বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮

স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে


   স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে
   ফেসবুক থেকে       শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু


কোনও এক গ্রূপে বিতর্কের সময় এই লেখাগুলো পোস্ট করেছিলাম।দীপ চ্যাটার্জীর অনুপ্রেরণায়।প্রথম লেখাগুলো তাঁর লেখা থেকে টোকা।

এডমিন যদি না বলেন তবে পরের পোস্টগুলো এখানে দেবো না।

কাউন্টার #1

■অভিযোগ:আমেরিকাতে থাকাকালীন স্বামীজী সেই সময় নিজের জন্যে ১৩ ডলার দিয়ে মীরশ্যামের পাইপ আর ৩০ ডলার দিয়ে কোট কিনেছিলেন।
আগে অভিজিতের লেখা দেখা যাক। অভিজিৎ লিখছে, “আবার আমেরিকায় থাকাকালীন অবস্থায় ইসাবেলকে লিখছেন, ‘গতকাল ১৩ ডলার দিয়ে একটা মীরশ্যাম পাইপ কিনেছি। ফাদার পোপকে যেন আবার বোল না। কোটের দাম পড়বে ৩০ ডলার। আমি তো বেশ ভালই আছি। খাবার দাবার জুটছে, যথেষ্ট টাকা কড়িও। আগামী বক্তৃতাগুলো হয়ে গেলে ব্যাঙ্কে কিছু রাখতে পারব আশা করি’।” যদিও অভিজিতিয় প্রথায় স্বামীজীর এই চিঠিরও তথ্যসূত্রের কোন উল্লেখ অভিজিতের লেখায় বা তথ্যসূত্রের তালিকায় কোথাও নেই, তবুও অভিজিৎ পরে এই নিয়ে ফোড়ন কেটেছে, “ভারতের হিন্দু ভিখারিরা তো আর তার রোজকার চুরুটের দামও দিতে পারবেন না, সেখানে তিনি পারবেন না ১৩ ডলার দিয়ে মীরশ্যাম পাইপ কিনতে বা ৩০ ডলার দিয়ে কোট কিনতে। বলা বাহুল্য, আজকের দুর্দিনের বাজারেও শিকাগোর কাপড়ের দোকানে সেল দিলে এখনো চল্লিশ ডলারের মধ্যেই থ্রি-পিস স্যুট দিব্বি পাওয়া যায়, সাথে টাই ফ্রি। আর ‘সন্ন্যাসী’ বিবেকানন্দ সে সময়ে বসে একটা পাইপের জন্যই খরচ করছেন ১৩ ডলার, আর একটা কোট কিনেছেন ৩০ দলার দিয়ে।” অর্থাৎ অভিজিৎ নিশ্চিত স্বামীজী ওই ১৩ ডলারের পাইপ নিজের রোজকার ব্যবহারের জন্য কিনেছিলেন।
প্রথমে আমরা স্বামীজীর ওই আসল চিঠিটার থেকে প্রয়োজনীয় অংশটা দেখি।

“New York,
1st May, 1894.
Dear Sister (Miss Isabelle McKindley),
I could not find the exact orange colour of my coat here, so I have been obliged to satisfy myself with the next best — a cardinal red with more of yellow.
The coat will be ready in a few days.
Got about $70 the other day by lecturing at Waldorf. And hope to get some more by tomorrow's lecture.
From 7th to 19th there are engagements in Boston, but they pay very little.
Yesterday I bought a pipe for $13 — meerschaum do not tell it to father Pope. The coat will cost $30. I am all right getting food . . . and money enough. Hope very soon to put something in the bank after the coming lecture.”
― The Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 7/Epistles - Third Series/XVIII Sister

পাইপ আর কোটের কথা যাওয়ার আগে একটা ব্যাপার এই চিঠি থেকে আরও বোঝা গেল, স্বামীজীর আমেরিকাতেও খেতে পাওয়া নিয়ে নিশ্চয়তা খুব বেশী ছিল না। এবং সেই নিয়ে ওখানে যাঁরা তাঁর কাছের মানুষ ছিলেন, তাঁরাও চিন্তিত থাকতেন। যে কারণে, তিনি তাঁর ভগিনীসমা ইসাবেলকে “I am all right getting food” লিখে আশ্বস্ত করছেন যে, তিনি এখন ঠিকমতো খাবার পাচ্ছেন।
এবার পাইপ উপাখ্যান। প্রথমেই আমাদের জানতে হবে “ফাদার পোপ” অর্থে স্বামীজী কাকে বোঝাতে চেয়েছেন? শুধুমাত্র অভিজিতের লেখা ফলো করলে মনে হবেই স্বামীজী সেই “ফাদার পোপ” সম্বোধনকারী ভদ্রলোককে লুকিয়ে নিজের জন্য অতো দামী পাইপ কিনছেন।
“Mr. and Mrs. Hale whom the Swami used to address as Father Pope and Mother Church.”
― The Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 8/Writings: Prose And Poems/An Interesting Correspondence/References

তাহলে ফাদার পোপ হলেন চিকাগোর সেই বিখ্যাত George W. Hale, স্বামীজীর ধর্মমহাসভার পরিচয়পত্র হারিয়ে যাওয়ার পর যাঁর স্ত্রী স্বামীজীকে বাড়িতে আশ্রয় দেন (যাকে তিনি “Mother Church” বলতেন), এবং যাঁরা চিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামীজীর অংশগ্রহণের সব ব্যবস্থা করে দেন।
এবার আবার পাইপে ফিরি। উপরের মীরশ্যাম পাইপ কেনার চিঠিটি স্বামীজী লিখছেন 1st May, 1894। এবার আমরা আরেকটি চিঠির প্রয়োজনীয় অংশ দেখবো, যেটি স্বামীজী লিখেছেন 23 July, 1894 তারিখে George W. Hale-র স্ত্রী অর্থাৎ স্বামীজীর “Mother Church”-কে।
“To Mrs. G. W. Hale
Swampscott, Massachusetts
23 July 1894
Dear Mother
What is Father Pope doing? Is it very hot in Chicago? I do not care for the heat of this country. It is nothing compared to our India heat. I am doing splendidly. The other day I had the summer cholera; and cramp, etc. came to pay their calls to me. We had several hours nice talk and groans and then they departed.
I am on the whole doing very well. Has the meerschaum pipe reached Chicago?”
― The Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 9/Letters - Fifth Series/XXV Mother
পাইপ প্রসঙ্গে আবার যাওয়ার আগে পাঠক স্বামীজীর রসবোধ লক্ষ্য করুন। তিনি তাঁর কলেরা, ক্র্যাম্প ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানাচ্ছেন কি পরিমাণ রসিকতার সঙ্গে! যাইহোক, এবার পাইপে ফিরি। স্বামীজী পাইপ কেনার প্রায় তিনমাস পর খোঁজ নিচ্ছেন সেই পাইপ চিকাগোতে পৌঁছেছে কিনা। কেন? অভিজিৎ তো বলল স্বামীজী তাঁর নিজের রোজকার ব্যবহারের জন্য মীরশ্যামের পাইপ কিনেছিলেন। তাহলে সেই পাইপ চিকাগো গেল কিনা খোঁজ নিচ্ছেন কেন? এক মিনিট, এক মিনিট। একটু আগেই তো আমরা দেখলাম, স্বামীজী এই পাইপ কেনার কথা George W. Hale-কে জানাতে বারণ করছেন। এখন দেখলাম, তিনি George W. Hale-র স্ত্রীর কাছে খবর নিচ্ছেন, সেই পাইপ চিকাগোয় তাঁদের বাড়ি পৌঁছেছে কিনা। তাহলে কি ওই পাইপ স্বামীজী নিজের জন্যে কেনেন নি? না। কেনেন নি। মীরশ্যামের পাইপ $13 দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ নিউ ইয়র্ক থেকে কিনেছিলেন George W. Hale-কে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য। সারপ্রাইজ গিফ্ট―তাই তাঁকে জানাতে বারণ করার নির্দেশ ছিল আগের চিঠিতে। আর সেই জন্যেই তিনি এই চিঠিতে খোঁজ নিচ্ছেন পাইপ পৌঁছেছে কিনা। এই কথাই খুব স্পষ্ট করে বলা আছে Complete Works-এ ওই চিঠিটির প্রসঙ্গে আলাদা একটি নোটে―“The Swami had purchased this pipe in New York as a gift for Mr. Hale.”

এই লেভেলের তথ্য-বিকৃতির উদাহরণ অভিজিৎ রায়ের মুক্ত-মন ছাড়া আর কার কাছ থেকেই বা পাওয়া যেতে পারে। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে করা অভিজিতের এই চূড়ান্ত মিথ্যাচার, যে মিথ্যাচারের কোন সীমা-পরিসীমা নেই, সেটা স্পষ্ট করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পর, আমরা একটা কথা নিঃসন্দেহে বলতেই পারি―মিথ্যেকথা আর তথ্য-জোচ্চুরিতে নোবেল প্রাইজ থাকলে, অভিজিৎ রায় তার খুব বড় দাবীদার হতে পারতো। তাহলে পাইপ নিয়ে অভিজিৎ রায়ের করা মিথ্যা কুৎসার এখানেই ইতি। নিতান্ত অভিজিতের অন্ধ স্তাবক না হলে, অভিজিতের তথ্য-জালিয়াতি এতক্ষণে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়ার কথা।

এবার কোট। ইসাবেলকে লেখা পূর্বোল্লখিত চিঠিতে স্বামীজী বলছেন, “I could not find the exact orange colour of my coat here, so I have been obliged to satisfy myself with the next best — a cardinal red with more of yellow. The coat will be ready in a few days... The coat will cost $30.”
এবার অভিজিতের থ্রিপিস কোট-টাইয়ের হিসেব নেওয়ার আগে তদানীন্তন ডলার আর টাকার হিসেবটা একবার দেখা যাক। তার জন্য বেশী অর্থনীতি চর্চার আমাদের দরকার নেই। স্বামীজী নিজেই অন্য একটি চিঠিতে সেই হিসেব তাঁর মাদ্রাজের শিষ্য আলাসিঙ্গা পেরুমলকে জানাচ্ছেন।
“U. S. A.,
11th July, 1894.
Dear Alasinga,
In the Detroit lecture I got $900, i.e. Rs. 2,700. In other lectures, I earned in one, $2,500, i.e. Rs. 7,500 in one hour, but got only 200 dollars! I was cheated by a roguish Lecture Bureau. I have given them up.”
― The Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 5/Epistles - First Series/XI Alasinga

এই চিঠি আর ইসাবেলকে লেখা চিঠির সাল দুটি লক্ষ্য করুন। দুটোই 1894। তাহলে এই হিসেবে 1894-তে আমেরিকাতে $1= Rs. 3। তাহলে স্বামীজীর সেই কোটের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৯০ টাকা―দামী কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত বেশী বা গগনচুম্বী কিছু নয়। অভিজিৎ আজকের মুক্ত অর্থনীতির বাজারের চিকাগোর সেলের সাথে সেই যুগের নিউইয়র্কের বাজারের তুলনা করেছে। আরও হাস্যকর অভিজিৎ থ্রি-পিস স্যুট-টাইয়ের কথা বলেছে। স্বামীজী যে কোট বানিয়েছিলেন, সেটা একটা লং কোট। সেই কোটের ছবি প্রধানত দেখা যায় স্বামীজীর ইংল্যান্ডের ছবিগুলিতে। স্বামীজীর নিজের যোগ্যতায় রোজগার করার ক্ষমতাকে (সেই যুগে বিদেশের মাটিতে এক ঘণ্টায় ৭৫০০ টাকা) যদি এখানে বিচারের মধ্যে নাও আনি (চিটিং ইত্যাদি কারণে সেই টাকা তিনি হাতে পান নি), তাহলেও একজন ভারতীয় প্রতিনিধি, সেই যুগের শীতপ্রধান পাশ্চাত্যের বিদগ্ধ সমাজের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যদি নিজের রোজগারে, তাঁর পছন্দের রঙের একটি কোট তৈরি করিয়ে থাকেন, যেটি পরে জনসমক্ষে দাঁড়ালে স্বামীজীকে দেখে তাঁদের করুণা বা উপহাসের পাত্র বলে মনে হবে না, তাহলে সেটাকে কি লাক্সারি বলা যায়? না সেটা একান্ত প্রয়োজনীয় একটা জিনিস? তাঁর সফরসূচীর মধ্যে ইংল্যান্ডও ছিল। ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক শোষকদের দেশে, যারা ভারতীয়দের সম্পর্কে খুব খারাপ ধারণা পোষণ করতো, সেখানে এবং আমেরিকায়, ঠাণ্ডায় প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র ছাড়া কাঁপতে কাঁপতে দীনহীনের মতো বক্তৃতা দিলে, সেটা কি ভারতবর্ষের কাছে খুব সম্মানের বা গৌরবের হতো? সেটা হয়নি বলেই কি অভিজিৎদের এতো গাত্রদাহ? আর তাছাড়া, সন্ন্যাসী বলে যে তাঁর ঠাণ্ডা লাগবে না, এমনটা ভাবাও কি মুক্ত-মনের পরিচয়? কোট নিয়ে এই অযথা কুৎসা করে স্বামীজীকে ভোগবিলাসী প্রমাণ করার অপচেষ্টা, অভিজিতের কুৎসা-অ্যাডিকশনের পরিচয়।
এই প্রসঙ্গ শেষ করবো স্বামীজীর সঙ্গে থাকা একটি সোনার চেনসহ ঘড়ির কথা দিয়ে। এটি লিখেছেন মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
“সেদিন সন্ধ্যার কিছু পূর্বে দশ বার জন যুবক এসে স্বামীজীকে দর্শন করবার অভিপ্রায়ে উপরের বারান্দায় অপেক্ষা করছিলেন। স্বামীজী ঘর থেকে বাইরে এলে তাঁরা তাঁকে প্রায় ঘিরে ফেললেন, স্বামীজীও সহজভাবে সকলের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কখনো কারও কাঁধে হাত দিয়ে, কখনো কারও পিঠ চাপড় মেরে এমনভাবে প্রসন্ন ও প্রফুল্লভাবে কথা বলছিলেন, যেন তিনি তাদেরই একজন। তাঁর গলায় ছিল একটি সোনার ঘড়ির চেন। সেকালে সোনার ঘড়ি ও সোনার চেন ব্যবহারের প্রথা ছিল, কিন্তু স্বামীজীকে কখনো এই ঘড়ি ও চেন ব্যবহার করতে দেখিনি।... একটি যুবক ঐ চেনে হাত দিয়ে বললেন, “এ চেনটি তো ভারি সুন্দর!” স্বামীজী তাঁর দিকে একবার চেয়ে দেখলেন; পরক্ষণে ঘড়ি ও চেনটি খুলে ফেলে বললেন, “নে, এটা তোকে দিলুম। তোর খুব পছন্দ হয়েছে―তা তুই-ই এটা রাখ।” ছেলেটি বিস্ময়ে হতবাক ঘড়ি ও ঘড়ির চেন নিয়ে কি করবেন বা কি বলবেন, ভেবে পেলেন না।... শুনেছি বিলেতে থাকাকালে কোন বিশিষ্ট মহিলা স্বামীজীকে ঘড়িটি উপহার দিয়েছিলেন। এমন মহামূল্য বস্তুটি স্বচ্ছন্দে এক অজ্ঞাত ব্যক্তিকে দান করে দিলেন কেন, তা আমরা ভেবে পেলাম না। তবে তাঁর ত্যাগ দেখে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হলো, সন্দেহ নেই।”
― স্মৃতির আলোয় স্বামীজী/দ্বিতীয় অধ্যায়/মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা
এই হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। যিনি উপহারে পাওয়া মহামূল্যবান সোনার চেনওয়ালা ঘড়ি প্রায় কোনদিন ব্যবহারই না করে, অনায়াসে কাউকে দিয়ে দিতে পারেন। আশা করি এরপর আমাদেরও সন্দেহাতীতভাবে “চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হলো”। এই পরিমাণ ত্যাগ যাঁর মধ্যে, তাঁকে অভিজিৎ রায় কয়েকটা কুৎসা গ্রন্থের ভিত্তিতে ভোগবিলাসী, ভণ্ড সাধু বানাবার নোংরা প্রয়াস করেছে।
কৃতজ্ঞতা:দীপ চ্যাটার্জী
(চলবে)