বুধবার, ২৩ মে, ২০১৮

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ( দুই )


মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁন্ধী ( দুই )



ঘটনাটা ১৮৯৩ সালের ৭ জুন !
দক্ষিণ আফ্রিকার রেল স্টেশনটির নাম ছিল পিটারমারিৎজবার্গা !
ট্রেনের কামরাটা শুধু শ্বেতাঙ্গদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল !
'হোয়াইটস ওনলি'  বলে বিজ্ঞপ্তিও সাঁটা ছিল !

সেই বিজ্ঞপ্তিকে উপেক্ষা করেই
ওই ট্রেনের প্রথম শ্রেণির সেই কামরায়
উঠে বসেছিলেন
ব্যারিস্টার মোহনদাস করমদাস গাঁন্ধি !

শ্বেতাঙ্গরা গান্ধিজিকে জোর করে
ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছিল !

ব্রাহ্মধর্ম


ব্রাহ্মধর্ম



পূর্বে ব্রাহ্মসভায় উপাসনার প্রচলন ছিল না !
কেবল উপনিষদের শ্লোক পাঠ ও তার ব্যাখ্যা করা হোত !
ব্রাহ্মধর্মও ছিল বেদান্তভিত্তিক !
যা বিবেকানন্দের মন-পছন্দ ছিল !

তবে শ্রীরামকৃষ্ণ
শ্রীবিবেকানন্দকে
ব্রাহ্মধর্মের সংস্পর্শে থাকতে দেন নি !

সেখান থেকে
বিবেকানন্দকে টেনে এনেছিলেন !

বিবেকানন্দকে
রামকৃষ্ণ
শিষ্য বানিয়েছিলেন !



*সুবল/৬৭১।

কাজি নজরুল


             কাজি নজরুল


Pranab Kumar Kundu আরে নজরুল তো হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করেছিলেন ! নজরুলের সন্তানেরা সব মুসলিম হয়েছিলেন ! নজরুল 'কাজি' ছিলেন ! তাঁর ছেলেরাও, নামের আগে কাজি শব্দটি ব্যবহার করতেন ! নজরুলের স্ত্রীকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিন কিনা, আমি বলতে পারব না ! / কাজি মুসলমান বিচারক বা ব্যবস্থাপক ! ওটি মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল ! নজরুল ভারতের নাগরিক ( পশ্চিমবঙ্গের ) ছিলেন। নজরুলের মৃত্যুর আগে, নজরুল, বাংলাদেশে ছিলেন। বাংলাদেশ সরকার, নজরুলের মরদেহ ভারতে ( পশ্চিমবঙ্গে ) ফেরত পাঠায় নি ! জোর করে বাংলাদেশে আটকে রেখেছিল ! ভারত সরকার মিলিটারি পাঠিয়ে, নজরুলের মরদেহ ভারতে নিয়ে আসতে পারত ! কিন্তু তৎকালীন ভারত সরকার তা করেন নি ! আমার মনে হয়, তাতে ভারত সরকারের সম্ভ্রম নষ্ট হয়ে ছিল ! সেটা ভারতের সার্বভৌম কর্তৃত্বের পরিপন্থী ছিল !, ভারতের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল !

ব্রহ্মগুপ্ত







Facebook     29/4/2018



ব্রহ্মগুপ্ত

শেয়ার করেছেন            Pranab Kumar Kundu.


Facebook © 2018


Bijan Banerjee

মাধ‍্যাকর্ষণ শক্তির কথা ভারতের জ‍্যোতির্বিজ্ঞানি ও গণিতবিদ হাজার বছর আগেই বলে গেছেন।

মহান বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের প্রায় এক হাজার বছর আগে ভারতের রাজস্থানের ভিনমাল নামের এক গ্রামে বসে দ্রাবিড় বংশদ্ভুদ এক গণিতবিদ বলেছিলেন, সকল বস্তুই ভূমিতে পতিত হয় কারন এই গ্রহের বৈশিষ্ঠ্যই এই যে সকল ভারী বস্তুসমুহকে ইহা কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে। কি অসম্ভব কথা ! এই অসামান্য গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নাম ছিল ব্রহ্মগুপ্ত। জন্ম ৫৯৮ সালে রাজস্থানের ভিনমাল গ্রামে। ব্রহ্মগুপ্ত হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে আদি ভারতের উজ্জ্বয়িনী নামের এক জায়গায় স্থাপিত এক মানমন্দিরের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সময়েই তিনি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে লিখে ফেলেন তার চারটি গ্রন্থ যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল "ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত" বা "Correctly Established Doctrine of Brahma"(রচনাকাল আনুমানিক ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ)। আল-বিরুণী তার রচিত বই তারিক আল-হিন্দ’এ উল্লেখ করেছেন যে আরব দুনিয়া ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় “ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্তের” মাধ্যমে। আনুমানিক ৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে কঙ্ক নামে উজ্জ্বয়িনীর এক পণ্ডিত বাগদাদে খালিফা আল-মনসুরের দরবারে "ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত" নিয়ে যান। খালিফার অনুরোধে আল-ফাজারি কঙ্কের সাহায্যে তর্জমা করে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন বইটিকে এবং নাম দেন “জিজ আল সিন্ধিন্দ” (সিন্ধিন্দ = সিদ্ধান্ত)। পরে আল-খোয়ারিজমি যখন তার “আল-কিতাব আল-মুখতাসার ফি হিসাব আল-জাবর ওয়া আল-মুকাবালা” লিখেন, তখন এই বইটিকেই (জিজ আল সিন্ধিন্দ) ব্যবহার করেছিলেন। হ্যাঁ, ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্তেই উল্লেখ করা হলো শূণ্য নামের এক ধারণা। প্রথম স্বীকৃতি দেয়া হলো শূণ্যকে একটি সংখ্যা হিসেবে। ব্যবিলনিয়ানরা যেই শূণ্যকে শুধুই দেখত অন্য সংখ্যার বিকল্প হিসেবে অথবা রোমানরা যেই শূণ্যকে দেখত কোনো পরিমাপের ঘাটতি বোঝাতে। ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত’র ১৮তম অধ্যায়ে ব্রহ্মগুপ্ত বলছেন, ১৮.৩০ দুটি ধণাত্নক সংখ্যার সমষ্টি ধণাত্নক, দুটি ঋণাত্নক সংখ্যার সমষ্টি ঋণাত্নক; একটি ধণাত্নক ও একটি ঋণাত্নক সংখ্যার সমষ্টি সংখ্যাদুটির বিয়োগফল; যদি সংখ্যাদুটি একই হয় তখন সেটা হবে শূণ্য। ঋণাত্নক সংখ্যা এবং শূণ্যের সমষ্টি ঋণাত্নক এবং ধণাত্নক সংখ্যা এবং শূণ্যের সমষ্টি ধণাত্নক; এবং দুটি শূণ্যের সমষ্টি শূণ্য। এইরকম আরও কথা ! বীজগণিতে ব্রহ্মগুপ্ত সমাধান করেছেন linear equation, quadratic equation’এর দুটি সমমূল্যের সমাধান, পথ দেখিয়েছেন indeterminate equation সমাধানের। চতুর্ভুজের ক্ষেত্রফল, অ্যারিথমাটিক সিরিজ এবং কিছু বিশেষ ধরণের ডায়োফ্যান্টাইন সমীকরণের সমাধানও তিনি করেছেন। পাই (π) এর গুরুত্বপূর্ণ মানের অনেক কাছাকাছি গিয়েছেন। প্রচুর কাজ করেছেন জ্যামিতিক আকার-আকৃতি নিয়ে। ভারতীয় গণিতশাস্ত্রে পাটি-গণিতা (“mathematics of procedures,” or algorithms) এবং বীজা-গণিতা (“mathematics of seeds,” or equations) এর ভিত্তি তো তার হাত ধরেই। । তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় মাত্রার নির্ণেয় ও অনির্ণেয় সমীকরণ সমাধানের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। বৃত্তস্থ চতুর্ভূজের নানা ধর্ম সম্বন্ধে তিনি যেসব প্রতিজ্ঞা আবিষ্কার করেছিলেন তা তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। বর্তমানে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ফ্রাস্টামের আয়তন নির্ণয়ের পদ্ধতি শেখানো হয়। পিরামিডের ফ্রাস্টামের আয়তন নির্ণয়ে যে সূত্রটি ব্রহ্মগুপ্ত আবিষ্কার করেছিলেন সেটা হল,

v = 1/3 h (S21 + S22 + S1S2), যেখানে

S1 , S2 = ফ্রাস্টামের বাহুদ্বয়ের দৈর্ঘ্য এবং h = উচ্চতা। পাটীগণিত ও বীজগণিতেও ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর পান্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি বীজগণিতের নাম দিয়েছিলেন ‘কুট্টক গণিত’ সংক্ষেপে ‘কুট্টক’। ‘বীজগণিত’ নামটা অবশ্য প্রথম ব্যবহার করেছিলেন পৃথূদকস্বামী (৮৬০ খ্রিস্টাব্দে)।

ব্রহ্মগুপ্ত ‘শূন্য’ কে সংখ্যা হিসেবে গণ্য করতেন। 0 – এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন a – a = 0, আর 0 – এর ধর্ম হিসাবে তিনি বলেন, 0 + 0 = 0, 0 – 0 = 0, a x 0 = 0 এবং 0/0 = 0 । যদিও তাঁর শেষ সিদ্ধান্তটি (0/0 = 0) ভুল ছিল।

জ্যামিতিতে ব্রহ্মগুপ্তের শ্রেষ্ঠ অবদান বৃত্তস্থ চতুর্ভুজের কর্ণের দৈর্ঘ্য নির্ণয়। এই দৈর্ঘ্য নির্ণয় করতে গিয়ে তিনি চতুর্ভূজের বাহু সমূহের দৈর্ঘ্যের যে সম্পর্ক নির্ণয় করেছিলেন তা হল :

বৃত্তস্থ চতুর্ভূজের বাহু চারটি যদি a, b, c, d হয় এবং কর্ণদ্বয়ের দৈর্ঘ্য m ও n হলে, ব্রহ্মগুপ্ত সূত্র অনুযায়ী আমরা পাব,

m2 = (ab+cd) (ac+bd)/ (ad+bc)

এবং n2 = (ac+bd) (ad+bc)/ (ab+cd)

বৃত্তস্থ চতুর্ভূজের ক্ষেত্রফল নির্ণয়েও তিনি একটি সূত্র দেন :

a, b, c, d বৃত্তস্থ চতুর্ভূজের বাহু এবং 2S চতুর্ভূজটির পরিসীমা অর্থাৎ,

(2S = a+b+c+d) হলে, চতুর্ভূজটির ক্ষেত্রফল

= √(S-a) (S-b) (S-c) (S-d) বর্গ একক।

শেষ বয়সে ব্রহ্মগুপ্ত আরও একখানি বই লেখেন। বইটির নাম খন্ডখাদ্যক। এছাড়াও একখানি বইয়ের কথা জানা যায়, নাম বিল্লমালাচার্য।৬৬৫ সালে এই মহান গনিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত পরোলোক গমন করেন।

পাণিনি


      পাণিনি


      শেয়ার করেছেন          প্রণব কুমার কুণ্ডু !


#বেদের ভাষা থেকে পানশালার হাঁকডাকও আছে তাঁর ব্যাকরণে
তিনি পাকিস্তানের তক্ষশীলার বাসিন্দা। কোন সময়ের লোক, তা নিয়ে মতভেদ প্রবল। কিন্তু তাঁর হাত থেকেই জন্ম নিল সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ। পাণিনি সংস্কার করেছিলেন বলেই তো এ ভাষা সংস্কৃত!
দেশ সলাতুর। নাম পাণিনি। মা দাক্ষী। বাবার অথবা গোত্রের নাম পাণিন। এর বেশি কিছু জানা যায় না সারা পৃথিবীর সর্বকালের অত্যাশ্চর্য ব্যাকরণের রচয়িতা পাণিনির সম্পর্কে, আমেরিকার গঠনতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্বের জনক লিওনার্দ ব্লুমফিল্ডের মতে যিনি ‘মনুমেন্ট অব হিউম্যান ইনটেলিজেন্স’, এবং যাঁর ভাষাদর্শনে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন আধুনিক গঠনতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্ব আর সেমিয়োটিক্স–এর পথিকৃৎ ফার্দিনান্দ দ্য সাস্যুর ।
কে এই পাণিনি আর কেমন-ই বা তাঁর সেই ‘অত্যাশ্চর্য’ ব্যাকরণ, যা নিয়ে এত মাতামাতি এই একবিংশতি শতকেও? এ বিষয়ে আলোচনা একটু গোড়া থেকে শুরু করা ভালো।
প্রাচীন ভারতের প্রায় সমস্ত শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যের রচনাকাল নিয়েই বিতর্কের যেমন শেষ নেই, পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ও তার ব্যতিক্রম নয়। খ্রিস্টজন্মের মোটামুটি চারশো বছর আগে পাণিনির জন্ম হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এ-মতের বিপক্ষেও অবশ্য কিছু কম যুক্তি নেই, আর সেগুলির মধ্যে কয়েকটি আবার নেহাত ফেলনাও নয়, সেগুলি গ্রহণ করলে আরও পিছিয়ে যাবে পাণিনির কাল।
বেদের যুগের শেষ স্তরে পাণিনির আবির্ভাব; তাঁর অন্তত দেড় হাজার বছর আগে থেকে যে বৈদিক সাহিত্য সঙ্কলিত হতে শুরু করে, তার ভাষা পাণিনির সময়ে আমজনতার কাছে ক্রমশ অতিপ্রাচীন এবং দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে থাকে— যেমনটা হাজার বছরের পুরনো চর্যাপদের ভাষা আধুনিক বাংলাভাষীর কাছে হয়েছে। বেদের ভাষার ব্যাপারটা অবশ্য অনেক গুরুতর ছিল কারণ সুবিপুল বৈদিক সাহিত্য ছিল সম্পূর্ণই শ্রুতিনির্ভর, অর্থাৎ শুধুমাত্র শুনে শুনে তা মনে রাখতে হত। বৈদিক সাহিত্য হল আর্যসংস্কৃতির ভিত্তিস্তম্ভ, তাই তাকে অতি যত্নে রক্ষা করাটা ধর্ম বলে মনে করা হত। কোনও ভাবে বেদের একটুও বিকৃতি ঘটতে দেওয়া যাবে না, তার একটি বর্ণ, মাত্রা বা অক্ষরও হারিয়ে গেলে চলবে না। এই প্রয়োজনীয়তা থেকে জন্ম নিল বেদাঙ্গ সাহিত্য। বৈদিক সাহিত্য যে কত বিশাল, তা এটুকু বললেই পরিষ্কার হবে যে চার বেদের মধ্যে শুধু ঋগ্বেদ-সংহিতার মন্ত্রসংখ্যাই হল প্রায় সাড়ে দশ হাজার, এর পরে আছে তার ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ, সবই আবার একাধিক শাখায়। এ হেন বেদকে সম্পূর্ণ অলিখিত অবস্থায় সংরক্ষণ করতে হলে বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পূর্ণ বিকাশ আমরা বেদাঙ্গগুলির মধ্যে দেখি। অঙ্গ বা অবয়ব যেমন অঙ্গী বা প্রাণধারীকে বাঁচিয়ে রাখে আর রক্ষা করে, সে রকম এই বেদাঙ্গগুলিও বেদের রক্ষাকবচের কাজ করেছে।
ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, শিক্ষা, কল্প, নিরুক্ত, ছন্দ, ব্যাকরণ আর জ্যোতিষ— এই ছয়টি বেদাঙ্গ কী অসাধারণ কৌশলে ধরে রেখেছে বেদের ত্রিমূর্তি— শব্দ, অর্থ, উচ্চারণ। এ ছাড়াও, বেদের প্রধান উপযোগ যে যজ্ঞকর্মে, তাকেও পুঙ্খানুপুঙ্খ ধরে রেখেছে কল্প নামে বেদাঙ্গটি। বেদের মতো বেদাঙ্গগুলিও কিন্তু লিখিত হত না, তাদেরকেও ধারণ করতে হত স্মৃতিতেই। বিশালাকৃতির বেদ মুখস্থ করার পর বেদাঙ্গগুলির জন্য মস্তিষ্কে আর বেশি স্থান রাখা মুশকিল, বোধহয় এই রকম একটা ধারণা থেকেই বেদাঙ্গগুলিকে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে রচনা করার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছিল; যার ফলে গদ্য ও পদ্য, সাহিত্যরচনার এই দুই প্রচলিত মাধ্যমের অতিরিক্ত এক নতুন ধারার উদ্ভব ঘটে— যার নাম সূত্রসাহিত্য।
সব বেদাঙ্গসূত্রের মধ্যে সেরা সূত্র হল পাণিনির ব্যাকরণ ‘অষ্টাধ্যায়ীসূত্র’। কত বড় বই এই অষ্টাধ্যায়ী তা দেখা যাক: এর আটটি অধ্যায়ে চারটি করে পরিচ্ছেদ বা পাদ, প্রতি পাদে রয়েছে শতাধিক সূত্র, এ ভাবে সব মিলিয়ে মোট ৩৯৯৫টি সূত্র। পর পর লিখলে একটা এক ফর্মার লিটল ম্যাগাজিনে ধরে যাবে গোটা অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ! কিন্তু সে বই আজও বিশ্বের পণ্ডিতদের বিস্ময়। এতে রয়েছে বেদের সেই প্রাচীন ভাষার ব্যাকরণ, অর্থাৎ সে ভাষার শব্দগুলির বিভিন্ন ধ্বনির উচ্চারণ, সন্ধির ফলে তাদের নানান বিকার ও পরিবর্তন (ধ্বনিতত্ত্ব), শব্দের গঠনপদ্ধতি-বিশ্লেষণ (রূপতত্ত্ব), যার মধ্যে আছে শব্দরূপ, ধাতুরূপ, প্রত্যয়, সমাস প্রভৃতির আলোচনা, এবং বাক্যে পদগুলির পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নির্ণয়, যাকে আমরা ‘কারক’ বলে জানি— ইত্যাদি বিষয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ।
মজার কথা এই যে, পাণিনির ব্যাকরণ বেদের অঙ্গ হলেও সেটি কিন্তু তাঁর সময়ে প্রচলিত লৌকিক ভাষারও ব্যাকরণ। এক কথায়, পাণিনি একই সঙ্গে দুটি ভাষার জন্যে ব্যাকরণ রচনা করেছেন, তারা হল যথাক্রমে ‘ছন্দস্‌’ অর্থাৎ বৈদিক সংস্কৃত এবং ‘ভাষা’, যেটি ছিল তাঁর সময়ে প্রচলিত লোকব্যবহারের ভাষা অর্থাৎ লৌকিক সংস্কৃত। প্রাচীন ভারতের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, আইন-কানুন, মামলা-মোকদ্দমা, ধর্ম-কর্ম ইত্যাদি সব কিছুর প্রধান মাধ্যম ছিল এই সংস্কৃত। অবশ্য ভাষা হিসেবে সংস্কৃত নামটির প্রচলন হয় পাণিনির অনেক পরে। প্রাচীন স্তরে বৈদিক ও পরবর্তীতে লৌকিক বলে পরিচিত এই ভাষার ব্যাকরণ পাণিনি এমন নির্দিষ্ট করে বেঁধে দিয়েছিলেন যে প্রায় আড়াই হাজার বছরেও সে ভাষার মৌলিক কোনও পরিবর্তন হয়নি।
পাণিনি এক আশ্চর্য কৌশলে গেঁথেছেন সূত্রগুলিকে, যার ফলে সব চেয়ে কম শব্দে বোঝানো গিয়েছে ভাষা-বিষয়ক সর্বাধিক নিয়ম, এই কৌশলে প্রধান হাতিয়ার তাঁর এক বিশেষ সাংকেতিক ভাষা, আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকরা যাকে বলছেন পাণিনির অধিভাষা বা মেটাল্যাংগোয়েজ। যেমন ধরুন একটি সূত্রে ব্যবহৃত একটি শব্দ পর পর বেশ কয়েকটি সূত্রেই প্রয়োগ করতে হবে, কিন্তু প্রতি বার তার পুনরাবৃত্তি না করে ধরে নেওয়া হয় যে সেটি আগের সূত্রটি থেকেই পরের সূত্রগুলিতে চলে আসছে, এ ব্যবস্থার নাম হল অনুবৃত্তি। পাণিনির ব্যাকরণ দাঁড়িয়ে আছে বর্ণবোধক চোদ্দোটি প্রত্যাহার সূত্রের ওপরে, যেগুলি ‘শিবসূত্র’ নামে প্রসিদ্ধ। এগুলি পাণিনির নিজের রচনা বলেই অনুমান, যদিও প্রাচীন কিংবদন্তি বলে যে এগুলির উৎপত্তি নাকি শিবের ঢক্কানিনাদ থেকে। এগুলি আসলে সংস্কৃতের যাবতীয় স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনি, এমন সুকৌশলে সাজানো যে বীজগণিতের (a+b)2 ফর্মুলার মতো অতি সংক্ষেপে জুগিয়ে দেয় অনেক বড় তথ্য। যেমন, ‘অচ্‌’ বললে বোঝায় যাবতীয় স্বরবর্ণকে, ‘হল্‌’ হল সমস্ত ব্যঞ্জন, আর ‘অল্‌’ মানে সব স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ একত্রে। এই অধিভাষার জোরে ‘ইকো যণচি’— এইটুকু পাণিনিসূত্রের মানে দাঁড়ায় “ই, উ, ঋ, ৯ – এই চারটি বর্ণের পরে যদি এরা নিজেরা ছাড়া অন্য কোনও স্বরবর্ণ থাকে তবে তারা যথাক্রমে য্‌, ব্‌, র্‌, ল্‌ হয়ে যায়”; এরই ফল হিসেবে আমরা পাই অতি+অন্ত = অত্যন্ত, ইতি+আদি = ইত্যাদি জাতীয় সন্ধি।
আজকের যুগের ভাষাতাত্ত্বিকদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে পাণিনির ব্যাকরণের নির্মাণকৌশল। দেখা গিয়েছে কম্পিউটার যে-কোনও ভাষা শেখার জন্যেই সব থেকে বেশি গ্রহণীয় মনে করছে পাণিনির কৌশলকে, তাঁর ভাষা-বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে। প্রাচীন ভারতে পাণিনির ব্যাকরণ ভাষাচর্চার একটা ধারা তৈরি করেছিল, যার ফলে পরবর্তী কালে তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাত্যায়ন পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ব্যাকরণকে আরও সম্পূর্ণতা দিতে রচনা করলেন ‘বার্ত্তিক’, এবং তাঁরও প্রায় দেড়শো বছর পরে পতঞ্জলি লিখলেন ‘মহাভাষ্য’। এই তিন বৈয়াকরণের গ্রন্থ সম্মিলিতভাবে ‘ত্রিমুনি ব্যাকরণ’ নামে পরিচিত।
তক্ষশিলার অধিবাসী ছিলেন পাণিনি, এমনটাই প্রচলিত মত। আর কে না জানে, অধুনা পাকিস্তানের সেই জায়গাটিতে ছিল প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। সপ্তম শতকে ঝুয়ান ঝাং তাঁর বিবরণে উল্লেখ করেছেন, তিনি নাকি লাহুরে (লাহৌর) পাণিনির মূর্তি দেখেছেন। আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা পাণিনির, তাঁর কান এড়িয়ে যায়নি হাটে আসা মানুষদের কথা, পানশালার খদ্দেরদের হাঁক অথবা বিপাশা নদীর উত্তরের আর দক্ষিণের বুলির মধ্যে আঞ্চলিক টানের তফাত। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে তাই তখনকার ভাষাই শুধু নয়, ধরা পড়েছে সেই যুগের সমাজ, সাধারণ মানুষ আর তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ছবিও।
শেষ কালে বলতে চাই সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘বৈয়াকরণ’ নামে একটি অসাধারণ গল্পের কথা, যেখানে একটি মেয়ে-স্কুলের সংস্কৃতের বৈয়াকরণ পণ্ডিত এক বৃদ্ধ মৈথিলি ব্রাহ্মণ গভীর আত্মসংকটে পড়ে তাঁর আজীবনের সঙ্গী পাণিনির ব্যাকরণ দিয়েই করেন নিজের মনঃসমীক্ষণ, এবং শিউরে ওঠেন সদাচারের আড়ালে ঢাকা নিজের কামাতুর পুরুষমুখটি দেখে। পাণিনির ব্যাকরণের এমন প্রয়োগ কে-ই বা ভাবতে পেরেছিল?
#collected*