বেদাঙ্গ
ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডু
প্রণব কুমার কুণ্ডু
বেদাঙ্গ বলতে আসলে কী বোঝায় ?
বেদাঙ্গ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে পাওয়া যাবে বেদ+অঙ্গ, অঙ্গ মানে যেহেতু অংশ বা পার্ট, সেহেতু বেদাঙ্গ মানে মনে হতে পারে বেদের অঙ্গ বা অংশ, এটা মনে করেই চিন্ময় নামে আমার এক পাঠকবন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছে বেদের ছয়টি অঙ্গের প্রমাণ বেদের কোথায় কিভাবে আছে, সেটা রেফারেন্স সহ আলোচনা করতে, যে প্রশ্নটি আপনারা ফটোপোস্টে দেখতে পাচ্ছেন; কিন্তু আসলে ব্যাপারটি সেরকম নয়, বেদাঙ্গ বলতে আসলে বেদের অঙ্গ বা অংশকে বোঝায় না, এগুলোর দ্বারা এমন কিছু বোঝায়, যা বেদ পড়ে বুঝতে সহায়ক। এককথায় বেদ পড়ে বুঝতে এবং বেদের জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে বেদাঙ্গ আবশ্যক।
বেদাঙ্গ ছয়টি। যথা- (১) শিক্ষা, (২) ছন্দ, (৩) ব্যাকরণ, (৪) নিরুক্ত, (৫) কল্প ও (৬) জ্যোতিষ।
এগুলো আসলেই কী, তা এখন নিচে একটা একটা করে আলোচনা করছি-
(১) শিক্ষা : শিক্ষা অর্থে স্বরবিজ্ঞান, যার দ্বারা বৈদিক সূক্তগুলি উচ্চারণ করে স্বর সংযোগে গান করার নিয়মকে বোঝায়। এককথায় গান করার যে নিয়ম, সেটাই বেদাঙ্গ এর উল্লিখিত শিক্ষা। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, সামবেদে যে ১৮৭৫টি মন্ত্র আছে, এগুলোই আসলে বৈদিক যুগের গান; আর এই ১৮৭৫টি সাম, নতুন কিছু নয়, ঋগ্বেদেরই কিছু নির্বাচিত মন্ত্র; তাই সামবেদে যা আছে, তার সবকিছুই ঋগ্বেদে আছে। এই তথ্য থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট যে- সামবেদ থেকেই সঙ্গীতের উৎপত্তি বা জন্ম এবং সঙ্গীত শব্দের সন্ধিবিচ্ছেদ যে সম+গীত, এই 'সম' আসলে 'সাম' শব্দেরই বিবর্তিত রূপ। এই আলোচনা থেকে এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত যে পৃথিবীতে সঙ্গীতের জনক হিন্দুরাই এবং হিন্দুরাই পৃথিবীকে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছে, যে শিক্ষা নিয়ে এখন খ্রিষ্টান মুসলমা্নসহ অন্যান্যরা ক'রেকর্মে খাচ্ছে এবং নাম ধাম করছে।
(২) ছন্দ : ছন্দ জ্ঞানের অভাবে বেদ পাঠ সম্পূর্ণ হয় না, বেদের রস উপলব্ধি হয় না এবং উচ্চারিত শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারিত না হওয়ায় তা হৃদয়াঙ্গম হয় না; এজন্য বেদ পাঠ করতে গেলে ছন্দজ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। গায়ত্রী, উষ্ণীক, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পঙক্তি, ত্রিষ্টুপ ও জগতী- এই সাতটি হলো বৈদিক ছন্দ, এই সাত ছন্দের মাধ্যমেই বৈদিক মন্ত্রগুলো লিখিত হয়েছে; তাই বেদের মন্ত্রগুলো সঠিক উচ্চারণে পাঠ ক'রে তা শ্রুতিমধুর করতে এবং হৃদয়াঙ্গম করতে ছন্দজ্ঞান খাকা অত্যাবশ্যক, এই বিষয়টিই হলো বেদাঙ্গের ছন্দ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে- বেদ ই পৃথিবীকে প্রথম ছন্দের শিক্ষা দিয়েছে এবং বেদের উপর্যুক্ত সাতটি ছন্দ থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন ছন্দের উৎপত্তি হয়েছে।
(৩) ব্যাকরণ : বেদাঙ্গের তৃতীয় বিষয় হলো ব্যাকরণ। ব্যাকরণ কী এবং ব্যাকরণ জানা কেনো প্রয়োজন সেটা আমরা সবাই জানি, তারপরও বলছি- ব্যাকরণ হলো যেকোনো ভাষা শিক্ষার মূল অস্ত্র। মূল বেদ সংস্কৃত ভাষায় লিখা, তাই বেদ সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে হলে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ জানা বা বোঝা দরকার; একারণেই ব্যাকরণকে বেদাঙ্গের ৬টি বিষয়ের একটি বিষয় বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গের আলোচনা থেকে এটাও স্পষ্ট যে সভ্যতাকে ব্যাকরণের ধারণা দিয়েছে আমাদের মুনি ঋষিরাই, যে ধারণার উপর গড়ে উঠেছে ভাষা শিক্ষার অত্যাবশকীয় বিষয় ব্যাকারণ সম্পর্কিত আলোচনা এবং রচিত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায় এ সম্পর্কিত বই পুস্তক।
(৪) নিরুক্ত : যেকোনো ভাষার একটি আবশ্যকীয় বিষয় হলো ডিকশনারি বা অভিধান, যার আরেকটি বাংলা অর্থ হলো শব্দকোষ। এক্ষেত্রেও পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছে আমাদের মুনি ঋষিরা নিরুক্তের মাধ্যমে। আশা করছি, নিরুক্ত যে কী সেটা আমার পাঠক বন্ধুরা এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, তারপরও বলছি- নিরুক্ত হলো বৈদিক অভিধান। নিরুক্ততে বেদের কঠিন শব্দের বিশ্লেষণ ও তার অর্থ আছে। কঠিন বৈদিক শব্দের ব্যাখ্যা এবং তার প্রয়োগ দেখানোই নিরুক্ত শাস্ত্রের উদ্দেশ্য।
সর্বমোট ১৭ জন বৈদিক অভিধান প্রণেতা বা নিরুক্তকারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়; এর মধ্যে সর্বশেষ জনের নাম যাস্ক। বর্তমানে বৈদিক সাহিত্যে যে নিরুক্তটি টিকে আছে বা ব্যবহার হয়, তার প্রণেতা যাস্ক। যাস্কের নিরুক্ততে মোট ১৪টি অধ্যায় আছে এবং এর বিভিন্ন অধ্যায়ে বেদে বর্ণিত শব্দগুলোর অর্থ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা আছে।
(৫) কল্প : কল্প এর পুরো নাম আসলে কল্পসূত্র। বৈদিক যজ্ঞকর্ম, সামাজিক জীবন বা লোকব্যবহারে বিস্তৃত হতে হতে ক্রমে ক্রমে এমনই জটিল ও বহুবিস্তৃত হয়ে উঠে যে, এই সকল ক্রিয়াকাণ্ডের ব্যবস্থাগুলিকে ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থ হতে সংক্ষিপ্ত করে একত্র করবার প্রয়োজন হয় এবং সূত্রাকারে রচনা করার প্রয়োজন হয়, এই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থকেই কল্পসূত্র বলা হয়।
উপরের অনুচ্ছেদে "ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থ" বলে একটি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার হয়েছে, এই বিষয়টি না বুঝলে আসলে কল্প বা কল্পসূত্রের ধারণাটা ক্লিয়ার হবে না, তাই ব্রাহ্মণ গ্রন্থ কী, সেটা এখন বুঝে নিন-
প্রতিটি বেদ চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: প্রথমটি হলো- 'সংহিতা', এর বিষয়বস্তু মন্ত্র ও আশীর্বচন। দ্বিতীয়টি হলো- 'আরণ্যক', এর বিষয়বস্তু - ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম ও যাগযজ্ঞ । তৃতীয়টি হলো- 'ব্রাহ্মণ', এর বিষয়বস্ত, আরণ্যকে উল্লিখিত- ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও যাগ যজ্ঞাদির বিষয়গুলো আরো ভালো করে বোঝার জন্য সেই সব বিষয়ের উপর রচিত টীকা; এই বিষয় সম্পর্কিত গ্রন্থগুলোকেই উপরে বলা হয়েছে 'ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থ'; কল্পসূত্র হলো এই ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোরই সারসংক্ষেপ। বিষয়টি জটিল হলেও আশা করছি তা আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার হয়েছে। এছাড়াও বেদের চারটি ভাগের শেষ টি হলো উপনিষদ, যার বিষয়বস্তু- ধ্যান, দর্শন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান-সংক্রান্ত আলোচনা।
(৬) জ্যোতিষ : জ্যোতিষের বিষয়বস্তু কী, সে সম্পর্কে প্রায় সবারই কম বেশি ধারণা আছে, তারপরও আলোচনার সুবিধার্থে বলছি- আকাশে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান এবং এইসব গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবী এবং পৃথিবীর উপরস্থিত মানুষের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ের ব্যাখ্যা সম্বলিত শাস্ত্রই হলো জ্যোতিষ শাস্ত্র। বেদাঙ্গের ছয়টির একটি হলো জ্যোতিষ; তাই, বেদাঙ্গ কী, তা সঠিকভাবে না জানার কারণে অনেকে নয় প্রায় সবাই মনে করে, বেদে জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্কে কোনো আলোচনা আছে বা এ সম্পর্কে কোনো সূত্র আছে, কিন্তু আসলে বেদে এ সম্পর্কিত কোনো আলোচনা নেই; তবে বেদ রচয়িতা মুনি ঋষিগণ এবং তাদের শিষ্যগণ জ্যোতিষের বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক বই লিখেছেন, যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে জ্যোতিষ শাস্ত্র এবং পথ দেখিয়েছে পৃথিবীর মানুষকে তথা সভ্যতাকে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে- এই জ্যোতিষশাস্ত্র বেদাঙ্গ হয় কিভাবে বা বেদ পড়ে বুঝতে এই জ্যোতিষ কিভাবে সাহায্য করে ?
বেদাঙ্গের অপর পাঁচটি বিষয়- শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত ও কল্প- বেদ পড়ে বুঝতে সহায়ক হলেও, জ্যোতিষ শাস্ত্র আসলে এসবে কোনো কাজে লাগে না, জ্যোতিষ কাজে লাগে বেদ নির্দেশিত যাগযজ্ঞ করার জন্য আকাশে গ্রহ নক্ষত্রের সঠিক অবস্থান জানতে এবং যাগযজ্ঞের জন্য সঠিক সময় তথা দিন তারিখ নির্ধারণ করতে; বলতে পারেন বেদাঙ্গের অপর পাঁচটি বিষয় বেদের থিয়োরি হলেও জ্যোতিষ আসলে বেদের ফল লাভের জন্য প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার।
আশা করছি, বেদাঙ্গ সম্পর্কে বুঝতে এই প্রবন্ধটি, আমার পাঠক বন্ধুদেরকে সহায়তা করবে।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
-----------------------------------
বি.দ্র : কেউ যদি চারখণ্ড বেদ ঘরে বসে পেতে চান, আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
-----------------------------------
বি.দ্র : কেউ যদি চারখণ্ড বেদ ঘরে বসে পেতে চান, আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
💜 জয় হোক সনাতনের 💜
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন