বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক অশোকবিজয় রাহা


  কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক অশোকবিজয় রাহা 

  ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন            প্রণব কুমার কুণ্ডু



প্রণব কুমার কুণ্ডু













কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক
অশোকবিজয় রাহা (জন্মঃ- ১৪ নভেম্বর, ১৯১০ - মৃত্যুঃ- ১৯ অক্টোবর, ১৯৯০) (সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান অনুযায়ী)

দেশবিদেশের বহু সাহিত্যপত্র এবং সংকলন গ্রন্থে কবির প্রায় পঞ্চাশটির মতো কবিতা হিন্দী, ইংরেজী, ফরাসী ও স্পেনীয় ভাষায় মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন অশোকবিজয় এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও একসময় সজনিকান্ত দাসের শনিবারের চিঠিতে তাঁর ‘ভানুমতীর মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের ভূয়সী প্রসংশা করেন; রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তরুণ চাঁদ বলে অভিহিত করে লিখেছিলেন..."আকাশের চেয়ে আলোক বড়, /মাগিল যবে তরুণ চাঁদ/রবির কর শীতল হয়ে/করিল তারে আশীর্বাদ।"-অশোকবিজয় রাহার কবিতার চরাচর জুড়ে নিসর্গ প্রকৃতির চিত্রবর্নণা, যেখানে নৈঃশব্দ্যটুকুও ভরে যায় মায়াপ্রকৃতির বিস্ময়ে। মায়াতরু” কবিতাটি রচনার দ্বারা এই রূপদক্ষ কবির কাব্যরচনায় শিল্পকর্মের নিদর্শন পাওয়া যায়।
কবি শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্গত ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে ভুমিষ্ঠ হন। তাঁর পিতার নাম বঙ্কবিহারী রাহা, পেশায় ইনি ছিলেন কাছাড়ের চা বাগানের কর্মী এবং মাতার নাম হল ব্রহ্মময়ী দেবী। পিতা চা বাগানের কর্মী ছিলেন বলে এই খ্যাতনামা কবির শৈশবকাল কাছাড়ে আদিম বনানী পরিবেশে অতিবাহিত হয়। এই খ্যাতনামা কবি কৈশোরে কাকার নিকটে শ্রীহট্ট শহরে আগমন করে এই শহরেরই মধ্যস্থিত ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই শহরের মধ্যস্থিত মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে আই. এ., কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 1931 সালে অনার্সসহ বি. এ. এবং 1947 সালে বাংলা সাহিত্যে এম. এ. পাশ করেন। এই খ্যাতনামা কবি 1932 সাল থেকে 1951 সাল পর্যন্ত শ্রীহট্ট এবং করিমগঞ্জের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও অধ্যাপনা করে অবশেষে 1951 সালে বাংলার অধ্যাপক হিসাবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। দীর্ঘ চব্বিশ বছর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র - অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করার পর 1974 সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহন করে শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীতে নিজের তৈরী” সুরাহা” নামক বাসভবনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বসবাস করছেন। এইস্থানেই কবির দেহাবসান হয়।

এই শ্রদ্ধেয় কবি 1966 সালে বিশ্বভারতীর প্রতিনিধি হিসাবে সোভিয়েট ল্যাণ্ড নেহেরু অ্যাওয়ার্ড কমিটির আমন্ত্রণে রাশিয়ায় গমন করে রবীন্দ্রনাথ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভাষণ প্রদান করেন। এই শ্রদ্ধেয় কবি কিশোর বয়সেই কাব্যরচনা আরম্ভ করেন, তার রচিত প্রথম কবিতা শ্রীহট্ট থেকে প্রকাশিত” কমলা” পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। এই শ্রদ্ধেয় কবির রচিত দুইটি কাব্যসংকলন” ডিহাং নদীর বাঁকে” এবং” রুদ্রবসন্ত” শ্রীহট্ট থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 1941 সালে প্রকাশিত হলে কলকাতার কাব্যরসিক সমাজ বিস্মিত ও চমকিত হয়। 1942 সালে কবি বুদ্ধদেব বসু তার “এক পয়সার সিরিজে” এই শ্রদ্ধেয় কবির দ্বারা রচিত” ভানুমতীর মাঠ” প্রকাশ করে এই কবিকে একবারে প্রথম সারির কবি হিসাবে অভিনন্দিত করেন। এই প্রথিতযশা কবি দশটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। সেই কাব্যগ্রন্থগুলির নাম হল -- ডিহাং নদীর বাঁকে (1941), রুদ্রবসন্ত (1941), ভানুমতীর মাঠ (1942), জল - ডম্বরু পাহাড় (1945), রক্তসন্ধ্যা (1945), শেষচুড়া (1945), উড়োচিঠির ঝাঁক (1951), যেথা ঐ চৈত্রের শালবন (1961), ঘন্টা বাজে : পর্দা সরে যায় (1981) এবং পৌষফসল (1983)। জীবনানন্দের জগৎ, রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা, গীতিকাব্যে রবীন্দ্রপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি এই প্রথিতযশা কবির উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। এই মহামান্য কবির রচিত” বাণীশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ” একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ। এই মহামান্য কবি তার কাব্যগুলিতে নদী, পাহাড়, অরন্য ও প্রকৃতির অপরূপ শোভারাশির বর্ণাঢ্য চিত্র অঙ্কন করেছেন। অভিনব রূপকল্প নির্মাণে বাংলা সাহিত্যজগতে এই মহামান্য কবির সমকক্ষ কবি খুব একটা চোখে পড়ে না।

একটি সন্ধ্যা
বেতারে কার সেতার বাজে, বাংলা খবর শেষ,
শুনে শুনে পথ দিয়ে যাই, মনে সুরের রেশ,
মফস্বলের শহরতলি খানিকটা বন –ঘেঁষা,
ঝোপে ঝাড়ে সন্ধ্যা নামে বুনো গন্ধে মেশা,
বাঁকের মোড়েই হঠাৎ আসে রাঙা মাটির টিলা
ওর পিছনে উঁকি মারে পাহাড়টা একশিলা,
শেয়াল-ডাকা রাত্রি আসে যেই আসি ওর কাছে,
বাদুরগুলো ঝাপটা মারে কাক-ডুমুরের গাছে,
মাথার উপর ডাকল পেঁচা, চমকে উঠি—আরে!
আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে!
~~~~০০০~~~~
শীত-রাত
গ্রাম-বুড়ী কাঁথামুড়ি খড়ের ধোঁয়ায়
নাক ডেকে ঘাড় গুঁজে বেজায় ঘুমায়,
পথঘাট ঘুমে কাঠ, কোথা নেই সাড়া,
এক পায়ে ঘুম যায় গাছপালা খাড়া,
ঝোপে ঝোপে শেয়ালেরা সব চুপচাপ,
শিশিরের ফোঁটাগুলি ঝরে টুপটাপ,
ইঁদুরের বাদুড়ের নেই খুট্খাট,
একধারে শুয়ে আছে ধান-কাটা মাঠ।
বটগাছে কেঁদে ওঠে শকুনের ছা
জেগে উঠে পাখসাট মারে তার মা,
একা একা কুয়াশায় এই শীত-রাতে
কানা চাঁদ ভাঙা এক লণ্ঠন হাতে
আদম পুরের দিকে চালিয়েছে পা।
~~~~০০০~~~~
মায়াতরু
এক যে ছিল গাছ
সন্ধ্যে হলেই দু হাত তুলে জুড়ত ভূতের নাচ।
আবার হঠাৎ কখন
বনের মাথায় ঝিলিক মেরে মেঘ উঠত যখন
ভালুক হয়ে ঘাড় ফুলিয়ে করত সে গরগর
বিষ্টি হলেই আসত আবার কম্প দিয়ে জ্বর।
এক পশলার শেষে
আবার কখন চাঁদ উঠত হেসে
কোথায়-বা সেই ভালুক গেল, কোথায়-বা সেই গাছ,
মুকুট হয়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ হীরার মাছ।
ভোরবেলাকার আবছায়াতে কাণ্ড হত কী যে
ভেবে পাইনে নিজে,
সকাল হল যেই
একটিও মাছ নেই,
কেবল দেখি পড়ে আছে ঝিকিরমিকির আলোর
রুপালি এক ঝালর।
~~~~০০০~~~~
একটি চলচ্চিত্র
জানালায় বসে বসে দেখি চেয়ে চেয়ে
ছোট্ট তারাটি নামে মেঘ-সিঁড়ি বেয়ে,
সেতারের দ্রুত তালে নাচে তার পা,
সন্ধ্যার সরোবরে ধুয়ে যাবে গা,
চোখে মুখে হাসি তার করে ঝলমল,
ছোট ছোট হাত দুটি ভারী চঞ্চল,
ঝলকায় মণিহার, চমকায় দুল,
দুটি গালে নাচে তার ফুরফুরে চুল,
সিঁড়ি বেয়ে নেমে নেমে এলো শেষ ধাপ,
হাত তুলে এইবার জলে দিল ঝাঁপ,
একটু সাঁতার কেটে ডুব দিল- টুপ,
সন্ধ্যার সরোবর একেবারে চুপ।
~~~~০০০~~~~
ভাঙল যখন দুপুরবেলার ঘুম
ভাঙল যখন দুপুরবেলার ঘুম
পাহাড় দেশের চারদিকে নিঃঝুম
বিকেলবেলার সোনালি রোদ হাসে
গাছে পাতায় ঘাসে।
হঠাৎ শুনি ছোট্ট একটি শিস,
কানের কাছে কে করে ফিসফিস?
চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি,
এ কী !
পাশেই আমার জানলাটাতে পরীর শিশু দুটি
শিরীষগাছের ডালের পরে করছে ছুটোছুটি।
অবাক কান্ড- আরে !
চারটি চোখে ঝিলিক খেলে একটু পাতার আড়ে !
তুলতুলে গাল, টুকটুকে ঠোঁট, খুশির টুকরো দুটি
পিঠের পরে পাখার লুটোপুটি,
একটু পরেই কানাকানি, একটু পরেই হাসি-
কচি পাতার বাঁশি-
একটু পরেই পাতার ভিড়ে ধরছে মুঠি-মুঠি
রাংতা আলোর বুটি।
এমন সময় কানে এলো পিটুল পাখির ডাক,
একটু গেল ফাঁক-
~~~~০০০~~~~
সমুদ্র স্বপ্ন
হঠাৎ সমুদ্র থেকে লাফ দিয়ে ওঠে এক চাঁদ
‘কি আশ্চর্য ! দেখো দেখো !
(সুজাতার দু’চোখে বিস্ময়!)
‘এমন প্রকান্ড চাঁদ দেখেছ কখনো?’
(সুজাতার দু’চোখের তারা
কী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে !)
‘এমন প্রকান্ড চাঁদ?- না তো !’
(হঠাৎ চাঁদের দিকে গলুই ফেরাই)
সত্যিই সেদিন
সমুদ্রে চাঁদের স্বপ্ন, সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে চাঁদ,
চাঁদের চেয়েও বড়ো আরেক বিস্ময়
ছিল তার দুটি চোখে
আমি তা দেখেছি !
সে দিনের রূপালি জ্যোৎস্নায়
ছিপ ছিপ দাঁড় ফেলে ফেলে
জলের ঝালর ছিঁড়ে ছিঁড়ে
চলে গেছি বহু দূরে – সুজাতা জানে নি কিছু তার,
সুজাতার চোখে ছিল চাঁদ,
আমারো দুচোখে ছিল আরো এক স্বপ্নজাল-ফাঁদ
দুজন দুখানে বন্দী !
সে-সমুদ্র, সেই চাঁদ কত দূরে চলে গেছে আজ !
একবার গলুই ফেরাই,
নিরেট চাঁদের মুখে চাই,
কী ঠান্ডা পাথর চাঁদ! বরফের মতো সাদা মুখ !
এ-চাঁদের মুখে চেয়ে সমুদ্র পাথর হয়ে গেছে।
বহুক্ষণ চুপ করে দেখি,
(সমুদ্র পাহাড় চাঁদ স্থির হয়ে আছে
পাথরে খোদাই,
দেহের শ্রায়
রক্তে ঝিঁঝিঁ ডাকে!)
হঠাৎ একটগু দূর ও দিকের খাঁড়ির কিনারে
যেখানে সমুদ্র জলে ডুবে আছে পাহাড়ের লেজ-
কারা হাসে?
(কারা যেন আসে, )
ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয় কথা,
একটু পরেই
ডানা-মেলা সাদা হাঁস-ছুটে আসে ছোটো সে শাম্পান !
‘দেখো, দেখো, কী সুন্দর চাঁদ !
এমন প্রকান্ড চাঁদ দেখেছ কখনো ?’
তরল রূপালি কন্ঠে সুর বাজে জলের মতন-
ডানা-মেলা সাদা হাঁস তীর বেগে উড়ে যায় দূরে !
দাঁড় হাতে চুপ করে থাকি
নিরেট চাঁদের মুখোমুখি
ঈশ্বরের মতো বোবা !
~~~~০০০~~~~
এরা
গেরুয়া পথের ধারে একদল তামাটে মানুষ
পাথরে হাতুড়ি পেটে এই সারা চৈত্রের দুপুর,
ধূলা শুঁকে শুঁকে এসে চেয়ে যায় একটি কুকুর,
পাশ দিয়ে ছেঁড়া-ছাতা হেঁকে যায় ‘সেলাই-বুরুশ’।
বিশাল মোটর এক দিয়ে যায় ধমক প্রচুর,
হঠাৎ ঝলকে চোখে কোনো এক সোনার ঈগল,
চিলের চিৎকার মেশা ঝলসানো রোদের পিতল
ভাঙা বাসনের ডাকে দিয়ে যায় ঝন ঝন সুর।
দিনের উজ্জ্বল ভিড় একবার গিয়েছে সকালে,
আরবার দেখা দেবে বিকেলের সোনালি আলোয়,
এদের হাতুড়ি পেটা তখনো চলছে একতালে
আকাশের ইঁটের রঙ যতক্ষণ ধূসর না হয়,
তারপর ঘাম যত ঝরে ঝরে রয়েছে কপালে
শেষবার মুছে যাবে খালি হাতে বাদামী চেটোয় !
~~~~০০০~~~~
মাঝরাতে
মাঝরাত
অন্ধকার ঘর
দেওয়াল ঘড়ির ঠক ঠক
টেবিলে আবছা বুদ্ধমূর্তি।
ঘুম আসে না তা
শুয়ে শুয়ে ভাবে প্রবাসের দিনটা
ভোরবেলা কোথা থেকে এসেছিল সেই ফুটফুটে শিশু-
দরজা দিয়ে বাড়িয়েছিল টুকটুকে মুখ?
চোখে ভাসে আমবাগানের সেই কিশোর
কাঠবেড়ালীর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে সমস্ত সকাল,
দুপুরবেলা এসেছল সেই তরুণ-তরুনী
ছেলেটির হাত বাঁশি, মেয়েটির কানে শিরীষফুল
যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে দুজনে-
এরা সব গেল কোথায়?
আর বিকেলবেলার সেই দরবেশ
সারঙ্গী বাজিয়ে গেয়েছিল একটা ভজন
কী যেন ছিল কথাগুলি-
আর ভাবতে পারে না সে
শরীরে একটা ঝিমঝিম অবসাদ
মাথার ভিতরে ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশা
বুদ্ধমূর্তিটা মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে
ক্ষীণ হয়ে আসছে ঘড়ির শব্দ
জানালায় চুপ করে চেয়ে আছে কালপুরুষ।
~~~~০০০~~~~
গলির মোড়ে
ছেঁড়া চট, ফুটো মগ, ভাঙা সানকি
পাশে হাঁ করে পড়ে আছে এক চামড়া ঢাকা কঙ্কাল
থমকে দাঁড়াই
চুপ করে ভাবি;
পথের ধার পথেই শোধ
কবে শোধ হবে ওর কাছে মানুষের ঋণ?
বড়ো রাস্তায় ট্রাফিকের ভীড়
অবিরল জনস্রোত
বিকেলের ভাটার টান, -
হঠাৎ এ কী,
আমি কি সত্যি দেখছি?
ওর টাকরায় চিকচিক করছে পড়ন্ত রোদ
হাঁ-করা মুখে একটা অদ্ভুত হাসি
অদ্ভুত, অদ্ভুত হাসি-
ও কি শুনতে পাচ্ছে একালের মৃত্যুঘন্টা?
~~~~০০০~~~~
প্রতীক্ষা
একটি আলোর পাখি ধরা দেবে বলে
বসে আছি।
বিকালের দেবদারু গাছে
জড়ালো সোনার জাল-
কিছু সুতো জড়ায়েছে মেঘে
কিছু ঘাসে।
একপাশে মেহেদির ছায়া
চুপিসারে বুকে হাঁটে,
বুটি-কাটা পেয়ারার ডালে
লেগে আছে লাল গিরগিটি,
বাখারি বেড়ার গায়ে পিলপিল পিঁপড়ের সারি।
টিক টিক চলেছে সময়...
হঠাৎ পাখার ঝটপট
কান পেতে চারদিকে চাই
গেটের কিনারে
দুলে ওঠে জুনিপার গাছ
একটু পরেই
ক্রোটনের ঝোপ থেকে ছুটে আসে খিলখিল হেসে
একটি মিকির মেয়ে
চোখে মুখে খুশির ঝলক
বুকে দুটি তিতিরের ছানা।
~~~~০০০~~~~
নেপথ্য সংলাপ
দৃশ্যপট ; বিকেলের নির্জন খোয়াই। পিছনে র ক্তরঙের আকাশ। দূরে একটা মাথাভাঙা তালগাছ। কুশীলবঃ দুটি অদৃশ্য কন্ঠস্বর।
কী খবর?
ভাল।
হাসছ যে?
চোরাই পথে ঢুকে পড়েছিলাম ওদের ঘাঁটিতী।
সেঁধিয়ে গিয়েছিলাম ওদের বুদ্ধির গোড়ায়
নেড়ে দিয়ে এলাম কলকাঠি।
তারপর?
আর ভাবতে হবে না আমাদের
এবার নিশ্চিন্ত।
বলো কী?
কী হারে বাড়ছে ওদের সংখ্যা, জানো?
জানি; ওটা বাইরের ছবি
ভিতরে উলটো পাকে ঘুরছে চাকা
ওরা ফিরে যাচ্ছে পিছনের দিকে।
তার মানে?
এখন ওরা ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির, গর্তে সাপ।
ওরা আজ ডানা মেলে উড়ছে আকাশে
সে খবর রাখো?
সে তো চোখেই দেখে এলাম
দিনরাত শূন্যে টহল দিচ্ছে রাক্ষুসে শকুন
শুধু নিচের আকাশে নয়
ল্যাজের ঝাপটায় ঠেলে উঠছে মহাকাশে।
তবে?
তাতে কী?
ওদের নিজের মধ্যেই চলেছে রেষারেষি
শুরু হয়ে গেছে খেয়োখেয়ির পালা।
সত্যি তাই?
ঠিকই বলছি।
কিন্তু থাক, সে কথা, - একটা কান্ড হয়েছে এদিকে।
কী শুনি।
সেই আদ্যিকালের আপেলের বিচি
এখনো গিজগিজ করছে এদের পেটে
সেগুলো চাঙা করে এসেছি এবার।
ফল হয়েছে তাতে?
বিলক্ষণ,
এখন ঘরে-বাইরে পথে-ঘাটে-
বুঝেছি।
ওহো, ভুল হয়ে গেছে একটা-
কী হলো?
এসব অন্ধকারে মানায় ভাল, - যাই
সূর্যটাকে নিবিয়ে আসি।‘
হঠাৎ হু হু কর ছুটে যায় একটা দমকা হাওয়া। উপর থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে একটা কালো পর্দা। কিছুক্ষণ সব চুপ। একটু পরে শুরু হয় ঝিঁঝির ঐকতান।
দুর্বোধ্য
লোকটা কেন যে এল
কেন চলে গেল
বোঝাই গেল না,
রেখে গেল একমুঠো ছাই
সেও হুস হাস
নিয়ে গেল দমকা বাতাস।
~~~~০০০~~~~
ভানুমতীর মাঠ
জ্বলন্ত ঘাসের শিখা- ধূ ধূ লাল সূর্যাস্ত-আগুন, -
ধসানো ইটের পাঁজা একাধার অট্টহাসি হাসে,
চারদিকে পোড়া মাটি-খাঁ খাঁ করে দুর্ভিক্ষের মাঠ,
একধারে ছায়া ফেলে ভাঙা-পাড় নদীর কঙ্কাল।
ভাঙা মন্দিরের গায়ে বটের ঝাঁকড়া মাথা থেকে
হঠাৎ টিকির মতো উড়ে যায় আগুনের পাখি,
আকাশের ডিমে বসে ডাকে এক অদ্ভুত টিট্রিভ,
মাটির ঢিবির গায়ে জ্বলে ওঠে তুবড়ির আলো।
পৃথিবীর হৃদপিন্ড এইখানে ডিমি ডিমি বাজে
পড়ো জমি স্বপ্ন দেখে চষা মাঠ ফসলের ক্ষেত,
মরা নদী উড়ে চলে স্ফীত পালে জলের যৌবনে
দূর থেকে ভেসে আসে মসৃণ দিনের কোন সুর।
পৃথিবীর হৃদপিন্ডে শুনি বসে বহু রূপকথা,
এইখানে একদিন হাড় থেকে হবে মায়াপুরী,
উজ্জ্বল বৃষ্টির হাসি একরাশি ঝরাবে হঠাৎ-
নূতন আলোর বীজে বোনা হবে নূতন ফসল।
সেদিন বিকেলবেলা এইখানে নদীর কিনারে
যে-সকল ছেলেমেয়ে চোখে মুখে ছড়াবে আলোক
রামধনু-রঙ-আঁকা মুঠি মুঠি তাদের ঝিনুক
দু’হাতে ছিটায়ে যাবে-হবে চন্দ্রমল্লিকার বন।
অপরূপ রূপকথা- তবু বসে কান পেতে শুনি-
এইখানে ভানুমতী মন্ত্র পড়ে জাদুকাঠি হাতে,
ছায়া হয়ে একদিন মিলায়েছে অনেক দানব,
হাড়ের বিছানা-লে রাক্ষসেরার গিয়েছে লুকায়ে।
ইটের পাঁজার ধারে সব শেষে এসেছিল যারা
তারাও ইঁটের গায়ে মিশে গেছে অট্টহাসি হয়ে,
ঘুমায় ঢিবির নিচে সিংহাসনে বত্রিশ পুতুল,
নূতন কালের তা’রা অন্তরীক্ষে কোলাহল করে।
~~~~০০০~~~~
ব্যক্তমধ্য
ব্যাপারটা কী?
কোথাও কিছু নেই
হঠাৎ ছোট একটা বিন্দু
তারপর বিরাট আকার
প্রচন্ড হুংকার –
‘অয়মহম ভো।‘
তারপর আবার ছোট একটি বিন্দু
তারপর কিছু নেই।
~~~~০০০~~~~


বঙ্গে আফিম ও গাঁজা ব্যবসার ইতিবৃত্ত




   প্রণব কুমার কুণ্ডু


















    বঙ্গে আফিম ও গাঁজা ব্যবসার ইতিবৃত্ত




    ফেসবুক থেকে          শেয়ার করেছেন         প্রণব কুমার কুণ্ডু


রানা চক্রবর্তী গোষ্ঠীটিতে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন: ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য

ব্রিটিশ শাসনে বঙ্গে সরকারি আফিম ও গাঁজা ব্যবসার ইতিবৃত্ত-

● ছবিতে- সরকারি আফিম তৈরির কারখানায়, আফিমের গোল কেক তৈরি করছেন দুই ভারতীয় শ্রমিক। ১৮৯০ এর দশকে তোলা, বঙ্গের এক স্থানের ছবি।
(তথ্যসূত্র:
১- Drug Trafficking and Organized Crime. Chapter III Part 1. By Alexander Cockburn; Jeffrey St. Clair.
২- Facts and figures showing the reduction of opium cultivation and production by Ron Gluckman.)
রানা চক্রবর্তী Krishnendu Sarkar এবং অন্যান্য 39 জন এর সঙ্গে আছেন।
পুরানো সেই দিনের কথা: বঙ্গে আফিম ও গাঁজা ব্যবসার ইতিবৃত্ত-
● ছবিতে- সরকারি আফিম তৈরির কারখানায়, আফিমের গোল কেক তৈরি করছেন দুই ভারতীয় শ্রমিক। ১৮৯০ এর দশকে তোলা, বঙ্গের এক স্থানের ছবি।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে আফিম- গাঁজা বিক্রির ব্যবসাটি ছিল বৈধ। আফিং-এর ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। মুঘল আমল থেকেই আফিং চাষ ও ব্যবসার পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ রকম সরকার নিয়ন্ত্রিত। ক্ষমতার হাতবদলের পর কোম্পানি ও ক্রমে পার্লামেন্ট আফিং চাষের পুরো নিয়ন্ত্রণটা পেয়ে গেলো। ফলে আফিং-এর চাষ কমানোর বদলে তরতর করে বাংলায় আফিম বা পোস্তর চাষ বাড়ে ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে। এর কিছুদিন পর থেকে আফিং চিনে যেতে শুরু করল। চিনে আফিং-এর আমদানি নিষিদ্ধ ছিল প্রায় ১০০ বছর ধরে যদিও গ্রেট ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় মদতে জলপথে চোরাচালান চলত’ই। চিনের সম্রাট লিন আফিং আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করতে চাইলে ব্রিটিশ গানবোটগুলো আফিং পাচারকারী জাহাজের সাহায্যে এগিয়ে এল। সম্রাট লিনের অপসারণের মধ্যে দিয়ে প্রথম আফিং যুদ্ধ মিটল, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু হল আফিং-এর দ্বিতীয় যুদ্ধ। পার্লামেন্ট এবারও ব্রিটেনবাসীদের বোঝাল এ আসলে মুক্তবাণিজ্য মুক্ত দুনিয়ার স্বার্থে লড়াই। এই যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশরা অনিয়ন্ত্রিত আফিং ব্যবসার অধিকারের পাশাপাশি বন্দর নগরী হংকংও পেয়ে যায়। এইসব ভালো কাজে বাগড়া দেওয়ার দুচারজন সবসময়েই জুটে যায়। ব্রিটেনে গড়ে উঠল The Society for Suppression of the Opium Trade (SSOT)। প্রায় দশবছরের লড়াইয়ের পর এঁরা পার্লামেন্টকে বাধ্য করে ফেলেন আফিং জিনিসটার খুঁটিনাটি রিভিউ করতে। সালটা ১৮৯৩। এইসময়ে একই সঙ্গে গাঁজা-চরস-ভাং বেঙ্গল প্রভিন্সে কী ক্ষতি করছে সেইটা দ্যাখার জন্য পার্লামেন্ট মনস্থ করে।
গাঁজা জিনিসটা সেইসময়ে যেহেতু খুব সস্তার নেশা ছিল, সেটা নিয়ে পার্লামেন্ট আগে খুব মাথা ঘামায় নি। মুঘল আমলেও গাঁজার ওপর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ বসেনি। তবে ১৭৭০-এ কোম্পানি যখন প্রায় দেউলিয়া হয়ে পার্লামেন্টের দ্বারস্থ হয়, বেল আউট প্যাকেজের পাশাপাশি কোম্পানির থেকে লাভ বাড়ানোর অপশনগুলো পার্লামেন্ট বিচার করে। ১৭৯০ এ ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার গাঁজা-চরস-ভাং-এর ওপর ট্যাক্স বসানো হল। এই ট্যাক্স বসানোর ব্যাপারে পরবর্তীকালে কিছু মজার ঘটনা ঘটেছিল। গাঁজা ভাং-এর ব্যাপক ব্যবহারে কালেক্টররা বুঝে উঠতে পারছিল না কীভাবে ট্যাক্সেশন করলে সবচেয়ে বেশি রেভিনিউ আসে। ফলে কখনো দোকানগুলোকে গুণগত তারতম্যে বিক্রির ওপর ট্যাক্স দিতে হয়, কখনো ট্যাক্সের নিয়ম পালটে দৈনিক ফিক্সড ট্যাক্স করা হয়, কখনো দামের ফারাক না দেখে সব ধরণের গাঁজা ভাং-এর ওপর ওজন অনুযায়ী ট্যাক্স ধরা হয়। ১৭৯০ এর নির্দেশনামায় কালেক্টররা সরাসরি ট্যাক্স নিতেন না, নিজের এলাকায় গাঁজা ভাং চরস বিক্রির থেকে জমিদারদের ট্যাক্স কালেক্ট করতে হত। ১৭৯৩ এ ৩৪ নং রেগুলেশন অনুযায়ী কোম্পানির অধীনস্থ এলাকায় গাঁজা ভাং চরস চাষও ব্যবসা করার জন্য আলাদা করে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হয়। বলাবাহুল্য, লাইসেন্সিং ছিল রেভিনিউ আদায় করার সবচেয়ে সহজ পন্থা। লাইসেন্স পাওয়া এবং রাখার জন্য নিয়মিত ফি দিতেই হত। রেগুলেশনের কারণ হিসেবে সেটা উল্লেখও করা হয় যে লাইসেন্সের মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কমবে এবং সরকারের অর্থাগমও সম্ভব হবে। ১৮০০ সালে আরেকটা রেগুলেশন বের হয়, যাতে বলা হয় এগুলোর মধ্যে চরস সবচেয়ে ক্ষতিকারক এবং চরস বানানো বা বিক্রি সম্পূর্ণরূপে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। আর মজার ব্যাপার, ১৮২৪এ আরেক নির্দেশনামায় বলা হয় যে গাঁজা বা অন্যান্য নেশার জিনিসের থেকে মেডিকেলি চরসের কোনো বেশি ক্ষতিকারক প্রভাব নেই, ফলে ব্যান তুলে নেওয়া হল। ১৮৪৯এ বেশি আবগারি শুল্ক আদায়ের জন্য খুচরো গাঁজার ব্যবসার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। এই সময় থেকে পরের কয়েক দশক ট্যাক্স দৈনিক হিসেবে হবে না ওজনের ওপর হবে এই নিয়ে বিভিন্ন আইন আসে। ফলে দ্যাখা যাচ্ছে যে কোম্পানির শাসনের আমলে গাঁজা ভাং-এর ব্যাপারে অর্থাগমের সুযোগ নিয়েই বেশি মাথা ঘামানো হয়েছিল। গাঁজা নিয়ে আফিং-এর মতন ব্যবসার সুযোগ ছিল না। কারণ গাঁজা সস্তা, প্রায় ঘরেই চাষ করে ঘরেই খাওয়া যায়, আর লোকে যেরকম সেরকম ভাবে জোগাড় করে নিতে পারে। সুতরাং চাষ আর পাইকারি ব্যবসাতে ট্যাক্স বসানোই এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় ছিল। একই কারণে খুচরো গাঁজার ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণও করতে চেয়েছিল কোম্পানি।
১৮৬১তে শাসন ক্ষমতা সরাসরি পার্লামেন্টের কাছে যায়। প্রায় সারা ভারত ইংরেজদের অধীনে আসে। এবং সিপাহি বিদ্রোহ-উত্তর যুগে ভারতবাসীদের হাল হকিকত নিয়ে ব্রিটিশদের একটু বেশি চিন্তা করতে হয়। এইসময়ে একটা থিওরি খাড়া হতে থাকে যে ভারতীয় সিপাহিদের গুণগত ডিগ্রেডেশনের জন্য গাঁজার নেশা দায়ী। লোকাল অফিসিয়ালরা বারবার এই নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলতে থাকেন। এর মধ্যে একটা তথ্য খুব জোরদার ভাবে উপরমহলের কাছে যায় যে বেঙ্গল প্রভিন্সের পাগলাগারদগুলো সবই গেঁজেলে ভর্তি। অন্যদিকে দুটো সমুদ্র পেরিয়ে আমেরিকায় কোকেন-এর ব্যবহার শুরু হয়। মেক্সিকান এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কোকেনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। অনেকক্ষেত্রেই অপরাধমূলক কাজের পিছনে কোকেনের প্রভাব দেখতে শুরু করেন স্থানীয় আইনরক্ষকরা। এর সমান্তরাল টেনে ভারতেও গাঁজা নিষিদ্ধ করার দাবি উঠতে শুরু করে। বিশেষতঃ সেনাপ্রধানদের দিক থেকে এরকম দাবি আসায় ১৮৭৭এ সরকার একটা স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠন করতে বাধ্য হন। টাস্ক ফোর্স বলে গাঁজার ওপর ট্যাক্স যত বেশি সম্ভব বাড়ানো হোক। এবং সেটাই ব্যবহার কমানোর একমাত্র উপায়। এবং প্রতিবারের মতন এবারও বলা হল, ব্র্যাকেটের বাইরেই বলা হল যে, ট্যাক্স বাড়ালে হার ম্যাজেস্টির রোজগারও বাড়বে। যাই হোক, এইসব তর্ক বিতর্ক, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং আফিং ব্যবসা বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আফিং-এর পাশাপাশি গাঁজার ব্যবহার নিয়েও পর্যালোচনা করার ব্যাপারে পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৯৩ সালে গঠিত হয় Indian Hemps Drug Commission বা IHDC। প্রথমে শুধু বেঙ্গল প্রভিন্সের জন্য হলেও, লর্ড কিম্বারলির সুপারিশে IHDC এক বছর ধরে সারাভারতে গাঁজার চাষ, ব্যবহার এবং প্রভাব নিয়ে এক অসাধারণ সমীক্ষা চালায়। সেই সময়ের ভারতের ইতিহাসে এরকম নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ সমীক্ষার আর কোনও নজির নেই এবং সম্ভবত গাঁজার ইতিহাসেও আজ অবধি সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা এটিই। IHDCর প্রেসিডেন্ট ছিলেন পাঞ্জাবের প্রথম ফিন্যান্স কমিশনার ম্যাকওয়ার্থইয়ং, সেক্রেটারি ছিলেন বেঙ্গল প্রভিন্সের অর্থ ও পৌর উপসচিব মিঃ ম্যাকিন্টোস। এছাড়া আরও ছজন সদস্য ছিলেন যার মধ্যে তিনজন ভারতীয়। বাংলা থেকে ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন তাহেরপুরের রাজা শশীশিখরেশ্বর রায়। উল্লেখ্য, কমিশনের পুরো মেয়াদে ভারতীয় প্রতিনিধিদের উপস্থতিতিই সবচেয়ে কম ছিল। ৩ অগস্ট ১৮৯৩ থেকে ৬ অগস্ট ১৮৯৪-এর মধ্যে IHDC মোট ১১৯৩ জন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সাক্ষীদের মধ্যে সিভিল সার্ভেন্ট, মেডিকেল অফিসার, প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনার, কবিরাজ, হেকিম, গাঁজা চাষী, ব্যবসায়ী, মিশনারিরা ছিলেন। সাক্ষীদের প্রথমে একটি ৭০টি প্রশ্নের প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়। পরে তাদের প্রায় প্রত্যেককে ক্রস-এক্সামিন করা হয়। যাঁরা প্রশ্নের লিখিত উত্তর দিতে পারেন না তাঁদের বিস্তারিত মৌখিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেজন্য কমিশন ভারতের আটটি প্রভিন্সের ৩০টি শহর এবং বার্মা ঘুরে আসে। কমিশন সাক্ষীদের নিয়ে বিভিন্ন দফায় মোট ৮৬ বার বসে এবং মেয়াদের শেষে সাত খন্ডে ৩২৮১ পাতার একটি রিপোর্ট বার করে। কমিশনের প্রশ্নগুলির মধ্যে কিছু ছিল এই রকম-
● গাঁজা ভাং বা চরস অল্প বা পরিমিত হারে নিয়মিত নিলে কি শারীরিক, মানসিক বা চারিত্রিক ক্ষতি হয়?
●এতে শরীরের স্থায়ী কোনও ক্ষতি হতে পারে কি?
●গাঁজা থেকে কি ক্ষুধামান্দ্য, আমাশা, ব্রংকাইটিস, হাঁপানি প্রভৃতি রোগ হয়?
এর ফলে কি আলস্য বা চারিত্রিক দোষ হতে পারে?
●এর ফলে কি বুদ্ধিলোপ কিম্বা পাগলামি আসে? পাগলামি এলে তা সেবনের পরে সাময়িক না চিরস্থায়ী?
●পাগলদের মধ্যে কতজনের গাঁজার নেশার পূর্ব ইতিহাস আছে?
●ব্যাপারটা কি এরকম যে একজন বিকৃতমস্তিষ্ক সহজে গাঁজা ভাং চরসের নেশা ধরেন?
●গাঁজা ভাং খাওয়ার হার কীরকম?
●পরিমিত গাঁজা সেবনের পর কি কেউ পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই নতুন কোনও অপরাধে লিপ্ত হতে পারে? এরকম কেস-এর সংখ্যা কীরকম? কী কী ধরণের অপরাধ?
ওপরের সবগুলো প্রশ্ন অত্যাধিক গাঁজা-ভাং এর ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্ত করা হয়।
অপরাধীদের মধ্যে স্বল্প বা মধ্যম পরিমাণে একই ভাবে অপরাধ সংগঠন, চারিত্রিক দোষের ক্ষেত্রেও গাঁজার নির্দিষ্ট ভূমিকা প্রমাণ করা যায় না। কমিশন আরও মন্তব্য করে যে অপরাধমূলক প্রবৃত্তির ক্ষেত্রে গাঁজার প্রভাব সম্ভবত মদের থেকে অনেকটা কম।
চূড়ান্ত রিপোর্টে IHDC জানায় যে স্বল্প বা মধ্যম পরিমাণে নিয়মিত গাঁজা ভাং বা চরস নিলে ব্যক্তির কোনও সিরিয়াস ক্ষতি হয় না। অধিক পরিমাণে নিলে হতে পারে, তবে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে যে কোনও জিনিস খেলেই তার ক্ষতিকর দিক দেখা যায়। এই অত্যন্ত বেশি পরিমাণ গাঁজা ভাং যাতে লোকে না নেয়, তার জন্য IHDC একটাই পন্থার সুপারিশ করে, যা প্রায় আগের সমস্ত কমিশন ও টাস্কফোর্স করেছিল- ট্যাক্স বাড়ানোর।
IHDC প্রায় শতিনেক ইউরোপিয়ান ও দেশীয় ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম, পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলে লক্ষ্য করে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোকে পরিমিত গাঁজা সেবনের সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতার সংযোগ দিতে পারছেনা। অনেকে পূর্বধারণা অনুযায়ী গাঁজার ক্ষতিকারক দিকের কথা বলছেন আবার কেউ কেউ ম্যালেরিয়া প্রভৃতি রোগের প্রতিষেধক হিসেবে গাঁজার উপকারিতার কথা বলেছেন। কোনও চিকিৎসকের মতে গাঁজা খাবার পর উপযুক্ত প্রোটিন না খেলে অসুখ হতে পারে। কিন্তু, IHDC সিদ্ধান্তে আসে যেপরিমিত গাঁজার নেশার সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতার সাধারণ কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায় না।
বেঙ্গল প্রভিন্সের সব পাগলাগারদ গাঁজার নেশাড়ুতে ভর্তি এরকম একটা খবর বিভিন্ন মহলে চালু ছিল। ফলে IHDCর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিভিন্ন অ্যাসাইলাম ও মানসিক রোগের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা। কমিশন আটটি প্রভিন্স ও বাংলার সমস্ত পাগলাগারদে গাঁজার নেশার ইতিহাস আছে এরকম রোগীদের তথ্য পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৯২ সালে সবকটি পাগলাগারদ মিলিয়ে ২৩৪৪ জন রোগী আসেন, যার মধ্যে ২২২ জনের গাঁজার নেশার ইতিহাস পাওয়া যায়। কমিশন এনকোয়ারির পর দেখে যে এর মধ্যে মাত্র ৬১টি কেস-এ গাঁজার নেশার ঘটনা রয়েছে, বাকিগুলিকে নিজস্ব ধ্যানধারণা অনুযায়ী ডাক্তার বা পাগলাগারদ কর্তৃপক্ষ গাঁজার জন্য বলে দাগিয়ে রেখেছেন। এই ৬১ জন রোগীর ২২ জনের কোনও বিশদ তথ্য বা ফাইল পাওয়া যায় না। বাকিদের মধ্যে পাগলামির একমাত্র কারণ গাঁজা খাওয়া নাকি আরও কিছু কারণ আছে সেটা স্পষ্ট করা যায় না। সব মিলিয়ে কমিশন দেখে যে গাঁজার থেকে স্থায়ী পাগলামি হয় এরকম সিদ্ধান্তে আসার মত যথেষ্ট তথ্য নেই। এর পাশাপাশি চিকিৎসকরা বাঁদরের মস্তিষ্কের ওপর গাঁজার প্রভাব দেখার পরীক্ষা করেন। যাতে দেখা যায় দীর্ঘদিনের গাঁজা সেবনের ফলে বাঁদরের ব্রেন-এর গঠন পালটায় না। অনুরূপ পরীক্ষায় অ্যালকোহল ও ধুতুরা বাঁদরের মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করে দেখা যায়। ফলে গাঁজার থেকে পাগলামি অ্যালিগেশন কমিশন প্রায় বাতিলই করে। একই ভাবে অপরাধ সংগঠন, চারিত্রিক দোষের ক্ষেত্রেও গাঁজার নির্দিষ্ট ভূমিকা প্রমাণ করা যায় না। কমিশন আরও মন্তব্য করে যে অপরাধমূলক প্রবৃত্তির ক্ষেত্রে গাঁজার প্রভাব সম্ভবত মদের থেকে অনেকটা কম।
চূড়ান্ত রিপোর্টে IHDC জানায় যে স্বল্প বা মধ্যম পরিমাণে নিয়মিত গাঁজা ভাং বা চরস নিলে ব্যক্তির কোনও সিরিয়াস ক্ষতি হয় না। অধিক পরিমাণে নিলে হতে পারে, তবে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে যে কোনও জিনিস খেলেই তার ক্ষতিকর দিক দেখা যায়। এই অত্যন্ত বেশি পরিমাণ গাঁজা ভাং যাতে লোকে না নেয়, তার জন্য IHDC একটাই পন্থার সুপারিশ করে, যা প্রায় আগের সমস্ত কমিশন ও টাস্কফোর্স করেছিল- ট্যাক্স বাড়ানোর।
(তথ্যসূত্র:
১- Drug Trafficking and Organized Crime. Chapter III Part 1. By Alexander Cockburn; Jeffrey St. Clair.
২- Facts and figures showing the reduction of opium cultivation and production by Ron Gluckman.)

নেহেরু কে ?


নেহরু কে ?

ফেসবুক থেকে  শেয়ার করেছেন      প্রণব কুমার কুণ্ডু


প্রণব কুমার কুণ্ডু











Surajit Sutradhar Partha Sarathi Sen এবং অন্যান্য 2 জন এর সঙ্গে আছেন।


বিষয়:---
শিশু দিবস,
দয়া করে কেউ এড়িয়ে যাবেন না একটিবার মন দিয়ে পড়ুন। 
১৪ই নভেম্বর শিশু দিবস ,মুলত এই শিশু দিবস পালিত হয় জহরলাল নেহেরুর জন্মদিন উপলক্ষে।
কিন্তু কেন?
কারণ জহরলাল নেহরু প্রাপ্ত বয়সেও নাকি তাঁর মনটা ছিল শিশুদের মত নির্মল ও অবোধ।
কে এই জহরলাল নেহেরু??
উঃ:-আফগান মুসলমান গাজী খাঁনের তিন ছেলে ,বড় ছেলে ফৈজাল খাঁন যে চৌদ্দ বছর বয়সে আন্ত্রিক রোগে মারা যায়,মেজো ছেলে সেলিম খাঁন যার বংশধররা হচ্ছেন ঐ জম্মু কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ‍্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহরা ,আর ছোট ছেলে ময়িম খাঁন।এই ময়িম খাঁন ভাবলেন যে এই ভারতবর্ষে/জম্মুদ্বীপে/আর্যাবর্তে যদি আমি মুসলমান হয়ে রাজনীতির ময়দানে পা রাখি তবে এদেশের মানুষ আমাকে মেনে নেবেন না তাই তিনি নিজের নাম পরিবর্তন (ময়িম খাঁন)করে নাম ধারন করলেন মতিলাল নেহেরু।এই মতিলাল নেহেরুর ছেলেই হলেন জহরলাল নেহরু।আর জহরলালের মেয়ে ইন্দিরা নেহেরু/গাঁন্ধী। ইন্দিরা আবার বিয়ে করলেন এক পারসিয়ান মুসলিম ফিরোজ খাঁনকে।ফিরোজকে গাঁন্ধীজী দত্বক ছেলে হিসেবে নিয়ে নিজের উপাধি উপহার দেন আর ফিরোজ খাঁন থেকে হয়ে গেলেন ফিরোজ গাঁন্ধী।ফিরোজ ও ইন্দিরার মিলিত সন্তান রাজীব গাঁন্ধী ।রাজীব আবার বিয়ে করলেন এক ইটালিয়ান খ্রীষ্টান মহিলাকে যিনি নাকি আবার রাশিয়ার চর ,নাম অ‍্যান্টোনিমো এডভিগ আলবানিয়া মাইনো(সোনায়া গাঁন্ধী)এই সোনিয়া ও রাজীবের মিলিত সন্তান হলেন আজকের রাহুল গাঁধী ।যিনি নিজেও জানেন না নিজের গৌত্র ও বংশ পরিচয়।যাক সেসব কথা এবার আসা যাক শিশুদিবস ও জহরলালের কথায়। স্বাধীনতার প্রাক্কাল থেকেই জহর লালের একটাই লালসা ছিল যেন তেন প্রকারে ভারতের মসনদ দখল করা মানে নিজেকে প্রধান মন্ত্রী প্রতিষ্ঠিত করা।তাতে ভারতবর্ষের অস্তিত্ব থাক আর যাক।তাই সেদিন ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭এর আগে মাউন্টব্যাটেন জহরলালকে বললেন যে তোমাকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাতে পারি তবে কিছু শর্তের বিনিময়ে।কি সেই শর্ত??সেই শর্ত হলো ৪০০০০(চল্লিশ হাজার)পাতার transfer of power agreement.অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিপত্র।যার প্রথম পাতার আর্টিকল নং ১৪৭ এ লেখা ছিলো ১/ভারতকে আজীবনের জন‍্য ব্রিটিশ কমন ওয়েল্থের সদস‍্য থাকতে হবে,২/নেতাজী সুভাষ চন্দ্রকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করতে হবে ,৩/ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তথা ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ দিবে ভারতবর্ষের পারলামেন্ট তথা সুপ্রিমকোর্টকে সেই নির্দেশ পালন করতে হবে,৪/ব্রিটিশদের লেখা ভারতের (বিকৃত) ইতিহাস কোনদিন পরিবর্তন করা যাবেন, ৫/আই এন এর কোন বাহিনীকে ভারতের সেনাবাহিনীতে বহাল রাখা যাবেনা,৬/দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ সেনাদের সমাধী স্থল যা দিল্লিতে অবস্থিত তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ভারতবর্ষকে নিতে হবে ,ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি আরো অনেক কিছু।আর এই চুক্তি পত্রে নির্লজ্জের মতো সেদিন স্বাক্ষর করেছিলেন এই জহরলাল নেহরু শুধু প্রধানমন্ত্রী ও পরিবারতন্ত্র রাজনীতি কয়েক করার জন‍্য।তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ নেহেরুর প্রধানমন্ত্রী হবার পালা ।ইনাকে শপথবাক্য পাঠ করালেন লর্ড মাউন্টব‍্যাটেন আর জহরলাল শপথবাক্য পাঠ করলেন ভারতমাতার নামে নয়,পাঠ করলেন ইংল‍্যাণ্ডের রাজা ষষ্টম জর্জের নামে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে মাউন্টব‍্যাটেন সিঙ্গাপুরে অবস্থিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্মৃতি সৌধ প্রত‍্যক্ষ দিবালোকে ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলেন আর সেখানে দেখা যায় নেহেরু মাউন্টব‍্যাটেনের মেয়ে পামেলা হিক্সের সঙ্গে একসাথে সিগারেট পান করছেন ও হাত তালি দিচ্ছেন।যে নেহেরু মদ, সিগারেট ও মেয়েমানুষ ছাড়া এক মূহুর্ত থাকতেন না আজ তার জন্মদিনে পালিত হয় শিশুদিবস!!!!!!এর চেয়ে বড় দুঃখ,কষ্ট ও লজ্জা আমাদের আর কি হতে পারে??সত‍্যিই এ যেন এক ত‍্যাগী প্রেমময় মানুষের জন্মদিন।শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু যেমন প্রেম বিলিয়ে হিংসা ও দ্বেষ দূর করে মন জয় করতেন বীর নির্লজ্জ,কামুক, চরিত্রহীন নেহেরু মাউন্টব‍্যাটেনের স্ত্রী মিসেস এডুইনা ও মেয়ে পামেলা হিক্সের সঙ্গে অগাধ প্রেম ও লাগামহীন মেলামেশার দ্বারা ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন।এ যেন ছিলো নেহেরুর স্বর্গীয় সুষমাণ্ডিত অপার্থিব সম্পর্ক।যে নেহেরু ভারতের শিশুদের কাছে থেকে কেড়ে নিলেন ভারতের প্রকৃত ইতিহাস,যে শিশুদেরকে শিক্ষা দিলেন দেশদ্রোহিতার শিক্ষা,যে শিশুদের কে শিক্ষা দিলেলেন নিজ বাবার নাম ও বংশ পরিচয় পাল্টে দেওয়া,যে শিশুদেরকে শিক্ষা দিলেন মদ‍্যপান-ধূম পান তারি জন্মদিন আজ শিশুদিবস!!!!হায় হায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজী, বিবেকানন্দ, ক্ষুদিরাম,ভগৎ সিং,বিনায়ক দামোদর সাভারকার,উল্লাস করে দত্ত কেন জন্মেছিলেন তোমরা এই দূর্ভাগা দেশে ?????!!!!!!!

নমস্কারন্তে----সঞ্জীত কুমার মণ্ডল,ছুটিপুর ,দৌলতাবাদ , মুর্শিদাবাদ,৭৬০২৫৫৯১৯২

Nehru


Nehru
Shared by     Pranab Kumar Kundu      from Facebook.


Pranab Kumar Kundu








Pranab Kumar kundu


রাস


রাস




প্রণব কুমার কুণ্ডু












ফেসবুক থেকে       শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু





রানা চক্রবর্তী একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন৷






রানা চক্রবর্তী      Tapash Sarkar এবং অন্যান্য 

রাস উৎসবের ইতিবৃত্ত:
‘রাস’ শব্দটি এসেছে ‘রস’ থেকে। ‘রস’ মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম। ‘লীলা’ অর্থ নৃত্য। রাসলীলা মুলত পুরাণের কৃষ্ণ ও বৈষ্ণব সাহিত্যের অতিজনপ্রিয় চরিত্র শ্রীমতি রাধার অপ্রাকৃত প্রেমলীলার একটি আখ্যান। বৃন্দাবনের গোপীদের নিয়ে রাধা ও কৃষ্ণ এই রাস করেন। নানানজন নানানভাবে রাসলীলার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বৈষ্ণব কবিরা নিজেদের মতো করে রাধা ও কৃষ্ণকে উপস্থাপন করেছেন তাদের রচনায়। তাঁরা বলছেন, পরমাত্মার সাথে আত্মার মহামিলনই রাস। পরমাত্মা কে ? যিনি ইশ্বর তিনিই পরমাত্মা। তিনি শ্রীকৃষ্ণ। আত্মা কে? শ্রীমতি রাধা ও গোপীরা, যারা পূণ্যবলে কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ করেছে। ভাগবৎ পুরাণে অবশ্য শ্রীমতি রাধার কথা নেই। সেখানে বলা হচ্ছে, বৃন্দাবনের রাসমন্ডলে সেখানকার গোপীদের সান্নিধ্য দিতে কৃষ্ণ রাসলীলা করেন। তাহলে যাদের সাথে এই লীলা হয়েছিল, তাদের অনেকেই লৌকিক দৃষ্টিতে অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী, অর্থ্যাৎ বিষয়টা পরকীয়া। কিন্তু ভাগবৎকার রাসলীলা বর্ণনার শুরুতেই বলছেন, নাহ এটা আপ্রাকৃত, মানে অলৌকিক লীলা। ভগবান নিদ্রার দেবী যোগমায়াকে আশ্রয় করে এই লীলা করেন যেখানে গোপীরা উপস্থিত থাকেন আত্মারূপে।

হর্ষচরিতের টীকাকার শঙ্করের মতে, রাস হলো এক ধরণের বৃত্তাকার নাচ যা আট, ষোলো বা বত্ৰিশ জনে সম্মিলিতভাবে উপস্থাপনা করা যায়।


পদ্মপুরাণে (৫২/১০৩-১০৫) শারদরাস ও বাসন্তীরাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়) বাসন্তীরাস এবং শ্ৰীমদ্ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণে (৫/১৩/১৪-৬১) শুধুমাত্র শারদরাসের বর্ণনা আছে। হরিবংশে ও ভাসের বালচরিতে উল্লেখ আছে যে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে হল্লীশনৃত্য করেছিলেন। হল্লীশনৃত্য যদি তালযুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে তাঁকে "রাস" নামে অভিহিত করা হয়। বিষ্ণুপুরাণের মতে, কৃষ্ণ রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন গোপরমণীদের সঙ্গে। শ্ৰীধর স্বামী বলেছেন, বহু নৰ্তকীযুক্ত নৃত্য বিশেষের নাম রাস– “রাসো নাম বহু নৰ্ত্তকীযুক্তে নৃত্যবিশেষঃ।” শ্ৰীমদ্ভাগবতের অন্যতম টাকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, —“নৃত্যগীতচুম্বনালিঙ্গনদীনাং রসানাং সমূহো রাসস্তন্ময়ী যা ক্রীড়া বা রাসক্রীড়া”। শ্ৰীমদ্ভাগবতের মতে, কৃষ্ণ যোগমায়াকে সমীপে গ্রহণ করেই রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন। বস্ত্রহরণের দিন গোপিনীদের কাছে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি রাসলীলা করবেন-
"যখন করেন হরি বস্ত্ৰহরণ।
গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ।।
আগামী পূর্ণিমাকালে তাঁহাদের সনে।
করবেন রাসলীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।।"
ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা ও বৃন্দাবনে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়াসহ অন্যান্য জায়গায়, ওড়িশা, আসাম ও মণিপুরে রাসযাত্রার উৎসব বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। এই উৎসবের অংশ হিসেবে গোপিনীবৃন্দ সহযোগে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা এবং অঞ্চলভেদে কথ্থক, ভরতনাট্যম, ওড়িশি, মণিপুরি প্রভৃতি ঘরানার শাস্ত্রীয় ও বিভিন্ন লোকায়ত নৃত্যসুষমায় রাসনৃত্য বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
রাস নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ উৎসব। শরৎকালে শারদোৎসবের পরেই শুরু হয় উৎসবের প্রস্তুতির বাড়বাড়ন্ত; কার্তিকীপূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয় নবদ্বীপের শ্ৰেষ্ঠ লোকায়ত উৎসব "রাস"। এখানকার রাসের প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে মূর্তির বিশালতা। অপরূপ মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে নানারূপে শক্তি আরাধনাই নবদ্বীপের রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি মূর্তিতে কত কারুকার্যময় নির্মাণশৈলী, কত বিচিত্র রূপকল্পনা, কত ব্যাপক ধর্মীয় ব্যঞ্জনা, কত পণ্ডিতের গভীর উপলব্ধির সুস্থিত বহিঃপ্রকাশ, কত শিল্পীর নিখুঁত চিত্রায়ণ—যা সম্মিলিত রূপে অসংখ্য মানুষের মনোরঞ্জনে সহায়তা করে। নবদ্বীপের রাস শুধুমাত্র উৎসব নয়, ধর্মীয় দ্যোতনার এক ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি।
রাস মূলতঃ কৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব; কিন্তু নবদ্বীপের রাস প্রধানত শাক্ত রসাশ্রিত। আবহমানকাল থেকে এখানকার ধর্ম-সংস্কৃতিতে তান্ত্রিক বীরাচারের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। মদ-মাংস (পঞ্চমকারের প্রধানবস্তু) এবং আড়ম্বরের জৌলুস ব্যতীত বীরাচারের আরাধনার পূর্ণতা ঘটে না। নবদ্বীপের রাসে অনিবার্যভাবেই ঘটেছে তন্ত্রাচারের পূর্ণ প্রতিফলন। অপরদিকে বৈষ্ণবীয় রাসের সাত্ত্বিক ধারা অনেকটাই কোণঠাসা। মন্দির অভ্যন্তরে রাধাকৃষ্ণের চক্ররাস যে হয় না তা নয়, তবে তা জাঁকজমকপূর্ণ শাক্তরাসের পাশে অনেকটাই ম্রিয়মান। জনশ্রুতি প্রচলিত আছে যে, চৈতন্যদেব রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসবের সূচনা করেছিলেন নবদ্বীপে। একথা যদি সত্যি হয় তাহলে স্বীকার করে নিতে হয় যে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভেই রাসের সূচনা হয়েছিল। তবে চৈতন্যদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের পর নবদ্বীপের বৈষ্ণব আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। গৌরাঙ্গ-পরিজনেরা বাধ্য হয়ে নবদ্বীপ ত্যাগ করে স্থানান্তরে গমন করেন। ফলে বৈষ্ণবীয় উৎসব অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নবদ্বীপে যে রাস উৎসবের সূচনা হয় তা অভিনব এবং বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে তা অদ্বিতীয়।
এগুলি পুরাণের কথা। রাসের ব্যাখ্যা পেতে চাইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বাংলার ভাবান্দোলন যার সূত্রপাত হয় মূলত দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব ও তৎপরবর্তী চন্ডীদাস (১৪শ শতক) ও বিদ্যাপতির (আনু. ১৩৭৪-১৪৬০) বৈষ্ণবপদ রচনার মধ্য দিয়ে। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণকে দেখেছেন স্রষ্টা আর রাধাকে দেখেছেন সৃষ্টির প্রতিনিধি হিসাবে। স্রস্টার কাছে পৌঁছানোর সহজতম তরিকা হল প্রেম৷ দীর্ঘকাল ধরে সুফি সাধকরা বাংলায় ‘ইশক’ এর মাধ্যমে খোদায় লীন হয়ে যাওয়ার ধারনাটি প্রচার করছিলেন। সুফি-সাধকরা বলতেন, ‘ হক্ এর সঙ্গে জীবের মিলনের একটিই পথ, তা হল প্রেম বা ইশক’৷ নদীয়ার শ্রীচৈতন্যের রাধাভিত্তিক ভাবান্দোলনের সাথে এই দর্শনের গভীর যোগসূত্র পাওয়া যায়৷ চৈতন্যদেব রাধার মতো পরমাত্মায় লীন হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন৷ মুলত শ্রীচৈতন্য জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের ধারনাটি লাভ করেছিলেন বাংলার সুফি-সাধকদের কাছ থেকেই।
মণিপুরিদের রাসলীলাটি মুলত একটি নাট্য আঙ্গিক। বলা ভাল ক্লাসিক্যাল নাট্য আঙ্গিক। এমনিতে মণিপুরের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ধারণা করা হয় এদের ঐতিহ্যগত লোকনৃত্যই কালক্রমে ধ্রুপদী নৃত্যধারায় পরিণত হয়েছে। মণিপুরিদের রাস ও রাসের থিম ভারতবর্ষে প্রচলিত অন্যান্য রাসের চেয়ে আলাদা। মণিপুরি পুরাণ লেখকরা দাবি করেছেন, মিথলজি অনুসারে মণিপুর রাজ্যই হলো সেই স্থান যেখানে রাধাকৃষ্ণের অনুসরনে শিব পার্বতী রাসলীলা করেন। পুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী মণিপুরের কৌব্রু পর্বতকে রাসলীলার উপযুক্ত করে তোলার জন্য শিব সূর্য, চন্দ্র এবং পাঁচটি গ্রহকে আহ্বান করেছিলেন। মণিপুরি ভাষায় এদের নাম হলো নোঙমাইজিঙ (সূর্য), নিঙ্‌থোউকাপা (চন্দ্র), লেইপাক্‌পোকপা (মঙ্গল), য়ুমসাঙকেইসা (বুধ), সাগোলসেন (বৃহস্পতি), ইরাই (শুক্র) এবং থাঙজা (শনি)। সাতদিন সাতরাত শিব-পার্বতীর রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত সহযোগী ছিলেন গন্ধর্ব এবং অন্যান্য দেবতারা। রাত্রিবেলার অনুষ্ঠানের জন্য নাগরাজ অনন্তদেব তাঁর মাথার মণি দান করেন। নাগদেবের মণির নামানুসারে এই স্থানের নাম হয় মণিপুর।
পুরাণকাররা তাদের মতো করে ইতিহাস রচনা করেছেন। বস্তুত এই পুরাণগুলি লেখা হয়েছে দ্বাদশ শতকের দিকে যখন শৈবধর্মের প্রকট প্রভাব ছিল। ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর এই অঞ্চলে শৈবমতাদর্শের লোকেরা একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা ভিন্নমতের গ্রন্থাদি ও নিদর্শন ধ্বংস করে দেন। এর ফলে মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু মণিপুরের বৈষ্ণবরাও শিবকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করতো ফলে শিব-পার্বতীর লীলাভিত্তিক গীত ও নৃত্য থেকে যায়। তারপর ইতিহাসের এক সময়ে বাঙলার ভাবান্দোলন যখন মণিপুর গিয়ে পৌঁছে তখন বৈষ্ণব পদকর্তাদের রচনাবলী মণিপুরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এগুলির উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় মণিপুরি রাসলীলার আঙ্গিক। ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার সাথে মণিপুরের লোকনৃত্যের ঐক্যতানে গড়ে উঠে এই নব্য ক্লাসিক্যাল শিল্পআঙ্গিক। রাধাকৃষ্ণের দর্শন গিয়েছিল বঙ্গ থেকেই। মণিপুরি রাসের গানগুলিও বাংলা ও ব্রজভাষায়, অধিকাংশই বাঙ্গালি বৈষ্ণব কবি ও পদকর্তাদের লেখা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে রাসলীলা যেটি ছিল দ্বাপর যুগের ঘটনা এবং যার সংঘটন স্থান ছিল শ্রীব্রজধাম, সেটাই এই যুগে এসে হয়েছে পূণ্যতিথি রাসপূর্ণিমা। ভারতবর্ষের নানান স্থানের কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবরা নানানভাবে রাস উদযাপন করে থাকেন। শাক্তরা পূর্ণিমার এই দিনে দেবদেবীদের নানান মূর্তি বানিয়ে পুজা দিত। নবদ্বীপের রাস উৎসবে পটুয়াদের দিয়ে বড় বড় পট আঁকিয়ে মঠে-মন্দিরে প্রদর্শন করা হত। তাই রাসপূর্ণিমার আরেক নাম ‘পট পূর্ণিমা’। আর ওপরে গরুর গাড়ির চাকার থেকেও বড় বড় কাঠের চাকা তৈরি করে তার মাঝখানে রাধাকৃষ্ণকে বসিয়ে চারপাশে অষ্টসখীর মূর্তি বসানো হত। আর ধীরে ধীরে সেই চাকার সাথে অষ্টসখীদের ঘোরানো হত। এই ছিল রাস। এখনও অনেক অঞ্চলে তাই আছে।
ভারতবর্ষে নাট্যাভিনয় ও নৃত্যগীতনির্ভর রাস উৎসবের প্রবর্তন করেন মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ (১৭৪৮-১৭৯৯)। ভাগ্যচন্দ্র সিংহ রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে সাজান। তার উদ্যোগে মণিপুর রাজ্যে প্রথম রাসলীলা মঞ্চস্থ হয় ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে। সেই রাসে তার কন্যা রাজকন্যা বিম্ববতী রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেন, তিনি নিজে মৃদঙ্গবাদকের দ্বায়িত্ব পালন করেন। জনশ্রুতি আছে, ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নাদ্রিষ্ট হয়ে রাসলীলা করার তাগিদ পান। রাসের জাঁকজমকপূর্ণ ও শৈল্পিক কারুকার্যখচিত পোষাকগুলোও তিনি স্বপ্নে পেয়েছিলেন বলে মণিপুরি লেখকদের বয়ান থেকে জানা যায়। বিষয়টার এরকম ব্যাখ্যা হতে পারে যে, ভাগ্যচন্দ্র একজন বড় মাপের চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী রাজা ছিলেন। রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে রূপ দিতে তিনি অহর্নিশ পরিশ্রম করেছেন। পঠনপাঠন ধ্যান করতে করতে তিনি মন্দিরেই ঘুমিয়ে পড়তেন। রাসের নাচ, গান, সুর, তাল ও মুদ্রাগুলোকে তিনি একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন যার নাম ‘গোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস’। রাজা ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে বসে ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর সময়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠে।
মণিপুরীদের রাসলীলার উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদে, নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে যে রাজকীয় গাম্ভীর্য দেখা যায় তাতে অনেক সময় একে রাজদরবারের পরিবেশনা বলেই ভ্রম হয়। অবশ্য রাসের জন্ম হয়েছে রাজদরবারে এই সত্যটি মেনে নিলে এটা নিয়ে কিছু বলার থাকে না। রাসের কষ্টিউমটির নাম ‘পল্লই’। এটি কমপক্ষে ১০টি ভাগে বিভক্ত। যেমন মাথার উপরিভাগে থাকে ‘কোকতোম্বি’। মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ উড়নাটির নাম ‘মেইখুম্বী’। গায়ে থাকে সোনালি ও রূপালি চুমকির কারুকাজের ঘন সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ যার নাম ফুরিৎ। কোমর পর্যন্ত বক্ষবন্ধরী যার নাম থাব্রেৎ। পল্লইয়ের মুল অংশের নাম ‘কুমিন’। অজস্র চুমকি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়নার দ্বারা এই অংশটি কারুকাজ করা থাকে, যা সামান্য আলোতেও ঝলমল করে ওঠে। আছে জরির কারুকাজ করা পেশোয়ান, খোল, খাঙ্গই। সাথে মণিপুরি স্বর্নালঙ্কার তো আছেই।
এই রাজসিক বিষয়টাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করেছে সাধারণ মণিপুরি জনগণ। ধর্ম-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই আছে যেখানে রাজদরবারের বস্তু সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু মণিপুরীদের রাসলীলার ক্ষেত্রে এমন ব্যপার ঘটেছে। রাসলীলা এখন আর রাজার সংস্কৃতি হয়ে নেই, তা হয়ে গেছে সাধারণের সংস্কৃতি।
এই কারণে রাসের ঐ ভারী ‘পল্লই’টি মণিপুরি বিবাহের অত্যবশ্যকীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। বিবাহের রাতে মণিপুরি মৈতৈ ও মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া কনেকে কারুকার্যখচিত এই পোশাকটি পড়তে হয়। আরো আশ্চর্যজনক যে মণিপুরি পাঙন যারা ধর্মে মুসলিম, তারাও বিবাহের দিনে রাসনৃত্যের এই পোশাকটি পরিধান করে।
কেন সাধারন একটি নাচগানের অনুষ্ঠান, একটি শিল্পআঙ্গিক একটা গোটা জনগোষ্ঠির কৃত্যে পরিণত হলো, তার পেছনে গুঢ় রাজনৈতিক সমাজবৈজ্ঞানিক কার্যকারণ লুকিয়ে আছে।
মণিপুরি রাসের শুরুতে বলা হয়, ‘রাস আরম্ভিলা ভাগ্যচন্দ্র মনোহর’, এটা মুলত মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র যিনি রাস প্রবর্তন করেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে করা হয়। এরপর থাকে বৃন্দা নর্তন ও কৃষ্ণ নর্তন৷ ভাগবত পুরাণের রাস-পঞ্চ-অধ্যায় অবলম্বনে কৃষ্ণ অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, মণ্ডলী সজ্জা, গোপীদের রাগালাপ, কৃষ্ণ-রাধা নর্তন, গোপিনীদের নর্তন, ভঙ্গি পারেং, রাধা কৃষ্ণের নৃত্যে কৃষ্ণের পরাজয় ও রাধার বাঁশি লাভ, কৃষ্ণের অন্তর্ধান, রাধা বিরহ, কৃষ্ণের পুণরাগমন ও যুগলমিলন এরকম কয়েকটি পর্বে থাকে মণিপুরি মহারাসে৷ টানা সাত থেকে আট ঘন্টা এই নৃত্যগীত চলে একটু সময়ও না থেমে৷ এখানে রাসের প্রণিক্ষক বা গুরু ছাড়াও সূত্রধারী ও মৃদঙ্গবাদকেরা বড় ভূমিকা রাখেন৷ রাসের ধারাবাহিকতা, এর সাথে সংশ্লিষ্ট কৃত্য এবং ভক্তসাধারনের ভাবভঙ্গি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাষ মণিপুরি রাসলীলা কেবল একটি নৃত্যের অনুষ্ঠান বা নাটক নয়, এটা অন্য কিছু। রাস দেখতে দেখতে উপস্থিত ভক্ত ও দর্শকেরা রাধা, কৃষ্ণ ও গোপীদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে, অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে, রাস দেখতে আসা স্বজনরা একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে। রাসের কয়েকটি অংশ বিশেষভাবে আবেগময় যেমন বিরহপর্বে কৃষ্ণের অন্তর্ধানের পর রাধার মূর্চ্ছা যাওয়া, গোপীদের বিলাপ ও পদচিহ্ন অনুসরন করে কৃষ্ণকে খুঁজতে যাওয়ার অংশটুকু বেশ মর্মস্পর্শী।
মণিপুরি রাসের মুলভাব ভাগবৎ পুরাণ ও বৈষ্ণব কবিদের কাব্য থেকে নেয়া হলেও এর কেন্দ্রে থাকেন বৃন্দা নামের এক চরিত্র। পুরাণ পাঠে বুঝা যায় বৃন্দা সম্পুর্ণ লোকমানসজাত এক চরিত্র৷ বৃন্দা রাধার একজন দূতী কিন্তু রাস শুরু হয় বৃন্দা নর্তন দিয়েই। বৃন্দা মণিপুরি রাসের ‘চিংপী’ বা সঞ্চালিকা। রাধাকৃষ্ণকে ছাপিয়ে তিনিই মণিপুরি রাসলীলার প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেন। মণিপুরী রাসলীলা মুলত বৃন্দাদেবীরই রাসলীলা। তাকে অনুসরন করেই অন্য গোপিনীরা নৃত্যগীত করেন। নৃত্যগুরুর কড়া নির্দেশ থাকে বৃন্দা ভুল করলে সেই ভুল ভঙ্গিতেই নাচতে হবে অন্যদের।
‘বৃন্দা’ শব্দটি ‘বৃন্দাবন’ থেকে এসেছে নাকি ‘বৃন্দাবন’ নামটিই ‘বৃন্দা’ থেকে এল বলা মুস্কিল। ইম্পেরিয়েল গেজেটিয়ার অফ ইন্ডিয়া (১৯০৯) অবশ্য বলছে সংস্কৃত ভাষায় ‘বৃন্দাবন’ কথাটি এসেছে ‘বৃন্দা’ (তুলসী) ও ‘বন’ (অরণ্য) শব্দদুটি থেকে। বৈষ্ণবরা বলেন বৃন্দাই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত তুলসীদেবী। তুলসী সব ধরনের পূজার্চনাতেই লাগে, তাহলে কি তুলসীবৃক্ষই যমুনাপাড়ের বৃন্দা? বিষ্ণুর পরম ভক্ত বলে বৃন্দার আরেক নাম বিষ্ণুপ্রিয়া৷ যাহোক মণিপুরি রাসের বৃন্দাকে দেখে মনে হয় খুব লৌকিক, যেন পাশের বাড়ির ভজন গাওয়া মেয়েটি যে কেবল কৃষ্ণানুরাগীই নয়, একই সাথে রাধাঅন্তপ্রাণ। যে কৃষ্ণের জন্য কুঞ্জ সাজায়, যে রাধার নিত্যসহচরী হয়ে পাশে পাশে থাকে। যে আকুল কন্ঠে সে গায়, "আমি কৃষ্ণের প্রেমে কাঙ্গালিনী / বৃন্দাবনে বৃন্দা দুর্ভাগিনী / আমি যুগলচরণ সেবা করিব / যুগলরূপ নেহারিব / জীবন সফল করিব…।" তার মানে দুর্ভাগিনী বৃন্দা নিজে কৃষ্ণকে পেতে চান না, যুগলচরণ পেলেই খুশি। এই যে পরমসত্তার প্রতি সমর্পন, এই কি তাহলে ভক্তির মূল কথা?
নিত্যরাস, বসন্তরাস, মহারাস, দিবারাস মণিপুরি রাসের এরকম অনেকগুলো ফর্মের মধ্যে মহারাসের স্থান সর্ব্বোচ্চ যেটি হয় কার্তিক পূর্ণিমায়। যেকেউ চাইলেই মহারাস আয়োজনের সৌভাগ্য অর্জন করে না, এটি পালা করে ন্যস্ত হয় একেকটি পরিবারের কাঁধে। রাস নৃত্যগীতের সাধারন কোন আয়োজন নয়, এটা হয়ে গেছে কৃত্য ও কঠিন সাধনার ব্রত। রাসের এক মাস আগ থেকে এই সাধনা শুরু হয়। মাসব্যাপী চলে রাসের প্রস্তুতি। বিশেষ দিনে নাচের প্রশিক্ষক বা অজাকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রন জানানো হয়। তিনি রাজী থাকলে শুভ কোন তিথিতে শুরু হয় নাচের চর্চা, নৃত্যকলা ও শিল্পরস উত্তীর্ন হবার কঠিন শর্ত নিয়ে। রাসের মূদ্রাগুলো শাস্ত্রীয়, নৃত্যভঙ্গি ধ্রুপদী। সঙ্গীতগুলো লেখা বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষায়, কাব্যমানসম্পন্ন। সেগুলি শ্রুতিমধুর কণ্ঠে পরিবেশনের জন্য দুর দুরান্ত থেকে দক্ষ সূত্রধারী নিমন্ত্রণ করে আনা হয়। আনা হয় মৃদঙ্গবাদক। রাসের শিল্পীরা যে পোশাক পরবে তাও পবিত্র পোশাক, দেবতার কাছে রেখে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে তার পূজা দিতে হয়। রাসের আগের দিন ‘বার্তন চালানি’ বা গুরুকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাসে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রন। রাসের মঞ্চটি হতে হয় বাঁশ ও কাগজের তৈরী, তারও নিজস্ব ডিজাইন আছে। মঞ্চ বসাতে হয় মাঝখানে, দর্শকরা যাতে গোল হয়ে বসে দেখতে পারে। রাস শুরুর আগে আগে হয় নটপালা কীর্ত্তন, সেখানে রাসের সাফল্যের জন্য মঙ্গলকামনা করা হয়। এ এক বিশাল কান্ড। কেবল শিল্পের মাপকাঠি দিয়ে মেপে একটি জনপদের এই বিশাল কাণ্ডকে মাপা সম্ভব না । এই প্রযোজনাটির আড়ালে থাকে একটা গোটা জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব ও পরিচয় নির্মাণের নিরবিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। একটা জাতিসত্তা যারা এককালে নিজেদের ভূখন্ড হারিয়ে এদেশে এসে বাস করছে, সংখ্যাগুরুর চাপে নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে যে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, রাসলীলা সে লড়াইয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ।
রাসনৃত্যে সাধারণত রাধা ও কৃষ্ণের ভূমিকা দেয়া হয় শিশুদের, যাদের বয়স পাঁচের কম। মনিপুরীদের বিশ্বাস, এই বয়সের পর শিশুদের দৈবশক্তি লোপ পেয়ে যায়। তবে প্রকৃত নাটনৃত্য ও গীত পরিবেশন করে তরুণীরা, যারা রাধার সহচরী হিসাবে মঞ্চে আসে। রাসনৃত্যের কেন্দ্রবিন্দু ভঙ্গি পরেং অর্থাৎ নৃত্যমালিকা। রাসলীলা শুরু হয় নট সঙ্কীর্তন দিয়ে। গোবিন্দজীর মন্দিরের বিশাল মণ্ডপে আরাধ্য দেবতার মূর্তির সামনে শিল্পীরা মৃদঙ্গ ও করতাল সহযোগে সঙ্কীর্তন করে। বিশেষ পোশাকে সাজেন শিল্পীরা। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বন্দনা দিয়ে শুরু হয়ে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ব্যাপী রাসসঙ্গীত অনুষ্ঠিত হয়।


🌸🌻🌸🌻🌸🌻🌸🌻🌸🌻🌸🌻