সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

সাংখ্যতত্ত্ব ছয়


সাংখ্যতত্ত্ব ছয়
অ্যাডমিন
 
3 ঘণ্টা
 সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
ষষ্ঠ পর্ব
★★★সাংখ্যমতে মোক্ষ বা কৈবল্য★★★
সাংখ্যমতে, আত্মা বা পুরুষে যে সুখ–দুঃখ–মোহাদিরূপ প্রাকৃতিক ধর্ম উপচারিত হয়, তার তিরোধানই হলো মুক্তি। এই মুক্তি–প্রাপ্তিকে সাংখ্য দর্শনে কৈবল্য–প্রাপ্তি বলা হয়, এবং এই কৈবল্যই সাংখ্য দর্শনে পরম পুরুষার্থ।
.
মহর্ষি কপিল বা অন্যান্য সাংখ্যাচার্যগণ ত্রিতাপ দুঃখভোগকে আত্মার বন্ধনের ফল বলেছেন। এই ত্রিতাপ দুঃখ কী ? সকল জীবই এ সংসারে আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক– এই ত্রিবিধ দুঃখভোগ করে। শারীরিক ও মানসিক দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক দুঃখ। বজ্রপাত, ভূকম্পন প্রভৃতি দৈব–দুর্বিপাক বশত জীবের যে দুঃখ হয়, তাকে বলে আধিদৈবিক দুঃখ। মানুষ ও অন্যান্য পশুপক্ষিজনিত প্রাপ্ত দুঃখকে বলা হয় আধিভৌতিক দুঃখ। মোটকথা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীব এই ত্রিবিধ দুঃখের কবলে পতিত হয়। এই যে দুঃখের কবলে পতিত হওয়া, সাংখ্যমতে একেই পুরুষের বদ্ধাবস্থা কিংবা সংসারদশা বলা হয়েছে।
.
এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে মানুষ যুগে যুগে নানা উপায় খুঁজেছে, উদ্ভাবন করেছে। ঔষধ সেবনে রোগাদিজনিত দুঃখ থেকে সাময়িকভাবে পরিত্রাণ পাওয়া গেলেও তা দিয়ে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় না। সুষুপ্তিতে যে দুঃখের নিরসন হয়, তাও আত্যন্তিক নয়। পুনর্জাগরণে পুনরায় সেই দুঃখভোগ শুরু হয়। যাগ–যজ্ঞাদি ক্রিয়া এবং দৃষ্ট ও লৌকিক কোন উপায়ই দুঃখের আত্যন্তিক বা চির নিবৃত্তি দিতে পারে না। বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ে এই দুঃখের চির নিবৃত্তির উপায় খোঁজা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সাংখ্য দার্শনিকরা তত্ত্বজ্ঞানকেই মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে করেন। এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির উপায় নির্দেশ করতে দ্বিতীয় কারিকায় বলেছেন–
‘…ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ’–
অর্থাৎ, ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী চিরনিবৃত্তি হয়।
.
‘ব্যক্ত’ হলো পরিণামপ্রাপ্ত সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থসমূহ, ‘অব্যক্ত’ হলো প্রকৃতি এবং ‘জ্ঞ’ হলো পুরুষ বা আত্মা। এই ত্রয়ের বিবেকজ্ঞান বা ভেদজ্ঞানই সর্ববিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ উপায়। অপরদিকে ব্যক্ত, অব্যক্ত এবং জ্ঞ– এই ত্রয়ের অবিবেক বা অভেদজ্ঞানই জীবের সর্ববিধ বন্ধনজনিত দুঃখের হেতু।
.
সাংখ্যমতে পুরুষ স্বরূপত নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত স্বভাব। সুতরাং স্বরূপত পুরুষ বদ্ধ হয় না, আবার মুক্তও হয় না। বুদ্ধির ধর্ম যখন পুরুষে প্রতিফলিত হয়, তখন অবিদ্যাবশত পুরুষ বা আত্মা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এক বলে মনে করে। এর ফলে মনের বৃত্তিগুলি যথা– সুখ, দুঃখ ও মোহকে বিবেকজ্ঞানহীন পুরুষ নিজের মনে করে অর্থাৎ নিজেকে কর্তা বা ভোক্তা বলে মনে করে। পুরুষ বা আত্মার এই অবস্থার নাম বন্ধনদশা। এর ফলে ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির সুখ–দুঃখাদি পুরুষে আরোপিত হয়। পুরুষ যখন অবিদ্যামুক্ত হয়ে চৈতন্য স্বরূপে অবস্থান করে, তখন সেই পুরুষের অবস্থাকে বলা হয় মুক্তাবস্থা।
.
সাংখ্যমতে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞানই মুক্তির পথ। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা সূক্ষ্মতম ভেদ লক্ষিত হয়। ক্ষণে যে পরিণাম হয়, তাই সূক্ষ্মতম ভেদ। বিবেকজ্ঞান এই সূক্ষ্মতম ভেদের জ্ঞান। ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ বা পুরুষের বিবেকজ্ঞান এই ত্রিতত্ত্বেও স্বরূপকে প্রকাশ করে। এর ফলে পুরুষের স্ব–স্ব রূপে অবস্থান হয় এবং পুরুষ কৈবল্য বা মোক্ষ লাভ করে। পুরুষের আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠাই হলো কৈবল্য।
.
অপরোক্ষ বিবেকজ্ঞানের দ্বারা পরমপুরুষার্থ কৈবল্য লাভ হয় বলে এই জ্ঞান ঐকান্তিক জ্ঞান। আবার সকল দুঃখের নিবর্তক বলে এই জ্ঞান আত্যন্তিক। যমনিয়মাদি সাধ্য বলে এই জ্ঞান শুদ্ধ এবং এর দ্বারা লব্ধ মুক্তি অবিনাশী বলে এই জ্ঞান অক্ষয়। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের বিবেকজ্ঞান উৎপন্ন হলে বুদ্ধিধর্ম পুরুষ থেকে অপসৃত হয়। এ অবস্থায় পুরুষের সুখ, দুঃখ ও মোহ কিছুই অনুভূত হয় না। আত্মার এই শুদ্ধাবস্থাই সাংখ্যশাস্ত্রে মোক্ষাবস্থা বা কৈবল্যাবস্থা বলে পরিচিত।
.
তবে সাংখ্যমতে জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি নামে দ্বিবিধ মুক্তিই স্বীকৃত। দেহের বর্তমানে বন্ধনের মূলোচ্ছেদ হলে জীবের যে মুক্তিলাভ হয়, তাই জীবন্মুক্তি। জীবন্মুক্তিতে জীবের সূক্ষ্ম সংস্কার বর্তমান থেকে যায়। দেহের বিনাশে এই সংস্কারের বিনাশ হয়। সকল প্রকার সংস্কারমুক্ত পুরুষের স্বরূপে অবস্থানই বিদেহমুক্তি বা পরম কৈবল্যাবস্থা।
.
ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলি মোক্ষ বা মুক্তিকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করলেও মুক্তির স্বরূপ সম্পর্কে তারা একমত হতে পারেননি। সাংখ্য, বৌদ্ধ ও বেদান্ত দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে, মোক্ষ প্রাপ্তির পর জীবের কোন দুঃখ থাকে না। কিন্তু সাংখ্য দার্শনিকরা আরো মনে করেন যে, মোক্ষ বা মুক্তি কোনরূপ সুখ অনুভূতিরও অবস্থা নয়। কারণ সুখ ও দুঃখ আপেক্ষিক শব্দ। যেখানে দুঃখ নেই সেখানে সুখ থাকতে পারে না। সাংখ্যমতে মোক্ষের দুটি দিক। একদিকে মোক্ষ বা মুক্তি বলতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বোঝায়। অন্যদিকে সাংখ্য দার্শনিকরা মোক্ষ বা মুক্তি সুখ–দুঃখের অতীত এক তৃতীয় অবস্থাকে মনে করেন।
.
এই মতে, মুক্তাবস্থায় পুরুষের দৃষ্টি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট হয়। বুদ্ধির সঙ্গে সে আর নিজেকে অভিন্ন বলে মনে করে না। এই অবস্থাকে বোঝাতে গিয়ে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ পঁয়ষট্টি নম্বর কারিকায় বলেন–
‘তেন নিবৃত্তপ্রসবামর্থবশাৎ সপ্তরূপবিনিবৃত্তাম্ ।
প্রকৃতিং পশ্যতি পুরুষঃ প্রেক্ষকবদবস্থিতঃ স্বস্থঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৬৫)
অর্থাৎ : সেই তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা পুরুষ–প্রকৃতি বিবেকজ্ঞান–রূপ সিদ্ধ হওয়ায় স্ব–স্বরূপে অবস্থিত পুরুষকে তখন সপ্তভাবশূন্যা প্রকৃতি স্পর্শ বা প্রভাবিত করতে পারে না এবং দর্শকের ন্যায় পুরুষ তখন উদাসীন, অসঙ্গ ও নির্বিকার।
.
বিবেকজ্ঞান যুক্তির দ্বারা বা গ্রন্থাদি দ্বারা প্রামাণ্য নয়। আত্মাকে সাক্ষাৎ উপলব্ধি করতে হলে দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন। বিবেকজ্ঞান, সাধনবল ও সাংখ্যোক্ত পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের জ্ঞানের দ্বারা জীব এইরূপ মোক্ষাবস্থা লাভ করে।
(চলবে…)

সাংখ্যতত্ত্ব পাঁচ


সাংখ্যতত্ত্ব পাঁচ

অ্যাডমিন
 
সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
পঞ্চম পর্ব
★★★★সাংখ্যমতে জগতের অভিব্যক্তি★★★
সাংখ্য দার্শনিকরা হলেন পরিণামবাদী। তাঁদের মতে জগৎ হলো প্রকৃতির পরিণাম। প্রকৃতি হলো জগতের উৎপত্তির প্রতি উপাদান কারণ। অর্থাৎ, জগৎ ও জগতের প্রত্যেক বস্তু ও বিষয়ের মূল কারণ প্রকৃতি। বলা হয়, সৃষ্টির পূর্বে জগৎ প্রকৃতির মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ হওয়ার ফলে জগতের অভিব্যক্তি হয়। সাংখ্যমতে একেই জগতের সৃষ্টি বলা হয়। এই সৃষ্টির পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াও সাংখ্যশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে।
.
কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, পুরুষ এবং প্রকৃতির সম্বন্ধ কিভাবে সম্ভব ? কারণ, সাংখ্যমতে পুরুষ হলো চেতন এবং অকর্তা। অন্যদিকে প্রকৃতি হলো অচেতন এবং কর্তা। ফলে পুরুষ এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধ ধর্ম থাকায় উভয়ের ভেদ স্পষ্ট।
এর উত্তরে বলা হয়, প্রকৃতি নিজেকে ভোগ করতে পারে না। আবার ভোক্তা না থাকলে ভোগ্য পদার্থের সার্থকতা নেই। পুরুষই ভোক্তা। এইজন্য প্রকৃতিকে পুরুষের প্রতীক্ষায় থাকতে হয়। যদিও সে পুরুষ থেকে ভিন্ন বা বিরুদ্ধ ধর্মবিশিষ্ট, তথাপি পুরুষই তার সার্থকতা সম্পাদন করে বলে সে পুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হতে ইচ্ছুক হয়।
.
এখানেও প্রশ্ন আসে, সাংখ্যমতে পুরুষ যেহেতু অসঙ্গ এবং উদাসীন, সেহেতু সে প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হবে কিভাবে ?
উত্তরে সাংখ্য দার্শনিকরা বলেন, পুরুষ কৈবল্য বা মুক্তির জন্য প্রকৃতি বা প্রধানের অপেক্ষা করে। সাংখ্য দর্শনে আধিদৈবিক, আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক– এই ত্রিবিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকেই কৈবল্য বা মুক্তি বলা হয়।
.
কিন্তু প্রশ্ন হলো, পুরুষ যেহেতু নিত্যমুক্ত, সেহেতু কৈবল্যের জন্য তার পক্ষে প্রকৃতির জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন কী ?
উত্তরে বলা হয়, প্রকৃতি বা প্রধান পুরুষের ভোগ্য। অনাদিকাল হতে প্রধানের থেকে নিজের ভেদ বুঝতে না পারার জন্য আত্মা বা পুরুষ প্রকৃতি বা প্রধানের ত্রিবিধ দুঃখকে নিজের দুঃখ বলে মনে করে চলেছে। ফলে পুরুষ কৈবল্যের জন্য ভীষণভাবে আগ্রহশীল হয়।
.
উল্লেখ্য যে, সাংখ্যমতে প্রকৃতি পুরুষের অপেক্ষা করে এবং পুরুষ প্রকৃতির অপেক্ষা করে, যেহেতু উভয়ের মধ্যে উপকার্য–উপকারভাব সম্বন্ধ আছে। পুরুষ প্রকৃতির উপকার করে প্রকৃতির সার্থকতা সম্পাদন করে। পাশাপাশি প্রকৃতির স্বরূপস্থিত সুখ–দুঃখ ভোগ করে। প্রকৃতি তখন কৃতার্থ হয়। আবার প্রকৃতি পুরুষের উপকার করে। কিভাবে ? সুখদুঃখময়ী হয়েও সে পুরুষকে সুখের স্পর্শ অপেক্ষা অধিক দুঃখের তাপ প্রদান করে। তার ফলে পুরুষের কৈবল্যলাভের আকাক্সক্ষা প্রবল হয়। এই উপকার্য–উপকারভাবটি বোঝাবার জন্য সাংখ্যকারিকাকার একবিংশ কারিকায় পঙ্গু এবং অন্ধ ব্যক্তির অপেক্ষার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন–
‘পুরুষস্য দর্শনার্থং কৈবল্যার্থং তথা প্রধানস্য।
পঙ্গ্বন্ধবদুভয়োরপি সংযোগস্তৎকৃতঃ সর্গঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২১)
অর্থাৎ : পুরুষের মুক্তির জন্য এবং প্রধানের (তথা মূল প্রকৃতির) ভোগের জন্য পঙ্গু ও অন্ধের মতো উভয়ের (অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ হয়। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগবশত মহদাদি ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি হয়।
.
পঙ্গুর জ্ঞান আছে, ক্রিয়া নাই। অন্যদিকে অন্ধের ক্রিয়া আছে, জ্ঞান নাই। অন্ধ যদি পঙ্গুকে বহন করতে ইচ্ছুক হয় এবং পঙ্গু যদি অন্ধকে চালনা করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে উভয়েই গন্তব্যস্থানে উপস্থিত হতে পারে। অনুরূপভাবে পরস্পরের উপকারের জন্যই পুরুষ এবং প্রকৃতির সংযোগ হয়ে থাকে। এজন্যেই সাংখ্যকারিকার ছাপ্পান্ন নম্বর কারিকায় বলা হয়েছে–
‘ইত্যেষ প্রকৃতিকৃতো মহাদাদিবিশেষভূতপর্য্যন্তঃ।
প্রতিপুরুষবিমোক্ষার্থং স্বার্থে ইব পরার্থ আরম্ভঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৫৬)
অর্থাৎ : এইভাবে মহৎ থেকে (শুরু করে) পঞ্চমহাভূত পর্য্যন্ত এই যে সৃষ্টি তা প্রত্যেক পুরুষের মুক্তির জন্য প্রকৃতি নিজের প্রয়োজনের মতই পরের (অর্থাৎ পুরুষের) প্রয়োজনে সৃষ্টি করে।
.
কৈবল্যপিপাসু পুরুষের উপকারের জন্যই প্রকৃতি মহৎতত্ত্বরূপে পরিণত হয়। মহৎতত্ত্ব হলো প্রকৃতির প্রথম পরিণাম এবং জগতের যাবতীয় বস্তুর বীজ।
.
তবে তার আগে প্রশ্ন হলো, প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ ভোগ ও কৈবল্যের হেতু হলে মহৎ প্রভৃতি সৃষ্টির প্রতি হেতু কে ?
উত্তরে বলা হয়, ভোগ ও কৈবল্য– এই দুটি হলো পুরুষার্থ। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগ হলেই ভোগ ও কৈবল্য হয় না। প্রকৃতির পরিণামবশত বুদ্ধি বা মহৎ প্রভৃতি সৃষ্টি হলে তবেই ভোগ সম্ভব হয়। অন্তঃকরণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত সুখ–দুঃখই ভোগ্য হয়। সুতরাং ভোগের জন্য মহৎ প্রভৃতির সৃষ্টি প্রয়োজন। আবার জ্ঞান হলো অন্তঃকরণের বৃত্তি। তত্ত্বজ্ঞান বা পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদের জ্ঞান না হলে কৈবল্য হয় না। সুতরাং কৈবল্যের জন্যও মহৎ প্রভৃতি সৃষ্টি প্রয়োজন। তাই সাংখ্যকারিকার সাঁইত্রিশ নম্বর কারিকায় বলা হয়েছে–
‘সর্ব্বং প্রত্যুপভোগং যস্মাৎপুরুষস্য সাধয়তি বুদ্ধিঃ।
সৈব চ বিশিনষ্টি পুনঃ প্রধানপুরুষান্তরং সূক্ষ্মম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৩৭)
অর্থাৎ : যেহেতু মহৎ বা বুদ্ধি সংসারদশায় পুরুষের সমস্ত ভোগ সাধন করে, (সেহেতু) সেই বুদ্ধিই পুনরায় মোক্ষদশায় প্রধান ও পুরুষের দুর্বিজ্ঞেয় ভেদ বিশেষভাবে প্রকাশ করে।
.
অতএব স্বীকার করতে হবে যে, প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগের ফলে মহৎ প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। এর দ্বারাই পুরুষের ভোগ এবং অপবর্গ সিদ্ধ হয়ে থাকে।
.
বস্তুত প্রকৃতি একটি ক্ষণেও স্থির থাকে না। প্রতিক্ষণেই তার নিয়ত বা নিয়মিত পরিণতি হয়ে চলেছে। প্রলয়কালেও তার পরিণামপ্রাপ্তি অব্যাহত থাকে। কিন্তু ঐ সময়ে প্রকৃতির স্বরূপভূত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণের তারতম্য হয় না বলে ঐ পরিণামের ফলে অন্য কোন তত্ত্ব প্রকাশিত হয় না। এইজন্য এই পরিণামকে বলা হয় স্বরূপপরিণাম। কিন্তু যখন সৃষ্টির সময় উপস্থিত হয়, অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ ঘটলে প্রকৃতির মধ্যে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে রজঃ সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া আরম্ভ হয়। রজোগুণ চঞ্চল বলে প্রথমে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পরে সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া আরম্ভ হয়। মোটকথা, সৃষ্টির সময় প্রকৃতির স্বরূপভূত তিনটি গুণের তারতম্য হওয়ায় যে পরিণাম হয়, তাকে বলা হয় রিরূপপরিণাম। প্রকৃতির প্রথম বিরূপপরিণাম হলো মহৎতত্ত্ব। সাংখ্যকারিকার ঈশ্বরকৃষ্ণ দ্বাবিংশ কারিকায় প্রকৃতির পরিণাম হিসেবে সৃষ্টির যে ক্রম উল্লেখ করেছেন তা হলো–
‘প্রকৃতের্মহাংস্ততোহহঙ্কারস্তস্মাদ্গণশ্চ ষোড়শকঃ।
তস্মাদপি ষোড়শকাৎ পঞ্চভ্যঃ পঞ্চভূতানি।। (সাংখ্যকারিকা–২২)
অর্থাৎ : প্রকৃতি থেকে মহৎ, মহৎ থেকে অহঙ্কার, অহঙ্কার থেকে (মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্র– এই) ষোলটি গণ (বা বিকার) এবং ষোলটি বিকারের অন্তর্গত পঞ্চতন্মাত্র থেকে (আকাশাদি) পঞ্চমহাভূত (উৎপন্ন হয়)।
.
তবে কারিকাটিতে একবাক্যে এই জগত সৃষ্টির ক্রম উল্লেখ করা হলেও সাংখ্যশাস্ত্রে এর সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রকৃতির প্রথম পরিণাম যে মহৎতত্ত্ব, এই মহৎতত্ত্বেরই নামান্তর হলো মহান, বুদ্ধি ইত্যাদি। একে মহান বলা হয় কারণ সকল উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে এই পদার্থটি মহাপরিমাণযুক্ত। বুদ্ধি বলা হয় এজন্যে যে, বুদ্ধি নিজেকে যেমন প্রকাশ করে তেমনি অন্যকেও প্রকাশ করে। সাংখ্যমতে প্রথম ব্যক্ত বুদ্ধির লক্ষণ হলো অধ্যবসায়। সাংখ্যকারিকার ত্রয়োবিংশ বা তেইশ কারিকায় বলা হয়েছে–
‘অধ্যবসায়ো বুদ্ধির্ধর্ম্মো জ্ঞানং বিরাগ ঐশ্বর্য্যম্ ।
সাত্ত্বিকমেতদ্রূপং তামসমস্মাদ্বিপর্য্যস্তম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৩)
অর্থাৎ : অধ্যবসায় (তথা অন্তঃকরণের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি) হলো বুদ্ধি। ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য ও (অনিমা ইত্যাদি) ঐশ্বর্য্য বুদ্ধির সাত্ত্বিক রূপ। এই ধর্মাদির বিপরীত– অধর্ম, অজ্ঞান, অবৈরাগ্য ও অনৈশ্বর্য্যরূপ চারটি অস˜গুণ বুদ্ধির তামস রূপ।
.
এই কারিকা অনুযায়ী, প্রথম ব্যক্ত বুদ্ধির লক্ষণ হলো অধ্যবসায়। যদিও অধ্যবসায় বুদ্ধির ব্যাপার বা বুদ্ধির ধর্মমাত্র, বুদ্ধির স্বরূপ নয়, তবুও অধ্যবসায়রূপ ব্যাপার বা ধর্মের দ্বারা বুদ্ধির লক্ষণ চিহ্নিত হয়। বুদ্ধির বিশেষ ধর্ম হলো নিশ্চয়, বস্তুর স্বরূপ নিশ্চয় করা যায় জ্ঞান বুদ্ধির দ্বারা। ‘এইটি আমার কর্তব্য’ এরকম নিশ্চয়ই অধ্যবসায় পদবাচ্য। প্রকৃতি যেমন ত্রিগুণের সাম্যাবস্থা, প্রকৃতি থেকে প্রথম উৎপন্ন বুদ্ধি বা মহৎও ত্রিগুণাত্মক। প্রকৃতির যেমন পরিণাম হয়, বুদ্ধিরও তেমনই পরিণাম হয়।
.
মহৎ থেকে অহঙ্কার উৎপন্ন হয়। অহঙ্কার হলো প্রকৃতির দ্বিতীয় পরিণাম। ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই দুটি বোধ অহঙ্কারের প্রধান লক্ষণ। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ চতুর্বিংশ বা চব্বিশ নম্বর কারিকায় অহঙ্কারের লক্ষণ এবং অহঙ্কার থেকে উৎপন্ন দু’প্রকার তত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন–
‘অভিমানোহহঙ্কারস্তস্মাদদ্বিবিধঃ প্রবর্ত্ততে সর্গঃ।
একাদশকশ্চ গণস্তন্মাত্রপঞ্চকশ্চৈব।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৪)
অর্থাৎ : অন্তঃকরণের অভিমানাত্মক বৃত্তি অহঙ্কার। অহঙ্কার থেকে দুই প্রকার সৃষ্টি হয়– একাদশ ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চতন্মাত্র।
.
পঞ্চতন্মাত্র হলো– শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ। আর একাদশ ইন্দ্রিয় হলো– পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরেন্দ্রিয় মন। সাংখ্যকারিকার ছাব্বিশ নম্বর কারিকায় জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে–
‘বুদ্ধীন্দ্রিয়াণি চক্ষুঃশ্রোত্রঘ্রাণরসনত্বগাখ্যানি।
বাক্পাণিপাদপায়ুপস্থানি কর্মেন্দ্রিয়াণ্যাহুঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৬)
অর্থাৎ: চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক্– এই পাঁচটিকে জ্ঞানেন্দ্রিয় বলে এবং বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ (যোনি)- এই পাঁচটিকে কর্মেন্দ্রিয় বলে।
.
মহৎ–এর মতো অহঙ্কারও ত্রিগুণাত্মক। তবে সাংখ্যশাস্ত্রে অহঙ্কারের অন্তর্গত ত্রিগুণের পৃথক পৃথক নামকরণ করা হয়েছে। এ থেকে অহঙ্কার তিনপ্রকারও বলা যায়। অহঙ্কারে সত্ত্ব গুণের প্রাধান্য ঘটলে সাত্ত্বিক অহঙ্কার, রজোগুণের আধিক্য ঘটলে রাজসিক অহঙ্কার এবং তমোগুণের আধিক্য ঘটলে তামসিক অহঙ্কারের সৃষ্টি হয়। সাংখ্যমতে, অহঙ্কারের সাত্ত্বিকভাগকে বৈকারিক বা বৈকৃত, রাজসভাগকে তৈজস এবং তামসভাগকে ভূতাদি বলা হয়েছে। সাংখ্যকারিকার পঁচিশ নম্বর কারিকায় বলা হয়েছে–
‘সাত্ত্বিকঃ একাদশকঃ প্রবর্ত্ততে বৈকৃতাদহঙ্কারাৎ।
ভূতাদেস্তন্মাত্রঃ স তামসস্তৈজসাদুভয়ম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৫)
অর্থাৎ : বৈকৃত নামক সাত্ত্বিক অহঙ্কার থেকে সাত্ত্বিক একাদশ ইন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়। ভূতাদি নামক তামস অহঙ্কার থেকে সেই তামসিক পাঁচটি তন্মাত্র উৎপন্ন হয়। তৈজস বা রাজস অহঙ্কার থেকে ইন্দ্রিয় ও তন্মাত্র উভয়েই উৎপন্ন হয়।
.
মোটকথা, সাংখ্যমতে অহঙ্কার থেকে ষোলটি তত্ত্ব উৎপন্ন হয়। সাত্ত্বিক অহঙ্কার থেকে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় এবং হাত, পা, পায়ু, মুখ ও উপস্থ বা জননেন্দ্রিয় এই পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও মনের আবির্ভাব হয়। আর তামসিক অহঙ্কার থেকে উদ্ভব হয় পঞ্চ তন্মাত্রের।
.
এখানে প্রশ্ন হতে পারে, অহঙ্কারের অন্তর্গত রজো গুণ যদি কোন তত্ত্ব উৎপন্ন না করে, তাহলে অহঙ্কারকে ত্রিগুণাত্মক বলা যাবে কিভাবে ?
এর উত্তর হলো, রজোগুণ না থাকলে সত্ত্বগুণের ও তমোগুণের কার্যকরতা সম্ভব নয়। কারণ সত্ত্বগুণ এবং তমোগুণ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। সুতরাং যদিও রজো গুণকে সাক্ষাৎভাবে কারণ বলা যায় না, তথাপি সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া উৎপাদন করে বলে রজো গুণও ঐ সকল কার্যের প্রতি কারণ হয়। অর্থাৎ উক্ত উভয়প্রকার কার্যের উৎপত্তিতে রজোগুণ হলো নিমিত্তকারণ।
.
একাদশ ইন্দ্রিয় মন হলো উভয়াত্মক। মন জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কার্যের যেমন সহায়ক হয়, কর্মেন্দ্রিয়ের কার্যেরও সহায়ক হয়। অর্থাৎ মনের সাহায্য না পেলে জ্ঞানেন্দ্রিয় জ্ঞান উৎপাদন করতে পারে না। আবার মনের সাহায্য না পেলে কর্মেন্দ্রিয়ও কর্মসাধনে সমর্থ হয় না। এইজন্য সাতাশ নম্বর কারিকায় মনকে উভয় ইন্দ্রিয়স্বরূপ বলা হয়েছে–
‘উভয়াত্মকমত্র মনঃ সংকল্পকমিন্দ্রিয়ঞ্চ সাধর্ম্ম্যাৎ।
গুণপরিণামবিশেষান্নানাত্বং বাহ্যভেদাশ্চ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৭)
অর্থাৎ: মন উভায়ত্মক ও সঙ্কল্পাত্মক। ইন্দ্রিয়ের সমানধর্মবশত (জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের মত মনও সাত্ত্বিক অহঙ্কার থেকে উৎপন্ন বলে) মনও ইন্দ্রিয়। গুণত্রয়ের পরিণামবিশেষহেতু ইন্দ্রিয় নানা এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শব্দাদি বাহ্য বিষয়গুলিও বহু।
.
সাংখ্যকারিকায় ইন্দ্রিয়গুলি বৃত্তি বা কার্য সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে–
‘শব্দাদিষু পঞ্চানামালোচনমাত্রমিষ্যতে বৃত্তিঃ।
বচনাদানবিহরণোৎসর্গানন্দাশ্চ পঞ্চানাম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৮)
অর্থাৎ : শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ বিষয়ে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের বৃত্তি আলোচনজ্ঞান বা নির্বিকল্পক জ্ঞান মাত্র এবং বচন, আদান (গ্রহণ), বিহরণ (গমন), উৎসর্গ (মলাদিত্যাগ) ও আনন্দ (স্ত্রীসম্ভোগরূপ সন্তোষ) পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়ের বৃত্তি– এটাই সাংখ্য স্বীকৃত।
.
সহজকথায়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় যথা– চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক্ এরা যথাক্রমে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ উপলব্ধি করে। আর পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় যথা– হাত, পা, পায়ু, মুখ ও জননেন্দ্রিয়ের বৃত্তি হলো গ্রহণ, গমন, ত্যাগ, কথন ও জনন প্রত্যক্ষ করা। সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয় বলতে ইন্দ্রিয়ের অন্তঃস্থিত অপ্রত্যক্ষ শক্তিকে বোঝায়। প্রত্যক্ষগোচর শরীরের বহির্দেশে অবস্থিত ইন্দ্রিয়গুলি বোঝায় না।
.
ইন্দ্রিয়গুলি শরীর নয়, শরীরাশ্রিত। বুদ্ধি বা জ্ঞানের সাধন ইন্দ্রিয়কে বুদ্ধিন্দ্রিয় বা জ্ঞানেন্দ্রিয় বলা হয়। কর্মের সাধন ইন্দ্রিয়কে বলা হয় কর্মেন্দ্রিয়। বাচস্পতি মিশ্রের মতে জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং কর্মেন্দ্রিয় উভয়ই ইন্দ্রিয়ের বা আত্মার চিহ্ন হওয়ায় ইন্দ্রিয় পদবাচ্য হয়। তবে ন্যায়–বৈশেষিক দার্শনিকরা কর্মেন্দ্রিয় স্বীকার করেন না। কারণ, তাদের মতে যা জ্ঞানের করণ তাই ইন্দ্রিয়। তাই সাংখ্যমে ইন্দ্রিয় একাদশটি হলেও ন্যায়–বৈশেষিক মতে ইন্দ্রিয় সংখ্য ছয়টি।
.
সাংখ্যমতে তামস অহঙ্কার থেকে পঞ্চ তন্মাত্রের আবির্ভাব হয়। এই পঞ্চ তন্মাত্র পাঁচ রকমের অনুভূতি যথা– রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ–এর সূক্ষ্ম উপাদান। তন্মাত্রগুলি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, তাই তাদের প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু তাদের অস্তিত্বকে অনুমান করা যায়। পঞ্চ তন্মাত্র থেকে পঞ্চ মহাভূত যথা– ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম বা আকাশের সৃষ্টি। সাংখ্যকারিকার আটত্রিশ নম্বর কারিকায় বলা হয়েছে–
‘তন্মাত্রাণ্যবিশেষাস্তেভ্যো ভূতানি পঞ্চ পঞ্চভ্যঃ।
এতে স্মৃতা বিশেষাঃ শান্তা ঘোরাশ্চ মূঢ়াশ্চ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৩৮)
অর্থাৎ : (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ– এই পাঁচটি) তন্মাত্রকে অবিশেষ (বা সূক্ষ্ম ভূত) বলে। সেই পাঁচটি (তন্মাত্র) থেকে (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম– এই) পাঁচটি স্থূলভূত উৎপন্ন হয়। এই পাঁচটি স্থূলভূত (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণাত্মক বলে এদের) সুখ, দুঃখ ও মোহ–স্বভাব বলা হয়।
.
পঞ্চতন্মাত্র থেকে যে পঞ্চমহাভূতের সৃষ্টি হয়, সাংখ্য দর্শনে এই কারিকাটির একাধিক ব্যাখ্যা দেখা যায়। প্রচলিত ব্যাখ্যানুযায়ী সাংখ্য দার্শনিকরা বলেন, শব্দতন্মাত্র থেকে ব্যোম বা আকাশ, শব্দতন্মাত্র ও স্পর্শতন্মাত্র থেকে মরুৎ বা বায়ু, শব্দস্পর্শরূপ তন্মাত্র থেকে তেজ, শব্দস্পর্শরূপরস তন্মাত্র থেকে অপ্ বা জল এবং শব্দস্পর্শরূপরসগন্ধ তন্মাত্র থেকে ক্ষিতি বা পৃথিবী উৎপন্ন হয়।
.
এ প্রেক্ষিতে কোন কোন সাংখ্যদার্শনিক যেমন যুক্তিদীপিকাকার বলেছেন যে, এক একটি তন্মাত্র থেকে এক একটি স্থূলভূত উৎপন্ন হয়। আকাশ যেমন শব্দতন্মাত্র থেকে উৎপন্ন হয়, তেমনি বায়ু, তেজ, জল ও পৃথিবী উৎপন্ন হয় যথাক্রমে স্পর্শতন্মাত্র, রূপতন্মাত্র, রসতন্মাত্র ও গন্ধতন্মাত্র থেকে। এক্ষেত্রে বায়ু প্রভৃতির সৃষ্টিতে অন্য তন্মাত্রের অনুপ্রবেশ হয় না। ফলে কার্যকারণভাব সুসঙ্গত হয়।
.
কিন্তু সাংখ্যদর্শনের অন্যান্য আচার্য্যদের মতে, বস্তুস্থিতির উপপাদনের জন্য হেতুরূপে অন্য তন্মাত্রের অনুপ্রবেশ স্বীকার করা প্রয়োজন। কারণ উপাদানকারণের গুণ কার্যে উপলব্ধি হয়। তাই উপাদানসংশ্লিষ্ট তন্মাত্রের কারণেই আকাশে শব্দ, বায়ুতে শব্দ স্পর্শ, তেজে শব্দ স্পর্শ রূপ, জলে শব্দ স্পর্শ রূপ রস এবং পৃথিবীতে শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ এই গুণগুলির উপলব্ধি হয়।
.
সাংখ্য দার্শনিকরা স্থূল মহাভূতের একাধিক গুণ আছে বলে স্বীকার করলেও ন্যায়মতে প্রত্যেকটি মহাভূতের জন্য একটি করে গুণ স্বীকার করা হয়।
.
সাংখ্যমতে স্থূল ভূতগুলি শান্ত ঘোর এবং মূঢ় হওয়ার জন্যই বিশেষত্ব বিশিষ্ট হয়। অর্থাৎ আকাশ প্রভৃতি স্থূল ভূতগুলি উক্ত তিনপ্রকার হলেও সকলের কাছে সমভাবে প্রতীত হয় না। কতকগুলি সত্ত্বগুণপ্রধান, কতকগুলি রজোগুণপ্রধান এবং কতকগুলি তমোগুণপ্রধান। শান্তভূতগুলি সুখ, প্রকাশ এবং লঘু। এগুলি সুখময় হওয়ায় সন্নিকৃষ্ট পুরুষকে সুখী করে। প্রকাশময় হওয়ায় পুরুষের নিকট স্বচ্ছভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করে। আবার লঘু হওয়ায় দ্রুতগতি উর্ধ্বগতি প্রভৃতির আশ্রয় হয়ে থাকে। এইভাবে শান্তত্ববিশিষ্ট ভূতগুলি উপভোগ্য হয়।
.
কিন্তু ঘোর ভূতগুলি দুঃখময় ও অনবস্থিত। রজোগুণ পরিস্ফুট হওয়ায় সে সন্নিকৃষ্ট পুরুষকে দুঃখী করে এবং অনবস্থিত, চঞ্চল বা ক্রিয়াশীল হয়। এইভাবে ঘোরত্ববিশিষ্ট গুণগুলি উপভোগ্য হয়।
আবার মূঢ় ভূতগুলি বিষণ্নও গুরু। বিষাদময় হওয়ায় সন্নিকৃষ্ট পুরুষকে মুগ্ধ করে এবং গুরু হওয়ায় সত্ত্ব ও রজোগুণের সতত কার্যকারিতায় প্রতিবন্ধক হয়। এইভাবে ভূতগুলি পরস্পর ভিন্ন হয়ে প্রতীয়মান হয়। বলাবাহুল্য যে এইরূপ উপভোগযোগ্যতারূপ বিশেষ না থাকায় তন্মাত্রগুলিকে অবিশেষ এবং সূক্ষ্ম বলা হয়।
.
সাংখ্যমতে সৃষ্টিকে সর্গ বলা হয়েছে। সর্গ দু’প্রকার যথা– প্রত্যয়সর্গ বা বুদ্ধি সর্গ এবং তন্মাত্র সর্গ বা ভৌতিক সর্গ। প্রত্যয় সর্গ বা বুদ্ধি সর্গের আওতাভুক্ত হলো মহৎ, অহঙ্কার, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও উভয়েন্দ্রিয় মন এই তেরোটি পরিণাম। আর তন্মাত্র সর্গ বা ভৌতিক সর্গের আওতায় পড়ে পঞ্চ তন্মাত্র, পঞ্চ মহাভূত এবং মহাভূত হতে উৎপন্ন সকল দ্রব্য। পঞ্চতন্মাত্র অতীন্দ্রিয় বলে তা ‘অবিশেষ’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে পঞ্চমহাভূত ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট দ্রব্যগুলিকে ‘বিশেষ’ বলা হয়। সাংখ্যকারিকায় বলা হয়েছে–
‘সূক্ষ্মা মাতাপিতৃজাঃ সহ প্রভূতৈস্ত্রিধা বিশেষাঃ স্যুঃ।
সূক্ষ্মাস্তেষাং নিয়তা মাতাপিতৃজা নিবর্ত্তন্তে।।’– (সাংখ্যকারিকা–৩৯)
অর্থাৎ : বিশেষ তিন প্রকার (যথা-) সূক্ষ্মশরীর, মাতা–পিতা থেকে জাত স্থূলশরীর ও পাঁচটি মহাভূত। এদের মধ্যে সূক্ষ্মশরীর প্রলয়কাল পর্যন্ত (আপেক্ষিক) নিত্য, স্থূলশরীর (কিছুদিন থেকে) নষ্ট হয়।
.
সাংখ্যমতে সৃষ্টি বলতে প্রলয়ের পর প্রথম সৃষ্টি বোঝানো হয়। সৃষ্টির পরে প্রলয় হয় এবং প্রলয়ের পর সৃষ্টি হয়। এইভাবে এই প্রবাহ অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। প্রলয়ের পর যখন সৃষ্টি আরম্ভ হয়, তখন সূক্ষ্মশরীর নির্মিত হয়। তখন হতে আরম্ভ করে মহাপ্রলয় পর্যন্ত এই সূক্ষ্মশরীর বর্তমান থাকে।
.
প্রশ্ন হতে পারে যে, প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই যেহেতু নিত্য সেহেতু প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগও নিত্য। ফলে সর্বদা কেবল সৃষ্টি হওয়ায়, প্রলয়ব্যবস্থার উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী।
উত্তরে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ উনষাট নম্বর কারিকায় বলেছেন–
‘রঙ্গস্য দর্শয়িত্বা নিবর্ত্ততে নর্ত্তকী যথা নৃত্যাৎ।
পুরুষস্য তথাত্মানং প্রকাশ্য বিনিবর্ত্ততে প্রকৃতিঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৫৯)
অর্থাৎ : নর্তকী যেমন দর্শকগণকে নৃত্য দেখিয়ে নৃত্য থেকে নিবৃত্ত হয়, প্রকৃতিও সেইরূপ পুরুষের সামনে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে (সৃষ্টি ব্যাপার থেকে) নিবৃত্ত হয়।
.
সুতরাং, সাংখ্যাচার্যের মতে, সৃষ্টির ন্যায় প্রলয়ও সম্ভব। আর জগৎকার্যরূপ সৃষ্টির কারণও সাংখ্যকারিকার আটান্ন নম্বর কারিকায় দৃষ্টান্ত দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে–
‘ঔৎসুক্যনিবৃত্ত্যর্থং যথা ক্রিয়াসু প্রবর্ত্ততে লোকঃ।
পুরুষস্য বিমোক্ষার্থং প্রবর্ত্ততে তদ্বদব্যক্তম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৫৮)
অর্থাৎ : লোকে যেমন কৌতুহল বা আগ্রহ নিবৃত্তির জন্য কার্যে প্রবৃত্ত হয়, তেমনি প্রকৃতিও পুরুষের মোক্ষের জন্য কার্যে প্রবৃত্ত হয়।
.
এই কার্যই হলো সৃষ্টি। বস্তুত সাংখ্যদর্শনের অভিব্যক্তিবাদ সৎকার্যবাদেও উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাই এই মতে উৎপত্তি নতুন কোন সৃষ্টি নয়, কেবল অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া। আবার বিনাশ কখনোই পরিপূর্ণ বিনাশ নয়, কেবল ব্যক্তের অব্যক্তে বিলীন হওয়া।
.
সাংখ্যমতে প্রকৃতির জগৎ সৃষ্টির উদ্দেশ্য দ্বিবিধ। পুরুষের ভোগ এবং পুরুষের মুক্তি। যদিও পুরুষ স্বরূপত ভোক্তা নয়, তবুও বুদ্ধি বা মহৎ স্বগত সুখ এবং দুঃখরূপ ভোগকে পুরুষে প্রতিবিম্বিত করে। এইভাবে পুরুষে ভোক্তৃত্ব উৎপন্ন হয়। আবার পুরুষ এবং প্রকৃতির ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি উৎপন্ন কওে প্রকৃতি পুরুষের মুক্তিসাধন করে। অর্থাৎ প্রকৃতির সৃষ্টির ফলে পুরুষ ভোগ কওে এবং পুরুষের ভোগের ফলে পুরুষের মুক্তি বা কৈবল্য সম্ভব হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকৃতির সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে উদ্দেশ্যমূলক বলা যায়। এই অভিব্যক্তি প্রক্রিয়া কোন আকস্মিক ঘটনা নয়।
.
অপরিণামী পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতির চব্বিশটি তত্ত্বেও সাহায্যে সাংখ্য দার্শনিকরা এভাবেই জগতের অভিব্যক্তি বর্ণনা করেছেন।
(চলবে…)

সাংখ্যতত্ত্ব চার



সাংখ্যতত্ত্ব চার

অ্যাডমিন
 সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
চতুর্থ পর্ব
★★★★★সাংখ্য জ্ঞানতত্ত্ব★★★★★★
সাংখ্য দর্শনে মোক্ষ–উপযোগী বিবেকজ্ঞান ছাড়াও একপ্রকার ব্যবহারিক জ্ঞান স্বীকার করা হয়েছে। ঘট–পট ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ক যে জ্ঞানের দ্বারা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার নিষ্পন্ন হয়, তাকেই ব্যবহারিক জ্ঞান বলা হয়। ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাংখ্য সম্প্রদায়ও এ বিষয়ে একমত যে, জ্ঞান মাত্রই সবিষয়ক। বিষয় বিহীন কোন জ্ঞানের অস্তিত্ব নেই। জ্ঞানের বিষয়কে বলা হয় জ্ঞেয় এবং জ্ঞানের কর্তাকে বলা হয় জ্ঞাতা। সাংখ্যমতে পুরুষই একমাত্র জ্ঞাতা হতে পারে। পুরুষ বা আত্মার বহুত্ব সাংখ্যশাস্ত্রে স্বীকৃত। পুরুষ ব্যতীত বাকি সকল তত্ত্বই অচেতন বলে প্রকৃতিজাত মহৎ ইত্যাদি যাবতীয় বস্তুই অচেতন ও কেবলমাত্র জ্ঞানের বিষয় বা জ্ঞেয় হতে পারে।
.
সাংখ্যমতে একটি জ্ঞেয়বস্তু একাধিক জ্ঞাতার দ্বারা জ্ঞাত হতে পারে। তবে একই বিষয়ের জ্ঞান যে সকলের একই রূপ হবে এমন কোন কথা নেই। একই বিষয় হতে বিভিন্ন জ্ঞাতার বিভিন্নরূপ জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে। যেমন বলা যেতে পারে যে, সুন্দরী রমণীকে দেখে স্বামীর সুখ, সপত্নীর দুঃখ, কামুকের মোহ এবং উদাসীনের ঔদাসীন্য দেখা যায়। আবার কোন বস্তু যদি কখনো কারোর জ্ঞানের বিষয় না হয়, তাহলেও তা অস্তিত্বশীল হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ সপ্তম কারিকায় বলেন–
‘অতিদূরাৎসামীপ্যাৎ ইন্দ্রিয়ঘাতাৎ মনোহনবস্থানাৎ।
সৌক্ষ্ম্যাৎ ব্যবধানাৎ অভিভবাৎ সমানাভিহারাৎ চ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৭)
অর্থাৎ : অতি দূরে অথবা অতি নিকটে থাকায়, ইন্দ্রিয় আহত হওয়ায়, মনোযোগের অভাবে, সূক্ষ্মতার জন্য, ব্যবধান বা আড়াল থাকায়, (উচ্চ শক্তি দ্বারা নিম্নশক্তি) অভিভূত হওয়ায় এবং সমান বস্তুতে মিশে যাওয়ায় সৎ বস্তুর অনুপলব্ধি হয় (অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বাধা প্রাপ্ত হয়)।
.
এ কারণে, সাংখ্যমতে, কোন জ্ঞাতার উপলব্ধিতে না এলেই বিষয়কে অনস্তিত্বশীল বলা যায় না। এজন্য বিষয়কে স্বতন্ত্র বলা হয়।
.
সাংখ্যমতে পরিণামী প্রকৃতির প্রথম উৎপন্ন তত্ত্ব হলো মহৎ বা বুদ্ধি। প্রকৃতিজাত বুদ্ধিও প্রকৃতির ন্যায় পরিণামী ও গতিশীল। বিষয়ের সংস্পর্শে বুদ্ধির বৃত্তি হয়। ইন্দ্রিয়ার্থ–সম্বন্ধাদিকে দ্বার করে বুদ্ধিবৃত্তি বহির্গমন করে এবং ঘট–পট ইত্যাদি বিষয়াকার ধারণ করে। অর্থাৎ, যখন বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ পায় এবং ইন্দ্রিয়ের সাথে মনের সংযোগ হয় তখন বুদ্ধি বিষয়াকারে পরিণত হয়। বুদ্ধি দর্পণের ন্যায় স্বচ্ছ, নির্মল ও সংকোচ–বিকাশ স্বভাব। ফলে বিষয়টি যে আকার বা প্রকারের হয়, বুদ্ধি বা চিত্ত সেই আকার বা প্রকার গ্রহণ করে। বুদ্ধির এইরূপ বিষয়াকার গ্রহণকে বলা হয় বুদ্ধিবৃত্তি।
.
বিষয়াকারে আকারপ্রাপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিতে যখন পুরুষ প্রতিবিম্বিত হয়, তখন আমাদের ঐ বিষয়ের জ্ঞান বা উপলব্ধি হয়। সাংখ্যমতে বুদ্ধিবৃত্তি ও বিষয় উভয়ই জড় পদার্থ হওয়ায় চৈতন্যস্বরূপ পুরুষের প্রতিবিম্বন ব্যতীত পুরুষ বা আত্মার বোধরূপ উপলব্ধি সম্ভব নয়। এই কারণে বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞানের করণ এবং পুরুষের উদ্ভাসিত বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞান বলা হয়।
.
সাংখ্যকারিকার টীকাকার বাচস্পতি মিশ্র মনে করেন, কেবল বুদ্ধিতে পুরুষের প্রতিবিম্বনের ফলেই জ্ঞান উৎপন্ন হয়। কিন্তু বিজ্ঞানভিক্ষুর মতে, জ্ঞানোৎপত্তির জন্য বুদ্ধিতে যেমন পুরুষের প্রতিবিম্বন প্রয়োজন, তেমনি পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিবিম্বন প্রয়োজন। বিজ্ঞানভিক্ষুর এই মতবাদ ‘অন্যোন্যপ্রতিবিম্ববাদ’ নামে পরিচিত।
.
প্রমাণ (Source of Knowledge)
যার দ্বারা যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় তাকে ‘প্রমাণ’ বলা হয়। আর যথার্থ জ্ঞান বা উপলব্ধি হলো প্রমা। সাংখ্যমতে বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞানের করণ বা প্রমাণ এবং পুরুষের উদ্ভাসিত বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞান বা প্রমা বলা হয়। এই মতে চৈতন্যের দ্বারা উদ্ভাসিত বুদ্ধিবৃদ্ধিমাত্রই প্রমাপদবাচ্য নয়। অসন্দিগ্ধ, অবিপরীত ও অনধিগত বিষয়ক চিত্তবৃত্তিই প্রমাণ এবং তার উদ্ভাসিত ফল হলো প্রমা। এ বিষয়ে বাচস্পতি মিশ্র তাঁর কৌমুদীতে বলেন–
‘অসন্দিগ্ধারিপরীতানধিগতবিষয়া চিত্তবৃত্তিঃ। বোধশ্চ পৌরুষেয়ঃ ফলং প্রমা, তৎ সাধনং প্রমাণমিতি।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী : কারিকা–৪)
অর্থাৎ : অসন্দিগ্ধ, অবিপরীত, অনধিগত বিষয়ের আকারে আকারিত চিত্তবৃত্তিকে প্রমাণ বলে। প্রমাণের পুরুষনিষ্ঠ বোধরূপ ফলই প্রমা। তার (প্রমার) সাধনই প্রমাণ।
.
সংশয়, ভ্রম বা জ্ঞাতবিষয়ের জ্ঞান সাংখ্যমতে প্রমাপদবাচ্য নয়। সংশয় হলো সন্দিগ্ধ জ্ঞান, ভ্রম হচ্ছে বিষয়–বিপরীত জ্ঞান এবং স্মৃতি হলো অধিগত বিষয়ের জ্ঞান। সংশয়, ভ্রম বা স্মৃতি যাতে প্রমাপদবাচ্য না হয়, সে কারণে অসন্দিগ্ধ, অবিপরীত ও অনধিগত বিষয়ক চিত্তবৃত্তিজন্য জ্ঞানকে প্রমা বলা হয়েছে। সাংখ্যমতে প্রমাণ ত্রিবিধ– প্রত্যক্ষণ (Perception), অনুমান (Inference) ও শব্দ বা আগম (Testimony)।
.
সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ চতুর্থ সাংখ্যকারিকায় বলেন–
‘দৃষ্টমনুমানমাপ্তবচনঞ্চ সর্ব্বপ্রমাণসিদ্ধত্বাৎ।
ত্রিবিধং প্রমাণম্ ইষ্টং প্রমেয়সিদ্ধিঃ প্রমাণাদ্ধি।।’– (সাংখ্যকারিকা–৪)
অর্থাৎ : (উপমান, অর্থাপত্তি, অনুপলব্ধি ইত্যাদি) সকল প্রকার প্রমাণ দৃষ্ট, অনুমান ও আপ্তবচনের দ্বারা সিদ্ধ হওয়ায় সাংখ্যশাস্ত্রে কেবলমাত্র এই তিনপ্রকার প্রমাণ অভিলষিত, যেহেতু প্রমাণের দ্বারাই প্রমেয় সিদ্ধি হয়।
.
পঞ্চম কারিকায় সাংখ্যকারিকাকার আবার এই ত্রিবিধ প্রমাণ তথা প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আপ্তবাক্য বা শব্দ প্রমাণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন–
‘প্রতিবিষয়াধ্যবসায়ো দৃষ্টং ত্রিবিধম্ অনুমানম্ আখ্যাতম্ ।
তল্লিঙ্গলিঙ্গিপূর্ব্বকম্ আপ্তশ্র“তিঃ আপ্তবচনম্ তু।।’– (সাংখ্যকারিকা–৫)
অর্থাৎ : বিষয়ের সঙ্গে সন্নিকৃষ্ট ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান দৃষ্ট বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ। লিঙ্গ ও লিঙ্গী পূর্বক অনুমান তিন প্রকার (যথা– পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট) বলা হয়। কিন্তু, (বেদবাক্য বা) ঋষিবাক্যই আপ্তবচন বা শব্দ প্রমাণ।
.
প্রত্যক্ষ প্রমাণ (Perception)
প্রত্যক্ষকে প্রমাণ–জ্যেষ্ঠ বলা হয়, এবং তা অন্যান্য প্রমাণের উপজীব্য বলে প্রত্যক্ষণই প্রমাণগুলির মধ্যে প্রথম প্রমাণ। বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে সাক্ষাৎ জ্ঞানের উদ্ভব হয়, তাকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয়। সাংখ্যকারিকাকার তাই পঞ্চম কারিকার সংশ্লিষ্ট অংশে বলেন–
‘প্রতিবিষয়াধ্যবসায়ো দৃষ্টম্’–
অর্থাৎ, বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষজনিত যে অধ্যবসায়, তাই প্রত্যক্ষজ্ঞান।
.
সাংখ্যমতে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও মন হলো জ্ঞানের করণ। তার মধ্যে পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় এবং বুদ্ধি, অহঙ্কার ও মন– এই ত্রিবিধ অন্তঃকরণ জ্ঞানসামান্যের কারণ। একমাত্র পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিশেষ কারণ। মন অন্তঃপ্রত্যক্ষেও বিশেষ কারণ এবং তা সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়গুলির সঙ্গে স্ব স্ব বিষয়ের সন্নিকর্ষের ফলে তমোগুণের অভিভবপূর্বক সত্ত্বগুণের যে পরিণাম হয়, তাই প্রত্যক্ষরূপ অধ্যবসায়।
.
প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে কেবল ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই বুদ্ধি বা চিত্ত বিষয়াকার গ্রহণ করে, কিন্তু অনুমিতি ও শাব্দবোধের ক্ষেত্রে ব্যাপ্তিজ্ঞান ও পদজ্ঞানের প্রয়োজন হয়। তবে বাচস্পতি মিশ্রেও মতে ইন্দ্রিয়কে প্রত্যক্ষেও করণ বলা যায় না। তাঁর মতে, ইন্দ্রিয়গুলি কোন কোন সময় যথার্থ জ্ঞান উৎপন্ন করলেও সব সময় তা করে না। তাই ইন্দ্রিয়গুলিকে করণ বলা যায় না। এই মতে বুদ্ধিবৃত্তিই প্রমাণ এবং ইন্দ্রিয়গুলি বুদ্ধিবৃত্তিরূপ প্রমাণের দ্বারস্বরূপ। একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে তিনি প্রত্যক্ষের উৎপত্তিক্রম ব্যাখ্যা করেছেন।
.
একটি বস্তু বা ঘট যখন চক্ষুরিন্দ্রিয়ের গোচর হয়, তখন বস্তুটি আমাদেও চক্ষুরিন্দ্রিয়ের মধ্যে এক প্রকার ঘটাকার আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর ফলে অন্তরিন্দ্রিয় মনে সেই আলোড়ন বা সংবেদনের ব্যাখ্যারূপ একপ্রকার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মন তখন ঐ ঘটাকারটিকে অহঙ্কারের নিকট প্রেরণ করে। অহঙ্কার সেই আকারে আকারিত হয়ে বুদ্ধিতে উপস্থিত হয়। বুদ্ধি যখন এই ঘটাকারে আকারিত হয়, তখন তাকে বলে ঘটাকার বুদ্ধিবৃত্তি। ঘটাকারে আকারিত এই বুদ্ধিবৃত্তি প্রকৃতিগতভাবে সত্ত্বগুণান্বিত এবং দর্পণের ন্যায় অতি স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছ বুদ্ধিবৃত্তিতে যখন পুরুষের চৈতন্য প্রতিবিম্বিত হয়, এর ফলে বুদ্ধিবৃত্তি চেতনাভাবাপন্ন হয় এবং তখনই ঘটটি প্রকাশিত হয়। ঘটটির এইরূপ যথাযথ প্রকাশকেই বলে ঘটের প্রত্যক্ষ প্রমা। যে বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা এইরূপ প্রকাশ হয়, তাকে বলা হয় প্রত্যক্ষ প্রমাণ। প্রমাণ হলো বুদ্ধির অচেতন বৃত্তি এবং প্রমা ঐ বৃত্তিরই প্রকাশিত চেতন রূপ।
যদিও বিজ্ঞানভিক্ষু এই মতের অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, জ্ঞান বুদ্ধিতে সম্ভব নয়, একমাত্র পুরুষেই জ্ঞান সম্ভব।
.
সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয়াদি করণবৃত্তি কখনো যুগপৎ, আবার কখনো ক্রমশ হয়ে থাকে। ক্রমশ বৃত্তির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের বৃত্তিকে আলোচন এবং পরবর্তী মনের বৃত্তিকে সংকল্প বলা হয়। বাচস্পতি মিশ্র ও বিজ্ঞানভিক্ষু আলোচন ও সংকল্প বৃত্তিকে যথাক্রমে নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষ সদৃশ বলে বর্ণনা করেছেন।
ন্যায়–বৈশেষিক মতে, যে প্রত্যক্ষণে বস্তুর কেবল অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান হয়, তাকে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ বলে। এই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণে বস্তুর কোন বৈশিষ্ট্যকে জানা যায় না। অর্থাৎ বস্তুটি কী রকমের, এর জাতি বা নাম কী, সংজ্ঞা কী ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায় না। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
অন্যদিকে, যে প্রত্যক্ষণে বস্তুর নাম, লক্ষণ, জাতি প্রভৃতি যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ হয়, তা সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ। সবিকল্পক প্রত্যক্ষণে বিশ্লেষণ, সাদৃশ্য, তুলনা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াকে প্রয়োগ করে বস্তু সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান লাভ হয়। সবিকল্পক প্রত্যক্ষকে ভাষায় প্রকাশ করা যায়। সাংখ্য দর্শনে সবিকল্প প্রত্যক্ষণকে ‘বিবেচনা’ও বলা হয়।
.
অনুমান প্রমাণ (Inference)
অনুমান হলো ব্যাপ্তিজ্ঞান ও পক্ষধর্মতা জ্ঞানজন্য বুদ্ধিবৃত্তি। দুটি বস্তুর মধ্যে যদি নিয়ত সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তি সম্বন্ধ দেখা যায়, তবে একটিকে প্রত্যক্ষ করে অন্যটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়, এই জ্ঞানকে অনুমানলব্ধ জ্ঞান বলা যায়। যেমন, একটি পর্বতে ধোঁয়া বা ধূম প্রত্যক্ষ করে ধারণা করা হয় যে, সেখানে আগুন রয়েছে। যেখানে ধোঁয়া সেখানে আগুন, ধোঁয়া এবং আগুনের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ আছে বলে ধোঁয়া প্রত্যক্ষ করে আগুনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা হয়। সাংখ্যকারিকার পঞ্চম কারিকায় সংশ্লিষ্ট অংশে অনুমানের সামান্য লক্ষণে বলা হয়েছে–
‘তল্লিঙ্গলিঙ্গিপূর্ব্বকম্’–
অর্থাৎ, লিঙ্গ ও লিঙ্গি পূর্বক অনুমান।
.
‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ ব্যাপ্য বা হেতু। ‘লিঙ্গি’ শব্দের অর্থ ব্যাপক বা সাধ্য। ধূম বহ্নির লিঙ্গ এবং বহ্নি ধূমের লিঙ্গি। এইরূপ লিঙ্গ–লিঙ্গি বা ব্যাপ্য–ব্যাপক সম্বন্ধের পারিভাষিক নাম ব্যাপ্তি। ব্যাপ্তি স্বাভাবিক সম্বন্ধ। অর্থাৎ ব্যাপ্তি সম্বন্ধ উপাধিরহিত বা অনৌপাধিক। যাদের মধ্যে শর্ত বা উপাধি থাকে, তাদেও সম্বন্ধকে স্বাভাবিক বলা যায় না। ধূমের সঙ্গে বহ্নি বা আগুনের সম্বন্ধ উপাধিশূন্য, মানে এখানে কোন শর্ত নেই। ধূম থাকলে সেখানে আগুন থাকবেই। কিন্তু বহ্নির সঙ্গে ধূমের সম্বন্ধ আর্দ–ইন্ধন উপাধিযুক্ত। মানে, আগুন থাকলেই সেখানে ধূম থাকবে না, যদি না কোন ভেজা জ্বালানি থাকে। অগ্নিতপ্ত গলন্ত লোহার আগুনে কোন ধূম থাকে না, ভেজা জ্বালানি না থাকায়। অর্থাৎ যে অগ্নি সেখানে ধূম থাকবে যদি সেখানে ভেজা জ্বালানি থাকার শর্ত বা উপাধি যুক্ত হয়। তাই ধূম ও বহ্নির মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ থাকে। কিন্তু বহ্নি ও ধূমের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ থাকে না। এই কারণে ধূম থেকে আগুনের অনুমান হয়, কিন্তু আগুন থেকে ধূমের অনুমান হয় না।
.
ন্যায়মতের অনুরূপ সাংখ্যমতেও অনুমান ত্রিবিধ– পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট।
.
অনুমানের ব্যাপ্তি যখন কার্য–কারণ সম্বন্ধের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আমরা যেমন কারণ থেকে কার্যকে অনুমান করতে পারি, তেমনি কার্য থেকে কারণকেও অনুমান করতে পারি। প্রথম প্রকার অনুমানকে বলা হয় পূর্ববৎ এবং দ্বিতীয় প্রকার অনুমানকে বলা হয় শেষবৎ। প্রচণ্ড খরা দেখে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষেও অনুমান হলো পূর্ববৎ অনুমানের দৃষ্টান্ত। আবার নদীর জলের মলিনতা ও খরস্রোত দেখে অতীত বৃষ্টির অনুমান হলো শেষবৎ অনুমানের দৃষ্টান্ত।
.
যে অনুমানের ব্যাপ্তি কার্য–কারণ সম্বন্ধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় না, বা যে অনুমানের হেতু ও সাধ্য কার্য–কারণ সম্বন্ধে সংবদ্ধ নয়, কেবল সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে অনুমানটি গড়ে ওঠে, সেই অনুমানকে বলা হয় সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান। বিভিন্ন সময়ে গ্রহাদির অবস্থান বিভিন্ন স্থানে বা দেশে পর্যবেক্ষণ করে আমরা যখন গ্রহাদিও গতির অনুমান করি, তখন সেই অনুমানকে বলা হয় সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান। একটি বস্তুর বিভিন্ন স্থানে অবস্থানের সঙ্গে ঐ বস্তুর গতির কোন কার্য–কারণ সম্বন্ধ নেই। কিন্তু দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আমরা গতিশীল বস্তুকে বিভিন্ন স্থানে দেখে থাকি এবং এই অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা গ্রহাদিও বিভিন্ন স্থানে অবস্থান দেখে অনুমান করি যে গ্রহাদি গতিশীল। এটাই সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান।
.
পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট– এই ত্রিবিধ অনুমানকে সাংখ্যাচার্যরা আবার বীত ও অবীত ভেদে দুইভাগে ভাগ করেছেন।
যে অনুমান হেতু ও সাধ্যেও অন্বয় সাহচর্যের ভিত্তিতে ভাবরূপে সাধ্যের সাধন করে, অর্থাৎ সদর্থক সামান্য বাক্যকে অবলম্বন করে যে অনুমান গড়ে ওঠে তাকে ‘বীত’ অনুমান বলা হয়।
অপরদিকে নঞর্থক সামান্য বাক্যকে অনুমান করে যে অনুমান গড়ে ওঠে, অর্থাৎ যে অনুমান হেতু ও সাধ্যের ব্যতিরেক সাহচর্যেও ভিত্তিতে সাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়, কিন্তু কারোর বিধায়ক না হয়ে প্রতিষেধক হয় তাকে ‘অবীত’ অনুমান বলে।
পূর্ববৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান হলো বীত অনুমান। অন্যদিকে শেষবৎ অনুমান হলো অবীত অনুমান।
.
শব্দ বা আগম প্রমাণ (Testimony)
সাংখ্যসম্মত তৃতীয় প্রকার প্রমাণ হলো শব্দ, আগম বা আপ্তবাক্য। যে সমস্ত বিষয় বা বস্তুকে প্রত্যক্ষ বা অনুমানের সাহায্যে জানা যায় না, তাদেরকে শব্দ প্রমাণের সাহায্যে জানা যায়। এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ ষষ্ঠ কারিকায় বলেন–
‘সামান্যতস্তু দৃষ্টাৎ অতীন্দ্রিয়াণাং প্রতীতিরনুমানাৎ।
তস্মাদপি চ অসিদ্ধং পরোক্ষম্ আপ্তাগমাৎ সিদ্ধম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৬)
অর্থাৎ : সামান্যতোদৃষ্ট অনুমানের দ্বারা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের অতীত (প্রকৃতি, পুরুষাদি) তত্ত্বের জ্ঞান হয়। সামান্যতোদৃষ্ট এবং শেষবৎ অনুমানের দ্বারা অতীন্দ্রিয় কোন তত্ত্ব অসিদ্ধ হলে সেই অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব আপ্তবচনরূপ আগম বা শব্দ প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয়।
.
যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে হলে শব্দ বা আপ্তবাক্যেল অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে হবে। আপ্তবাক্য হলো বিশ্বস্ত ব্যক্তির উপদেশ। যে ব্যক্তি ভ্রম–বিপ্রলিপ্সাদি দোষমুক্ত, তিনিই আপ্ত। এইরূপ আপ্তব্যক্তির উপদেশ হলো শব্দ প্রমাণ। বলাই বাহুল্য যে, উপদেশজন্য জ্ঞানের পক্ষে একদিকে বাক্যের পদজ্ঞান এবং অপরদিকে আকাক্সক্ষা, যোগ্যতা, সন্নিধি ও তাৎপর্য, বাক্যান্তর্গত এই চার প্রকার সম্বন্ধের জ্ঞান প্রয়োজন। সুতরাং যে বুদ্ধিবৃত্তি এই সকল জ্ঞানসাপেক্ষ প্রমার করণ হয়, তাই শব্দ প্রমাণ।
.
ন্যায় সম্প্রদায়ের অনুরূপ সাংখ্যমতেও শব্দ প্রমাণ দু’প্রকার– লৌকিক ও বৈদিক।
.
লৌকিক শব্দ হলো বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বাসযোগ্য লোকের বচন। লৌকিক শব্দ প্রত্যক্ষণ ও অনুমানের সাহায্যেও লাভ করা যায়। সাংখ্য দার্শনিকরা লৌকিক শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে মনে করেন না, কিন্তু বৈদিক শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ মানেন। বৈদিক শব্দ হলো বেদের বচন। বেদ, দেবতা, স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষের অতীত এবং অনুমানের অগম্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানদান করে। বৈদিক শব্দ কোন মানুষের কৃত নয়। মানুষের কৃত নয় বলে মানুষ যে জাতীয় ভুল করে সে জাতীয় ভুল বেদে থাকতে পারে না। সত্যদ্রষ্টা ঋষিদেও অভিজ্ঞতাকেই বেদে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাই বৈদিক শব্দ অভ্রান্ত ও স্বতঃপ্রমাণ।

সাংখ্যতত্ত্ব তিন


সাংখ্যতত্ত্ব তিন


অ্যাডমিন
 

সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
তৃতীয় পর্ব
★★★★ঈশ্বরপ্রসঙ্গে সাংখ্যমত★★★★
দার্শনিক মহলে মহর্ষি কপিল প্রবর্তিত সাংখ্য দর্শনকে নিরীশ্বর সাংখ্য এবং পতঞ্জলি প্রবর্তিত যোগ দর্শনকে সেশ্বর সাংখ্য বলা হয়। তবে এটি সর্বসম্মত মত নয়। কেননা, সাংখ্য দর্শন নিরীশ্বরবাদী কিনা, সে বিষয়ে সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। বলা হয়, প্রাচীন সাংখ্যাচার্যরা নিরীশ্বরবাদী এবং পরবর্তী সাংখ্যাচার্যরা ঈশ্বরবাদী।
ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে সাংখ্যপ্রবচনসূত্রে বলা হয়েছে–
‘ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ প্রমাণাভাবাৎ।’– (সাংখ্যপ্রবচনসূত্র–১/৯২)
অর্থাৎ : প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধ।
.
এক্ষেত্রে উক্ত সূত্রটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু তাঁর সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যে বলেন– ‘প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধ’– এই উক্তি থেকে একথা প্রমাণিত হয় না যে, সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বর অস্বীকৃত হয়েছেন। বরং, এর দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হলেও কোন প্রমাণের দ্বারা তা সিদ্ধ বা প্রমাণ করা যায় না।
.
এখানে উল্লেখ্য, ষোড়শ শতকের ঈশ্বরবাদী সাংখ্য দার্শনিক বিজ্ঞানভিক্ষু তাঁর সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যের ভূমিকায় বলেই দিয়েছিলেন যে,-
‘সাংখ্যশাস্ত্র কালসূর্যের গ্রাসে পতিত হয়েছে এবং তার কলামাত্রই অবশিষ্ট আছে; আমি অমৃতবাক্যের দ্বারা তা পূরণ করবো।’
.
সাংখ্যের কলামাত্র অবশিষ্টকে অমৃতবাক্যের দ্বারা পূর্ণ করার ফলাফল সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়–এর প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিটিও প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়।
‘…তার ফলে এ–দর্শন আর যাই হোক সাংখ্য–দর্শন থাকেনি– বেদান্তমতে বা অন্তত প্রায়–বেদান্তমতে পরিণত হয়েছিলো। কেননা, নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বর দর্শনে পরিণত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি; শেষপর্যন্ত তিনি বেদান্তের সঙ্গে সাংখ্যের প্রায় সমস্ত মৌলিক প্রভেদই উড়িয়ে দেবার আয়োজন করেছিলেন।’– (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা–২৩)
.
নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বর সাংখ্যে রূপায়ন–প্রচেষ্টা পরবর্তীকালের অন্যান্য ঈশ্বরবাদী ভাষ্যকারদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। যেমন সাংখ্যের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক তত্ত্ব পুরুষতত্ত্বে সাংখ্যকারিকা অনুযায়ীই পুরুষ–বহুত্ব স্বীকৃত হলেও সাংখ্যকারিকার অন্যতম ভাষ্যকার গৌড়পাদ তাঁর গৌড়পাদভাষ্যে সংশ্লিষ্ট কারিকার ব্যাখ্যায় ঠিক বিপরীত মত–ই প্রস্তাব করেছেন যে (সূত্র– দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা–২৪)-
‘অনেকং ব্যক্তমেকব্যক্তং তথা পুমানপ্যেকঃ।’– (গৌড়পাদভাষ্য)
অর্থাৎ : ব্যক্ত অনেক, অব্যক্ত এক, সেই প্রকার পুরুষও এক।
.
প্রাচীন আধ্যাত্মবাদী বা ব্রহ্মবাদী দার্শনিকদের কাছে সাংখ্য যে কেবল নিরীশ্বরবাদী দর্শনই ছিলো, তা–ই নয়, বেদ বা শ্র“তিবিরোধী দর্শন হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের বিখ্যাত অদ্বৈত–বেদান্তবাদী দার্শনিক শংকরাচার্যও প্রাচীন আস্তিক মতের সমর্থনে সাংখ্যকে বেদমূলক দর্শন বলে স্বীকার করতে সম্মত হননি। প্রাচীন আস্তিক মতের প্রধান দার্শনিক উদ্যোক্তা হলেন ‘ব্রহ্মসূত্র’–প্রণেতা বাদরায়ণ। বাদরায়ণও সাংখ্য–দর্শনকে বেদান্ত–দর্শনের অর্থাৎ উপনিষদ বা শ্রুতি–প্রতিপাদ্য তত্ত্বের প্রধানতম প্রতিপক্ষ বলেই গ্রহণ করেছিলেন।
.
‘সাংখ্য–গণিতের একটি সরল হিসেব থেকেই এ–কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। ব্রহ্ম–সূত্রে মোট ৫৫৫টি সূত্র আছে। তার মধ্যে অন্তত ৬০টি সূত্র প্রধানতই সাংখ্য–খণ্ডন উদ্দেশ্যে রচিত। তুলনায় বাকি সব বিরুদ্ধ–মত খণ্ডনের উদ্দেশ্যে বাদরায়ণ মোট ৪৩টি সূত্র রচনা করেছেন ; তার মধ্যে জৈন–মত খণ্ডনে মোট ৪টি সূত্র। এবং সমস্ত রকম বৌদ্ধমত খণ্ডনে মোট ১৫টি সূত্র দেখা যায়। এই হিসেবটুকু থেকেই বোঝা যায় সূত্রকারের কাছে বিরুদ্ধ–মত হিসেবে সাংখ্যর গুরুত্ব কতখানি ছিল। সাংখ্য যদি প্রকৃতই শ্র“তি–মূলক হয় তা হলে শ্রুতি–তত্ত্বর ব্যাখ্যায় সাংখ্য–খণ্ডনে এমন উৎসাহ কেন ?’- (ভারতীয় দর্শন,পৃষ্ঠা–২২, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)
.
তাছাড়া ব্রহ্মসূত্রের মূল পরিকল্পনায়ও দেখা যায়, গ্রন্থের শুরুতে প্রথম চারটি সূত্রে বাদরায়ণ ব্রহ্ম বিষয়ে কয়েকটি মূল কথা ব্যাখ্যা করে এরপর পঞ্চম সূত্রেই বলেছেন–
‘ঈক্ষতেঃ ন অশব্দম্ ।’– (ব্রহ্মসূত্র: ১/১/৫)
শংকরাচার্যেরব্যাখ্যানুযায়ীসূত্রটিরঅর্থ : জগতের আদি কারণের চিন্তা, দর্শন ইত্যাদির কথা শাস্ত্রে আছে– এই ব্রহ্ম চেতন–পদার্থ। কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত অচেতন প্রধানের কথা শাস্ত্রে নাই বলে অচেতন প্রকৃতি বা প্রধানকে জগৎসৃষ্টির আদি কারণ বললে তা অশাস্ত্রীয় উক্তি হবে।
.
মোটকথা, আধুনিক বিদ্বানদের মতে, আদিতে বেদ–রিরুদ্ধ দর্শনের মধ্যে সাংখ্যের স্থানই প্রধান ছিলো। লুপ্তপ্রায় মূল গ্রন্থের অভাবে পরবর্তীকালের ঈশ্বরবাদী দার্শনিকদের হাতে তার ব্যাখ্যাগুলি নিজেদের মতো করে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। প্রকৃতপক্ষে আদিতে সাংখ্য দর্শনের জন্ম হয়েছে নিরীশ্বরবাদী দর্শন হিসেবেই। সাংখ্যকারিকায় ঈশ্বরের কোন প্রসঙ্গ নেই। এমনকি সায়ন মাধবাচার্যও তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’–এর সাংখ্য–প্রস্থান শেষ করেছেন এই বলে যে–
‘এতচ্চ নিরীশ্বরসাংখ্যশাস্ত্রম্ ।’– (সাংখ্য–প্রস্থানম্, সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : এইভাবে নিরীশ্বর সাংখ্যশাস্ত্রের প্রবর্তক কপিলের মত প্রদর্শিত হলো।
.
ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদের প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে ও পক্ষে সাংখ্য দর্শনে বিভিন্ন যুক্তির উপস্থাপন ঘটেছে।
.
ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে যুক্তি
প্রাচীন সাংখ্য দার্শনিকদের মতে ঈশ্বর বলে কেউ নেই, প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। এই মতবাদ স্থাপনের জন্য তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে কতকগুলি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।
.
(১) সাংখ্যমতে মহৎ তত্ত্ব থেকে মহাভূত পর্যন্ত এই জগৎ সৃষ্টি প্রকৃতিরই কার্য। কার্য থাকলে এর পেছনে কারণও থাকবে। পরিণামী প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। তাই জগৎ–কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই।
.
(২) কোন কর্ম সম্পাদনে কর্তার একটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। জগৎ কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলে জগৎ সৃষ্টির দ্বারা ঈশ্বরের কোন্ উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তা বলতে হয়। কিন্তু জগৎ সৃষ্টির মাধ্যমে ঈশ্বরের কোন উদ্দেশ্য সাধনের কথাই আমরা বলতে পারি না।
প্রথমত, জীবের প্রতি করুণাবশত ঈশ্বও জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন না, কারণ জগৎ সৃষ্টির পূর্বে জীবের প্রতি করুণার প্রশ্নই ঊঠে না। আর যদি তিনি জীবের ভাবী কল্যাণের কথা ভেবে জগৎ সৃষ্টি করতেন, তাহলে জগতে বহুবিধ দুঃখের আবির্ভাব হতো না।
দ্বিতীয়ত, জগৎ সৃষ্টির মাধ্যমে ঈশ্বরের কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না, কারণ তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। পূর্ণ ঈশ্বরের কোন অপূর্ণ ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।
সুতরাং জীবের প্রতি করুণা বা ব্যক্তিগত কোন স্বার্থসিদ্ধি জগৎ সৃষ্টির প্রতি ঈশ্বরের প্রবৃত্তির নিয়ামক হতে পারে না।
.
(৩) ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলে তাঁকে পুরুষ রূপেই স্বীকার করতে হয়। কিন্তু ঈশ্বর মুক্ত বা বদ্ধ কোন পুরুষ রূপেই স্বীকৃত হতে পারেন না। তিনি যদি বদ্ধ পুরুষ হন, তাহলে তিনিও দুঃখ–ত্রয়ের অধীন হবেন। কিন্তু ঈশ্বর কখনো দুঃখের অধীন হতে পারেন না। আবার ঈশ্বর যদি মুক্ত হন তাহলে তাঁকে নিত্য–মুক্তই বলতে হয়। তিনি যদি নিত্য–মুক্তই হন, তাহলে জগতের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।
.
প্রাচীন সাংখ্যাচার্যদের উপরিউক্ত যুক্তির সাহায্যে বাচস্পতি মিশ্র, অনিরুদ্ধ প্রমুখ দার্শনিকরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী। এই মতে, অচেতন প্রকৃতি স্বভাববশেই জগৎ রূপে পরিণাম প্রাপ্ত হয়। তার এইরূপ স্বভাবের কারণ হলো পুরুষের ভোগ ও মোক্ষ সম্পাদন। গোবৎসের নিমিত্ত যেমন গাভীর দুগ্ধ ক্ষরণ হয়, তেমনি সাংখ্যকারিকার একবিংশ কারিকা অনুযায়ী– (‘পুরুষস্য দর্শনার্থং কৈবল্যার্থং তথা প্রধানস্য) পুরুষের ভোগ ও মোক্ষের নিমিত্তই প্রকৃতি পরিণাম প্রাপ্ত হয়। এই পরিণামের কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নেই।
.
ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি
সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যে কোন কোন আধুনিক ব্যাখ্যাকার ঈশ্বর সম্বন্ধে উপরিউক্ত নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যমত গ্রহণ করেন নি। যেমন– বিজ্ঞানভিক্ষুর মতে সাংখ্য ঈশ্বরবাদী। তিনি মনে করেন, সাংখ্যপ্রবচনসূত্রকার ঈশ্বরের নাস্তিত্বের কথা কোথাও বলেন নি। ঈশ্বরের নাস্তিত্বই যদি সূত্রকারের অভিপ্রেত হতো, তাহলে তিনি প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধির কথা না বলে সরাসরি ঈশ্বরের নাস্তিত্বের কথাই বলতেন। বিজ্ঞানভিক্ষুর মতে, সূত্রকারের বক্তব্য থেকে একথাই মনে হয় যে, সাংখ্য সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মতো জগৎস্রষ্টারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের বিরোধী।
.
ঈশ্বরবাদী সাংখ্যাচার্যদের মতে, ঈশ্বর হলেন আদি পুরুষ। পুরুষ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় জগৎ সৃষ্টি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তাঁরই ইচ্ছায় প্রকৃতির মধ্যে চাঞ্চল্য ঘটে এবং প্রকৃতি ক্রিয়াশীল হয়। চুম্বকের সান্নিধ্যে লৌহ যেমন চুম্বকধর্মবান বলে প্রতিভাত হয়, তেমনি চৈতন্যময় পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতিতে চেতনার প্রতিফলন ঘটে। এর ফলে প্রকৃতিতে চাঞ্চল্য দেখা দেয় এবং জগৎরূপে প্রকৃতির পরিণাম ঘটে। তাই প্রকৃতির গতিময়তার হেতুরূপে সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা যেতে পারে। তাছাড়া স্মৃতি ও শ্রুতি থেকেও ঈশ্বরের অস্তিত্বেও কথা জানতে পারা যায়।
(চলবে…)

সাংখ্যতত্ত্ব এক


সাংখ্যতত্ত্ব এক

অ্যাডমিন
 সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
বাদাবনের জ্ঞানকাণ্ডে যে দর্শন কে পৃথিবীর প্রথম দর্শন ও তার স্রষ্টা কে আদিযোগী বলা হয়েছে সেই মহর্ষি কপিল কে নিয়ে আমার কয়েক পর্ব লেখা চলবে। সাগরসঙ্গম এর অন্তিম সীমায় বাস করে সাঙ্খ্য যোগ এর স্রষ্টা মহর্ষি কপিল হলেন বাদাবন ও সাগরসঙ্গমের প্রথম তথা সারা পৃথিবীর আদি জ্ঞানী। বাদাবন থেকেই দুঃখবাদ এর উদ্ভব। এখানকার প্রকৃতি সর্বদা মানুষেকে জীবনযুদ্ধে ব্যাস্ত রাখে ও সাহসী করে তোলে। আজকের প্রথম পর্ব........
ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম সাংখ্যদর্শন বা সাংখ্যশাস্ত্রকে প্রাচীনতম ভারতীয় দর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহর্ষি কপিল হচ্ছেন এই দর্শনের সূত্রকার। তাই সাংখ্যকে কখনও কখনও কপিল–মত বা কপিল–দর্শন নামেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, কপিলের শিষ্য ছিলেন আসুরি এবং আসুরির শিষ্য ছিলেন পঞ্চশিখ। কথিত আছে যে, মুনি কপিল দুঃখে জর্জরিত মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর শিষ্য আসুরিকে পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান সাংখ্যশাস্ত্র প্রদান করেছিলেন। আসুরি সেই জ্ঞান পঞ্চশিখকে প্রদান করেন। এরপর পঞ্চশিখ–এর দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র নানাভাবে বহু শিষ্যের মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
পঞ্চশিখ–এর কাছ থেকে শিষ্যপরম্পরাক্রমে মুনি কপিল প্রণীত এই সাংখ্যশাস্ত্র ভালোভাবে জেনে ঈশ্বরকৃষ্ণ আর্য্যা ছন্দে ‘সাংখ্যকারিকা’ নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন, তা–ই এখন পর্যন্ত সাংখ্য সম্প্রদায়ের প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। সাংখ্যদর্শনের পরিচয় প্রসঙ্গে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেন–
‘এতৎ পবিত্রমগ্র্যাং মুনিরাসুরয়েহনুম্পয়া প্রদদৌ।
আসুরিরপি পঞ্চশিখায় তে চ বহুধা কৃতং তন্ত্রম্ ।। (সাংখ্যকারিকা–৭০)
অর্থাৎ: কপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞান) আসুরিকে প্রদান করেন, আসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেন) এবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখ) দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
.
সাংখ্যদর্শন কতোটা প্রাচীন তা নিয়ে বহুমত থাকলেও এর প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য শ্র“তি, স্মৃতি, পুরাণ ইত্যাদিতে সাংখ্য দর্শনের বহুল উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (আনুমানিক ২০০–১০০ খ্রিষ্টপূর্ব) কপিল একজন খ্যাতনামা ঋষি এবং সেই উপনিষদে তাঁর দর্শনের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। ভাগবতে কপিল মুনিকে চব্বিশজন অবতারের একজন বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তাঁর পিতার নাম কর্দম ঋষি এবং মাতার নাম দেবহুতি। আবার মহাভারতে কপিল ও আসুরির সাংখ্যমতের উল্লেখ পাওয়া যায় ভালোভাবেই। মহাভারতের শান্তিপর্বে আচারজ্ঞ পিতামহ ভীষ্মের জবানিতে সাংখ্যমত সম্পর্কিত যে দীর্ঘ উদ্ধৃতি রয়েছে, তার খানিকটা এরকম–
.
‘তত্র পঞ্চশিখো নাম কাপিলেয়ো মহামুনিঃ।
পরিধাবন্মহীং কৃৎস্নাং জগাম মিথিলামথ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৬)
অর্থাৎ : সেই সময়ে কপিলানাম্নী কোন ব্রাহ্মণীর পুত্র মহর্ষি পঞ্চশিখ সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করে পরে মিথিলানগরে এলেন।
.
ঋষীণামাহুরেকং যং কামাদবসিতং নৃষু।
শাশ্বতং সুখমত্যন্তমন্বিচ্ছন্তং সুদুর্ল্লভম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৮)
অর্থাৎ : সেই যে পঞ্চশিখ ঋষিদের মধ্যে অদ্বিতীয় ও মনুষ্যমধ্যে সকল কামনা থেকে বিরত ছিলেন এবং নিত্য, অত্যন্ত ও অতিদুর্লভ নির্বাণমুক্তি কামনা করতেন, তা সেকালের লোকেরা বলতো।
.
যমাহুঃ কপিলং সাংখ্যাঃ পরমর্ষিং প্রজাপতিম্ ।
স মন্যে তেন রূপেণ বিস্মাপয়তি হি স্বয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৯)
অর্থাৎ : সাংখ্যমতাবলম্বীরা যাঁকে মহর্ষি ও প্রজাপতি কপিল বলেন; আমি মনে করি, স্বয়ং সেই কপিলই পঞ্চশিখরূপে এসে জ্ঞানালোকের প্রভাবে সকল লোককে বিস্ময়াপন্ন করছেন; তাও তখন কেউ কেউ বলতো।
.
তমাসীনং সমাগম্য কাপিলং মণ্ডলং মহৎ।
পুরুষাবস্থমব্যক্তং পরমার্থং ন্যবেদয়ৎ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১১)
অর্থাৎ : একদা আসুরি আপন তপোবনে উপবিষ্ট ছিলেন; এমন সময়ে সাংখ্যমতাবলম্বী বহুতর মুনি সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে পুরুষরূপ অব্যক্ত, পরম পদার্থ বলবার জন্য নিবেদন করলেন।
.
যত্তদেকাক্ষরং ব্রহ্ম নানারূপং প্রদৃশ্যতে।
আসুরির্মণ্ডলে তস্মিন্ প্রতিপেদে তদব্যয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১৩)
অর্থাৎ : সেই যে একাক্ষরময় ব্রহ্ম নানাপ্রাণীতে নানারূপে দৃষ্ট হন, সেই অবিনশ্বর ব্রহ্মের বিষয় আসুরি সেই মুনিগণের নিকট বিস্তৃতরূপে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
.
এতন্মে ভগবানাহ কাপিলেয়স্য সম্ভবম্ ।
তস্য তৎ কাপিলেয়ত্বং সর্ববিত্ত্বমনুত্তমম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১৬)
অর্থাৎ : ভগবান্ মার্কণ্ডেয় এই পঞ্চশিখের উৎপত্তি এবং তাঁর কাপিলেয়ত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞত্ব বিষয় আমাকে বলেছিলেন।
.
মহাভারতে সাংখ্যমতের বিস্তৃত আলোচনা থেকে এ দর্শনের প্রভাব ও প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় অবশ্যই। অন্যদিকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের প্রাচীন সূত্রগ্রন্থ ‘চরক–সংহিতা’র দার্শনিক অনুক্রমে এই সাংখ্যশাস্ত্রেরই ভিত্তি পরিলক্ষিত হয়। যেমন–
‘সত্ত্বমাত্মা শরীরঞ্চ ত্রয়মেতাত্রিদণ্ডবৎ।
লোকন্তিষ্ঠতি সংযোগাৎ তত্র সর্ব্বং প্রতিষ্ঠিতম্ ।।
স পুমাং শ্চেতনং তচ্চ তচ্চাধিকরণং স্মৃতম্ ।
বেদস্যাস্য তদর্থংহি বেদোহয়ং সম্প্রকাশিতঃ।। (চরক–সংহিতা : প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠা–৬)
অর্থাৎ : মন, আত্মা ও শরীর– এরা ত্রিদণ্ডের ন্যায়। অর্থাৎ যেমন তিনটি দণ্ডের সংযোগে একটি ত্রিদণ্ড (ত্রিপদী বা তেপায়া) প্রস্তুত হয় এবং তার উপর দ্রব্যাদি রাখা যায়, তেমনি মন, আত্মা ও শরীরের সংযোগেই লোক সকল জীবিত রয়েছে এবং এই সংযোগের উপরই কর্মফল, বিষয়বাসনা সুখ, দুঃখ, জ্ঞানাজ্ঞান প্রভৃতি সবকিছু নির্ভর করছে। এদের সংযুক্ত অবস্থাকেই পুরুষ বলে। এই পুরুষই চেতন, তিনিই সুখ দুঃখাদির আধার এবং এরই জন্য এই আয়ুর্বেদ প্রকাশিত হয়েছে।
.
বৈদিক সংস্কৃতিতে সকল শাস্ত্রের সার বলে কথিত প্রাচীন মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতায়ও সাংখ্যদর্শনের প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়। মূলত মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের দার্শনিক প্রপঞ্চটাই সংখ্যদর্শন ভিত্তিক। যেমন–
‘তেষামিদন্তু সপ্তানাং পুরুষাণাং মহৌজসাম্ ।
সূক্ষ্মাভ্যো মূর্তিমাত্রাভ্যঃ সম্ভবত্যব্যয়াদ্ব্যয়ম্ ।। (মনুসংহিতা : ১/১৯)
অর্থাৎ : মহত্ত্ব, অহঙ্কারতত্ত্ব এবং পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটি অনন্তকার্যক্ষম শক্তিশালী পুরুষতুল্য পদার্থের সূক্ষ্ম মাত্রা থেকে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে; অবিনাশী পুরুষ (পরমাত্মা) থেকে এই রকম অস্থির জগতের উৎপত্তি হয়েছে।
.
আদ্যাদ্যস্য গুণং ত্বেষামবাপ্নোতি পরঃ পরঃ।
যো যো যাবতিথশ্চৈষাং স স তাব˜গুণঃ স্মৃতঃ।। (মনুসংহিতা : ১/২০)
অর্থাৎ : আকাশাদি পঞ্চভূতের মধ্যে পর–পর প্রত্যেকে পূর্ব–পূর্বের গুণ গ্রহণ করে। এদের মধ্যে যে সৃষ্টিক্রমে যে স্থানীয়, সে ততগুলি গুণ পায়। –প্রথম ভূত আকাশের ১ গুণ,- শব্দ। দ্বিতীয় ভূত বায়ুর ২ গুণ,- শব্দ ও স্পর্শ। তৃতীয় ভূত অগ্নির ৩ গুণ– শব্দ, স্পর্শ এবং রূপ। চতুর্থ ভূত জলের ৪ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ এবং রস। পঞ্চম ভূত পৃথিবীর ৫ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধ।
.
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের বিখ্যাত প্রামাণিক গ্রন্থ কৌটিল্য প্রণীত ‘অর্থশাস্ত্র’–এ সাংখ্যদর্শনের প্রশস্তি দেখা যায়। কৌটিল্য সাংখ্যশাস্ত্রকে অনুমোদিত বিদ্যাচতুষ্টয়ের অন্যতম আন্বীক্ষিকীর অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন–
‘সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অর্থাৎ : সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত– এই তিনটি শাস্ত্র উক্ত আন্বীক্ষিকী–বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
.
কৌটিল্যের এই বিদ্যাচতুষ্টয় হলো–
‘আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)।
অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্–যজুঃ–সামবেদাত্মক বেদ–বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।
.
কৌটিল্যের মতে আন্বীক্ষিকী সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ–
প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।
.
এসব প্রাচীন সাহিত্যে সাংখ্যমতের বহুতর উল্লেখ থেকে অনুমান করাটা অসম্ভব নয় যে, অন্তত খ্রিষ্টপূর্ব চারশ বছরের পূর্ব থেকেই ভারতীয় দর্শন জগতে সাংখ্যদর্শনের জোরালো উপস্থিতি ছিলো। এবং প্রাচীন পুঁথিপত্রে এ–দর্শনের প্রভাব এতো ব্যাপক ও বিশাল যে, সাংখ্যমতের পেছনে অতি সুদীর্ঘ যুগের ঐতিহ্য স্বীকার না করলে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। ফলে সাংখ্যদর্শনকে খুবই প্রাচীন বলে স্বীকার করা অমূলক হবে না। আধুনিক বিদ্বানদের কেউ কেউ সাংখ্যকে গৌতম বুদ্ধের চেয়ে অনেক প্রাচীন কালের দর্শন বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাঁদের মতে সাংখ্য–সম্প্রদায়ের প্রবর্তক কপিলের নাম থেকেই বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর নামকরণ হয়েছিলো।
(চলবে…)
ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম সাংখ্যদর্শন বা সাংখ্যশাস্ত্রকে প্রাচীনতম ভারতীয় দর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহর্ষি কপিল হচ্ছেন এই দর্শনের সূত্রকার। তাই সাংখ্যকে কখনও কখনও কপিল–মত বা কপিল–দর্শন নামেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, কপিলের শিষ্য ছিলেন আসুরি এবং আসুরির শিষ্য ছিলেন পঞ্চশিখ। কথিত আছে যে, মুনি কপিল দুঃখে জর্জরিত মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর শিষ্য আসুরিকে পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান সাংখ্যশাস্ত্র প্রদান করেছিলেন। আসুরি সেই জ্ঞান পঞ্চশিখকে প্রদান করেন। এরপর পঞ্চশিখ–এর দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র নানাভাবে বহু শিষ্যের মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
পঞ্চশিখ–এর কাছ থেকে শিষ্যপরম্পরাক্রমে মুনি কপিল প্রণীত এই সাংখ্যশাস্ত্র ভালোভাবে জেনে ঈশ্বরকৃষ্ণ আর্য্যা ছন্দে ‘সাংখ্যকারিকা’ নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন, তা–ই এখন পর্যন্ত সাংখ্য সম্প্রদায়ের প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। সাংখ্যদর্শনের পরিচয় প্রসঙ্গে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেন–
‘এতৎ পবিত্রমগ্র্যাং মুনিরাসুরয়েহনুম্পয়া প্রদদৌ।
আসুরিরপি পঞ্চশিখায় তে চ বহুধা কৃতং তন্ত্রম্ ।। (সাংখ্যকারিকা–৭০)
অর্থাৎ: কপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞান) আসুরিকে প্রদান করেন, আসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেন) এবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখ) দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
.
সাংখ্যদর্শন কতোটা প্রাচীন তা নিয়ে বহুমত থাকলেও এর প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য শ্র“তি, স্মৃতি, পুরাণ ইত্যাদিতে সাংখ্য দর্শনের বহুল উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (আনুমানিক ২০০–১০০ খ্রিষ্টপূর্ব) কপিল একজন খ্যাতনামা ঋষি এবং সেই উপনিষদে তাঁর দর্শনের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। ভাগবতে কপিল মুনিকে চব্বিশজন অবতারের একজন বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তাঁর পিতার নাম কর্দম ঋষি এবং মাতার নাম দেবহুতি। আবার মহাভারতে কপিল ও আসুরির সাংখ্যমতের উল্লেখ পাওয়া যায় ভালোভাবেই। মহাভারতের শান্তিপর্বে আচারজ্ঞ পিতামহ ভীষ্মের জবানিতে সাংখ্যমত সম্পর্কিত যে দীর্ঘ উদ্ধৃতি রয়েছে, তার খানিকটা এরকম–
.
‘তত্র পঞ্চশিখো নাম কাপিলেয়ো মহামুনিঃ।
পরিধাবন্মহীং কৃৎস্নাং জগাম মিথিলামথ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৬)
অর্থাৎ : সেই সময়ে কপিলানাম্নী কোন ব্রাহ্মণীর পুত্র মহর্ষি পঞ্চশিখ সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করে পরে মিথিলানগরে এলেন।
.
ঋষীণামাহুরেকং যং কামাদবসিতং নৃষু।
শাশ্বতং সুখমত্যন্তমন্বিচ্ছন্তং সুদুর্ল্লভম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৮)
অর্থাৎ : সেই যে পঞ্চশিখ ঋষিদের মধ্যে অদ্বিতীয় ও মনুষ্যমধ্যে সকল কামনা থেকে বিরত ছিলেন এবং নিত্য, অত্যন্ত ও অতিদুর্লভ নির্বাণমুক্তি কামনা করতেন, তা সেকালের লোকেরা বলতো।
.
যমাহুঃ কপিলং সাংখ্যাঃ পরমর্ষিং প্রজাপতিম্ ।
স মন্যে তেন রূপেণ বিস্মাপয়তি হি স্বয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৯)
অর্থাৎ : সাংখ্যমতাবলম্বীরা যাঁকে মহর্ষি ও প্রজাপতি কপিল বলেন; আমি মনে করি, স্বয়ং সেই কপিলই পঞ্চশিখরূপে এসে জ্ঞানালোকের প্রভাবে সকল লোককে বিস্ময়াপন্ন করছেন; তাও তখন কেউ কেউ বলতো।
.
তমাসীনং সমাগম্য কাপিলং মণ্ডলং মহৎ।
পুরুষাবস্থমব্যক্তং পরমার্থং ন্যবেদয়ৎ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১১)
অর্থাৎ : একদা আসুরি আপন তপোবনে উপবিষ্ট ছিলেন; এমন সময়ে সাংখ্যমতাবলম্বী বহুতর মুনি সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে পুরুষরূপ অব্যক্ত, পরম পদার্থ বলবার জন্য নিবেদন করলেন।
.
যত্তদেকাক্ষরং ব্রহ্ম নানারূপং প্রদৃশ্যতে।
আসুরির্মণ্ডলে তস্মিন্ প্রতিপেদে তদব্যয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১৩)
অর্থাৎ : সেই যে একাক্ষরময় ব্রহ্ম নানাপ্রাণীতে নানারূপে দৃষ্ট হন, সেই অবিনশ্বর ব্রহ্মের বিষয় আসুরি সেই মুনিগণের নিকট বিস্তৃতরূপে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
.
এতন্মে ভগবানাহ কাপিলেয়স্য সম্ভবম্ ।
তস্য তৎ কাপিলেয়ত্বং সর্ববিত্ত্বমনুত্তমম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১৬)
অর্থাৎ : ভগবান্ মার্কণ্ডেয় এই পঞ্চশিখের উৎপত্তি এবং তাঁর কাপিলেয়ত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞত্ব বিষয় আমাকে বলেছিলেন।
.
মহাভারতে সাংখ্যমতের বিস্তৃত আলোচনা থেকে এ দর্শনের প্রভাব ও প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় অবশ্যই। অন্যদিকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের প্রাচীন সূত্রগ্রন্থ ‘চরক–সংহিতা’র দার্শনিক অনুক্রমে এই সাংখ্যশাস্ত্রেরই ভিত্তি পরিলক্ষিত হয়। যেমন–
‘সত্ত্বমাত্মা শরীরঞ্চ ত্রয়মেতাত্রিদণ্ডবৎ।
লোকন্তিষ্ঠতি সংযোগাৎ তত্র সর্ব্বং প্রতিষ্ঠিতম্ ।।
স পুমাং শ্চেতনং তচ্চ তচ্চাধিকরণং স্মৃতম্ ।
বেদস্যাস্য তদর্থংহি বেদোহয়ং সম্প্রকাশিতঃ।। (চরক–সংহিতা : প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠা–৬)
অর্থাৎ : মন, আত্মা ও শরীর– এরা ত্রিদণ্ডের ন্যায়। অর্থাৎ যেমন তিনটি দণ্ডের সংযোগে একটি ত্রিদণ্ড (ত্রিপদী বা তেপায়া) প্রস্তুত হয় এবং তার উপর দ্রব্যাদি রাখা যায়, তেমনি মন, আত্মা ও শরীরের সংযোগেই লোক সকল জীবিত রয়েছে এবং এই সংযোগের উপরই কর্মফল, বিষয়বাসনা সুখ, দুঃখ, জ্ঞানাজ্ঞান প্রভৃতি সবকিছু নির্ভর করছে। এদের সংযুক্ত অবস্থাকেই পুরুষ বলে। এই পুরুষই চেতন, তিনিই সুখ দুঃখাদির আধার এবং এরই জন্য এই আয়ুর্বেদ প্রকাশিত হয়েছে।
.
বৈদিক সংস্কৃতিতে সকল শাস্ত্রের সার বলে কথিত প্রাচীন মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতায়ও সাংখ্যদর্শনের প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়। মূলত মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের দার্শনিক প্রপঞ্চটাই সংখ্যদর্শন ভিত্তিক। যেমন–
‘তেষামিদন্তু সপ্তানাং পুরুষাণাং মহৌজসাম্ ।
সূক্ষ্মাভ্যো মূর্তিমাত্রাভ্যঃ সম্ভবত্যব্যয়াদ্ব্যয়ম্ ।। (মনুসংহিতা : ১/১৯)
অর্থাৎ : মহত্ত্ব, অহঙ্কারতত্ত্ব এবং পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটি অনন্তকার্যক্ষম শক্তিশালী পুরুষতুল্য পদার্থের সূক্ষ্ম মাত্রা থেকে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে; অবিনাশী পুরুষ (পরমাত্মা) থেকে এই রকম অস্থির জগতের উৎপত্তি হয়েছে।
.
আদ্যাদ্যস্য গুণং ত্বেষামবাপ্নোতি পরঃ পরঃ।
যো যো যাবতিথশ্চৈষাং স স তাব˜গুণঃ স্মৃতঃ।। (মনুসংহিতা : ১/২০)
অর্থাৎ : আকাশাদি পঞ্চভূতের মধ্যে পর–পর প্রত্যেকে পূর্ব–পূর্বের গুণ গ্রহণ করে। এদের মধ্যে যে সৃষ্টিক্রমে যে স্থানীয়, সে ততগুলি গুণ পায়। –প্রথম ভূত আকাশের ১ গুণ,- শব্দ। দ্বিতীয় ভূত বায়ুর ২ গুণ,- শব্দ ও স্পর্শ। তৃতীয় ভূত অগ্নির ৩ গুণ– শব্দ, স্পর্শ এবং রূপ। চতুর্থ ভূত জলের ৪ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ এবং রস। পঞ্চম ভূত পৃথিবীর ৫ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধ।
.
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের বিখ্যাত প্রামাণিক গ্রন্থ কৌটিল্য প্রণীত ‘অর্থশাস্ত্র’–এ সাংখ্যদর্শনের প্রশস্তি দেখা যায়। কৌটিল্য সাংখ্যশাস্ত্রকে অনুমোদিত বিদ্যাচতুষ্টয়ের অন্যতম আন্বীক্ষিকীর অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন–
‘সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অর্থাৎ : সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত– এই তিনটি শাস্ত্র উক্ত আন্বীক্ষিকী–বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
.
কৌটিল্যের এই বিদ্যাচতুষ্টয় হলো–
‘আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)।
অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্–যজুঃ–সামবেদাত্মক বেদ–বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।
.
কৌটিল্যের মতে আন্বীক্ষিকী সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ–
প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।
.
এসব প্রাচীন সাহিত্যে সাংখ্যমতের বহুতর উল্লেখ থেকে অনুমান করাটা অসম্ভব নয় যে, অন্তত খ্রিষ্টপূর্ব চারশ বছরের পূর্ব থেকেই ভারতীয় দর্শন জগতে সাংখ্যদর্শনের জোরালো উপস্থিতি ছিলো। এবং প্রাচীন পুঁথিপত্রে এ–দর্শনের প্রভাব এতো ব্যাপক ও বিশাল যে, সাংখ্যমতের পেছনে অতি সুদীর্ঘ যুগের ঐতিহ্য স্বীকার না করলে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। ফলে সাংখ্যদর্শনকে খুবই প্রাচীন বলে স্বীকার করা অমূলক হবে না। আধুনিক বিদ্বানদের কেউ কেউ সাংখ্যকে গৌতম বুদ্ধের চেয়ে অনেক প্রাচীন কালের দর্শন বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাঁদের মতে সাংখ্য–সম্প্রদায়ের প্রবর্তক কপিলের নাম থেকেই বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর নামকরণ হয়েছিলো।
(চলবে…)