শুক্রবার, ১৩ জুলাই, ২০১৮

রাসবিহারী বসু ( দুই )


                    রাসবিহারী বসু ( দুই )


                    ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন :         প্রণব কুমার কুণ্ডু




রাসবিহারী বসু কেন জাপানে গিয়েছিলেন ?

(তৃতীয় পর্ব)

১৯১৫ সালের সেপ্টম্বর ও অক্টোবর এই দুই মাস ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্ৰামের ইতিহাসে বড়োই দুর্ভাগ‍্যের। প্রথমত সেপ্টম্বর মাসের ৯ তারিখে বাঙলার দুই দামাল বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ ও চিত্তপ্রিয় হঠাৎই নিহত হলেন। যতীন্দ্রনাথের মতোন মহান সংগঠক কে আমরা এমন সময় হারালাম যখন বিদেশ থেকে জার্মান সাহায‍্য আসার সব ব‍্যবস্থা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। অপর দিকে অক্টোবর মাসে রাসবিহারীর সাংহাইতে তৈরি করা দুটো প্রচেষ্টাই ব্রীটিশ গোয়ন্দাদের হাতে ধরা পরে যায়। প্রথমে নিলসেনের দ্বারা নিযুক্ত চীনা কে সাংহাই পুলিস গ্ৰেফতার করলো এবং তাকে জেরা করে সমস্থ নাম ঠিকানা জেনে নিল। এর পর আবার সিঙ্গাপুর পুলিসের হাতে অবনী মুখার্জী তাঁর সেই বিখ‍্যাত নোটবই সমেত ধরা পড়ল এবং সেই নোটবই থেকে তো ব্রিটিশ পুলিশ অনেক নাম ও বিভিন‍্য তথ‍্য পেয়ে গেল।
সিঙ্গাপুর জেলে কিছুদিন কাটানোর পরে অবনী মুখার্জী এক আইরিশ জেলারের সাহায‍্যে জেল থেকে পালিয়ে ইন্দোনেশিয়া চলে যান। সেখান থেকে এক ডাচ ব‍্যবসায়ীর মালয়েশিয় চাকর রুপে ইউরোপে পালিয়ে যান। কিন্তু এদিকে রাসবিহারী বসুর জার্মান অস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে ব্রীটিশের হাত থেকে ভারত মাতার মুক্তির সকল প্রচেষ্টা শেষ হয়ে গেল। তিনি আবার জাপানের উদ্দেশ‍্যে রওনা হলেন।
জাপানে ফিরে গিয়েও তাঁর বিপ্লাবাত্মক প্রচেষ্ট চলতে থাকলো। ১৯১৫ সালের ২৭ শে নভেম্বর স্বাধীন ভারত গড়ার উদ্দেশ‍্যে তিনি আমেরিকা ফেরত হেরম্বলাল গুপ্ত এবং লালা লাজপত রায় একটি সভা করে তাদের করনীয় কার্যাবলী স্থির করেন।। জুনো পার্কের প্রসিদ্ধ ভোজনালয় সিওকিনে এই সভা হয়েছিল। ওই সভায় জাপানী ডাক্তার সুমেই ওহকাওয়া উপস্তিত ছিলেন। সভায় লালা লজপত রায় ওজস্বিনী ভাষায় যে বক্তিতা দেন তাতে জাপানী নিমন্ত্রিত ব‍্যক্তি মাত্রেই অভীভূত হয়ে যান। কিন্তু এই সভার কথা ব্রিটিশ প্রসাশনের কানে যায়। এই সভা ও সাংহাই থেকে অস্ত্র সংগ্ৰহে রাসবিহারীর প্রচেষ্টার কথা জেনে ব্রিটিশ প্রসাশন জাপানী বৈদেশিক বিভাগের মন্ত্রীকে অনুরোধ ( আদেশ ) করেন যে ভারতীয় বিপ্লবীদের অবিলম্বে জাপান থেকে নির্বাসন করার জন‍্য। এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের কোন পথ খুজে না পেয়ে রাসবিহারী ও হেরম্বলাল জাপানী জনগনের কাছে আবেদন জানালেন যে তাদের বিরুদ্ধে যেন সেই কঠিন পদক্ষেপ না নেওয়া হয় কিন্তু জাপানী পুলিশের অধক্ষ‍্য নিসিকুরো ঘোষনা করলেন যে ভারতীয়দ্বয়কে ( লাজপত রায় তখন আমেরিকা চলে গেছেন) ২রা ডিসেম্বর ইয়াকোহামা বন্দর হতে যাত্রাকারি জাহাজে বলপূর্বক তুলে দেওয়া হবে।
ঠিক সেই সময় পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ব্ল‍্যাক ড্রাগন পার্টির এক প্রভাবশালী নেতা এবং বিখ‍্যাত বিপ্লবীকার মিৎসুই তোয়ামা। এই তোয়ামার পরামর্শেই এক বেকারী কোম্পানীর মালিক আজিও সোমা ও তাঁর স্ত্রী মাদাম কোকো সোমা রাসবিহারী ও হেরম্বলাল কে টোকিও শহরের বাইরে তাঁদের বাগান বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। সেই দিনটি ছিল ১৯১৫ সালের ১লা ডিসেম্বর। এখানে কিছুদিন থাকার পর গোপনে হিরম্বলাল আমেরিকায় পালিয়ে যান কিন্তু রাসবিহারী বসুর আর কোনদিন দেশে ফেরা হলোনা । তিনি ১৯১৮ সালে আজিও সোমার কন‍্যা তোশিকাকে বিবাহ করেন। ১৯২৩ শে তিনি জাপানী নাগরিকত্ব লাভ করেন। প্রায় সাত বছর তাঁকে জাপানী পুলিশের ভয়ে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। এতকিছুতেও ভারত মাতার মুক্তির জন‍্য তাঁর বৈপ্লবিক প্রচষ্টা বন্ধ করা যায়নি । আর সে ইতিহাস তো আমাদের অনেকেরই জানা।
(শেষ)



                    বালা সাহেব-এঁর ছবি

                  ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন :      প্রণব কুমার কুণ্ডু

বারাণসী ( তিন )


বারাণসী ( তিন )


ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন :                 প্রণব কুমার কুণ্ডু




#বারাণসী - প্রাচীন ভারতের এক অন্যতম নিদর্শন। গঙ্গার পশ্চিম তীরে বরুণা ও অসি নদীর মিলনস্থলে বিশ্বের 'প্রাচীনতম জীবন্ত শহর'। অতীতের কাশী আজকের বারাণসী, হিন্দুধর্মের পবিত্রতার প্রতীক। পুরাণে আছে, খ্রিস্টের জন্মের ১২০০ বছর আগে সুহোত্র-পুত্র কাশ্য পত্তন করেন এ নগরী। কাশ্য থেকে নাম হয় কাশী। The City of Light। গঙ্গা, গঙ্গার ঘাট, মন্দির, ভারতীয় সঙ্গীত, রাবড়ি-লস্যি-মালাই, অলিগলি-তস্য গলি, দোকানপাট, যানজট, ষাঁড়, বেনারসি শাড়ির দোকান, কাচের চুড়ি - এ সব নিয়েই এক প্রাণবন্ত শহর বারাণসী। হানাদারদের হানায় বার বার এর অতীত ধ্বংস হলেও পুণের পেশোয়া, ইন্দোরের হোলকার, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া এবং বারাণসীর রাজাদের হাতে মন্দির, ঘাট এবং শহর গড়ে উঠেছে নতুন করে।
বারাণসীর প্রধান দর্শনীয় স্থান হলো বিশ্বনাথ মন্দির আর গঙ্গাতীরের প্রাচীন ঘাট। এখানকার প্রধান ঘাটগুলো হলো - দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকা, হরিশ্চন্দ্র, মানমন্দির, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, পঞ্চগঙ্গা, রানিমহল, অহল্যাবাই ঘাট প্রভৃতি। ইন্দোরের মহারানি অহল্যাবাই হোলকার ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান কাশী-বিশ্বনাথ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। আর পাঞ্জাব কেশরী রণজিত্‍ সিংহ মন্দিরের শিখরগুলো সোনা দিয়ে মুড়ে দেন ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে। মন্দিরের দেবতা কালো পাথরের বিশ্বেশ্বর। এটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। বিশ্বনাথ মন্দিরের বিপরীতে অন্নপূর্ণা মন্দির। কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে এখানে অন্নকূট উত্‍সব হয়।
মূল শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে রয়েছে রানি ভবানী প্রতিষ্ঠিত দুর্গামন্দির। গোধুলিয়া থেকে ৩ কিলোমিটার দূর রয়েছে শ্বেতপাথরের তুলসী মানস মন্দির। বিদ্যাপীঠ রোডে আছে ভারতমাতা মন্দির। ১৯৩৬ সালে মহাত্মা গান্ধী উদ্বোধন করেন এই মন্দির। এই মন্দিরে মূর্তির বদলে রয়েছে পাথরের তৈরি ভারতের মানচিত্র। এখানেই গড়ে উঠেছে এশিয়ার বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্থে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় (BHU) প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম 'ভারত কলাভবন'-এ রয়েছে চিত্র ও ভাস্কর্যের অপূর্ব সংগ্রহ।
গঙ্গার পূর্ব পাড়ে রয়েছে সতেরো শতকে নির্মিত রামনগর দুর্গপ্রাসাদ। রাজবাড়িতে আছে দুর্গা ও ছিন্নমস্তার মন্দির। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে রামনগরে এক মাসব্যাপী সাড়ম্বরে পালিত হয় রামলীলা উত্‍সব। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত সতীর কাহিনীর একান্নটি সতী পীঠের একটি হলো বারাণসী। সতী দেবীর কুণ্ডল পড়েছিল মণিকর্ণিকা ঘাটে। তাই এটি একটি অন্যতম পীঠস্থান।
যুগযুগ ধরে গঙ্গার পাড়ে গড়ে উঠেছে বহু জনপদ। তারই একটি নিদর্শন বেনারস বা বারাণসী। প্রায় ১০০টি ঘাট রয়েছে মা গঙ্গার পাড় ঘেঁষে। তারমধ্যে মূল ঘাট ২৫টি। অস্যি ঘাট থেকে শুরু করে রাজ ঘাট পর্যন্ত বিস্তারিত এলাকায় ভক্ত ও পর্যটক সমাগম সারা বছরই লক্ষ্য করা যায়। বেড়াতে যেতে চাইলে দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে নৌকা বিহার শুরু করতে পারেন। যাত্রা শেষ হরিশচন্দ্র ঘাটে পৌঁছে। আর যদি নৌকায় উঠতে না চান, পায়ে হেঁটেও পরিদর্শন করতে পারেন বারাণসীর শোভা। ঘাটে পেয়ে যাবেন টুরিস্ট গাইডদেরও। তাঁদের মুখেও শুনতে পারেন বারাণসীর রোমাঞ্চকর গল্প।
বারাণসীর দক্ষিণপ্রান্তে অস্যি ঘাট। সেখানেই মা গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে অস্যি নদী। একেবারে দক্ষিণে অবস্থানের কারণে লোকজন খুব একটা যায় না সেখানে। ফলত তেমন ভিড় নেই। শান্ত, নিরিবিলি ঘাট একান্তে সময় কাটানোর আদর্শ লোকেশন। যদিও হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এই ঘাটের বিশেষ প্রাধান্য আছে। বারাণসীতে এসে শিবের পুজো করার আগে ভক্তরা এই ঘাটে স্নান করেন।
ঘাটের কাছে একটি পিপুল গাছের নিচে রয়েছে শিবের লিঙ্গ। স্নান সেরে ভক্তরা সেই লিঙ্গের উপাসনা করেন। এছাড়া, ঘাটে রয়েছে কিছু জিনিসপত্রের দোকান ও খাবারদাবারের স্টল। যদি বারাণসীতে বেশিদিন থাকার পরিকল্পনা থাকে, এই ঘাটের আশপাশের হোটেল কিংবা গেস্ট হাউজ়ে বুকিং করে নিতে পারেন। এই ঘাট থেকে দশাশ্বমেদ ঘাটের দূরত্ব পায়ে হাঁটলে মাত্র ৩০ মিনিট।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে এই ঘাটের। ১৮ শতাব্দীতে এই ঘাটেই ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন বারাণসীর তৎকালীন মহারাজা চেত সিং। যুদ্ধের আগে ঘাটে একটি ছোট্ট দুর্গ বানিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, শেষরক্ষা করতে পারেননি। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হন। যদিও কিছুদিনের মাথায় ছদ্মবেশ ধারণ করে মাথায় পাগড়ি পরে জেল থেকে পালিয়ে যান।
বারাণসীর ঘাটের ফোটো তুলতে চাইলে বেছে নিন এই ঘাটকে। ফোটোগ্রাফারদের মতে, বারাণসীর সবচেয়ে ফোটোজেনিক ঘাট দ্বারভাঙ্গা। খুব সুন্দর এর শোভা। বহু সিনেমার শুটিং হয়েছে। দ্বারভাঙ্গা ঘাটের নির্মাণশৈলি মনমুদ্ধকর। ১৯০০ সালে বিহারের রাজপরিবার এখানে একটি মহল তৈরি করে, যার পর থেকে ঘাটের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পায়।
দ্বারভাঙ্গা ঘাটের পাশেই রয়েছে মুন্সি ঘাট। ১৯১২ সালে দ্বারভাঙ্গা রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শ্রীধর নারায়ণ মুন্সি নির্মাণ করেন ঘাটটি। তাঁর নামেই নামকরণ হয় ঘাটের।
বারাণসী ঘাটের হৃদপিণ্ড দশাশ্বমেধ ঘাট। সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে আর্কষণীয় স্থান। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এই ঘাট পবিত্র। এখানকার মূল আকর্ষণ গঙ্গা আরতি। শুধু আরতি দেখবে বলে দেশ-বিদেশের বহু মানুষ ভিড় করে দশাশ্বমেধ ঘাটে। প্রতিদিন সন্ধে হওয়ার পর গঙ্গা আরতি শুরু হয় ভারতের মূলত তিনটি জায়গায় - হরিদ্বার, ঋষিকেশ ও বারাণসীতে।
নদীর দিকে মুখ করে সংগীত সহযোগে আরতি হয়। বড় বড় প্রদীপ জ্বালিয়ে ৮-১০জন পণ্ডিত আরতি করেন সেখানে। সে দৃশ্য চাক্ষুস না করলে মুখে বলে প্রকাশ করা কঠিন। আরতি শেষে সকল ভক্ত করজোড়ে প্রণাম করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ঝড়-জল বা প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও সন্ধ্যারতি স্থগিত হয় না কোনও সময়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে বসে কাটিয়ে দিলেও কখনও ক্লান্তি আসে না। এমনই তার স্থানমাহাত্ম্য।
বারাণসীর আরও একটি প্রাচীন ঘাট মানমন্দির। রাজপুত স্থাপত্যের জন্য ঘাটটি বিখ্যাত। জয়পুরের রাজপুত রাজা মানসিং ১৬০০ শতকে নির্মাণ করেন সেই ঘাট। তারপর ১৭৩০ সালে সাওয়াই জয় সিং (দ্বিতীয়) সেখানে একটি অবজ়ার্ভেটরি তৈরি করেন। আজও গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি জানার টেলিস্কোপটি সঠিকভাবে কাজ করে চলেছে।
বারাণসী ঘাটগুলির আরও একটি সুন্দর ঘাট স্কিনদিয়া। নিরিবিলি ও শান্ত পরিবেশ। স্কিনদিয়ায় রয়েছে অর্ধ নিমজ্জিত শিবের মূর্তি। ১৮৩০ সালে ঘাট নির্মাণের সময় মূর্তিটি জলে অর্ধেক ডুবে যায়। সেই থেকে মূর্তিটি অর্ধেক ডুবেই রয়েছে। এছাড়াও এই ঘাটে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো মন্দির। জায়গাটিকে বলা হয় “সিদ্ধক্ষেত্র”।
১৭৮০ সালে নাগপুরের মারাঠি রাজা ভোঁসলে বারাণসীতে একটি ঘাট তৈরি করেন। সেই থেকে ঘাটের নাম হয় ভোঁসলে ঘাট। ঘাটে রয়েছে পাথরের বহুতল, যার উপরে তাকালে লক্ষ্য করা যায় ছোটো ছোটো জানালা। রয়েছে তিনটি ঐতিহ্যবাহী মন্দির - লক্ষ্মীনারায়ণ, ইয়ামেশ্বর ও ইয়ামাদীতা মন্দির।
দশাশ্বমেধ ঘাটের মতো আরও একটি ঘাটের নাম জনপ্রিয় - মণিকর্ণিকা ঘাট। এটি আসলে শ্মশান। বারাণসীর অধিকাংশ সৎকার এই ঘাটেই হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাস, এই ঘাটে সৎকার হলে জন্মান্তরের চক্র থেকে আত্মা মুক্তি লাভ করে। সব দোষ মুছে যায়।




#COLLECTED*

কুড়ি লাখ বৌদ্ধ সন্ন‍্যাসির হেরিটেজ গোরস্থান ৮১৬ খৃষ্টাব্দ থেকে, জাপানের অকুনিয়নে।


    কুড়ি লাখ বৌদ্ধ সন্ন‍্যাসির হেরিটেজ গোরস্থান ৮১৬ খৃষ্টাব্দ থেকে, জাপানের অকুনিয়নে।


    ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন :               প্রণব কুমার কুণ্ডু



কুড়ি লাখ বৌদ্ধ সন্ন‍্যাসির হেরিটেজ গোরস্থান ৮১৬ খৃষ্টাব্দ থেকে ,,জাপানের অকুনিয়নে।

অয়াকাইয়ামা পাহাড়টা বেশ বড়। সেই পাহাড় টপকে আমাদের গাড়ি যখন গোরস্থানে ঢুকছি তখন সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে । গোরস্থানের ভেতরে গাড়ি যাবার ব‍্যাবস্থা নেই। তাই গোধূলির আলোতে পাথুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। আমাদের হাতে লন্ঠন। কেননা ইলেকট্রিক আলোর ব‍্যবস্থা নেই।অন্ধকার নামার ভয়ে আগেই লণ্ঠন জ্বালানো হয়েছে। চারপাশের ছাতা আকৃতির পাইন গাছ এবং বিষাক্ত হেমলক লতার ঝোপে সাপের কিলবিলে অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। আমরা কিছুটা ভীত, আবার কিছুটা উত্তেজিতও। হাঁটছি খুব সাবধানে। মোহগ্রস্থের মত এগুচ্ছি ১২শ’ বছরের পুরনো এক অরণ্যের দিকে। যত ভেতরের দিকে যাচ্ছি আলো তত কমছে। হাঁটার সময় লণ্ঠনের আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেই কম্পিত আলো গিয়ে পড়ছে বহু প্রাচীন সব কবরের গায়ে, ছায়া সরে যাচ্ছে ধূপ সুবাসিত কাঠে কিংবা পাথরে খোদাই করা মুখের অবয়বে। মনে হচ্ছে গোরস্থানের অন্ধকার জায়গাগুলো থেকে কেউ নিঃশব্দে নজর রাখছে আমাদের উপর। সেটা হওয়া খুবই সম্ভব। কারণ এই গোরস্থান সাধারণ কোনো গোরস্থান না। এটা জাপানের সবচেয়ে বড় অকুনিয়ন গোরস্থান। কুয়াশাচ্ছন্ন এবং ঘন শেওলায় ভর্তি প্রায় দুই কিমি লম্বা এই গোরস্থানে কুড়ি লাখ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কবর হয়েছে। মৃত সন্ন্যাসীরা বহু বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে এখানে। তারা বুদ্ধ হয়ে আবার পুনর্জন্ম লাভ করবে পৃথিবীতে এমনটাই কথা রয়েছে। এই গোরস্থানের সূচনা হয়েছিল ৮১৬ খ্রিস্টাব্দে। বলা হয়, এর প্রত্যেকটা ইঞ্চি পবিত্র। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো পবিত্র অনুভূতি আমাদের ভেতরে হচ্ছে না, বরং অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথে কেমন যেন একটা ছমছমে অনুভূতি হচ্ছে...... অকুনিয়ন গোরস্থান জাপানের পাহাড়ি অয়াকাইয়ামা অঞ্চলের প্রাচীন গ্রাম কয়া-সানে অবস্থিত। জায়গাটি জাপানের কি পর্বতমালার অনেকগুলো পবিত্র স্থানের মধ্যে একটা। ইউনেস্কো এই জায়গাটিকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর তালিকায় স্থান দিয়েছে। প্রায় ১৫শ বছর আগে আধুনিক আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান অঞ্চল থেকে সন্ন্যাসীরা গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের গোড়া পত্তন করেছিলেন জাপানে। কয়া-সান অঞ্চলকে শিংগন বৌদ্ধধর্মের উপকেন্দ্র হিসেবে ধরা যেতে পারে। শিংগন বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে পূর্ব এশিয়ার গুটি কয়েকটি টিকে থাকা তান্ত্রিক ধারার ধর্ম। এই ধারাতে ‘মিক্ক্য’ (বজ্রযান) নামের একটা রহস্যজনক বিদ্যার চর্চা করেন সন্ন্যাসীরা এবং এই গুপ্ত বিদ্যার কথা শুধু মুখে মুখে বলে যান পরবর্তী প্রজন্মের বিশ্বস্ত সন্ন্যাসীদের কাছে। ৮০৫ খ্রিস্টাব্দে এই ধর্ম চর্চা জাপানে প্রথম চালু করেন কবি ও বৌদ্ধ মাস্টার কুকাই। তার আরেক নাম কোবো-দাইশি। তিনি ট্যাঙ ডায়ন্যাস্টির সময়ে চীনের জিয়ানের সন্ন্যাসীদের সাথে থেকে এই ধর্ম চর্চা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে জাপানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা হয়ে ওঠেন। গোরস্থানের একেবারে শেষ প্রান্তে তার মন্দির। এই মন্দিরে অনন্তকালের জন্য ধ্যান মগ্ন অবস্থায় রয়েছেন তিনি। তার ধ্যানের একটাই উদ্দেশ্য- জীবিত প্রাণকে দেহের খাঁচা (জরা-ব্যাধি) থেকে মুক্তি দেয়া। অন্যকথায় বলতে গেলে তিনি মৃতের মুক্তির সাধনা করছেন। কয়া-সানের পাহাড়ি অঞ্চল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানকার মন্দিরগুলোতে ইচ্ছা করলে দর্শকরা সন্ন্যাসীদের সাথে থাকতে পারবেন। পর্যটকদের নিরামিষ খাবার এবং ধ্যান করার উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেন সন্ন্যাসীরা। আধুনিক নগর জীবন যাদের মন বিষিয়ে দিয়েছে তারা এখানে খুঁজে পাবেন প্রশান্তিময় জীবন। কয়া-সানে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে জাপানের বুলেট ট্রেন। টোকিও থেকে বুলেট ট্রেন নানকাই লাইনে চড়ে বসলে ৫ ঘণ্টা লাগবে ওসাকার নাম্বা স্টেশানে পৌঁছাতে। এখানে পৌঁছালেই চোখে পড়বে সবুজ ঘাসে মোড়া পাহাড় ভর্তি চেরি ফুলের গাছ। এখানকার গেস্ট হাউসগুলোও অনেকটা নবম শতকের দালানের আদলে তৈরি। ভ্রমণের একেবারে শেষ ধাপে রয়েছে বৈদ্যুতিক তারের ট্রাম (কেবল কার) ভ্রমণ। এই ট্রাম পাহাড়ের ৮০০ মিটার উচ্চতায় নিয়ে যাবে মাত্র পাঁচ মিনিটে।তবে আমরা কোচে গিয়েছিলাম। ঊর্ধ্ব গমনের সাথে সাথেই আধুনিক জগতের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে মন। মনে হবে, মর্তলোক ছেড়ে স্বর্গলোকে আরোহণ করা হচ্ছে। বলা হয়, কয়া-সান পাহাড়ের ৮টি চূড়া উপর থেকে দেখতে অনেকটা পদ্ম ফুলের মত। আমরা জানি না ব্যাপারটা সত্যি কিনা, কিন্তু এখানে আসার পর এর কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ি প্রকৃতি দেখে বোঝা গেলো প্রথম দিককার সন্ন্যাসীরা কেন জায়গাটিকে আধ্যাত্মিক চর্চার জন্য আদর্শ জায়গা বলে বেছে নিয়েছিলেন। এখানে সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে আছে, শুধু উড়ে বেড়াচ্ছে ঠাণ্ডা দমকা বাতাস। বৌদ্ধরা দারিদ্র্যতাকে মহান আখ্যায়িত করে যে রকম বড় বড় কথা বলে, সেটা আধ্যাত্মিক অন্বেষণের খোঁজে আসা পর্যটকদের জন্য খাটবে না। পর্যটকদের জন্য গলায় ছুরি। হোটেল ভাড়া, খাবার দাবার এবং ধ্যান করার খরচ প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার টাকা। এটা স্রেফ ডাকাতি। তাছাড়া সেকিশো ইন নামের যে হোটেলে আমাদের থাকতে দিয়েছিল সেটাও দেখতে আহামরি কিছু না। তবে হোটেলের যে কক্ষে আমাদের থাকতে দেয়া হয়েছিল সেটা অনেক পুরনো ধাচের অভিজাত একটা কামরা। এরকম নির্জন প্রাচীন কামরায় এমনিতেই ধ্যান করতে ইচ্ছা হয়। যে রাতে কয়া – সানে পৌঁছেছি তার পরদিন আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম সেখানকার ১১৭টি মন্দির এবং সন্ন্যাসীদের মঠ। সেখানকার প্রধান বৌদ্ধ মন্দিরের নাম হচ্ছে ড্যানজো গরান কমপ্লেক্স। এখানেই সন্ন্যাসীরা পর্যটকদের ধ্যান করার প্রশিক্ষণ দেয়। এই কমপ্লেক্সে নবম দশকের একটি সিন্ধুরবর্ণ বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। জাপানের বেশিরভাগ জায়গাতেই যে অস্পষ্ট জেন বৌদ্ধ মন্দিরগুলো রয়েছে, সেগুলোর চেয়ে এই মন্দিরের পার্থক্য আছে। এখানকার মন্দিরগুলো অনেকটা তিব্বত, নেপাল এবং ভুটান ধাঁচের। সকাল বেলা মন্দির দেখা শেষ করে শেষ বিকেলে বের হলাম গোরস্থানের উদ্দেশ‍্যে। অকুনিয়ন গোরস্থান যেন ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে আছে বহুবছর, আমরা তার আঁচ পাচ্ছি শুধু। গোরস্থানের ভেতরে যে পাথরের মূর্তিগুলো রয়েছে সেগুলো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জিজো বোসাতসুর। বিভিন্ন আকৃতিতে তাকে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। বলা হয়, কেউ যদি তার সন্তান হারিয়ে ফেলে, তাহলে এই মূর্তির উপরে একটুকরো লাল কাপড় রেখে গেলে জিজো সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তানের দেখভাল করেন। সেই কারণেই বোধ আমরা দেখলাম চারপাশে হাজার হাজার কাপড় পড়ে রয়েছে, মৃদু বাতাসে উড়ছে, পাক খাচ্ছে। এই গোরস্থান নির্বাণ লাভের গোরস্থান। এটা যেন যেন সমগ্র মানব জাতিকে নির্বাণ দেয়ার জন্য জমা করে রেখেছে তাদের সমস্ত দুঃখ দুর্দশা। এটা যেন মানুষের দুঃখ কমানোর জায়গা। কারো দুঃখ বেড়ে গেলে সে এই জায়গায় এসে কিছুটা দুঃখ রেখে যাবে, হালকা করে যাবে নিজেকে। সৌন্দর্য অনেক রকম হয়, এই গোরস্থানের সৌন্দর্য হচ্ছে বেদনা। আমরা গোরস্থানের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। এখানে রয়েছে মাস্টার কুকাইয়ের দরগা। দরগার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, কারণ ১০ হাজার ঝুলন্ত লণ্ঠন একসাথে জ্বলে এখানে। এর মধ্যে ২টি লণ্ঠন ১০৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে একটানা জ্বলছে। আমরা দরগার ভেতরে ঘুরতে শুরু করলাম...ভেতরে কাঠের কারুকাজ করা, তার ভেতরে আলো জ্বলছে ধিকি ধিকি......... মন্দির দেখার পর অন্ধকারে আমরা যখন চুপচাপ ফিরছিলাম হোটেলের পথে তখন কেন জানি গোরস্থানের অন্ধকারকে একটুও ভয় করছিল না। আগের মত গা ছমছম করছিল না মোটেও। আলো এবং অন্ধকারের মধ্যকার তফাৎ যেন আর পীড়া দিচ্ছিল না আমাদের। আমরা যেন বুঝতে শুরু করেছি গৌতম বুদ্ধ কেন বলেছিলেন, ‘Be a light unto yourself’, অর্থাৎ নিজের ভেতরে আলো জ্বালো, সেই আলো কখনো নিভবে না।


তবে তাই হোক ! আমি কিন্তু তোমাদেরই লোক !


        তবে তাই হোক ! আমি কিন্তু তোমাদেরই লোক !


        ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন :                 প্রণব কুমার কুণ্ডু




লাইক
মন্তব্য করুন
মন্তব্যগুলি