০ এর ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে মুসলিমরা সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বন্দর বাজারে সুবিশাল একটি পোস্টার টানায়। লাঠি এবং অস্ত্র হাতে হিন্দুরা একজন মুসলিমের গলায় রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটি ছবি ওই পোস্টারে আঁকা ছিল যার শিরোনাম ছিল হিন্দুস্থানের মুসলমানদের উপর হিন্দুদের নির্যাতন। লামডিং (আসামের একটি শহর) এবং কোলকাতায় মুসলিমদের রক্তের নদী প্রবাহিত হচ্ছে-এমন গুজব ছড়ানো হয়। স্থানীয় মুসলিমরা খুব আগ্রহ সহকারে এই পোস্টার দেখত এবং কিছু অতি উৎসাহী এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে বলে শপথ নেয়। ১১ ফেব্রুয়ারিতে গোবিন্দ পার্কে আয়োজিত র্যা্লিতে হিন্দুর রক্তের জন্য হুঙ্কার ছাড়ে মুসলিমরা। এর মাঝেই গুজব ছড়ানো হয় কোলকাতায় এ কে ফজলুল হককে হত্যা করা হয়েছে। ফলে সিলেটের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকায় পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব বাংলার মুখ্য সচিবদের নেয়া যৌথ সিদ্ধান্ত অনুসারে, সিলেটে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এর মাঝেই পৃথ্বীশ দাস নামে একজন হিন্দু যুবককে জিন্দাবাজারে ছুরি দিয়ে কোপানো হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি, গুজব ছড়ানো হয় আসামের করিমগঞ্জে মুসলিমদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। আইনজীবীদের একটি সমাবেশে সিলেটের ডেপুটি কমিশনার তার অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, করিমগঞ্জে ৫,০০০ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেখানকার বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী সিলেটে আশ্রয়ের জন্য এসেছে। সেদিনই সন্ধ্যায় মতি দাস নামক একজন বাঙ্গালী হিন্দুকে জালালপুরের কাছে হত্যা করা হয়। তিনজন মনিপুরীকে কোপানো হয়, যাদের মধ্যে দুজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
১৯৫০ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকাল বেলায় লামাবাজার নামক বিপণীকেন্দ্র মুসলিমরা লুট করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা থেকেই গ্রামাঞ্চলে লুটপাট এবং হত্যা শুরু হয়। সকাল ন টায় মূর্তি নামক গ্রামে আক্রমণ হয়। শত শত মুসলিম হিন্দুবিদ্বেষী স্লোগান সহকারে সেনাপতি পরিবারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। পরিবারের সদস্যদেরকে পিটিয়ে বাড়ি ঘর লুট করে মুসলিমরা। উপাসনালয়ের পবিত্র ছবি ও মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং পরিবারের সকল সদস্যদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। এরপর মুসলিমরা আজমতপুর, দাসপাড়া, নাসিয়াঞ্জি এবং মহেশপুর গ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। পরবর্তী দিনে মুসলিমরা পুনারায় মূর্তি গ্রামে যায় এবং সেনাপতি পরিবারের কাছ থেকে জোরপূর্বক একটি লিখিত বিবৃতি আদায় করে যেখানে লেখা ছিল সেনপাতি পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। রাত ৮ টায় সিলেট থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে নওগ্রামের গুরুচরণ ধরের পরিবারের উপর আক্রমণ করা হয়। পরের দিন সকাল ৭ টায় ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুসলিমরা গ্রামটি ঘিরে ফেলে। কমপক্ষে ১,৫০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। মুসলিমরা সম্পূর্ণ গ্রাম ধরে লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ করে এবং সকল পারিবারিক মন্দির, উপাসনালয় ও পবিত্র তুলসীমঞ্চ গুলো ধ্বংস করে ফেলে। পাশের গ্রাম মন্মথপুরের মহেন্দ্র চন্দ্র দে, কামাকান্ত ধর, অশ্বিনী কুমার দে' র বাড়ি সহ সকল হিন্দুর বাড়ি-ঘর লুট করে তারা। তারা অশ্বিনী কুমার দে’র এক কন্যা কে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরের দিন ধর্ষিত, বিকৃত, জ্ঞানশূন্য অবস্থায় হতভাগ্য মেয়েটির দেহ বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মুসলিমরা ঢাকাদক্ষিনের ভরত দত্তের দুজন অবিবাহিত কন্যাকে ধর্ষণ করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলায় চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়। তাদের পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে, পুলিশ তাদেরকে আদালতের বাইরে কেস মিমাংসার জন্য ১,০০০ রূপী দিতে বলে। সিলেট সদর পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় সব গ্রামেই অসংখ্য মেয়েকে এভাবে ধর্ষণ করে মুসলিমরা।
১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে গঙ্গাজল গ্রামের দীনেন্দ্র চন্দ্র দেব পুরকায়স্থের বাড়ি লুট হয় এবং মুসলিম দুষ্কৃতকারীরা তা দখল করে নেয়। সকাল ৯ টায় বাহুবল (পূর্বে করিমগঞ্জের একটি সাব-ডিভিশন ছিল) পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন সিলানি গ্রামে আক্রমণ চালানো হয়। সেখানে হিন্দু বিদ্বেষী স্লোগান দেয়া হয় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনেক হিন্দু প্রাণ বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেয় এবং যারা পালাতে পারেনি তাদেরকে ধর্মান্তরিত করা হয়। আর যারা ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করে তাদেরকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকাদক্ষিন এবং কাচুয়ারি থেকে অনেক প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েদেরকে জোরপূর্বক অপহরণ করে মুসলিমরা। হবিগঞ্জ সাব-ডিভিশনের চুনারঘাট পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার কেতন দাস,অশ্বিনী নাথ, বীরেন্দ্র নাথ সহ নাম না জানা আরও অনেক হিন্দু পরিবারের সকল সদস্যদেরকে ঘৃণ্য উপায়ে ধর্মান্তর করে মুসলিমরা। ফেঞ্জুগঞ্জের একটি স্টিমার কোম্পানি লুট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ইলাসপুরে পুলিন দে নামক একজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। ফেঞ্জুগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত মাজিগাঁও এলাকার অম্বিকা কবিরাজ ও মাখন সেনের নিবাস লুট করে পুড়িয়ে দেয় মুসলিমরা। বালাগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত রুকানপুর গ্রামের দিগেন্দ্র সেন, গোপেশ সেন এবং শিব চরণ দাসের বসত বাড়ি লুট করা হয় এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা নির্মম প্রহারের শিকার হয়। মাধুরাই এবং কাঁঠালখই এলাকার হিন্দুদেরকেও প্রহার করা হয় এবং তারা জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের শিকার হয়। গোলাপগঞ্জ পুলিশস্টেশনের ফুলসাইন গ্রামের বৈকুণ্ঠ রায় এবং রাসবিহারী রায়ের বাড়িও লুট হয়। বিশ্বনাথ পুলিশ স্টেশনের দণ্ডপাণিপুরের হিন্দুরাও ভয়ঙ্কর লুটপাটের শিকার হয়। হিন্দুদেরকে জোরপুর্বক গরু জবাই করে তাদেরকে সেটির মাংস খাওয়ানো হয়, জোর করে আর সবাইকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। টুকেরকান্দি গ্রামের ঘোষ বাড়ি লুট করে মুসলিমরা। যোগেন্দ্র ঘোষকে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করা হয় এবং অনেক হিন্দুকে কুপিয়ে আহত করা হয়। সিজেরকাছ নামক এলাকার পাল, চৌধুরী সহ সকল ব্রাহ্মণ বাড়ি-ঘর লুটপাট করা হয় এবং সবাইকে ধর্মান্তরিত করা হয়। বিমল স্মৃতিতীর্থ নামে একজন সজ্জন হিন্দু পণ্ডিত ইসলাম গ্রহন করতে অস্বীকার করেন। তার পবিত্র পৈতা ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে উপর্যুপরি কোপানো হয়। ব্রাহ্মণদের মাথায় রাখা শিখা বা চুলের টিকি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং উপাসনার মন্দির ও মূর্তি গুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে মুসলিমদের ৩০০ জনের একটি দল আখরা নামের গ্রামে আক্রমন করে। গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত পালিয়ে গেলে তারা সকল ছবি ও মূর্তি ধ্বংস করে। এরপর তারা হরিপদ চৌধুরী ও বিমল ভট্টাচার্যের বসত বাড়ি সহ পুরো গ্রামের সব হিন্দু বাড়ি ঘর লুট করে। ১৭ ফেব্রুয়ারিতে মুসলিম গুণ্ডারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দুদেরকে আক্রমন করে। তারা ব্রাহ্মণদের পৈতা টেনে ছিঁড়ে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয় এবং জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে। সুনাইতা এবং কুর্মা গ্রামের হিন্দু মহিলাদের উপরও চালানো হয় বীভৎস নির্যাতন। তাদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয়া হয় এবং হাতের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলা হয়। রাজগঞ্জ আখরা গ্রামের নীর ভট্ট এবং রাম চন্দ্র ভট্টের বাড়ি লুট করে মুসলিমরা। ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে ৫০০ থেকে ৬০০ মুসলিমের একটি দল ছাতক পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত লোকেশ্বর গ্রামে আক্রমন করে। সেখানে হিন্দুদের বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের বাড়িঘর লুট করে এবং দুজনকে নির্মম ভাবে পিটিয়ে আহত করে। এখানেও তারা ব্রাহ্মণদের পবিত্র পৈতা ছিঁড়ে ফেলে এবং মাথায় রাখা চুলের শিখা বা টিকি কেটে দেয়। তাদেরকেও জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। মারকুল নামের একটি গ্রাম পুরোপুরি লুট করা হয় এবং গ্রামের সকল অধিবাসীদেরকে মুসলমান বানিয়ে দেয়া হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে জকিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন সদরপুর গ্রামে আক্রমণ করে মুসলিমরা।শুকলাল নমশূদ্রের বাড়ি লুট করে তারা। তার ভাই পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ তাকে বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে জখম করে এবং পা দিয়ে লাথি মেরে পুলিশ স্টেশন থেকে তাড়িয়ে দেয়। রাতের আঁধারে গ্রামের হিন্দুরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সাঁতার কেটে নদী পার হয়। পারগ্রামের অক্রু নমশূদ্র এবং রমেশ নমশূদ্রের বাড়ি মুসলিমরা লুট করে এবং দখল করে নেয়।
আজ এ পর্যন্তই দিলাম, আগামী পর্বে দেখবেন, মুসলমানদের দ্বারা নির্যাতিত হিন্দুরা কিভাবে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে ভারতে ঢুকেছে, যার মধ্যে ছিলো হয় তো এই নির্বোধ মহিলা এবং তার আত্মীয় স্বজনও।
জয় হিন্দ।
💜 জয় হোক সনাতনের 💜




রাধা কৃষ্ণ


    রাধা কৃষ্ণ


     ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু

কৃষ্ণ, রাধা এবং হ্লাদিনী শক্তি:
রাধার ভক্ত, সমর্থক এবং রাধার অস্তিত্ব রক্ষার প্রচেষ্টাকারী গোষ্ঠীর একটি ব্যাপক অপপ্রচার হলো- রাধা, কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। এই হ্লাদিনী শক্তির মানে হলো "আনন্দদায়িনী শক্তি"; সুতরাং- রাধা, কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি, এটা দ্বারা বোঝানো হয় যে- রাধা, কৃষ্ণের আনন্দদায়িনী শক্তি, আরেকটু খোলসা করে বললে বলতে হয়- রাধা, কৃষ্ণের সেক্স পার্টনার; কেননা, যৌন আনন্দই পার্থিব জগতের সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম আনন্দ।
এই "হ্লাদিনী শক্তি" শব্দগুচ্ছটা বৈষ্ণব সমাজের আবিষ্কার; কারণ, হিন্দুধর্মের প্রাচীন কোনো গ্রন্থে এই শব্দের ব্যবহার নেই।

এমন কি যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধা একটি নষ্টা মেয়ে, যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মূল উদ্দেশ্য রাধার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বরিক মহিমাকে ধ্বংস করে হিন্দু সমাজকে বিলুপ্ত করা, সেই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও শ্রীকৃষ্ণ এক স্থানে রাধাকে বলেছে,
"আদ্যাশক্তি প্রকৃতি যে তুমি সুলোচনে।"
তার মানে উদ্ভট ও গাঁজাখুরি কাহিনী সমৃদ্ধ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও রাধাকে আদ্যাশক্তি বলা হয়েছে, রাধাকে কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি বলা হয় নি।
এখন বলি, কিভাবে এই 'হ্লাদিনী শক্তি' কনসেপ্টটির আবিষ্কার ?
ভারতে মুসলিম দুঃশাসন শুরু হওয়ার পর, রাধার মাধ্যমে কৃষ্ণের চরিত্রকে ধ্বংস করে হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রচনা করা হয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ; এই পুরাণে রাধার চরিত্র একটি কলঙ্কিনী মেয়ের চরিত্র, স্বামী থাকা সত্ত্বেও যে কৃষ্ণের সাথে প্রেম ও যৌনক্রিয়া করে বেড়ায় এবং রাধার সাথে সঙ্গ দেওয়ার কারণে এই পুরাণে কৃষ্ণের চরিত্রও একটি লম্পট চরিত্র। হিন্দুসমাজকে ধোকা দেওয়ার জন্য এই পুরাণের প্রকৃত রচয়িতা এবং পৃষ্ঠপোষকরা, এই পুরাণটি চালিয়ে দেয় মহর্ষি বেদব্যাসের নামে এবং এই ধোকা ও চালাকিকে বুঝতে না পেরে, এই পুরাণ থেকে কাহিনী ধার করে জয়দেব নামের এক সংস্কৃত কবি, সংস্কৃত ভাষায় লিখে "গীত গোবিন্দ" এবং বড়ু চণ্ডীদাস নামের এক বাঙ্গালি কবি বাংলায় লিখে "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য" নামের একটি কাব্য। এরপর এই সব মিথ্যাগল্পের উপর ভিত্তি করে রচিত হয় বৈষ্ণব পদাবলী নামের রাধা ও কৃষ্ণের মিথ্যা প্রেম ও বিরহের গান, যাতে চৈতন্যদেব ও বৈষ্ণব সমাজের ছিলো এবং এখনও আছে প্রত্যক্ষ সমর্থন, এতে করে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম বাঙ্গালি হিন্দুদের মাথায় শেকড় গেঁড়ে বসে।
যা হোক, চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগের ও পরের কয়েকশ বছরে, রাধা কৃষ্ণের মিথ্যা প্রেমের গল্প যখন বাঙ্গালি হিন্দুদের মাথায় শেকড় গেঁড়ে বসে, তখন এই প্রেম নিয়ে হিন্দুরা, হিন্দু বিরোধী শক্তির প্রশ্নের মুখে পড়ে নানাভাবে নাজেহাল হতে শুরু করে; যেমন- কৃষ্ণ, ভগবান হয়ে এমন প্রেম করতে যাবে কেনো, যেখানে রাধা অন্যের স্ত্রী অর্থাৎ এই সম্পর্ক ছিলো অবৈধ পরকীয়ার ? এর সাথে হিন্দু বিরোধী শক্তিরা যুক্ত করে আরো একটি তথ্য যে রাধা ছিলো কৃষ্ণের মামী, সুতরাং এটা শুধু অবৈধ পরকীয়া প্রেমই নয়, এটা অনৈতিকও বটে, একজন স্বর্গীয় মহিমার ভগবান বা ঈশ্বর এসব কাজ কিভাবে করতে পারে বা এসব লীলার মাধ্যমে তিনি জগতকে তিনি কি শিক্ষা দিয়ে গেছেন ? ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব অভিযোগ উঠার পর হিন্দুদের উচিত ছিলো শাস্ত্রগ্রন্থ ঘেঁটে খুঁজে দেখা যে, সত্যই রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম বলে হিন্দু শাস্ত্রে কিছু আছে কি না বা সত্যই রাধা, কৃ্ষ্ণের মামী ছিলো কি না ? কিন্তু এই কষ্ট স্বীকার না করে, হিন্দু বিরোধী শক্তির অপপ্রচারকেই হিন্দুরা সত্য বলে ধরে নিয়ে কৃষ্ণের মান বাঁচাতে, তাঁর এই তথাকথিত অবৈধ ও অনৈতিক পরকীয়া প্রেমের পক্ষে যুক্তি খোঁজার জন্য নানা উদ্ভট থিয়োরির আবিষ্কার করে. যার মধ্যে একটি হলো এই 'হ্লাদিনী শক্তি'। হ্লাদিনী উচ্চারণ করতে যাদের অসুবিধা হচ্ছে, তারা এটাকে 'হলাদিনী' ও উচ্চারণ করতে পারেন, তাতে অর্থের হেরফের হবে না।
যা হোক, এই হ্লাদিনী শক্তির থিয়োরিকে প্রতিষ্ঠিত করতে, এর প্রবক্তারা আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকেই ধার করে এক ঐশ্বরিক গল্পের, যে গল্প বলছে- রাধা ও কৃষ্ণ, তারা একই শক্তির দুই রূপ, তারা গোলকে বাস করতেন; তো পৃথিবী থেকে পাপের বোঝা নামাতে, কৃষ্ণ, পৃথিবীতে আসার সিদ্ধান্ত নিলে রাধাও পৃথিবীতে আসার সিদ্ধান্ত নেন কৃষ্ণকে সঙ্গ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কোনো পুরুষের নারী সঙ্গের প্রধান কারণ হলো যৌনতা, তাহলেও এই গল্পটি এটাই প্রমান করে যে, পৃথিবীতে কৃষ্ণের আসার একটি প্রধান কারণ যৌনসুখ উপভোগ, কিন্তু যা মোটেই সত্য নয়।
তাছাড়া রাধা যদি দেবলোকের সদস্য হয় এবং কৃষ্ণের সঙ্গে মিলে পৃথিবীতে নেমে আসার এই পরিকল্পনা করে, এই ঘটনার উল্লেখ শুধু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে থাকবে কেনো ? পৃথিবীতে কৃষ্ণের জন্ম নেওয়া সনাতন ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা হিন্দুশাস্ত্রের প্রাচীন সকল গ্রন্থে আছে, রাধা যদি এই ঘটনার অংশ হতো, তাহলে রাধার কথাও সেই সব গ্রন্থে উল্লেখ থাকতো, সেই সব গ্রন্থে রাধার উল্লেখ নেই মানেই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণনা করা রাধার সব কাহিনী মিথ্যা; তাছাড়া- রাধা, কৃষ্ণ এই নামগুলো পৃথিবীর; দেবলোকে বা স্বর্গ-গোলোকে রাধা কৃষ্ণ বলে কিছু নেই, দেবলোকে আছে বিষ্ণু, নারায়ণ, লক্ষ্মী এসব নাম, সুতরাং স্বর্গের কাহিনী বর্ণনায় যখন বলা হচ্ছে রাধা, কৃষ্ণ; এসব নাম, তখনই প্রমান হয়ে যাচ্ছে যে, এসব কাহিনী পুরোটাই বোগাস।
এত সব কাহিনী বাদ দিলেও রাধা যে কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি, এই কথাও কৃষ্ণের প্রামান্য কোনো জীবনী গ্রন্থ যেমন- ভাগবত, হরিবংশ, মহাভারতে নেই কেনো ? নেই; কারণ, কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি বলে বাস্তবে কিছু নেই, আর কৃষ্ণ আনন্দ করার জন্যও এই পৃথিবীতে আসেন নি, তিনি এসেছিলেন অধর্মকে বিনাশ করে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে, যে কথা বলা আছে গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ৭ ও ৮ নং শ্লোকে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
এর অর্থ- যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি নিজেকে প্রকাশ ক’রে অবতীর্ণ হই, সাধুদের পরিত্রাণ করি, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করি এবং ধর্মকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করি।
গীতা হচ্ছে হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ গ্রন্থ, তাই গীতার কথাই শেষ কথা। গীতায় যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমি পৃথিবীতে আসি অধর্মকে বিনাশ করে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে, সেখানে রাধা ভক্তরা কিভাবে বলে যে, কৃষ্ণ পৃথিবীতে আসে আনন্দ করতে ? কৃষ্ণকে লম্পট প্রমান করতে তারা এত মরিয়া কেনো ? না, কৃষ্ণকে লম্পট হিসেবে প্রমান করতে পারলে নিজেদের লাম্পট্যের সুবিধা হবে, এজন্যই তাদের এই মিথ্যার বেসাতি ? যেমন- যারা গাঁজা খায়, তারা এটা প্রচার করে যে মহাদেব শিবও তো গাঁজা খায়, তাহলে আমরা খেলে দোষ কী ?
রাধার ভক্তদেরকে আমি একটা স্পেশাল প্রশ্ন করছি, আচ্ছা বলেন তো, কৃষ্ণের জীবনে রাধার দরকারটা কী ? নারী ছাড়া কোনো পুরুষ সম্পূর্ণ নয়, এই থিয়োরিতে কৃষ্ণের জীবনে তার স্ত্রী রুক্মিনী তো রয়েছেই, কৃষ্ণের স্ত্রীকে বাদ দিয়ে কৃষ্ণের তথাকথিত গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে আপনাদের এত আগ্রহ কেনো ? কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিনী, যার সম্পর্কে কৃষ্ণ নিজে রুক্মিনীর পিতাকে বলেছেন,
"আপনার যে কন্যা রুক্মিনী তিনি প্রকৃত মানুষী নহেন। তিনি লক্ষ্মী। ব্রহ্মার বচন অনুসারে কোনো কারণবশত তিনি ভূলোকে জনগ্রহন করিয়াছেন।" ( হরিবংশ, পৃষ্ঠা ১৮৯, নিউ বেঙ্গল প্রেস, কোলকাতা)
এই লক্ষ্মীর অবতার রুক্মিনীকে আপনারা কৃষ্ণের পাশে দাঁড় না করিয়ে, কৃষ্ণের সাথে তার পূজা বা আরাধনা না করে, কোনো একজন নষ্টা ও চরিত্রহীনা মেয়েকে আপনারা কেনো পূজা করছেন ? নিজেরা ভবিষ্যতে পরকীয়া প্রেম করে নষ্টামি করবেন সেজন্য, নাকি পরকীয়া প্রেম কোনো ঘটনা নয়, চাইলেই যে কেউ পরকীয়া প্রেম ও তার সাথে যৌনক্রিয়া করতে পারে, ছেলে মেয়েকেই এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য ? কৃষ্ণের পাশে রাধাকে দাঁড় করিয়ে আপনার সমাজকে কী শিক্ষা দিচ্ছেন এবং সমাজকে কোথায় নিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন, সেটা কি একবার ভেবে দেখেছেন ?
অনেকে এও বলে যে রাধা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি, এসব মনগড়া এবং অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত কানমন্ত্র দীক্ষামন্ত্র শিক্ষামন্ত্র গুরুদের কুশিক্ষার ফল। কোথায় লেখা আছে যে রাধা, কৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি ? কৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়া, যে কথা বলা আছে গীতার ৭ম অধ্যায়ের ২৫ নং শ্লোকে, এভাবে-
নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ।
মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম।।- (গীতা, ৭/২৫)
এর অর্থ : আমি মূঢ় ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিদের কাছে কখনও প্রকাশিত হই না। তাদের কাছে আমি আমার অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়ার দ্বারা আবৃত থাকি। তাই তারা আমার অজ ও অব্যয় স্বরূপকে জানতে পারে না।
ফলে কৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি রাধা নয় এবং কৃষ্ণ, আনন্দ করার জন্যও পৃথিবীতে আসেন নি, তাই কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির কোনো প্রশ্নই আসে না। হিন্দু বিরোধী শক্তির প্রশ্নের মুখে পড়ে, নিজেদের (ভুল) বিশ্বাসের মান বাঁচাতে বৈষ্ণব সাধু সন্ন্যাসী গুরুরা আবিষ্কার করেছিলো এই হ্লাদিনী শক্তির থিয়োরি, যার মাধ্যমে তারা এটা বোঝাবার চেষ্টা করে যে- রাধা কৃষ্ণের প্রেম জাগতিক নয়, এই প্রেম আধ্যাত্মিক; এছাড়াও এটা নিচের অর্থাৎ পৃথিবীর কোনো ব্যাপার নয়, এটা সম্পূর্ণ উপরের ব্যাপার, এটা বোঝা সহজ নয় বা সবার পক্ষে বোঝাও সহজ নয়, প্রভুর কৃপা হলেই কেবল এটা বোঝা সম্ভব; এসব বলে বলে তারা এমন ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে যে, রাধা ও কৃষ্ণের তথাকথিত প্রেমের ব্যাপারে তাদের ভক্তরা স্পষ্ট করে কিছু জানতে বা বুঝতে পারে না। আর এইসব গুরুরাও স্পষ্ট করে তাদের শিষ্যদেরকে কিছু বোঝাতে বা জানাতে পারে না; কারণ, ঐসব কানমন্ত্র বা দীক্ষামন্ত্র বা শিক্ষামন্ত্র গুরুরা বা পদাবলী কীর্তনীয়ারাও তো আসলে স্পষ্ট করে রাধা কৃষ্ণের প্রকৃত থিয়োরিটা জানে না বা বোঝেই না, তারা অন্যদেরকে তা জানাবে বা বোঝাবে কিভাবে ?
একটা কথা কিন্তু পরিষ্কার যে, যে যে বিষয়টা জানে বা বোঝে, সে কিন্ত অন্যদেরকে সেই বিষয়টা জানাতে বা বোঝাতে সক্ষম; কানমন্ত্র গুরুরা বা পদাবলী কীর্তনিয়ারা কাউকেই রাধা কৃষ্ণের প্রকৃত থিয়োরি স্পষ্ট করে বোঝাতে পারে না, এর কারণ তারা নিজেরাই বিষয়টি বোঝে না।
কৃষ্ণের হলাদিনী বা হ্লাদিনী শক্তি বলে যে কিছু নেই এবং কানমন্ত্র গুরু ও পদাবলী কীর্তনীয়াদের বিদ্যার দৌড় যে কতটুকু, আশা করছি আমার পাঠক বন্ধুদেরকে তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।
জয় হিন্দ।

জয় শ্রীরাম, জয় শ্রী কৃষ্ণ।

💜 জয় হোক সনাতনের 💜


নব্য কালিকা


     নব্য কালিকা




    ফেসবুক থেকে          শেয়ার করেছেন              প্রণব কুমার কুণ্ডু




Bappa Pan

JAY MAA..