শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৭

সত্য



সত্য

শ্রী শ্রী আনন্দ মূর্ত্তিজি-এর লেখাটি শেয়ার করেছেন                 প্রণব কুমার কুণ্ডু।

Sanatan Dharma / সনাতন ধর্ম

বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদ বা মায়াবাদ বা উত্তর মীমাংসা দর্শন মতে,‘ব্রহ্ম সত্য , জগত মিথ্যা’ কতটা গ্রহণযোগ্য ?

‘সত্যম্‌’ শব্দের একটা মানে হল ‘ঋতম্‌’। আরেকটা মানে হল ‘পরহিতার্থং বাঙ্‌মনসো যথার্থত্বং সত্যম্‌’। অন্যের হিত করবার জন্যে,  বাক্যের দ্বারা,  অথবা মনের দ্বারা,  তুমি যে পথে চলছ,  সেই পথটার নাম সত্য। এখন ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা’ - জগৎ মিথ্যা, জীব নেই, তাহলে কার হিতটা করবে তুমি ? ‘পরহিতার্থং’ - পর বলে কেউ নেই, সুতরাং সত্য জিনিসটাও তো থাকছে না। তাহলে ‘ব্রহ্ম সত্যম্‌’ কী করে বলছ ?

সত্যের দ্বিতীয় মানে হচ্ছে,  অপরিণামী সত্তা, That undergoes no metamorphosis, যার মধ্যে কোন পরিবর্ত্তন হয় না। কারুর মধ্যে পরিবর্ত্তন হয় না বলে,  যদি কাউকে বিশিষ্ট করতে চাই,  তাহলে পরিবর্ত্তন বলে একটা ভাবনার অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকছে কি না ? আর সেই পরিবর্ত্তন আর অন্যান্যদের হয়, কেবল ওঁরই হয় না, তাহলে অন্যান্যরা তো থাকছেন,  যাদের মধ্যে পরিবর্ত্তন হয়। তবে তো একে আমি বিশিষ্ট করতে পারব,  যে এঁর মধ্যে পরিবর্ত্তন হয় না, আর বাকীদের মধ্যে পরিবর্ত্তন হয়। যাদের মধ্যে পরিবর্ত্তন হয় তাদের থেকে ইনি আলাদা, বাকীরা পরিণামী আর ইনি অপরিণামী। ওঁর পরিবর্ত্তন হয় না। কিন্তু বাকীদের তো স্বীকারই করছি না ! ‘জগন্মিথ্যা’ - জীব মিথ্যা; সুতরাং এর পরিণামিত্বও মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মের অস্তিত্ব বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে,  যদি জীব ও জগতের আপেক্ষিকতা স্বীকার না করা হয়। কী সাংঘাতিক জিনিস! বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে কী দারুণ অপচয় ! একে আমি intellectual extravaganza ছাড়া আর কিছুই বলতে পারি না। A foolish intellectual extravaganza , একটা নির্বোধাত্মক বৌদ্ধিক অপচয় ।

আর তৃতীয় জিনিসটা হচ্ছে কী ? - না, ‘সত্য’ শব্দের অন্য মানে হচ্ছে যা ঋত অর্থাৎ যা বাস্তবিকই ঘটেছে; যে ঘটনা ঘটেছে সেইটাকেই স্বীকৃতি দেওয়া বা তারই বিবৃতি দেওয়া - সেইটাকেই বলা হয় সত্য, ঘটনার যথাযথ পঞ্জীকরণ। এই সত্যের ভিত্তিতে যে শাস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে তাকে বলা হয় ইতিকথা (History) - ইতিহাস নয়, ইতিহাসের অন্য মানে। ঘটনার যথাযথ পঞ্জীকরণ, যা ঘটেছে,  তাই রেকর্ড করছি,  বা তাই বলছি - এ হল সত্য। এ অর্থে যদি দেখি, এক ব্রহ্মই আছেন, আর দ্বিতীয় কেউ নেই,  তাহলে ঘটনাই বা ঘটবে কি করে ? ব্রহ্ম ছাড়া তো কেউ নেই, কোন কিছু নেই -
“অষ্টকূলাচলাঃ সপ্তসমুদ্রাঃ ব্রহ্মপুরন্দর দিনকররুদ্রাঃ।
ন ত্বং নাহং নায়ং লোকঃ ব্যর্থ কিমর্থং ক্রিয়তে শোকঃ।।”
- এই অষ্টকুলাচল, এই সপ্ত সমুদ্র, এই যে বিরাট নিহারিকাপুঞ্জ, এই যে সৃষ্টিকারী ব্রহ্মা, সৃষ্টিকর্তা এই যে পুরন্দর, এই যে দিনকর অর্থাৎ সূর্য, এই যে রুদ্র অর্থাৎ কালাগ্নি - এরা কেউই নেই, তুমিও নেই, আমিও নেই, সুতরাং বৃথা এ বিষয়ে,  ও বিষয়ে চিন্তা করে কী করছ ? একথা বলা হচ্ছে বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদে। এরা কেউই যখন নেই - এদের পারস্পরিক সংঘর্ষে ও সমিতিতেই না ঘটনা ঘটছে । ধরো, এই পাশ বালিশটা ডাইনে থেকে এনে বাঁয়ে রাখা হল। এই পাশবালিশটা আছে, আর একজন লোক রয়েছেন যিনি পাশবালিশটা সরালেন। তবে এই সরাবার ঘটনাটা ঘটল। যখন ব্রহ্ম ছাড়া আর কেউই নেই তখন কোন ঘটনাও ঘটছে না। ঘটনা ঘটতে গেলে আরও মানুষ দরকার, বস্তু দরকার, ক্রিয়ার অন্বয় হওয়া দরকার। সুতরাং কিছুই হচ্ছে না। সুতরাং ঘটনা পঞ্জীকরণের প্রশ্নও উঠছে না। আর ঘটনা পঞ্জীকরণ করবার কোন মানুষও নেই, কোন কাগজ-পত্তরও,  পৃথিবীতে,  বিশ্বে নেই, পেন পেন্সিল কিছুই নেই, ইতিহাস নেই, ইতিহাসবেত্তাও নেই, ঐতিহাসিকও নেই, সুতরাং ঘটনা ঘটছে না,  আর ঘটনা পঞ্জীকরণের নামই যখন সত্য, তখন সত্যও জন্মাচ্ছে না। সুতরাং ‘ব্রহ্ম সত্যম্‌’ হবে কোত্থেকে ? যে সত্যের অস্তিত্বই নেই ব্রহ্মকে সেই সত্য বলব কি করে ? এদিক দিয়েও মহাভুল হল।

-শ্রী শ্রী আনন্দ মূর্ত্তি

Pranab Kumar Kundu



Pranab Kumar Kundu