রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

পরীক্ষায় ভীত ঈশ্বরচন্দ্রকে রচনা লিখিয়েছেন শিক্ষক মহাশয় ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


পরীক্ষায় ভীত ঈশ্বরচন্দ্রকে রচনা লিখিয়েছেন শিক্ষক
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


ফেসবুক থেকে               শেয়ার করেছেন                        প্রণব কুমার কুণ্ডু



Abhik Dey



#পরীক্ষায় ভীত ঈশ্বরচন্দ্রকে রচনা লিখিয়েছেন শিক্ষক মহাশয়
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
#ত্রিশ বছরেরও বেশি সংস্কৃত কলেজে অলঙ্কারশাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। পরীক্ষার ভয়ে ভীত ঈশ্বরচন্দ্রকে জোর করে রচনা লিখিয়েছেন, জাগিয়েছেন উৎসাহ, আত্মবিশ্বাস। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যেই বিদ্যাসাগর পরে হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রদরদি অধ্যক্ষ।

সে দিন সংস্কৃত কলেজে পরীক্ষা। সকাল দশটা বাজতেই ছাত্ররা একে একে ক্লাসে এসে লিখতে শুরু করেছে। তারই মাঝে বেঁটেখাটো পণ্ডিতমশায়ের কৌতূহলী চোখ ঘরের এ দিক ও দিক কাকে যেন বারবার খুঁজছিল। ছাত্রদের মধ্যে এক জন বাদে সকলেই সেখানে উপস্থিত। বিশেষ এই ছাত্রটিকে পণ্ডিতমশাই অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সে জন্যেই তাকে নিয়ে ভাবনা!

ক্লাসে না এলেও ইতিমধ্যেই ছাত্রটি কলেজের অন্য একটি ফাঁকা ঘরে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। অবিলম্বে তিনি ছাত্রটিকে রচনা লেখার পরীক্ষায় বসাতে চাইলেন। কিন্তু জেদি ছেলেটি বেঁকে বসল। সে কিছুতেই পরীক্ষা দেবে না। পণ্ডিতমশাই যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন, তার জেদও ততটাই বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে পণ্ডিতমশাই কলেজের অধ্যক্ষ মার্শাল সাহেবের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনাটি জানালেন। তার পর ছাত্রটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে আনলেন ক্লাসে!

সেই ছাত্রটি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আর পণ্ডিতমশাই অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। পরীক্ষায় বসলেও ঈশ্বরচন্দ্র এ বার বিরক্ত হয়েই পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন শুধু শুধু তাকে এই পরীক্ষায় বসালেন তিনি? এর উত্তরে প্রেমচন্দ্র একটু হেসে বললেন, ‘‘যা পারো তাই লেখো, না হলে সাহেব অসন্তুষ্ট হবেন।’’ আসলে সাহেবের নাম করে তিনি নিজের ইচ্ছের কথাই বললেন।

প্রেমচন্দ্র ভাল করেই জানতেন ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিভার কথা। আর এও জানতেন যে সে কিছু লিখলে সেটা ব্যতিক্রমী হবেই। ঈশ্বরচন্দ্র সে সময় স্মৃতিশ্রেণির ছাত্র হলেও, তখনও অলঙ্কারশ্রেণিতে আসেননি। পণ্ডিতমশাই চেয়েছিলেন কলেজে সকলের সামনে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিভা তুলে ধরতে। তবে তাঁর আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা নিরুপায় হয়েই ঈশ্বরচন্দ্রকে পরীক্ষায় রচনা লিখতে বসতে হল। ইতিমধ্যে এগারোটা বেজে গিয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র প্রেমচন্দ্রকে বললেন, সকলে দশটায় লিখতে শুরু করেছে, এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কী-ই বা লিখবেন। বিরক্ত প্রেমচন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রচনার বিষয় ছিল ‘সত্যকথনের মহিমা’। পণ্ডিতমশাই চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, ঈশ্বরচন্দ্র চুপচাপ বসে আকাশকুসুম ভাবতে লাগলেন। একটি অক্ষরও লিখলেন না। দেখতে দেখতে বারোটা বেজে গেল। প্রেমচন্দ্র সেখানে এসে অবস্থা দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলেন। তর্কবাগীশকে দেখে ঈশ্বরচন্দ্র অজুহাত দিলেন, তিনি কী লিখবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। মনে মনে রাগ সংবরণ করে প্রেমচন্দ্র শান্ত ভাবে ছাত্রকে বললেন ‘সত্যং হি নাম’ এই বিষয়ে গদ্য লিখতে শুরু করতে। ঈশ্বরচন্দ্র এ বার ভালমতই বুঝলেন, রচনা না লিখলে সে দিন পণ্ডিতমশায়ের হাত থেকে নিস্তার নেই। দেরি না করে লিখতে শুরু করলেন, এক ঘণ্টার মধ্যে রচনা শেষও করলেন।

সে দিন ঈশ্বরচন্দ্র ভেবেছিলেন, পরীক্ষকরা বুঝি তাঁর রচনা পড়ে পরিহাস করবেন। কিন্তু ঘটনা এই, এই রচনা লিখেই তিনি কলেজে একশো টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রেমচন্দ্রের এত কিছু করার উদ্দেশ্য ছিল— ঈশ্বরচন্দ্রের মন থেকে রচনা লেখার ভয় এবং পরীক্ষার ভীতি কাটানো। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও ঘটনাটিতে ঈশ্বরচন্দ্র এক দিকে যেমন উৎসাহিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনই তাঁর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরের বছরও কলেজের পরীক্ষায় পদ্য লিখে পুরস্কার পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

এমনই এক শিক্ষকের কাছে ঈশ্বরচন্দ্র পেয়েছিলেন অনুপ্রেরণা, জীবনের মূল্যবোধ আর কুসংস্কারমুক্ত চিন্তাধারা। বিদ্যাসাগরের মানসিকতা এবং চারিত্রিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার নেপথ্যেও প্রেমচন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অলঙ্কারশ্রেণিতে ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র এক বছর পড়েছিলেন। তার মধ্যেই গুরু-শিষ্যের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

তখনও এ দেশে বেশ কিছু পাঠ্য বিষয় বই আকারে ছাপা হয়নি। প্রেমচন্দ্রের হাতে লেখা ‘সাহিত্যদর্পণ’-এর একটি পুঁথি ছিল। ব্যবহারের জন্য সেটি তিনি কলেজেই রেখে দিতেন। ছাত্ররা প্রয়োজন মতো এক-একটি পাতা খুলে বাড়ি নিয়ে যেত। আবার রেখেও দিত। এক দিন পুঁথির পাতা মেলাতে গিয়ে প্রেমচন্দ্র দেখেন, কয়েকটি পাতা নেই। এর পর পরই তিনি পুঁথির পাতা ছাত্রদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

কয়েক দিন পরে বিশেষ প্রয়োজনে ঈশ্বরচন্দ্র পুঁথির কয়েকটি পাতা খুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন কাজ মিটে গেলে আবার সেগুলি যথাস্থানে রেখে দেবেন। কেউ বুঝতেই পারবে না। সে দিন কলেজ থেকে বেরনোর ঠিক আগেই এক পশলা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট বেশ পিচ্ছিল হয়ে উঠেছিল। রাস্তায় যেতে যেতে আচমকা পা পিছলে ঈশ্বরচন্দ্র কাদায় পড়ে গেলেন। জামাকাপড় তো বটেই, পুঁথির পাতাগুলিও জলে ভিজে গেল। এমন অবস্থায় একটি দোকানে উনুনের পাশে নিজের ভিজে চাদরখানা বিছিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ভিজে পুঁথির পাতাগুলি শুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।

ঘটনাচক্রে ঠিক সেই সময় প্রেমচন্দ্র ওই জায়গা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। প্রিয় ছাত্রের এমন দশা দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন কী হয়েছে। এমন পরিস্থিতির জন্য ঈশ্বরচন্দ্র মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে পুরো ঘটনা অকপটে পণ্ডিতমশাইকে জানালেন। সব শুনে প্রেমচন্দ্র নিজের গায়ের চাদরটি ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আগে কাপড় বদলাতে, পরে দুঃখ করতে! ঈশ্বরচন্দ্র ইতস্তত করছেন দেখে তিনি একটি ঘোড়ার গাড়ি ডেকে সে দিন তাঁর ছাত্রটিকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনদর্শন আলোকিত হয়েছিল বলেই পরবর্তী কালে তিনি নিজেও এক জন ছাত্রদরদি শিক্ষক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

এক দিন যে ঈশ্বরচন্দ্রকে তিনি জোর করে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষায় রচনা লিখতে বসিয়েছিলেন, সেই ঈশ্বরচন্দ্র পরবর্তী কালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তবু দু’জনের কখনও ঘটেনি ব্যক্তিত্বের সংঘাত। ঈশ্বরচন্দ্রের বন্ধু গিরীশ বিদ্যারত্নের পুত্র হরিশ্চন্দ্র কবিরত্ন প্রেমচন্দ্রের ছাত্র ছিলেন। এক বার অলঙ্কারশাস্ত্রের কোনও একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন ‘কাশীস্থিতগবাম্’। যা ব্যাকরণগত ভাবে প্রেমচন্দ্রের ভুল মনে হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত রেগে গিয়ে অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর, তুমি বাপু এই সব ছেলেপিলের মাথা খাচ্ছ। বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা লিখে যে কী সর্বনাশ করবে, তা বুঝতে পারছ না। এরা কিছু শিখছে না।’’

মাস্টারমশাইয়ের মুখে সে দিন এমন অভিযোগ শুনে, ঈশ্বরচন্দ্র এতটুকুও রাগ করেননি। বরং তাঁকে শান্ত করে বলেছিলেন, ‘‘আর ভাবনা নেই, পণ্ডিতমশাই! আমি এ বার ব্যাকরণ কৌমুদী লিখেছি, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ এর উত্তরে প্রেমচন্দ্র আরও রেগে গিয়ে বলেছিলেন ‘‘ছাই হবে।’’ ঈশ্বরচন্দ্র সে দিন এতটুকুও বিরক্ত হননি। কারণ তিনি জানতেন, প্রেমচন্দ্রের এমন উক্তি শিক্ষাপ্রণালী সম্পর্কে তাঁর কঠোরতার প্রকাশ মাত্র। ব্যাকরণগত ভাবে কিছু ভুল বললে প্রেমচন্দ্র যেমন রেগে যেতেন, ঠিক তেমনই কারও মধ্যে প্রতিভার আভাস পেলে প্রশংসাও করতেন।

বরাবরই প্রেমচন্দ্র ছিলেন প্রতিবাদী চরিত্রের। লর্ড মেকলে যখন এ দেশে সংস্কৃত শিক্ষা বন্ধ করতে সংস্কৃত কলেজ বন্ধের দাবি করেন, প্রেমচন্দ্র তার প্রতিবাদ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও জীবনের বিভিন্ন সময়ে পেয়েছিলেন প্রেমচন্দ্রের সাহচর্য। বিদ্যাসাগর আয়োজিত প্রথম বিধবাবিবাহ সভায় তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রেমচন্দ্রও উপস্থিত ছিলেন।

প্রেমচন্দ্রের জন্ম ১৮০৬-এ বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত শাকনাড়া গ্রামের এক প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বংশে। পূর্বপুরুষদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন খ্যাতনামা পণ্ডিত। ছেলেবেলায় তাঁর শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালাতে। পরে বাবার ইচ্ছায় প্রেমচন্দ্র শাকনাড়া থেকে কিছুটা দূরে দুয়াড্ গ্রামে জয়গোপাল তর্কভূষণের টোলে ভর্তি হয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রেমচন্দ্র জয়গোপালের অন্যতম প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন এবং তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সভায়, অনুষ্ঠানে যাতায়াত শুরু করেন। এর ফলে তাঁর পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।

কাব্যের প্রতি প্রেমচন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেই সহজ সরল ভাষায় কবিতা-গান রচনা করতে পারতেন। এমনকী তিনি কবির দলে গানও বাঁধতেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হওয়ার পরে নিজের বাড়িতে বিভিন্ন পার্বণ-উৎসব উপলক্ষে কবিগানের আয়োজন করতেন। শোনা যায়, প্রেমচন্দ্রের বাড়ির উৎসবে-অনুষ্ঠানে কবিগানের আসরে ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র সবান্ধব যোগ দিতেন। মাঝে মাঝে কলেজের ছুটিতে তিনি প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে এসে পড়াশোনাও করতেন। পুকুরে ছিপ ফেলে মাছও ধরতেন!

১৮২৪-এ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্কৃত কলেজ। তার ঠিক দু’বছর পরে ১৮২৬-এ বাবার উৎসাহে প্রেমচন্দ্র কলেজে যোগ দেন। সে সময় হোরেস হেম্যান উইলসন কলেজের সেক্রেটারি ছিলেন। প্রথম দিন তিনি শাস্ত্র সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে প্রেমচন্দ্রকে কবিতা লিখতে বলেন। অল্প সময়ের মধ্যে প্রেমচন্দ্র উইলসন সাহেবের সংস্কৃত ভাষায় অনুরাগ, তাঁর নানা গুণ সম্পর্কে শ্লোক রচনা করেছিলেন। ‘ভবান্ ধন্যঃ শ্রীহোরেস উইলসন সরস্বতী। লক্ষ্মীবাণী চিরদ্বন্দ্বং ভবতৈব নিরাকৃতং।।’ এর অর্থ, হোরেস উইলসন তুমি সরস্বতী, ধন্য তুমি, বুঝলাম আমি। লক্ষ্মী সরস্বতী, দুয়ে শত্রু বারো মাস, একত্র তোমারি গুণে, করিছেন বাস! রচনাটি দেখে উইলসন সাহেব অত্যন্ত খুশি হয়ে অবাক দৃষ্টিতে প্রেমচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

কলেজে কিছু দিনের মধ্যে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এঁরা দু’জনেই বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য উৎসাহী ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে যখন ‘সংবাদ প্রভাকর’ সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হয়, ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে প্রেমচন্দ্র তার সম্পাদনা করতেন।

প্রেমচন্দ্র ‘পুরুষোত্তম-রাজাবলী’ নামক একটি কাব্য লেখার পাশাপাশি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের টীকা রচনা করেছিলেন। আগে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’-এর সপ্তম সর্গ পর্যন্ত এ দেশে পাওয়া গেলেও অষ্টম সর্গ সহ সম্পূর্ণ গ্রন্থটি পাওয়া যেত না। কাপ্তেন মার্সেল ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় অষ্টম সর্গ সহ সম্পূর্ণ গ্রন্থটি পাওয়া গেলে প্রেমচন্দ্র এর টীকা রচনা করে ‘কুমারসম্ভব’-এর অষ্টম সর্গ প্রকাশ করেছিলেন। আগে এ দেশে সংস্কৃত নাটকগুলি ছাপা না হওয়ায় সাধারণ মানুষ সেগুলি পড়ার সুযোগ পেতেন না। ১৮৩৯-’৪০ নাগাদ প্রেমচন্দ্রই উদ্যোগী হয়ে মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ প্রথম বাংলা অক্ষরে ছাপিয়েছিলেন।

অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রেমচন্দ্র প্রাচীন তাম্রশাসন এবং পাথরের ফলক পাঠোদ্ধার করতে পারতেন। এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস প্রিন্সেপ পূর্ববঙ্গ, ওডিশা এবং মগধ থেকে উদ্ধার হওয়া সংস্কৃত-মিশ্রিত পালি ভাষার তাম্রশাসন এবং পাথরের ফলক প্রেমচন্দ্রের সাহায্যে পাঠোদ্ধার করে বহু ঐতিহাসিক তথ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

শোনা যায়, রাজা রাধাকান্ত দেব কোনও জটিল শাস্ত্রের মীমাংসার সময়ে প্রেমচন্দ্রের মতামত না পেলে সন্তুষ্ট হতেন না। কলেজে প্রেমচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে প্রায় রোজই আসতেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। পাশ্চাত্য নাটক ও কাব্যের প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলুটোলার শ্রীকৃষ্ণ মল্লিক তাঁর কাছে শ্রীমদ্ভাগবতের পাঠ ও ব্যাখ্যা শুনতে আসতেন। প্রেমচন্দ্রও তাঁর কাছে শেক্‌সপিয়রের কাব্যগুলির ব্যাখ্যা মন দিয়ে শুনতেন এবং দেশীয় নাটকের সঙ্গে তুলনা করতেন।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ্য। সেই সময় মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। এমন সময় পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের একান্ত ইচ্ছায় নাটকটি এক বার প্রেমচন্দ্রকে পড়িয়ে নেওয়ার কথা ওঠে। মধুসূদন নাটকটির কয়েকটি ফর্মা এক বন্ধুর হাত দিয়ে প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। যথাসময়ে প্রেমচন্দ্র নাটকটি পড়ে মধুসূদনকে ফেরতও দেন। তবে নাটকটি পড়ে প্রেমচন্দ্র কোনও ভুলত্রুটির উল্লেখ না করায় মধুসূদন অবাক হয়ে সেই বন্ধুর কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। এই কথাটি যখন প্রেমচন্দ্রের কানে পৌঁছয় তিনি বলেছিলেন, কোনও চিহ্ন রাখতে গেলে, অনেক চিহ্ন থেকে যাবে, তার চেয়ে বরং যেমন আছে তাতে কোনও ক্ষতি নেই। বন্ধুর মুখে প্রেমচন্দ্রের এমন মতামত শুনে মধুসূদন তাঁকে অত্যন্ত দাম্ভিক মনে করেছিলেন। পরে মধুসূদনের সঙ্গে যখন প্রেমচন্দ্রের দেখা হয় তখন মধুসূদন নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্বীকার করেছিলেন যে সংস্কৃত ভাষায় অলঙ্কার না পড়ে বাংলায় নাটক লেখায় ত্রুটি হয়েছে।

প্রেমচন্দ্র অহংকারী ছিলেন না। বরং সকলকে সম্মান করতেন। হারা নামে এক ধোপা তাঁর কাপড় কাচত। নিপুণ ভাবে কাজ করলেও কাপড় কেচে ফেরত দিতে সে বড় দেরি করত। আর সেই সঙ্গে দিত নানান অজুহাত। এমনটা বহু বছর ধরে চলতে থাকায় প্রেমচন্দ্র এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। এক দিন প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে এসে হারা কাপড়ের পুঁটলি সবেমাত্র নামিয়েছে, এমন সময় প্রেমচন্দ্র তাঁর কাজের লোকটিকে বললেন, কাচতে দেওয়া কাপড় গুনে নিয়ে হারাকে বিদায় করে দিতে। কথাটি হারা শুনতে পেয়ে বলেছিল, এ দুনিয়ায় ‘সর্বস্কন্দী’-র হাত থেকে কারও রেহাই নেই। আপন মনে আরও কথা বলছে নিজের মনে, এমন সময় প্রেমচন্দ্র সেখানে এসে হারাকে বললেন, তিনি এই ‘সর্বস্কন্দী’ কথাটির অর্থ বুঝতে পারলেন না।

হারা প্রেমচন্দ্রকে এক তৃষ্ণার্ত ব্রাহ্মণের এক চণ্ডালের সঙ্গে কথোপকথনের কাহিনি শোনাল। সেই চণ্ডাল নিজের পরিচয় দিয়েছিল ‘সর্বস্কন্দী’ বলে। কেননা ব্রাহ্মণ কিংবা দেবতা, সে সকলেরই কাঁধে চাপে। এ বার প্রেমচন্দ্র বুঝলেন, ‘সর্বস্কন্দী’-র অর্থ চণ্ডাল বা রাগ। যা কারও কাঁধে চড়লে মানুষ নিজের যুক্তি, বুদ্ধি, সব কিছু হারিয়ে ফেলে। হারার মুখে এমনটা শুনে প্রেমচন্দ্র এতটুকু রাগ করেননি। বরং হারার গভীর উপলব্ধি ও জ্ঞানের প্রশংসা করে বলেছিলেন, এখন থেকে তিনি হারার শাগরেদ হলেন। হারাকে তিনি ‘ওস্তাদজি’ বলে ডাকতেন।

কর্মসূত্রে প্রেমচন্দ্র দীর্ঘ ৩১ বছর ৯ মাস সংস্কৃত কলেজে অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপনা করার পর অবসর নেন। এর পর কাশীতে চলে যান। সেখানে তিনি প্রায় চার বছর জীবিত ছিলেন। ১৮৬৭-তে কাশীতে প্রেমচন্দ্রের মৃত্যু হয়। জীবনের শেষ সময়ে প্রেমচন্দ্রের স্ত্রী ছাড়া আর কোনও আত্মীয় পাশে ছিল না। তবে ঈশ্বরচন্দ্রের বাবা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় সে সময় কাশীতে, প্রেমচন্দ্রের শেষশয্যায় ও অন্ত্যেষ্টিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন।

পুনশ্চ: প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের কোনও ছবি পাওয়া যায় না। তাঁর পঞ্চম পুরুষ বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের বাড়িতেও প্রেমচন্দ্রের কোনও ছবি নেই। শিক্ষক দিবসের আগে এ বারেও তাই ছবিহীন থেকে গেলেন বিদ্যাসাগরের মাস্টারমশাই। 🙏🙏🙏

#COLLECTED*

সোমনাথ মন্দিরের কথা


   সোমনাথ মন্দিরের কথা



   ফেসবুক থেকে          শেয়ার করেছেন               প্রণব কুমার কুণ্ডু

সোমনাথ মন্দির ভারতের একটি প্রসিদ্ধ শিব মন্দির। গুজরাট রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সৌরাষ্ট্রঅঞ্চলের বেরাবলের নিকটস্থ প্রভাস ক্ষেত্রে এই মন্দির অবস্থিত। এটি হিন্দু দেবতা শিবের দ্বাদশ লিঙ্গের মধ্যে পবিত্রতম। সোমনাথ শব্দটির অর্থ “চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা”। সোমনাথ মন্দিরটি ‘চিরন্তন পীঠ’ নামে পরিচিত। কারণ অতীতে ছয় বার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মন্দিরটি সত্বর পুনর্নিমিত হয়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জুনাগড়ের ভারতভুক্তির সময় এই অঞ্চল পরিদর্শন করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলবর্তমান মন্দিরটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মন্দিরের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান ভারত সরকারের অপর এক মন্ত্রী কে. এম. মুন্সি।
ইতিহাস
কথিত আছে, সোমনাথের প্রথম মন্দিরটি খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে বিদ্যমান ছিল।
গুজরাটের বল্লভীর যাদব রাজারা ৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। ৭২৫ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধের আরব শাসনকর্তা জুনায়েদ তাঁর সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এই মন্দিরটি ধ্বংস করে দেন। তারপর ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে গুজ্জর প্রতিহার রাজা দ্বিতীয় নাগভট্টসোমনাথের তৃতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল লাল বেলেপাথরে নির্মিত সুবিশাল একটি মন্দির।
১০২৪ খ্রিস্টাব্দে মামুদ গজনি আরেকবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন। ১০২৬ থেকে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দের মাঝে কোনো এক সময়ে গুজ্জর পরমার রাজা মালোয়ার ভোজ ও সোলাঙ্কি রাজা আনহিলওয়ারার প্রথম ভীমদেব আবার মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল কাঠের তৈরি। কুমারপাল (রাজত্বকাল ১১৪৩-৭২) কাঠের বদলে একটি পাথরের মন্দির তৈরি করে দেন।
১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজিরসৈন্যবাহিনী পুনরায় মন্দিরটি ধ্বংস করে। হাসান নিজামির তাজ-উল-মাসির লিখেছেন, গুজরাটের রাজা করণ পরাজিত হন, তাঁর সেনাবাহিনী পলায়ন করে, "পঞ্চাশ হাজার কাফেরকে তরবারির আঘাতে নরকে নিক্ষেপ করা হয়" এবং "বিজয়ীদের হাতে আসে কুড়ি হাজারেরও বেশি ক্রীতদাস ও অগণিত গবাদি পশু"। ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে সৌরাষ্ট্রের চূড়াসম রাজা মহীপাল দেব আবার মন্দিরটি নির্মাণ করান। তাঁর পুত্র খেঙ্গর ১৩২৬ থেকে ১৩৫১ সালের মাঝে কোনো এক সময়ে মন্দিরে শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান প্রথম মুজফফর শাহ আবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন। মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হলে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান মাহমুদ বেগদা আবার এটি ধ্বংস করে দেন।
কিন্তু এবারও মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়। ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দিরটি ধ্বংস করেন। আওরঙ্গজেব সোমনাথ মন্দিরের জায়গায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদে হিন্দু শাস্ত্র-ভিত্তিক মোটিফগুলি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েনি।
পরে ১৭৮৩ সালে পুণের পেশোয়া, নাগপুরের রাজা ভোঁসলে, কোলহাপুরের ছত্রপতি ভোঁসলে, ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই হোলকর ও গোয়ালিয়রের শ্রীমন্ত পাতিলবুয়া সিন্ধের যৌথ প্রচেষ্টায় মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মূল মন্দিরটি মসজিদে পরিণত হওয়ায় সেই জায়গায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করা যায় নি। মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ধ্বংসাবশেষের পাশে।
স্বাধীন ভারতে সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণ
স্বাধীনতার আগে, প্রভাস পত্তন ছিল দেশীয় রাজ্য জুনাগড়ের অংশ। জুনাগড়ের ভারতভুক্তির পর ১৯৪৭ সালের ১২ নভেম্বর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল জুনাগড়-পুনর্গঠনের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে উপযুক্ত নির্দেশ দিতে আসেন। সেই সময়ই তিনি সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন।
সর্দার প্যাটেল, কে এম মুন্সি ও কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর কাছে গেলে, গান্ধীজি তাঁদের আশীর্বাদ করেন। তবে তিনি বলেন, মন্দির নির্মাণের খরচ যেন সরকার বহন না করে। তিনি জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দেন। পুনর্নির্মাণের কাজে যুক্ত হতে পেরে তিনি নিজে গর্বিত, এমন কথাও বলেন। কিন্তু তারপরই গান্ধীজি ও সর্দার প্যাটেলের মৃত্যু হলে, নেহেরু সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী কে এম মুন্সি একাই মন্দির পুনর্নির্মাণের কাজটি এগিয়ে নিয়ে চলে।
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে ধ্বংসাবশেষ সাফ করে ফেলা হয়। আওরঙ্গজেব নির্মিত মসজিদটি কয়েক মাইল দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৫১ সালের মে মাসে কে এম মুন্সির আমন্ত্রণে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ মন্দিরের শিলান্যাস করেন। রাজেন্দ্র প্রসাদ তাঁর ভাষণে বলেন, "যেদিন শুধুমাত্র এই ভিত্তির উপর এক অসামান্য মন্দিরই নির্মিত হবে না, বরং প্রাচীন সোমনাথ মন্দির ভারতের যে ঐশ্বর্যের প্রতীক ছিল, সেই ঐশ্বর্য ভারত ফিরে পাবে, সেইদিনই আমার দৃষ্টিতে সোমনাথ মন্দির পুননির্মিত হবে।" তিনি আরও বলেন, "ধ্বংসের শক্তির চেয়ে যে সৃষ্টির শক্তি মহৎ তার প্রতীক সোমনাথ মন্দির।"
এই সময় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কে এম মুন্সির মধ্যে এক মতান্তর দেখা দেয়। নেহেরু এই মন্দির পুনর্নির্মাণকে হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলন হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কে এম মুন্সি মনে করেছিলেন, এই মন্দির পুনর্নির্মাণ স্বাধীনতার ফলস্রুতি এবং অতীতে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হওয়া অবিচারের প্রতিকার।
সোমনাথ মন্দির বর্তমানে শ্রীসোমনাথ ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়।


অনির্বাণের ‘পত্রং পুষ্পম্‌’ থেকে


অনির্বাণের ‘পত্রং পুষ্পম্‌’ থেকে


শেয়ার করেছেন         'বর্তমান' থেকে           প্রণব কুমার কুণ্ডু


অমৃতকথা

কুণ্ডলিনী-শক্তি

তুমি অনুভূতির কথা যা লিখেছ, তাতে বুঝতে পারছি, কাজ ঠিক মতই হচ্ছে। ঐ নরম তুলোর মত অনুভবটির কথা খুব ভাল লাগল। ওটি Psychic-এর অনুভূতি, যোগীরা যাকে কুণ্ডলিনী-শক্তি বলেন। ওর নানা রূপ আছে। তোমার বেলায় ওটিকে ‘কিশোরী-চেতনা’ নাম দিতে পারি। এক সময় আমি ওকে বলতাম চম্পাবতী। ওর আত্মোন্মীলনের ছন্দটি বড় সুন্দর। ঠিক ফুল ফোটার মত। ওর মাধুরীতে সমস্ত সত্তাকে ও ঐ আইপোমিয়ার রেশম-চিক্কণ আভায় গলিয়ে দিতে পারে। একটু নীচে নেমে এলে এই চেতনাই আবার অপ্সরা-চেতনায় রূপান্তরিত হয়। নারী তখন মোহিনী হয়। কিন্তু মহাশূন্যের পানে ওকে যদি মেলে রাখা যায়, তাহলে নারী হয় গোপী।
সঙ্গীতের বৈদিক আর লৌকিক ভেদ নিয়ে পণ্ডিতদের আলোচনা বহিরঙ্গ আলোচনা মাত্র। বৈদিক সঙ্গীতের অর্থাৎ সাম-সঙ্গীতের মূলভাবটা হচ্ছে পৌরুষের বা রাগের। মহাব্রত-যাগে মেয়েদের গাইবার বিধান ছিল, তা সামগান নয়। আমার বিশ্বাস, তাতে রাগিণীর বিকাশ হতো। ঐ ধারাই দেশী সঙ্গীতের ধারা। সঙ্গীতেও পুরুষ-প্রকৃতির সংমিশ্রণ হয়েছে। সঙ্গীতের মূল কথাটা হল স্বরের বিন্যাসে ভাবের জাগরণ। আমাদের সাধারণ কথা ও সুর আছে, তাই দিয়ে বাচ্যার্থকে ছাপিয়ে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করি। যে সুরে দৃঢ় সঙ্কল্প প্রকাশ পায়, সে সুরে তো আদর-সোহাগ প্রকাশ পায় না। ভাব অনুভাবে (expression) অভিব্যক্ত হয়, অর্থাৎ সুর রূপ নেয়। যে গায় বা বাজায় প্রথম রূপ নেয় তার মাঝে। তারপর তা শ্রোতাতে সংক্রামিত হয়। দুয়ের যোগাযোগে সুর ভাবলোকে মূর্তিমান হয়। তখন তাকে প্রত্যক্ষ হতে দেখা যায়। আধুনিক ওস্তাদী গানে আমি দেখি শুধু নানা কসরত; অনুভাবের পরিচয় হতাশাজনক রূপে কম। সুর যদি আসরের আবহে মূর্তি না নিতে পারল, তাহলে সবই বৃথা। কীর্তনে তবুও অনুভাব কতকটা ফোটে, কিন্তু অন্যত্র বলতে গেলে কিছুই না। artist এবং শ্রোতা দুই-ই সেসব জায়গায় বর্বর। রবীন্দ্রনাথের ‘গাহিছে কাশীনাথ’ কবিতাটি মনে করো। সেখানে আবহ-সৃষ্টির ইঙ্গিত আছে। এই আবহ-সৃষ্টি না করতে পারলে স্বর হতে রূপের সৃষ্টি হয় না।
পতঞ্জলি চিত্তকে পঞ্চভূমিকে বলেছেন— তিনটা ভূমি প্রাকৃত গুণময়, দুটা ভূমি অপ্রাকৃত। পাঁচ ভূমিতে পাঁচরকম ভালবাসা ফোটে। মূঢ়ভূমির ভালবাসা অন্ধ জৈব আকর্ষণ— যা সর্বজীবসাধারণ। ক্ষিপ্তভূমির প্রেম রজোগুণময়, তাতে চাঞ্চল্য আছে লালসা আছে, যার ছবি চারিদিকে ছড়ানো। বিক্ষিপ্তভূমির প্রেম সাত্ত্বিক। সেখানে প্রেম idealised— রবীন্দ্রনাথের মহুয়াতে তার অনেক নিদর্শন ছড়ানো। এই প্রেমই সুস্থ সমাজ গড়তে পারে। তার পরের ভূমি হল একাগ্র এবং নিরুদ্ধ। এই একাগ্রভূমির প্রেমই গোপীর প্রেম। এটা মনের ওপারে বিজ্ঞানভূমির কথা। কিশোরীচেতনায় এটি খুব সহজেই আসে। তারও উজানে আকাশের শূন্য নিস্পন্দ চেতনায় জাগে আত্মারামের ভালবাসা— চিত্তের নিরুদ্ধভূমিতে। এই হলো পুরুষোত্তমের প্রেম। সে প্রেম প্রসন্ন উদার স্নিগ্ধতায় জগতের পানে চেয়ে আছে, আর মহাপ্রকৃতি বিবশ হয়ে তার বুকে ঢলে পড়ছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রকৃতির প্রেমকে সুন্দর করে আঁকা হয়েছে; কিন্তু ঐ পুরুষের প্রেমের ছবি কোথাও ফুটতে দেখিনি। আমার কতকগুলি কবিতায় তাকে রূপ দিতে চেষ্টা করেছিলাম।
কিশোরীর ভালবাসা জৈব আকর্ষণে জড়ের দিকে নেমে যাবার সময় ঐ অপ্সরা-চেতনার সৃষ্টি হয়। এইখানকার ছবিটাই বৈষ্ণব কবি একটু বেশী ফলাও করে বর্ণনা করেছেন, যেটা আমি বৈষ্ণব কবিতার ত্রুটি বলে মনে করি। জৈব আকর্ষণটা হ’ল প্রকৃতির একটা কৌশল। বহু জীব সৃষ্টি করে তার থেকে বাছাই করে-করে একদিন হয়তো সে চিরকিশোর আর চিরকিশোরীকে পেয়ে যাবে ঐ Natural Selection-এর তাগিদে, তাই কিশোরীকে নামিয়ে আনে নীচে। এটা তার সকরুণ sacrifice বলতে পার। কি করা? Matter থেকে spirit কে evolved হতে হলে এই ভুলের মাশুলটুকু দিতে হবে যে!

অনির্বাণের ‘পত্রং পুষ্পম্‌’ থেকে

বাংলা বানানের নিয়ম জানা


    বাংলা বানানের নিয়ম জানা


    ফেসবুক থেকে       শেয়ার করেছেন         প্রণব কুমার কুণ্ডু

সহজ বাংলা বানানের নিয়ম

(Ahammad Ali-র টাইমলাইন থেকে।)

১. দূরত্ব বোঝায় না এরূপ শব্দে উ-কার যোগে ‘দুর’ (‘দুর’ উপসর্গ) বা ‘দু+রেফ’ হবে। যেমন— দুরবস্থা, দুরন্ত, দুরাকাঙ্ক্ষা, দুরারোগ্য, দুরূহ, দুর্গা, দুর্গতি, দুর্গ, দুর্দান্ত, দুর্নীতি, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, দুর্নাম, দুর্ভোগ, দুর্দিন, দুর্বল, দুর্জয় ইত্যাদি।

২. দূরত্ব বোঝায় এমন শব্দে ঊ-কার যোগে ‘দূর’ হবে। যেমন— দূর, দূরবর্তী, দূর-দূরান্ত, দূরীকরণ, অদূর, দূরত্ব, দূরবীক্ষণ ইত্যাদি।

৩. পদের শেষে ‘-জীবী’ ঈ-কার হবে। যেমন— চাকরিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, আইনজীবী ইত্যাদি।

৪. পদের শেষে ‘-বলি’ (আবলি) ই-কার হবে। যেমন— কার্যাবলি, শর্তাবলি, ব্যাখ্যাবলি, নিয়মাবলি, তথ্যাবলি ইত্যাদি।

৫. ‘স্ট’ এবং ‘ষ্ট’ ব্যবহার: বিদেশি শব্দে ‘স্ট’ ব্যবহার হবে। বিশেষ করে ইংরেজি st যোগে শব্দগুলোতে ‘স্ট’ ব্যবহার হবে। যেমন— পোস্ট, স্টার, স্টাফ, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, স্ট্যাটাস, মাস্টার, ডাস্টার, পোস্টার, স্টুডিও, ফাস্ট, লাস্ট, বেস্ট ইত্যাদি। ষত্ব-বিধান অনুযায়ী বাংলা বানানে ট-বর্গীয় বর্ণে ‘ষ্ট’ ব্যবহার হবে। যেমন— বৃষ্টি, কৃষ্টি, সৃষ্টি, দৃষ্টি, মিষ্টি, নষ্ট, কষ্ট, তুষ্ট, সন্তুষ্ট ইত্যাদি।

৬. ‘পূর্ণ’ এবং ‘পুন’ (পুনঃ/পুন+রেফ/পুনরায়) ব্যবহার : ‘পূর্ণ’ (ইংরেজিতে Full/Complete অর্থে) শব্দটিতে ঊ-কার এবং র্ণ যোগে ব্যবহার হবে। যেমন— পূর্ণরূপ, পূর্ণমান, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ ইত্যাদি। ‘পুন’ (পুনঃ/পুন+রেফ/পুনরায়— ইংরেজিতে Re- অর্থে) শব্দটিতে উ-কার হবে এবং অন্য শব্দটির সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবহার হবে। যেমন— পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পুনঃপুন, পুনর্জীবিত, পুনর্নিয়োগ, পুনর্নির্মাণ, পুনর্মিলন, পুনর্লাভ, পুনর্মুদ্রিত, পুনরুদ্ধার, পুনর্বিচার, পুনর্বিবেচনা, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ইত্যাদি।

৭. পদের শেষে '-গ্রস্থ’ নয়,  ‘-গ্রস্ত’ হবে। যেমন— বাধাগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত ইত্যাদি।

৮. অঞ্জলি দ্বারা গঠিত সকল শব্দে ই-কার হবে। যেমন— অঞ্জলি, গীতাঞ্জলি, শ্রদ্ধাঞ্জলি ইত্যাদি।

৯. ‘কে’ এবং ‘-কে’ ব্যবহার:  প্রশ্নবোধক অর্থে ‘কে’ (ইংরেজিতে Who অর্থে) আলাদা ব্যবহার হয়। যেমন— হৃদয় কে? প্রশ্ন করা বোঝায় না এমন শব্দে ‘-কে’ একসাথে ব্যবহার হবে। যেমন— হৃদয়কে আসতে বলো।

১০. বিদেশি শব্দে ণ, ছ, ষ ব্যবহার হবে না। যেমন— হর্ন, কর্নার, সমিল (করাতকল), স্টার, আস্‌সালামু আলাইকুম, ইনসান, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি।

১১. অ্যা, এ ব্যবহার: বিদেশি বাঁকা শব্দের উচ্চারণে ‘অ্যা’ ব্যবহার হয়। যেমন— অ্যান্ড (And), অ্যাড (Ad/Add), অ্যাকাউন্ট (Account), অ্যাম্বুলেন্স (Ambulance), অ্যাসিস্ট্যান্ট (Assistant), অ্যাডভোকেট (Advocate), অ্যাকাডেমিক (Academic), অ্যাডভোকেসি (Advocacy) ইত্যাদি। অবিকৃত বা সরলভাবে উচ্চারণে ‘এ’ হয়। যেমন— এন্টার (Enter), এন্ড (End), এডিট (Edit) ইত্যাদি।

১২. ইংরেজি বর্ণ S-এর বাংলা প্রতিবর্ণ হবে ‘স’ এবং sh, -sion, -tion শব্দগুচ্ছে ‘শ’ হবে। যেমন— সিট (Seat/Sit), শিট, (Sheet), রেজিস্ট্রেশন (Registration), মিশন (Mission) ইত্যাদি।

১৩. আরবি বর্ণ ش (শিন)-এর বাংলা বর্ণ রূপ হবে ‘শ’ এবং ث (সা), س (সিন) ও ص (সোয়াদ)-এর বাংলা বর্ণ রূপ হবে ‘স’। ث (সা), س (সিন) ও ص (সোয়াদ)-এর উচ্চারিত রূপ মূল শব্দের মতো হবে এবং বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ‘স’ ব্যবহার হবে। যেমন— সালাম, শাহাদত, শামস্‌, ইনসান ইত্যাদি। আরবি, ফারসি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা থেকে আগত শব্দসমূহে ছ, ণ ও ষ ব্যবহার হবে না।

১৪. শ ষ স :
তৎসম শব্দে ষ ব্যবহার হবে। খাঁটি বাংলা ও বিদেশি শব্দে ষ ব্যবহার হবে না। বাংলা বানানে ‘ষ’ ব্যবহারের জন্য অবশ্যই ষত্ব-বিধান, উপসর্গ, সন্ধি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বাংলায় অধিকাংশ শব্দের উচ্চারণে ‘শ’ বিদ্যমান। এমনকি ‘স’ দিয়ে গঠিত শব্দেও ‘শ’ উচ্চারণ হয়। ‘স’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ বাংলায় খুবই কম। ‘স’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছে— সমীর, সাফ, সাফাই। যুক্ত বর্ণ, ঋ-কার ও র-ফলা যোগে যুক্তধ্বনিতে ‘স’-এর উচ্চারণ পাওয়া যায়। যেমন— সৃষ্টি, স্মৃতি, স্পর্শ, স্রোত, শ্রী, আশ্রম ইত্যাদি।

১৫. সমাসবদ্ধ পদ ও বহুবচন রূপী শব্দগুলোর মাঝে ফাঁক রাখা যাবে না। যেমন— চিঠিপত্র, আবেদনপত্র, ছাড়পত্র (পত্র), বিপদগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত (গ্রস্ত), গ্রামগুলি/গ্রামগুলো (গুলি/গুলো), রচনামূলক (মূলক), সেবাসমূহ (সমূহ), যত্নসহ, পরিমাপসহ (সহ), ত্রুটিজনিত, (জনিত), আশঙ্কাজনক, বিপজ্জনক (জনক), অনুগ্রহপূর্বক, উল্লেখপূর্বক (পূর্বক), প্রতিষ্ঠানভুক্ত, এমপিওভুক্ত, এমপিওভুক্তি (ভুক্ত/ভুক্তি), গ্রামভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক, রোলভিত্তিক (ভিত্তিক), অন্তর্ভুক্তকারণ, এমপিওভুক্তকরণ, প্রতিবর্ণীকরণ (করণ), আমদানিকারক, রফতানিকারক (কারক), কষ্টদায়ক, আরামদায়ক (দায়ক), স্ত্রীবাচক (বাচক), দেশবাসী, গ্রামবাসী, এলাকাবাসী (বাসী), সুন্দরভাবে, ভালোভাবে (ভাবে), চাকরিজীবী, শ্রমজীবী (জীবী), সদস্যগণ (গণ), সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী (কারী), সন্ধ্যাকালীন, শীতকালীন (কালীন), জ্ঞানহীন (হীন), দিনব্যাপী, মাসব্যাপী, বছরব্যাপী (ব্যাপী) ইত্যাদি। এ ছাড়া যথাবিহিত, যথাসময়, যথাযথ, যথাক্রমে, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহিঃপ্রকাশ শব্দগুলো একত্রে ব্যবহার হয়।

১৬. বিদেশি শব্দে ই-কার ব্যবহার হবে। যেমন— আইসক্রিম, স্টিমার, জানুয়ারি, ফ্রেরুয়ারি, ডিগ্রি, চিফ, শিট, শিপ, নমিনি, কিডনি, ফ্রি, ফি, ফিস, স্কিন, স্ক্রিন, স্কলারশিপ, পার্টনারশিপ, ফ্রেন্ডশিপ, স্টেশনারি, নোটারি, লটারি, সেক্রেটারি, টেরিটরি, ক্যাটাগরি, ট্রেজারি, ব্রিজ, প্রাইমারি, মার্কশিট, গ্রেডশিট ইত্যাদি।

১৭. উঁয়ো (ঙ) ব্যবহার যোগে কিছু শব্দ। এক্ষেত্রে অনুস্বার (ং) ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— অঙ্ক, অঙ্কন, অঙ্কিত, অঙ্কুর, অঙ্গ, অঙ্গন, আকাঙ্ক্ষা, আঙ্গুল/আঙুল, আশঙ্কা, ইঙ্গিত, উলঙ্গ, কঙ্কর, কঙ্কাল, গঙ্গা, চোঙ্গা/চোঙা, টাঙ্গা, ঠোঙ্গা/ঠোঙা, দাঙ্গা, পঙ্‌ক্তি, পঙ্কজ, পতঙ্গ, প্রাঙ্গণ, প্রসঙ্গ, বঙ্গ, বাঙালি/বাঙ্গালি, ভঙ্গ, ভঙ্গুর, ভাঙ্গা/ভাঙা, মঙ্গল, রঙ্গিন/রঙিন, লঙ্কা, লঙ্গরখানা, লঙ্ঘন, লিঙ্গ, শঙ্কা, শঙ্ক, শঙ্খ, শশাঙ্ক, শৃঙ্খল, শৃঙ্গ, সঙ্গ, সঙ্গী, সঙ্ঘাত, সঙ্গে, হাঙ্গামা, হুঙ্কার।

১৮. অনুস্বার (ং) ব্যবহার যোগে কিছু শব্দ। এক্ষেত্রে উঁয়ো (ঙ) ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— কিংবদন্তী, সংজ্ঞা, সংক্রামণ, সংক্রান্ত, সংক্ষিপ্ত, সংখ্যা, সংগঠন, সংগ্রাম, সংগ্রহ, সংগৃহীত।
[দ্রষ্টব্য: বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ দুটি অনুস্বার (ং) দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে।]

১৯. ‘কোণ, কোন ও কোনো’-এর ব্যবহার:
কোণ : ইংরেজিতে Angle/Corner (∠) অর্থে।
কোন : উচ্চারণ হবে কোন্। বিশেষত প্রশ্নবোধক অর্থে ব্যবহার করা হয়। যেমন— তুমি কোন দিকে যাবে?
কোনো : ও-কার যোগে উচ্চারণ হবে। যেমন— যেকোনো একটি প্রশ্নের উত্তর দাও।

২০. বাংলা ভাষায় চন্দ্রবিন্দু একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ। চন্দ্রবিন্দু যোগে শব্দগুলোতে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করতে হবে; না করলে ভুল হবে। অনেক ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার না করলে শব্দে অর্থের পরিবর্তন ঘটে। এ ছাড়া চন্দ্রবিন্দু সম্মানসূচক বর্ণ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যেমন— তাহাকে>তাঁহাকে, তাকে>তাঁকে ইত্যাদি।

*২১. ও-কার: অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়া পদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ও-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব সৃষ্টি হতে পারে এমন শব্দে ও-কার ব্যবহার হবে। যেমন— মতো, হতো, হলো, কেনো, ক্রয় করো), ভালো, কালো, আলো ইত্যাদি। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ও-কার ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— ছিল, করল, যেন, কেন (কী জন্য), আছ, হইল, রইল, গেল, শত, যত, তত, কত, এত ইত্যাদি।*

২২. বিশেষণবাচক আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে। যেমন— সোনালি, রুপালি, বর্ণালি, হেঁয়ালি, খেয়ালি, মিতালি ইত্যাদি।

**২৩. জীব, -জীবী, জীবিত, জীবিকা ব্যবহার। যেমন— সজীব, রাজীব, নির্জীব, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, জীবিত, জীবিকা।**

২৪. অদ্ভুত, ভুতুড়ে বানানে উ-কার হবে। এ ছাড়া সকল ভূতে ঊ-কার হবে। যেমন— ভূত, ভস্মীভূত, বহির্ভূত, ভূতপূর্ব ইত্যাদি।

২৫. হীরা ও নীল অর্থে সকল বানানে ঈ-কার হবে। যেমন— হীরা, হীরক, নীল, সুনীল, নীলক, নীলিমা ইত্যাদি।

২৬. নঞর্থক পদগুলো (নাই, নেই, না, নি ) আলাদা করে লিখতে হবে। যেমন— বলে নাই, বলে নি, আমার ভয় নাই, আমার ভয় নেই, হবে না, যাবে না।

২৭. অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে ই-কার ব্যবহার হবে। যেমন— সরকারি, তরকারি, গাড়ি, বাড়ি, দাড়ি, শাড়ি, চুরি, চাকরি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বেআইনি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, নিচু।

২৮. ত্ব, তা, নী, ণী, সভা, পরিষদ, জগৎ, বিদ্যা, তত্ত্ব শব্দের শেষে যোগ হলে ই-কার হবে। যেমন— দায়িত্ব (দায়ী), প্রতিদ্বন্দ্বিতা (প্রতিদ্বন্দ্বী), প্রার্থিতা (প্রার্থী), দুঃখিনী (দুঃখী), অধিকারিণী (অধিকারী), সহযোগিতা (সহযোগী), মন্ত্রিত্ব, মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ (মন্ত্রী), প্রাণিবিদ্যা, প্রাণিতত্ত্ব, প্রাণিজগৎ, প্রাণিসম্পদ (প্রাণী) ইত্যাদি।

২৯. ঈ, ঈয়, অনীয় প্রত্যয় যোগ ঈ-কার হবে। যেমন— জাতীয় (জাতি), দেশীয় (দেশি ), পানীয় (পানি), জলীয়, স্থানীয়, স্মরণীয়, বরণীয়, গোপনীয়, ভারতীয়, মাননীয়, বায়বীয়, প্রয়োজনীয়, পালনীয়, তুলনীয়, শোচনীয়, রাজকীয়, লক্ষণীয়, করণীয়।

৩০. রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না৷ যেমন— অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ, কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য৷
৩১. ভাষা ও জাতিতে ই-কার হবে। যেমন— বাঙালি/বাঙ্গালি, জাপানি, ইংরেজি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি।

৩২. ব্যক্তির ‘-কারী’-তে (আরী) ঈ-কার হবে। যেমন— সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী, পথচারী, কর্মচারী ইত্যাদি। ব্যক্তির ‘-কারী’ নয়, এমন শব্দে ই-কার হবে। যেমন— সরকারি, দরকারি ইত্যাদি।

৩৩. প্রমিত বানানে শব্দের শেষে ঈ-কার থাকলে –গণ যোগে ই-কার হয়। যেমন— সহকারী>সহকারিগণ, কর্মচারী>কর্মচারিগণ, কর্মী>কর্মিগণ, আবেদনকারী>আবেদনকারিগণ ইত্যাদি।

৩৪. ‘বেশি’ এবং ‘-বেশী’ ব্যবহার: ‘বহু’, ‘অনেক’ অর্থে ব্যবহার হবে ‘বেশি’। শব্দের শেষে যেমন— ছদ্মবেশী, প্রতিবেশী অর্থে ‘-বেশী’ ব্যবহার হবে।

৩৫. ‘ৎ’-এর সাথে স্বরচিহ্ন যোগ হলে ‘ত’ হবে। যেমন— জগৎ>জগতে জাগতিক, বিদ্যুৎ>বিদ্যুতে বৈদ্যুতিক, ভবিষ্যৎ>ভবিষ্যতে, আত্মসাৎ>আত্মসাতে, সাক্ষাৎ>সাক্ষাতে ইত্যাদি।

৩৬. ইক প্রত্যয় যুক্ত হলে যদি শব্দের প্রথমে অ-কার থাকে তা পরিবর্তন হয়ে আ-কার হবে। যেমন— অঙ্গ>আঙ্গিক, বর্ষ>বার্ষিক, পরস্পর>পারস্পরিক, সংস্কৃত>সাংস্কৃতিক, অর্থ>আর্থিক, পরলোক>পারলৌকিক, প্রকৃত>প্রাকৃতিক, প্রসঙ্গ>প্রাসঙ্গিক, সংসার>সাংসারিক, সপ্তাহ>সাপ্তাহিক, সময়>সাময়িক, সংবাদ>সাংবাদিক, প্রদেশ>প্রাদেশিক, সম্প্রদায়>সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি।

৩৭. সাধু থেকে চলিত রূপের শব্দসমূহ যথাক্রমে দেখানো হলো: আঙ্গিনা>আঙিনা, আঙ্গুল>আঙুল, ভাঙ্গা>ভাঙা, রাঙ্গা>রাঙা, রঙ্গিন>রঙিন, বাঙ্গালি>বাঙালি, লাঙ্গল>লাঙল, হউক>হোক, যাউক>যাক, থাউক>থাক, লিখ>লেখ, গুলি>গুলো, শুন>শোন, শুকনা>শুকনো, ভিজা>ভেজা, ভিতর>ভেতর, দিয়া>দিয়ে, গিয়া>গিয়ে, হইল>হলো, হইত>হতো, খাইয়া>খেয়ে, থাকিয়া>থেকে, উল্টা>উল্টো, বুঝা>বোঝা, পূজা>পুজো, বুড়া>বুড়ো, সুতা>সুতো, তুলা>তুলো, নাই>নেই, নহে>নয়, নিয়া>নিয়ে, ইচ্ছা>ইচ্ছে ইত্যাদি।

৩৮. হয়তো, নয়তো বাদে সকল তো আলাদা হবে। যেমন— আমি তো যাই নি, সে তো আসে নি ইত্যাদি।
[দ্রষ্টব্য: মূল শব্দের শেষে আলাদা তো ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে।]

৩৯. ঙ, ঞ, ণ, ন, ং বর্ণের পূর্বে ঁ হবে না। যেমন— খান (খাঁ), চান, চন্দ (চাঁদ), পঞ্চ, পঞ্চাশ (পাঁচ) ইত্যাদি।

৪০. -এর, -এ ব্যবহার:
=> চিহ্নিত শব্দ/বাক্য বা উক্তির সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— গুলিস্তান ‘ভাসানী হকি ষ্টেডিয়াম’-এর সাইনবোর্ডে স্টেডিয়াম বানানটি ভুল।
=> শব্দের পরে যেকোনো প্রতীকের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— বিসর্গ (ঃ )-এর সঙ্গে স্বরধ্বনি কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির যে সন্ধি হয়, তাকে বিসর্গসন্ধি বলে।
=> বিদেশি শব্দ অর্থাৎ বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ নয় এমন শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— SMS-এর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হবে।
=> গাণিতিক শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— ৫-এর চেয়ে ২ কম।
=> সংক্ষিপ্ত শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— অ্যাগ্রো কোম্পানি লি.-এর সাথে চুক্তি।
এ ছাড়া পৃথক রূপে ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— বাংলাদেশ-এর না লিখে বাংলাদেশের, কোম্পানি-এর না লিখে কোম্পানির, শিক্ষক-এর না লিখে শিক্ষকের, স্টেডিয়াম-এ না লিখে স্টেডিয়ামে, অফিস-এ না লিখে অফিসে লিখতে হবে।

***৪১. বিসর্গ (ঃ ) ব্যবহার:
বিসর্গ একটি বাংলা বর্ণ— এটি কোনো চিহ্ন নয়। বর্ণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বিসর্গ (ঃ) হলো অঘোষ ‘হ্‌’-এর উচ্চারণে প্রাপ্ত ধ্বনি। ‘হ’-এর উচ্চারণ ঘোষ কিন্তু বিসর্গ (ঃ)-এর উচ্চারণ অঘোষ। বাংলায় ভাষায় বিস্ময়াদি প্রকাশে বিসর্গ (ঃ )-এর উচ্চারণ প্রকাশ পায়। যেমন— আঃ, উঃ, ওঃ, ছিঃ, বাঃ । পদের শেষে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার হবে না। যেমন— ধর্মত, কার্যত, আইনত, ন্যায়ত, করত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ ইত্যাদি। পদমধ্যস্থে বিসর্গ ব্যবহার হবে। যেমন— অতঃপর, দুঃখ, স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তঃস্থল, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। অর্ধ শব্দকে পূর্ণতা দানে অর্থাৎ পূর্ণ শব্দকে সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশে বিসর্গ ব্যবহার করা হলেও আধুনিক বানানে ডট ( . ) ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন— ডাক্তার>ডা. (ডাঃ), ডক্টর>ড. (ডঃ), লিমিটেড> লি. (লিঃ) ইত্যাদি। বিসর্গ যেহেতু বাংলা বর্ণ এবং এর নিজস্ব ব্যবহার বিধি আছে— তাই এ ধরনের বানানে (ডাক্তার>ডা., ডক্টর>ড., লিমিটেড> লি.) বিসর্গ ব্যবহার বর্জন করা হয়েছে। কারণ বিসর্গ যতিচিহ্ন নয়।
[সতর্কীকরণ: বিসর্গ (ঃ)-এর স্থলে কোলন ( : ) কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— অত:পর, দু:খ ইত্যাদি। কারণ কোলন ( : ) কোনো বর্ণ নয়, চিহ্ন। যতিচিহ্ন হিসেবে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার যাবে না। যেমন— নামঃ রেজা, থানাঃ লাকসাম, জেলাঃ কুমিল্লা, ১ঃ৯ ইত্যাদি।]
বিসর্গসন্ধি:
বিসর্গ (ঃ )-এর সঙ্গে স্বরধ্বনি কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির যে সন্ধি হয়, তাকে বিসর্গসন্ধি বলে। উচ্চারণের দিক থেকে বিসর্গ দু রকম :
১. র্ -জাত বিসর্গ : শব্দের শেষে র্ থাকলে উচ্চারণের সময় র্ লোপ পায় এবং র্-এর জায়গায় বিসর্গ (ঃ) হয়। উচ্চারণে র্ বজায় থাকে। যেমন— অন্তর>অন্তঃ+গত=অন্তর্গত ( অন্‌তোর্‌গতো)।
২. স্-জাত বিসর্গ : শব্দের শেষে স্ থাকলে সন্ধির সময় স্ লোপ পায় এবং স্-এর জায়গায় বিসর্গ ( ঃ ) হয়। উচ্চারণে স্ বজায় থাকে। যেমন : নমস্ > নমঃ + কার = নমস্কার ( নমোশ্‌কার্‌)।
বিসর্গসন্ধি দু-ভাবে সাধিত হয় : ১. বিসর্গ ( ঃ ) ও স্বরধ্বনি মিলে; ২. বিসর্গ ( ঃ ) ও ব্যঞ্জনধ্বনি মিলে।
১. বিসর্গ ও স্বরধ্বনির সন্ধি:
ক. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে অ-ধ্বনি থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি স্থলে ও-কার হয়। যেমন—
ততঃ + অধিক = ততোধিক
যশঃ + অভিলাষ = যশোভিলাষ
বয়ঃ + অধিক = বয়োধিক
খ. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে অ, আ, উ-ধ্বনি থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি মিলে র হয়। যেমন—
পুনঃ + অধিকার = পুনরধিকার
প্রাতঃ + আশ = প্রাতরাশ
পুনঃ + আবৃত্তি = পুনরাবৃত্তি
পুনঃ + উক্ত = পুনরুক্ত
২. বিসর্গ ও ব্যঞ্জনধ্বনির সন্ধি
ক. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে বর্গের ৩য়/ ৪র্থ/ ৫ম ধ্বনি অথবা য, র, ল, হ থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি স্থলে র-জাত বিসর্গে র/ রেফ (র্) এবং স-জাত বিসর্গে ও-কার হয়। যেমন—
র-জাত বিসর্গ : র্
অন্তঃ + গত = অন্তর্গত
পুনঃ + জন্ম = পুনর্জন্ম
অন্তঃ + ধান = অন্তর্ধান
পুনঃ + বার = পুনর্বার
অন্তঃ + ভুক্ত = অন্তর্ভুক্ত
পুনঃ + মিলন = পুনর্মিলন
স-জাত বিসর্গ : ও
মনঃ + গত = মনোগত
সদ্যঃ + জাত = সদ্যোজাত
তিরঃ + ধান = তিরোধান
তপঃ + বন = তপোবন
অধঃ + মুখ = অধোমুখ
মনঃ + যোগ = মনোযোগ
মনঃ + রম = মনোরম
মনঃ + লোভা = মনোলোভা
মনঃ + হর = মনোহর
খ. বিসর্গের পরে চ/ছ থাকলে বিসর্গের স্থলে শ; ট/ঠ থাকলে ষ এবং ত/থ থাকলে স হয়। যেমন—
নিঃ + চয় = নিশ্চয়
দুঃ + চরিত্র = দুশ্চরিত্র
ধনুঃ + টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার
নিঃ + ঠুর = নিষ্ঠুর
চতুঃ + টয় = চতুষ্টয়
দুঃ + তর = দুস্তর
নিঃ + তেজ = নিস্তেজ
ইতঃ + তত = ইতস্তত
দুঃ + থ = দুস্থ
গ. অ/আ ভিন্ন অন্য স্বরের সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে স্বরধ্বনি, বর্গের ৩য় / ৪র্থ / ৫ম ধ্বনি অথবা য, র, ল, হ থাকলে বিসর্গ স্থলে র হয়। যেমন—
নিঃ + অবধি = নিরবধি
নিঃ + আপদ = নিরাপদ
নিঃ + গত = নির্গত
নিঃ + ঘণ্ট = নির্ঘণ্ট
নিঃ + বাক = নির্বাক
নিঃ + ভয় = নির্ভয়
আবিঃ + ভাব = আবির্ভাব
আশীঃ + বাদ = আশীর্বাদ
দুঃ + অবস্থা = দুরবস্থা
দুঃ + আচার = দুরাচার
দুঃ + গতি = দুর্গতি
দুঃ + বোধ = দুর্বোধ
প্রাদুঃ + ভাব = প্রাদুর্ভাব
দুঃ + মর = দুর্মর
দুঃ + যোগ = দুর্যোগ
দুঃ + লভ = দুর্লভ
ঘ. র-জাত বিসর্গের পরে র থাকলে বিসর্গ লোপ পায় এবং প্রথমে ই-কার থাকলে তা ঈ-কার হয়। যেমন—
নিঃ + রব = নীরব
নিঃ + রস = নীরস
নিঃ + রোগ = নীরোগ
ঙ. অ/আ ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে ক, খ, প, ফ থাকলে বিসর্গ স্থলে স হয়। যেমন—
নমঃ + কার = নমস্কার
তিরঃ + কার = তিরস্কার
পুরঃ + কার = পুরস্কার
ভাঃ + কর = ভাস্কর
চ. ই/উ ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে ক, খ, প, ফ থাকলে বিসর্গ স্থলে ষ হয়। যেমন—
নিঃ + কাম = নিষ্কাম
নিঃ + পাপ = নিষ্পাপ
নিঃ + ফল = নিষ্ফল
বহিঃ + কার = বহিষ্কার
চতুঃ + পদ = চতুষ্পদ
চতুঃ + কোণ = চতুষ্কোণ
ছ. কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ধির বিসর্গ লোপ পায় না। যেমন—
প্রাতঃ + কাল = প্রাতঃকাল
মনঃ + কষ্ট = মনঃকষ্ট
শিরঃ + পীড়া = শিরঃপীড়া
অন্তঃ + করণ = অন্তঃকরণ
৪২. ম-ফলা ও ব-ফলার উচ্চারণ:
ম-ফলার উচ্চারণ:
ক. পদের প্রমে ম-ফলা থাকলে সে বর্ণের উচ্চারণে কিছুটা ঝোঁক পড়ে এবং সামান্য নাসিক্যস্বর হয়। যেমন— শ্মশান ( শঁশান্), স্মরণ (শঁরোন্)।
কখনো কখনো ‘ম’ অনুচ্চারিত থাকতে ও পারে। যেমন— স্মৃতি (সৃতি বা সৃঁতি)।
খ. পদের মধ্যে বা শেষে ম-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে সে বর্ণের দ্বিত্ব হয় এবং সামান্য নাসিক্যস্বর হয়। যেমন— আত্মীয় (আত্‌তিঁয়), পদ্ম (পদ্‌দোঁ), বিস্ময় (বিশ্‌শঁয়), ভস্মস্তূপ (ভশ্‌শোঁস্‌তুপ্‌), ভস্ম (ভশ্‌শোঁ), রশ্মি (রোশ্‌শিঁ)।
গ. গ, ঙ, ট, ণ, ন, বা ল বর্ণের সঙ্গে ম-ফলা যুক্ত হলে, ম-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যুক্ত ব্যঞ্জনের প্রথম বর্ণের স্বর লুপ্ত হয়। যেমন— বাগ্মী (বাগ্‌মি), যুগ্ম (যুগ্‌মো), মৃন্ময় (মৃন্‌ময়), জন্ম (জন্‌মো), গুল্ম (গুল্‌মো)।
ব-ফলার উচ্চারণ:
ক. শব্দের প্রমে ব-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে শুধু সে বর্ণের উপর অতিরিক্ত ঝোঁক পড়ে। যেমন— ক্বচিৎ (কোচিৎ), দ্বিত্ব (দিত্‌তো), শ্বাস (শাশ্), স্বজন (শজোন), দ্বন্দ্ব (দন্‌দো)।
খ. শব্দের মধ্যে বা শেষে ব-ফলা যুক্ত হলে যুক্ত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন— বিশ্বাস (বিশ্‌শাশ্), পক্ব (পক্‌কো), অশ্ব (অশ্‌শো)।
গ. সন্ধিজাত শব্দে যুক্ত ব-ফলায় ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন— দিগ্বিজয় (দিগ্‌বিজয়), দিগ্বলয় (দিগ্‌বলয়)।
ঘ. শব্দের মধ্যে বা শেষে ‘ব’ বা ‘ম’-এর সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন— তিব্বত (তিব্‌বত). লম্ব (লম্‌বো)।
ঙ. উৎ উপসর্গের সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বহাল থাকে। যেমন— উদ্বাস্তু (উদ্‌বাস্‌তু), উদ্বেল (উদ্‌বেল্‌)।
[দ্রষ্টব্য: আমাদের অবশ্যই বাংলা বানান ও বাংলা বানানের উচ্চারণ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কারণ বাংলা বানান ও উচ্চারণের পার্থক্য রয়েছে। যেমন— আছ (আছো), দেখা (দ্যাখা), একা (অ্যাকা) ইত্যাদি।]
#
(সংগৃহীত)

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন

পাখি ( তিন )


     পাখি ( তিন )


      ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন         প্রণব কুমার কুণ্ডু



Partha Deb এতে Indian Birds

Leiothrix, mirik ,westbengal.

Nicon. D3200.Tamron 150 600

F 6.3 Iso 1600 sp 680 , Auto


অমরনাথ গুহা


  অমরনাথ গুহা


  ফেসবুক ধেকে       শেয়ার করেছেন            প্রণব কুমার কুণ্ডু


WPF_Street/People/Travel...

Amarnath Cave...J&K, India.