সোমবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৮

কবি ও সাহিত্যিক সুভাষ মুখোপাধ্যায়


কবি ও সাহিত্যিক  সুভাষ মুখোপাধ্যায়


ফেসবুক থেকে         নাম না জানা লেখকের লেখা         পোস্ট করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু


টিচার্স টট Riju Ganguly এবং অন্যান্য ১০ জন এর সঙ্গে আছেন।

ক্ষমতার একটা সহজাত ধর্মই হলো যে সে সকল সময়ে সৃষ্টিশীল মননকে নিজের কাছাকাছি , নিজের পক্ষে রাখতে চায়। আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই অচিরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আঁস্তাকুড়ে। স্রষ্টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হন অভিমানী , বিবেকী মানুষ। নিজের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়, লাঞ্ছনাকে অদেখা করে আবার সৃষ্টির কাজে মেতে ওঠেন। কিন্তু সব কিছুর হিসেবে রাখে ইতিহাস।

জুলাই মাসের ৮ তারিখ আজকে। ২০০৩ সালে আজকের দিনেই এক বুক অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন শতবর্ষে পা রাখা, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

দুনিয়ার তামাম সাহিত্যপ্রেমী, জুলাই মাসের ৮ তারিখ স্মরণে রাখে প্রকৃতিপাগল কবি পার্সি শেলীর মৃত্যুদিন হিসেবে। তিরিশতম জন্মদিনের এক মাসের কিছু আগে একটি নৌকা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে অসময়ে নিভে যায় শেলীর জীবনপ্রদীপের আলো। কিন্তু সাহিত্যরসিক বাঙালির কাছে আজকের দিনটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করবার দিন। সেই কবি, যাঁর কলম সৃষ্টি করেছিল :

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

গত ২৫শে ফেব্রুয়ারী, আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম পাঠক। শিরোনাম: শতবর্ষী পদাতিক। লেখকের নাম কারণবশত উহ্য রাখলাম। কোনোরকমের কোনো বিতর্কের উদ্রেক করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এই লেখায় ঘোরতর কঠিন বাস্তবের বর্ণনাই করা হয়েছে।

তখন আমার কত বয়স?‌ ষোলো?‌ সতেরো?‌ আজ আমি ঠিক করে কিছু বলতে পারব না। না পারলেও এটুকু বলতে পারি তারও আগে থেকে শুধু গল্প–‌উপন্যাসের নয়, কবিতারও নিয়মিত পাঠক। তখন রবীন্দ্রনাথের পরে জীবনানন্দের ভক্ত হয়ে উঠেছি। জীবনানন্দের বহু পঙ্‌ক্তি তখন আমার মাথায় গেঁথে গেছে। তখন আমি জীবনানন্দে আচ্ছন্ন।

ঠিক সেই সময় আমি আবিষ্কার করলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। এক স্বতন্ত্র উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর। আধুনিক কবিদের মতো তিনি দুর্বোধ্য নন, দুরূহ নন। সহজেই তাঁর কবিতা পড়া যায়, বোঝা যায় এবং অনুভব করা যায়। প্রথমে পড়ি তাঁর পদাতিক। এই বইয়ের কবিতার ধ্বনিসৌন্দর্য এবং চমকপ্রদ মিল আমাকে রীতিমতো চমকে দিয়েছিল। তারপর পড়লাম ‘‌চিরকুট’‌ এবং ‘‌অগ্নিকোণ’‌। আমি তখনও সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চোখে দেখিনি। দেখবার খুব ইচ্ছে হত। অথচ কোথায় গেলে তাঁর দেখা পাব তা জানি না। আমি সেই সময় থাকতাম একাত্তর নম্বর পটুয়াটোলা লেনে। আমাদের বাড়ি থেকে দু’‌হাত দূরে একটি পত্রিকার অফিস ছিল। কিশোরদের পত্রিকা। নাম ‘‌আগামী’‌। মাঝে মাঝে আমি সেই পত্রিকার অফিসে যেতাম। গল্প করতাম। সেখানে আসত আমার বয়সের নানা ছেলে। শিশুসাহিত্যিক হওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিল। আমার অবশ্য শিশুসাহিত্যিক হওয়ার কোনও বাসনা ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল গল্প করা, স্রেফ গল্প করা। পত্রিকার সম্পাদক আমাকে প্রশ্রয় দিতেন। ফলে আমার কোনও অসুবিধে হত না। সেই অফিসে ছোটরা ছাড়াও আসতেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে আসতেন ‘‌ভোম্বল সর্দার’‌–‌এর বিখ্যাত লেখক খগেন্দ্রনাথ মিত্র। তিনি এসে গল্প করতেন। আমি সে সব গল্প শুনতাম। সেই সময় একদিন পত্রিকার অফিসে ঢুকলেন এক ভদ্রলোক। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি। পরনে সাদা পায়জামা। মাথাভর্তি ঘন কোঁকড়ানো চুল। বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখ। চোখে চশমা। তাঁকে দেখেই মনে হল ইনি বিশিষ্ট কেউ হবেন। কিন্তু কে ইনি? সম্পাদক তাঁকে দেখেই বললেন, আসুন সুভাষদা। পুজো সংখ্যার কবিতা এনেছেন?‌ সঙ্গে সঙ্গে আমার আর বুঝতে অসুবিধে হল না ইনিই আমার প্রিয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কবি মৃদু হেসে চেয়ারে এসে বসলেন। হাতে নিলেন কাগজ আর কলম। আমার সামনে শুরু হল কবিতা লেখা। মাঝে মাঝে তাঁর একটা আঙুল চলে যাচ্ছে মাথার চুলের মধ্যে। আঙুলে পেঁচিয়ে নিচ্ছেন চুল। তারপর চুল থেকে আঙুল নামিয়ে নিয়ে লিখছেন কবিতা। সেই সময় কেন জানি না কবির দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হল:‌ ‘‌প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/‌ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’‌।‌ ভাগ্যিস পঙ্‌ক্তি দুটি বলিনি!‌ বললে কী বিচ্ছিরি ব্যাপারই না হত। যাই হোক, কবিতা লেখা একসময় শেষ হল। তিনি কবিতাটি সম্পাদকের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলেন। সেই কবিতার নাম ‘‌পুপে’‌। ‘‌ফুল ফুটুক’‌ গ্রন্থে কবিতাটি আছে। এই সময় আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম চারপাশের লোকজনের কথাবার্তার মধ্যে থেকেও একজন কবি কীভাবে আত্মমগ্ন হয়ে কবিতা লিখতে পারেন। এই আত্মমগ্নতা আমাকে বিস্মিত করেছিল। বুঝেছিলাম জনতার কবি হয়েও তিনি আলাদা, তিনি নিঃসঙ্গ, তিনি একাকী। দলের কাজে তিনি গ্রামবাংলা চষে বেড়িয়েছেন। গরিব মানুষদের সঙ্গে দিন কাটিয়েছেন। তাদের নিয়ে অসংখ্য গদ্য লিখেছেন। দল ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। দলের প্রচার ও প্রসারের কাজে সংসারের সুখশান্তির দিকে ফিরেও তাকাননি। বাউন্ডুলে হয়ে জীবনযাপন করেছেন। দলের প্রতি নিষ্ঠাই তাঁর শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

প্রথমে আমরা কেউই তা বুঝতে পারিনি। শুধু তাঁর কবিতা পড়ে মনে হচ্ছিল তিনি বদলাচ্ছেন। কবিতা আর আগের মতো স্লোগানধর্মী হচ্ছে না। শত্রুকে বিদ্রুপ করার প্রবণতাও কমছে। তিনি হয়ে উঠতে চাইছেন আরও সহজ হতে, আরও সরল হতে। তিনি চাইছেন কবিতাকে আরও চিত্রময় করে তুলতে। মনে হয় নাজিম হিকমত–‌এর কবিতার অনুবাদের পরেই তাঁর কবিতায় একটি পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন দেখা দিল ‘‌ফুল ফুটুক’‌ কাব্যগ্রন্থ থেকে। এই বইয়ে একটি কবিতা আছে। নাম:‌ ‘‌আরও একটা দিন’‌।‌ সম্ভবত এই কবিতাটি পরিচয় পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ঠিক মনে নেই। এই কবিতাটি আমার এত ভাল লেগেছিল যে বলবার মতো নয়। কবিতাটি আমি মুখস্থ করে ফেললাম। আর এটা যে আমার একদিন কাজে দেবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ঘটনাটা বলি। আমি তখন আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজের ছাত্র। আমার ছিল বাংলায় অনার্স। একদিন অনার্সের ক্লাস নিচ্ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তাঁর তখন ‘‌দিনগুলি রাতগুলি’‌ বেরিয়েছে। তাঁর কবিতার অনেক পঙ্‌ক্তি আমাদের ঠোঁটস্থ। তিনি সেদিন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘‌কাব্য সঞ্চয়ন’‌ পড়াচ্ছিলেন। পড়াতে পড়াতে তিনি একসময় বললেন, আজকের কবিরা গদ্য কবিতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আবার ফিরে আসছে ছন্দ, মিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, কথাটা স্যর পুরোপুরি সত্যি নয়। স্যর জানতে চাইলেন, কেন?‌ আমি তখন প্রমাণ হিসেবে ‘‌আরও একটা দিন’‌ কবিতাটি আবৃত্তি করলাম। কবিতাটি তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কবিতাটিতে ছন্দের স্পন্দন ছিল, কিন্তু মিল ছিল না। শুধু এক জায়গায় একটা মিল ছিল। স্যর তারপর আমাকে টিচার্স রুমে ডেকে পাঠালেন। মৃদুস্বরে বললেন, এটা একটা ব্যতিক্রম। তারপর আরও কিছু কথা হল। সে সব আর মনে নেই। এই প্রসঙ্গে বলি, স্যর–‌এর কাছ থেকে একদিন একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, কবিরা অক্ষর গুনে গুনে কবিতা লেখেন না। কানের ওপর নির্ভর করেই কবিতা লেখেন। পরে জেনেছি এই ছন্দ শুধু কবিতায় থাকে না, গদ্যেও থাকে। তার জন্যেও চাই কান। আমি কথাটা আজও ভুলিনি।

আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমি ওই কবিতাটি পড়ে উপলব্ধি ‌‌‌করেছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় একটা বদল আসছে। ‘‌ফুল ফুটুক না ফুটুক’‌, ‘‌এখন ভাবনা’‌ তার প্রমাণ। তারপর ‘‌যত দূরেই যাই’‌ থেকে ‘‌ছড়ানো ঘুঁটি’‌ পর্যন্ত এই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থেকেছে। মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমও ঘটেছে।

এই পরিবর্তন খুবই জরুরি ছিল। নইলে তিনি শেষ পর্যন্ত অমলেন্দু বসুর ভাষায় ‘‌ক্যানেস্তারা পেটানো’‌ কবিতে রূপান্তরিত হতেন। যেমন তাঁর আগে হয়েছেন নজরুল। পরে নজরুল রবীন্দ্রনাথেই আত্মসমর্পণ করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে অবশ্য তা করতে হয়নি। তিনি নিজস্ব বাক্‌ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। অবশ্য এই পরিবর্তন রাতারাতি হয়নি। পরিবর্তনের ইঙ্গিত ‘‌পদাতিক’‌–‌এ পাওয়া গিয়েছিল। পাওয়া গিয়েছিল ‘‌বধূ’‌ ও ‘‌এখানে’‌ কবিতায়। পরবর্তিকালে ‘‌ফুল ফুটুক না ফুটুক’‌, ‘‌আরও একটা দিন’‌ বা ‘‌এখন ভাবনা’‌ কবিতায় তা তীব্র হয়ে দেখা দেয়। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন ‘‌একারম্যানের সঙ্গে কথোপকথন’‌–‌এ গ্যেটের সেই অমূল্য উপদেশ। সেখানে তিনি স্পষ্টভাষায় বলেছেন:‌ ‘‌মনে রেখো রাজনৈতিক নেতারা কবিকে গ্রাস করবে। তাঁর সংগীত স্তব্ধ হবে।’‌ তাই সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখতে পেরেছিলেন ‘‌যত দূরেই যাই’‌–‌এর মতো অসামান্য চিত্রময় কবিতা। প্রথম থেকেই অবশ্য তাঁর কবিতায় চিত্রের প্রাধান্য ছিল। তবে সে–সব চিত্রে স্লোগানের স্পর্শ লেগেছিল। আস্তে আস্তে তাঁর কবিতা থেকে স্লোগান সরে গেছে। তার বদলে তাঁর কবিতায় এসেছে এমন সব চিত্র যা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। আমিও আস্তে আস্তে তাঁর স্লোগানধর্মী কবিতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিই। কারণ সে–সব কবিতায় যে চটক ছিল, যে চমক ছিল, যে উজ্জ্বলতা ছিল, তা মলিন হয়ে আসছিল। তা যে শুধু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে বলে নয়, সেখানে অনুভূতির স্পর্শ ছিল না। সেখানে ছিল শুধু চকচকে ঝকঝকে শব্দ যা আমাদের বুদ্ধিকে নাড়া দেয়, কিন্তু হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে না। জীবনানন্দকে তাই তিনি একসময় বুঝতে পারেননি, অনুভব করতে পারেননি। ফলে তিনি না বুঝেই জীবনানন্দকে আক্রমণ করেছিলেন। ‘‌উত্তরবঙ্গ সংবাদ’‌–‌এ তাঁর ধারাবাহিক আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে পড়েছিলাম দলের চাপে পড়েই তিনি নাকি এ কাজ করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে এ কাজ করতে বারণ করেছিলেন। তিনি তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেননি। কী করে করবেন?‌ তখন দল যে তাঁকে প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে। তখন দল তাঁর কাছে প্রথম কথা, দলই তাঁর কাছে শেষ কথা। অবশ্য দল সম্পর্কে তাঁর মোহ তারপর আস্তে আস্তে ভাঙতে থাকে। ভাঙতে ভাঙতে দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একসময় ছিন্ন হয়ে যায়। দলের সবাই তখন তাঁর ওপর খড়্গহস্ত। এই প্রসঙ্গে তাঁর সম্পর্কে দু–‌তিনজনের মনোভাবের কথা বলতে পারি। একদিন আমি এক বন্ধুকে নিয়ে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় এক কবির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সমবয়সি খ্যাতিমান বামপন্থী কবি। তিনিও সংগ্রামের কবিতা লিখতেন। তাঁর কাছে কথায় কথায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রশংসা করেছিলাম। তাতে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, একা সুভাষই কি কবিতা লিখেছে?‌ আর আমরা সারাজীবন কি ঘাস কেটেছি?‌ তারপর তাঁর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। আমরা সেখান থেকে সরে পড়েছিলাম। আর একবার এক তরুণ কবির কাছে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কয়েকটি কথা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি উত্তরে বললেন, সুভাষ তো এখন এখানে নেই। তাঁর যে কলকাতা–মস্কোর মান্থলি টিকিট কাটা আছে‍‌!‌ আমি এই উত্তরে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলাম। এ কী কথার ছিরি!‌ এভাবে কেউ তাঁর দলের একজন কবি সম্পর্কে বলতে পারেন!‌ আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সবাই জানেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তিনি চাকরি করতেন না। তাঁর স্ত্রী সংসার চালাতেন। ফলে কবিকে অর্থের জন্যে মাঝে মাঝে খবরের কাগজে ফিচার লিখতে হত। কারণ কবিতা লিখে সিগারেটের খরচও ওঠে না। দলও তাঁকে কোনওদিন আর্থিক সাহায্য করেছে বলে জানি না। একমাত্র ফিচার লিখেই তাঁর যৎসামান্য উপার্জন হত। একসময় তিনি বামপন্থী দৈনিক পত্রিকায় ফিচার লিখতেন। তাতে তাঁর কী রোজগার হত জানি না। জীবনের শেষ দিকে এসে আনন্দবাজার পত্রিকায় নিয়মিত ফিচার লিখতে শুরু করলেন। তাঁকে একদিন পত্রিকার অফিসে সন্তোষকুমার ঘোষের ঘরের সামনে পায়চারি করতে দেখেছিলাম। কিন্তু একটি বুর্জোয়া সংবাদপত্রে ফিচার লেখার ফলে বামপন্থীদের বিরাগভাজন হয়ে উঠলেন। আমি নিয়মিত লেখাগুলো পড়তাম। সেই সময় আমি এক বামপন্থী গদ্যলেখককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি লেখাগুলো পড়ছেন?‌ তিনি গম্ভীরমুখে উত্তর দিলেন, না। তারপর আমি বললাম, ওই লেখাগুলো আপনি আপনাদের কাগজে ইচ্ছে করলে ছাপতে পারতেন। তিনি এবার আমার ওপরে রেগে গিয়ে বললেন, আমাদের কাগজ ওইসব আবর্জনা ছাপার জায়গা নয়। এই কথা শুনে ইচ্ছে হল বলি, আজ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা আবর্জনা হয়ে গেল!‌ অথচ এই সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন আপনাদের নয়নের মণি, আপনাদের দলের সম্পদ। সাম্যবাদ প্রচারের জন্যে তিনি গ্রামে গ্রামে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন। গরিবদের মধ্যে সাম্যবাদের মতবাদ ছড়িয়েছেন, অভিনব স্লোগান লিখেছেন। এমন–কি জেলও খেটেছেন। সে কি এই প্রতিদানের জন্য?‌ শেষ পর্যন্ত এই তাঁর কপালে লেখা ছিল?‌ বামপন্থীরা কবি–লেখকদের ব্যবহার করে কীভাবে তাঁদের ছুঁড়ে ফেলে দেয় সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় একজন বড় কবি ছিলেন। কিন্তু কত বড়?‌ তার প্রমাণ পাওয়া গেল একটি কবিতায়। কবিতার নাম:‌ ‘‌যাচ্ছি’‌। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যায়। এই কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবি–প্রতিভার একটা বিস্ময়কর উন্মোচন ঘটেছিল। কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছিল জীবনানন্দের ‘‌আট বছর আগের একদিন’‌–‌এর পর আর একটি মহৎ কবিতা লেখা হল। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছিল যে, সারা পৃথিবীর সাম্প্রতিক কবিতার মধ্যে এটি একটি অমূল্য রত্ন। যাঁরা কবিতা নিয়মিত পড়েন, অনুভব করেন, আমার মন্তব্যে তাঁরা সাড়া দেবেন। এই কবিতাটি পড়ে এমনই আপ্লুত হই যে আমি ঠিক করি এই কবিতাটি নিয়ে কবির একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রয়োজন। আমার এক বন্ধু, তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক। তাঁকে আমার ইচ্ছের কথা জানাতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন।‌ আমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্যে আর এক লেখককে পেয়ে গেলাম। একদিন সন্ধেবেলায় কবির সঙ্গে আমাদের দেখা হল। দেখা হল তাঁর বাড়িতে। কবিতাটি নিয়ে আমার যে যে প্রশ্ন ছিল তা করলাম। তিনি সব ক’‌টি প্রশ্নের উত্তর দিলেন সস্নেহে। সে সব প্রশ্নের মধ্যে মধ্যে আমার একটি প্রশ্ন ছিল:‌ আমার কাছে ‘‌যাচ্ছি’‌ একটি anti poetry.‌ আপনি কী বলবেন?‌ তিনি বললেন, না। এটি anti poetry‌ নয়। তা‌রপর আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, anti poetry‌–‌র বাংলা কী হবে?‌ তিনি বললেন, অ কবিতা। আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম, অ আর কবিতার মাঝখানে কি হাইফেন দেওয়া দরকার?‌ তিনি বললেন, না, দরকার নেই। তারপর একসময় সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষ হল। তিনি আমার কাছে একটি চারমিনার চাইলেন। আমি তাঁর হাতে চারমিনারের প্যাকেট তুলে দিলাম। সিগারেট খাওয়া শেষ হলে আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম, আপনি ‘‌জল সইতে’‌ বইটা আমাকে উপহার দেবেন?‌ তিনি দ্বিধা না করে অন্য ঘরে ‌গিয়ে বইটি নিয়ে এলেন। বইয়ে আমার নাম লিখে নিচে সই করলেন। বইটি আজও আমার কাছে সযত্নে রক্ষিত আছে। মাঝে মাঝে বইটি খুলে তাঁর স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে থাকি। বইটির মূল্য আমার কাছে অপরিসীম। কারণ এই বইয়েই আছে তাঁর অমূল্য কবিতা ‘‌যাচ্ছি’‌। তারপর কবিকে আর বিরক্ত না করে চলে এলাম। বন্ধুর সম্পাদিত কাগজে সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল। কবির কাছে তা পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছিল। পত্রিকাটি আজ আমার হাতের কাছে নেই। পত্রিকাটি হারিয়ে গেছে। সংগ্রহ করার সম্ভাবনাও নেই। কারণ বন্ধু বহু বছর হল প্রয়াত হয়েছেন।
তখনও আমি জানতাম না কবির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। জানলে নিশ্চয় কিছু একটা করা যেত। শুধু তাই নয়, আমি জানতাম না দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি হয়ে গেছেন নির্জন, নিঃসঙ্গ, একাকী। দলের কেউই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন না। ঠিক এই সময় ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তখন শুনেছি লেখার সরঞ্জাম কেনার পয়সাও তাঁর ছিল না। মমতাই সে–সবের ব্যবস্থা করে দিতেন। এই দুরবস্থার মধ্যেও ‘‌জল সইতে’‌–‌র পর আরও ছটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর প্রকাশিত হয়েছে। সে–সব গ্রন্থেও তাঁর কবি–প্রতিভা হ্রাস পায়নি, তাঁর নিজস্ব বাচনভঙ্গি অক্ষুণ্ণ থেকেছে। তারপর একদিন তাঁর দেহাবসান হল। কবির স্ত্রীর নির্দেশেই মমতা ব্যানার্জি দাহকর্ম সম্পন্ন করলেন। দুঃখের কথা, তাঁর দেহ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির চত্বরে আনা হয়নি। দেওয়া হয়নি গান স্যালুট। এমন–কি তাঁর একদা সংগ্রামী সতীর্থদের একজনও একফোঁটা চোখের জল খরচ করেননি। তাঁরা তখন ভেবে দেখেননি বা তাঁদের মাথায় আসেনি যে একদিন দেশ থেকে বামপন্থা মুছে যাবে, কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায় মুছে যাবেন না। তিনি থাকবেন, বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। কয়েক বছর হল কবির নামে একটি মেট্রো স্টেশন হয়েছে। পরে হয়তো আরও অনেক কিছু হবে। কিন্তু শেষজীবনে তিনি যেভাবে দলের কাছে অপমানিত হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, তিনি যেভাবে নীরবে মুখ বুজে অসহনীয় অর্থকষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন, তা কেউ ভুলবে না। তিনি বোধহয় কাউকে জানতেও দেননি তাঁর এই কষ্টের কথা। এমনই আত্মসম্মানবোধ ছিল তাঁর, যা বামপন্থীদের মধ্যে একেবারেই দুর্লভ।

আজ কবির জন্মশতবর্ষে তাঁর স্তুতি করার জন্যে লোকের অভাব হবে না। না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কেন করব স্তুতি?‌ তিনি কী দিয়ে গেছেন আমাদের?‌ আমরা অকৃতজ্ঞ নই। তাই বাংলা সাহিত্যে তাঁর দানের কথা আমরা ভুলব না। প্রথমে বলি তাঁর গদ্যের কথা। তাঁর মতো কেউ বাংলা গদ্যে দক্ষতার সঙ্গে বাগ্‌ধারা ব্যবহার করেননি। তাঁর গদ্য হয়ে উঠেছিল জীবন্ত। এমন জীবন্ত সুন্দর বাংলা সম্প্রতি কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। তাঁর দুটি উপন্যাসের কথা জানি। একটির নাম ‘‌হ্যানসের অসুখ’‌। উপন্যাসটি সম্ভবত প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। উপন্যাসটি পড়ে আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। আমার এই উচ্ছ্বাস গোপন থাকেনি। একদিন সম্পাদক ও উপস্থিত লেখকদের সামনে উপন্যাসটি নিয়ে আবেগ প্রকাশ করি। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, আপনি উপন্যাসটির এত প্রশংসা কেন করছেন?‌ আমি তখন যুক্তিসহকারে আমার প্রশংসার কারণ ব্যক্ত করি। অদ্ভুত কথা, উপস্থিত কেউই আমার বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। তাঁরা সকলেই নীরব হয়ে থাকলেন। সম্ভবত, উপস্থিত লেখকদের মধ্যে অনেকেই উপন্যাসটি পড়েননি। পরেও পড়েছেন কি না জানি না। কারণ পরেও এই উপন্যাসটি নিয়ে তাঁদের কেউই কোনও মন্তব্য করেননি। বিস্ময়কর, এই উপন্যাস নিয়ে পরবর্তিকালে লেখক ও পাঠকদের মধ্যে কোনও আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে উপন্যাসটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। অথচ বইটি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে। কেন তা জানি না। বাংলাদেশে রসিক পাঠকের কি এতই অভাব ঘটল?‌ ব্যাপারটা আমার কাছে আজও বোধগম্য হয়নি। উপন্যাস লেখা ছাড়াও তিনি উপন্যাসের অনুবাদ করেছেন। লিখেছেন অজস্র ফিচার, করেছেন নানা আলোচনা।
‘‌ভূতের বেগার’‌ তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য বই। তাঁর অনবদ্য গদ্যশৈলী এখানেও উপস্থিত।

গদ্যের কথা ছেড়ে দিলেও বাংলা কবিতায় তিনি এনেছেন নতুন একটি ধারা। সেই ধারাটিকে আমরা অ্যান্টি রোমান্টিকতা বলতে পারি। বাংলা কবিতা যখন জোলো রোমান্টিক প্রেমের প্লাবনে প্লাবিত, তখন তাঁর কবিতা এর বিপরীত দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। অনেকেই অবশ্য এ প্রসঙ্গে সমর সেনের নাম করবেন। নাম করাটাও অসঙ্গত নয়। কিন্তু সমর সেনের বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক আমাদের মুগ্ধ করে। আলোড়িত করে না। এদিক দিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা আমাদের মুগ্ধ করে এবং আলোড়িত করে। পরে কবি অবশ্য এই শ্লেষাত্মক কবিতার পথ থেকে সরে আসেন। তিনি হয়ে ওঠেন আরও সহজ, আরও সরল, আরও চিত্রময়। এই প্রসঙ্গে আবার সেই ‘‌আরও একটা দিন’‌ কবিতায় ফিরে আসি। এখানে এই কবিতার শেষ পাঁচ পঙ্‌ক্তি তুলে আনছি:‌

জলায় এবার ভালো ধান হবে—
বলতে বলতে পুকুরে গা ধুয়ে
এ বাড়ির বউ এল আলো হাতে
সারাটা উঠোন জুড়ে
অন্ধকার নাচাতে নাচাতে।

একেবারে কথ্যভাষায় এরকম একটি চিত্র তুলে ধরতে বাংলা কাব্যে আর কাউকে দেখিনি। শুধু এই কবিতায় নয়, আরও অজস্র কবিতায় এরকম অভিনব চিত্র আমরা দেখতে পাই। এই সঙ্গে বলতে হয়, কবিতায় এরকম কথ্য বুলির ব্যবহার আর কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। আফসোসের কথা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পরে যাঁরা কবিতা লিখতে এলেন তাঁরা প্রায় সবাই ভেসে গেলেন ছেঁদো রোমান্টিকতায় এবং সেই সঙ্গে কথ্য বুলির ব্যবহারকে অবান্তর বলে মনে করলেন। করতেই পারেন। এতে বলার কিছু নেই। কিন্তু কোনও নতুন ধারা কি এল?‌

বামপন্থীরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গুরুত্ব বোঝেননি। না বোঝারই কথা। তাঁরা কবেই বা সাহিত্য বুঝেছেন!‌ তাঁরা চিরকাল প্রকৃত লেখকদের অলেখক করে তোলার চেষ্টা করেছেন। আর অলেখকদের লেখক বানানোর চেষ্টা করেছেন। বামপন্থীদের সাহিত্যবোধের ওপর আমার কোনও কালেই আস্থা ছিল না, আজও নেই। বামপন্থীদের ইতিহাস প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধদের ইতিহাস। তাই পচা শামুকে যেমন পা কাটে, তেমনি আমাদের অনেক লেখক বামপন্থীদের আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম। যন্ত্রণাকাতর হৃদয় নিয়ে তিনি শেষ জীবন কাটিয়েছেন। তাই অনেক বেদনা নিয়ে এই সাধের পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন। লিখেছিলেন ‘‌যাচ্ছি’‌–‌র মতো অসামান্য কবিতা। আমি এবার সেই কবিতার প্রথম কয়েকটি পঙ্‌ক্তির উদ্ধৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছি।

ও মেঘ
ও হাওয়া
ও রোদ
ও ছায়া
যাচ্ছি
ও ফুলের সাজি
ও নদী, ও মাঝি
বনের জোনাকি
ও নীড়, পাখি
যাচ্ছি
ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরপর ঈশ্বরের কাছে আমার জিজ্ঞাসা:‌ হে ঈশ্বর!‌ আর কতকাল কবি ও লেখকদের রাজনৈতিক নেতাদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হবে?‌ স্বাধীনতা কি কেবল নেতারাই ভোগ করবে?‌ কবি–‌লেখকরা নয়?‌ (সমাপ্ত)

তথ্যসূত্র : আজকাল আর্কাইভস

ঋণস্বীকার:‌ কবিতা সংগ্রহ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়। দে’‌জ পাবলিশিং।‌‌‌‌

ভালো থাকুন

জর্জিয়া


     জর্জিয়া

     ফেসবুক থেকে      শেয়ার করেছেন      প্রণব কুমার কুণ্ডু

ফিরে দেখা,
ইউরেশীয়ার ককেশাস অঞ্চলের একটি দেশ যার নাম " জর্জিয়া " মাএ চব্বিশ বছরের মধ্যে এক বিশাল পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের -কে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য ইসলামের পাদতল থেকে বেরিয়ে এলো।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে নয় কি! তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে এসে কি পেল?
আপনি এককথায় কি উওর দিবেন?
হ্যাঁ, উওর এটাই যে - তারা সংঘাতমুক্ত একটি দেশ পেল, একটা জাতি পেল, পৃথিবীর অন্য দেশ বা জাতির সাথে চলাফেরার এক সুবর্ণ সুযোগ পেল।
আর কি পেল জানেন? অন্ধকারাচ্ছন্ন ধর্মীয় ব্যবস্থা থেকে পরিএাণ পেয়ে সুন্দর মানব -জীবনের প্রকৃত সত্বা পেল।
আর শিক্ষায় পেল আধুনিক বিজ্ঞানের ছোঁয়া!!!

তাহলে কি তারা ভুল করল নাকি সঠিক কাজটা করল - আপনি কি বলবেন???

হাতে শাঁখা পলা খারু ও মাথায় সিঁদুর


হাতে শাঁখা পলা খারু ও মাথায় সিঁদুর

ফেসবুক থেকে      শেয়ার করেছেন     প্রণব কুমার কুণ্ডু


Rupok Roy

মাথায় সিঁদুর এবং হাতে খারু-পলা-শাঁখা না থাকলে, সংসার জীবনের দুর্যোগ সামাল দেওয়া যে অত সহজ নয়, সেই বিষয়টি বুঝতে হলে পড়ুন নিচের এই প্রবন্ধটি-

হিন্দু বিবাহিতা নারীদের শাঁখা-সিঁদুর-খারু-পলা ব্যবহার করার কারণ:

এ ব্যাপারে যেকোনো হিন্দু মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেও তাদের এক জবাব, জানি না, তবে স্বামীর মঙ্গলের জন্য পরি। স্বামীর মঙ্গল তো অবশ্যই, তবে তার চেয়ে বেশি নিজের মঙ্গল, পোস্টটা পড়লে ডিটেইলস জানতে পারবেন।

প্রথমেই বলি, জ্যোতিষ শাস্ত্রে আমার কিছু জ্ঞান রয়েছে এবং জ্যোতিষ বিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দু বিবাহিত মহিলাদের শাঁখা-সিঁদুর-খারু-পলা ব্যবহার করার সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। এখানে আরও বলে রাখি জ্যোতিষ বিদ্যা হচ্ছে বেদ এর একটি অংশ এবং একারণেই প্রথমত হিন্দু বিবাহিত মহিলারা ধর্মীয় কারণে শাঁখা সিঁদুর খারু পলা পরিধান করে থাকে। কিন্তু শুধু বিশ্বাসের কারণেই এই পরিধান নয়; এগুলোর ব্যবহারের পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট বাস্তব উপকারিতা, যেগুলো আমি নিচে বর্ণনা করার চেষ্টা করছি:

১। শাঁখা : জ্যোতিষ শাস্ত্রে মুক্তা হচ্ছে চন্দ্রের প্রতীক। মুক্তা ব্যবহার করলে- মাথা ঠাণ্ডা থাকে, রূপ লাবন্য বৃদ্ধি পায়, মানসিক বিষন্নতা দূর হয়, মেয়েলী রোগ প্রতিরোধ করে – সাদা শাঁখাও এই একই কাজ করে। মূলত মেয়েদের মাথা ঠাণ্ডা রেখে সুখে সংসার ধর্মপালন করতে শাঁখা মেয়েদেরকে সাহায্য করে। তাই যেসব আল্ট্রা মডার্ন মহিলারা সাদা শাঁখাকে সোনায় মুড়ে পরিধান করেন, তারা শাঁখার উক্ত উপকারগুলো থেকে যে বঞ্চিত হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সর্বোচ্চ উপকারিতা পেতে হলে শাঁখাকে তার আসল রূপেই ব্যবহার করতে হবে।

২। সিঁদুর ও পলা : জ্যোতিষ শাস্ত্রে মঙ্গল গ্রহ হচ্ছে সকল প্রকার দুর্ঘটনার কারণ। তাই মঙ্গলের দশা চললে জীবনে নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। যারা বিজ্ঞান পড়েছেন, তারা জানেন যে মঙ্গল গ্রহের রং লাল। তাই অশুভ মঙ্গলের প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য জ্যোতিষীগণ লাল রং এর প্রবাল পাথর যা রক্ত প্রবাল নামে পরিচিত তা ব্যবহার করতে বলেন। শুধু লাল রং এর পাথরই নয়, লাল বর্ণের যেকোনো বস্তু বা পোষাক পরিধান করলেও মঙ্গলের এই অশুভ প্রভাব থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়। এ কারণেই প্রাচীন হিন্দু মনীষীগণ হিন্দু বিবাহিত মহিলাদের লাল রং এর চুড়ি যা পলা নামে পরিচিত এবং লাল রং এর সিঁদুরব্য বহার করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তারা সংসার জীবনে অশুভ মঙ্গলের প্রভাবে নানা রকম দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের রক্ষা করে সাংসারিক জীবনে শান্তিতে থাকতে পারে। এই একই কারণে ভারত উপমহাদেশে মেয়েদের বিয়ের পোষাকের রং লাল; যাতে বিবাহের মতো একটি শুভ অনুষ্ঠানে মঙ্গলের অশুভ প্রভাব না পড়ে এবং দম্পতি একটি শুভ সময়ের মাধ্যমে তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করতে পারে। এছাড়াও মহাভারত থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস হলো সিঁদুর এবং এর মধ্যে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান থাকে, যা নিয়মিত ব্যবহারের ফলে সেই রাসায়নিক উপাদানগুলো ত্বকের ভেতর প্রবাহিত হয়ে রক্তের সাথে মিশে মেয়েদের ঋতুচক্রকালীন যে ক্ষয় তার কিছুটা পূরণে সাহায্য করে। এছাড়া ও রক্ত প্রবাল ব্যবহারে মানুষের ধৈর্য, সাহস, মনোবল বৃদ্ধি পায়। চাকুরি স্থলে যোগ্য পদ লাভ হয়, স্বাস্থ্যহানী ও দুর্ঘটনা থেকে তো রক্ষা করেই। সিঁদুর ও পলার ব্যবহার, এই বিষয়গুলোতেও সাহায্য করে। আজকাল অনেক মহিলা শাঁখা ব্যবহার করলেও পলা ব্যবহার করে না। তারা নিজের অজ্ঞাতেই যে নিজের ক্ষতি করে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

৩। খারু : শনির দশায় পড়লে মানুষের যে কি দূরবস্থা হয় তা বোধহয় আর কাউকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবেনা। বিদ্রোহ, ফাটল, ক্ষয়-ক্ষতি, লোকসান, ধ্বংস, দাম্পত্যকলহ, বিচ্ছেদ, দারিদ্রতা, অকারণ শত্রুতাসহ সকল দুঃখ-কষ্টের কারণ শনি। শনির দশায় পড়ার আগেই মানুষ যদি নীলা পাথর ব্যবহার শুরু করে তাহলে এই সব ক্ষয়ক্ষতি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পায়। কিন্তু কখন শনির দশা শুরু হবে সেটা যেহেতু অভিজ্ঞ জ্যোতিষীগণ ছাড়া কেউ জানেনা, তাই প্রায় সকলকেই অশুভ শনির প্রভাবে জীবনে এক বার বা দুবার কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এই অশুভ শনিকে কিছুটা শান্ত রাখতে পারে তামা বা লোহা। একারণেই তামা এবং লোহার মিশ্রণে বা শুধু লোহা দিয়ে একধরণের চুড়ি তৈরি করা হয় যা খারু নামে পরিচিত। এটা নিয়মিত পরিধান করলে অশুভ শনির কবল থেকে হিন্দু বিবাহিত মহিলারা নিজেদের কিছুটা হলেও রক্ষা করে সাংসারিক শান্তি বজায় রাখতে পারে। অনেকেই হয়তো খেয়াল করে থাকবেন জন্মের পর ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে লোহার চুড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়, এর মূল কারণ কিন্তু শনির ভয় এবং তা থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করা। আজকাল অনেক মহিলাই খারু ব্যবহার করেন না, তারা যে নিজেদের কি পরিমান ঝুঁকির মধ্যে রেখেছেন তা তারা নিজেরা জানলে শিউরে উঠতেন।

শাখা-সিঁদুর ও খারু ব্যবহার করার বৈজ্ঞানিক কারণ :

রক্তের ৩টি উপাদান – শাঁখায় ক্যালসিয়াম, সিঁদুরে মার্কারি বা পারদ এবং লোহায় আয়রণ আছে। রক্তের এ্ই ৩টি উপাদান মেয়েদের ঋতুস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। তাই এই তিনটি জিনিস নিয়মিত পরিধানে রক্তের সে ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণে সহায়তা করে।

সামাজিক কারণ :

হিন্দু মেয়েরা বিয়ের পর মাথায় সিঁদুর, হাতে শাখা, খারু, পলা এবং ভারতের কোনো কোনো জায়গায় এসবের সাথে গলায় মঙ্গল সূত্র প’রে থাকে। এ থেকে বোঝা যায় যে মেয়েটি বিবাহিতা। ফলে প্রথম দর্শনেই কারো ভালো লেগে গেলেও, অনিচ্ছাকৃত পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা হিন্দু বিবাহিতা নারীদের ক্ষেত্রে খুবই কম এবং এতে বিয়ের পর, পর পুরুষের সাথে হৃদয় ঘটিত ব্যাপারে সাংসারিক জটিলতা যে অনেক কমে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটাই হলো হিন্দু বিবাহিতা মহিলাদের শাঁখা-সিঁদুর পরিধানের বাস্তব কারণ।

মোটামুটি এই হলো হিন্দু বিবাহিতা মহিলাদের শাঁখা-সিঁদুর-খারু-পলা ব্যবহারের কারণ। এর ফলে হিন্দু বিবাহিতা মহিলাদের জীবন হয়েছে সুরক্ষিত। তাদের জীবনে নেই কোনো ডিভোর্স বা তালাকের ভয়। এই একই কারণে হিন্দু বিবাহিতা মহিলাদের সাংসারিক জীবনও অন্যান্য ধর্মের মহিলাদের তুলনায় তুলনামূলক বেশি সুখের। এক কথায় বলা যায় শাঁখা-সিঁদুর-খারু-পলা একজন হিন্দু বিবাহিতা মহিলার সংসার জীবনের রক্ষা কবচ।

জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম।জয় শ্রীকৃষ্ণ।