সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮

সতীদাহ ও দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধভায়


    সতীদাহ ও দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধভায়


    শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু                    ফেসবুক থেকে...


সতীদাহ ও দক্ষিণাবাবু।
বরানগর রতনবাবুর ঘাট। শ্মশান। সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে শোভাযাত্রা। মুহুর্মুহু উঠছে ‘সতী মা’য়ের নামে জয়ধ্বনি। ঢাকঢোলের উন্মত্ততা আর গাঢ় ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়ার জোগাড় ১৮বছরের তাজা শরীরের। দিনরাত ক্রমামত ধুতুরো আফিমের ঘো‍‌রে দিশাহারা। মৃতপ্রায়। তবুও জীবনের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ। যদিও জানে, কিছুই করার নেই।
৯০বছরের লাহিড়ী মশাইয়ের সঙ্গে নবদাম্পত্য শুরু হওয়ার দিন থেকেই মনে মনে শুরু হয়ে গিয়েছিল এই অগ্নিশয্যার প্রস্তুতি। এবং আজ সময় হয়েছে। চিতা জ্বালানোর আয়োজন সম্পূর্ণ। মহাপতিব্রতা, পুণ্যময়ী সাধ্বীকে বেঁধে ডাব, নারকেল, দই, খই, ফুল, বেলপাতা সহযোগে শাস্ত্রমতে পুড়িয়ে মারা হবে আগুনে। খসে, গলে পড়বে মাংস, পুড়ে যাবে হাড়। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোবে মহান হিন্দুধর্মের জয়যাত্রা।
হঠাৎ ছন্দপতন। শোভাযাত্রার আচমকা গতিরোধ। শ্মশানের মুখে পথ আগলে দাঁড়িয়ে, ওরা কারা? দাঁড়িয়ে আছেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রাধানাথ শিকদার আর এক পাও এগোতে দেওয়া যাবে না। এই সর্বনাশা শোভাযাত্রাকে। তাঁদের বক্তব্য স্পষ্ট। এই বীভৎস অনাচারকে হিন্দুধর্ম বলে মানবো না। এই অসহায় কিশোরীকে পুড়িয়ে মারতে দেবো না। থমকে যাওয়া মিছিলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললো ‘ইয়ং বেঙ্গল’ — সতীদাহ চলছে না চলবে না।
পত্রিকা-সম্পাদক, সমাজসেবক দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আজ প্রয়ান দিবস। ১৮১৪ সালে তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল কাঁচড়াপাড়ার ভাটপাড়ায়। তিনি হেয়ার স্কুল ও হিন্দু কলেজে পড়াশুনা করেন এবং সেই সূত্রে ইয়ং বেঙ্গল দলের কর্মী ও ডিরোজিওর প্রিয় পাত্র ছিলেন।
দক্ষিণারঞ্জন ছাত্রাবস্থায়ই জ্ঞানান্বেষণ (১৮৩১) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পরে তিনি ভারত পত্রিকা, সমাচার হিন্দুস্থানী ইত্যাদি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তিনি বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। একজন খ্যাতনামা বাগ্মিরূপে দক্ষিণারঞ্জন সংবাদপত্র দলন-আইনের বিরোধিতা করেন। তিনি কলকাতা পৌরসভার প্রথম ভারতীয় কালেক্টর, মুর্শিদাবাদের নবাব নাজিমের দেওয়ান, বর্ধমানরাজের ডেপুটি কালেক্টর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন।
১৮৪৩ সালে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি স্থাপনে দক্ষিণারঞ্জন অন্যতম উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেন। সমাজ ও প্রচলিত রীতির বিরোধী রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে স্বজনদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে তাঁর আশ্রয় লাভ করেন। দক্ষিণারঞ্জন স্ত্রীশিক্ষার জন্য বেথুন সাহেবকে জমি দান করেন (১৮৪৯); পরে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হলে তার উন্নতির জন্যও তিনি নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
প্রচলিত সমাজবিধান উপেক্ষা করে দক্ষিণারঞ্জন বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্রের বিধবা রানীকে বিবাহ করলে কলকাতার সুহূদজনেরা তাঁকে ত্যাগ করেন। তখন তিনি সপরিবারে লক্ষ্ণৌ চলে যান (১৮৫১) এবং সেখানে অল্পদিনেই বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। লক্ষ্ণৌতে তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৬১) ও লক্ষ্ণৌ ক্যানিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং লক্ষ্ণৌ টাইমস পত্রিকার স্বত্ব কিনে নিজেই সম্পাদনা করেন। তিনি লক্ষ্ণৌ তথা অযোধ্যার সহকারী অবৈতনিক কমিশনার এবং জমিদারদের শিক্ষায়তন ওয়ার্ড ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক কমিশনার ছিলেন।
লক্ষ্ণৌতে সরকার মনোনীত এবং জননির্বাচিত সমান সংখ্যক সভ্য নিয়ে প্রাদেশিক সরকার গঠনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তাঁর প্রতিপত্তি বিনষ্ট হয়। তবে সিপাহি বিদ্রোহে সরকারকে সহায়তা করার জন্য লর্ড ক্যানিং তাঁকে রায়বেরিলির শঙ্করপুর তালুক জায়গির হিসেবে দান করেন (১৮৫৯) এবং লর্ড মেয়ো তাঁকে ‘রাজা’ (১৮৭১) উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৮৭৮ সালের ১৫ জুলাই লক্ষ্ণৌতে তাঁর মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্রঃ বাংলাপিডিয়া


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন