শনিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৮

কালাপাহাড়


   কালাপাহাড়


   শেয়ার করেছেন              প্রণব কুমার কুণ্ডু।

কালাপাহাড়
------------
মুর্শিদকুলি খাঁর মতই ব্রাহ্মণকুলে জন্ম হয়েছিল কালাচাঁদ রায়ের। একটাকিয়ার জমিদার বংশে। মাতৃকুল ছিল পরম বৈষ্ণব।
সংস্কৃত শাস্ত্রে পণ্ডিত, অস্ত্রবিদ্যায় বীরোচিত গুণের অধিকারী।
গৌড় বাদশাহের দরবারে রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছিল কালাচাঁদ। আর প্রাসাদ-সংলগ্ন বাসভবন থেকে প্রতিদিন মহানন্দায় স্নান করতে যাবার সময় নবাবকন্যা দুলারী অপেক্ষা করত সুদর্শন সুপুরুষ ব্রাহ্মণ যুবকের দর্শন পাবার আশায়।
বলিষ্ঠ রূপবান চেহারা, গলায় উপবীত, হাতে স্বর্ণময় কোষা, সুকন্ঠে সঙ্গীতস্তোত্র। পিছনে চলত ছাতাবরদার।
বাদশাহ এবং বেগম বুঝলেন, এই হিন্দু যুবকের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একমাত্র কন্যাকে অসুখী করতে চাননি তাঁরা। তাই কালাচাঁদ রায়কে বললেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দুলারীর পাণিগ্রহণ করো।
কালাচাঁদ অসম্মত হল।
বাদশাহ ক্রোধান্ধ হয়ে তাকে হত্যা করার আদেশ দিলেন।
জল্লাদ এগিয়ে এল কর্তব্যপালনের জন্যে।
আর সেই মুহুর্তে সপ্তদশী নবাবকন্যা মর্মর জাফরির আড়াল থেকে ছুটে এসে বললে, আগে আমায় হত্যা করো, তারপর আমার স্বামীর অঙ্গ স্পর্শ করবে।
মুগ্ধ হল কালাচাঁদ। বিস্মিত হল রূপবতী যবনীর দুঃসাহস দেখে।
দুলারীকে বিবাহ করতে সম্মত হল। কিন্তু ধর্মত্যাগ করতে নয়। মুসলমানীকে বিবাহ করলেই বিধর্মী হতে হবে কেন, এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেল না কালাচাঁদ। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ধর্না দিল, দেবতার প্রত্যাদেশ জানবার জন্যে। শ্রীমন্দিরের পুরোহিতকুল, কালাচাঁদের আত্মীয়-স্বজন সকলেই অপমানিত করল তাকে। সমাজপতিরা বললে মুসলমানীকে বিবাহ করে ধর্মত্যাগী হয়েছে কালাচাঁদ।
সামাজিক অনুশাসনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কালাচাঁদ একদিন নিজেই অত্যাচারী হয়ে উঠল। প্রতিজ্ঞা করল, ভারতবর্ষ থেকে হিন্দুধর্মের উচ্ছেদ সাধন করবে।
স্বেচ্ছায় এবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল সে, নামকরণ হল মহম্মদ ফরমুলি।
হিন্দু ভারত কেঁপে উঠল কালাপাহাড়ের নামে।
জগন্নাথের প্রত্যাদেশ জানবার জন্যে একদিন পূরীধামে ধর্না দিতে গিয়ে অপমানীত হয়েছিল কালাচাঁদ। তাই শাহি ফৌজের অধিনায়ক হয়ে প্রথমেই উৎকল ধ্বংস করতে এগিয়ে গেল কালাপাহাড়। দেবমূর্তি অপবিত্র করল, বলপ্রয়োগে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করল হিন্দু প্রজাদের। হিন্দু নারীর সতীত্ব আর কৌমার্যের অহংকার টলে পড়ল লালসামত্ত শাহি ফৌজের আক্রমণে।
বনাগ্নির মতই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তাদের অত্যাচার। অভিযানের পর অভিযান। মুসলমান সমাজও শঙ্কিত হল, ব্যাথায় কাতর হল হিন্দুর প্রতি কালাপাহাড়ের অত্যাচার দেখে।
কালাপাহাড়ের শাহি সৈন্য শুধু দেবমূর্তিই নয়, নারীলাঞ্ছনাতেও তৎপর হয়ে উঠল। হিন্দু নারীর ধর্ম বিনষ্ট করার উৎসাহে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠল শাহি ফৌজ।
মন্দিরের পর মন্দির ধ্বংস করে অত্যাচারের আগুন জ্বালিয়ে বারাণসীতে পৌঁছল কালাপাহাড়। একটির পর একটি প্রাচীন দেবমন্দির ধ্বংস করে শেষে বারাণসীর কেদারেশ্বর-লিঙ্গ অপবিত্র করার নির্দেশ দিল।
বিধর্মীর চিৎকার তুলে ছুটে গেল সৈন্যরা।
এমন সময় রোরুদ্যমানা বৈধব্যের রূপ নিয়ে কালাপাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়াল এক শুভ্রবাস বিধবা রমনী ! কালাচাঁদ রায়ের মাতুলানী।
শ্বেতবসনা কাসিবাসিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল দেবদ্রোহী কালাচাঁদ। মনে পড়ল, এই মাতুলানীর স্নেহ আর মমতায় শৈশব কাটিয়েছে সে, মাতৃত্বে লালন করেছে তাকে এই বিধবা শুচিতা।
শুনল কালাচাঁদ। তারই লালসামত্ত সৈন্যের দল বিধবার ধর্ম বিনষ্ট করেছে।
অবলা এক নারীর উন্মাদ এক হতাশার দৃষ্টিতে বিবেক ফিরে পেল কালাপাহাড়। তার চোখের সামনে বিষপান করে অভিশাপ দিতে দিতে মৃত্যুবরণ করল বিধবা।
অনুশোচনা দেখা দিল তার মনে। অত্যাচার বন্ধ করার নির্দেশ দিল কালাপাহাড়। রক্ষা পেল কেদারেশ্বর-লিঙ্গ, রক্ষা পেল হিন্দু ধর্ম।
আর কালাপাহাড় ??
পরদিন প্রত্যূষে শাহিরক্ষীর দল খুঁজে পেল না কালাপাহাড়কে। তন্নতন্ন করে, চতুর্দিকে তল্লাসি পাঠিয়েও হদিস মিলল না।
হয়ত সন্ন্যাসী হয়েই হিমালয়ের কোনও অজ্ঞাত গুহায় প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টায় লোকচক্ষুর আড়ালেই মৃত্যু হল তার, হয়ত বা গঙ্গাগর্ভে আত্মহত্যা করল অনুশোচনায়।
কালাপাহাড়ের প্রকৃত ইতিহাস কেউই জানে না। গ্রাম্য কিম্বদন্তীর মধ্যেই তা আবদ্ধ হয়ে আছে।
----- রমাপদ চৌধুরী (লালবাঈ)



রাহুল দেববর্মণ


   রাহুল দেববর্মণ

   শেয়ার করেছেন                   প্রণব কুমার কুণ্ডু
সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার
রাহুল দেববর্মণ (জন্মঃ- জুন ২৭, ১৯৩৯ -মৃত্যুঃ- জানুয়ারি ৪, ১৯৯৪)
জানুয়ারি ৩, ১৯৯৪। নতুন একটা ছবির ক্লাইম্যাক্স নিয়ে উত্তেজনায় সন্ধেটা ভরপুর। প্রোডিউসার ডিরেক্টরের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা ধরে মিটিং। এ বার বেরোতে হবে, সান্তাক্রুজে শক্তি সামন্তের বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন। সাড়ে ন’টা নাগাদ প্রোডিউসার বেরিয়ে গেলেন। এ বার বাড়ির মানুষটিও বেরোনর পালা। ক্যালেণ্ডারের পাতায় দিন বদলে হল ৪ জানুয়ারি। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরলেন মানুষটি। দারোয়ানকে পঞ্চাশ টাকা বকশিস দিলেন গাড়িটা একটু পার্ক করে দেওয়ার জন্যে, বোধ হয় শরীরটা ঠিক লাগছিল না। রোজকার মতো ঘরের ৪০ ইঞ্চি টিভিটায় বিবিসি দেখতে বসলেন। কিন্তু শরীরটা কেমন করছে। কাউকে ডাকা দরকার। রাত আড়াইটায় ঘরের বেলটা বেজে উঠল। ছুটে এল কাজের লোকেরা। তিনি শুয়ে আছেন, জিভ বেরিয়ে গিয়েছে। কাজের লোক, কাছের লোক সুদাম চটপট মুখে সরবিট্রেট স্প্রে করে দিলেন। ড্রাইভার রমেশ অ্যাম্বুল্যান্স ডাকলেন। সেক্রেটারি ভারত এক জন ডাক্তার নিয়ে এলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ করলেন। অ্যাম্বুল্যান্স এসে গেল তিনটে চল্লিশে।
শচীন দেববর্মন আর মীরা দেববর্মনের ঘরে জন্ম হয়েছিল এক ছেলের। তখন তার ডাক নাম ঠিক হল টুবলু। পঞ্চম নামটা তার হবে আরও কিছু দিন পরে। সে নাকি সব সময়েই কাঁদত পঞ্চম স্বরে। আর একটা গল্পও আছে। বাবা ‘সা’ গাইলেই ছেলে নাকি ‘পা’ গাইত। তাই অশোককুমার তার এই নামটা দিয়েছিলেন। পঞ্চমের কেরিয়ারের প্রথম দিকে পাঁচ সংখ্যাটা কিন্তু সত্যি লাকিও হয়েছিল। ‘তিসরি মঞ্জিল’ (১৯৬৬) ছিল তাঁর সুর করা পঞ্চম ছবি।
ছবি হবে ‘তিসরি মঞ্জিল’। শাম্মি কপূরের পছন্দের সুরকার শঙ্কর জয়কিষাণ এবং ও পি নায়ার। শাম্মি এলেন শুনে দেখতে ‘আর ডি’ ব্যাপারটা কী। প্রথম বলটাই ওয়াইড। পঞ্চম সবে একটা নেপালি সুর গেয়েছেন, (যে সুর থেকে পরে তৈরি হবে ‘দিওয়ানা মুঝসে নহী’)
শাম্মি বললেন, ‘স্টপ স্টপ’। এটা আমি জয়কিষাণকে দিয়ে করিয়ে নেব, আর একটা কুছ সুনাও। নার্ভাস পঞ্চম বাইরে গিয়ে সিগারেটে দুটো টান দিয়ে এলেন। এসে গাইলেন পর পর তিনটে সুর, ‘ও মেরে সোনা...’, ‘আ যা আ যা...’ এবং ‘ও হাসিনা জুলফোঁ ওয়ালি...’-র গান তিনটের জন্যে। আবার শাম্মি দুম করে থামিয়ে দিলেন তাঁকে। বললেন, আরে তুম পাস হো গয়ে হো। আহা কী গান ‘ও হাসিনা জুলফোঁ ওয়ালি...’! আর এই সব গান তৈরিই তো পঞ্চমের জীবন।
আর ডি’র গানের পেছনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন তাঁর দলের সঙ্গীরা, যেমন কারসি লর্ড, মনোহারি সিংহ, ভানু গুপ্তা আর আরও অনেকে। আর ডি’র সঙ্গীতের মূল ব্যাপারটাই ছিল নিয়ম ভাঙা এক প্রাণের স্পন্দন। ‘ও হাসিনা...’র কথা ধরুন, ৮০ জন শিল্পীকে ব্যবহার করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৪০ জন বাজিয়েছিলেন বেহালা। আজকের দিনের মতো ট্র্যাকের কারিগরি ছিল না। একসঙ্গে এতগুলো বাদককে ব্যবহার করা, কী কাণ্ড! শুধু কী বাদ্যযন্ত্র। মোটর গাড়ির ইঞ্জিন, পেডেস্টাল পাখা, কী না চলবে তাঁর গানে। তৈরি হবে জাদু।
বীর সাংভি একটি লেখায় বলেছিলেন যে, দুনিয়া জুড়ে ষাটের দশককে যৌবনের দশক বলে বাড়াবাড়ি করা হয়। ভারতে কিন্তু যৌবনের দশক বলতে সত্তরের দশক। আর সত্তরের দশক মানেই পঞ্চমের দশক।
ফিয়াট গাড়িতে বসে থাকা তিন জন পুরুষই মহিলাটিকে লক্ষ করল। হাল্কা নীল শাড়ি, সানগ্লাস, খোঁপায় ফুল আর হাতে সাদা ব্যাগ। মুম্বইয়ের কোলাবা কজওয়ের রিগ্যাল সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ফোনে তো সেই রকমই কথা হয়েছিল। দু’জন পুরুষ টুক করে গাড়ি থেকে নেমে হাওয়া। তৃতীয় জন গাড়িটা বেসমেন্টে পার্ক করে এগিয়ে গেলেন মহিলার দিকে। কিছু কথা হল, তার পর দু’জনে ঢুকে গেলেন হলে। হলে যে ছবিটা চলছিল তার নাম ‘গোল্ড ফিঙ্গার’। জেমস বণ্ডের ছবি। ছবির আগে বিজ্ঞাপন চলছিল। তখনই মহিলা হঠাৎ হল থেকে উঠে বেরিয়ে গেলেন আর ফিরে এলেন না।
গল্পটা এ বার খুলে বলা দরকার। পুরুষ তিন হলেন, পঞ্চম, শচীন ভৌমিক আর মনোহারি সিংহ। ক’দিন আগেই পঞ্চম লক্ষ্মীকান্ত আর প্যারেলালের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে বম্বের কিছু কলেজ ছাত্রীরাও ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। তাদের এক জন এসে পঞ্চমের অটোগ্রাফ চায় ও পায়। বম্বেতে ফিরে সে পঞ্চমকে ফোন করে বলে সে-ই সেই অটোগ্রাফ শিকারি, পঞ্চম কি তার সঙ্গে ‘গোল্ড ফিঙ্গার’ দেখতে যাবেন? হলের বাইরে মেয়েটি নিজের নাম বলেছিল রীতা পটেল। তার পর এই কাণ্ড!
ছবির বণ্ডের মতোই পঞ্চম ও তাঁর বন্ধুরা লেগে পড়লেন রীতার সন্ধানে। মেয়েটি অ্যাম্বাসাডার চালিয়ে এসেছিল। তখন বম্বেতে ফিয়াটের রাজত্ব। এ ছাড়াও সে বলেছিল, সে নির্মলা নিকেতন নামে চার্চ গেটের একটা হোম সায়েন্স কলেজে আসে। জায়গাটা পঞ্চমের ভালই চেনা, কারণ তাঁর ফেভারিট ‘গে লর্ড’ রেস্তোরাঁটা ওর কাছেই।
ধরা পড়লেন রীতা। জানা গেল, রাহুল দেববর্মনকে সিনেমা হলে টেনে আনবেন, এই বেট জিতে যাওয়ার পর (হলের আনাচেকানাচে বন্ধুরা ছিল) তিনি চলে যান। কিন্তু চলে গেলেই তো হবে না। আবার ধরা পড়তে কতক্ষণ! জমে উঠল প্রেম। আর কয়েক মাস পরে মালাবার হিলস-এ এক বন্ধুর বাড়িতে গোপনে বিয়েও হয়ে গেল দু’জনের। বিয়েটা সুখের হয়নি। শচীনকর্তা বউমাকে মেনে নিলেও শোনা যায় শাশুড়ির সঙ্গে জমেনি রীতার।
কিন্তু এর খুঁটিনাটি তো আর পাঁচটা জীবনের মতো। এই জীবনের কান্না হাসিগুলোকে ‘হাম বেওয়াফা হরগিজ ন থে’ করে তুলতে পারেন ক’জন? ক’জন আমাদের বুকের মধ্যে বাজাতে পারেন ‘এ কেয়া হুয়া ক্যায়সে হুয়া, কব হুয়া’? আবার অ্যারেঞ্জমেন্টে পুরে দিতে পারেন আনন্দের সুর— সব ছক ভেঙে। জীবনে সুখ আর দুঃখ মেশামেশি— তাকে ও ভাবে আলাদা করা যায় না— এই আশ্চর্য বোধকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন প্রাণভাসি বানভাসি সুরের কাঠামোয়?
সত্তর জুড়ে শুধুই যেন পঞ্চম। সেই সময়টা যে কী দারুণ সময় তাঁর সুরের সঙ্গীদের। এই সময় কোনও এক জ্যোতিষী রাহুলকে বলেছিলেন, গান না গুনতে, কাজ না গুনতে। তাই তিনি শুধু গুনগুনই করে গিয়েছেন, যোগ-বিয়োগ-ভাগ করেননি কখনও। তাঁর এই সময়কার সুরের এক সঙ্গী এই সময়টার কথা মনে করতে গিয়ে বলেন, তখন আমরা দিন নেই, রাত নেই শুধু সুর নিয়ে আছি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না ক’টা গান রেকডিং হল, ক’টা বাকি। শুধু একটা পাগলামো থেকে আর একটাতে ছুটে চলা। একটা চ্যালেঞ্জ পার করে আর একটা। সে যে কী সময় গিয়েছে! অনেক দিন পরে, ১৯৮৫-র পর যখন শুকিয়ে আসবে কাজের ধারা, কাছের বন্ধুরাও ছেড়ে চলে যাবেন তাঁকে, তখন অনেক দুঃখে একটা হিসেব করবেন রাহুল। বলবেন, পর পর ২৯টা ফ্লপ গেছে আমার। একটা সময় ছিল, যখন আমার সন্ধ্যা শুরু হত মধ্য রাতে। শেষ হত সকালে গিয়ে। বাইরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত প্রোডিউসারদের গাড়ি। এখন সন্ধ্যা শুরু হয় সূর্য ডুবতে ডুবতেই, শেষও হয়ে যায় তখনই। বাড়ির বাইরে আর গাড়ির ভিড় থাকে না। কিন্তু সে কথা তো তিনি আগেই জানতেন, নইলে কী করে সুর দিয়েছিলেন সেই গানে, ‘জিন্দেগি কি সফর মে গুজর যাতে হ্যায় জো মকান ও ফির নাহি আতে...’। প্রোডিউসারদের গাড়ি না থাক, আমরা তো থেকে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে। এখনও তো ভালবাসায় ‘করবটে বদলতে রহে সারে রাত হম। আপ কী কসম। আপ কী কসম।’
১৯৬৫। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ। নতুন দুটো দেশই ১৮ বছরের হল। ঘরের ছেলেরা যুদ্ধে গেছে, ও দিকে কাশ ফুটছে, চালচিত্রে ফুটে উঠছে ছবি। রথের দিনে মাটি পড়ছে খড়ে। পুজোর তিন সপ্তাহ আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হল, সৈনিকরা ফিরল ঘরে। বাংলায় সে বার পুজোর গানে এলেন আর ডি বর্মন। কিন্তু তেমন কিছু হল না। এর পর ১৯৬৭-তে এল ‘এক দিন পাখি উড়ে’, ‘আকাশ কেন ডাকে’ আর তার পর ‘মনে পড়ে রুবি রায়’। মনে রাখতে হবে, এই সময়ের কলকাতা খাদ্য আন্দোলনের কলকাতা, নকশাল আন্দোলনের কলকাতা, কংগ্রেসের বদলে প্রথম যুক্তফ্রন্ট আসার কলকাতা। এই কলকাতার মুড ছিল আলাদা। আর তখনও আর ডি’কে খোলাখুলি গ্রহণ করতে পারেনি বাঙালি। শান্তিনিকেতন, ডোভার লেন আর বামপন্থীদের সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির নানান অনুশাসনের ফাঁকে রাহুলের গান ছিল আর এক ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত। সে নাকি বড় চটুল, বড় পশ্চিমি, বড় অনৈতিক! ভারতীয়দের অনেকের ভারতীয় হয়ে বেড়ে ওঠার আনন্দে যে সামিল হতে পারিনি আমরা বাঙালিরা, যার ফল সব সময় আমাদের পক্ষে ভাল হয়নি, তার একটা লক্ষণ বোধ হয় এই সময় আমাদের রাহুলকে গ্রহণ করার ব্যর্থতার মধ্যে ফুটে উঠেছিল। আমরা যৌবনকে ‘রাজনৈতিক’ করতে গিয়ে বোধ হয় তাঁর বহুমুখী সহজাত দিকগুলোকে অস্বীকার করেছিলাম। যাক গে, সে বিষাদের গল্প আজ থাক। বরং দুটো মজার তথ্য জানা যাক। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ গানটা লিখেছিলেন শচীন ভৌমিক, তিনি নিজের জীবনে ছবি রায় বলে একটি মেয়ের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, কাজেই রুবির আসল নাম ছবি। রেকর্ডটার উল্টো পিঠে ছিল ‘ফিরে এসো অনুরাধা’ গানটি। অনেকেই ভেবেছিলেন দাগ দিয়ে চলে গেল কে এই অনুরাধা? শচীন বলেছেন, অনুরাধা কোনও মেয়ের নাম নয়, তাঁর লেখা প্রথম চিত্রনাট্যটি ছিল ‘অনুরাধা’ নামের ছবিটির জন্য লেখা। তাই এই নামটা বসিয়েছিলেন!
‘কাটি পতঙ্গ’ ছবিতে ‘আকাশ কেন ডাকে’ ফিরে এল ‘ইয়ে শাম মস্তানি’ হয়ে। তার পাশে থাকল ‘ইয়ে জো মহব্বত হ্যায়...’। জানি, আপনারা অনেকেই কাগজ থেকে চোখ তুলে একটু লক্ষ্যহীন ভাবে তাকাচ্ছেন, যেটা আসলে নিজের ভেতর তাকানো, আর সুরগুলো গুনগুন করে নিচ্ছেন এক বার। এটা তো বার বার হতেই থাকে।
বনফুলের ভাই পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় বনফুলের ‘হিংয়ের কচুরি’ গল্প নিয়ে ছবি বানালেন, ‘নিশিপদ্ম’। সুর দিলেন নচিকেতা ঘোষ। ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’ গানের জন্য মান্না দে জিতলেন তাঁর দ্বিতীয় জাতীয় পুরস্কার। শক্তি সামন্ত ছবিটি হিন্দিতে বানাতে চাইলেন— ‘অমর প্রেম’। সুরকার কে? রাহুল দেববর্মন। শক্তি সামন্ত বলেছেন, ছবির কাজ করার সময় পঞ্চম মিউজিক রুমে ঢুকত সকাল ন’টায়, বেরোত রাত ন’টায়। বাবার গলায় শোনা ‘বেলা বয়ে যায়’ গানটি অনুপ্রেরণা জোগালো, ‘রায়না বিত জায়ে’ গানটির। গান শুনে মদনমোহন ফোন করে অভিনন্দন জানালেন শচীন দেবকে। বাবা সবিনয়ে জানালেন, এই গানটির সুর তাঁর নয়, তাঁর ছেলের। মদনমোহনের ঠিক বিশ্বাস হল বলে মনে হল না। তোড়ি আর খামাজ— এই দুই সুরের মিশাল গানটিতে। খামাজ পঞ্চমের প্রিয় সুর। বার বার তিনি ফিরে ফিরে আসেন এই সুরে। ‘রায়না বিত জায়ে’ মুগ্ধ করল অনেককেই। আরতি মুখোপাধ্যায় শুনলেন, মাল্লিকার্জুন মনসুর এই সুরটি গুনগুন করছেন। বিস্মিত আরতিকে এই পণ্ডিত জানালেন, কী অনায়াসে নোটগুলোকে মিলিয়েছে বলো তো? আম জনতার কাছে চিঙ্গারি হয়ে উঠল জীবনের সেই মুহূর্তগুলোর গান, যেগুলোকে আমরা বয়ে বেড়াই। এই গান আমাদের একলা ছাদে বা জানলায় দাঁড় করিয়ে সেই বোধগুলোকে একটা ভাষা দেয়, এক ধরনের তর্পনের শক্তি দেয়, যা নইলে এ জীবনভার অসহ হয়ে উঠত।
গল্পটা টুকরো টুকরোই বলা যায়। জীবনটাই তো টুকরো টুকরো। পঞ্চমের, তাঁর সুরের যাত্রার, আমাদের। আশা আর পঞ্চম। গান বেঁধে দিয়েছিল বন্ধনহীন গ্রন্থি। একটি সাক্ষাৎকারে আশা বলেন, ৭ মার্চ ১৯৭৯ সালে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে সাক্ষী ছিলেন লতা, কিশোর, ভারতী মঙ্গেশকর (হৃদয়নাথের স্ত্রী) ও বন্ধু বাবুভাই দেশাই। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য কিশোর নাকি সপন চক্রবর্তীর ক্যামেরা থেকে ফিল্মটা খুলে নেন। শচীন ভৌমিক আবার অন্য কথা বলেন। তিনি বলেন, বিয়ে কোনও দিন হয়নি। আশা পঞ্চমকে দার্জিলিঙের এক মন্দিরে নিয়ে গিয়ে মালা বদল করেছিলেন। কোনও রেজিষ্ট্রি না, ছবি নেই। যাক গে, তাঁদের গানে গানে উচ্ছ্বসিত, আনন্দে উদ্ভাসিত মিলনের বাইরে অন্য প্রমাণ আমাদের কী দরকার? তাঁদের গানগুলোর উত্তরাধিকার পেতে তো আমাদের উইলের প্রবেট নিতে হয়নি। আর কী চাই।
পঞ্চমের খুব খারাপ সময়ে আর ডি পাগল বিধু বিনোদ চোপড়া, পঞ্চমকে দেবেন ‘পারিন্দা’ ছবির সুরের ভার। আমরা আবার পাব অসাধারণ কিছু সুর। বিধু লিখছেন, এক দিন ‘পেয়ারকে মোড়পে’ গানটার রেকর্ডিংয়ের পর রেনু সালুজা, বিনোদ প্রধান আর আমি রাস্তায় বেরিয়ে এসে গানটা গুনগুন করে গাইছি। হঠাৎ দেখি পঞ্চমদা ওঁর সেই ফিয়েট গাড়িটা করে বেরোচ্ছেন। আমাদের দেখে উনি নামলেন, গান ধরলেন। একটু লোক জন জড়ো হল। তখন পঞ্চমদা বললেন, না রে চল, লোকগুলো ভাববে আমার এমন অবস্থা একেবারে রাস্তায় গাইছি।
পঞ্চমের জীবন আর গানের মেশামেশি দিনলিপি, যা আবার একটা দেশের জীবনগান হয়ে ওঠে, লেখা সহজ নয়। সেই কাজটা অসাধারণ ভাবে করেছেন, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য আর বালাজি ভিত্তল। গানগুলোর বিশ্লেষণ পড়লেই বোঝা যায় এই দু’জনও এই গানের ভেতর ডুব দিয়ে তার মুক্তোগুলোকে চেনার চেষ্টা করেন। তাঁদের ধন্যবাদ, রাহুলের জীবন আর তার সঙ্গে আমাদের নিজেদের জীবনের তীব্র অনুভূতিগুলোকে আর এক বার ফিরিয়ে আনার জন্যে। রাহুলের মতো মানুষরা ফুরান না, বেঁচে থাকেন নিজেদের সুরলোকে। সেই সুরলোকে বিশ্বাস রাখার জন্য পরলোকে বিশ্বাস করার দরকার নেই।
সৌজন্যেঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ বৈশাখ ১৪১৮ রবিবার ১ মে ২০১১
...........


আরও প্রতিক্রিor Ba

সোমনাথ মন্দির, নেহরু, ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ


সোমনাথ মন্দির, নেহরু, ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ






Shared by                     Pranab Kumar Kundu.


Ramprasad Goswami

গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরে’র কারণে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রয়াত ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের কি হাল হয়েছিল, -- আজ আপনাদের সে বিষয়ে কিছু জানানো অবশ্যই দরকার। সত্যি কথা বলতে কি, ডঃ প্রসাদ’কে এর জন্যে বিরাট মূল্য চোকাতে হয়।

জওহরলাল যে সোমনাথ মন্দিরের বিপক্ষে ছিলেন, -- কথাটা কমবেশি সকলেই প্রায় জানাই ছিল। অতএব সর্দার প্যাটেল গান্ধী’জীর শরণাপন্ন হলেন। কোনমতে সেখান থেকে সম্মতি আদায় করেই তিনি হাত লাগালেন মন্দিরের পুনঃনির্মাণে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! কাজ শেষ হবার আগেই মৃত্যু হল তাঁর।

সর্দার’জীর মৃত্যুর পর, তাঁর এই অসমাপ্ত কাজের ভার গিয়ে পড়ে, শ্রদ্ধেয় শ্রী কে এম মুন্সী’র উপর, অন্যদিকে যিনি আবার ছিলেন নেহেরুর ক্যাবিনেট মন্ত্রীও । ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়েছে গান্ধী’জীর-ও।

গান্ধী-প্যাটেলের মৃত্যুর পর এই ইস্যু’তে নেহেরুর বল্গাহীন বিরোধী সুর ক্রমশঃই তীব্রতর হতে শুরু করে। চড়তে থাকে তিক্ততার পারদ। তেমনই একটি মিটিং-এ তো একবার মুন্সী’কে কড়া ধমক’ই দিয়ে বসেন নেহেরু! তাঁর বিরুদ্ধে ‘হিন্দু-পুনরুত্থানবাদ’ তথা ‘হিন্দুত্ববাদ’ প্রচারের তকমা লাগিয়ে তীব্র ভর্ৎসনাও করেন তিনি। কিন্তু মুন্সী’জীও তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তাঁর চাঁছা-ছোলা বক্তব্য – সর্দার প্যাটেলের অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাধা করবেন-ই করবেন! তাছাড়া মুন্সী ছিলেন নিজেও একজন গুজরাটি, অতএব,  তাঁর পক্ষে এই বিষয়টিও মন্দির নির্মাণে গতি আনতে সহায়তা করে।

অতঃপর মন্দির নির্মান সমাপ্ত হলে, তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ’কে শুভ-দ্বারোদঘাটনের জন্য সসম্মানে আমন্ত্রণ জানান। রাজেন্দ্রপ্রসাদও অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে উক্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতে স্বীকৃত হন। কিন্তু এই খবরে বেঁকে বসেন নেহেরু। জল এতদূর গড়ায় যে, স্বয়ং নেহেরু চিঠি লিখে ডঃ প্রসাদ’কে সোমনাথ মন্দিরের উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে নিষেধ করে দেন। কিন্তু এবারে রুখে দাঁড়ালেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। নেহেরুর রক্তচক্ষু’কে আমল না দিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন সোমনাথ মন্দিরে। শুধু উপস্থিত হওয়াই নয়, সেখানে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে দিলেন এক জবরদস্ত ভাষণ।

মারাত্মক ঝটকা খেলেন নেহেরু। তাঁর আঁতে লাগল ঘা! এটিকে তিনি নিজের নৈতিক পরাজয় বলে হজম করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু বিনিময়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ’কেও বড়ো গুনাগার গুনতে হল, কারণ এরপর থেকে নেহেরু তাঁর সঙ্গে যে ধরণের নজিরবিহীন অভব্য আচরণ শুরু করেন, তা ভাবলে আজও বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়!

সোমনাথ মন্দিরের তরজা’কে কেন্দ্র করে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও নেহেরুর ব্যক্তিগত সম্পর্কে এতটাই তিক্ততার সৃষ্টি হয় যে, রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁকে দিল্লীতে থাকার মত একটি ঘর পর্যন্ত বরাদ্দ করতে অস্বীকার করেন নেহেরু। অথচ রাজেন্দ্রবাবু লেখালেখি পছন্দ করতেন, তার বড় শখ ছিল, বৃদ্ধ বয়সে জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি দিল্লীর বুকেই বই-টই লিখে কাটান। নেহেরুর মত মানুষের কি এমন’টা করা উচিৎ ছিল? একজন ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি’র যা যা সম্মান বা অধিকার পাবার কথা ছিল, তা’র সব কিছু থেকেই ওই ভদ্রলোকটিকে বঞ্চিত করা হয়। অগত্যা নিরুপায় প্রসাদজী’ তাঁর আদি নিবাস পাটনায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু সেখানেও তাঁর নিজস্ব কোন সংস্থান ছিল না। না ছিল টাকা-কড়ি, না কোন বাড়ি-ঘর। আর অন্যদিকে পাটনা’তে যথেষ্ট সংখ্যক সরকারী বাংলো বা আবাসন থাকা সত্ত্বেও নেহেরুর নিষ্ঠুরতায় সে সব জায়গায় তাঁর থাকা খাওয়ার নুন্যতম সুযোগ-ও তিনি হারালেন।

শেষমেশ পাটনার সদাকৎ আশ্রমের একটি আলো-বাতাসহীন বদ্ধ কুঠুরিতে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে। না, তাঁকে দেখভাল করার মতও কেউ ছিল না; ছিল না কোন ডাক্তার!

ধীরে ধীরে শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগল, ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতির। আবদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে ক্রমশঃ দেখা দিল শ্বাসকষ্ট। সারা দিন ধরে দমকে দমকে কাশির সঙ্গে উঠতে লাগল কফ। কিন্তু হায়! তিনি ছিলেন অসহায়!! দেশের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুবাদে দ্বারে দ্বারে সাহায্যের জন্য ভিক্ষা করাও যে তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব। অন্যদিকে, রাজেন্দ্রপ্রসাদের পাটনা আসার পর থেকে তিনি কেমন আছেন, বা তাঁর কি ভাবে চলছে? – ইতিহাস সাক্ষী, চক্ষুলজ্জার খাতিরে নেহেরু একবারও সে খবর নেবার প্রয়োজন বোধ করে দেখলেন না।

শুধু নেহেরুই নন, সেদিন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি’র অসুস্থতার খবর পাবার পরও এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যিনি... নূন্যতম চিকিৎসার সুবিধাও তাঁর কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছিলেন!

বিহারে তখন কংগ্রেসেরই রাজত্ব, সুতরাং বলাইবাহুল্য কোন এক অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ডঃ রাজেন্দ্রবাবু সুচিকিৎসা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে চিরবঞ্চিত রইলেন। পাশাপাশি ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রইল তাঁর প্রতি নানা নির্দয় অমানবিক আচরণের। কার নির্দেশে এসব ঘটেছিল সেদিন?

ডঃ প্রসাদের কফ-কাশির সমস্যা ছিল। তাই প্রায়ই পাটনার মেডিক্যেল কলেজে তিনি চিকিৎসা করাতে যেতেন। সেখানে, আর দশজন সাধারণ রোগীর মতোই তাঁর চিকিৎসা হত। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন,... সেখানে যে মেশিনটি’তে তাঁর চিকিৎসা হত, সেটিকেও পর্যন্ত দিল্লী পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা যায়। অর্থাৎ রাজেন্দ্রবাবুকে প্রকারান্তরে তিলে তিলে মারার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত ভাবেই সম্পন্ন করা হয়েছিল।

একবার শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে সদাকৎ আশ্রমে গিয়ে পৌঁছান। উদ্দেশ্য, দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি তথা সংবিধান সভার অধ্যক্ষ কেমন আছেন তা স্বচক্ষে পরিদর্শন করা। কিন্তু হায়! এ কি দেখছেন নারায়ণ? রাজেন্দ্রপ্রসাদের অবস্থা দেখে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান! তাঁর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। তাঁর ভাবনাতেই আসে না, কি বলবেন তিনি? আর একমূহুর্তও অপেক্ষা না করে তিনি তাঁর অফিসারদের নির্দেশ দেন, প্রসাদজী’র কামরাখানিকে যাতে অবিলম্বে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। সেই মত কাজও হয় তুরন্ত। কিন্তু রাজেন্দ্রবাবু আর বেশি দিন বাঁচেন নি। সেই ঘরেই ১৯৬৩’র ২৮শে ফেব্রুয়ারী তাঁর দেহান্ত হয়।

ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের মৃত্যুর পরেও নেহেরুর ক্ষোভ প্রশমিত হয় নি। শান্ত হতে পারেননি তিনি। তাই প্রসাদজী’র অন্ত্যেষ্টি’তে পর্যন্ত যোগ দিতে নেহেরু অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। আর সম্ভবত সেই কারণেই, রাজেন্দ্রপ্রসাদের শেষ যাত্রার দিন তিনি পাটনা থেকে বহু দূরে রাজস্থানে’র জয়পুরে চলে যান। শুধু কি তাই? রাজস্থানের তৎকালীন রাজ্যপাল, ডঃ সম্পূর্ণানন্দ’জী এই উপলক্ষে পাটনা আসতে চাইলে, স্বয়ং নেহেরু তাঁকে সেখানে যেতে বারণ করেন!

“এটা কি ভাবে সম্ভব? যে, দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন কোন রাজ্যে অবস্থান করছেন; আর সে রাজ্যের রাজ্যপালই অনুপস্থিত”! – দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির অন্তিম যাত্রায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সে দেশেরই কোন এক অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের কাছে সেদিন নেহেরুর তরফে এমনই বার্তা প্রেরিত হয়েছিল। অতয়েব এরপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্পূর্ণানন্দ’জীকে তাঁর পাটনা সফর বাতিল করতে হয়।

ভাবছেন এখানেই শেষ?
- না বন্ধুরা, আরও আছে। নেহেরু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, তথা বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের উত্তরসুরী ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ’কেও একই কারণে পাটনা সফর বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ডঃ রাধাকৃষ্ণাণ সে কথায় কর্ণপাত না করে সোজা রাজেন্দ্রপ্রসাদের অন্ত্যেষ্টিস্থলে পৌঁছে দেশের মানরক্ষা করেন।

আজ আর হয়তো দিল্লী’র রাজঘাটের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে সেদিনের নেহেরুর বর্বর আচরণের স্মৃতিচারণ করার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই আছে। তবে এটাও তো ঠিক যে, মহাত্মা গান্ধী’র সৌধের পাশে সঞ্জয় গান্ধী’র মত লোকও জায়গা পেতে পারে, কিন্তু ঠাঁই মেলে না – স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি’র মত মানুষের! এই দেশে তাদের ইজ্জত মেলা ভার!!

- তবে হ্যাঁ, এটা নিঃসঙ্কোচে মনে হতেই পারে যে, এদেশের যাবতীয় মহত্ত্ব আর বলিদানের কপিরাইট কেবল এক গান্ধী-নেহেরু পরিবারের জন্যেই চিরকালীন সংরক্ষিত...!!!

................ ছিঃ !!!!



মন্তব্যগুলি
Upasana Banerjee
Upasana Banerjee Neheru akta joghonno choritro o manosikotar lok. Or jnyo desh vag hoyeche. Or jnyo Pakistan somosya. Or jnyo pak odhikrito kashmir bole akta jayga toiri hoyeche.




Shared by
Pranab Kumar Kundu.