বুধবার, ১১ জুলাই, ২০১৮

রাসবিহারী বসু


        রাসবিহারী বসু


        ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                 প্রণব কুমার কুণ্ডু



পুরানো সেই দিনের কথা: নিজের পুত্র ও কন্যার সাথে বিপ্লবী ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী রাসবিহারী বসু। জাপানে খুব সম্ভবত ১৯৩০ এর দশকে তোলা ছবি। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে শ্রী রাসবিহারী বসু ও শ্রীমতি তোশিকো এর বিবাহ হয়। ১৯১৯ সালে তাঁদের প্রথম পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর দুটি নাম রাখা হয়েছিল। জাপানি ও ভারতীয়- মাশাহিদে ও ভারতচন্দ্র। কন্যা তেৎসু এর জন্ম হয় খুব সম্ভবত ১৯২২ সালে। শ্রী রাসবিহারী বসুর পুত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন গত হন। কন্যা প্রায় ৯০ বৎসর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।




দিল্লির রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান

দিল্লির রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান


ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু

Sambuddha Mukhopadhyay গোষ্ঠীটিতে একটি পোস্ট শেয়ার 
করেছেন: ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য



ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু




Sambuddha Mukhopadhyay ইতিহাস বিশ্লেষণ : 

— Subhasis Chirakalyan Patra এবং আরো 40 জন এর সাথে।

বিশ্বাসঘাতক আর মীরজাফর এখন যেন সমার্থক। আধুনিক ইতিহাসে আমাদের জানা বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনাগুলির মধ্যে পলাশীর যুদ্ধের সেই ঘটনাই সকলেরই সমধিক জানা। কিন্তু মধ্যযুগীয় ইতিহাসের আরেক বীরের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে আরেক রাজার কথা, যিনি দেশ ও জাতির সাথে ঘাতকতা করেছেন, আর তার চরম শাস্তিও পেয়েছেন।
১১৯১ সালে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মুখোমুখি হন দিল্লীর রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান আর আফগান সুলতান মহম্মদ ঘোরী। ভারতীয়দের মধ্যে অনৈক্য বহুকাল ধরেই এক জ্বলন্ত সমস্যা,কাজেই বিদেশী শক্তির আক্রমণকে প্রতিহত করার বেলায় কোন শক্তিজোটই গঠন হয়নি।সুলতান ঘোরী যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন রাজস্থানের চৌহান সম্রাট বীর পৃথ্বীরাজ ব্যতীত আর কেউ দেশমাতৃকার সম্মান রক্ষার্থে রুখে দাঁড়াননি।পাশে ছিলেন আরেক রাজপুত বীর সংগ্রাম সিং। ১১৯২ এর খ্যাতনামা তরাইনের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করেন পৃথ্বীরাজ, কিন্তু ঘোরীকে মুক্তি দেন।
ঘোরী আফগানিস্তান ফিরে যান ঠিকই, কিন্তু পরাজয়ের যন্ত্রনা ও শত্রুপক্ষের কৃপাপূর্ণ মুক্তি তাঁকে অসম্ভব লাঞ্ছিত করেছিল, কাজেই মনের মধ্যে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। আর সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছিল তাঁর মনোজাত অসন্তোষ। চরম ক্রোধে ঘোরী ঠিক করেন, প্রতিশোধ নিতেই হবে। কিন্তু তিনি জানতেন, পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বাধীন রাজপুত শক্তিকে পরাজিত করা মুখের কথা নয়।
কাজেই রাজপুতানার অন্তর্দাহকে ব্যবহার করার দিকে এগোন তিনি, আর গ্রহণ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের 'শত্রুর শত্রু আমার মিত্র' নীতি, হাল আমলের নেতাজী, হিটলার, মুসোলিনি বা আরো বহু রাষ্ট্রনায়কই যা গ্রহণ করেছেন।
সেইসময় কনৌজ ও বারাণসীর অপর রাজপুত রাজা, গাড়োয়াল সম্রাট জয়চন্দ্রের সাথে পৃথ্বীরাজ চৌহানের শত্রুতার কাহিনী ছিল সুপরিচিত। বস্তুত, জয়চন্দ্রের কন্যা সংযুক্তা ও পৃথ্বীরাজের মধ্যেকার প্রেমের সম্পর্কের আগাগোড়া বিরোধী ছিলেন জয়চন্দ্র। এবিষয়ে কন্যার সাথে বারংবার মতবিরোধ হয় তাঁর।এমতাবস্থায় কন্যার স্বয়ম্বর সভায় পৃথ্বীরাজকে আহ্বান না করে তাকে অপমানও করেন তিনি। কিন্তু, সেইসময়ের প্রচলিত প্রথানুযায়ী, রাজারা তাঁদের পছন্দের রমণীকে 'হরণ' করে নিজের বীরত্বের প্রমাণ দিয়ে বিবাহের পথ প্রস্তুত করবেন। বীর পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে বীরত্বপূর্বক দিল্লীতে নিয়ে এসে সেই রাজপ্রথার পালন করেন। তাঁর বীরত্ব জয়চন্দ্রকে বুঝিয়ে দেয়, পৃথ্বীরাজের মোকাবিলার জন্য তাঁকে তৃতীয় শক্তির সাহায্য নিতে হবে।
কাজেই কনৌজ সম্রাট জয়চন্দ্র ও আফগান সুলতান মহম্মদ ঘোরীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয়। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাস্ত হন তাঁর একদা ক্ষমাপ্রাপ্ত সুলতান ঘোরী এবং শ্বশুর তথা স্বজাত জয়চন্দ্রের কাছে। শোনা যায়, ২৬ বছরের বীরযুবক পৃথ্বীরাজকে অন্ধ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু তবুও বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে শানিত অস্ত্রাঘাত তাঁকে অমর করে রেখেছে,সেইসাথে বিমূর্ত প্রেমের এক অমর প্রতীক তিনি। পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তার এই প্রেমকাহিনী শুধুই সাহিত্য বা ফিল্ম-টেলিফিল্মের উপজীব্যই নয়, এই প্রেমগাঁথা তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে ভারতীয় ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ যুগের সূচনা করেছে : ভারত ইতিহাসের 'মধ্যযুগ',যা বিস্তৃত ছিল পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) পর্যন্ত। বস্তুত, ১১৯২ সালের এই ভবিতব্য যুদ্ধই ভারত ইতিহাসে প্রাচীন যুগ এবং মধ্যযুগের সন্ধিক্ষণ, আর সেই সাথে দিল্লীতে ঘোর বংশের সাম্রাজ্যস্থাপনের কারণে সুলতানি সাম্রাজ্য এক বিশেষ মাত্রা লাভ করে।
কিন্তু ইতিহাস বিশ্বাসঘাতককে কদাচ ক্ষমা করে! এরপর জয়চন্দ্র ভেবেছিলেন পৃথ্বীরাজ তথা চৌহান বংশের পতনের মাধ্যমে তিনিও বিপন্মুক্ত হলেন, কিন্তু তাঁর পথের কাঁটা যে আরো জাঁকিয়ে বসল,সেটা তিনি বুঝতে পারেনইনি। ঠিক এক বছর পরের ঘটনা। মহম্মদ ঘোরীর এই সাম্রাজ্যবিস্তারের পরম্পরা তাঁর উত্তরসূরীরা মান্য করতে থাকেন।কাজেই দিল্লীকে কেন্দ্রিভূত করে পত্তন লাভ করা সুলতানাত আরো বৃহত্তর হতে থাকে।ধীরে ধীরে তাঁদের সাম্রাজ্যের পরিসীমা দক্ষিণে বাড়তে বাড়তে একসময় কনৌজের সীমানায় এসে পৌঁছোয়। জয়চন্দ্র ভাবেন,যে বীজবৎ সাম্রাজ্যকে তিনি ভূমিভেদে সাহায্য করেছিলেন, আজ তা বিশাল মহীরুহে পরিণতি লাভ করে তাঁকে নিশ্চয়ই বৃক্ষতলে ছত্রছায়া প্রদান করবে।কিন্তু হায়! কুতুবউদ্দিন আইবেক, মহম্মদ ঘোরী ও অন্যান্য সেনাপতিদের নেতৃত্বাধীন ঘোর শক্তি জয়চন্দ্রের সাথে কোনরূপ বাক্যালাপেই রাজি ছিল না, তাঁরা স্রেফ তাঁদের সাম্রাজ্য ও ঔপনিবেশিক শক্তিবৃদ্ধির জন্য সমস্ত প্রকার নিধনে রাজী ছিলেন। কাজেই ১১৯৩ সালে অধুনা ফতেপুরে তাঁরা জয়চন্দ্রের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, স্বার্থসিদ্ধিবাজ জয়চন্দ্র যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে পলায়নে বাধ্য হন, কিন্তু পারেননি। দেশ,জাতি, মাতৃভূমির এই বিশ্বাসঘাতকের অসাড় দেহ তলোয়ারের কোপে লুটিয়ে পড়ল ফতেপুরের রণক্ষেত্রে। সুলতানি সাম্রাজ্য দখল করল কনৌজ, বারাণসী,গাড়োয়াল সহ বিভিন্ন অঞ্চল, যেগুলি বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহারে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে।
রাজপুতানার ইতিহাসে এটি অতিপ্রসিদ্ধ একটি কাহিনী। পৃথ্বীরাজ চৌহানের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তাঁর পত্নী তথা কনৌজের রাজকন্যা, জয়চন্দ্র-দুহিতা সংযুক্তা জহরব্রত পালন করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরগতিপ্রাপ্ত হাজারো যোদ্ধার পত্নীরাও আগুনে ঝাঁপ দিয়ে একইভাবে আত্মাহুতি দেন।
না রাজা তাঁর স্ত্রীকে পেলেন দেশের জন্য বলিদান দিয়ে, না নিজেকে বাঁচালেন শত্রুকে ক্ষমা করে, না পিতা তাঁর কন্যাকে পেলেন জামাতাকে হত্যা করে, না পারলেন সু-কন্যার প্রাণই বাঁচাতে, না পারলেন নিজেকে বাঁচাতে। অমর এই প্রেমগাঁথা শুধু তিনটি শীর্ষবিন্দুতে থাকা পিতা-কন্যা-সম্রাটের ত্রিকোণকেই ধ্বংস করল না, ইতিহাসকে এক নতুন মোড় দিল।


গান্ধিজি ( দুই )


             গান্ধিজি ( দুই )


             ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু



Hindoo - হিন্দু 2
গান্ধী কে কি কারণে শ্রদ্ধা বা সম্মান করবো??

লিখেছেনঃ
Subrata Saha Roy


১. গান্ধীজি দঃ আফ্রিকায় কোথায় চাকরী করতেন?
- আবদুল্লা নামে গুজরাটবাসী এক আরব ব্যবসায়ীর কাছে।
২. উনি কত বৎসর বয়সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন?
- মাত্র ৪৬ বৎসর বয়সে!
৩. উনি কি কখনও যুদ্ধ করেছিলেন?
- হ্যাঁ করেছিলেন তবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে গান্ধী তিন তিন বার যুদ্ধ ক্ষেত্রে সশরীরে হাজির ছিলেন এবং ব্রিটিশ সেনাদের সাহায্য করার জন্যে তিন তিন বার ব্রিটিশদের দ্বারা পুরস্কৃত হন। বুয়োর যুদ্ধ, জুলুর যুদ্ধ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
৪. ওনার ৪ পুত্রের মধ্যে কোন ছেলে স্বাধীনতা সংগামে যোগ দিয়েছিলেন?
- একজনও নয়। সবকটা ছেলেই অমানুষ তৈরী হয়েছিল, তাই তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি, বড় ছেলে তো আবার কালেমা পড়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে কাটমোল্লা হয়ে করাচির রাজপথ দিয়ে নেত্য করে বেড়াত।
৫. স্বাধীনতা সংগ্রামে তার প্রথম ভূমিকা কি?
- ১৯২০ তে মুসলিম দুনিয়ার প্রধান খলিফাকে ক্ষমতা ফেরৎ দেওয়ার জন্য ইংরেজের বিরুদ্ধে এক আন্দোলন সংগঠিত করে, হাজার হাজার হিন্দু হত্যা ও ইসলামি করণ সফল করা।
৬. ওনার সর্বশেষ আন্দোলন কি?
- নিজের দেহের উপর দিয়ে দেশ ভাগের শপথ বিফল হওয়ার পর পাকিস্থানের দাবী অনুসারে বৎসরে ৮০ কোটি টাকা করে দেওয়া দাবীতে ভারত সরকারকে বাধ্য করতে অনশণে বসা।
৭. ওনার সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কার্য্যকলাপ কি?
- কংগ্রেস দলকে নেতাজী মুক্ত করা, ভগৎ সিং ও অন্যান্য মুক্তিকামী সংগ্রামীদের ফাঁসিকে সমর্থন করে, অহিংসা আন্দোলনকে মহিমান্বিত করণ। দেশ ভাগের বিরোধীতা বা আরবদাসদের দ্বারা লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ খুন, উৎখাতের বিরুদ্ধে একদিনও অনশনে না বসে উনি অহিংসা আন্দোলনের উৎকর্ষতা প্রমান করেছেন।
৮. গান্ধী কিভাবে ও কাদের সাহায্যে নেতা হয়ে উঠেছিলেন?
- গান্ধীখুড়ো ১৯১৫ সালে ভারতে ফিরল ৪৬ বছর বয়সে আর মাত্র ৬ বছরের মধ্যেই অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠলেন কংগ্রেসের!! পিছন থেকে ব্রিটিশদের সাহায্য না থাকলে তা অসম্ভব ছিল, কারণ ব্রিটিশ অক্টিভিয়াম হিউম সাহেবের নিজের হাতে তৈরী কংগ্রেস দলটা ব্রিটিশদের কাছে ছিল অনেকটা সেফটি ভাল্বের মত, যার গৌণ কাজ ছিল ভারতীয়দের নিয়ে ভারতীয়দের পক্ষে বিভিন্ন দাবী দাওয়া আদায় করা ব্রিটিশদের কাছ থেকে কিন্তু তলেতলে মুখ্য কাজই ছিল ভারতীয়দের দ্বারা তৈরী হওয়া ব্রিটিশ বিরোধী ক্ষোভের আগুনকে ও হিংসাত্মক আন্দোলনকে সীমিত ও স্তিমিত করে দেওয়া, আর তা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কোনো ব্রিটিশ ইংরেজ নয় একটা ভারতীয় মুখ দরকার ছিল, আর সাউথ আফ্রিকার গান্ধীর মধ্যে সেই আপাত বিশ্বাসযোগ্য মুখটা খুঁজে পেয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা, যেই ভাবা সেই কাজ, এরপর গান্ধীকে অহিংসার পূজারী হিসেবে প্রজেক্ট ও প্রমোট করেছিল ইংরেজরা যাতে বিপ্লব ও সহিংস আন্দোলনের পরিবর্তে অহিংস আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে সুবিধে হয় তাদের।

রাসবিহারী বসু


       রাসবিহারী বসু


       ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                প্রণব কুমার কুণ্ডু


পুরানো সেই দিনের কথা: বিপ্লবী ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্রষ্টা (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) শ্রী রাসবিহারী বসুর ১৩২তম জন্মবার্ষিকী (জন্ম- ২৫শে মে ১৮৮৬ সাল, সুবলদহ গ্রাম, রায়না ২ নং ব্লক, পূর্ব বর্ধমান) তে শ্রদ্ধার্ঘ্য- স্ত্রী শ্রীমতী তোশিকো বসু ও কন্যা শ্রীমতী তেৎসুকো বসুর সাথে শ্রী রাসবিহারী বসু। খুব সম্ভবতঃ ১৯৩০ এর দশকে জাপানে তোলা ছবি।

রাসবিহারী বসুর জন্ম বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে। পিতা বিনোদবিহারী বসুর কর্মক্ষেত্র চন্দ্রনগরে তিনি শিক্ষালাভ করেন।পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালায়। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের প্রবেশিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু শৈশবে রাসবিহারী বসুর পড়াশুনার প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না। তবে ইংরেজী-ফার্সী ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। ভারতবর্ষে শুধু ফার্সী ভাষা শিখলে চলবে না, তাই তাঁর বাবা তাঁকে কলিকাতা মটন স্কুলে ভর্তি করান। এই স্কুলে পড়াশুনার সময় তিনি ইংরেজী ভাষা শিক্ষা, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহী হন। বাল্যকাল থেকে তিনি ইংরেজী ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করতেন যা তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হত। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। কিন্তু সুন্দরভাবে ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারতেন। স্কুলে পড়াশুনার সময় চন্দননগরের মতিলাল রায়ের সাথে রাসবিহারী বসুর সৌহার্দ গড়ে উঠে। বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে তিনি অরবিন্দ ঘোষের সাথে পরিচিত হন। শ্রী অরবিন্দের সংস্পর্শে তিনি যোগতত্ত্বের (দেশমাতৃকার তরে জীবন উৎসর্গ করা) সন্ধান পান। তখন থেকেই রাসবিহারী বসু দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্বান্ত নেন। ১৯০৮ সালে বড়লাটকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বোমা নিক্ষেপ করে। এই ঘটনার পর পুলিশ মানিকতলা মুরারীপুকুর উদ্যানে তল্লাশি চালায়। এসময় পুলিশ রাসবিহারীর হাতে লেখা দু'টি চিঠি পায়। ওই বছর রাসবিহারী বসুকে 'আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলা'য় গ্রেফতার করে বেশ কিছুদিন কারাগারে রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তিনি মুক্তি পান। ওই সময় শশীভূষণ রায় চৌধুরী নামে এক দেশপ্রেমিক ডেরাডুনে শিক্ষকতা করতেন। তিনি রাসবিহারীর বিপদ দেখে নিজের চাকরিটি তাঁকে দিয়ে ডেরাডুনে পাঠিয়ে দেন। ডেরাডুনে শিক্ষকতা করার সময় রাসবিহারী বসু বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে ছুটি পেলেই তিনি চন্দনগরে চলে আসতেন। এই চন্দননগরেই বাল্য বয়সে তাঁর সশস্ত্র বিপ্লববাদী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল।বছর দেড়েক শিক্ষকতা করার পর তিনি ডেরাডুনে বন বিভাগের গবেষণাগারে কেরানির চাকরি নেন। ১৯১০ সালে তিনি বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেডক্লার্ক হয়েছিলেন। এসময় তিনি গোপনে বিপ্লবীদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা এবং হুগলি জেলার চন্দননগর। চন্দননগরকে গুপ্ত সশস্ত্র কর্মকাণ্ড, আগ্নেয়াস্ত্রের লেনদেন এবং বোমা তৈরির কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। বাইরে তাঁর বেশবাস সরকারি চাকরিজীবী ভদ্রলোকের মতো হলেও গোপনে তিনি ব্রিটিশদের নিদ্রাহরণকারী ভয়ানক বিপ্লবী ছিলেন।
১৯১২ সালে রাসবিহারী বসু দিল্লীতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যার বর্ণনা শুরুতেই দেয়া হয়েছে। রাসবিহারী বসুর একান্ত অনুগত শিষ্য কিশোর বসন্তকুমার বিশ্বাস লীলাবতীর বেশ ধরে বোমা নিক্ষেপকারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।১৯১১ সালে ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লির দরবারে ঘোষণা করেন, ১৯১২ সালে ভারতের সমস্ত প্রভাবশালী ও বিত্তবান ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি শোভাযাত্রা করবেন। ঘোষণা অনুযায়ী ১৯১২ সালের শীত কালে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রাটি কুইন্স গার্ডেন হয়ে চাঁদনীচক দিয়ে দেওয়ান-ই-আমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রাজ্যের সকল মানুষ এই শোভাযাত্রা দেখছেন। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ সস্ত্রীক হাতির পিঠে বসে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পাঠানো ষোড়শী ছদ্মবেশী একটি বালিকা লীলাবতী বড়লাটকে মারার জন্য মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনে বোমা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। অসংখ্য মহিলা সূরম্য পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের তৃতীয় তলায় শোভাযাত্রা দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। লীলাবতী চাদর গায়ে মহিলাদের মাঝে মিশে গেলেন। ইতিমধ্যে শোভাযাত্রাটি ভবনের প্রায় নিকটে চলে আসে।
ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের সম্মুখের আরেকটি ভবনে রাসবিহারী বসু সবকিছু সর্তকতার সাথে তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং লীলাবতীকে বোমা মারার ইঙ্গিত প্রদানের অপেক্ষায় রয়েছেন। লীলাবতীও রাসবিহারী বসুর ইঙ্গিতের জন্য অপেক্ষা করছেন। এমন সময় এক মহিলা লীলাবতীকে জিজ্ঞেস করে "তেরি নাম ক্যা বহিনী?" লীলাবতী রাসবিহারীর দিকে দৃষ্টি রেখে বলেন, "মেরী নাম লীলাবতী'। ততক্ষণে শোভাযাত্রাটি ভবনের একেবারে নিকটে চলে আসে। রাসবিহারী মহিলাদের দৃষ্টি শোভাযাত্রা অথবা তাঁর দিকে ফেরানোর জন্য জোরে বলে উঠেন, বড় আজব, সামনে দেখ বাহিনী। মহিলারা অন্যদিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি লীলাবতীকে ইঙ্গিত দেন। লীলাবতী তৎক্ষণাৎ বড়লাটকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। প্রচন্ড শব্দে সবাই এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। পুলিশ আততায়ীকে ধরার জন্য খোঁজ শুরু করে। রাসবিহারী বসু বসন্তকুমার বিশ্বাসকে লীলাবতীর বেশ পরিবর্তন করিয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ডেরাডুনে চলে যান। ভাগ্যক্রমে বড়লাট বেঁচে গেলেন, মারা গেল তাঁর একজন চৌকিদার (রাজদরবারের পেয়াদা)।
এই ঘটনার পর ব্রিটিশ পুলিশ এলোপাথাড়ি গ্রেফতার অভিযান চালায়। পুলিশ যাতে রাসবিহারীকে সন্দেহ না করে সে জন্য তিনি ডেরাডুনে গিয়ে বড়লাটের উপর বোমা হামলার নিন্দা জানিয়ে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।কয়েক মাস পর বসন্ত কুমার বিশ্বাসসহ ১০ জন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ১৯১৫ সালের ১১ মে ব্রিটিশ সরকার এই মামলায় বসন্ত কুমার বিশ্বাসসহ ৩ জনকে অবৈধভাবে গোলাবারুদ বহনের অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।
এই ষড়যন্ত্রের ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে মূল পরিকল্পক রাসবিহারী বসুর উপর ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিসহ তাঁর মাথার মূল্য ১২ হাজার রুপী পুরস্কার স্বরূপ ঘোষণা করে। অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ তাঁকে ধরতে ব্যর্থ হলে পরে পুরস্কারের অর্থের সঙ্গে আরও ৫ হাজার রুপী যোগ করা হয়। কিন্তু বিপ্লবী রাসবিহারীকে কেউ ধরিয়ে দিতে পারেনি। তিনি এই ঘটনার পর বারাণসী (বেনারস) শহরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে গুপ্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু তিনি বাইরে বেরুতে পারতেন না। কেননা তাঁর ছবিসহ পোস্টার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সর্বত্র।
দিল্লীতে লর্ড হার্ডিঞ্জ-হত্যা পরিকল্পনা ছিল বিপ্লবীদের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবের পদক্ষেপ কিন্তু সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় সুযোগ তাঁরা খুঁজে পেলেন লাহোরে। বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের গুপ্তদলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯১৩ সালে রাসবিহারী বসু পাঞ্জাবের ক্যাপ্টেন গর্ডনকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেন। এজন্য চন্দননগর হতে কয়েকটি বোমা আনেন। ১৩ মে লাহোরের লরেন্স পার্কে গর্ডন সাহেবের আসার কথা ছিল। রাসবিহারী বসন্তগুপ্ত নামক এক বালককে এই হত্যায় নিয়েজিত করেন। ওই দিন সন্ধ্যার সময় বসন্তগুপ্ত লরেন্স পার্কে সভামঞ্চস্থলের কাছের রাস্তায় একটি বোমা রেখে আসেন। কিন্তু বোমাটি গর্ডন সাহেব চলে যাওয়ার পর বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে তিনি বেঁচে যান। এতে মারা যান রাম নামক এক ব্যক্তি।
লাহোরে এই ঘটনার পর পুলিশের নজরদারী আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। বারাণসীও অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ওই বছর রাসবিহারী সন্ন্যাসীর বেশে তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাশী চলে যান। সেই সময় শচীন্দ্রনাথ সান্যাল কাশীতে ঢাকা 'অনুশীলন সমিতি'র একটি শাখা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু দিল্লী ও লাহোর ষড়যন্ত্রের পর ব্রিটিশ সরকার 'অনুশীলন সমিতি'কে নিষিদ্ধ করে। যার কারণে শচীন্দ্রনাথ সান্যাল 'অনুশীলন সমিতি'র নাম পরিবর্তন করে 'ছাত্র-যুব সঙ্ঘ' নামকরণ করেন। রাসবিহারী কাশীতে এসে এই 'ছাত্র-যুব সঙ্ঘ'-এর সাথে যুক্ত হন এবং এক পর্যায়ে এই সঙ্ঘের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন। তিনি এই সঙ্ঘের সদস্যদের অস্ত্র চালানো ও বোমা নিক্ষেপ প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি কাশীতে থাকাকালীন দিনে বের হতেন না। তিনি নানা নামে নানা পরিচয়ে চলাফেরা করতেন। এসময় তিনি সুরেন্দ্রনাথ দত্ত ও নরেন্দ্র সেন নামে অমৃতবাজার পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন।
কাশীতে বিষ্ণু গনেশ পিঙ্গলু নামে মুম্বাই প্রদেশের দুই মারাঠী দেশপ্রেমিক ও বিনায়ক রাও কাপলের সাথে রাসবিহারীর পরিচয় ঘটে। যারা আমেরিকায় ছিলেন দীর্ঘদিন। তাঁরা রাসবিহারী বসুকে জানান, গদার পার্টির চার হাজার সদস্য আমেরিকা থেকে বিদ্রোহের জন্য ভারতে এসেছেন। বিদ্রোহ শুরু হলে আরো ২০ হাজার সদস্য ভারতে আসবে। আমরাও দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। ইতিমধ্যে আমেরিকা থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভারতে এসে তাঁর সাথে যোগাযোগ করেন।
১৯১৪ সালে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করতে অবিরত কাজ করেন রাসবিহারী বসুসহ অন্যান্য বিপ্লবীরা। গোপনে গোপনে সেনাবাহিনী এইসব সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন রাসবিহারী বসু। দেশ-বিদেশ থেকে বিপ্লবী গদার পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়। সংগ্রহ করা হয় বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। ১৯১৫ সালে রাসবিহারী 'ছাত্র-যুব সঙ্ঘে'র একটি সভা করে দলের সভ্যদেরকে 'দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করার প্রস্তুতি নিতে বলেন'। তিনি সমগ্র ভারত নিয়ে একটি বিপ্লবের চিন্তা করেন। তিনি শচীন্দ্রণাথ সান্যালের সহযোগিতায় বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লী, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের 'জাতীয় অভ্যুত্থানের' জন্য অনুপ্রাণিত করে তাঁদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলেন।
১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বিদ্রোহ ঘটানোর দিন ধার্য করা হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি। প্রধান লক্ষ্যস্থল পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর। সেইসঙ্গে বারাণসী ও জব্বলপুর সেনা ঘাঁটিও প্রস্তুতি নিয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। রাসবিহারী বসু লাহোর শহরের ৪টি গুপ্তস্থানে এই সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান গুপ্ত দপ্তর স্থাপন করেন। অবাঙালি বিপ্লবী রামশরণ দাসের বাড়িতে বিদ্রোহের আদেশ প্রদানের সময়টুকুর প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিদ্রোহের ঠিক ৪ দিন পূর্বে এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস করে দেয় রামশরণ দাস। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে যেখানে যেখানে সম্ভব ভারতীয় সৈন্যদেরকে অস্ত্রহীন করে এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪ প্রধান দপ্তরের একটিতে অকস্মাৎ হামলা চালায়। বিপ্লবীদের একটি দল ১৯ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় লাহোরে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই সশস্ত্র হামলায় দুপক্ষের অনেক লোক মারা যায়। দ্রুত সমস্ত লাহোরব্যাপী এই ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন সমস্ত শক্তি দিয়ে এই সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র দমন করতে সক্ষম হয়।এটাই ঐতিহাসিক 'লাহোর ষড়যন্ত্র' নামে পরিচিত। এই ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতায় অনেক বিপ্লবী গ্রেপ্তার এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এই সময় তিনি কাশী থেকে চলে আসেন কলকাতায়। তারপর চন্দননগর, নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে খুব সর্তকতার সাথে ঘুরে ঘুরে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে তিনি কখনো নারী বেশে, কখনো দারোয়ান, কাজের লোক, সন্ন্যাসি বেশে চলাফেরা করতেন। তিনি এমনভাবে চলতেন যাতে কেউ কোন ধরনের সন্দেহ না করতে পারে। এরপর সশস্ত্র বিপ্লবকে সফল করার উদ্দেশ্যে বেছে নেন জাপান দেশটিকে।
১৯১৫ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সন্ন্যাসীর বেশে কলকাতাগামী ট্রেনে জাপানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। স্টেশনে স্টেশনে তাঁর ছবিসহ পোস্টার লাগানো থাকায় রাসবিহারী বসু নানা কৌশল অবলম্বন করে ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করে জাপানে পৌঁছেন। ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের পত্রপত্রিকায় এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যাচ্ছেন এরকম সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সেটা দেখে রাসবিহারী বসু জাপানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং রবীন্দ্রনাথের সচিব হিসেবে (মতান্তরে আত্মীয়) পি. এন. ঠাকুর (প্রিয়নাথ ঠাকুর) নাম ধরে জাপানে বসবাস শুরু করেন।
জাপানে এসে তিনি প্রথমে পাঞ্জাবের দুর্দান্ত বিপ্লবী ভগবান সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর জাপানে পলাতক চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সান-ইয়াৎ সেনের (১৮৬৬-১৯২৫) কথা জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান সহযোগিতা পাবার আশায়। সান-ইয়াৎ তাঁকে গুরু তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। এর কয়েক মাস পরেই জাপানে আসেন আর এক দুর্দান্ত বিপ্লবী হেরাম্বলাল গুপ্ত (১৮৮৯-১৯৬৫) একই পুরস্কারের অঙ্ক মাথায় নিয়ে। তাঁদের দুজনকে জাপানি পুলিশের হাত থেকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রভাবশালী গণমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা রাজনীতিক এবং ‘গেনয়োশা’ নামক গুপ্ত সমিতির পরিচালক গুরু তোয়ামা মিৎসুরু (১৮৫৫-১৯৪৪)।তাঁকে আরও যাঁরা সহযোগিতা করেন এবং পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন তাঁরা হলেন: কুজো ইয়োশিহিসা, উচিদা রিয়োহেই, ওওকাওয়া শুমেই, সুগিয়ামা শিগেমারু, ইয়াসুওকা মাসাহিরো, শিমোনাকা ইয়াসাবুরো, ওজাকি য়ুউকিও, গোতো শিনপেই, মিৎসুকাওয়া কামেতারো, নাকানো সেইগো, সাসাকি ইয়াসুগোরো, কিমুরা নিক্কি, ড.ওওকুরা কুনিহিকো, ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, য়োশিদা শিগেরু প্রমুখ প্রভাবশালী আদর্শবান এশিয়াবাদী (প্যান-এশিয়ানিস্ট) রাজনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। তাঁদের আগমনের কয়েক মাস পর নভেম্বর মাসে জাপান সফরে আসেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী নেতা, ভয়ঙ্কর বিপ্লবী বলে পরিচিত লালা লাজপৎ রায় (১৮৬৫-১৯২৮)। রাসবিহারী বসু তাঁর আগমনকে উপলক্ষ করে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করতে মনস্থির করেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি চাচ্ছিলেন জাপানি সমাজে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচার করতে যাতে করে জাপানি নাগরিকরা প্রবাসী বিপ্লবীদেরকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে, পাশাপাশি ভারতে বৃটিশের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যদিও জাপান তখন সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ।দর্শনশাস্ত্রের গবেষক তুখোড় তরুণ বুদ্ধিজীবী ওওকাওয়া শুমেই (১৮৮৬-১৯৫৭)-এর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি গভীরভাবে সহানুভূতিশীল ছিলেন। সম্ভবত তাঁরই পরামর্শে টোকিওর উয়েনো শহরের বিখ্যাত সেইয়োকেন্ মিলনায়তনে তাইশো সম্রাট ইয়োশিহিতো’র (১৯১২-২৬) সিংহাসন আরোহণকে কেন্দ্র করে একটি অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে মূল লক্ষ্য অনুসারে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন লালা লাজপৎ রায়, রাসবিহারী বসু, হেরাম্বলাল গুপ্ত। তোয়ামা মিৎসুরুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন।এই অনুষ্ঠানে বৃটিশ দূতাবাসের কতিপয় গুপ্তচর উপস্থিত ছিলেন তাঁরা যথা সময়ে বিবরণ উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রদূতের কাছে। পরের দিন বৃটিশ দূতাবাস জাপান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে বিপ্লবীদেরকে ধরিয়ে দেবার জন্য। সরকার বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে জাপানত্যাগের নির্দেশ জারি করে। লালা রাজপৎ রায় আমেরিকা চলে যান। রাসবিহারী এবং হেরাম্বলালকে গুরু তোয়ামা আশ্রয় প্রদান করেন। তাঁদেরকে তাঁর বাড়ির কাছেই শিনজুকু শহরে অবস্থিত সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘নাকামুরায়া’র কর্ণধার সোমা আইজোর সঙ্গে আলাপ করে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে একটি পরিত্যক্ত ছবি আঁকার স্টুডিও ভবনে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু কিছুদিন পর পুলিশ ঠিকই তাঁদের গুপ্ত অবস্থান জানতে পারে। এর মধ্যে হেরাম্বলাল গৃহবন্দী অবস্থায় অস্থির হয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং ওওকাওয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। মাস চারেক সেখানে থাকার পর আমেরিকায় চলে যান।
এদিকে যখন রাসবিহারী বসুকে আর কিছুতেই পুলিশের নজর থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না তখন তোয়ামা মিৎসুরু সোমা আইজোকে তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা তখন কলেজ ছাত্রী তোশিকো সোমার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাবে সোমা দম্পতি মহাবিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। কিন্তু তাঁদেরকে রক্ষা করেন তোশিকো নিজেই এগিয়ে এসে। প্রস্তাবিত বিয়েতে তিনি রাজি হন। বলেন, ‘মিঃ বোস স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জাপানে থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সহযোগিতা করতে চাই, আমাকে তাঁর কাছেই যেতে দাও।’ তাঁদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৮ সালের ৯ই জুলাই তোয়ামা মিৎসুরুর বাড়িতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে।
কিন্তু বিয়ের পরও কয়েক মাস বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে জীবন যাপন করতে হয় তাঁদেরকে। শাশুড়ি সোমা কোক্কো’র ডায়েরি থেকে ১৭ বার বাসা বদলের তথ্য পাওয়া যায়। এই সময় বিহারী বসু তাঁদের বিয়ে নিয়েও মানসিক অশান্তিতে ভোগেন কিছুদিন। নববিবাহিতা স্ত্রী তোশিকো আসলেই তাঁকে ভালোবাসে কিনা এই সন্দেহে দগ্ধ হচ্ছিলেন। তোশিকো কি পারিবারিক শুভাকাঙ্খী গুরুস্থানীয় তোয়ামা মিৎসুরুর প্রস্তাব উপেক্ষা করতে না পেরে অনিচ্ছাসত্ত্বে তাঁকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে? এই প্রশ্নটি তাঁকে সর্বক্ষণ তাড়া করছিল। একদিন দুজনে বেড়াতে গিয়ে নিভৃতে বিহারী বসু তোশিকোকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, তোশিকো যদি সত্যিই তাঁকে ভালোবাসে তাঁর সামনে প্রমাণ করতে পারবে কিনা? তোশিকো এই কথা শুনে অশ্রুসিক্ত হন। বিহারী বসু বলেন, যদি ভালোবাসো তাহলে এই বারান্দা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরে প্রমাণ করতে পারবে? সঙ্গে সঙ্গে তোশিকো দৌড়ে ঝাঁপ দিতে গেলে বিহারী বসু তাঁকে জাপটে ধরে আলিঙ্গন করেন। এরপর আর কোনোদিন তাঁদের মধ্যে এ প্রসঙ্গ ওঠেনি। এই ঘটনার পেছনে মূল কারণ ছিল তোশিকোর সঙ্গে নাকামুরায়ার অভ্যন্তরে আশ্রিত নাকামুরা ৎসুনে নাম্নী জনৈক তরুণ চিত্রশিল্পীর সঙ্গে তোশিকোর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা বিহারী বসু জানতেন। ৎসুনে কর্তৃক গোপনে তোশিকোর কয়েকটি ছবি আঁকার ফলে সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঐ চিত্রশিল্পীকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিহারী বসু বিয়ের পরও সেই প্রেম তোশিকো ভুলতে পারেনি বলে মনে মনে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তা যে নয় তোশিকো তা প্রমাণ করে দেয়ার পরে বিহারী বসু আশ্বস্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে পালিয়ে থাকলেও দুজনে খুব সুখী ছিলেন। তোশিকো ছিলেন মেধাবী ছাত্রী এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। তিনি বিহারী বসুর একান্ত সচিবের মতো সকল দাপ্তরিক কাজকর্ম করতেন।
১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপে যুদ্ধবিরতি এবং পরের বছর প্যারিস শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়। ফলে বিহারী বসুর উপর থেকে জাপান সরকার সকল বাধানিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বন্ধের সূত্র ধরে ভারতে বৃটিশ প্রশাসন ১৯২১ সালে ‘রয়্যাল ক্লেমেন্সি’ বা ‘রাজকীয় ক্ষমা’ ঘোষণা করে বৃটিশবিরোধী বিদ্রোহী, বিপ্লবী-সন্ত্রাসীদের জন্য একটি শর্তে যে, ক্ষমা চেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে হবে। এই সুযোগ গ্রহণ করেন অনেক জেলবন্দী বিপ্লবী; এমনকি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত আসামিরা পর্যন্ত ছাড়া পান কিন্তু তাঁরা মুক্ত হয়েই গা ঢাকা দেন। এই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য রাসবিহারী বসুও চন্দননগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে বাংলার ইংরেজ গভর্নমেন্টের কাছে লিখিত পত্রে আবেদন জানান ১৮ এপ্রিল ১৯২১ তারিখে। কিন্তু বৃটিশ সরকারের বিবেচনায় বিহারী বসু তখনও এক নম্বর শত্রু বলে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর কী হয়েছিল জানা যায় না, তবে তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রকৃত কারণ আজও রহস্যজনক। যাই হোক, পলাতক জীবনের ইতি ঘটিয়ে এবার মুক্ত আলোয় স্বাধীনভাবে বসবাস শুরু করেন নবদম্পতি। দুবছর পর ১৯২০ সালে পুত্র মাসাহিদে ১৯২২ সালে এবং কন্যা তেৎসুকো জন্মগ্রহণ করে। নিজের বংশ পরিচয়ে পরিচিত করার জন্য তিনি জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন ১৯২৩ সালে। কিন্তু দাম্পত্য-সুখ বেশি দিন তাঁর ভাগ্যে সয় না। পলাতক জীবনে স্ত্রী তোশিকোকে অমানবিক কষ্ট সহ্য করতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গায়, সেখানে না ছিল পর্যাপ্ত আলো-বায়ু, না ছিল সুস্থ পরিবেশ। ফলে লাগাতার জ্বরজারি থেকে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ভুগে ১৯২৫ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে পরলোকে যাত্রা করেন। ধরায় রেখে যান প্রাণপ্রিয় স্বামী ও দুটি শিশুসন্তানকে। পরলোকগত স্ত্রীর ভালোবাসার সম্মানার্থে রাসবিহারী বসু আর বিয়ে করেননি বাকি জীবনে শাশুড়ির আবেদন-বিবেদন সত্ত্বেও। পত্নীবিয়োগের এক বছর পর ১৯২৭ সালে নাকামুরায়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ্বিতলে ভারতীয় কারি রেস্টুরেন্ট ‘ইন্দো নো মোন’ তথা ‘ভারতীয় তোরণ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ৮০ বছর পেরিয়ে এই কারি রেস্টুরেন্ট এখনও ‘নাকামুরায়া নো কারেএ’ নামে জাপানে কিংবদন্তীসম জনপ্রিয়। রাসবিহারী বসুই প্রথম জাপানে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মশলায় রাঁধা মুরগি-মাংসের কারি প্রচলন করেন। একই ধরনের সুস্বাদু কারি আজও জাপানি পাচক উপহার দিচ্ছেন প্রতিদিন। ভারত বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা তাঁর সম্পর্কে জানেন এই রেস্টুরেন্টে এসে এই কারির স্বাদ গ্রহণ এবং রাসবিহারী বসুকে স্মরণ করেন তবে তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই আঙুলে গোনার মতো।এই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এখানে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনকারী জাপানি রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ আলাপ-আলোচনায় বসতেন। অবশ্য অন্যান্য প্রবাসী ভারতীয়রাও আসতেন নিয়মিত। রাসবিহারী বসু ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের (IIL: Indian Independence League) প্রেসিডেন্ট। অসাধারণ কূটনৈতিক মেধাশক্তি ও বিচক্ষণতা দিয়ে প্রভাবশালী জাপানি নেতৃবৃন্দের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার যেমন করতে পেরেছিলেন তেমনি জাপানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশ্বাস ও রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা ছিল ভিন্ন দুটি জাতি ও সংস্কৃতির সমন্বয় রক্ষার্থে অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। কিন্তু এই কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন বলা যায়।
ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনে জাপান-প্রবাসী রাসবিহারী বসুর অবদানের কথা বলতে গেলে এটাই শুধু বলতে হয় যে, তিনি জাপানে না এলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কোন পথে যেত এবং কবে স্বাধীনতা আসত বলা মুশকিল। মূলত তাঁর প্রচেষ্টার জোরেই জার্মানি প্রবাসী সুভাষচন্দ্র বসু জাপানে আহুত হয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA: Indian National Army) মূলত বিহারী বসুর পরিকল্পনা ও উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ১৯৪২ সালেই এবং পরে সুভাষচন্দ্র বসু যার অধিনায়ক হন। এবং এই উপলক্ষে সিঙ্গাপুরে আয়োজিত এক মহাসভায় রাসবিহারী বসুই সুভাষ বসুকে ‘নেতাজি’ অভিধা প্রদান করেন বলে কথিত আছে। তিনি গোঁড়া থেকেই গান্ধীকে ভক্তি করলেও তাঁর অহিংস নীতির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি গান্ধীর বিকল্প একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধিনায়কের প্রত্যাশায় ছিলেন। সেই অধিনায়কই হচ্ছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁকে ‘দেশনায়ক’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মৃত্যুর আগে। তাঁর সঙ্গে ১৯৩৮ সাল থেকেই রাসবিহারী চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিস্থিতি বুঝে ১৯৪০ সালে গান্ধীকে ‘গতকালের লোক’ বলে অভিহিত করে ‘আজকের অবিসংবাদিত নেতা’ হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ঘোষণা করেন। বিভিন্ন জাপানি পত্রিকা ও সাময়িকীতে সুভাষ বসুর নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তাঁর চৌকস তারুণ্য, যোগ্যতা, অনস্বীকার্যতা এবং বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব তুলে ধরে একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন মূলত এশিয়াবাদী ভারতদরদী জাপানি রাজনীতিক, প্রভাবশালী সরকারি কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সহানুভূতি লাভের জন্য। যাতে করে জাপানিদের সামনে বর্তমান ও আগামী ভারতবর্ষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর একটি সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে—যেহেতু জাপান ছাড়া আর কোনো দেশ ছিল না তখন যে দেশটি ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত জাপানের সশস্ত্র ভূমিকাই ভারতবাসীর আরাধ্য স্বাধীনতা দ্রুত অর্জনে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু এর জন্য রাসবিহারী বসুসহ অসংখ্য প্রবাসী বিপ্লবী ও নেতাজির বহু বছরের সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষাকে স্বীকার না করলে নয়। কিন্তু তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন আজও হয়েছে বলে মনে হয় না।চরমপন্থী রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু শক্তিশালী ‘হিন্দুমহাসভা’র প্রতিষ্ঠাতা (১৯১৫) গান্ধী-কংগ্রেসবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী বিপ্লবী বীর দামোদর সাভারকারে’র পরামর্শে ভারত ত্যাগ করে রাশিয়া হয়ে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ জার্মানির বার্লিন শহরে পৌঁছেছিলেন। সেখানে থেকেই তিনি স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে থাকেন। একমাত্র বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৪৩ সালের ১৬ মে জাপানে আগমন করেন। এই সালেই নেতাজি গঠিত স্বাধীন ভারত সরকারের (Free India Government/Provisional Government) প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন রাসবিহারী বসু। তখন তিনি মরণব্যাধি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত, অসুস্থ। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি টোকিওর নিজগৃহে। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে মাসাহিদে বোস জাপানি সৈন্য হিসেবে ওকিনাওয়া যুদ্ধে মিত্রশক্তি মার্কিনী সেনাদের হাতে প্রাণ হারান। মেয়ে তেৎসুকো বোস হিগুচি পদবিধারী জনৈক জাপানি প্রকৌশলীকে বিয়ে করে বর্তমানে বার্ধক্য জীবন অতিবাহিত করছেন। একবারও যেতে পারেননি স্বাধীন পিতৃভূমিতে। কেন যেতে পারেননি সেও এক রহস্য। স্বাধীন ভারতের কোনো রাজনীতিক তাঁকে তাঁর পিতৃভূমিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিনা জানি না, জানালে নিশ্চয়ই তিনি যেতেন। তবে মেয়ে তথা রাসবিহারীর পৌত্রী মাতামহের জন্মস্থান একবার ঘুরে এসেছেন ব্যক্তিগতভাবে। সম্প্রতি বিশিষ্ট ভারত-বিষয়ক গবেষক এবং হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাকাজিমা তাকেশি তেৎসুকো হিগুচির মুখে শোনা তাঁর পিতার কাহিনী একটি চমৎকার গ্রন্থ চিচি বোওসু বা পিতা বোস-এ লিপিবদ্ধ করেছেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন যেমন শিক্ষামূলক তেমনি বৈচিত্র্যময় একটি উপন্যাস বললে অত্যুক্তি হয় না, যা চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হলে পরে তরুণ প্রজন্মকেই শুধু স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ করবে না, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’দের জন্যও শিক্ষণীয় হবে নিঃসন্দেহে। ন্যাশনালিস্টরা যে চোর হয় না, জনগণের সম্পদ লুন্ঠনকারী নয়, একমাত্র নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন কৈশোর থেকেই তার আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন। তাঁর নীতিজ্ঞান ছিল অত্যন্ত খাঁটি। তিনি যেমন ছিলেন একনিষ্ঠ হিন্দুধর্মাবলম্বী তেমনি নিঃস্বার্থ স্বদেশপ্রেমে তেজস্বী। নিয়ম ও সময়জ্ঞান ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রখর। তাঁর প্রবল আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ তাঁকে আজীবন সশস্ত্রবিপ্লবের প্রতি অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছিল। ১৯৩৫ সালে তিনি টোকিওতে বিশ্ব আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, নিজেও গবেষণা করেছিলেন মূলত বিশ্বসংস্কৃতিকে আরও অনুধাবন করার জন্য। শুধু এশিয়ার পরাধীন মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণার্থে তাঁর উদ্যোগের ইতিহাস অপ্রচারিতই থেকে গেছে।ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবাসী ভারতীয়দেরকে একত্রিত করার জন্য তিনি ‘ভারত মৈত্রী সমিতি’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে শুধু যে ভারতীয়রা আসতেন তা নয়, ভারত, এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহী জাপানিরাও আসতেন। আলাপ-আলোচনা এবং পান-ভোজনাদি হত বেশ ঘটা করে। প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালের ৩০ শে জুন তারিখে তাঁর রেস্টুরেন্টের ভিতরেই। তাতে ৩১ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন জাপানের স্বনামখ্যাত আন্তর্জাতিক কবি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু নোগুচি ইয়োনেজিরো (১৮৭৫-১৯৪৭) বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সমিতির সর্বমোট ১০টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমিতি থেকে ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সম্মেলনে জাপান থেকে একজন প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। আবার ভারত থেকে বিশেষ অতিথি কেউ এলে তাঁর স্মরণে বিশেষ সভা-সম্মিলনেরও আয়োজন করেছেন তিনি। যেমন জাপানস্থ প্রাচ্য গবেষণা সংস্থায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিনয়কুমার সরকার; জাপান সফরে এসেছিলেন স্বনামখ্যাত বৌদ্ধভিক্ষু রাষ্ট্রপাল সান্ধিরিয়া; বিশ্বভারতীর জনৈক শিল্পী-অধ্যাপকও এসেছিলেন বলে জানা যায়, তাঁরা বিশেষ সভায় আলোচনা ও বক্তৃতা করেছিলেন।নানাবিধ কাজের পাশাপাশি রাসবিহারী বসু নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকসাহিত্য এবং ভারতে বৃটিশের শাসন-শোষণ নিয়ে অনেক লেখা জাপানি জাতীয় দৈনিক, সাময়িকী ও সংকলনে প্রকাশ করেছেন। তবে অধিকাংশই জাপানি ভাষায়। সারা জাপান ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অবরুদ্ধ, শোষিত মাতৃভূমির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দুরবস্থার ইতিহাস তুলে ধরেছেন জাপানিদের সামনে। জাপানে এশিয়ানদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এশিয়ানদের মুখপত্র হিসেবে নিজব্যয়ে মাসিক নিউ এশিয়ানামে একটি তথ্যভিত্তিক কাগজ প্রকাশ করেছিলেন কিছুদিন। স্বনামে ও যৌথভাবে প্রায় ১৫/১৬টি গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন। যার মধ্যে গ্রন্থিত আছে মূল্যবান বিস্তর তথ্য ও ঘটনা। গ্রন্থগুলোর মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন। চরমপন্থী বিপ্লবী হলেও তিনি যে রোমান্টিক ছিলেন তাতেই প্রমাণিত হয়। যুদ্ধপূর্ব টোকিওর সবচেয়ে ব্যয়বহুল কেতাদুরস্ত আধুনিক শহর ‘গিনজা’তে প্রায়শ সন্ধ্যেবেলা ‘সুশি বার’ পানশালায় বন্ধুদের সঙ্গ দিতেন।