স্তনকর এবং অন্যান্য কর
■ ইতিহাসের কূখ্যাত স্তন কর !
মে ২৬, ২০১৮
Google+
StumbleUpon
__লেখকঃ ভানুলাল দাস __শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু______________________________
সময় – ১৮০৩ সাল , স্থান – কেরালার চেরথালা । সমুদ্রের পাশেই থাকা ছোট্ট একটা শহর । আজ থেকে প্রায় ২১৫ বছর আগের কথা ! সে সময় কেরল এর রাজা ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর /ত্রিবাঙ্কুর ! আজব দেশের এই আজব শাসক বিভিন্ন করের নামে শোষণ করতেন নিম্নবর্ণের বা দলিত শ্রেণীর মানুষ কে ! সে সময় নিম্নবর্ণের নারী -পুরুষকে নির্বিশেষে অলংকার পরিধানের জন্য কর দিতে হত ! পুরুষরা গোঁফ রাখতে চাইলে কর দিতে হত ! এর চেয়েও ঘৃণ্য এক কর ছিল – স্তনকর বা স্তনশুল্ক ! স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হত – “মূলাক্করম ” ! তখন নিয়ম ছিলো ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো হিন্দু নারী তার স্তনকে ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হিন্দু নারীরা তাদের স্তনকে এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারতো, বাকি হিন্দু শ্রেণীর নারীদেরকে প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো। দলিত জাতীয় নারীর স্তন রাখতে হবে অনাবৃত , উন্মুক্ত ! আবৃত করতে হলে দিতে হবে স্তনশুল্ক অর্থাৎ শুল্কের বিনিময়ে কিনে নিতে হবে আত্মমর্যাদা ! শুল্কের পরিমাণ নির্ভর করবে স্তনের আকারের উপর ! এ শুল্কের কারণ বাড়তি কর আদায় না চোখভোগ ? নাকি দলিতদের আজীবন ঋণের জালে বেঁধে রাখার প্রক্রিয়া ! স্তনশুল্কের মোটা অংশ চলে যেত পদ্মনাভ মন্দিরে ! কত দলিতের ঘাম আর দীর্ঘশ্বাস লেগে আছে সে মন্দিরের পয়সায় ! পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির ! গিনিস বুক অব রেকর্ড তাইই বলে ! ১৮০৩ সালে নাঙ্গেলী (Nangeli) অর্থাৎ সুন্দরী নামক এক নিম্ন বর্ণের হিন্দু নারী তার স্তনকে আবৃত করে রাখে এবং রাজা “ত্রিভাঙ্কুরের কাছে “স্তন কর” দিতে অস্বীকৃতি জানায়। শাসক দলের এ ঘৃণ্য প্রক্রিয়া কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে স্তন আবৃত রাখতো নাঙ্গেলি নামের এই পঁয়ত্রিশ বছরের নারী ! কেউ কেউ বুকে আগুন নিয়েই জন্মায় ! নাঙ্গেলি তাদেরই একজন ! কৃষ্ণ বর্ণের অতীব সুন্দরী এই নারীকে জীবিকার প্রয়োজনে প্রায়ই ঘরের বাইরে যেতে হত ! শুল্ক সংগ্রাহকের নজরে পড়ায় তারা শুল্ক দাবী করে ! অস্বীকৃত হয় নাঙ্গেলি ! শুল্ক সে দেবে না ! যেন বলতে চায় – স্তন আমার , তাকে আবৃত রাখব না অনাবৃত রাখব তা ঠিক করার তুমি কে ? শুল্ক সংগ্রাহক অতিষ্ট করে তোলে নাঙ্গেলিকে ! দিন , দিন করের বোঝাও বাড়তে থাকে ! অবশেষে কর দিতে রাজি হয় নাঙ্গেলি ! শুল্ক সংগ্রাহকরা তার থেকে স্তন কর চাইতে এলে , নাঙ্গেলী তাদের কিছুক্ষণ বসতে বলে। এরপর নাঙ্গেলী বাড়ির ভেতর থেকে একটা কলাপাতা এনে, ঘরের মেঝেতে বিছায়, আর মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে প্রার্থনা করে। তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলে তার স্তনদুটি ! শুল্ক সংগ্রাহকের হাতে শুল্কস্বরূপ তুলে দেয় কলাপাতার আবরণে রক্ত মাখা দুটি স্তন ! কাটা স্তন দেখে খাজনা আদায়কারি অবাক হয়ে যায়। হতবাক সকলে ! নিজেকে কতটা ভালবাসলে এমনটা করা যায় ? অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয় ! নাঙ্গেলির শরীর চিতায় যখন জ্বলছে হঠাৎ এক পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই চিতায় ! নাঙ্গেলির স্বামী ! একেই বুঝি প্রকৃত সহমরণ বলে ! ভারতের ইতিহাসে কোন পুরুষের স্ত্রীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়ার প্রথম ও শেষ ঘটনা ! ইতিহাস এ প্রেমিক পুরুষের নাম খোদাই করার তাগিদ অনুভব করে নি ! সহমরণের চিতায় জ্বলে যায় ওদের পার্থিব শরীর । বেঁচে থাকে তাদের অমর প্রেম গাথা ! এই ঘটনার পর থেকেইে স্তনকর রহিত হয়। নিজের প্রাণের বিনিময়ে নাঙ্গেলী এই বিভৎস কর বন্ধ করেন। “”তবে স্তনকর বন্ধ করা হলেও দক্ষিণ ভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত করতে হয়েছে তাদের। ১৯ শতাব্দীর মাঝে এসে যখন কিছু হিন্দু নারী তাদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার দাবি করে, তখন হিন্দু পুরোহিতরা স্পষ্ট করে বলে দেয়-- নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম-বিরোধী। বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিলো হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। এই দাঙ্গা “কাপড়ের দাঙ্গা” হিসেবে পরিচিত।
শোনা যায় এরপর রহিত হয়ে ছিল স্তনশুল্ক বা মূলাক্করম ! নাঙ্গেলি জানতে পারে নি ! ওরা তখন বিচ্ছেদহীন অমৃতলোকে ! নাঙ্গেলী যেখানে বসবাস করতো, পরবর্তীতে নাঙ্গেলীর স্মরণে সেখানকার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “মুলাচিপারামবু”, যার অর্থ “The land of breasted women”।
সম্প্রতি সাহিত্যিক শিবশংকর পিল্লাই এর নাতি, রাজ নাইর ঘোষণা দেন যে, নাঙ্গেলীর স্মরণে তিনি একটা সিনেমা তৈরি করবেন। তিনি সিনেমাটির নাম ঠিক করেন Mulachi, যার অর্থ “Breasted Woman”। শুধু তাই নয়, সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করার জন্য রাজ নাইরের সাথে হলিউডের নায়িকা এঞ্জেলিনা জোলির কথাও হয়েছিল ।
____________________________________________
🔔 সংগৃহীত এই প্রবন্ধ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন