র্যাডক্লিফ লাইন: ভারতবর্ষের বুকে লাখো মানুষের রক্তে আকা এক দাগ
১৯৪৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার নাতি লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ভাইসরয় হয়ে ভারতে আসেন, তখন সেখানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রদীপ নিভু নিভু করে জ্বলছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাসা বেঁধেছে ভারতের বুকে। কংগ্রেস শুরু থেকেই অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে অটল ছিলো। আর মুসলিম লীগ দ্বি-জাতি তত্ত্ব আঁকড়ে ধরে ভারতীয় মুসলমানদের আলাদা এক রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবি থেকে একচুল নড়বার জন্যও প্রস্তুত নয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর এর ফলে উদ্ভুত সকল সমস্যা এড়াতে মাউন্টব্যাটেন তাই দ্বারস্থ হচ্ছিলেন ভারতীয় রাজনীতিবিদদের কাছে। জিন্নাহ মাউন্টব্যাটেনকে সরাসরি প্রস্তাব দিলেন এক জীবন্ত ব্যবচ্ছেদের। কিন্তু জীবন্ত এই ব্যবচ্ছেদের আগে যে অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে রোগীকে অজ্ঞান করাতে হবে, তা জিন্নাহকে এক চা চক্রে মাউন্টব্যাটেন এভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন 1–
“Mr. Jinnah claimed that there was only one solution – a “surgical operation” on India, otherwise India would perish altogether. I replied by reiterating that I had not yet made up my mind, and pointed out that an ‘anesthetic’ must precede any ‘surgical operation’”
আইনজীবী র্যাডক্লিফ হলেন সীমান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান
কিন্তু মাউন্টব্যাটেন যে ভারতবাসীকে অ্যানেস্থেশিয়া দেবার জন্য সিরিল র্যাডক্লিফকে ধরে আনবেন, তা হয়তো কারো জানা ছিলো না। ব্রিটেনের চ্যান্সারি বারের দক্ষ আইনজীবী ছিলেন র্যাডক্লিফ।
ব্রিটেনে তার আইনি সাফল্য আর খ্যাতি ছিলো অনেক। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে আগ্রহ কিংবা অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিলো না এই আইনজীবীর। বিবিসির এক ডকুমেন্টারিতে তো তাকে নিয়ে অনেকটা মজা করেই বলা হয়েছে,
“Radcliffe, a man who had never been east of Paris, was given the chairmanship of the two boundary committees set up with the passing of the Indian Independence Act.”
আইন বিষয়ক কাজের বাইরে অভিজ্ঞতা বলতে তার ঝুলিতে ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করা। তবে র্যাডক্লিফকে সীমান্ত নির্ধারণ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে প্রথমে তার নাম সুপারিশ করেন লর্ড লিস্টোওয়েল। এতো বড় দেশভাগের দায়িত্ব একা এক ব্যক্তির কাঁধে দেওয়া সমীচীন হবে কিনা, তা নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন মাউন্টব্যাটেন। তবে এই ব্যাপারে জিন্নাহ তাকে পরামর্শ দিলেন, একজন চেয়ারম্যান হলে তিনি সঠিকভাবে দুই সীমান্তের লাভ-ক্ষতির ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন এবং যথাযথ সমাধানও দিতে পারবেন। কিন্তু ৪০ কোটি জনগণের এই ভারতবর্ষকে ভাগ করতে মাত্র ৫ সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল এই আইনজীবীকে1। বিশাল ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে দূরে থাক, যে দেশকে তার কাছ কেটেকুটে দুভাগে ভাগ করার জন্য দেওয়া হলো, তার ঠিকঠাক মানচিত্রটিও তিনি পেলেন না।
বহু বছরের পুরাতন সেই মানচিত্রের সামনে বসে ধর্মকে সামনে রেখে লাইন টানা শুরু করলে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে এই বিষয়ের ন্যূনতম কোনো ধারণাও ছিলো না। র্যাডক্লিফ লাইনের ফলে সৃষ্টি হয় হাজারো সমস্যা।
একজন র্যাডক্লিফ এবং ৫ সপ্তাহ সময়
ভারত ভাগ নিয়ে তাড়াহুড়া শুরুর প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৯৪৭ এর ১২ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে জওহরলাল নেহেরুর পাঠানো চিঠিতে। এই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন 1–
“The work of the Boundary Commissions is meant to be done fairly rapidly. If we complicate the issue at this stage, the work will be prolonged and final decision will be delayed. I imagine that if and when two States have been formed, those States will mutually consider modifications and variations of their frontiers so that a satisfactory arrangement may be arrived at”
প্রথমে তাড়াহুড়া করে সীমান্তরেখা টেনে দিয়ে পরে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে যে সমাধানের কাল্পনিক স্বপ্ন নেহেরু দেখেছিলেন, তা ভারত-পাকিস্তানের ইতিহাসে আর হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। ৫ সপ্তাহ সময়ে নির্ধারিত সীমান্তই কাল হয়ে দাঁড়ায় ভারতের ৪০ কোটি মানুষের জন্য। নেহেরুর ধারণা ছিলো, সীমান্ত নিয়ে গড়িমসি করতে করতে ব্রিটিশরা আবার ঘাড়ে চেপে না বসে। তাই সীমান্ত কমিশন যত দ্রুত রিপোর্ট দেবে, তত দ্রুত ব্রিটিশদের হাত থেকে ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে চলে আসবে। হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসা মানুষগুলো যে সীমান্তের বেড়াজালে আটকে হঠাৎ করেই পর হয়ে যাবে, তা বুঝতেই হয়তো ভুল করে ফেলেছিলেন কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের বাঘা বাঘা সব নেতারা। তাই অর্ধশতাব্দীর চেয়ে বেশি সময় কেটে গেলেও, সীমান্ত নিয়ে পারস্পরিক সমঝোতাটা আর হয়ে ওঠেনি ভারত-পাকিস্তানের মাঝে।
ভারতবাসীকে অ্যানেস্থেশিয়া দিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিজেই
বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে নানা ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট সিরিল র্যাডক্লিফ তার রিপোর্ট তৈরি করেন। তিনি ঘোষণা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তা পিছিয়ে দিলেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো, ১৫ আগস্ট ভারতের হাতে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, দুই দেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার উল্লাস করছে, তারা তখনো জানে না, কোথায় তাদের সীমান্ত শেষ আর কোথায় তার শুরু। ১৭ আগস্ট প্রকাশিত হলো বহুল প্রত্যাশিত সেই র্যাডক্লিফের সীমান্ত কমিশনের রিপোর্টের গেজেটেড কপি। ভারতভাগের আসল ভয়াবহতার শুরু সেদিন থেকেই। ধীরে ধীরে সারা ভারত জুড়ে ব্যবচ্ছেদ শুরু হয়ে গেলো। সরকারি গেজেট থেকে জেলা-থানা গড়িয়ে যতই গ্রাম অবধি সেই সীমান্ত কমিশনের রিপোর্ট যেতে শুরু করলো, ততই যেন সাধারণ মানুষের হাহাকার বাড়তে লাগলো। সিএননের ভিডিওচিত্রে উঠে এসেছে লাখো মানুষের এই স্থানান্তরের খন্ডচিত্র।
সাধের ঘরবাড়ি, সহায় সম্বল, জমিজমার উপর দিয়ে যেন র্যাডক্লিফ লাইনের স্টীম রোলার চলে গেলো। সীমান্ত পারাপার আর দুপাশে শত সহস্র স্থানে ছড়িয়ে ধর্মীয় সহিংসতা ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাড়াহুড়োর সীমান্ত এতো মানুষের মৃত্যু বয়ে আনতে পারে, ব্যাপারটি মোটেই হয়তো প্রত্যাশিত ব্যাপার ছিলো না র্যাডক্লিফের কাছে। পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার সঠিক বণ্টন নিয়ে ধারণা না থাকায় এতো বিপুল পরিমাণ মানুষের যে বাস্তুচ্যুতি ঘটতে পারে, তা কল্পনার বাইরেই থেকে যায় সীমান্ত কমিশনের।
১৪ আর ১৫ আগস্ট যথাক্রমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা হওয়ার আনন্দে অচেতন হয়ে যাওয়া পুরো ভারতবাসীর যন্ত্রণা বাড়তে থাকে ক্রমেই। জায়গাজমি ও বসতভিটা রেখে হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বীরা পাড়ি জমাতে থাকেন ভারতে আর মুসলমানেরা পাকিস্তানে। পাঞ্জাব, বাংলা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, কাশ্মীর সহ র্যাডক্লিফ লাইনের আশেপাশের এলাকাগুলোতে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। শুধু ব্রিটিশ হিসেব অনুযায়ী, ভারত জুড়ে তখন ৬০০ শরণার্থী শিবির গড়ে ওঠে।
প্রকৃত সংখ্যা হয়তো ছাড়িয়ে গেছে হাজারের কোঠাও। এই শিবিরগুলোতে মানুষেরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবার সময় কিংবা নতুন দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর এই স্থানান্তরের সময় কম করে হলেও সত্তর হাজার নারী শিকার হয়েছেন যৌন নিপীড়নের। অনেক ধর্মীয় আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো।
দেশভাগের প্রস্তুতির সময় মাউন্টব্যাটেনকে এক সাংবাদিক দেশভাগের পরে এই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে কিনা এই মর্মে প্রশ্ন করেছিলেন। বরাবরের মতো মাউন্টব্যাটেন আশা করেছিলেন, এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম আর সৃষ্টি হলেও দুই দেশের সরকার হয়তো সমঝোতার মাধ্যমে তা সমাধান করে নিতে পারবে। কিন্তু এই সমঝোতার সুবাতাস আর ভারতীয় উপমহাদেশে বয়ে যায়নি কোনোদিন।
সমঝোতা হয়নি, বরং সমস্যা বেড়েছে
সদ্য স্বাধীন হওয়া দু দেশের মধ্যে ক্রমেই তিক্ততা বাড়তে থাকে। জম্মু কাশ্মীর নিয়ে স্বাধীন হওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ভারত আর পাকিস্তানের। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধ চলে ১ জানুয়ারি ১৯৪৯ পর্যন্ত।
১৯৬৫, আর সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরের কারগিলে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও সমাধান হয়নি সীমান্তজনিত অনেক সমস্যার। তাই তাড়াহুড়া করে নির্ধারণ করা সীমান্ত ক্ষণে ক্ষণে দুই প্রতিবেশীর রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে।
র্যাডক্লিফ থেকে স্যার র্যাডক্লিফ
র্যাডক্লিফ তার নিজের কাজের ফলাফলের খানিকটা নিজের চোখেই দেখে গিয়েছিলেন। বিবিসির কাছে এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “অন্তত ৮ কোটি মানুষ আমাকে দেখবে ক্ষোভ নিয়ে”। তাই আর কোনোদিন ভারত কিংবা পাকিস্তানে না ফিরবার দৃঢ় পণ করে ফিরে গেলেন নিজ দেশে।
ব্রিটেনে ফিরে এই বিশাল কাজ অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করার কৃতিত্বস্বরূপ পেলেন নাইটহুড। কিন্তু স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের টানা লাইন আর তড়িঘড়ি করে নির্ধারণ করা সীমান্ত আজও ভারতবর্ষের বুকে রয়ে গেছে দগদগে ক্ষতের মতো।
দেশভাগ নিয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন যশোবন্ত সিংহ-এর লেখা 'জিন্না: ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা' বইটি।
তথ্যসূত্রঃ
- Singh, Jaswant (2009). Jinnah: India, Partition, Independence, Issue 1; page: 417-427
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন