ধর্মভাবনা
শ্রীগোপীনাথ কবিরাজের, ' বিশুদ্ধবাণী ', প্রথমখণ্ড-এর বক্তব্য অনুযায়ী.....
সাধনের তত্ত্ব ও প্রক্রিয়া
অজপা
সাধনের তত্ত্ব ও প্রক্রিয়া সম্বন্ধে মহাজনগণ গুরুপরম্পরা অনুসৃত পদ্ধতির
বশবর্তী হইয়া বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হইতে বিভিন্ন প্রকার বিবরণ প্রকাশিত
করিয়াছেন। সাধকের যোগ্যতা ও অধিকারগত বৈশিষ্ট্য হইতে বিচার করিলে বুঝিতে
পারা যায় যে ইহাদের প্রত্যেকের সার্থকতা আছে।
অজাপা কুণ্ডলিনী হইতে
উদ্ভূত প্রাণধারিণী প্রাণবিদ্যারূপে যোগিসমাজে পরিচিত। শ্যেনপক্ষী যেমন
ঊর্ধ্ব আকাশে উড্ডীন হইলেও গুণবদ্ধ থাকিলে নিম্নে পৃথিবীর দিকে আকৃষ্ট হয়
তদ্রূপ প্রাণ ও অপানের ক্রিয়ার বশীভূত জীব ঊর্ধ্বদিকে ও অধোদিকে গতিলাভ
করিয়া থাকে। কোন কোন আচার্য্য বলেন, ‘তৎ’ পদবাচ্য পরমাত্মা হংসবিদ্যার
প্রথম অবয়ব ‘হ’কার দ্বারা বর্ণিত হন এবং ‘তং’ পদবাচ্য প্রত্যক চৈতন্য অথবা
খেচরী বীজ দ্বিতীয় অবয়ব ‘সঃ’ কার দ্বারা দ্যোতিত হয়। প্রাণিমাত্রের হৃদয়ে
যে অব্যাকৃত আকাশ আছে তাহাতে লিঙ্গ-শরীর বিদ্যমান রহিয়াছে। উহার প্রতি
লোমভাবে হংসের গতি হইয়া থাকে। শাস্ত্রে আছে—‘সঃকারো ধ্যায়তে জন্তুর্হংকারো
জায়তে ধ্রুবম্’। ‘সঃ’ অথবা জীব নিজের জীবত্ব পরিহার করিলে সোহং শব্দের
লক্ষ্য প্রত্যক্ আত্মার সহিত অভিন্ন পরমাত্মা ভিন্ন অপর কিছু নহে। যে সাধক
নিজের আত্মাকে ধ্যান করিয়া থাকে, তাহার পক্ষে ‘হ’-কারাত্মক পরমাত্মভাবের
প্রাপ্তি সুলভ হয়। দ্বিতীয় মতে, হংস বলিতে প্রত্যক্ আত্মা অথবা
ব্যষ্টি-তুরীয় বুঝিতে হইবে এবং পরমহংস শব্দে পরমাত্মা অথবা সমষ্টি-তুরীয়কে
বুঝাইয়া থাকে। ব্যষ্টি-তুরীয় ও সমষ্টি-তুরীয় পরস্পর যুক্ত হইলে হংসযোগ
নিষ্পন্ন হয়। ইহাই অজপার তত্ত্ব। তৃতীয় মতে, সাধকের প্রজ্ঞা ও সাধনশক্তির
তারতম্য অনুসারে অজপা তত্ত্ব সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রকার দৃষ্টি অঙ্গীকৃত হইয়া
থাকে। মন্দপ্রজ্ঞ মধ্যপ্রজ্ঞ এবং উত্তমপ্রজ্ঞ সাধকের দৃষ্টি যে ভিন্ন
তাহা অধোলিখিত বিবরণ হইতে স্পষ্টই বুঝিতে পারা যাইবে। যাহার জ্ঞানশক্তি
উজ্জ্বল নহে, যে অতি সূক্ষ্মতত্ত্ব গ্রহণ করিতে পারে না, তাহার নাম
মন্দপ্রজ্ঞ। এই প্রকার সাধক ‘হ’কার দ্বারা পুরুষ এবং ‘স’-কার দ্বারা
প্রকৃতি এই দুইটি ধারণা করিয়া থাকে। সুতরাং তাহার দৃষ্টিতে হংসযোগ বলিতে
পুরুষ ও প্রকৃতির যোগ বুঝায়। কিন্তু যাহার প্রজ্ঞা অপেক্ষাকৃত তীক্ষ্ণ,
অর্থাৎ যে মধ্যপ্রজ্ঞ, তাহার দৃষ্টি অনুসারে ‘হ’কার অপানের সঞ্চার এবং
‘স’কার প্রাণের সঞ্চার বুঝাইয়া থাকে। মুখ্য প্রাণ যখন পরাঙ্খুখভাবে
আবর্ত্তিত্ত হয় তখন তাহাকে প্রাণ না বলিয়া অপান বলা হয়। সুতরাং হংস বিদ্যার
রহস্য মধ্যম সাধকের দৃষ্টি অনুসারে প্রাণ ও অপানের সংযোগ ভিন্ন অপর কিছু
নহে। কিন্তু যে সাধক উত্তম প্রজ্ঞাসম্পন্ন তাহার দৃষ্টি আরও সূক্ষ্ম। সে
প্রকৃতি পুরুষের সম্বন্ধ অথবা প্রাণ ও অপানের সম্বন্ধ পরিহার করিয়া আত্ম
স্বরূপের দিকে লক্ষ্য করিয়া থাকে। এই সাধক অজপা মন্ত্রের পূর্ব্বভাগ
‘অহং’কে জীবাত্মার বাচক এবং উত্তরভাগ ‘সঃ’কে শক্তিবাচক বলিয়া ধারণা করিয়া
থাকে।
অধিকার ভিন্ন বলিয়া অজপা জপের বিধানও ভিন্ন। নিম্নাধিকারী তালু,
ওষ্ঠ প্রভৃতি দৈহিক উচ্চারণ-যন্ত্রের ব্যাপারের দ্বারা অজপা-জপ সম্পাদন
করে। এই সকল সাধকের চিত্ত সম্পূর্ণভাবে সংস্কৃত বা শোধিত নহে। তাই ইহারা
দেহগত ক্রিয়াকে আশ্রয় না করিয়া জপ সাধন করিতে পারে না। কিন্তু যাহারা মধ্যম
অধিকারী তাহাদের চিত্তসংস্কার অধিক। এইজন্য তাহাদের পক্ষে অজপা জপ করিবার
জন্য তালু প্রকৃতির কোন প্রকার ক্রিয়া আবশ্যক হয় না। তাহাদের অধিকার উচ্চ
বলিয়া তাহাদের বিধানও ভিন্ন।
শ্রীগোপীনাথ কবিরাজের ‘বিশুদ্ধবাণী’ (১ম খণ্ড) থেকে.....
' বর্তমান ', ১৭/০৮/২০১৭ থেকে সংগৃহীত !