শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭

আব্বাস্‌উদ্দীন



আব্বাস্উদ্দীন

শেয়ার করেছেন                 প্রণব কুমার কুণ্ডু।

পল্লীগীতি এবং লোকসঙ্গীত শিল্পী
আব্বাসউদ্দীন আহমদ (জন্মঃ- ২৭ অক্টোবর, ১৯০১ - মৃত্যুঃ- ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৫৯)
(আমার শিল্পী জীবনের কথা- আব্বাসউদ্দীন আহমদ-সৃষ্টি প্রকাশনী অনুযায়ী)

তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লীগায়ের একজন গায়ক। বিভিন্ন গ্রাম্য অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং নিজ চেষ্টায় গান গাওয়া রপ্ত করেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য তিনি ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছিলেন। রংপুর ও কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল চটকা গেয়ে আব্বাস উদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। তারপর জারি, সারি, ভাটিয়ালি , মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয় হন। তিনি তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লি গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও অদ্বিতীয়। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। আব্বাস উদ্দিন এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। আব্বাসউদ্দীনের প্রথম রেকর্ডে ছিল ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ও ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ গান দুটি। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে- ও আমার দরদী আগে জানলে, ওকি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরারে, মাঝি বাইয়া যাওরে, সোনাবন্ধুরে কোন দোষেতে যাইবা ছাড়িয়া, আমার হাড় কালা করলা মরে, আল্লাহ মেঘ দে পানি দে, নদীর কূল নাই কিনার নাইরে, আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি, আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে, থাকতে পারঘাটাতে তুমি পারের নাইয়া প্রভৃতি। এ ছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ তার কণ্ঠে প্রথম রেকর্ড করা হয়। আব্বাস উদ্দীন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন। প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭ সালে) ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংগীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তার্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।
আব্বাস উদ্দিন সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেনঃ আব্বাস উদ্দিন কেবল গায়ক ছিলেন না, এই প্রজন্মের গায়করা যদি ভাবেন আব্বাস উদ্দিন শুধু গান গেয়ে এদেশের মানুষের মন জয় করেছেন তাহলে তা মস্ত বড় ভুল হবে। আব্বাস তাঁর সময়কালের আকাঙ্খা ও সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন,সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল এবং আরো অনেকে।” তাঁর সন্তান ফেরদৌসী রহমান এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসীও গান গেয়ে খ্যাতি লাভ করেছেন।
জন্ম
বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। বলরামপুর স্কুলে আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এখান থেকে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সংগীত জগতে প্রবেশ করেন।
চলচ্চিত্রে অভিনয়
আব্বাসউদ্দিন আহমেদ মোট ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।এই ৪টি সিনেমা হলো 'বিষ্ণুমায়া' (১৯৩২),'মহানিশা' (১৯৩৬), 'একটি কথা' ও 'ঠিকাদার'(১৯৪০)। ঠিকাদার সিনেমাতে আব্বাস উদ্দিন একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে তিনি এর চেয়ে বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও তা উল্লেখ করেন নি। কারণ সেই চরিত্রগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এসব সিনেমাতে তিনি গানও করেছিলেন।
গ্রন্থ ও পুরস্কার
আমার শিল্পীজীবনের কথা (১৯৬০) আব্বাস উদ্দীনের রচিত একমাত্র গ্রন্থ। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন।
মৃত্যু
১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর পল্লীগানের এই মহান সম্রাট মৃত্যুবরণ করেন।
আব্বাসউদ্দীন
(একটি ছোটো স্মৃতিচারণা)
মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্
শৈশবে গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনেই তার নামের সাথে প্রথম পরিচয়। আব্বাসউদ্দীনের গান ছাড়া তখন কোনো ‘কলের গানের আসর’ জমতো না। গ্রামোফোনের রেকর্ডের গানকেই সে সময় বলা হতো ‘কলের গান’। গ্রামে কারো বাড়িতে ‘কলের গান’ শুরু হলে আমরা দৌড়ে গিয়ে ভিড় জমাতাম, সেই গানের আসরে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত। কত রাত জেগে যে ‘কলের গান’ শুনেছি, সে কথা ভাবলে আজও বিস্ময় লাগে।
আমাদের শৈশব-কৈশোরে গ্রামোফোন রেকর্ডে কত নামকরা কণ্ঠশিল্পীর গানই না শুনেছি। কিন্তু আব্বাসউদ্দীনের গান বেশি শুনতে না পারলে আমাদের মন ভরতো না। তাই ‘কলের গানের আসরে’ গেলেই আমাদের ফরমাশ হতো আব্বাসউদ্দীনের গানের জন্যে। গানের ভালোমন্দ তখন কিছুই বুঝতাম না; গানের গায়কী, গলার কাজ, সুরের মাধুর্য, রচনার উৎকর্ষ ইত্যাদি কাকে বলে তাও ছিল অজানা। তবুও, সুকণ্ঠ গায়কের গান ভালো লাগতো, আব্বাসউদ্দীনের রেকর্ড বাজলে আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম।
আব্বাসউদ্দীন কৈশোরেই আমাদের মন হরণ করেছিলেন। পল্লীগীতির প্রতি আমার আকর্ষণ আশৈশব। ভাটিয়ালী, বাউল, মুর্শিদী, মারফতি প্রভৃতি সুকণ্ঠে গীত হলে আজও আমি তন্ময় হয়ে শুনি। আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া ইসলামী গান, ভাটিয়ালী, বাউল, মুর্শিদী, মারফতি গান আমার শোনার আগ্রহকে সেই কৈশোরেই বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার গান যখন শুনতাম, যেন মনে হতো গায়ককেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
আব্বাসউদ্দীনের ছবি দেখেছিলাম পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠায়, গ্রামোফোন রেকর্ডের বিজ্ঞাপনে। কিন্তু কৈশোরেই তাকে নিজের চোখে দেখার সাধ জেগেছিল। আর সৌভাগ্যক্রমে, আমার স্কুল জীবনেই আব্বাসউদ্দীনকে দেখেছিলাম এক বিশাল জনসভায়। সেই জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন জননেতা হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, আর গান গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও তার সঙ্গীরা। হাজার হাজার শ্রোতাকে তারা সেদিন মাতিয়ে দিয়েছিলেন গান গেয়ে। আব্বাসউদ্দীনের গানে আগে থেকেই মুগ্ধ ছিলাম, সেদিন তাকে দেখেও মুগ্ধ হলাম।
মঞ্চের উপর হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছিলেন শিল্পী আব্বাসউদ্দীন, তার চারপাশে সহশিল্পীবৃন্দ। ফর্সা সুন্দর চেহারা ও বাবড়ি চুলওয়ালা আব্বাসউদ্দীনের পরনে ছিল সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবী, গলায় চাদর। দূর থেকে মনে হচ্ছিল যেন একজন তন্ময় সাধক ও মরমী ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন। গান শুরু করার আগে তিনি শুদ্ধ ভাষায় চমৎকার উচ্চারণে দু’একটি কথা বললেন তারপর আঙুল চালালেন হারমোনিয়ামের রিডে। সেদিন তিনি গান গাওয়ার আগে কী কথা বলেছিলেন, এতকাল পর তা আর মনে নেই। যদিও প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার সেই গানের আসরের স্মৃতি আমার মনে জীবন্ত হয়ে আছে।
পরবর্তীকালে অনেক জলসায় আব্বাসউদ্দীনের গান শোনার, তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হওয়ায় লক্ষ্য করেছি, তিনি গান শুরু করার আগে প্রায়ই কিছু কথা বলতেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গানের কথার মর্ম শ্রোতাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতেন। তার বাসভবনে ঘরোয়া আসরেও অন্তরঙ্গ পরিবেশে যখন শিল্পীকণ্ঠে গান শুনেছি, তখনও এর ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি। সেই অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে আব্বাসউদ্দীনের ইন্তেকালের পর এক নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম, ‘ঘরোয়া মজলিসে যারা তার গান শোনার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তারা অবশ্যই লক্ষ করেছেন যে, গীতি-কাব্যের উৎকর্ষ অপকর্ষ সম্পর্কে প্রায়ই তিনি আবেগমুখর হয়ে উঠতেন এবং যে-কোনো সঙ্গীত পরিবেশনের আগে সঙ্গীতের বাণীটি সম্পর্কে তিনি শ্রোতার মনে আকর্ষণ ও আবেগ সৃষ্টির প্রয়াস পেতেন। গান গাইতে গাইতে তিনি মাঝে মাঝে এমন আবেগ-উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন যে, তা সমবেত শ্রোতাদের মনে সংক্রামকের মতো প্রভাব বিস্তার করতো।’
কৈশোরের স্মৃতি মনে সঞ্জীবিত ছিল বলেই আব্বাসউদ্দীনকে খুব কাছ থেকে দেখার সাধ মনে মনে পোষণ করেছিলাম। পঞ্চাশ সালের দিকে ঢাকা আসার পর অনেক খ্যাতনামা শিল্পী সাহিত্যিকের সাথেই পরিচয়ের সুযোগ হয়। কিন্তু আব্বাসউদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ পরিচয়ের কিংবা তার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ তখনো হয়নি। ঢাকা কলেজে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নকালেই শুনেছিলাম পুরানা পল্টনে আব্বাসউদ্দীনের একটি বাড়ি আছে। তাকে দেখার বাসনা নিয়েই একদিন খুঁজে খুঁজে ঐ বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু গিয়ে শুনলাম, এই বাড়িতে আব্বাসউদ্দীন থাকেন না, সেখানে কেন্দ্রীয় প্রকাশনা-দফতর ও ‘মাহে-নও’ পত্রিকার অফিস।
আব্বাসউদ্দীনের এই বাড়িটির নাম ‘হীরামন মঞ্জিল’। জিপিও-র পেছনে ‘মুক্তাঙ্গনের’ পাশে একটু অভ্যন্তরে ‘হীরামন মঞ্জিল’ অবস্থিত। আব্বাসউদ্দীনের স্মৃতিধন্য এই বাড়িতে এখনও তার পরিবার-পরিজন বাস করেন। আমাদের অনেক স্মৃতিই এই বাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে। প্রথম এই বাড়িটি দেখতে গিয়ে শুনেছিলাম, পুরানা পল্টনের এই বাড়ির সঙ্গে আব্বাসউদ্দীন তার কুচবিহারের পৈতৃক বাড়ি ‘হীরামন মঞ্জিল’ বদল করেছেন। শিল্পীর মা মরহুমা হীরামন নেসার নামেই বাড়ির নাম ‘হীরামন মঞ্জিল’ রাখা হয়েছিল। সেই স্মৃতি সঞ্জীবিত রাখার জন্যে তিনি এই বাড়িটিরও নাম রেখেছেন ‘হীরামন মঞ্জিল’।
‘হীরামন মঞ্জিলে’ গিয়ে সেদিন শিল্পী আব্বাসউদ্দীনকে পাইনি। কিন্তু পেলাম কয়েকজন খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিককে। মনে পড়ে, কবি তালিম হোসেন, কবি আশরাফ সিদ্দিকী, কবি আবদুল রশীদ খান প্রমুখের সাথে ‘হীরামন মঞ্জিলের’ ‘মাহে-নও’ অফিসেই আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। ‘মাহে-নও’-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন তখন জনাব এম. এ. নান্না। তার আসল নাম আলী আহমদ হলেও তিনি এম. এ. নান্না নামেই পরিচিত ছিলেন। কুমিল্লার অধিবাসী জনাব এ নান্না চমৎকার ইংরেজি লিখতেন। ইংরেজিতে তার এতখানি দখল ছিল যে তিনি কোনো ড্রাফট না করেই টাইপরাইটারে অবলীলায় বড় বড় প্রবন্ধ তৈরি করে ফেলতেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে লেখা তার অনেক প্রবন্ধ ডন, পাকিস্তান টাইমস, পাকিস্তান অবজারভার ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাও তিনি লিখতেন, তবে বাংলা ভাষার ওপর তার তেমন দখল ছিল না। তাছাড়া তিনি তার বাংলা রচনায় আরবি-ফারসি শব্দ খুব বেশি ব্যবহার করতেন, কিন্তু তা সর্বত্র সুপ্রযুক্ত হতো না বলে উপভোগ্য আনন্দের স্বাদ দিতো না। এম. এ. নান্না লোকান্তরিত হয়েছেন কয়েক বছর আগে, সে সময়ে তিনি সম্ভবত রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। তার মৃত্যু-সংবাদ পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো শিল্পী-সাহিত্যিকই এই অমায়িক সদাহাস্যমুখ ও সাহিত্যপ্রাণ ব্যক্তিটিকে স্মরণ করেন নি। এম. এ. নান্নাই ‘হীরামন মঞ্জিলে’ আমাকে কবি তালিম হোসেন ও অন্যান্য অনেক কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কবি তালিম হোসেন ছিলেন তার সহকর্মী ‘মাহে-নও’-এর সহসম্পাদক। পরবর্তীকালে আমিও তাদের সহকর্মী হয়েছিলাম। ঐ ‘হীরামন মঞ্জিলেই’ অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের সঙ্গে আমি প্রথম পরিচিত হই। তিনি ছিলেন তখন ‘মাহে-নও’ পত্রিকার সম্পাদক। পরে তার জায়গায় কবি আবদুল কাদির ‘মাহে-নও’-এর সম্পাদক হয়ে আসেন এবং ‘মাহে-নও’ অফিসও পরবর্তীকালে ৬নং পুরানা পল্টনে স্থানান্তরিত হয়ে যায়।
‘হীরামন মঞ্জিলের’ পাশের ঠিক উল্টোদিকেই ছিল ব্রিটিশ ইনফরমেশন অফিস ও লাইব্রেরি। এই সমৃদ্ধ লাইব্রেরিটিও ছিল আমাদের অন্যতম আকর্ষণ। সময় পেলেই আমরা এই তথ্যকেন্দ্র ও লাইব্রেরিতে বই পড়ার জন্যে যেতাম। সেখানে গেলেই ‘হীরামন মঞ্জিলে’ ও ‘মাহে-নও’ অফিসেও যাওয়া হতো, দেখা-সাক্ষাৎ হতো কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। তরুণ কবি ও কুমিল্লার অধিবাসী হিসেবে নান্না সাহেব আমাকে বেশ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। সম্ভবত চুয়ান্ন কী পঞ্চান্ন সালের দিকে ‘মাহে-নও’ অফিস ৬নং পুরানা পল্টনে স্থানান্তরিত হয়। আর ব্রিটিশ ইনফরমেশন অফিসের লাইব্রেরিটিও পরবর্তীকালে এক অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এর পেছনে অবশ্য একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনা এবং জনতার রোষবহ্নি ছিল। ১৯৫৬ সালে মিসরের ওপর ব্রিটেনের হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় এক বিরাট মিছিল হয় এবং মিছিলকারীরা এক পর্যায়ে ব্রিটিশ ইনফরমেশন অফিসের এই লাইব্ররিতে অগ্নিসংযোগ করে। সেই আগুনে কাঠের তৈরি এই বাঙলো বাড়িটি পুড়ে যায়।
‘মাহে-নও’ অফিস স্থানান্তরিত হয়ে গেলেও, ‘হীরামন মঞ্জিল’-এর আকর্ষণ আমাদের জন্যে এতটুকুও কমেনি। শিল্পী আব্বাসউদ্দীনই ছিলেন সেই আকর্ষণের উৎস। তিনি তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে ‘হীরামন মঞ্জিলে’ স্থায়ীভাবে বাস করছেন। তার বাসভবনে প্রায়ই সাহিত্যসভা, সঙ্গীতের আসর বসেছে, তাতে অংশ নিয়েছেন খ্যাতনামা শিল্পী-সাহিত্যিক ও গায়করা। তরুণ লেখক শিল্পী-সঙ্গীতের অনুরাগী হিসেবে আমরাও মাঝে-মাঝে যোগ দিয়েছি সে-সব আসরে, কখনো আমন্ত্রিত হয়ে, কখনো বা বিনা আমন্ত্রণেই। আব্বাসউদ্দীন তখন সরকারি প্রচার-বিভাগে ‘সং-পাবলিসিটি’র অর্গানাইজার। তার সহকর্মী তারই হাতে-গড়া অনেক খ্যাতনামা গায়ক-শিল্পী, তারাও অনেকেই আসেন সে-সব সাহিত্যসভা ও সঙ্গীতের আসরে। কথায়, কবিতায়, গানে-গল্পে প্রতিটি আসরই জমজমাট হয়ে ওঠে।
আব্বাসউদ্দীন শুধু সুকণ্ঠ শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সুরসিক, সদা হাস্যালাপী। গানে যেমন, তেমনি কথায়ও তিনি মাতিয়ে তুলতেন। গান গাওয়া তখন তিনি অনেকটা ছেড়ে দিয়েছেন, তবুও তিনি ছিলেন আসরের মধ্যমণি। তাকে ঘিরে কবি-সাহিত্যিক-গায়কদের আসর বসতো। এসব আসরেই বেদারউদ্দিন আহমদ, মমতাজ আলী খান, সোহরাব হোসেন, আবদুল লতিফ, ওসমান খান, আবদুল আলীম, গোলাম মোস্তফা, শমশের আলী, শামসুদ্দোহা এবং আরো অনেক শিল্পীর গান খুব কাছ থেকে শোনার সুযোগ হয়। আর ফেরদৌসী বেগম ও মোস্তফা জামান আব্বাসীর গান কত যে শুনেছি, তার তো ইয়াত্তাই নেই। এরা দু’জনই তখন খুব ছোট, গুণীপিতার সযতেœ লালনে অশেষ সম্ভাবনা আর প্রতিশ্রুতি নিয়ে বড় হয়ে উঠছেন। তখনই তাদের গানে শ্রোতারা মুগ্ধ।
মনে পড়ে, সাহিত্যের আসর ও গানের জলসা বসতো ‘হীরামন মঞ্জিল’-এর পশ্চিম দিকের একটি প্রশস্ত কামরায়। কার্পেট বিছানো, সাদা চাদরে ঢাকা কামরায় আমরা বসতাম জমাট হয়ে, ক্রমে লোকে ঘর ভরে যেতো, তারপর এক সময় শুরু হতো সাহিত্যসভা, কী গানের আসর। সন্ধ্যা পেরিয়ে অনেক সময়ই বেশ রাত হয়ে যেতো, কিন্তু আসর সহজে ভাঙতো না। ফেরদৌসী যেদিন কাসিক্যাল, কী পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী-ভাওয়াইয়া গাইতেন কিংবা ওদের দুই ভাইবোনের দ্বৈত-সঙ্গীত হতো, সেদিন আসর চলতো অনেক রাত অবধি। শিল্পী ও সমঝদার পিতা পুত্র-কন্যাকে নিজেই ফরমাশ দিতেন বিশেষ বিশেষ গান গাওয়ার জন্যে। ট্র্যাজিক ও করুণামিশ্রিত গানের প্রতি শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের ছিল অনেকটা সহজাত টান। মনে পড়ে, তিনি ফেরদৌসী ও আব্বাসীকে প্রায়ই ফরমাশ করতেন ঐ ধরনের কিছু গান পরিবেশনের জন্য। প্রায় আসরেই তার ফরমাশে ওদের গাইতে হতো ‘ও গাড়িয়াল ভাই’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা’, ‘আবো নওদাড়ীটা মরিয়া’, ‘প্রেম জানেনা রসিক কালা চান্দ’, ‘এত রাত্রে কেন ডাক দিলে’ ইত্যাদি অনেক গান। আব্বাসউদ্দীন নিজে তখন গান গাওয়া একরূপ ছেড়ে দিলেও অনুরাগীদের অনুরোধে তাকেও মাঝে মাঝে গাইতে হতো। তিনি তখন প্রায়ই গাইতেন, ‘দিনার দিন দিন ফুরাইল শুকনাতে তরুণী’। তার কণ্ঠে এই গান শুনে আমাদের চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠতো।
আব্বাসউদ্দীনের আরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয় চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন সালের দিকে। সে-সময়ে আমরা ‘পাকিস্তান মজলিস’ নামে একটি সাহিত্য-সংস্কৃতি সংস্থা গঠন করেছিলাম। কবি গোলাম মোস্তফা, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, কবি মঈনুদ্দীন, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, ইব্রাহীম খাঁ, মুজিবুর রহমান খাঁ, ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, সৈয়দ আলী আশরাফ আরও অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকই ছিলেন এই সংস্থার সাথে জড়িত। শিল্পী আব্বাসউদ্দীনেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এই সংস্থার সাথে। তার বাসভবন ‘হীরামন মঞ্জিল’-এ পাকিস্তান মজলিসের বৈঠক একাধিক বারই অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্ভবত এই সাহিত্য-সংস্কৃতি সংস্থা গঠিতও হয় সেখানে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকেই। পাকিস্তান মজলিসের উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন সঙ্গীত বিষয়ে একটি প্রবন্ধও পাঠ করেন। আব্বাসউদ্দীনের বাসভবনে সে-সময়ে প্রায়ই সাহিত্য-সভা বসতো।
মনে পড়ে এমনি এক সাহিত্য-সভায় শিল্পীর জ্যেষ্ঠপুত্র জনাব মোস্তফা কামাল আমার লেখা ‘মেঘ-রৌদ্রের খেলা’ শীর্ষক একটি কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। মোস্তফা কামাল মেধাবী ছাত্র, সুবক্তা এবং সুলেখক হিসেবে ছিলেন তখনই বিশেষ পরিচিত। তার মুখে সেদিন আমার কবিতাটির সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
মোস্তফা কামাল এখন খ্যাতনামা ব্যারিস্টার। এককালে প্রচুর প্রবন্ধ লিখলেও, এখন আর লেখেন না বললেই চলে। অন্তত তার লেখা পত্রিকায় তেমন দেখা যায় না। তাদের বাসভবন ‘হীরামন মঞ্জিলে’ সাহিত্য সভা তো হতোই, নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি পর্ব উপলক্ষেও আয়োজিত হতো সাহিত্যসভা, বসতো গানের আসর। আব্বাসউদ্দীন অসুস্থ হয়েছেন, তবু তিনি তাতে শরিক হয়েছেন। ‘হীরামন মঞ্জিলের’ প্রাঙ্গণে-ফুলবাগানের শোভায় বিমণ্ডিত পরিবেশে আয়োজিত অনেক বৈকালিক অনুষ্ঠান আজও আমাদের স্মৃতি হয়ে আছে। আব্বাসউদ্দীনের অসুস্থতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য সঙ্গীতের আসরও ক্রমে ক্রমে কমতে থাকে। কিন্তু সেই সদাহাস্যমুখ, সুরসিক ও সঙ্গীত পিপাসু শিল্পীর মনে ও অবয়বে অসুস্থতার কোনো ছায়া ফেলতে পারেনি। যখনই কোনো শিল্পী-সাহিত্যিক, বন্ধু-বান্ধব তার কাছে গিয়েছেন, সবাইকে তিনি হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।
আব্বাসউদ্দীন যখন একেবারে বিছানা নিয়েছেন তখন তার কাছে অনেকবারই গিয়েছি। কবি আবদুল কাদির, কবি তালিম হোসেন, ইজাবউদ্দীন আহমদ, কবি আজিজুর রহমান এবং আরও অনেকের সঙ্গেই সে সময়ে তার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এদের সাথে ছিল তার দীর্ঘকালের পরিচয় ও সৌহার্দ্যরে সম্পর্ক। তার কাছে গেলে সেই অসুস্থতার সময়েও তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন। মনে পড়ে অসুস্থ আব্বাসউদ্দীন তার আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’র অংশবিশেষ আমাদের পড়ে শুনিয়েছিলেন। তার পরিচ্ছন্ন ও চমৎকার হাতের লেখা দেখে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমরা বসে থাকতে থাকতেই তার এক অনুরাগী অসুস্থ শিল্পীর জন্যে কিছু ‘দাওয়াই’ নিয়ে এলেন। শিল্পীর মুখেই শুনলাম, তার ভক্ত অনুরক্তদের অনেকেই দূর-দূরান্তর থেকে ওষুধপত্র, লতাপাতা, তাগা-তাবিজ, পানিপড়া ইত্যাদি পাঠিয়ে থাকেন। অনেকে চিঠি লিখে শিল্পীর অসুস্থতায় তাদের মনোবেদনা প্রকাশ করেন, সেই চিঠিতে থাকে তার আশু রোগনিরাময়ের জন্যে আন্তরিক ও আকূল প্রার্থনার ভাষা। দু’একটি চিঠি পড়ে আমরাও অভিভূত হয়েছিলাম।
কিন্তু কারো ওষুধে আন্তরিক প্রার্থনায়ও কোনো ফল হলো না। আব্বাসউদ্দীনের স্বাস্থ্যের অবনতিই হতে লাগলো। লক্ষ করলাম তার একটি পা শুকিয়ে তখনই একরূপ কাঠ হয়ে গেছে, যদিও শিল্পীর মুখের সেই অনিন্দ্য হাসিটি একেবারে ম্লান হয়নি। কিন্তু ক্রমে তার জীবনশক্তি কমে এল, তিনিও অসুস্থতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে লাগলেন। তারপর একদিন বিদায় নিলেন এই রৌদ্র-ছায়াময় পৃথিবী থেকে। ‘খাঁচার ভেতর যে অচিন পাখি’ আসা-যাওয়া করত সে চলে গেল কোন মহাশূন্যে এক অচেনা জগতে। কিন্তু গানের পাখি উড়ে গেলেও, তার স্মৃতি পড়ে রইল, পড়ে রইল সেই সুর সেই কণ্ঠ।
আজও যখন গ্রামোফোন রেকর্ডে, বেতারে তার গাওয়া গান শুনি, মুহূর্তেই তন্ময় হয়ে যাই, কৈশোরের-যৌবনের অনেক স্মৃতির ছবিই মনে ভেসে ওঠে, চেতনায় গুঞ্জরিত হয় সেই মরমী কণ্ঠস্বর, ‘দিনার দিন দিন ফুরাইল শুকনাতে তরণী/বইসারে দিন গুনি।’


তিতুমীর


তিতুমীর

শেয়ার করেছেন                                প্রণব কুমার কুণ্ডু ।




এই বাংলার মাটিতে তিতুমীর কে আমাদের কে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে প্রতিপন্ন করেই পরীক্ষায় পাশ করতে বাধ্য করা হয়েছে ।
মাধ্যমিকের সিলেবাসে আমাদের সমাজের ছাত্র/ছাত্রীরা পড়ছে,  তিতুমীর ওয়াহাবী আন্দোলনের জনক।
১৬/১১/১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে এই তিতুমীর বাদুড়িয়া থানার রামচন্দ্র পুর গ্রামের ব্রাক্ষ্মণ দের হিন্দু কন্যাদের ধরে ধরে মুসলমানদের সঙ্গে নিকা দিয়েছিল, তাদের পরিবারের লোকজনদেরর মুসলমান হতে বাধ্য করে সেই ব্রাক্ষ্মণ দের মুখে জোর করে গরুর মাংস দিয়ে ইসলামী শান্তি বিস্তার করে, তৎকালীন বসিরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তীকে ইসলাম গ্রহণের নির্দশ দেয়, তিনি তা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করলে,  বাঁশের কেল্লার নিকটবর্তী বুরুজ গ্রামের ইছামতী নদীর তীরে নিয়ে জবাই করে। 
যদি ইতিহাস জিহাদী তিতুমীরকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর তকমা দিতে পারে ----তবে নাথুরাম গডসের অপরাধ কি????

(তথ্য সংগ্রহ --- বাংলার মাটিতে ইসলামের উদয়। ডঃ রূদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়)