বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০

ধ্যান ( তিন )

 ধ্যান( তিন )

অমৃতকথা
 

 ধ্যান

 
ধ্যানে ‘আমি’-বোধকে অনেকক্ষণ ধরে রাখতে পারলে সাধক মনোময় কোশ ত্যাগ করে বিজ্ঞানময় কোশে উঠে যান। একটি কোশ থেকে অন্য কোশে ওঠার সময় সাধক কতকগুলি বাধার সম্মুখীন হন। প্রথমত, এই ধ্যানে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ কমে আসতে থাকে এবং এর ফলে ধ্যানের অবিচ্ছিন্নতা কেটে যেতে পারে। সাধকের মনে হয় শ্বাস-প্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে চলেছে। সাধারণ অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে যেমন নাক-বুক-পেটকে নিয়ে চলে, ধ্যানের গভীরতার সেই কাজটি যেন শুধু নাককে আশ্রয় করে চলে, ক্রমে সেটি নাসিকাগ্রে আসে, এবং পরে সেটিও যেন খুব ধীরে ধীরে হয়ে নাসিকাগ্রমাত্রকে আশ্রয় করে একটি অতি ধীর স্পন্দন-মাত্র পর্যবসিত হয়। প্রথমদিকে এর ফলে সাধকের অসুবিধে হতে পারে, কিন্তু অভ্যাসের সাহায্যে (অর্থাৎ এই ব্যবস্থাতেও ধ্যান চালিয়ে যাওয়া) এটি সহজ হয়ে আসে, শ্বাস-প্রশ্বাস অত্যন্ত আস্তে হলেও তার কোনরকম অসুবিধে হয় না।
দ্বিতীয়ত, ধ্যানের সময় মেরুদণ্ডের কোন অংশ কাঁপতে থাকে কিম্বা মনে হয় একটি ছুরি কেউ যেন মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে নীচে থেকে ওপর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ-অবস্থায় সাধকের শারীরিক অস্বস্তি হয়। খুব বেশি অস্বস্তি হলে মেরুদণ্ডের সেই অংশে হাত দিয়ে সামান্য ম্যাসাজ্‌ করে দিতে হয়। ম্যাসাজ করার সময় হাতকে ভার্টিক্যাল, না চালিয়ে হরাইজন্টাল ভাবে চালাতে হবে। এ-ধরনের শারীরিক অস্বস্তি অনেক সময় ধ্যানকালীন অবস্থার পরেও হয়। তখন সাধক উঠতে-বসতে-শুতে এটি অনুভব করেন, স্থির হয়ে থাকতে পারেন না। কয়েকদিন ধ্যান বন্ধ রাখলে এটি চলে যায়, কিন্তু ধ্যান বন্ধ না করে নীরবে এই অস্বস্তিকে সহ্য করা দরকার।
তৃতীয়ত, সাধকের তখন নানারকম দর্শন হতে পারে — জ্যোতি, দেব-দেবীর উজ্জ্বল রূপ, চেনা-অচেনা বিভিন্ন জায়গার এবং পরিচিত-অপরিচিত নারী-পুরুষের মুখ, সুন্দর ও বীভৎস দৃশ্য ইত্যাদি অনেক কিছু সাধকের সামনে আসে। কিছু মানসিক শক্তিরও বিকাশ ঘটে। প্রথমদিকে এগুলি তাকে আনন্দ দিলেও পরে এগুলিও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যে সাধক যা-কিছু দেখুন-শুনুন বা অনুভব করুন না কেন, এগুলির ওপর নজর না দিয়ে চিন্তা করতে হয়—‘কে দেখছে?’ অর্থাৎ ‘আমি’-বোধের ওপর মনকে ফিরিয়ে আনতে হয়। এসব দর্শনকে প্রাধান্য দিলে সাধকের উন্নতি ব্যাহত হয়।
চতুর্থত, ধ্যান করার সময় মন লয়-অবস্থায় চলে যেতে পারে, অর্থাৎ মনে অন্য চিন্তা না উঠলেও সাধক ‘আমি’-বোধ সম্বন্ধেও সচেতন থাকেন না। কিছুক্ষণ পর মন সাধারণ অবস্থায় ফিরে এলে সাধক সচেতন হন ও ভাবেন যে তার হয়তো সমাধি হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এটি সমাধি নয়, মন তখন লয় অবস্থায় চলে গিয়েছিল। ধ্যানের সময় ‘আমি এক চেতন সত্তামাত্র’ এই বোধ ভুললে চলবে না। এই বোধ স্পষ্টরূপে থাকবে। ধ্যানের সময় সমাধি হয়েছিল অথবা লয় হয়েছিল, এটি বুঝবার জন্যে সাধক নিজেকে ভালোভাবে বিচার করে দেখবেন। কিছুক্ষণের জন্যে তার কাছে সবকিছু বিলীন হয়ে গিয়েছিল বলে যদি মনে হয় তবে এই অবস্থা থেকে সাধারণ অবস্থায় নেমে এসে তিনি চিন্তা করবেন ধ্যানাবস্থায় তার কোনোরকম তত্ত্বের বা সত্যের উপলব্ধি হয়েছিল কিনা এবং পরে ঘুম পাচ্ছে কিনা। মনের লয় হলে কোনো তত্ত্বের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয় না এবং ঘুম পায়। আর সমাধিতে ঠিক এর বিপরীত হয়।
পঞ্চম বাধাটি ঠিক বাধা নয়, এটি একটি উপলব্ধি। তবে প্রথমাবস্থায় সাধকের কাছে এটি অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানময় কোশে যখন সাধক অনেকক্ষণ ধরে থাকেন তখন ধ্যান ভাঙার সময় এটিকে তিনি অনুভব করেন। তিনি অহ্‌ম-বোধ থেকে মনোময়কোশে নেমে আসেন সহজে, কিন্তু এরপরই অনুভব করেন তার চেতনা-কেন্দ্র তার শরীরের বাইরে।
স্বামী সৌমেশ্বরানন্দের ‘দৈনন্দিন জীবনে ধ্যান ও শান্তি’ থেকে
 
বর্তমান

শেয়ার করেছেন :- প্রণব কুমার কুণ্ডু
প্রণব কুমার কুণ্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন