শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নালন্দা


   নালন্দা

  ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু

নালন্দা = নালম + দা
নালম ---> পদ্মফুল যা জ্ঞানের প্রতীক
দা ---> দান করা।
“নালন্দা” শব্দের অর্থ “জ্ঞান দানকারী”। প্রথম অবস্থায় নালন্দা ছিল একটি বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধধর্ম চর্চার কেন্দ্র। পরবর্তীতে নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা উপলব্ধি করেন যে ধর্মচর্চার পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত ইত্যাদিরও চর্চার প্রয়োজন উন্নত জাতি গঠনের জন্য। তাঁদের উৎসাহে বৌদ্ধ বিহারটি ক্রমে রূপ নেয় সর্বাঙ্গীন শিক্ষাচর্চা কেন্দ্রের। গুপ্ত সম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন। মূলত গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্তের আমলেই এই মহা বিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাটগণ পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান। ৪২৭ বা ৪৫০ খৃষ্টাব্দে স্থাপিত হওয়ার পর প্রায় ৮০০ বছর ধরে জ্ঞান বিতরন করে গেছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।
নালন্দা ছিল সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রবেশ করতে গেলে আজকের দিনের মতোই কঠিন পরীক্ষায় বসতে হত। শোনা যায় প্রতি দশ জনে তিন জন সেই পরীক্ষায় পাশ করত। ছাত্র সংখ্যা ছিল আন্দাজ দশ হাজার। শিক্ষক দুই হাজার । ৫:১ এর ঈর্ষনীয় ছাত্র - শিক্ষক অনুপাত।
নালন্দা ছিল সত্যিকারের "বিশ্ববিদ্যালয়"। ভারতবর্ষের সীমা অতিক্রম করে পশ্চিমে সুদূর ইরান, ইরাক, তুরস্ক, গ্রীস থেকে; উত্তরে হিমালয় পেরিয়ে চীন থেকে; উত্তর ও পূর্বে সাগর পেরিয়ে জাপান, ইন্দোনেশিয়া থেকে জ্ঞান পিপাসু আসত নালন্দায়। সম্পূর্ণ অবৈতনিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল খরচ বহন করার জন্য উদার বৌদ্ধ শাসকরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ২০০ গ্রামকে উৎসর্গ করেছিলেন। চিনতে পারার সুবিধার্থে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরী করে গ্রাম গুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছিল অনান্য গ্রাম থেকে। এই সব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্য দ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচের যোগান আসত।
প্রাচীর বেষ্টিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল এলাকায় শ্রেনীকক্ষ, ছাত্রাবাস, শিক্ষকাবাস, সুরম্য উদ্যান, বীথি, দিঘি ইত্যাদি তো ছিলই; তার সাথে ছিল বিশ্বের অহংকার, সুবিশাল তিনটি গ্রন্থাগার।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন পন্ডিত শীলভদ্র। বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম।
তারপর নেমে এল কালো দিন।
১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী এল নালন্দায়। লক্ষ্য একটাই, ইসলামের প্রসার। প্রচার নয় প্রসার। নালন্দার বৌদ্ধ ভিক্ষু, ছাত্র, শিক্ষক কেউ যখন ধর্মান্তরিত হতে রাজি হল না, তখন শুরু হল হত্যালীলা। তার আক্রমনের বর্বরতা সম্পর্কে পারস্য ইতিহাসবিদ মিনহাজ “তাবাকাতে নাসিরি” গ্রন্থে লিখেছেন “হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করে খিলজী”। এরপর আগুন লাগিয়ে দেয় লাইব্রেরীর ভবনগুলোতে। লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমান এত বেশী ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বইগুলো পুড়ে ছাই হতে। জনশ্রুতি আছে ছয় মাস সময় লেগেছিল সব বই পুড়তে। বর্বর খিলজী শুধু নালন্দাকে পোড়ায়নি, শুধু ছাত্র শিক্ষক ভিক্ষুদের হত্যা করেনি, সে শেষ করে দিয়েছে এক জাতির তথা সমগ্র পৃথিবীর এক রত্নকে। অতীত ভারতের অমূল্য রত্ন চিরতরে হারিয়ে গেল নরপিশাচের উন্মাদনায়।
তারপর খিলজী এল সোনার বাংলায়। যার ফলশ্রুতি আজকের মৌলবাদী বাংলাদেশ। সে এক অন্য কলঙ্কময় অধ্যায়।
ভারত আজও বহন করে চলেছে বর্বর খিলজীর চিহ্ন, কোনো সভ্য দেশে যা চিন্তাই করা যায় না। নালন্দা সংলগ্ন রেলওয়ে স্টেশনের নাম "বখতিয়ারপুর"! নরাধম বর্বর খিলজীর চিহ্ন সমূলে উপড়ে ফেলে সেখানে চাই বাঙালীর গর্ব আচার্য শীলভদ্র বা মহাজ্ঞানী পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের নামে শহর, স্টেশন। কোনো বাঙালী বুদ্ধিজীবি কি দাবি জানাবেন?

রামকৃষ্ণ


  রামকৃষ্ণ

  *** রামকৃষ্ণ***         ফেসবুক থেকে      শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু

***ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখনীয়:***

গৃহস্থ শিষ্য :– মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অক্ষয়কুমার সেন প্রমুখ;

ত্যাগী বা সন্ন্যাসী শিষ্য :– নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ), রাখালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), কালীপ্রসাদ চন্দ্র (স্বামী অভেদানন্দ), তারকনাথ ঘোষাল (স্বামী শিবানন্দ), শশীভূষণ চক্রবর্তী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী (স্বামী সারদানন্দ) প্রমুখ।
এছাড়া নারী ভক্তদের একটি ছোটো অংশও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। এঁদের মধ্যে গৌরী মা ও যোগীন মা উল্লেখযোগ্য। এঁদের কেউ কেউ মন্ত্রদীক্ষার মাধ্যমে তাঁর থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। তবে তপস্যার বদলে শহরে অবস্থান করে নারীসমাজের সেবাতেই তাঁদের উৎসাহিত করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসতে শুরু করেন - “কি মহারাজা কি ভিখারি, কি পত্রিকাকার কি পণ্ডিত, কি শিল্পী কি ভক্ত, কি ব্রাহ্ম কি খ্রিস্টান কি মুসলমান, সকল মতের সকল পেশার আবালবৃদ্ধ বণিতা”। জীবনীকারদের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন খুবই মিশুকে ও তুখোড় আলাপচারী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক নাগাড়ে বলে যেতে পারতেন – নিজের অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতার কথা, নানা গল্প; খুব সাধারণ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে চলতেন বেদান্তের দুর্বোধ্য তত্ত্ব; রসিকতা, গান বা অন্যদের নকল করারও মাধ্যমে আমোদ-প্রমোদেও পিছপা হতেন না। সকল শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধের মত টেনে রাখতেন তাঁর কাছে।
কিছু সন্ন্যাসী শিষ্য থাকলেও, তিনি সকলকে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে বলতেন না। আবার ত্যাগী শিষ্যদের সন্ন্যাসজীবনের জন্য প্রস্তুত করার মানসে তাদের জাতিনির্বিশেষে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষা করার নির্দেশ দিতেন। এঁদের তিনি সন্ন্যাসী জীবনের প্রতীক গৈরিক বস্ত্র ও মন্ত্রদীক্ষাও দান করেছিলেন।
COLLECTED*

বুদ্ধদেব বসু


   বুদ্ধদেব বসু

    ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন             প্রণব কুমার কুণ্ডু

কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক এবং সম্পাদক
বুদ্ধদেব বসু (জন্মঃ- ৩০ নভেম্বর, ১৯০৮ - মৃত্যুঃ- ১৮ মার্চ, ১৯৭৪)
অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরী করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় সমানে লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্যের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে স্বাগত বিদায় গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র-পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
জন্ম
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয় কুমিল্লায়। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর পিতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘন্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয় কুমারী ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ-মাতামহীর কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। পুলিশ অফিসার বা দারোগা চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন তাঁর পিতামহ। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়।
১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০ -এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৩১ খৃষ্টাব্দে তিনি ঢাকা পরিত্যাগ করে কলকাতায় অভিভাসন গ্রহণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯৩৪ সালে খ্যাতিমান লেখিকা প্রতিভা বসু'র (বিবাহ-পূর্বঃ প্রতিভা সোম) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
কর্ম জীবন
অধ্যাপনার মাধ্যমেই তাঁর কর্মময় জীবন শুরু। জীবনের শেষাবধি তিনি নানা কাজে-কর্মে ব্যাপৃত রেখেছেন। শিক্ষকতাই ছিল জীবিকা অর্জনে তার মূল পেশা। কর্মময় জীবনের শুরুতে স্থানীয় কলেজের লেকচারের পদের জন্য আবেদন করে দু'বার প্রত্যাখ্যাত হলেও ইংরেজি সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য পরিণত বয়সে তিনি আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। বাঙলা ভাষার তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার ক্ষীণস্রোতকে তিনি বিস্তৃত ও বেগবান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫২ সালে দিল্লী ও মহিশূরে ইউনেস্কোর প্রকল্প উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসু তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
এছাড়াও, তিনি উচ্চ মানের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বুদ্ধদেব বসু প্রভুগুহ ঠাকুরতা, অজিত দত্ত প্রমূখকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। এ সময় ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২৭ - ১৯২৯ পর্যন্ত সচিত্র মাসিক 'প্রগতি' (১৯২৭) মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন এবং 'কল্লোল' (১৯২৩) গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কলকাতায় বসবাসকালে তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ১৯৩৫ সালে ত্রৈমাসিক কবিতা (আশ্বিন ১৩৪৪) পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পঁচিশ বছরেরও অধিককাল তিনি পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা সম্পাদনা করে আধুনিক কাব্যআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তৃতীয় বর্ষ ১ম সংখ্যা (আশ্বিন ১৩৪৪) থেকে বুদ্ধদেব ও সমর সেন এবং ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (চৈত্র ১৩৪৭) থেকে বুদ্ধদেব বসু একাই এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায়, সদিচ্ছায়, অনুশাসনে এবং নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বাংলা কবিতা তার যথার্থ আধুনিক রূপ লাভ করে। এটি কবি বুদ্ধদেব বসুর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশে কবিতা পত্রিকার ভূমিকা দূরসঞ্চারী। আধুনিক বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি, প্রসার ও তা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে কবিতার তুলনারহিত।
১৯৩৮ সালে হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে ত্রৈমাসিক চতুরঙ্গ সম্পাদনা করেন। ১৯৪২ সালে ফ্যাসীবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের আন্দোলনে যোগদান করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একজন সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু'র গদ্য ও পদ্যের রচনাশৈলী স্বতন্ত্র ও মনোজ্ঞ। রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক কাব্য ধারার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। গদ্যশিল্পী হিসেবে সমধিক সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতময়তা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর গদ্যের বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সমালোচনামূলক সাহিত্য রচনায়ও মৌলিক প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্য গঠনের ভঙ্গী গ্রথিত করে বাংলা ভাষাকে অধিকতর সাবলীলতা দান করেন তিনি।
বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন,
“ আধুনিক বাংলা-সাহিত্যের যে অধ্যায়কে বলা হয় 'কল্লোল যুগ' সেই অধ্যায়ের তরুণতম প্রতিনিধি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে যখন 'কল্লোল' প্রকাশিত হয় তখন বুদ্ধদেবের বয়স মাত্র পনেরো। কলকাতায় কল্লোল (১৩৩০) এবং কালিকলমে'র (১৩১৩) মতো ঢাকায় 'প্রগতি' ছিল সে যুগের আধুনিকতার মুখ্য বার্তাবহ। গ্রন্থকার হিসেবে বুদ্ধদেবের জীবনে ১৯৩০ সালটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই বৎসরেই তাঁর বন্দীর বন্দনা (কাব্য), সাড়া (উপন্যাস), অভিনয় নয় (ছোট গল্প-সঙ্কলন) প্রকাশিত হয়। তখন তিনি সবেমাত্র একুশ বৎসর অতিক্রম করেছেন। ”
সাহিত্যে অবদান
ছাত্রজীবনে ঢাকায় তিনি যে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন প্রৌঢ় বয়সেও সেই এক্সপেরিমেন্টের শক্তি তাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর প্রথম যৌবনের সাড়া এবং প্রাক-প্রৌঢ় বয়সের তিথিডোর উপন্যাস দু'টি দুই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। তাঁর চল্লিশোর্ধ বয়সের রচনাগুলোর মধ্যে - গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত নানা চিরায়ত সাহিত্যের উপমার প্রাচুর্য্য দেখা যায়। অতি আধুনিক উপন্যাসের গীতিকাব্যধর্মী উপন্যাস রচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। রচনার অজস্রতা এবং অভিনব লিখনভঙ্গীর দিক দিয়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর উপন্যাসে যে ঘাত-প্রতিঘাত ও মানবিক প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেছেন, তাতে মনঃস্তত্ত্বের বিশ্লেষণের পরিবর্তে কাব্যোচ্ছাসের প্রাধান্য বিদ্যমান। অকর্মণ্য, রডোড্রেনড্রন গুচ্ছ, যেদিন ফুটল কমল প্রভৃতি উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু কাব্যপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিথিডোর, নির্জন স্বাক্ষর, শেষ পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি উপন্যাস নতুন জীবন-সমীক্ষা-রীতির পরিচয়বাহী।
বুদ্ধদেব বসু'র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পৃথিবীর প্রতি (১৯৩৩) 'বন্দীর বন্দনা'র পরিপূরক গ্রন্থ। উভয় গ্রন্থেই শরীরী প্রত্যয়ে প্রেমের অভিব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে। কিছুটা স্বাদের ব্যতিক্রম এসেছে - 'কঙ্কাবতী' (১৯৩৭) কাব্যগ্রন্থে। পদ ও বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তির সাহায্যে একটি ধ্বনি আবর্ত নির্মাণ করে বুদ্ধদেব বসু যৌবনের আনন্দগানকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক কবিকুলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। সুকুমার সেনের ভাষায় -
“ তাঁর লক্ষ্য ছিল আধুনিক কবিতার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং 'আধুনিক' কবিতা লেখকদের পক্ষ সমর্থন করা। ”
সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে সমালোচনামূলক সাহিত্যে তাঁর সাফল্য সমপর্যায়ের। তিনি বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্যগঠনের ভঙ্গী সুপ্রসিদ্ধ করেছেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতমগ্নতা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা বুদ্ধদেব বসু'র গদ্যের বৈশিষ্ট্য। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, সম্পাদনা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে বসু'র প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫৬টি।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পত্তনে যে কয়েকজনের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় বুদ্ধদেব বসু তার মধ্যে অন্যতম। তাকে কল্লোল যুগ-এর অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলা কবিতায় আধুনিক চিন্তা-চেতনা এবং কাঠামো প্রবর্তনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্যক পরিচয় ছিল। ফলে ইউরোপীয় এবং মার্কিন সাহিত্যের কলা-কৌশল বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতায় তার বাড়ির নাম রেখেছিলেন কবিতাভবন যা হয়ে উঠেছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান। ১৯৩০-এর দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকটি দশক সাহিত্য পরিমণ্ডলে তার প্রভাব ছিল অবিসংবাদিত। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তিনি কাজ করেছেন।
জীবনের শেষের দিকে তিনি নাট্যকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তপস্বী ও তরঙ্গিনী, কলকাতার ইলেকট্রা ও সত্যসন্ধ, কালসন্ধ্যা, পুনর্মিলন, অনামী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ প্রভৃতি নাট্যকাব্য বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন শিল্পরূপে জন্ম দিয়েছে। জগদীশ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন,
“ বস্তুত শুধু নিজে অজস্র রূপ ও রীতির কবিতা লিখেই নয়, সহযাত্রী এবং উত্তরসূরি আধুনিক কবি সমাজকে কবি মর্যাদায় সমুন্নীত করে কবিতা সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু একালের বাংলা কাব্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন। ”
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
কবিতাঃ
মর্মবাণী (১৯২৫), বন্দীর বন্দনা (১৯৩০), পৃথিবীর পথে (১৯৩৩), কঙ্কাবতী (১৯৩৭), দময়ন্তী (১৯৪৩), দ্রৌপদীর শাড়ি (১৯৪৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩), শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর (১৯৫৫), যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮), দময়ন্তী: দ্রৌপদীর শাড়ি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৬৩), মরচেপড়া পেরেকের গান (১৯৬৬), একদিন: চিরদিন (১৯৭১), স্বাগত বিদায় (১৯৭১)
উপন্যাসঃ
সাড়া (১৯৩০), সানন্দা (১৯৩৩), লাল মেঘ (১৯৩৪), পরিক্রমা (১৯৩৮), কালো হাওয়া (১৯৪২), তিথিডোর (১৯৪৯), নির্জন স্বাক্ষর (১৯৫১), মৌলিনাথ (১৯৫২), নীলাঞ্জনের খাতা (১৯৬০), পাতাল থেকে আলাপ (১৯৬৭), রাত ভর বৃষ্টি (১৯৬৭), গোলাপ কেন কালো (১৯৬৮), বিপন্ন বিস্ময় (১৯৬৯), রুক্‌মি (১৯৭২)
গল্পঃ
অভিনয়, অভিনয় নয় (১৯৩০), রেখাচিত্র (১৯৩১), হাওয়া বদল (১৯৪৩), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৫৯), একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু (১৯৬০), হৃদয়ের জাগরণ (১৩৬৮), ভালো আমার ভেলা (১৯৬৩), প্রেমপত্র (১৯৭২)
প্রবন্ধঃ
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি (১৯৩৫), কালের পুতুল (১৯৪৬), সাহিত্যচর্চা (১৩৬১), রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য (১৯৫৫), স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭), সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৩), প্রবন্ধ-সংকলন (১৯৬৬), কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)
নাটকঃ
মায়া-মালঞ্চ (১৯৪৪), তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬), কলকাতার ইলেক্ট্রা ও সত্যসন্ধ (১৯৬৮)
অনুবাদঃ
কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭), বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা (১৯৭০), হেল্ডালিনের কবিতা (১৯৬৭), রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা (১৯৭০)
ভ্রমণ কাহিনীঃ
সব-পেয়েছির দেশে (১৯৪১), জাপানি জার্নাল (১৯৬২), দেশান্তর (১৯৬৬),
স্মৃতিকথাঃ
আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩), আমার যৌবন (১৯৭৬)
সম্পাদনাঃ
আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৬৩)
নদী-স্বপ্ন – বুদ্ধদেব বসু
কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটোকথা শোনা দিকি
এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবেকি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে
আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকেহবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার- না, আমি একা ল’ব মাথা পেতে।
নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবলঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামী? সোনালী? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়
শুয়ে’ শুয়ে’ – মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই?
কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান ক’রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতেফুর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বে তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ’লো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পালতুলে দাও।
আমর দু’জন দেখি ব’সে ব’সে আকাশ কত না নীল,
ছোট পাখি আরো ছোট হ’য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গোলা, সূর্য লুকালো জলেরতলার ঘরে,
সোনা হ’য়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হ’লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ’লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।
ইলিশ
আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।
মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।
দায়িত্বের ভার
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,
যা-কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার-
সব যেন, বৃহদরণ্যের মতো তর্কপরায়ণ
হয়ে আছে বিকল্পকুটিল এক চতুর পাহাড়।
সেই যুদ্ধে বার বার হেরে গিয়ে, মরে গিয়ে, মন
যখন বলছে; শুধু দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা তার
সবচেয়ে নির্বাচিত, প্রার্থনীয়, কেননা তা ছাড়া আর
কিছু নেই শান্ত, স্নিগ্ধ, অবিচল প্রীতিপরায়ণ-
আমি তাকে তখন বিশ্বস্ত ভেবে, কোনো-এক দীপ্ত প্রেমিকার
আলিঙ্গনে সত্তার সারাত্সার করে সমর্পণ-
দেখেছি দাঁড়িয়ে দূরে, যদিও সে উদার উদ্ধার
লুপ্ত করে দিল ভাবা, লেখা, পড়া, কথোপকথন,
তবু প্রেম, প্রেমিকেরে ঈর্ষা করে, নিয়ে এলো ক্রূর বরপণ-
দুরূহ, নূতনতর, ক্ষমাহীন দায়িত্বের ভার।
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
প্রত্যহের ভার
যে-বাণীবিহঙ্গে আমি আনন্দে করেছি অভ্যর্থনা
ছন্দের সুন্দর নীড়ে বার বার, কখনো ব্যর্থ না
হোক তার বেগচ্যুত, পক্ষমুক্ত বায়ুর কম্পন
জীবনের জটিল গ্রন্থিল বৃক্ষে; যে-ছন্দোবন্ধন
দিয়েছি ভাষারে, তার অন্তত আভাস যেন থাকে
বত্সরের আবর্তনে, অদৃষ্টের ক্রূর বাঁকে-বাঁকে,
কুটিল ক্রান্তিতে; যদি ক্লান্তি আসে, যদি শান্তি যায়,
যদি হৃত্পিণ্ড শুধু হতাশার ডম্বরু বাজায়,
রক্ত শোনে মৃত্যুর মৃদঙ্গ শুধু; … তবুও মনের
চরম চূড়ায় থাক সে-অমর্ত্য অতিথি-ক্ষণের
চিহ্ন, যে-মূহূর্তে বাণীর আত্মারে জেনেছি আপন
সত্তা বলে, স্তব্ধ মেনেছি কালেরে, মূঢ় প্রবচন
মরত্বে; খন মন অনিচ্ছার অবশ্য বাঁচার
ভুলেছে ভীষণ ভার, ভুলে গেছে প্রত্যহের ভার।
ব্যাঙ
বর্ষায় ব্যাঙের ফুর্তি। বৃষ্টি শেষ, আকাশ নির্বাক;
উচ্চকিত ঐকতানে শোনা গেল ব্যাঙেদের ডাক।
আদিম উল্লাসে বাজে উন্মুক্ত কণ্ঠের উচ্চ সুর।
আজ কোনো ভয় নেই- বিচ্ছেদের, ক্ষুধার মৃত্যুর।
ঘাস হল ঘন মেঘ; স্বচ্ছ জল জমে আছে মাঠে
উদ্ধত আনন্দগানে উত্সবের দ্বিপ্রহর কাটে।
স্পর্শময় বর্ষা এল; কী মসৃণ তরুণ কর্দম!
স্ফীতকণ্ঠ, বীতস্কন্ধ- সংগীতের শরীরী সপ্তম।
আহা কী চিক্কণ কান্তি মেঘস্নিগ্ধ হলুদে-সবুজে!
কাচ-স্বচ্ছ উর্ধ্ব দৃষ্টি চক্ষু যেন ঈশ্বরের খোঁজে
ধ্যানমগ্ন ঋষি-সম। বৃষ্টি শেষ, বেলা পড়ে আসে;
গম্ভীর বন্দনাগান বেজে ওঠে স্তম্ভিত আকাশে।
উচ্চকিত উচ্চ সুর ক্ষীণ হলো; দিন মরে ধুঁকে;
অন্ধকার শতচ্ছিদ্র একচ্ছন্দা তন্দ্রা-আনা ডাকে।
মধ্যরাত্রে রুদ্ধদ্বার আমরা আরামে শয্যাশায়ী,
স্তব্ধ পৃথিবীতে শুধু শোনা যায় একাকী উত্সাহী
একটি অক্লান্ত সুর; নিগূঢ় মন্ত্রের শেষ শ্লোক-
নিঃসঙ্গ ব্যাঙের কণ্ঠে উত্সারিত- ক্রোক, ক্রোক, ক্রোক।
রূপান্তর
দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু,
রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে।
ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা,
বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী,
মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা।
জাগো, হে পবিত্র পদ্ম, জাগো তুমি প্রাণের মৃণালে,
চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান ক্ষমায়,
ক্ষণিকেরে কর চিরন্তন।
দেহ হোক মন, মন হোক প্রাণ, প্রাণে হোক মৃত্যুর সঙ্গম,
মৃত্যু হোক দেহ প্রাণ, মন।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা
আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পড়ো না, কথা বলেও নষ্ট করো না এই রাত্রি-
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।
কেননা কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হয়ে গেছে,
কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই;
তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল-
অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন।
কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন,
তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু?
বলো না ‘সুন্দর’, বলো না ‘ভালোবাসা’, উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না
নিজেদের-
শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে।
আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই,
যার উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে,
যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ-
নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন।
আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।
দেখবে কেমন ছোটো হতেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধরে যায়,
যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর, যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো
অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ-
সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত,
যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়,
রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ-
যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব
সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে,
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়-
সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের।
আমাকে ভুল বোঝো না। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ,
প্রাণ কত বিপন্ন।
কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান,
যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর
মৃত্তিকায়-
চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত।
তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি,
আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া?
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের-
যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।
নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক,
যারা ভোলো নি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে,
রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য
এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা :
আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ-
সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে
নিশান।
মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে
শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার।
স্টিল্ লাইফ
সোনালি আপেল, তুমি কেন আছ? চুমো খাওয়া হাসির কৌটোয়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে?
ঠাণ্ডা, আঁটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়?
এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র। হেমন্তের যেন অন্ত নেই।
গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে।
তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে
থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার। কিন্তু শুধু এই?
তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে
আসে ভারী-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা
থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে
ছুঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে
হয়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা-
যা দেখে, হঠাৎ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হতে
কোনো মৃতার প্রতি
‘ভুলিবো না’ - এত বড় স্পর্ধিত শপথে
জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।
তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে
ব্যপ্ত হোক। তোমার মুখশ্রী-মায়া মিলাক, মিলাক
তৃণে-পত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলে-স্থলে, আকাশের নীলে।
শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে
জ্বেলে রাখি এই রাত্রে - তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে।
বিদ্যাসুন্দর
বলতে পারো, সরস্বতীর
মস্ত কেন সম্মান?
বিদ্যে যদি বলো, তবে
গণেশ কেন কম যান?
সরস্বতী কী করেছেন?
মহাভারত লেখেন নি।
ভাব দেখে তো হচ্ছে মনে,
তর্ক করাও শেখেন নি।
তিন ভুবনে গণেশদাদার
নেই জুড়ি পাণ্ডিত্যে
অথচ তার বোনের দিকেই
ভক্তি কেন চিত্তে?
সমস্ত রাত ভেবে ভেবে
এই পেয়েছি উত্তর-
বিদ্যা যাকে বলি, তারই
আর একটি নাম সুন্দর।
প্রেমের কবিতা
শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
শুধু নয় কঙ্কণে ক্ষণে ক্ষণে ঝংকার
আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।
শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন।
-কিছু তার দ্বন্দ্ব, কিছু তার ছন্দ।
পুষ্পের নিশ্বাস, রেশমের শিহরণ,
রক্তের রক্তিমা, কনকের নিক্কণ।
গন্ধের বাণী নিয়ে পরশের সুরকার
অঙ্গের অঙ্গনে আনলো যে-উপহার-
সে-তো শুধু বর্ণের নহে গীত-গুঞ্জন।
-কিছু তার স্বর্ণ, কিছু তার স্বপ্ন।
বিলাসিত বলয়ের মত্ত আবর্তন,
মূর্ছিত রজনির বিদ্যুৎ-নর্তন।
বিহ্বল বসনের চঞ্চল বীণা তার
উদ্বেল উল্লাসে আঁধারের ভাঙে দ্বার-
সে কি শুধু উদ্দাম, উন্মাদ মন্থন।
---কিছু তার সজ্জা, কিছু তার লজ্জা।
শুধু নয় দু’জনের হৃদয়ের রঞ্জন,
নয়নের মন্ত্রণা, স্মরণের অঞ্জন।
রঙ্গিণী করবীর গরবিনী কবিতার
জাদুকর-তির্যক ইঙ্গিত আনে যার,
সে কি শুধু দেহতটে তরঙ্গ-তর্পণ।
-কিছু তার দৃশ্য, কিছু বা রহস্য।
এসো শুভ লগ্নের উন্মীল সমীরণ
করো সেই মন্ত্রের মগ্নতা বিকীরণ,
যার দান বিরহের অনিমেষ অভিসার,
মিলনের ক্ষণিকার কণ্ঠের মণিহার;---
সেথা বিজ্ঞানিকের বৃথা অণুবীক্ষণ।
---কিছু তার জৈব, কিছু তার দৈব।
শেষের রাত্রি
পৃথিবীর শেষ সীমা যেইখানে, চারিদিকে খালি আকাশ ফাঁকা,
আকাশের মুখে ঘুরে-ঘুরে যায় হাজার-হাজার তারার চাকা,
যোজনের পর হাজার যোজন বিশাল আঁধারে পৃথিবী ঢাকা।
(তোমার চুলের মতো ঘন কালো অন্ধকার,
তোমারি আঁখির তারকার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
বিশাল আকাশ বাসনার মতো পৃথিবীর মুখে এসেছে নেমে,
ক্লান্ত শিশুর মতন ঘুমায় ক্লান্ত সময় সগসা থেমে;
দিগন্ত থেকে দূর দিগন্তে ধূসর পৃথিবী করিছে খাঁ-খাঁ।
(আমারি প্রেমের মতন গহন অন্ধকার,
প্রেমের অসীম বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
নেমেছে হাজার আঁধার রজনি, তিমির-তোরণে চাঁদের চূড়া,
হাজার চাঁদের চূড়া ভেঙে-ভেঙে হয়েছে ধূসর স্মৃতির গুঁড়া।
চলো চিরকাল জ্বলে যেথা চাঁদ, চির-আঁধারের আড়ালে বাঁকা
(তোমারি চুলের বন্যার মতো অন্ধকার,
তোমারি চোখের বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )
এসেছিল যত রূপকথা-রাত ঝরেছে হলদে পাতার মতো,
পাতার মতন পীত স্মৃতিগুলি যেন এলোমেলো প্রেতের মতো।
---রাতের আঁধারে সাপের মতন আঁকাবাঁকা কত কুটিল শাখা
(এসো, চলে এসো; সেখানে সময় সীমাহীন
হঠাৎ ব্যথায় নয় দ্বিখণ্ড রাত্রিদিন;
সেখানে মোদের প্রেমের সময় সীমাহীন,
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
অনেক ধূসর স্বপনের ভারে এখানে জীবন ধূসরতম,
ঢালো উজ্জ্বল বিশাল বন্যা তীব্র তোমার কেশের তম,
আদিম রাতের বেণিতে জড়ানো মরণের মতো এ-আঁকাবাঁকা।
(ঝড় তুলে দাও, জাগাও হাওয়ার ভরা জোয়ার,
পৃথিবী ছাড়ায়ে সময় মাড়ায়ে যাবো এবার,
তোমার চুলের ঝড়ের আমরা ঘোড়সাওয়ার---
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )
যেখানে জ্বলিছে আঁধার-জোয়ারে জোনাকির মতো তারকা-কণা,
হাজার চাঁদের পরিক্রমণে দিগন্ত ভরে উন্মাদনা।
কোটি সূর্যের জ্যোতির নৃত্যে আহত সময় ঝাপটে মাথা।
(কোটি-কোটি মৃত সূর্যের মতো অন্ধকার
তোমার আমার সময়-ছিন্ন বিরহ-ভার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
তোমার চুলের মনোহীন তমো আকাশে-আকাশে চলেচে উড়ে
আদিম রাতের আঁধার-বেণিতে জড়ানো মরণ পঞ্জে ফুঁড়ে,---
সময় ছাড়ায়ে, মরণ মাড়ায়ে---বিদ্যুৎময় দীপ্ত ফাঁকা।
(এসো চলে এসো যেকানে সময় সীমানাহীন,
সময়-ছিন্ন বিরহে কাঁপে না রাত্রিদিন।
যেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
নবযৌবন
(এটি অগ্রন্থিত কবিতা)
বেদনায় রাঙা মোর দগ্ধ বুক ভরি
যুগ হতে যুগান্তর ধরি
কী গান উঠেছে বাজি, কী সঙ্গীত তুলিয়াছে তান
কোন্ মহামায়া মন্ত্র তুলিয়াছে নিত্য নব গান,
কী সঙ্গীত উঠিয়াছে ধ্বনিয়া
মর্ম-মাঝে রণিয়া-রণিয়া,
ওগো মহাকাল,
হে সুন্দর, নিষ্ঠুর, ভয়াল
তোমার ললাট ’পরে লেখা হয়েছিল যদি,
নিরবধি
বয়ে চলা ফল্গুধারা সম
ছিন্ন-তন্ত্রী এই বীণা মম
তোমার বুকের ’পরে জাগাইয়াছে যদি প্রতিধ্বনি
সে কথায় জেগে যদি উঠেছে অবনী,
তবে ওই ভীষণ মৌনতা
কেন আজ টুটিল তা?
কেন আজ ভেঙে গেল যুগান্তের শৃঙ্খল কঠিন?
প্রসন্ন নবীন
উদিল প্রভাত
অকস্মাৎ,
পোহাইল যেন দীর্ঘ দুঃখ-বিভাবরী,
কেটে গেল মরণ-শর্ব্বরী।
আর ভয় নাই, নাই ভয়,
জীবনে-মরণে আজ, প্রভূ মোর, হোক তব জয়!
এনেছে যৌবন তার
বিচিত্র সম্ভার;
বসন্তের ফুলদল হাতে লয়ে এসেছে সে
নব অতিথির বেশে।
তারে আজ করিনু বরণ,
তাহার পরশ পেয়ে ধন্য হল আমার মরণ,
ধন্য হল দুঃখ-দগ্ধ ক্লান্ত বিভাবরী,
তাই বক্ষ তরঙ্গিত করি,
উঠিয়াছে আনন্দ-হিল্লোল,
চিরন্তন সঙ্গীত কল্লোল
বক্ষে বাজে শঙ্খধ্বনি-সম,
নিরূপম
উচ্ছ্বাসের উন্মত্ত ধারায়,
জীবনের সূত্রগুলি আচম্বিতে কখন হারায়!
চিরদিনকার পাওয়া যৌবন আমার
লহ নমস্কার!
তুমি রুদ্র, তুমি ভয়ঙ্কর,
তাই তুমি অমন সুন্দর।
প্রবালের মতো তব রাঙা ওষ্ঠাধরে
চুম্বন আঁকিয়ে দিতে জন্ম-জন্মান্তরে
সাধ মোর;
অন্ধতার ঘোর
রাত্রির আকাশ সম সুনিবিড় কেশ,
ঊষার উদয় সম চক্ষে তব আনন্দ-উন্মেষ,
বক্ষে তব নবজন্ম আশা
মুখে তব বিশ্বসৃষ্টি ভাষা
সারা দেহে লীলায়িত গভীর বেদন
অনন্ত জীবন আর নিবিড় মরণ
নমি তোমা বার বার, হে আমার অনন্ত যৌবন।
...........


মৌমাছি


   মৌমাছি


   ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু

শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক এবং মণিমেলার প্রতিষ্ঠাতা
বিমল ঘোষ (মৌমাছি) (জন্মঃ- ১৮ মার্চ, ১৯১০ – মৃত্যুঃ- ৭ মার্চ, ১৯৮২)
১৯৪০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় ছোটদের জন্য “আনন্দমেলা” নামক একটি অংশ নির্দিষ্ট করা হয়। বিমল ঘোষ “মৌমাছি” নামে এই বিশেষ বিভাগটি পরিচালনা করতেন। তাঁর রচিত শিশুসাহিত্য বিষয়ক রচনা শতাধিক। কবিতা, ছড়া, নাটক, গল্প সব ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর লেখা অসংখ্য বইয়ে তিনি ছোটদের জন্য সৃষ্টি করলেন এমন এক অনন্য ভুবন যেখানে মায়াবী জগতের সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, তাদের সাথে মজার খেলায় মত্ত হয়েও ছোটরা একই সঙ্গে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে এক প্রবহমান শক্তি-প্রাচীর। নিছকই আজগুবি কোনো কিছুকে মৌমাছি শিশু-মনে লালন করতে দিতে চাইতেন না। চল্লিশের দশকে সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর একটি নাটক ‘সোনার বাংলা’-র গ্রামাফোন রেকর্ড দু’ খন্ডে প্রকাশিত হয়। ভ্রমণ ও শিক্ষামূলক এই নাটকে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ছোটদের দেশাত্মবোধের কথা শুনিয়েছেন। ওই নাটকেই তিনি স্পষ্টভাষায় ছোটদের ভূতুড়ে গল্প পড়তে নিষেধ করেছেন। কেননা তাতে ক্ষতিকর দিক ছাড়া, ছোটদের ভীতু করা ছাড়া গঠনমূলক কিছু নেই বলে তিনি মনে করতেন। তিনি চাইতেন ছোটরা অল্প বয়স থেকেই মানসিকভাবে দৃঢ়চেতা হয়ে উঠুক। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সেই সমাজের যেখানে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। তাঁর অধিকাংশ লেখাতে তাই আমরা ছোটদের ভবিষ্যতের সুনাগরিক হওয়ার প্রত্যাশার ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়।
ছোটদের জন্য মৌমাছি প্রায় একশ চল্লিশটি বই লিখেছেন। যদিও তার অধিকাংশই আজ আর পাওয়া যায় না। শিশু সাহিত্য সংসদ(কলকাতা) প্রকাশিত তাঁর চেঙা বেঙা সিরিজের তিনটি বই(পিকনিক, নাকাল নেংটি, চালাক বোকা) এবং কার্তিক ঘোষ সম্পাদিত মৌমাছি রচনা সম্ভার (মায়ের বাঁশি-উপন্যাস, কয়েকটি কবিতা, দুটি রূপকথা ও অ্যাঙাচি ব্যাঙাচি, টুনটুনি আর ঝুনঝুনি, কালটু-গুলটু) ছাড়া আর কোনো বই পাওয়া যেত না। আশার কথা এই যে, তাঁর জন্মশতবর্ষকে স্মরণে রেখে ২০১০ সালে কলকাতার লালমাটি প্রকাশন নিমাই গরাই-এর সম্পাদনায় মৌমাছি রচনাসমগ্র ১ নামে অত্যন্ত শোভন একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। শোনা যাচ্ছে তাঁরা খন্ডে খন্ডে মৌমাছির অধিকাংশ লেখাই প্রকাশ করবেন। মৌমাছি রচনাসমগ্র ১-এ স্থান পেয়েছে-- গল্পগ্রন্থ : যে গল্পের শেষ নেই, নয়া যুগের রূপকথা, বাছা বাছা, কালটু গুলটু ; উপন্যাস : মায়ের বাঁশি, ঝড়ের পালক ; কার্টুন : রাজার রাজা(স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী) ; নাটক : কথামালা রাজকন্যে; এবং মৌমাছির চিঠি।
সুন্দর কিছু ছড়া-কবিতাও লিখেছিলেন মৌমাছি। যদিও তাঁর ছড়ার বই ‘মৌ-মিছরি-মন্ডা’ প্রকাশিত হয়েছিল তার মৃত্যুর অনেক পরে। কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি যে সব ছড়া-কবিতা লিখতেন তা প্রায় সর্বাংশেই কৌতুকদীপ্ত ও রসোত্তীর্ণ। ‘যদি হয়!’ কবিতায় তিনি লিখছেন--
কুমড়ো যদি ধুমড়ো দেহে জ্যান্ত হয়ে নড়ে,/ ঝুড়ির থেকে লাফিয়ে উঠে আমার ঘাড়ে পড়ে।/ শশা যদি মশাল জ্বেলে ডাকাত হয়ে ওঠে,/ মায়ের গায়ের গয়না নিয়ে পুকুরপাড়ে ছোটে।/ বেগুন যদি আগুন পোয়ায় উনুন ধারে বসে,/ তেল নিয়ে তার কালো দেহে মালিশ করে কষে।/ লঙ্কা যদি ডঙ্কা বাজায় করতালটি পেটে,/ ল্যাজ করে তার বোঁটাটিকে এগিয়ে আসে হেঁটে।/ খাটে শুয়ে আমি ভাবি এসব যদি হয়!/ এমন সময় টিক্টিকিটা ঠিক ঠিক ঠিক কয়।
(মৌমাছি রচনা সম্ভার, পৃ- ১৪৫)
গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি মৌমাছি ছোটদের জন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক রচনা করেছিলেন। শুধু নাটক লেখা নয়, ছোটদের দিয়ে তিনি সেগুলি মঞ্চে অভিনয়ও করিয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রধান দুটি নাটক হল-- ‘পুতুলের দেশ’ এবং ‘যারা মানুষ নয়’। ‘পুতুলের দেশ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। এই রূপক নাটকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। ভারতবর্ষের দেশনায়কদের অনুসরণে এই নাটকটির প্রধান প্রধান চরিত্র নির্মিত হয়েছিল। প্রায় এক বছর ধরে রঙমহলে এটি নিয়মিত অভিনীত হয়েছিল। ছোটদের দিয়ে এই নাটক মঞ্চে নিয়মিত অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মৌমাছি এদেশে ‘শিশু রঙ্গমঞ্চ আন্দোলন(চিলড্রেন্স থিয়েটার)’-এর গোড়াপত্তন করেন।
আনন্দমেলা-র পাতায় ২২ ভাদ্র, ১৩৪৮-এ লেখা ‘মৌমাছির চিঠি’তে ছোটদের উদ্দেশে তিনি লিখছেন ---
তোমাদের মধ্যে অনেকেই যে বড়লোকের ছেলে-মেয়ে সে-খবর আমি জানি...। যদি তোমাদের ওই ঐশ্বর্য দিয়ে তোমাদের আত্মীয় বন্ধু, পাড়াপড়শিদের দুঃখের কিছুমাত্র লাঘব করতে না-পারো, তবে সে-ঐশ্বর্যের গর্ব সত্যিকারের মানুষের মনকে লজ্জাই দেয়। তাই মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমরা... দেশের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবার ব্রত নিয়েছ। কাজেই যাদের এই দুর্দিনেও ভালো ভালো দামি পোষাক জামাকাপড় কেনবার সামর্থ আছে, তারা যেন সেই সামর্থকে কাজে লাগায় -- অপরের সাহায্যে অপরের সেবায়। ...অনায়াসে কম দামি জুতো বা শাড়ি কিনে বাকি পয়সা দিয়ে নিজের গরীব জ্ঞাতি, আত্মীয় বা বন্ধুদের কিছু কিছু কাপড় জামা কিনে দিতে পারো এই পুজোর সময়। মনে রেখো এ-দেশে আজও যারা গরীব, চাষী, মজুর, কুলি তারাই দেশের প্রকৃত শক্তি। (মৌমাছির চিঠি, মৌমাছি রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা- ৫৮৫)
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে আনন্দবাজার পত্রিকার সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও প্রফুল্লকুমার সরকারের ডাকে তিনি ১৯৩৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলেন। এর কিছু দিন পর, ১৯৪০-এর ১৫ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকার শেষ পাতায় ভারতীয় ভাষায় ছোটদের গল্প, কবিতা, ছড়া, ছবিতে সুসজ্জিত হয়ে প্রকাশিত হল একটি চমকপ্রদ চিরনতুন পাতা-- ‘আনন্দমেলা’। পরিচালক ‘মৌমাছি’ ছদ্মনামে বিমল ঘোষ। এর পর থেকে প্রতি সোমবার আনন্দের নানা পশরা সাজিয়ে এটা প্রকাশিত হত। আনন্দমেলা-র পরিচালক হিসাবে তিনি এত জনপ্রিয় হয়েছিলেন তাঁর কাছে ছোটদের হাজার হাজার চিঠি আসত আর সপ্তাহান্তে আনন্দমেলা-য় প্রকাশিত তাঁর ‘মৌমাছির চিঠি’ পড়ার জন্য ছোটোরাও মুখিয়ে থাকত।
আসলে শুধুই আনন্দদান বা তাৎক্ষণিক তৃপ্তির জন্য মৌমাছি কলম ধরেন নি। শিশুদের ভালোবেসে, জাতি গঠনের জন্য তাদের দায়িত্বসচেতন করার উদ্দেশ্যে তিনি আনন্দমেলার পাতায় নিয়মিত যে চিঠিগুলি লিখতেন তা পড়ে শিশুরা যাতে জ্ঞানার্জন করতে পারে সেজন্য তাঁর চেষ্টার অবধি ছিল না। শোনা যায় শিশুকিশোরদের চিঠির প্রশ্নের উত্তরে এই চিঠিগুলি লেখার সময় মাঝেমাঝে তিনি বিশেষজ্ঞদের সাহায্যও নিতেন। আর তাই সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, মজার খেলা, শিল্পচর্চা ইত্যাদি বিষয়গুলি আকর্ষনীয় ভাবে উপস্থাপনের জন্য আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শিশু-কিশোরদের কাছে ‘মৌমাছি’ এবং ‘আনন্দমেলা’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
মৌমাছির লেখা প্রথম উপন্যাস এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘মায়ের বাঁশি’(১৯৫৮)। ছোট্ট ছেলে মিঠু ও তার আদরের কুকুর টমকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। বইটির নিবেদন অংশে মৌমাছি জানিয়েছিলেন, অশোককুমার সরকার এবং চিত্রপরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের আগ্রহে তিনি এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। দশ মাস ধরে আনন্দবাজার পত্রিকার আনন্দমেলা পাতায় এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে সিনেমা করার জন্য এটির চিত্ররূপ প্রকাশের স্বত্ব কেনে তখনকার বিখ্যাত ‘ডি-ল্যুক্স ফিল্মস’। অত্যন্ত গরীবের ছেলে বাবাহারা মিঠুর ব্যথা-সকরুণ জীবনের নানা দিক, তার হাসি-কান্না, জীবজন্তুর সঙ্গে তার সখ্যতা, তার অভিমান এই সব নিয়ে বিমল ঘোষ এমন এক নিটোল কিশোর উপন্যাস লিখেছেন যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র। যেখানে সহজিয়া এক বালক তার সারল্য, মায়া দিয়ে সবার মন জয় করে নেয়।
...মিঠু ঝোপজঙ্গলে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যেতেই ও ভালোবাসে। রকমারি বুনো ফুল আর লতা-পাতা নেড়েচেড়ে দেখে। ছিঁড়ে নিয়ে আসে। মাকে দেখায়, জিজ্ঞেস করে-- ‘এটার কী নাম? ওটার রং অমন কেন?’
ওই বাগানটাই ওর মনে রূপকথার মায়া-কানন। এ-গাছে, সে-গাছে উঠে, মিঠু ওখানেই খুঁজে বেড়িয়েছে সোনার ডালে হিরের ফুল। যা খুঁজেছে, তা পায়নি। খোঁজ পেয়েছে রকমারি পোকামাকড়, পাক-পাখালির ডিম, বাসার। দেখেছে পাখি-মার সঙ্গে পাখির ছানাদের ভাব-ভালোবাসা। দেখেছে তাদের উড়তে শেখা, হাওয়ায় ভাসা।
তবে ছোটদের কাছে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই চেঙা-বেঙা(১৯৫৬)। মজার ছবি ও গল্পের এ এক অনন্য বই। মৌমাছির লেখা গল্পে ছবি এঁকেছিলেন শিল্পী ধীরেন বল। অবশ্য বর্তমানে যে সংস্করণ পাওয়া যায় তার ছবি এঁকেছেন প্রশান্ত মুখার্জি। ধবধবে সাদা এক ছোট্ট খরগোশ-- নাম তার চেঙা। আর সবুজ গা, থপথপে চলন যে ব্যাঙের তার নাম বেঙা। এই দুই বন্ধুর মজার কান্ডকারখানা নিয়ে তিনটি অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লিখেছিলেন মৌমাছি-- পিকনিক, নাকাল নেংটি, চালাক বোকা। তিনটিই শিশুদের কাছে সমান জনপ্রিয়। এই গল্প সিরিজটি লেখার জন্য মৌমাছি সাহিত্য অকাদেমি কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও তৎপরবর্তী ঘটনাপরম্পরায় ঘরছাড়া মানুষের উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে লেখা বিমল ঘোষের ‘ঝড়ের পালক’ একটি অসাধারণ উপন্যাস। এই উপন্যাসে সময়সচেতন লেখক ভারতবর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়পর্বকে অত্যন্ত নিপুণভাবে এঁকেছেন। দশ বছরের ছোট্ট বালক দুখু, তার বোন ছ’বছরের লখু এবং তাদের ঠাকুমাকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসের মূল কাঠামো। ছোট্ট দুখুর চোখ দিয়ে মৌমাছি সেই সময়কার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খুন, লুঠতরাজ, অগ্নিকান্ডের ছবি আমাদের প্রত্যক্ষ করান--
সে চোখ বুজেই স্পষ্ট দেখছে--- তার বুড়ি ঠাকুরমা রাতের গহন আঁধারে একটা জলমরা নদী পেরুচ্ছে হাঁটুর কাপড় তুলে দুখুকে কাঁধে চড়িয়ে। তাদের চারপাশে নাচছে লকলকে আগুনের শিখা। ঘরবাড়ি পুড়ছে দাউ দাউ করে। আকাশে বাতাসে বুকভাঙা হাহাকার। ভয়-পাওয়ানো হিংসা মারামারির খুনচাপা বীভৎস চিৎকার। (ঝড়ের পালক, মৌমাছি রচনাবলী ১, পৃ-৩৬৪)
ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক অধ্যায়ের সামনে বিমল ঘোষ আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন। ১৯৫৯ সালে যখন এটি প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গে তখন আর এক ট্র্যাজিক অধ্যায়। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই তখন খাদ্য আন্দোলনের ঢেউ। ব্যাপক আইন অমান্য, ভুখা মিছিল, গ্রেপ্তার, ছাত্র ধর্মঘট-- সব মিলিয়ে রাজ্যে তখন এক টালমাটাল পরিস্থিতি। এমনই সময়ে প্রকাশিত হয় ‘ঝড়ের পালক’।
দাঙ্গাবিধ্বস্ত সময়ে ছোট্ট দুখু ওরফে সুখরঞ্জন ও লখু ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের বাবা-মার কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বৃদ্ধা ঠাকুমার সাথে এসে আশ্রয় নেয় সরকারি উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। এখান থেকে তাদের জীবন বিচিত্র খাতে বইতে থাকে। যে জীবনে পর্বতপ্রমাণ কষ্ট। যে জীবন নিরুপায় মানুষকে ভিখারি, চোর কিংবা মাস্তান বানিয়ে দেয়। পরে ঘটনা-পরম্পরায় দুখু তার বাবা-মাকে ফিরে পায়। এই উপন্যাসে মেকি উদ্বাস্তুদরদী ভোটপ্রার্থী রায়বাহাদুর মোহন সিংহের যেমন দেখা মেলে, তেমনি পাই সহৃদয় উদ্বাস্তু-ক্যাম্প সুপারিনটেন্ডেন্ট নাগ সাহেব এবং ¯স্নেহশীলা রায়বাহাদুর-গিন্নিকে। একদা জমিদারগৃহিনী সময়ের ফেরে কীভাবে ভিখারি হয়ে ওঠে(বলা ভালো ভিখারি হতে চায়) তারই করুণ চিত্র এই উপন্যাসে এঁকেছেন মৌমাছি--
দুখুর ঠাকুরমার মাথাতেও ফন্দি ঘোরে।... ছোটে এখানে সেখানে। স্টেশনে যায়, সন্ধ্যার অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে। ডেলি প্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে পয়সা চাইবার মতলবেই যায়। হাত পেতে চাইতে পারে না আর পাঁচজন উদ্বাস্তুর মতো।... না চাইতে পেরে ফিরে আসে।...
অনেক দিন পরে চোখে ভেসে উঠল স্বর্গবাসী জমিদার-স্বামীর পাকানো চোখ দুটো। ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো স্টেশনের বাইরে একগলা ঘোমটা টেনে ফটকের ধারে। টলতে টলতে অন্ধকার রাস্তার একটা গাছের আড়ালে গিয়ে বুড়ি হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল।
রায়বাহাদুর-গিন্নি শহর থেকে ফিরছিলেন। ...তিনি কান্না শুনে বুড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘কী হয়েছে গা ? কাঁদছ কেন অমন করে ?’
বুড়ি আরো জোরে কেঁদে উঠল। ছেলেমানুষের মতো বলল-- ‘ভিক্ষা করনের লাইগ্যা রোজই আইতে আছি। পারতে আছি না মা।’
(ঝড়ের পালক, মৌমাছি রচনাবলী ১, পৃ-৩৬৬-৬৭)
মূল্যবোধের অবক্ষয় ও কিছু মানুষের উসকানিতে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ কীভাবে অসহায় ও বিপন্ন হয়ে ওঠে এ উপন্যাস তারই এক দলিল।
উপন্যাসের পাশাপাশি ছোটদের উপযোগী অনেক গল্পও লিখেছেন বিমল ঘোষ। কিন্তু প্রতিটি গল্পেই তিনি তাদের জন্য কিছু না কিছু বার্তা রেখেছেন যা তাদের মানসগঠনে সহায়ক হতে পারে। এমনই দুটি গল্পগ্রন্থ ‘যে গল্পের শেষ নেই’(১৯৪২) এবং ‘নয়া যুগের রূপকথা’(১৯৪৭)। ‘যে গল্পের শেষ নেই’ গ্রন্থে মোট আটটি গল্প আছে। গল্পগুলি হল-- যে গল্পের শেষ নেই, মরণ-জয়ী, আনন্দ-উৎসব, পাগলা মোনা, এদের তোরা চিনলি না, দেশের মাটি, ব্ল্যাক-আউট, এই কি শেষ। এই গল্পগ্রন্থটি যখন প্রকাশিত হয় বিশ্বযুদ্ধের রণহুঙ্কারে সারা পৃথিবী তখন কাঁপছে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়েছে দেশের মানুষ। জাপানি বোমাতঙ্কে প্রায় সবারই তখন বুক দুরুদুরু। দেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয়দের মনে তখন নিঃশেষে প্রাণ দান করার তীব্র ব্যাকুলতা। এমনই এক সন্ধিক্ষণে প্রকাশিত হয়েছিল ‘যে গল্পের শেষ নেই’। যে কোনও সমাজ ও দেশসচেতন লেখকের লেখায় তখন স্বাধীনতার বার্তা কম বেশি উঠে আসছে। রূপকার্থে মৌমাছি এই গ্রন্থে লিখলেন তেমনই কিছু গল্প। ‘যে গল্পের শেষ নেই’-এ মূল চরিত্র রাজার কন্যা ভারতী। ছোট্ট কিশোর চঞ্চল অত্যাচারী রাজাকে তার মুখের উপর শুনিয়ে দিয়েছিল তাদের দাবি, চেয়েছিল স্বাধীনতা। সেই অপরাধে শূলে চড়িয়ে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলে ভারতী আর চুপ করে থাকতে পারেনি। সে চায় পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন করতে। চায় অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের একজোট করতে। রাজা জানতে পেরে তাকে বনে নির্বাসন দেয়। সেখানে সে প্রার্থনারত অবস্থায় দেবতার দেখা পায়। দেবতার কাছে সে স্বাধীনতা অর্জন করার তেজ ও শক্তি চাইলে দেবতা বলেন--
তোমার লক্ষ সন্তান যদি সমস্ত অন্তর দিয়ে তাদের স্বাধীনতা কামনা করে, শক্তি, প্রেম-ভালোবাসার করে যদি যোগ্য পূজা, তবেই হবে তোমার সফল-স্বপ্ন, পাবে তারা মানুষের অধিকার।
(‘যে গল্পের শেষ নেই’, মৌমাছি রচনাবলী ১, পৃ-২৬)
আবার ‘মরণ-জয়ী’ গল্পে পাই বিদ্রোহী শিল্পী চিরঞ্জীবকে, যে তার গড়া মূর্তির মধ্য দিয়ে মজুরদের উজ্জীবিত করে রক্তচোষা কারখানা-মালিকের প্রাসাদোপম বাড়িকে গুঁড়িয়ে দেয়। যদিও মজুররা তাদের স্বাধীনতার বীর চিরঞ্জীবকে বা তার মাকে আর কোথাও খুঁজে পায় না। যে চারটি মূর্তি এঁকে সে সাধারণ মানুষকে অত্যাচারী মালিকের বিরুদ্ধে একজোট করে তার প্রথমটিতে দেখা গেল-- মজুরদের ছেলেমেয়েরা সব পাঠশালায় পড়াশুনা করছে। তার নীচে লেখা-- ‘এদের ভালো করে খেতে দাও, লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করো, তবে তো ঘুচবে দুঃখ।’ দ্বিতীয়টিতে ছিল-- হাতে মদের বোতল ধরা এক মজুরের ছবি, যাকে একটি প্রকান্ড সাপ জড়িয়ে ধরেছে। নীচে লেখা-- ‘নেশা ভাং ছেড়ে মানুষের মতো মানুষ হও, নইলে তোমাদের কে বাঁচাবে?’ তৃতীয় ছবিতে তিনজন মানুষ মিলে একটা প্রকান্ড ভারি জিনিস মাথার উপর তুলে ধরেছে। কিন্তু এত পরিশ্রমেও তাদের মুখে ক্লান্তির কোনও ছাপ নেই। তার নীচে লেখা-- ‘সবাই এক হও, দেখবে কোনো জিনিসই ভারি নয়’। চতুর্থ ছবিতে দেখা যাচ্ছে-- একটা প্রকান্ড কারখানায় কাজ করছে উজ্জ্বল একদল মজুর, যাদের চোখে-মুখে আনন্দ ও গৌরবের দীপ্তি। নীচে লেখা-- ‘নিজেদের কারখানা গড়ে নিজেরাই চালাও, পরের পেট ভরালে তো নিজের পেট ভরবে না।’ এই গল্পের মধ্য দিয়ে প্রায় নিঃশব্দেই মৌমাছি ছোট-বড় সবার জন্য কিছু অসাধারণ বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন যা তৎকালীন সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। বর্তমান সময়ের নিরিখেও তা প্রাসঙ্গিক বইকি।
শিশুদের দ্বারা অভিনীত মৌমাছির আর একটি মঞ্চসফল নাটক ‘যারা মানুষ নয়’। শিল্পী সমর দে চিত্রিত এটি একটি মুখোশ নাটক। এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। মৌমাছি-র পরিচালনায় এই নাটকটি দু’ মাসেরও বেশি সময় ধরে রঙমহলে মঞ্চস্থ হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, ড. হরেন্দ্র কুমার মুখোপাধ্যায়, ড. প্রফুল্ল ঘোষ, শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই নাটকের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে মৌমাছিকে ছোটদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসাবে অভিহিত করেছিলেন।
রূপকথার গল্প নিয়ে মৌমাছি-র আর একটি নাটক ‘মায়াময়ূর’ বিশ্বরূপা রঙ্গমঞ্চে সাত মাস ধরে নিয়মিত অভিনীত হয়েছিল। সুন্দর পোষাক, মঞ্চ, আলো-- সবটার পিছনে অনেক টাকা খরচ করে পেশাদারি ঢঙে এটি মঞ্চস্থ হত।
মৌমাছি সম্পর্কে এত কিছু লেখার পরও যে বিষয়ের উল্লেখ না করলে তাঁর সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না তা হল ‘মণিমেলা’ প্রসঙ্গ। এই মণিমেলা-র জন্য বেশি সময় দেবেন বলে বিমল ঘোষ তাঁর লেখায় পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করেন নি। রাজনৈতিক হানাহানি, চক্রান্ত, কোন্দল থেকে শিশুমনকে বিযুক্ত রেখে তিনি তাদের আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তাই সারা দেশজুড়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘মণিমেলা’। ছোটদের চারিত্রিক ও মানসিক গঠনকে আরো বিকশিত করার জন্য বড়দের তত্ত্বাবধানে ছোটদের নেতৃত্বে গঠিত সংগঠন এই ‘মণিমেলা’। আর তাঁর লেখায় তিনি শিশুমনে গেঁথে দিলেন প্রকৃতি ও প্রাণীজগৎকে আপন করে নেওয়ার মন্ত্র। ‘মণিমেলা’ প্রসঙ্গে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ভগীরথ যেমন সগর বংশের ছেলেদের উদ্ধারের জন্য গঙ্গাকে এনেছিলেন, মৌমাছিও তেমনি ছোটোদের মঙ্গলের জন্য মণিমেলার কর্মধারার মধ্যে দিয়ে তাদের প্রাণশক্তিকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের সমস্ত কিশোর-কিশোরী এই আদর্শকে গ্রহণ করবে।’
মণিমেলা-র উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে একটি সভায় বিমল ঘোষ বলেছিলেন,
আমাদের দেশে স্কুল বা কলেজীয় শিক্ষার নামে যে শিক্ষা চলছে তাতে প্রাণপ্রাচুর্যের অভাবে শিশু বা কিশোর সত্তা তার মনের খোরাক পায় না। এটা সবাই আজ উপলব্ধি করেন যে, এই শিক্ষা শিশু ও কিশোরদের ছন্দহীন বিকৃত রুচিসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে সাহায্য করছে মাত্র-- এ অবস্থার পরিবর্তন মণিমেলাকেই করতে হবে। (দেশমণিকার মৌমাছি, পৃ-৬৮)
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী শিক্ষাবিজ্ঞানী না হলেও মৌমাছি প্রকৃতঅর্থেই ছিলেন এক আধুনিকমনস্ক শিক্ষাবিজ্ঞানী যিনি তাঁর ভাবনা ও কর্মকে শিশুকল্যাণে যুগপৎ মিলিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৭ ফেব্র“য়ারি আনন্দমেলা-য় মৌমাছি ‘মণিমেলা’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন। আনন্দমেলা-র এক একজন সদস্য এক একজন মণি। তারা যে সঙ্ঘে এসে মিলিত হবে তাই-ই মণিমেলা। মণিমেলা সারা দেশে, এমনকি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে এর সদস্যসংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মণিমেলা যখন প্রথম গড়ে ওঠে তখন সারা ভারতে শিশু-কিশোর সংগঠন বা আন্দোলন বলে কিছু ছিল না। এ বিষয়ে সারা ভারতে তিনিই পথিকৃৎ। এ কথা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে মৌমাছি ছিলেন প্রাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীনোত্তর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশু-কিশোর সংগঠক। অথচ তাঁর কোনও সঠিক মূল্যায়নই করল না আমাদের এই দুর্ভাগা দেশ।
মণিমেলাকে একটি সুশৃঙ্খল সংগঠনে পরিণত করার জন্য মৌমাছি তাদের কিছু নিয়মের নিগড়ে বাঁধতে চেয়েছিলেন। ‘মণি’দের অবশ্যপালনীয় বারোটি নিয়ম ছিল এ রকম--
১. ‘মণি’ হবে বিশ্বাসের ঠাঁই। ২. ‘মণি’র আনুগত্য চাই। ৩. ‘মণি’ দেবে সেবা শত। ৪. ‘মণি’ হবে না নত। ৫. ‘মণি’ হবে বন্ধু সবার। ৬. ‘মণি’র রবে দয়া অপার। ৭. ‘মণি’ সর্বদাই বাধ্য থাকে। ৮. ‘মণি’ মনকে খুশিই রাখে। ৯. ‘মণি’ বে-হিসাবী নয়। ১০. ‘মণি’ সাফসুতোর রয়। ১১. ‘মণি’ রাখে সাহস শক্তি। ১২. ‘মণি’র থাকে শ্রদ্ধা ভক্তি।
মণিমেলা-র প্রতিটি কেন্দ্রে প্রেয়ার হত, অনুষ্ঠানের কার্যবিবরণী মৌমাছিকে লিখে পাঠাতে হত। সে সব দেখে তিনি মণিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নেতৃত্বের ধারণাকে জাগ্রত করার জন্য তিনি প্রতিটি মণিমেলার যোগ্য ‘মণি’কে ‘মধ্যমণি’ নামে অভিহিত করলেন, যে কিনা নিরপেক্ষ ভাবে দক্ষতার সঙ্গে এই দলকে নেতৃত্ব দেবে। সংঘের প্রতিটি মণি-ই মধ্যমণি হওয়ার স্বপ্ন দেখত। নিয়মানুবর্তিতা ও সত্যবাদিতার নিগড়ে নিজেকে পরিশীলিত করে তোলার এই উন্মাদনা অপূর্ব দক্ষতায় শিশুদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন তিনি। মৌমাছির এই সব কর্মকান্ডে মুগ্ধ সুখলতা রাও লিখলেন, ‘মৌমাছি ভারতের ভবিষ্যৎ সমাজ গড়ে তুলেছেন।’ আর প্রমথনাথ বিশী লিখলেন, ‘মৌমাছি-র মধুচক্রটির কর্মীর দল সংখ্যায় যেমন হাজার হাজার, কাজকর্মেও তেমনি তাদের নানামুখী কৃতিত্ব।’
প্রতি বছর সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বার্ষিক নিখিল ভারত মণিমেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হত। সেখানে সারা ভারত ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে মণিমেলার প্রতিনিধিরা যোগ দিতেন। মণিমেলার সাফল্যে উৎফুল্ল মৌমাছি-র পরিকল্পনায় ১৯৪৮ সালের বার্ষিক সম্মেলনে প্রকাশিত হল মণিমেলা সংগঠনের মুখপত্র ‘মণিমুকুর’। সম্পাদনার দায়িত্ব পেলেন মৌমাছির চিরসঙ্গী বুদ্ধভূতুম(নির্মল চৌধুরী)। কিশোর সম্পাদক নির্বাচিত হলেন ডা. অরুণ ভট্টাচার্য। এই সম্মেলনের পাঁচ দিন ধরে ‘মণিবার্তা’ নামে একটি শিশুদের দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হল। বাংলা ভাষায় এটি প্রথম শিশু-দৈনিক সংবাদপত্র।
ভারতবর্ষের শিক্ষাবিপ্লবের অন্যতম নায়ক ছিলেন মৌমাছি। মণিমেলার বিভিন্ন সম্মেলনে তিনি যে সারদীপ্ত বক্তব্য রাখতেন তা পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাবে শিক্ষার প্রসারে কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। স্কুল প্রসঙ্গে তিনি ১৯৪৮ সালে কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন--
ইস্কুল বলতে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বোঝায় না, শিক্ষার ধারাকেও নয়। কিংবা অভিজ্ঞতাকে উত্তরপুরুষে সঞ্চারিত করবার প্রেরণাকেও নয়। ইস্কুল হচ্ছে সংগঠিত কার্যনিয়ামক প্রথা । এই ব্যবস্থার তিনটি স্তর; প্রথম-- প্রথা, দ্বিতীয়-- কার্য নিয়ন্ত্রণ, তৃতীয়-- সংগঠন। তিনটি স্তরের কোন্টি কোন্ সময়ে আসছে, সে কথা অনুধাবন করে চলতে পারলেই তা থেকেই হবে আধুনিক শিক্ষার প্রস্তুতি!
(দেশমণিকার মৌমাছি, পৃ. ৬২)
মৌমাছি তাঁর শিল্পীসত্তা দিয়ে অনুভব করেছিলেন, ছোটবেলা থেকে শিশুদের মধ্যে পড়াশুনার পাশাপাশি শিল্পচেতনা জাগিয়ে তুলতে পারলে তারা ভবিষ্যতে সুনাগরিক হবার সুযোগ পাবে। তাই মৌমাছি মণিমেলার কর্মসূচির মধ্যে শিল্পকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষামূলক শিল্পচর্চা শিশু ও কিশোরদের সুস্থ, সরল ও আনন্দময় জীবনের সন্ধান দেবে এবং নিয়মানুবর্তিতা ও নম্র হতে সাহায্য করবে।
শিশুদের চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে তিনি ‘মণি পাঠাগার’কে মণিমেলা কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয় হিসাবে স্থান দিয়েছিলেন। প্রাক্তনদের কাছে মৌমাছি প্রায়ই বলতেন--
তোরা ভাবিস না, একদিন সবাই বুঝতে পারবে ‘মৌমাছি’ কেন ‘মণিমেলা’র মধ্যে দিয়ে দেশের শিশু ও কিশোরদের গড়ার এই আয়োজন করেছিল। সেদিন হয়ত আমি এই পৃথিবীতে থাকব না। তবুও আমি তোদের বলছি--দেখবি-- আমার প্রতিদিনের ইচ্ছা, ভাবনা ও জীবনীশক্তির মধ্যে দিয়েই জেগে উঠবে আমার দেশের তরুণদল। সেদিনই সার্থক হবে আমাদের এই ‘মণিমেলা’ গড়া। (দেশমণিকার মৌমাছি, পৃ. ৭৯)
আমাদের দুর্ভাগ্য, মৌমাছি-র সেই সাধের মণিমেলার আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
চার
স্মৃতিচারণে স্বপনবুড়ো(অখিল নিয়োগী) লিখেছিলেন, ‘মৌমাছি যে কত বড়ো শিশুদরদী ও সংগঠক তা সবাই হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন সেদিন, যেদিন ও পৃথিবীতে থাকবে না। তখনই তাঁর পূর্ণ মূল্যায়ন হবে।’ কিন্তু সত্যিই কি তা ঘটেছে? যিনি সারাজীবন শিশুকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করলেন তাঁর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও প্রচারমাধ্যম এত নীরব কেন? পরাধীন ভারতবর্ষের অগণিত শিশু-কিশোর তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা দেশজুড়ে অসংখ্য মণিমেলা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। দেশের এই অসংখ্য মানুষ যাঁরা তাঁর লেখা ও কাজকে প্রশংসা ও নিজ নিজ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, তাঁরাও কি ভেবেছিলেন তাঁদের উত্তরসূরিদের কাছে মৌমাছি এতখানি অবহেলিত হবেন? তবে কি তাঁর রচনা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে? মৌমাছি-র পরিকল্পনায় প্রকাশিত ‘আনন্দমেলা’ দেখে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ চোদ্দ লাইনের এক আশীর্বাণীতে তিনি লিখেছিলেন--
মূর্ত্ত তোরা বসন্তকাল মানবলোকে,
সদ্য নবীন মাধুরীকে আনলি চোখে।
পুরানোকে ঝরিয়ে দেওয়ার মন্ত্র সাধা,
সরিয়ে দিলি জীবনপথের জীর্ণ বাধা।
ফুল ফোটানোর আনন্দগান এলি শিখে,
কোথা থেকে ডাক দিয়েছিস মৌমাছিকে ?
চঞ্চল ঐ নাচের ঘায়ে তরুণ তোরা
উচ্ছলিয়া দিলি ধরার পাগলা-ঝোরা। ...

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ






বিশ্বের বিভিন্ন দেশ


শেয়ার করেছেন
Pranab Kumar Kundu
24 মার্চ 2017 ·
[Worldometers]

Population


 How many Countries are there in the World?

Countries in the World:
195

There are 195 countries in the world today. This total comprises 193 countries that are member states of the United Nations and 2 countries that are non-member observer states: the Holy See and the State of Palestine.
Not in the list

Not included in this total count of 195 countries are:

Taiwan - the United Nations considers it represented by the People's Republic of China
The Cook Islands and Niue, both states in free association with New Zealand which are members of several UN specialized agencies and have been recognized "full treaty-making capacity", but are neither member states nor non-member observer states.
Dependencies (or dependent territories, dependent areas, dependencies) and Areas of Special Sovereignty (autonomous territories)
Other countries recognized by the United Nations as not being self-governing

Where are they located?

Of the 195 countries in the world:

54 countries are in Africa
48 in Asia
44 in Europe
33 in Latin America and the Caribbean
14 in Oceania
2 in Northern America

List of countries

Below is the full table of countries ranked by the most populous and showing current population, share of world population, and land area:
Search:
# Country Population
(2017) World
Share
1 China 1,388,232,693 18.5 %
2 India 1,342,512,706 17.9 %
3 U.S. 326,474,013 4.3 %
4 Indonesia 263,510,146 3.5 %
5 Brazil 211,243,220 2.8 %
6 Pakistan 196,744,376 2.6 %
7 Nigeria 191,835,936 2.6 %
8 Bangladesh 164,827,718 2.2 %
9 Russia 143,375,006 1.9 %
10 Mexico 130,222,815 1.7 %
11 Japan 126,045,211 1.7 %
12 Ethiopia 104,344,901 1.4 %
13 Philippines 103,796,832 1.4 %
14 Viet Nam 95,414,640 1.3 %
15 Egypt 95,215,102 1.3 %
16 DR Congo 82,242,685 1.1 %
17 Iran 80,945,718 1.1 %
18 Germany 80,636,124 1.1 %
19 Turkey 80,417,526 1.1 %
20 Thailand 68,297,547 0.9 %
21 U.K. 65,511,098 0.9 %
22 France 64,938,716 0.9 %
23 Italy 59,797,978 0.8 %
24 Tanzania 56,877,529 0.8 %
25 South Africa 55,436,360 0.7 %
26 Myanmar 54,836,483 0.7 %
27 South Korea 50,704,971 0.7 %
28 Colombia 49,067,981 0.7 %
29 Kenya 48,466,928 0.6 %
30 Spain 46,070,146 0.6 %
31 Ukraine 44,405,055 0.6 %
32 Argentina 44,272,125 0.6 %
33 Sudan 42,166,323 0.6 %
34 Uganda 41,652,938 0.6 %
35 Algeria 41,063,753 0.5 %
36 Iraq 38,654,287 0.5 %
37 Poland 38,563,573 0.5 %
38 Canada 36,626,083 0.5 %
39 Morocco 35,241,418 0.5 %
40 Afghanistan 34,169,169 0.5 %
41 Saudi Arabia 32,742,664 0.4 %
42 Peru 32,166,473 0.4 %
43 Venezuela 31,925,705 0.4 %
44 Malaysia 31,164,177 0.4 %
45 Uzbekistan 30,690,914 0.4 %
46 Mozambique 29,537,914 0.4 %
47 Nepal 29,187,037 0.4 %
48 Ghana 28,656,723 0.4 %
49 Yemen 28,119,546 0.4 %
50 Angola 26,655,513 0.4 %
51 Madagascar 25,612,972 0.3 %
52 North Korea 25,405,296 0.3 %
53 Australia 24,641,662 0.3 %
54 Cameroon 24,513,689 0.3 %
55 Côte d'Ivoire 23,815,886 0.3 %
56 Niger 21,563,607 0.3 %
57 Sri Lanka 20,905,335 0.3 %
58 Romania 19,237,513 0.3 %
59 Burkina Faso 19,173,322 0.3 %
60 Syria 18,906,907 0.3 %
61 Mali 18,689,966 0.2 %
62 Chile 18,313,495 0.2 %
63 Malawi 18,298,679 0.2 %
64 Kazakhstan 18,064,470 0.2 %
65 Zambia 17,237,931 0.2 %
66 Netherlands 17,032,845 0.2 %
67 Guatemala 17,005,497 0.2 %
68 Ecuador 16,625,776 0.2 %
69 Zimbabwe 16,337,760 0.2 %
70 Cambodia 16,076,370 0.2 %
71 Senegal 16,054,275 0.2 %
72 Chad 14,965,482 0.2 %
73 Guinea 13,290,659 0.2 %
74 South Sudan 13,096,190 0.2 %
75 Rwanda 12,159,586 0.2 %
76 Burundi 11,936,481 0.2 %
77 Tunisia 11,494,760 0.2 %
78 Benin 11,458,611 0.2 %
79 Belgium 11,443,830 0.2 %
80 Somalia 11,391,962 0.2 %
81 Cuba 11,390,184 0.2 %
82 Bolivia 11,052,864 0.1 %
83 Haiti 10,983,274 0.1 %
84 Greece 10,892,931 0.1 %
85 Dominican Republic 10,766,564 0.1 %
86 Czech Republic 10,555,130 0.1 %
87 Portugal 10,264,797 0.1 %
88 Azerbaijan 9,973,697 0.1 %
89 Sweden 9,920,624 0.1 %
90 Hungary 9,787,905 0.1 %
91 Belarus 9,458,535 0.1 %
92 United Arab Emirates 9,397,599 0.1 %
93 Tajikistan 8,858,115 0.1 %
94 Serbia 8,776,940 0.1 %
95 Austria 8,592,400 0.1 %
96 Switzerland 8,454,083 0.1 %
97 Israel 8,323,248 0.1 %
98 Honduras 8,304,677 0.1 %
99 Papua New Guinea 7,933,841 0.1 %
100 Jordan 7,876,703 0.1 %
101 Togo 7,691,915 0.1 %
102 Bulgaria 7,045,259 0.1 %
103 Laos 7,037,521 0.1 %
104 Paraguay 6,811,583 0.1 %
105 Sierra Leone 6,732,899 0.1 %
106 Libya 6,408,742 0.1 %
107 Nicaragua 6,217,796 0.1 %
108 El Salvador 6,167,147 0.1 %
109 Kyrgyzstan 6,124,945 0.1 %
110 Lebanon 6,039,277 0.1 %
111 Singapore 5,784,538 0.1 %
112 Denmark 5,711,837 0.1 %
113 Finland 5,541,274 0.1 %
114 Turkmenistan 5,502,586 0.1 %
115 Eritrea 5,481,906 0.1 %
116 Slovakia 5,432,157 0.1 %
117 Norway 5,330,800 0.1 %
118 Central African Republic 5,098,826 0.1 %
119 State of Palestine 4,928,225 0.1 %
120 Costa Rica 4,905,626 0.1 %
121 Congo 4,866,243 0.1 %
122 Ireland 4,749,153 0.1 %
123 Oman 4,741,305 0.1 %
124 Liberia 4,730,437 0.1 %
125 New Zealand 4,604,871 0.1 %
126 Mauritania 4,266,448 0.1 %
127 Croatia 4,209,815 0.1 %
128 Kuwait 4,099,932 0.1 %
129 Moldova 4,054,640 0.1 %
130 Panama 4,051,284 0.1 %
131 Georgia 3,972,532 0.1 %
132 Bosnia and Herzegovina 3,792,759 0.1 %
133 Uruguay 3,456,877 0 %
134 Mongolia 3,051,900 0 %
135 Armenia 3,031,670 0 %
136 Albania 2,911,428 0 %
137 Lithuania 2,830,582 0 %
138 Jamaica 2,813,285 0 %
139 Namibia 2,568,569 0 %
140 Botswana 2,343,981 0 %
141 Qatar 2,338,085 0 %
142 Lesotho 2,185,159 0 %
143 Gambia 2,120,418 0 %
144 TFYR Macedonia 2,083,308 0 %
145 Slovenia 2,071,252 0 %
146 Latvia 1,944,565 0 %
147 Guinea-Bissau 1,932,871 0 %
148 Gabon 1,801,232 0 %
149 Bahrain 1,418,895 0 %
150 Trinidad and Tobago 1,369,157 0 %
151 Swaziland 1,320,356 0 %
152 Estonia 1,305,755 0 %
153 Mauritius 1,281,353 0 %
154 Timor-Leste 1,237,251 0 %
155 Cyprus 1,187,575 0 %
156 Djibouti 911,382 0 %
157 Fiji 902,547 0 %
158 Equatorial Guinea 894,464 0 %
159 Comoros 825,920 0 %
160 Bhutan 792,877 0 %
161 Guyana 774,407 0 %
162 Montenegro 626,250 0 %
163 Solomon Islands 606,215 0 %
164 Luxembourg 584,103 0 %
165 Suriname 552,112 0 %
166 Cabo Verde 533,468 0 %
167 Brunei 434,448 0 %
168 Malta 420,521 0 %
169 Bahamas 397,164 0 %
170 Maldives 375,867 0 %
171 Belize 374,651 0 %
172 Iceland 334,303 0 %
173 Barbados 285,744 0 %
174 Vanuatu 276,331 0 %
175 Sao Tome and Principe 198,481 0 %
176 Samoa 195,743 0 %
177 Saint Lucia 187,768 0 %
178 Kiribati 116,405 0 %
179 St. Vincent & Grenadines 109,895 0 %
180 Grenada 107,850 0 %
181 Tonga 107,797 0 %
182 Micronesia 105,566 0 %
183 Seychelles 97,539 0 %
184 Antigua and Barbuda 93,659 0 %
185 Dominica 73,353 0 %
186 Andorra 68,728 0 %
187 Saint Kitts and Nevis 56,780 0 %
188 Marshall Islands 53,132 0 %
189 Liechtenstein 38,022 0 %
190 Monaco 38,010 0 %
191 San Marino 32,104 0 %
192 Palau 21,726 0 %
193 Nauru 10,301 0 %
194 Tuvalu 9,975 0 %
195 Holy See 801 0 %
Share This!

পাখি ( ছয় )


   পাখি ( ছয় )

  ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু




Vikas Agrawal এতে Indian Birds 
Crested/changeable hawk eagle
Oct 16
Nagjhira wls

চিহ্নিত / changeable হক ঈগল
অক্টোবর 16
Nagjhira wls