ভূগোল বইতে ভুল
শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু।
রাজ্যের ভূগোল বইগুলিতে পৃথিবীর সূর্য্যাবর্ত্তনকালের ভুল মান
পৃথিবী সূর্য্যের চারদিকে এক পাক খেতে ৩৬৫দিন ৬ঘণ্টা ৯ মিনিট ৯.৫ সেকেণ্ড সময় নেয়। আমাদের রাজ্যের ভূগোল বইগুলিতে বলা হয়েছে পৃথিবী ৩৬৫দিন ৫ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেণ্ডে সূর্য্যকে এক পাক খায়। ভূগোল বইগুলিতে ভুল তথ্য আছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রথম সময়কালটাকে নাক্ষত্রবৎসর এবং দ্বিতীয় সময়কালটাকে ক্রান্তিবৎসর বলে। প্রথমটা দ্বিতীয়টার চেয়ে প্রায় ২০মিনিট বেশী এবং পৃথিবীর সূর্য্যাবর্ত্তনকাল বলতে সেটাকেই (প্রথমটাকেই) বুঝতে হবে। তাহলে ভূগোললেখকরা ভুল করলেন কেমন করে? উত্তরে বলি যে, দুই প্রকার বর্ষমানের মধ্যে ২০ মিনিটের ফারাক হয় পৃথিবীর অয়নচলনের জন্য। পৃথিবীর এই গতির জন্যই (অয়নচলনেরজন্য) পৃথিবী সূর্য্যের চারদিকে এক পাক খাওয়ার ২০ মিনিট আগেই ঋতুচক্র শেষ হয়। সেটা ভালো করে না বুঝার ফলেই ভুগোল লেখকরা ভুল করে ক্রান্তিবৎসরের সঙ্গে মিলিয়ে পৃথিবী ৩৬৫দিন ৫ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেণ্ডে সূর্য্যকে এক পাক খায় বলে বলেছেন, সেই ভুল সংশোধন করা দরকার। বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করছি।
অয়নচলন
পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্ত্তনে পৃথিবীর বার্ষিকগতি এবং অয়নচলন উভয়েরই প্রভাব আছে।
অয়নচলন সম্বন্ধে বিস্তারিত বলার আগে বঙ্গাব্দ ও খ্রীষ্টাব্দের তফাৎ নিয়ে কিছু কথা বলি। বিষয়টা এইভাবে শুরু করা যাক। আজকাল বৈশাখ মাসের শুরুতে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি হয়। তাহলে বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে কখনও খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাস হতে পারে কি? উত্তর: হ্যাঁ পারে। বঙ্গাব্দে ৪০০ বছরে ১০০টা অধিবর্ষ (leap year) হয়, খ্রীষ্টাব্দে ৪০০ বছরে ৯৭টা। এখান থেকে হিসাব করে দেখুন যে বেশী সংখ্যক অধিবর্ষ থাকার জন্য বঙ্গাদের বছরগুলি গড়ে খ্রীষ্টাব্দের বছরগুলির চেয়ে ২০ মিনিট করে বেশী হয়। অতএব ইংরেজী নববর্ষ বাংলা ক্যালেণ্ডারের মধ্য দিয়ে প্রতি বছরে গড়ে ২০ মিনিট করে এগিয়ে আসে, বা বাংলা নববর্ষ ইংরেজী ক্যালেণ্ডারের ভিতর দিয়ে বছরে ২০ মিনিট করে পরে আসে। এইভাবে ৭০ বছরে ১দিন, কিঞ্চিদধিক ২০০০ বছরে একমাস এবং ৭৫০০ বছরে সাড়ে তিন মাসের ফারাক হয়। তাহলে এখন যেখানে বৈশাখে এপ্রিল হয়, আজ থেকে সাড়ে সাত হাজার বছর আগে বৈশাখে জানুয়ারী মাস ছিল বলে বলতে হবে। সহজ গণনায় দেখা যায় যে আজ থেকে প্রায় ১২০০০ থেকে ১৩০০০ হাজার বছর পরে নভেম্বর মাসে বৈশাখ মাস পড়বে। তখন বৈশাখ মাসে শীত পড়বে, শরৎকালে (চৈত্র সংক্রান্তিতে) শিবের গাজন হবে। ব্যাপারটা অনেকের আজব লাগতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এমনটাই ঘটবে যদি না বাংলা পঞ্জিকার বর্ষমান ২০ মিনিট কমিয়ে তাকে খ্রীষ্টাব্দের (গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের) বর্ষমানের সমান করা হয়। তা নাহলে যে আজ থেকে প্রায় ১৩০০০ হাজার বছর পরে আশ্বিন মাসে শিমূল আর পলাশ ফুল ফুটবে তাতে সন্দেহ নাই।
অয়নচলন সম্বন্ধে বিস্তারিত বলার আগে বঙ্গাব্দ ও খ্রীষ্টাব্দের তফাৎ নিয়ে কিছু কথা বলি। বিষয়টা এইভাবে শুরু করা যাক। আজকাল বৈশাখ মাসের শুরুতে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি হয়। তাহলে বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে কখনও খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাস হতে পারে কি? উত্তর: হ্যাঁ পারে। বঙ্গাব্দে ৪০০ বছরে ১০০টা অধিবর্ষ (leap year) হয়, খ্রীষ্টাব্দে ৪০০ বছরে ৯৭টা। এখান থেকে হিসাব করে দেখুন যে বেশী সংখ্যক অধিবর্ষ থাকার জন্য বঙ্গাদের বছরগুলি গড়ে খ্রীষ্টাব্দের বছরগুলির চেয়ে ২০ মিনিট করে বেশী হয়। অতএব ইংরেজী নববর্ষ বাংলা ক্যালেণ্ডারের মধ্য দিয়ে প্রতি বছরে গড়ে ২০ মিনিট করে এগিয়ে আসে, বা বাংলা নববর্ষ ইংরেজী ক্যালেণ্ডারের ভিতর দিয়ে বছরে ২০ মিনিট করে পরে আসে। এইভাবে ৭০ বছরে ১দিন, কিঞ্চিদধিক ২০০০ বছরে একমাস এবং ৭৫০০ বছরে সাড়ে তিন মাসের ফারাক হয়। তাহলে এখন যেখানে বৈশাখে এপ্রিল হয়, আজ থেকে সাড়ে সাত হাজার বছর আগে বৈশাখে জানুয়ারী মাস ছিল বলে বলতে হবে। সহজ গণনায় দেখা যায় যে আজ থেকে প্রায় ১২০০০ থেকে ১৩০০০ হাজার বছর পরে নভেম্বর মাসে বৈশাখ মাস পড়বে। তখন বৈশাখ মাসে শীত পড়বে, শরৎকালে (চৈত্র সংক্রান্তিতে) শিবের গাজন হবে। ব্যাপারটা অনেকের আজব লাগতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এমনটাই ঘটবে যদি না বাংলা পঞ্জিকার বর্ষমান ২০ মিনিট কমিয়ে তাকে খ্রীষ্টাব্দের (গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের) বর্ষমানের সমান করা হয়। তা নাহলে যে আজ থেকে প্রায় ১৩০০০ হাজার বছর পরে আশ্বিন মাসে শিমূল আর পলাশ ফুল ফুটবে তাতে সন্দেহ নাই।
অধিবর্ষ ও বর্ষমানের ব্যাপারটা আর একটু বুঝিয়ে বলি। খ্রীষ্টাব্দের বর্ষসংখ্যা ৪ দিয়ে বিভাজ্য হলে তা অধিবর্ষ হয়, কিন্তু এর একটু ব্যতিক্রম আছে। বর্ষসংখ্যার শেষ দুটি অঙ্ক শূন্য হলে তা যদি ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য হয় তবেই তা অধিবর্ষ। খ্রীষ্টাব্দের ২১০০, ২২০০, ২৩০০ প্রভৃতি সালগুলি ৪ দিয়ে বিভাজ্য হলেও এরা অধিবর্ষ নয়।বতবে ২৪০০ খ্রীষ্টাব্দ অধিবর্ষ হবে কারণ তা ৪ দিয়ে বিভাজ্য। এইভাবে ৪০০ বছরে ১০০টি নয়, ৯৭টি অধিবর্ষ হয় (৩টি বাদ)। কিন্তু বাংলায় অধিবর্ষের নিয়মটা আলাদা (তার বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়)। বঙ্গাব্দে ৪০০ বছরে ১০০টি অধিবর্ষ হয়। এর ফলে আমাদের বছর গুলির গড় মান খ্রীষ্টাব্দের চেয়ে প্রায় ২০মিনিট বেশী হয়।
এখন পৃথিবী সূর্য্যের চারদিকে এক পাক খেতে কত সময় নেয় সেই প্রসঙ্গে আসি। এই সময়কালটা বঙ্গাব্দের বর্ষমানের সমান (প্রায়) এবং জ্যোতিঃবিজ্ঞানে একে বলে নাক্ষত্রবৎসর (sideral year)। ঋতুচক্রের এক বার আবর্ত্তনে কত সময় লাগে? উত্তর : সেটা খ্রিষ্টাব্দের বর্ষমানের সমান এবং জ্যোতিঃবিজ্ঞানে একে বলে ক্রান্তিবৎসর (tropical year)। উভয়ের মধ্যে ২০ মিনিটের তফাৎ আছে। এই ফারাক কেন আসে? উত্তর : সেটা হয় পৃথিবীর অয়নগতির (precession-এর) জন্য। এটি পৃথিবীর আহ্নিকগতি ও বার্ষিকগতি ছাড়াও আর এক ধরণের গতি। এই গতির জন্য পৃথিবী সূর্য্যের চারদিকে এক পাক খাওয়ার ২০ মিনিট আগেই ঋতুচক্র শেষ হয় (এটি পরিষ্কার করে বুঝতে গেলে ঋতুপরিবর্ত্তনের কারণ বুঝতে হবে)।
প্রাচীন ভারতীয় ও গ্রীক জ্যোতিঃবিজ্ঞানীরা ভালোভাবে আকাশ পর্য্যবেক্ষণের ফলে অয়নচলনের বিষয়টা (ক্রান্তিবৃত্তের পথ ধরে বিষুববিন্দুদ্বয়ের গতির ব্যাপারটা) জানতেন, কিন্তু তার কারণটা নিউটনের আগে কেউ বুঝতে পারেননি। পৃথিবীর স্ফীত নিরক্ষীয় অঞ্চলের উপর সূর্য্যচন্দ্রের টানে ফলে পৃথিবীর মেরুদণ্ডটা তার কক্ষতলের উপর অঙ্কিত লম্বের চারদিকে ২৬০০০ বছরে একটি শঙ্কু রচনা করে বলেই এটা হয়। ঘূর্ণনবেগ কমে এলে একটা লাটিম যেমন হেলে গিয়ে মাথা চালে, পৃথিবীর এই গতিও সেই রকম। এর ফলে আকাশের মেরুতারাগুলিও বদলায়। বর্ত্তমানে যে তারাটি ধ্রুবতারা, মিশরের পিরামিডগুলি নির্ম্মাণের সময় সেই তারাটি যে ধ্রুবতারা ছিল না (থুবন নামের অন্য একটি তারা তখন ধ্রুবতারা ছিল)। এর থেকে এবং আরও নানা প্রমাণ থেকে পৃথিবীর অয়ন চলনের সত্যতা প্রমাণিত হয়। বিষয়টার পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছেন স্যার আইজ্যাক নিউটন, তাঁর গতিসূত্র ও মহাকর্ষ সূত্রের সাহায্যে। পৃথিবীর এই মাথাচালার পর্য্যায়কালটা যে ২৬০০০ হবে তাও নিউটনের সূত্রের সাহায্যে হিসাব করে দেখানো যেতে পারে।
অবশ্য ইতিমধ্যে যদি বাংলা ক্যালেণ্ডারের বর্ষমানকে ২০মিনিট কমিয়ে (অধিবর্ষের সংখ্যা কিছুটা কমিয়ে সেটা করা সম্ভব) গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের বর্ষমানের সমান করে দেওয়া যায় তাহলে পৃথিবীর অয়ন চলন ঘটলেও বাংলা মাসগুলি বরাবারই ঋতুনিষ্ঠ থাকবে (যথা আশ্বিনে চিরকাল শরৎ থাকবে)। গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারে বর্ষমান বঙ্গাব্দের চেয়ে ২০ মিনিট কম বলে জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী প্রভৃতি মাসগুলি বরাবর ঋতুনিষ্ঠই থাকে (যথা জানুয়ারীতে বরাবর শীতকাল)। ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে পোপ ষোড়শ গ্রেগরির আমলে ইউরোপে এই পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়েছিল। এদেশের পঞ্জিকাকারেরা বঙ্গাব্দেও এইরকম সংস্কার করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
সঙ্গের ছবিতে ড্রাকো তারা মণ্ডলে অবস্থিত ক্রান্তিবৃত্তের উত্তর মেরুকে কেন্দ্র করে ২৩.৫ ডিগ্রী ব্যাসার্ধের বৃত্ত বরাবর ২৬০০০ বছরে খ-গোলের উত্তর মেরুর এক পাক খাওয়াটা বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পৃথিবীর মেরুরেখাটি যখন যে তারার কাছে গিয়ে পড়ে তখন সেই তারাটিই ধ্রুবতারা (pole star) হয়। পৃথিবীর ঘূর্ণাক্ষের উপর অবস্থান করার জন্য ঐ তারাটিকে স্থির বলে মনে হয় অন্য তারাগুলিকে তার চারদিকে ঘুরতে দেখা যায় (তারকাদের দৈনিক ঘূর্ণন)। কয়েক হাজার বছর ধরে দেখলে ধ্রুবতারা ধীরে ধীরে পাল্টায়। ছবিতে দেখুন যে ১৪০০০ খ্রীষ্টাব্দে অভিজিৎ ধ্রুবতারা হবে।
অয়নচলন সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের 'কৃষ্ণচরিত্র', যোগেশচন্দ্র রায়বিদ্যানিধির 'পূজাপার্ব্বণ' এবং বর্ত্তমান লেখকের 'প্রাথমিক জ্যোতির্বিজ্ঞান' ইত্যাদি গ্রন্থগুলি দ্রষ্টব্য।
পরিশেষে আমার বক্তব্য :
অয়নচলনের বিষয়টি একটু জটিল বলে সব ছাত্রছাত্রীকে না বুঝানো গেলেও, পৃথিবী যে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা ৯মিনিট ৯.৫ সেকেণ্ডে সূর্য্যকে এক পাক খায়, এই সত্যি কথাটুকু বলতেই হবে। এখানে নাক্ষত্র বৎসরের বদলে ক্রান্তিবৎসরের মান দিয়ে দিলে চলবে না। আপনাদের মতামত কাম্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন