সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

রাজশেখর বসু ( দুই )


    রাজশেখর বসু ( দুই )

    ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন          প্রণব কুমার কুণ্ডু

সাহিত্যিক, অভিধান প্রণেতা, অনুবাদক এবং রসায়নবিদ
রাজশেখর বসু - পরশুরাম (জন্মঃ- ১৮ মার্চ, ১৮৮০ - মৃত্যুঃ- ২৭ এপ্রিল, ১৯৬০) ("সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান" অনুযায়ী)
তাঁর ব্যঙ্গকৌতুক ও বিদ্রুপাত্মক গল্পগুলির জন্য পাঠকের মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন। প্রথম জীবনে তিনি আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসে কর্মরত ছিলেন। ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে পরিচিত ছিলেন। ১৯২০-এর দশকে রাজশেখর তাঁর সাহিত্যিক কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯২২ সালে ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে তিনি একটি মাসিক পত্রিকায় 'শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড' নামে ব্যঙ্গ রচনা প্রকাশ করেন। সেখানে অনেকগুলো রসরচনামূলক গল্পগ্রন্থ রচনা প্রকাশ করেন, যা তাঁকে প্রভূত জনপ্রিয়তা প্রদান করেছিল। বেশী বয়সে সাহিত্য-জীবন শুরু করেন। গল্পরচনা ছাড়াও স্বনামে প্রকাশিত কালিদাসের মেঘদূত, বাল্মীকি রামায়ণ (সারানুবাদ), কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত (সারানুবাদ), শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা ইত্যাদি ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থগুলিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় রাজশেখর বসুর প্রবাদপ্রতিম বাংলা অভিধান গ্রন্থ চলন্তিকা। এগুলি ছাড়াও লঘুগুরু, বিচিন্তা, ভারতের খনিজ, কুটির শিল্প প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থও রচনা করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ২১টি। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ও ভারত সরকার পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৫৫ সালে আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প বইটির জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
রাজশেখর বসু বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দ্বারভাঙ্গা-রাজ-এস্টেটের ম্যানেজার, দার্শনিক পণ্ডিত চন্দ্রশেখর বসুর নিবাস ছিল নদীয়া জেলার বীরনগর (উলা) গ্রামে ও মায়ের নাম ছিল লক্ষ্মীমণি দেবী। তিনি ছিলেন চন্দ্রশেখর দম্পতির ৬ সন্তানের (শশীশেখর, গিরিন্দ্রশেখর প্রমূখ) মধ্যে ২য়। দ্বারভাঙ্গায় তিনি শৈশবকাল কাটান ও বাংলা ভাষার তুলনায় হিন্দী ভাষায় পারদর্শীতা লাভ করেন। তিনি ১৮৯৫ সালে দ্বারভাঙ্গা রাজস্কুল থেকে এন্ট্রাস, ১৮৯৭ সালে পাটনা কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করেন। ফার্স্ট আর্টস পাস করার পর শ্যামাচরণ দে'র পৌত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৯৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন। তখনও এম.এস-সি কোর্স চালু হওয়ায় ১৯০০ সালে রসায়নে এম.এ পরীক্ষা দেন এবং প্রথম হন।
১৯০২ সালে রিপন কলেজ থেকে বি.এল পাশ করে মাত্র তিনদিন আইন ব্যবসা করেছিলেন। আইন ব্যবসার তুলনায় বিজ্ঞান চর্চায়ই অধিকতর সফলতা লাভের লক্ষ্যে আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯০১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস কোম্পানীতে ১৯০৩ সালে রাজশেখর তাঁর চাকুরী-জীবনের শুরু করেন। সেখানে তিনি সামান্য বেতনে নিযুক্ত হন একজন রাসায়নিক হিসেবে। স্বীয় দক্ষতায় অল্পদিনেই তিনি আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডাঃ কার্তিক বসুর প্রিয়পাত্র হন। ১৯০৪ সালে তিনি ঐ কোম্পানীর পরিচালক পদে উন্নীত হন। একদিকে গবেষণার কাজ, অন্যদিকে ব্যবসা পরিচালনা - উভয়ক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। কেমিস্ট্রি ও ফিজিওলজির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে তিনি এক নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। স্বাস্থ্যহানির দরুণ ১৯৩২ সালে এখান থেকে অবসর নিলেও উপদেষ্টা এবং ডিরেক্টররূপে আমৃত্যু এই কোম্পানীর সাথে যুক্ত ছিলেন। নিয়মানুবর্তিতা ও সুশৃঙ্খল অভ্যাসের জন্য তাঁর জীবন-যাপন-পদ্ধতি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিল।
১৯০৬ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলে তিনি তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।
রচিত গ্রন্থাবলী
গ্রন্থনাম বর্গ প্রকাশক প্রথম প্রকাশ (বঙ্গাব্দ)
গড্ডলিকা গল্পগ্রন্থ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩৩১
কজ্জলী গল্পগ্রন্থ ১৩৩৫
চলন্তিকা অভিধান সুধীরচন্দ্র সরকার ১৩৩৭
হনুমানের স্বপ্ন গল্পগ্রন্থ এম. সি. সরকার অ্যান্ড সনস লিমিটেড ১৩৪৪
লঘুগুরু প্রবন্ধ-সংগ্রহ রঞ্জন পাবলিশিং হাউজ ১৩৪৬
কুটিরশিল্প জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ - ২) ১৩৫০
কালিদাসের মেঘদূত অনুবাদ গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ ১৩৫০
ভারতের খনিজ জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ - ৭) ১৩৫০
সম্মাননা
১৯৫৫ সালে সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ 'কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প' গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করে। আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প বইটির জন্য তিনি ১৯৫৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গঠিত বানান-সংস্কার সমিতি ও ১৯৪৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিভাষা সংসদের সভাপতিত্বও করেন রাজশেখর। ১৯৫৭-৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। এছাড়াও, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে। ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার কর্তৃক তিনি পদ্মভূষণ উপাধিতেও সম্মানিত হন। ১৯৪০ সালে জগত্তারিণী পদক এবং ১৯৫৫ সালে সরোজিনী পদকেও ভূষিত হন।
বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় রাজশেখর বসু'র দু'টি ছোটগল্প চলচ্চিত্ররূপ ধারণ করে। সেগুলো হলো - পরশ পাথর এবং 'বিরিঞ্চি বাবা' অবলম্বনে মহাপুরুষ।
পুরস্কার প্রদানকারী সাল গ্রন্থ
জগত্তারিণী পদক
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৪০
সরোজিনী পদক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৪৫
রবীন্দ্র পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গ সরকার
১৯৫৫ কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার
পশ্চিমবঙ্গ সরকার
১৯৫৬ আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প
পদ্মভূষণ উপাধি
ভারত সরকার ১৯৫৬
ডি.লিট উপাধি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৫৭-৫৮
সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৫৮
জীবনাবসান
বসু দম্পতির এক কন্যা ছিল। তাঁর মেয়ের স্বামী খুব অল্প বয়সে অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে; শোকে কাতর হয়ে মেয়েও একই দিনে মারা যায়। ১৯৪২ সালে তাঁর স্ত্রীও মারা যায়। এরপর ১৮ বছর স্ত্রী বিয়োগজনিত সময়কালে তাঁর অমূল্য সৃষ্টিকর্মগুলো রেখে যান। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-দূর্দশার কথা তাঁর লেখনিতে পাওয়া যায়নি। ১৯৫৯ সালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েও লেখালেখি চালিয়ে যান। অবশেষে ১৯৬০ সালের ২৭শে এপ্রিল ২য় বার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় পরলোকগমন করেন।