সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮

শূন্য


   শূন্য


   ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু



ভারত থেকে বহির্বিশ্বে শূন্যের চলন

ভারতীয় গণিতের এই রত্নখনির সন্ধান পেয়েছিল আরবেরা। পারস্যদেশের খলিফাদের রাজসভার সভাপণ্ডিত গণিতজ্ঞদের হাতে অনুদিত হয়ে টিকে গিয়েছিল এই প্রাচীন সভ্যতার গণিত-জ্ঞানভাণ্ডার। পরবর্তী সময়ে নবজাগরণের সূচনায় ল্যাটিনে অনুবাদ হয়ে এই শূন্যসহ দশমিক সংখ্যাতন্ত্র ক্রমশ প্রবেশ করেছিল ইউরোপে। সে যাত্রাপথ খুব মসৃণ ছিল, এমনটা নয়। এই কারনেই ইউরোপে এই সেদিন পর্যন্ত এইসব সংখ্যাচিহ্নদের বলত আরবিক সংখ্যাচিহ্ন। এখন অবশ্য সেই ভুল আর কেউ করেনা। ভারতের অবদান স্বীকার করে এর নতুন নাম হয়েছে হিন্দু-আরবিয় সংখ্যাচিহ্ন।
প্রাচীন ভারতে গাণিতিক শূন্যের সবচেয়ে চালু নাম ছিল ‘খ’, অর্থাৎ আকাশ অথবা গগন, অন্তরীক্ষ বা জলধরপথ, ইত্যাদি কত বিচিত্র প্রতিশব্দ – পরিভাষায় যাদের বলে ‘ভূতসংখ্যা’ (word numerals)। কেমন ছিল ভারতীয় শূন্যের আদি চেহারা? বরাহমিহিরের ‘সূর্যসিদ্ধান্তে’ বা সুবন্ধুর নাটক ‘বাসবদত্তায়’ রয়েছে শূন্যকে বিন্দুর সঙ্গে তুলনা (শূন্যবিন্দবহ্), অমরকোষের কোষকার অমরসিংহ বলেছেন, শূন্য হলো ফাঁকা, তুচ্ছ বা রিক্তক। কেউ এর নাম দিয়েছেন ‘ছিদ্র’। অন্যত্র পাওয়া যায় ‘রন্ধ্র’। নাম-মাহাত্ম্য থেকে এর আকৃতির গোল ছাঁচ সহজেই অনুমেয়। তবে শুরুতে সম্ভবত গোলের ভেতরটা ফাঁকা থাকত না, ভরাট করে দেওয়া হত। পরে কোন এক সময় থেকে, হয়ত বা সময় বাঁচাতেই সেই প্রথা উঠে যায়।
শূন্যের লিখিত প্রমান – যা পাওয়া যায়
এই ভরাট শূন্যকে লিখিত আকারে দেখা যায় বার্চ গাছের ছালে লেখা বকশালি পান্ডুলিপিতে, বর্তমানে অক্সফোর্ডের এক বিশেষ পাঠাগারে যা সংরক্ষিত রয়েছে। এর রচনার সময়কাল নিয়েও যথারীতি নানা মুনির নানা মত। কেউ একে দ্বিতীয় শতকে লেখা বলেন, তো কেউ বলেন একেবারে দ্বাদশ শতকে, অন্য অনেকে আবার এর মাঝামাঝি কোথাও। এদিকে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ঘোষিত এক রেডিও-কার্বন পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী এটা নাকি কোন এক বিশেষ সময়ের রচনা নয়। সব মিলিয়ে এই বিতর্ক এখন জমজমাট।
বকশালি পান্ডুলিপিতে শূন্য
পাথরে খোদাই করা প্রাচীনতম শূন্য সংখ্যা দেখতে হলে যেতে হবে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র দুর্গে। সেখানকার চতুর্ভুজ বিষ্ণু মন্দিরের উৎকীর্ণ শিলালিপিতে দেখা যায় নবম শতাব্দীর কোন এক রাজা ভোজদেব ওই মন্দির সংলগ্ন একখণ্ড জমি দেবত্র করেছেন। যেখানে ফুলের চাষ হবে, সেই ফুল উৎসর্গ হবে ভগবান বিষ্ণুর পূজায়। জমির মাপ বোঝাতে গুপ্ত যুগের নাগরি লিপিতে লেখা ২৭০ হস্ত দৈর্ঘ্য ও ৫০ হস্ত প্রস্থের কথা, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আমাদের জানা আধুনিক শূন্যের বর্তমান চেহারার সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত লিপির নিদর্শন। বর্তমান চেহারার লিখিত শূন্য আরও অনেক আছে, তবে তা তাম্রপত্রে খোদাই করা এবং এদের সময়কাল অপেক্ষাকৃত বেশী পুরানো হলেও এগুলোর সময়কালের দাবীর সত্যতা নিয়ে পণ্ডিতেরা একমত নন।
শূন্য থেকে জিরো
বস্তুত শুধুমাত্র ভারতীয় প্রসঙ্গে শূন্যকে সব দিক থেকে দেখাতে হলে যা লিখতে হবে, তা একটা গোটা বইয়ের উপজীব্য হতে পারে। সংস্কৃত শব্দ ‘শূন্য’ এসেছে শুনা (+যৎ প্রত্যয়) থেকে, যা মূল ধাতু ‘শ্বি’- এর পুরাঘটিত অতীত রূপ। মূল ধাতুর প্রত্যক্ষ অর্থ ছিল ‘ফুলে ওঠা ফাঁপা গহ্বর’, যে অর্থে ‘শুনম্’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ঋগ্বেদে, নিহত পশুদের পচনশীল ফুলে ওঠা দেহাবশেষের বর্ণনায়। সময়ের সাথে এর অর্থ বিস্তারিত হয়েছে ‘অভাব’ বোঝাতে – এমন কিছু, যা থাকার কথা ছিল কিন্তু বাস্তবে নেই! ভাষা বিজ্ঞানীরা বলেন ‘সেমান্টিক এক্সটেন্সন’। এই না থাকা, অর্থাৎ ‘নেই’, যতটা নঞর্থক, ততটাই অস্ত্যর্থক – আপাত অভাব যেন অসীম সম্ভাবনার উদ্ভাসের প্রতিক্ষায় উন্মুখ তাকে বরণ করে নিতে – যেমনটা হয় মাতৃগর্ভের শূন্যতা।
লিবের আবাচির একটি আধুনিক সংস্করন
আরবদের অনুবাদ ‘শূন্য’ শব্দের এই দার্শনিক দ্যোতনাকে ধরতে পারেনি – ভারতীয় দর্শনের আত্মার সন্ধান ছাড়া তা ধরা সম্ভবও ছিলনা। তাই আরবিয় আক্ষরিক অনুবাদে ‘শূন্য’ হয়েছিল ‘সিফ্র’ (sfr), যা শুধুই অভাব বোধের নঞর্থক প্রতিধ্বনি। পরবর্তী সময়ে ল্যাটিন অনুবাদকদের হাতে পড়ে বদলাতে বদলাতে এর নাম দাঁড়ায় সিফ্রা, সিফ্রে, জিফ্রা, জাইফ্রা ইত্যাদি নানান রকম। ইতালির পিসা অঞ্চলের ব্যবসায়ী বোনাচ্চিওর গণিতজ্ঞ ছেলে লিওনার্দো, যিনি গণিত জগতে ফিবনাচ্চি নামেই বেশী পরিচিত, তিনি ছোটবেলায় আফ্রিকার আরব উপনিবেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন ব্যবসায়ী বাবার সঙ্গে। সেখানেই আরবদের কাছে তাঁর এই সংখ্যা পদ্ধতিতে হাতেখড়ি, সঙ্গে শেখা মাত্র দশটা সংখ্যাচিহ্ন ব্যবহার করে যত বড় খুশি সংখ্যা লিখতে পারার দশমিক পদ্ধতি। বড় হয়ে ত্রয়োদশ শতকে তিনি যখন রচনা করলেন ‘লিবের আবাচি’ অর্থাৎ সংখ্যাদের বই, সেখানে তিনি বললেন আরবদের এই অসামান্য সংখ্যাতন্ত্রের কথা – তাঁর লেখনীতে জিফ্রা দাঁড়ালো ‘জেফিরাম’, ল্যাটিনে যার মানে ‘পশ্চিমের মলয় বাতাস’, খুবই হালকা, তুচ্ছ – প্রায় অনুভুতই হয় না এত মৃদু। এই জেফিরাম থেকে ভেনিসিয় কথ্য ভাষায় একদিন তৈরি হোল নতুন প্রতিশব্দ ‘জেফিরো’ – ক্রমশ ‘জেরো’, যার ইংরেজি তুতভাই হোল ‘জিরো’ – আমাদের আধুনিক শূন্য।
সংগৃহীত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন