মুঘল বাদশাহ বাবরের সময় সতীদাহ প্রথাটি অনেক কমে গিয়েছিল। আর বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সময় সতীদাহ প্রথাটা এক প্রকার বন্ধই হয়ে গেছিল। আবার অনেক উচ্চ বর্ণের হিন্দু মেয়েকে স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা আগুনে পোড়াতে চাইলে তখন সে স্থানীয় শাসকের কাছে মুসলমান হয়ে যেত। সতীদাহ প্রথা নির্মূলীকরণে মুসলমানদের কতোটা অবদান ছিল.. আসুন সেটা দেখে নেওয়া যাক।
সতীদাহ প্রথা নির্মূলীকরণে মুসলিমদের আইনানুগ অবদান
1. সতীদাহ প্রথা বন্ধের প্রথম সরকারি প্রচেষ্টা মুসলিমরা করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সর্বপ্রথম এই প্রথা বন্ধের চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। [L. C. Nand, Women in Delhi Sultanate, Vohra Publishers and Distributors Allahabad 1989]
2. মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যারা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হুমায়ূন স্থানীয় হিন্দুদের প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন। [Central Sati Act – An analysis by Maja Daruwala is an advocate practising in the Delhi High Court. Courtsy: The Lawyers January 1988. The web site is called “People’s Union for Civil Liberties”]
3. অনেক সময় মুঘল প্রসাশন থেকে বিধবা মহিলাদের পেনশন বা উপহার দেওয়া হতো সতীদাহ না করার জন্য। [উপরের সূত্র দ্রষ্টব্য]
4. শিশুদের এই প্রথা থেকে রক্ষা করা হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহানের সময় নিয়ম ছিল কোনো অবস্থাতেই যেসব মহিলাদের সন্তান আছে তাদের দাহ হতে দেওয়া হবে না। [XVII. “Economic and Social Developments under the Mughals” from Muslim Civilization in India by S. M. Ikram edited by Ainslie T. Embree New York: Columbia University Press, 1964. This page maintained by Prof. Frances Pritchett, Columbia University]
5. সব থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়। 1663 সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রুল জারি করেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে মুঘল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দেশের কোথাও সতীদাহ ঘটতে সরকারি অনুমতি দেওয়া হবে না। ইউরোপীয় পর্যটকদের বর্ণনা অনুযায়ী সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষের দিকে সতীদাহ প্রথা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু রাজাদের স্ত্রীরা ব্যতীত। [XVII. “Economic and Social Developments under the Mughals” from Muslim Civilization in India by S. M. Ikram edited by Ainslie T. Embree New York: Columbia University Press, 1964. This page maintained by Prof. Frances Pritchett, Columbia University]
সতীদাহ প্রথা বন্ধে ইসলামের পরোক্ষ অবদান
ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষা নিয়ে হিন্দু ধর্মের সংষ্কারে সৃষ্টি হয় শিখ ধর্ম যাতে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ। তার মানে ভারতে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের প্রথম অমুসলিম ভারতীয় পদক্ষেপটিও আসে ইসলামেরই প্রভাবে। খারাপকে খারাপ জানতে পারা অনেক বড় বিষয়, আর এই কাজটিই ভারতে ইসলাম করেছে। ইসলাম সবাইকে মুসলিম বানাতে না পারলেও ভারতের সার্বিক মূল্যবোধ তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সতীদাহ যে একটি চরম অমানবিক প্রথা, নিদেনপক্ষে এটা ভারতীয়দের বুঝাতে পেরেছে – শিখ ধর্মে সতীদাহ নিষিদ্ধ হওয়া তারই একটি বাস্তব প্রতিফলন।
রাজা রামমোহন রায়ও ইসলাম সম্পর্কে গভীরভাবে পড়াশুনা করেন, কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করেন, এবং মু'তাজিলা ও সুফীবাদ দ্বারা প্রভাবিত হন। ফলে তিনি মূর্তিপূজা ছেড়ে দেন এবং একেশ্বরবাদী হয়ে যান। যার ফলশ্রুতিতে পিতার সাথে মতবিরোধের কারণে তাকে গৃহত্যাগ করতে হয়। তাই একেশ্বরবাদী রাজা রামমোহনের মনন সৃষ্টিতে ইসলামের অবদান অস্বীকার করা যায় না। এজন্য তাঁর দ্বারা সনাতন ধর্মের যদি কোনো উপকার হয়ে থাকে, তাহলে সেই উপকারের পিছনে ইসলামের নাম রাখতেই হবে।
আপনারা হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী(রহঃ)-এর নাম শুনেছেন? বাদশাহ আকবর যখন মুরতাদ হয়ে দ্বীনে ইলাহী ধর্ম প্রচার শুরু করেন তখন মুজাদ্দেদ আলফেসানী(রঃ) বাদশাহ আকবরের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। পরে বাদশাহ আকবর উনাকে বন্দী করেন। বাদশাহ আকবরের মৃত্যুর পর বাদশাহ জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ আলফেসানীর(রহঃ) কাছে ক্ষমা চেয়ে উনাকে মুক্ত করে দেন। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রহঃ) ঐ সময় যে বিভিন্ন চিঠিপত্র লিখতেন যেটাকে মাকতুবাদ বলে এই মাকতুবাদ বা চিঠিপত্র গুলি বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলা অনুবাদ করে বের করেছে। সেইখানে এরকম অনেক কাহিনী পাওয়া যায় যে মুজাদ্দেদ আলফেসানী(রহঃ) উচ্চ বর্ণের অনেক হিন্দু মেয়েকে বিধবা হওয়ার পর আগুনে পোড়ানোর হাত থেকে বাচিয়েছিলেন।
যাই হোক লর্ড বেন্টিঙ্ক 1829 সালে সতীদাহ প্রথাটি নিষিদ্ধ করলেও দেশের কিছু কিছু জায়গায় এই ঘৃণ্য পৈশাচিক প্রথাটি বহুদিন পর্যন্তই রমরমিয়ে চলেছিল। যেমন ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলাতে কিন্তু 1900 সাল পর্যন্ত সতীদাহ প্রথা চলেছিল। এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানে এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও বিদ্যমান ছিল প্রাচীন নৃশংসতম সতীদাহ প্রথা। আজ থেকে মাত্র 11 বছর পূর্বে 2006 সালে মধ্যপ্রদেশের তুলসীপূর গ্রামে “জনক রাণী” নামে জনৈক রমণী এই রীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার স্বামীর মৃত্যুর পর চিতা খোলায় নিজেকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। উল্লেখ্য, এর আগে 2002 সালে মধ্যপ্রদেশে 65 বছরের এক বৃদ্ধাকে এবং 1987 সালে রাজস্থানে রূপ কানওয়ার নামে 18 বছরের এক কিশোরীকেও জ্বলন্ত চিতায় মৃত স্বামীর সাথে জোর করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
আধুনিক কালেও সতীদাহ প্রথা চলছে…
http://news.bbc.co.uk/2/hi/south_asia/5273336.stm Last Updated: Tuesday, 22 August 2006, 06:57 GMT 07:57 UK
Police in India say a woman has burned to death on her husband's funeral pyre, committing the outlawed Hindu practice of "sati".
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'প্রথম আলো' উপন্যাসটি যারা পড়েছেন তাদের মনে পড়বে.. ঐ যে ত্রিপুরার মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য.. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস 'প্রথম আলো'তে একটা তথ্য উল্লেখ করেন যে 1900 সালেও এই আগরতলা রাজ্যে সতীদাহ প্রথা চলেছিল। এক সেনাপতির মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে আগুনে পোড়ানোর ঘটনাও এই ঐতিহাসিক উপন্যাসে বর্ণনা করা হয়েছে। ত্রিপুরার মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য যখন কলকাতা গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য তখন এক বড় ডাক্তার রাধাকিশোর মাণিক্যকে তার গায়ের চামড়া ধরে টান দিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিল আর বলেছিলযে আপনার এই চামড়া যদি আগুনে পুড়াই তাহলে আপনার কেমন লাগবে ? আর আপনার রাজ্যে এখন জীবিত মেয়েদের কে আগুনে পুড়ান হচ্ছে আর আপনি এই সতীদাহ প্রথা কে সমর্থন দিচ্ছেন।..যাই হোক.. প্রথম আলো উপন্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব চমৎকার ভাবেই ত্রিপুরা রাজ্যের ওই 1900 সালেও সতীদাহ প্রথার কাহিনী গুলি তুলে ধরেছেন।
সেইজন্যই আমাদের খুব খারাপ লাগে যখন আমরা দেখি হিন্দু ছেলে মেয়েরা ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিদ্রুপ করে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে অবমাননামূলক কথাবার্তা বলে। এই হিন্দু মেয়েরা কি ইসলাম আসার পূর্বে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়েননি? এমনকি তারা কি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'প্রথম আলো' উপন্যাসটাও পড়ে দেখতে পারেননি যে কিরকম অত্যাচার করা হয়েছিল তাদের উপরে ইসলাম আসার পূর্বে। ভাই.. ইসলাম তো লাখলাখ হিন্দু মেয়েকে আগুনে পোড়ানোর হাত থেকে বাঁচিয়েছে, হাজার হাজার হিন্দু মেয়েকে মন্দিরের সেবাদাসী হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। অন্তত এই কারণেই, শিক্ষিতা হিন্দু মেয়েদের উচিত ইসলামকে ভালবাসা। স্বামী বিবেকানন্দ একটা কথা যথার্থই বলেছিলেন যে - “ইসলাম তো ভারত বর্ষের নিপীড়িত জনগণের জন্য ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল।”....

.