সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭

ঋগ্বেদের নদীসমূহ


ঋগ্বেদের নদীসমূহ                     প্রবন্ধটি ভাগ করে দিলাম !                            প্রণব কুমার কুণ্ডু।

ঋগ্বেদীয় নদীসমূহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নদী হিসাবে, সপ্তসিন্ধু ("সাত নদী")  (সংস্কৃত: सप्ता सिंधू),[১],  ঋগ্বেদের স্তবগানে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে, এবং এর ফল,  প্রারম্ভিক বৈদিক ধর্মে অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি পুরোনো  আদি-ইন্দো-ইরানীয় ভাযা থেকে প্রাপ্ত হতে পারে, যার একটি সমজাতীয় নাম হিসাবে, হপ্তা হেন্দুআবেস্তীয় ভাষায় যা বিদ্যমান।

পরিচ্ছেদসমূহ

পুরাণ

যজুর্বেদের একটি আবৃত্ত বিষয় হল যে ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে (আক্ষরিক অর্থ "বাধা") হনন করেন, নদীর মুক্তিদান করেন; বৈকল্পিক শ্রুতিতে, ইন্দ্র "ভালা গুহা" ধ্বংস করে, তার মধ্যে আবদ্ধ গরু-দের মুক্তি প্রদান করেন। যদিও দুইটি শ্রুতি পৃথক,[২],  তবে নদী ও গরু প্রায়ই কাব্যিকভাবে ঋগ্বেদে পরম্পর সম্পর্কযুক্ত করা হয়, উদাহরণ হিসাবে ৩।৩৩ শ্লোকে, ভারত উপজাতির রথ ও শকট-এর দুই স্ফীত নদী পারাপারের বর্ণনা একটি উল্লেখযোগ্য গান, ৩।৩৩।১ শ্লোকে যেমন দুই উজ্জ্বল গাভী মাতা,  যারা তাদের কচি শাবকদের লেহন করছে, বিপাশা এবং সুতুদ্রি  তাদের জলের গতি মন্থর করে দিচ্ছে।[৩]

সপ্তসিন্ধু

সপ্তসিন্ধু হল সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে অনিশ্চিত বা পরিবর্তনশীল সাতটি প্রধান নদীর একটি জোট (জোটের সঠিক সদস্যদের চেয়ে সাত সংখ্যাটির অনেক বেশি গুরুত্ব রয়েছে), যা আবেস্তার সপ্তর্ষির সঙ্গে তুলনীয় (এবং পরে সাত সমুদ্রপথ এবং সাত স্থানের সঙ্গে)। আবেস্তার হপ্তা হেন্দু মোটামুটিভাবে  বৈদিক সপ্ত সিন্ধভ-এর  সঙ্গে সমান ভাবে সমার্থক বা মুখোমুখি হয়: ভেংদিদাদ-এর ১।৮-এ বর্ণিত যে ষোলটি জমির মধ্যে পঞ্চদশটি মজ্দা দ্বারা নির্মিত।[৪]

সাত নদীর পরিচয়

এটা সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার না কিভাবে সাত নদীকে গাণিতিক করার উদ্দেশ্য করা হয়। সেগুলো প্রায়ই উত্তর ভারত / বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। যদি সরস্বতী  এবং পাঞ্জাবের পাঁচটি প্রধান নদী অন্তর্ভুক্ত করা হয় (সুতুদ্রি, পরুশনী, অশিকনি, বিতস্তা ও বিপাশা, আধুনিককালে সব সিন্ধুর উপনদী), দেখা যায় একটি নদী অনুপস্থিত, সম্ভবত সেটি হল কূভা (সিন্ধু একটি বিশেষ ক্ষেত্র, যার স্ত্রীলিঙ্গ বা পুংলিঙ্গ উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োগ হয়)। অন্যান্য সম্ভাবনার মধ্যে আর্জিকিয়া বা সুষমা অন্তর্ভুক্ত; ঋগ্বেদের ১০।৭৫ শ্লোকে, নদীস্তুতি সুক্ততে, সিন্ধুর পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে, এছাড়াও দশটি নদীর তালিকাও তুলনীয়। ৬।২১।১০ শ্লোকে, সরস্বতী নদীকে "সাত বোন সঙ্গে তিনি" (সপ্তস্বসা) বলে আটটি নদীর একটি জোটকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, সংখ্যা সাত ব্যক্তি সদস্যদের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ (এছাড়াও আবেস্তীয় সপ্তর্ষি, হপ্তা কর্সূয়ার / হাফ্ত্‍ কেশ্বর দেখুন), তাই সপ্তসিন্ধুর তালিকা সংশোধনীয় বা অপরিবর্তনীয় কোনটাই নয়। ঋগ্বেদের ১০।৬৪।৮ এবং ১০।৭৫।১ শ্লোকে, সাতটি নদীর তিনটি জোট উল্লেখ করা হয় ("সাতটি তিনবার বিচরিত নদী"), ৯৯টি নদীর মত। সপ্তসিন্ধু অঞ্চল পূর্বদিকে সরস্বতী দ্বারা, পশ্চিমে সিন্ধু এবং মধ্যে সুতুদ্রি, বিপাশা, অশিকনি, পরুশনী এবং বিতস্তা এই পাঁচটি দ্বারা বেষ্টিত ছিল।
সব গবেষক এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হন না।  বই,  "ল্যন্ড অফ দি সেভেন রিভার্স"-এ, লেখক,  শ্রীসঞ্জীব সান্যাল যুক্তি দিয়েছেন যে সপ্তসিন্ধু বলতে শুধুমাত্র সরস্বতী এবং তার নিজস্ব উপনদী বোঝায়। যদি সান্যাল ঠিক হয়, সপ্তসিন্ধু অঞ্চল বলতে শুধুমাত্র হরিয়ানা এবং উত্তর রাজস্থান সহ একটি ছোট অংশ বোঝায় কিন্তু পাঞ্জাবের বেশীরভাগ এলাকা বাদ চলে যায়। তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সপ্তসিন্ধু ঋগ্বেদের ভূখণ্ডের শুধুমাত্র একটি ছোট উপবিভাগ এবং এটা বিজয়ী ভারত ত্রুত্সু উপজাতির মূল স্বদেশ হওয়ার ফলস্বরূপ এর অনুপাতহীন গুরুত্ব আহরিত হয়েছে।

ঋগ্বেদের ভূগোল


ঋগ্বেদের ভূগোল; সোয়াত এবং সমাধিক্ষেত্র এইচ সংস্কৃতির পরিমাণ নির্দেশ করা হয়েছে
একমাত্র ঋগ্বেদের নদী সনাক্তকরণই প্রথম দিকের বৈদিক সভ্যতার ভূগোল প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। নির্দিষ্ট শনাক্তকরণযুক্ত নদীকে পূর্ব আফগানিস্তান থেকে পশ্চিম গাঙ্গেয় সমভূমি পর্যন্ত প্রসারিত করুন, পাঞ্জাবের জোট অবধি (পাঁচটি জল (নদীসমূহ))। কিছু কিছু নদীর নাম ঘুরে ফিরে সাধারণ ইন্দো-ইরানীয় নদীতে প্রদর্শিত, আবেস্তীয় সমানজাতীয় নদীর নামের সাথে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সরস্বতী (আবেস্তীয় হরক্ষবাইতি, ফার্সি হারা(জ)উবতি) এবং সরযূ (ইরানীয় হরয়ু, আবেস্তীয় হরইইউম, ফার্সি হরে)।
পাঞ্জাবের কেন্দ্রীয় বৈদিক হৃদয়ভূমি থেকে পূর্বদিকে বাহিত বৈদিক সংস্কৃতি কেন্দ্রের অনেক নদীর নাম দেখা যেতে পারে যা অন্যান্য নদীতে পুনরায় প্রয়োগ করা হয়েছে। "নদীস্তুতি সুক্ত" (১০।৭৫)-কে ধন্যবাদ, যাতে নদীর একটি ভৌগোলিক ভিত্তিক তালিকা রয়েছে, ফলস্বরূপ ঋগ্বেদের সর্বশেষ ধাপের জন্য একটি পরিষ্কার ছবি স্থাপন করা সম্ভব। ঋগ্বেদে বিশিষ্ট নদী হল সিন্ধু,  পরবর্তী, সরস্বতী। ঋগ্বেদের সরস্বতী নদী সাধারণত বর্তমানের "ঘগ্গর হকরা" নদীর সঙ্গে চিহ্নিত করা হয়, যদিও "হেলমান্দ নদী" প্রথম দিকের ঋগ্বেদের তথ্য অনুযায়ী একটি সম্ভাব্য স্থান কিনা তাই নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এটা মাঝে মাঝে বৈদিক আর্যরা তাদের প্রথম আবাসস্থল সেইস্তান (এরাকোজিয়া, আবেস্তীয় হারইউয়া) থেকে অনুমিত অবস্থান, সিন্ধু সমতলের মধ্যে গান্ধার এবং পূর্ব আফগানিস্তান এবং তার পরেও পরিবর্তনের জন্যে বলে আরোপিত হয়, যদিও তেমন অবস্থান পরিবর্তনের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। অন্যদিকে বি॰বি॰ লাল-এর মত প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন সিন্ধু অববাহিকা থেকে কিছু ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর বিপরীত পশ্চিমাভিমুখী অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা হিসেবে এবং একই সঙ্গে উপমহাদেশের বাইরের অনুপ্রবেশের জন্য কোনো নির্দিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অভাব।[৫]

তালিকা

নিম্নলিখিত তালিকায় ভৌগলিক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতির সময়ে, এটা মনে রাখতে হবে যে ঋগ্বেদ রচনার সময় প্রথম দিকে এবং শেষের স্তবগানে উভয় স্থানে উপস্থিত কিছু নাম পুনরায় প্রয়োগ করা হয়েছে যা ঋগ্বেদের রচনা অনুযায়ী নতুন নদী হিসাবে গণ্য করতে হবে।

জালালাবাদের কাছাকাছি কাবুল নদী

খাইবার পাখতুনখাওয়ার সোয়াত নদী

আফগানিস্তানের হরি নদী বা হরিরুদ
উত্তর পশ্চিম নদীসমূহ (সিন্ধুর পশ্চিম উপনদীসমূহ):
  • ত্রস্তম্ (গিলগিট)?
  • সুসার্তু
  • অনীতাভ (একবার তালিকাভুক্ত, ৫।৫৩।৯ তে, আফগান নদী রসা (আবেস্তীয় রঙ্ঘ/রনহা), কূভা, ক্রূমু, সরযূ (আবেস্তীয় হরইউ) সাথে)
  • রসা (সিন্ধুর উপরভাগে (প্রায় একটি কাল্পনিক নদী, আবেস্তীয় রঙ্ঘ, স্ক্যথিয়ান রা্)
  • শ্বেত্যা
  • কূভা (কাবুল), গ্রিক কফেণ
  • ক্রূমু (কুররা্ম)
  • মেহত্‍নু (গোমতী এবং ক্রূমু সহ)
  • সুবস্তু (সোয়াত) ঋগ্বেদ ৮।১৯।৩৭ এ)
  • গৌরী (পঞ্জকরা)??
  • কুসভা (কুনার)??
সিন্ধু এবং এর গৌণ পূর্বদিকের উপনদীসমূহ:
মধ্য নদীসমূহ (পাঞ্জাবের নদীসমূহ):
পূর্ব-মধ্য নদীসমূহ (হরিয়ানার নদীসমূহ):
  • সরস্বতী (ঋগ্বেদের মধ্যে উল্লেখিত সরস্বতী নদীকে বর্তমানের ঘগ্গর হকরা নদী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, যদিও প্রারম্ভিক ঋগ্বেদের সুত্রে একটি সম্ভাব্য স্থান হিসেবে অর্ঘণ্ডব নদী (হেলমান্দ নদীর একটি উপনদী) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।)
  • দ্র্শাদ্বতি, অপয় (ঋগ্বেদ ৩।২৩।৪, মহাভারত অপগা।)
পূর্ব নদীসমূহ:
অনিশ্চিত / অন্যান্য

পাদটীকা




  • e.g. RV 2.12; RV 4.28; RV 8.24

  • আরও দেখুন

    তথ্যসূত্র

    • S.C. Sharma. 1974. The description of the rivers in the Rig Veda. The Geographical Observer, 10: 79-85.
    • Michael Witzel, Tracing the Vedic dialects in Dialectes dans les litteratures Indo-Aryennes ed. Caillat, Paris, 1989, 97–265.
    • Gherardo Gnoli, De Zoroastre à Mani. Quatre leçons au Collège de France (Travaux de l’Institut d’Études Iraniennes de l’Université de la Sorbonne Nouvelle 11), Paris (1985)
    • Shrikant G. Talageri, The Rigveda, a historical analysis, Aditya Prakashan, New Delhi (chapter 4)

    অবতার কাহিনী

    মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন-এর লেখা ভাগ করে দিলাম !                                     প্রণব কুমার কুণ্ডু।



    অবতার কাহিনী



    মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন



    সনাতন ধর্মাবলম্বী শৈব বা শিবের অনুসারী, বৈষ্ণব বা বিষ্ণুর অনুসারী এবং কতিপয় সম্প্রদায়ের অনুসারীরা বিশ্বাস করে, সৃষ্টি বিনাশোন্মুখ হলে বা পৃথিবীতে অধর্ম-অনাচার-পাপ বৃদ্ধি পেলে ভগবান যুগে যুগে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন এবং সৃষ্টিকে ধ্বংস হতে রক্ষা করেন ও মানুষকে রক্ষা এবং মোক্ষ লাভ করতে সাহায্য করেন। পৃথিবীতে অবতীর্ণ ভগবানের বিভিন্ন পার্থিব রূপই ‘অবতার’।
    ৭. “যদা যদা হি ধর্মস্য, গ্লানির ভবতি ভারত অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মনম সৃযামি অহম ৮. পরিত্রাণায় সাধুনাম বিন্যাস্য চ দুস্কৃতাম ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগয় যুগয়।” ভগবত গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের সপ্তম ও অষ্টম স্তোত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সখা ভারতকে (অর্জুন) বলছেন,‘যখনই পৃথিবীতে ধর্মের অবক্ষয় ঘটে, অধর্মের গ্লানি বৃদ্ধি পায়; তখনই আমি ধর্ম সংস্থাপনের জন্য এবং দুস্কৃতকারীদের বিনাশের জন্য যুগে যুগে (পৃথিবীতে) অবতীর্ণ হই।’ ‘অবতরণ করি’ বা ‘অবতীর্ণ হই’ বর্ণনা হতে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা ‘অবতার’ অর্থে বুঝে থাকেন, স্রষ্টা বা ভগবান যুগে যুগে যুগসন্ধিক্ষণে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন বা জন্মগ্রহণ করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ব্রহ্মা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তথা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু বিশ্বজগৎ রক্ষা করেন এবং শিব বিশ্বজগৎ ধ্বংস করেন। এই তিনে মিলে ভগবানের ত্রিমূর্তি। তিন জনের তিন গুণ- রজঃ (আবেগ/আসক্তি), সত্ত্ব (জ্ঞান/ধর্ম) ও তমঃ (অজ্ঞান/অধর্ম)। এই তিন সত্তাই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতে পারেন। গুণভিত্তিক অবতারগণই হলেন ‘গুণাবতার’। অবতার সম্পর্কে ঋগে¦দে এই মর্মে একটি ইঙ্গিত রয়েছে, অজেয় রক্ষাকর্তা বিষ্ণু তিন পদক্ষেপে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিভ্রমণ করেন। বৈদিক ভাষ্যকাররা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বলতে ভূমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল এবং নভোমণ্ডলের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এই ব্যাখ্যা মতে, বিষ্ণু পৃথিবীতে অগ্নিমূর্তি, বায়ুতে বজ্র মূর্তি এবং অন্তরীক্ষে আলোকমূর্তি ধারণ করেন। কিন্তু ভাষ্যকার সায়নের মতে, ‘তিন পদক্ষেপ’ বলতে বরাহ অবতাররূপী বিষ্ণুর তিন পদক্ষেপ বোঝায়। তবে অবতার বিষয়ক সব ধারণা বা বিশ্বাস বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিশ্বাসই সর্বাধিক জনপ্রিয়, অর্থাৎ বিষ্ণুই যুগে যুগে অবতাররূপে পৃথিবীতে আগমন করেছেন। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে, বিষ্ণুর অবতার দশজন- ‘দশাবতার’। মৎস্য অবতার শতপথ ব্রাহ্মণ এবং মৎস্য পুরাণে বলা হয়েছে, জগৎপালক বিষ্ণু সত্যযুগে মৎস্য রূপ ধারণ করে প্রথম অবতাররূপে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। মৎস্য পুরাণের কাহিনী মতে, সত্যযুগে দ্রাবিড় রাজা সত্যব্রত একজন বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। পরে রাজা সত্যব্রতকে আদিপুরুষ মনু বলে গণ্য করা হয়। কথিত আছে, একদিন নদীতে হস্ত ধৌত করার সময় একটি ক্ষুদ্র মৎস্য পোনা মনুর হস্তোপরে উঠে এসে জীবনরক্ষার্থে আশ্রয় প্রার্থনা করে। মনু তাকে একটি ক্ষুদ্র হাঁড়িতে রেখে দেন। অচিরেই মৎস্যটির দেহাবয়ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। মনু মৎস্যটিকে হাঁড়ি থেকে পুকুরে, পুকুর থেকে নদীতে, নদী থেকে সাগরে অবমুক্ত করেন। সাগরে অবমুক্তির পর মৎস্যটি মনুকে স্বীয় পরিচয় দান করে। এই মৎস্য সাধারণ মৎস্য নন; তিনি হলেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। বিমূঢ় সত্যব্রতের প্রশ্নের উত্তরে ভগবান বিষ্ণু জানালেন, মহাপ্লাবনরূপী এক মহাপ্রলয় হতে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য তিনি মৎস্য রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। ‘আমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে রক্ষা এবং দুষ্টের দমনের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ করেছি। এখন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে সিন্ধুর জলরাশি বৃদ্ধি পেতে পেতে সপ্তদিবসান্তে সমগ্র পৃথিবীকে জলমগ্ন করবে। তখন একটি বিশাল তরী তোমার কাছে এসে ভিড়বে।
    পরবর্তীকালে পুনঃসৃষ্টির প্রয়োজনে পশুপাখিসহ প্রাণিজগতের প্রতিটি প্রজাতির নারী-পুরুষের একটি করে জোড় নমুনা, সর্বপ্রকার বনৌষধি, সর্বপ্রকার বীজ, নাগরাজ বাসুকী এবং সাতজন ঋষিসহ ঐ তরীতে আশ্রয় গ্রহণ করে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।’ সত্যব্রতকে এই আদেশ দান করে মহাপ্রভু বিষ্ণু হয়গ্রীবা অসুরের কবল থেকে বেদ রক্ষার্থে অন্তর্ধান করেন। প্রসঙ্গক্রমে মৎস্য পুরাণের একটি কাহিনী উল্লেখ করতে হয়। বলা হয়, মহাঅস্তিত্বের একটি ‘কল্প’ অতিবাহিত হতে ৪৩২ কোটি বছর সময় লাগে। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার একটি দিবস একটি কল্পের সমান। একটি কল্প বা ব্রহ্মার একটি দিবস অতিবাহিত হওয়ার পর ব্রহ্মা নিদ্রাভিভূত হন। ব্রহ্মা নিদ্রাভিভূত হলে বেদচতুষ্টয় ব্যতীত অন্য সব সৃষ্টি বিলুপ্ত হয়। বেদচতুষ্টয় ব্রহ্মার দেহাভ্যন্তরে অবস্থান করে এবং সেই কারণে বেদগুলো পরিবর্তন করা যায় না ও ধ্বংস হয় না। বেদচতুষ্টয়ের মধ্যে সৃষ্টি বিষয়ক সূত্রাবলি বিদ্যমান বিধায় সৃষ্টি প্রক্রিয়া চলমান রাখার জন্য বেদ অপরিহার্য। কোন এক কল্পে নিদ্রাবিষ্ট হয়ে হাই তোলার সময় বেদচতুষ্টয় তার মুখগহ্বর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়। ওই সময়ে হয়গ্রীবা নামের এক অসুর অমরত্ব লাভের আশায় বেদচতুষ্টয় কুক্ষিগত করে। হয়গ্রীবা অসুরের দেহ ছিল মানুষের মতো এবং মুখমণ্ডল ছিল ‘হয়’ বা অশ্বের গ্রীবার মতো। মৎস্যাবতাররূপী বিষ্ণু তখন নিদ্রার ভান করে বেদচুরির সমগ্র ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন এবং হয়গ্রীবাকে বধ করে বেদচতুষ্টয় পুনরুদ্ধার করেন। অন্য এক ভাষ্যমতে, বিষ্ণু নিজেই সাগরে ভাসমান বেদচতুষ্টয় আত্মসাৎকারী দু’জন দৈত্যের কবল হতে উদ্ধার করেন।
    মৎস্য অবতারের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে সপ্তাহান্তে পৃথিবী মহাপ্লাবনে নিমজ্জিত হয় এবং একটি বিশাল আকৃতির তরী সত্যব্রতের নিকটবর্তী হয়। বিষ্ণুর নির্দেশমতো সত্যব্রত মনু পশুপাখিসহ প্রাণিজগতের প্রতিটি প্রজাতির নারী-পুরুষের একটি করে জোড় নমুনা, সব ধরনের বনৌষধি, বীজ এবং সাতজন ঋষিসহ ওই তরীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অতঃপর নাগরাজ বাসুকীকে রজ্জুরূপে ব্যবহার করে ওই বিশাল তরী মৎস্য অবতারের শৃঙ্গের সঙ্গে বন্ধনযুক্ত করা হয়। সত্যব্রতের তরী ব্রহ্মার এক রজনী ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগরে পাড়ি জমায় এবং এইরূপে সৃষ্টির ধারা বহমান হয়। রাজা সত্যব্রত পরবর্তীকালে মনুরূপে জন্মগ্রহণ করে ভগবান বিষ্ণু কর্তৃক মৎস্য অবতাররূপে প্রদত্ত জ্ঞান মানবকল্যাণে প্রয়োগ করেন।
    প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তোরাহ্ ও খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে প্রফেট নোয়াহ্’র আমলে এবং মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফে পয়গম্বর নূহ্ আলাইহে ওয়া সাল্লামের আমলে মহাপ্লাবন এবং মহাপ্লাবন হতে সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য পশুপাখিসহ প্রাণিজগতের প্রতিটি প্রজাতির নারী-পুরুষের একটি করে জোড় নমুনা, সব ধরনের বনৌষধি, বীজ ইত্যাদি তরীতে নিয়ে পর্বতশৃঙ্গে রাখার বিষয়টি বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এক অর্থে মৎস্য অবতাররূপী বিষ্ণু কেবল মহাপ্লাবন হতে বিশ্ব এবং প্রাণিজগৎকেই রক্ষা করেননি, এই প্রাকৃতিক ঘটনার মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি তার মমত্ববোধ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। কূর্ম্ম অবতার ভগবান বিষ্ণু দ্বিতীয়বারের মতো পৃথিবীতে কূর্ম্মরূপে সত্যযুগে অবতরণ করেন। যর্জুবেদান্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণে কূর্ম্মাবতারের প্রথম আভাস পাওয়া যায়। ওই ব্রাহ্মণে বলা হয়, ‘প্রজাপতি কূর্ম্মরূপ ধারণ করে সন্তান উৎপাদন শুরু করেন। তিনি যে কর্মই করলেন সে কর্মই সৃষ্টির রূপ ধারণ করল।’ কিন্তু এই সম্পর্কে আর কোন বিবরণ শতপথ ব্রাহ্মণে পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে, বিষ্ণুর কূর্ম্মরূপ ধারণ সম্পর্কে স্পষ্ট বিবরণ বরাহ পুরাণে পাওয়া যায়। এই পুরাণের প্রথম অধ্যায়ের ৭ম স্তোত্রে ভগবান বিষ্ণুর স্তব কীর্তনকালে বলা হয়, “অন্যৎ সুরাসুরমিতে ত্বৎ সমুদ্রস্য মন্থনে।
    ধৃতবানসি কৌর্ম্মেণ মন্দরং মধুসূন। অতঃপর, হে মধুসূদন! আপনি দেবাসুর-কৃত সমুদ্রমন্থনকালে কূর্ম্মরূপে মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করিয়াছিলেন।” কূর্ম্মাবতাররূপে ভগবান বিষ্ণুর নাভী হতে নিম্ন অংশ কূর্ম্ম বা কচ্ছপরূপী ঊর্ধ্বাঙ্গ মনুষ্যরূপী। তার ওপরের বাম হাতে তিনি শঙ্খ ধারণ করে আছেন। শঙ্খ এক সামুদ্রিক প্রাণীবিশেষ। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানাদিতে ফুৎকার দ্বারা শঙ্খবাদন করে থাকেন। শঙ্খ এক বলয়ের, অস্তিত্বের, বিদ্যমানতার প্রতীক;  মঙ্গল বহন করে। ওপরের ডান হাতে বিষ্ণু বহন করে থাকেন; নাম সুদর্শনচক্র। আক্ষরিক অর্থে চক্র ক্ষুরধার অস্ত্রের প্রতীক, যে অস্ত্রের মাধ্যমে বাধাবিপত্তি দূরীভূত করে ভগবান সত্য প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য, দক্ষযজ্ঞে সতী দেহ ত্যাগ করলে মহাদেব সেই দেহ স্কন্ধে ধারণ করে উন্মত্তবৎ প্রলয়নৃত্য শুরু করেন। নটরাজের প্রলয়নৃত্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংসোন্মুখী দেখে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শনচক্রের আঘাতে সতীর দেহ ৫১ ভাগে খণ্ডবিখণ্ড করেন এবং মহাদেবকে শান্ত করেন। সতীর খণ্ডবিখণ্ড ৫১টি অঙ্গ ৫১ পীঠস্থানে পতিত হয়। নিচের বাম হাতে ভগবান বিষ্ণু গদা ধারণ করেন; যে কারণে তার এক নাম গদাধর। বিষ্ণুর এই গদার নাম ‘কৌমদকী’, যা মনকে মদোন্মত্ত করে। বিষ্ণু গদা জ্ঞানের শক্তি ও পরাক্রমতার প্রতীক। এই গদা ভক্তদের মনকে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করে, অনুপ্রাণিত করে। ভক্তরা জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মহাকালকে জয় করতে পারে। এক অর্থে মহাকালের দেবী শিবপত্নী কালীও গদার প্রতীক; কারণ তিনি সব অশুভ শক্তি বিনাশ করেন, তিনি কালজয়ী। কূর্ম্ম অবতাররূপী বিষ্ণু নিচের ডান হাতে পদ্ম ধারণ করে আছেন। পদ্ম নির্লিপ্ততা, নির্বিকারত্ব, নিরাসক্তির প্রতীক। পদ্ম কর্দমাক্ত জলে উৎপন্ন হয়, কিন্তু কর্দম কিংবা জল পদ্মফুল কিংবা পাপড়ির সৌন্দর্য বিনষ্ট করতে পারে না। পদ্ম প্রতীকের মাধ্যমে বিষ্ণু সৃষ্টিকে সর্বময় সুখ দান করেন, কিন্তু তিনি পৃথিবীর মায়ায় আবদ্ধ হন না।
    সমুদ্রমন্থনকালে অসুরদের বিপক্ষে দেবতাগণকে সহায়তা দান করার জন্য ভগবান বিষ্ণু কূর্ম্ম অবতাররূপে পৃথিবীতে অবতরণ করেন পরবর্তী কল্পে সত্যযুগে। পুরাণ কাহিনী মতে, অত্যন্ত কোপনস্বভাবের জন্য প্রসিদ্ধ মহামুনি দুর্বাসা একদা ফুলমালা হাতে যাত্রা করছিলেন, বিপরীত দিক থেকে আগাত ঐরাবত আরোহী দেবরাজ ইন্দ্রকে তিনি ফুলমালা দিয়ে স্বাগত জানান। ইন্দ্র দুর্বাসা প্রদত্ত ফুলমালা তার বাহন ঐরাবতকে প্রদান করেন। ঐরাবত ফুলমালাটি মাটিতে পদদলিত করে। দুর্বাসা এতে রুষ্ট হন এবং এই মর্মে অভিশাপ দান করেন, লক্ষ্মী ইন্দ্রকে পরিত্যাগ করবে এবং ইন্দ্রের সম্পদগৌরব বিনষ্ট হবে। ইন্দ্র তার ভুল স্বীকার করে দুর্বাসার ক্ষমাপ্রার্থী হন। দুর্বাসা তাকে এই বলে বর দান করেন, ‘ভগবান বিষ্ণু তার সহায় হবেন।’ দুর্বাসার অভিশাপের ফলে দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রকে পরিত্যাগ করেন। সব শক্তিমত্তা, ক্ষমতা, উৎসাহ ও উদ্দীপনার দেবী হলেন লক্ষ্মী; তিনি ইন্দ্রকে পরিত্যাগ করায় দেবরাজ অসহায় ও অক্ষম হয়ে পড়েন। তার বিপক্ষ শক্তি অসুররা এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল। যুদ্ধে ইন্দ্রকে পরাজিত করে অসুররা স্বর্গলোক দখল করে। ইন্দ্র ও দেবতারা অসুরদের ভয়ে স্বর্গলোক ত্যাগ করে নিরুদ্দেশে
     গমন করেন। কালক্রমে দেবকুল তাদের শৌর্যবীর্য, অমরত্ব হারিয়ে নিঃস্ব হন। “দেবান্ প্রতি বলোদ্দ্যোগং চক্রর্দ্দৈতেয়-দানবাঃ লোভাভিভূতা নিঃশ্রীকা দৈত্যাঃ সত্ত্ব বিবর্জিতাঃ শ্রিয়া বিহীনৈর্নিঃসত্ত্বৈর্দেদৈশ্চক্রুস্ততো রণম্। বিজাতাস্ত্রিদশা দৈত্যৈরিন্দ্রাদ্যাঃ শরণং যযুঃ। পিতামহং মহাভাগং হুতাশনপুরোগমাঃ। যথাবৎ কথিতো দেবৈর্ব্রহ্মা প্রাহ ততঃ সুরান্। তদনন্তর লোভাভিভূত নিঃশ্রীক সত্ববর্জিত দৈত্যসকল শ্রীহীন নিঃসত্ব দেবগণের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিল এবং ইন্দ্রাদি দেবতারা দৈত্যদিগের দ্বারা বিজিত হুতাসনকে পুরোবর্তী করত মহাভাগ পিতামহের শরণ লইলেন।” (বিষ্ণু পুরাণম, নবম অধ্যায় স্তোত্র-৩০-৩৪)।
    দেবগুরু বৃহস্পতি দেবদের বিপন্ন ও বিষণ্ণতায় বিচলিত এবং দেবদের নিয়ে ভগবান ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা কোন উপান্তর না দেখে শ্রীবিষ্ণুর সাহায্য প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু দেবতাদের অভয় দান করে বলেন, তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। তাদের করণীয় কাজ হবে ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করে অমৃতের সন্ধান করা। অমৃত পান করে দেবতারা অমর হতে পারবেন। তারা পরাশক্তিধর হবেন এবং অসুরদের পরাজিত করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু সমুদ্রমন্থন একটি বিষম কাজ; সে জন্য অসুরদের বন্ধুত্ব ও সহায়তা গ্রহণ প্রয়োজন হবে। ভগবান বিষ্ণু আরও বলেন, মন্দর পর্বতকে ক্ষীরসমুদ্র মন্থনদণ্ডরূপে এবং সর্পরাজ বাসুকীকে রজ্জুরূপে ব্যবহার করতে হবে। যথোপযুক্ত সময়ে সমুদ্রমন্থনস্থলে তার আবির্ভাব ঘটবে। জগৎপালক শ্রীবিষ্ণু আরও জানান, সমুদ্রমন্থনের ফলে লক্ষ্মীর পুনরাবির্ভাব ঘটবে এবং লক্ষ্মীর বরে দেবতাদের বিজয় নিশ্চিত হবে। ‘ইত্যুক্তা দেবদেবেন সর্ব্ব এব ততঃ সুরাঃ। সন্ধানমসুরৈঃ কৃত্বা যত্নোবন্তোহমৃতেহভবন। (পরাশর কহিলেন,) দেবাদেব এইরূপ বলিলে সুরগণ অসুরগণের সহিত সন্ধি করিয়া অমৃতের জন্য যত্নবান হইলেন।’ (বিষ্ণু পুরাণম, ৯ম অধ্যায়, স্তোত্র-৮১)। দেবগুরু বৃহস্পতি চাতুর্যের জন্য খ্যাতিমান। তিনি অসুরদের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মিলিত হন। দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন এবং সম্মিলিতভাবে ক্ষীরসমুদ্র মন্থনে উভয় পক্ষের সম্মতি লাভে সমর্থ হন। সম্মতি প্রদানের পেছনে অসুরদের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল অমরত্বদানকারী অমৃত লাভ এবং ধনসম্পদ অর্জন। অসুরদের সম্মতিলাভের পর দেবতারা ক্ষীরসমুদ্রের উপাসনায় নিমগ্ন হন। দেবতা ও অসুররা সব ধরনের বনৌষধি অর্ঘ্যরূপে ক্ষীরসমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। সমুদ্রমন্থনে দণ্ডরূপে ব্যবহারের জন্য অসুর ও দেবতারা মন্দরপর্বত পাদদেশে গমন করেন এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মন্দরপর্বত উন্মীলনে সমর্থ হন। কিন্তু মন্দরপর্বতকে স্কন্ধে বহন করে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়ার সময় বহু দেবতা ও অসুর পর্বতভারে নিহত হন। এই যাত্রায়ও বিষ্ণু আবির্ভূত হয়ে নিহত দেবতা ও অসুরদের পুনরুজ্জীবিত করেন। অতঃপর ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশে গরুড় স্বীয় পৃষ্ঠে মন্দরপর্বত বহন করে ক্ষীরসমুদ্রে তা প্রতিস্থাপন করেন। নাগরাজ বাসুকীকে মন্দরপর্বতের চতুর্দিকে রজ্জুসম বেষ্টনীরূপে ব্যবহার করে অসুর ও দেবতারা ক্ষীরসমুদ্র মন্থন শুরু করেন। মন্থন চলাকালে অকস্মাৎ সমুদ্রতলে মন্দরপর্বতের নিমজ্জন শুরু হয়। অসহায় অসুর ও দেবতারা বিষ্ণুর কৃপা প্রার্থনা করেন। কূর্ম্মরূপ ধারণ করে বিষ্ণু সমুদ্রতল হতে মন্দরপর্বতকে সমুদ্রপৃষ্ঠে উত্তোলন করেন এবং সমুদ্রমন্থনের সুবিধার্থে মন্দরপর্বতকে স্বীয় পৃষ্ঠে ধারণ করেন। অসুর ও দেবরা আবার সমুদ্রমন্থনে লিপ্ত হন।
    নব উদ্দীপনা সহকারে ক্ষীরসমুদ্র মন্থন চলাচালে অকস্মাৎ অসুর ও দেবতারা এক নতুন বিপদের সম্মুখীন হন। সমুদ্রবক্ষ হতে উত্থিত এক ধূম্রপাহাড় অসুর ও দেবতাদের শ্বাসরোধের উপক্রম করে। তারা জানতে পারলেন, সমুদ্রমন্থনের ফলে নাগরাজ বাসুকীর মুখনিঃসৃত গরল ‘কালকুট’ সমুদ্রবক্ষে নিক্ষিপ্ত হয়ে বিষবাষ্পরূপে তাদের শ্বাসরোধ করছে। অসুর ও দেবতারা জানতেন, কালকুট বিষের তীব্রতা এত বেশি, এই বিষ পানকারীর মৃত্যু অনিবার্য; এই বিষ সমগ্র সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে সক্ষম। ভীতসন্ত্রস্ত্র অসুর ও দেবতারা ভগবান শিবের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তাদের প্রার্থনায় ভগবান শিব সাড়া দিলেন। কিন্তু অসুবিধা হল, এই গরল তার পাকস্থলিতে স্থান পেলে তার নিশ্চিত মৃত্যু হবে, গরল পান না করলে সৃষ্টি বিনষ্ট হয়। ভগবান শিব স্বীয় কণ্ঠেই কালকুট বিষ ধারণ করলেন, যার ফলে তার কণ্ঠ নীল হয়ে যায়। শিব হয়ে উঠলেন ‘নীলকণ্ঠ’। ‘কালকুট’ গরল হতে পরিত্রাণলাভের পর অসুর ও দেবতারা আবারও সমুদ্রমন্থনে লিপ্ত হন। মহাপ্রলয়কালে বিলুপ্ত দ্রব্যসব, যেমন মাদকতার দেবী ‘সুরা’, চন্দ্র, অপ্সরী, রম্ভা, কৌস্তভ (বিষ্ণুর অঙ্গসজ্জার মণি), শঙ্খ, উচ্চৈঃশ্রবা (স্বর্গের অশ্ব), পারিজাত (ইচ্ছাপূরণে সক্ষম বৃক্ষ), সুরভী (ইচ্ছাপূর্ণকারিণী স্বর্গের গাভী), ঐরাবত (স্বর্গের চতুঃদন্ত বিশিষ্ট হস্তী এবং ইন্দ্রের বাহন), পঞ্চজন্য (শঙ্খ), ষড়ঙ্গ (অব্যর্থ ধনু) প্রভৃতি ক্রমান্বয়ে সমুদ্রবক্ষ হতে উত্থিত হতে থাকে।
    অকস্মাৎ সমগ্র দিগন্ত উদ্ভাসিত করে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়- স্বর্গীয় মুখাবয়বের এক দেবী ক্ষীরসমুদ্রের মধ্যস্থল হতে উত্থিত হন। তার কণ্ঠে শোভা পাচ্ছিল পদ্মফুলের মালা, তার হস্তে ছিল পদ্মফুল এবং তিনি দণ্ডায়মান ছিলেন এক ফুটন্ত পদ্মফুলের ওপর। তিনি হলেন দেবী লক্ষ্মী। দেবতারা তার বন্দনায় পঞ্চমুখ হলেন, গন্ধর্ব ও অপ্সরিরা তার প্রশংসায় নৃত্যগীতে মগ্ন হলেন। হস্তিকুল তার ওুপর স্বর্গের জল বর্ষণ করলেন; তিনি গজলক্ষ্মী উপাধি পেলেন। সমুদ্র দেবতা স্বয়ং জলরাশি হতে উত্থিত হয়ে স্বীয়কন্যাকে স্বর্গের বস্ত্র ও অলংকারে ভূষিত করলেন। তার এক নাম হয়ে পড়ল ‘সমুদ্রতনয়া’। সবাই যখন লক্ষ্মীর অপরূপ রূপশোভায় মোহিত, লক্ষ্মী তখন বিষ্ণুর গলায় মাল্যদান করে বিষ্ণুবক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তিনি দেবতা ইন্দ্রের ওপর দৃষ্টিপাত করলেন; ইন্দ্র তার পূর্ব ঐশ্বর্য ফিরে পেলেন।
    অসুর ও দেবতাদের সমুদ্রমন্থন চলাকালে একসময় সমুদ্রবক্ষ হতে ধন্বন্ত্বরীর উত্থান ঘটে। তিনি হলেন সব ধরনের বনৌষধির আবিষ্কারক, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের জনক এবং সব রোগের নিরাময়কারী সমুদ্রবক্ষ হতে উত্থানকালে ধন্বন্ত্বরী অমৃতে পূর্ণ একটি পবিত্র পাত্র ধারণ করেছিলেন। অমৃতপানে অমরত্বলাভ করা যায়। অমৃতের সংবাদ পেয়ে অসুররা ধেয়ে এসে অমৃত পাত্র ছিনিয়ে নিলেন। ফলে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা হয়। দেবতাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে ভগবান বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করে অসুরদের কাছে বিবাদের কারণ জানতে চান। অমৃতই এই বিবাদের কারণ বলে অসুররা জানালে মোহিনীরূপী বিষ্ণু দেবতা ও অসুরদের দুই সারিতে বসে অমৃত পানের জন্য অপেক্ষমাণ হতে বললেন। সুন্দরী রমণীর কথায় মোহিত হয়ে অসুর ও দেবতারা সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন। হাতের কারসাজির মাধ্যমে মোহিনী অসুরদের অতিনেশাযুক্ত মাদক পানীয় এবং দেবতাদের অমৃত পান করান। অমৃত পান করে দেবতারা অমর ও অজেয় হন এবং অসুররা মাদক পানীয় পান করে প্রতারিত হন। অসুররা দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে অতি সহজেই দেবতারা অসুরদের পরাজিত করেন। কূর্ম্ম অবতাররূপে দ্বিতীয়বারের মতো পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে ভগবান বিষ্ণু এইভাবে ছলনার আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে দেবতাদের অমরত্ব দান করেন এবং অসুরদের ক্ষমতা বিনাশ করেন।


    বাংলাদেশনিউজ২৪x৭.কম

    কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ২


    কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ২



    মানুষ অহিংসক হলে, শ্রীমদ্ভাগবদ্ গীতা-র,  উদ্ভব হত না !

    শ্রীকৃষ্ণকেও,  জ্ঞান বিতরণের জন্যে,  দরকার পড়ত না !

    হিন্দুরা,  এক ধর্ম-কর্মের,  মহান পাণ্ডিত্যপূর্ণ শাস্ত্র,  হারাত !

    কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ


    কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ



    কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে,  অর্জুন, জ্ঞাতি ও বন্ধুবান্ধব নাশের ভয়ে, প্রাথমিক ভাবে, যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন !

    শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে, নানান উপদেশ দানে, অর্জুনের উদ্বেগ, প্রশমিত করেন, যুদ্ধে অণুপ্রাণিত করেন, উদ্বুদ্ধ ও উত্তেজিত করেন !

    কুরুক্ষেত্র-এর যুদ্ধ শুরু হয়েছিল !

    যুদ্ধে, ন্যায়-নীতি ও অন্যায়-নীতিহীনতা, দুইই, সমান তালে চলেছিল !

    ধর্মের নামে, পাণ্ডব পক্ষের, জয় হয়েছিল !

    কৌরবেরা ধ্বংস হয়েছিল !

    মারকুটে মারদাঙ্গা-বাজ কৃষ্ণ


    মারকুটে মারদাঙ্গা-বাজ কৃষ্ণ



    ছোটবেলাতেই কৃষ্ণ
    পুতনা
    তৃণবর্ত
    অঘ
    অরিষ্ট
    প্রভৃতি অসুর এবং অসুরীদের বধ করেছিলেন !

    কালিন্দী নদীর ( যমুনা নদীর পৌরাণিক নাম ),  জলে বাসকারী,  কালীয় নাগকে ( ভাগবতে বর্ণিত যমুনা নদীর জলে বসবাসকারী, পৌরাণিক  'নাগ'-বিশেষ ), দমন করেছিলেন !

    কৃষ্ণের পরামর্শে, গোপিনীসহ গোপেরা, ব্রজধাম ছেড়ে, অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গায়, বৃন্দাবন-এ গিয়ে বসবাস শুরু করেন !

    কৃষ্ণ, পরবর্ততিতে, কংসের ধনুর্যজ্ঞে গিয়ে, বিরাট বলশালী পাগলা হাতি, মল্লদের ( কুস্তিগির, পালোয়ান ), প্রাণবধ
    করেন !

    সেই সময়ে, মামা,  'কংস'-কেও, হত্যা করেন !

    কৃষ্ণ ছিলেন, মারকুটে, মহা মারদাঙ্গা-বাজ !

    তবে কৃষ্ণের কোন বরফাট্টাই ছিল না !

    কৃষ্ণ


    কৃষ্ণ



    ছোটবেলায় শ্রীকৃষ্ণ গরু চরাতেন !
    গোবর সংগ্রহ করে, তা ঘেঁটে, ঘুঁটে দিতেন !
    গোচোনা খেতেন !
    তাতে নাকি, শ্রীকৃষ্ণের, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকত !
    অনেক ধরণের অসুখ-বিসুখ করত না !

    ছোটবেলা থেকেই, শ্রীকৃষ্ণের শারিরীক শক্তি, দুষ্টুবুদ্ধি, ও সৌন্দর্ষ ছিল অসামান্য !
    তাই ছোট হলেও, সবাই কৃষ্ণকে  করতেন মান্য !
    তবে শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রঙ ছিল, কালো !
    ঐ কালো রঙই শ্রীরাধিকার আর গোপিণীদের মন-পছন্দ ছিল !
    কৃষ্ণের সাথে, কালো তমাল বা তমালক গাছের,  ভালো,  যোগসূত্র ছিল !
    তখন  'তমাল প্রচুর দেশ',  আমাদের এদিককার, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার,  'তমলুক'-এর, খুব নামডাক ছিল !

    কৃষ্ণের সাথে গোপিনীরা, উন্মুক্ত বনাঞ্চলেই থাকতেন !
    তাদের ঘরের বা মনের দরজায়, খিল দেবার কোন ব্যবস্থা, বা, ব্যবস্থাপক ছিল না !
    দুগ্ধবতী গাভিদের দুধ, তাঁরা, সবাই মিলে, হৈ-চৈ করে,  দোহাতেন !
    তারপর গরম গরম টাটকা,  সেই দুধ,  তাঁরা, একসঙ্গেই বসে বসে খেতেন !
    আর খুব মজা করতেন ! মজা লুটতেন !