মঙ্গলবার, ১০ জুলাই, ২০১৮

মহম্মদ আলি জিন্নাহ ! সেই সময়ের এই উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ আইনজীবী !



                 মহম্মদ আলি জিন্নাহ ! সেই সময়ের এই উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ আইনজীবী !,



Pranab Kumar Kundu     শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু



Pinak Biswas এতে ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য  ফেসবুক থেকে



ব্যারিস্টার জিন্নাহ ও একটি নিষিদ্ধ বই
পি বিশ্বাস
মহম্মদ আলি জিন্নাহ ঘোড়েল রাজনীতিবিদ ছিলেন, তবে তার চাইতেও ছিলেন প্রখরবুদ্ধি ব্যারিস্টার। ইনি পৃথিবীর অন্যতম ব্যতিক্রমী ব্যক্তি যিনি স্রেফ মেট্রিকুলেশন লেভেলের যোগ্যতা নিয়ে ব্যারিস্টারি পড়তে যান এবং শ্রেষ্টতম ইন্সটিটিউট লিংকনস ইন থেকে বার অ্যাট-ল হন!! তার অসামান্য মেধা আর পরিশ্রম সে যোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করেছিল। যদিও তাকে জহরলাল ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা হাফ এডুকেটেড ব্যারিস্টার বা ম্যাটকু ব্যারিস্টার বলত। কারণ থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করে ব্যারিস্টারি পড়ার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। আদতে জিন্নাহ বুদ্ধির দৌড়ে নেহরুকে এক হাটে কিনে তিন হাটে বেচে দেওয়ার মুরোদ রাখতেন, তাও কানাকড়ি তে!
জিন্নার রাজনীতি নিয়ে লেখার ধক নেই, আমি বরং তার উকিলি জীবন ও বইটার গল্পে আলোকপাত করি।
জিন্নাহ নাকি আদালতে কখনো হারতে শেখেননি। অথচ একটি কেস, যেটিতে এপিয়ার করার পর রাজনীতিবিদ হিসেবে তার দ্রুত উত্থান ঘটে, সেটিতে তিনি পরাজিত হন।
সে মামলায় মেরিট ছিলনা, নামকরা উকিলরা হার নিশ্চিত জানলে তাতে সচরাচর হাত দিতে চানননা, অথচ এই কেসে অযাচিতভাবে জিন্নাহ লড়েছিলেন! কেন?
সেই গল্পটা বলা যাক।
গৌরচন্দ্রিকা টা বিরক্তিকর হতে পারে, একটু ধৈর্য ধরে পড়তে অনুরোধ করি।
জিন্নাহর জীবনের দুখানা ভাগ ছিল। রাজনীতিক ও আইনজ্ঞ। যে লোকটা জন্মে রোজা নামাজের ধার মাড়াতোনা, ইসলামে যত হারাম কাজ, অখাদ্য কুখাদ্য খেত, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ সে কিকরে এত্তবড় মসীহা হল? চুড়ান্ত আধুনিক, পশ্চিমি শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত জিন্না ক্রমশ হয়ে উঠলেন এক শ্রেনীর মুসলিমদের ধর্মগুরু। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, গদির লোভ, সর্বোপরি নেহরুর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন। ক্ষমতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে ভন্ডামির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ।
এই ভন্ডামিটা তাকে করতে হয়েছিল।
ধর্মকে পুঁজি করে রাজপাটে বসতে গেলে বড় মাপের বকধার্মিক হতে হয়। আলোচিত মামলাটা ছিল ভন্ডামির ভিত্তিপ্রস্তর।
জিন্নাহ আদালতে কখোনো হারেননি।
মানে তিনি হারতে পছন্দ করতেন না। সাদাত হোসেন মান্টো তুলে ধরেছেন তার ড্রাইভারের বয়ান, স্যার জীবনে কখনো সরি বলেননি। সরি শব্দটা পারলে জীবন থেকেই ছেঁটে ফেলতেন।
মাত্র ২০ বছর বয়েসে বোম্বে হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই দেওয়ানী ও ফৌজদারি দুই ধারাতেই তার দক্ষতা প্রমানিত হল। প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের লোভনীয় পদ প্রত্যাখ্যান করে মন দিলেন পুরোদস্তুর প্র‍্যাকটিশে। এজলাসে ছিলেন খাপখোলা তলোয়ার। এক সাহেব জাজ তাকে সতর্ক করেন এই বলে: Mr Jinnah, remember that you are not addressing a third class magistrate
জিন্নাহর জবাব চাবুকের মত আছড়ে পড়ল
My Lord, allow me to warn you that you are not addressing a third class pleader
ঔদ্ধত্যের সাথে মিশেছিল অপরিসীম আত্মবিশ্বাস। বুঝুন আইনে কতখানি দখল থাকলে এভাবে পালটা দাবড়ানি দেওয়া যায়।
যখন বোম্বের হায়েস্ট পেইড ল-ইয়ার তখন দাঁড়ালেন বাল গঙ্গাধর তিলকের পক্ষে, বিখ্যাত সিডিশন মামলায়। জাতীর জনক গান্ধীজী যখন ভগৎ সিংদের অনশনের সময় হিরন্ময় নীরবতা পালন করছেন তখন তাদের পক্ষে ব্রিটিশ আইনসভায় জিন্না বললেন The man who goes on hunger strike has a soul. He is moved by that soul and he believes in the justice of his cause; he is not an ordinary criminal who is guilty of cold-blooded, sordid, wicked crime!
শাব্বাস!
এমনকি ভগৎ সিং দের ট্রায়াল যে কতটা আনফেয়ার, ব্রিটিশ আইন যার গর্বে সাহেবদের পা পড়েনা তাকেও আচ্ছাসে তুলোধোনা করলেন।
তাহলে কি জিন্না কখোনো হারেননি?
হেরেছিলেন, কখোনো হারেননি ওটা মিথ।
বিখ্যাত বোম্বের বাওলা মার্ডার কেসে তিনি যে অভিযুক্তের হয়ে দাঁড়ান সেই মৃত্যুদন্ডের হাত থেকে বাঁচে, তবে যাবজ্জীবন হয়। বাকিদের ফাঁসি (এটাকে হার বলা যায় কি?)
এবার আসি সেই মামলার গল্পে যেখানে ঘটে তার চরম পরাজয়। এটা সারাভারত ব্যপী বিখ্যাত মামলা, আজো বিখ্যাত। এক খুনী আসামীর হয়ে আপিল কেসে আদালতে আর্গুমেন্ট করেন তিনি। সেই খুনী যে কিনা খুনটাকে অপরাধই মনে করেনি এবং ফাঁসি যেতে উদগ্রীব হয়েছিল, ধর্মরক্ষায়, তথাকথিত জিহাদের নামে।
আর এই কেসে দাঁড়ানোটাই ছিল ধুরন্ধর জিন্নার চাল। আস্তিনের তলা থেকে পাসিয়ে দিলেন রঙের টেক্কাখানা নিজের ধর্ম-রাজনীতির কেরিয়ার মজবুত করতে!! ক্রমশ হয়ে উঠলেন ধর্মান্ধ মুসলিমদের নয়া যুগপুরুষ।
১৯২০ দশক, পাঞ্জাবে আর্য সমাজী ও মুসলিমদের ধর্মীয় সংঘাত জন্ম দেয় পারস্পরিক খেউড়ের। একপক্ষ রামায়নের সীতা কে পতিতা বানিয়ে নোংরা গল্প ফেঁদে এক প্যামফ্লেট বের করে। এরই পালটা দিতে একজন পন্ডিত চমুপতি ছদ্মনামে লিখে ফেলে রঙিলা রসুল নামে আরেক নোংরা বই। বিষয় মহম্মদের যৌন জীবন। এ বইয়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়, প্রকাশক কিন্তু লেখকের পরিচয় গোপন রাখতে পেরেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত প্রকাশক লাহোর হাইকোর্ট থেকে আপিলে নির্দোষ প্রমানিত হন। তার অপরাধ IPC 153A ধারাতে ফেলা গেলনা (এই ফাঁক পূরণ করতে ১৯২৭ সালে তৈরী হল 295A!!)। ফল হল মারাত্মক। লেখককে তো পাওয়া গেলনা। ১৯২৯ সালের ৬ এপ্রিল এক ফ্যানাটিক তরুন ইলমুদ্দিন ছুরি মেরে প্রকাশ্যে খুন করল প্রকাশক রাজপালকে। সে গিলটি প্লিড করে এবং বলা বাহুল্য এই ঘৃন্য কাজের জন্য তার কিস্যু অনুতাপ ছিলনা।
সেসন জাজ দলীপ সিং ইলমুদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন লাহোরের উকিল ফারুক হোসেন। আপিলে অভিযুক্তের হয়ে দাঁড়ান জিন্না সাহেব। ট্রায়াল কোর্টে আনিত প্রমানের অপ্রতুলতা, সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা এবং অভিযুক্তের বয়েসের ডিফেন্স নেন তিনি।
জাস্টিস ব্রডওয়ে ও জাস্টিস জনসনের ডিভিশন বেঞ্চ কড়া ভাষায় জিন্নাহর বোগাস যুক্তির সমালোচনা করে বলেন Interestingly, the curious reference to 19 or 20 years deserves some attention. Why did Jinnah as one of the leading lawyers refer specifically to an argument that had been exploded by the same court only two years earlier? That only Mr Jinnah can answer and I do not wish to speculate
অবশ্য জিন্না সাহেবের কিছু করারও ছিলনা। আসামী যেখানে নিজেই ফাঁসিতে ঝুলে শহীদ (?) হতে স্থিতপ্রজ্ঞ সেখানে তাকে বাঁচায় সাধ্য কার।
ফাঁসির পর ইলমুদ্দিন বীরের সম্মান পায়, তার জানাজায় লোক হয় দুই লক্ষ। কবি ইকবাল গদগদ কন্ঠে খুনী ইলমুদ্দিনকে মহান শহীদের মর্যাদা দেন। পাশাপাশি আদালতে জিন্নার সওয়াল তাকেও হিরোর আসনে বসিয়ে দিয়েছিল। যেটা তিনি দারুনভাবে ব্যবহার করলেন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যারিস্টার পরিনত হল অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতায়। জুটলো ব্যাপক জনসমর্থন।
পুনশ্চ: এই সময়ে IPC 295A ধারা বলে রঙিলা রসুল বইটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়। যা ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আজো নিষিদ্ধ!!
ইতিহাসের পরিহাস ভারতীয় দন্ডবিধির 295A অতিরিক্ত ধারাটি অন্তর্ভুক্তকরণের সময় একজন তার অপব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে সতর্ক করেন। তার ভয় ছিল হয়ত ধর্মের নামে লেখক, সমালোচকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে। সেই ব্যক্তিটি মহম্মদ আলি জিন্নাহ! এই উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ আইনজীবী।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন