সোমবার, ২ জুলাই, ২০১৮

ঐতিহাসিক হুল দিবস.....



   
      ঐতিহাসিক হুল দিবস.....


      ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                        প্রণব কুমার কুণ্ডু


ঐতিহাসিক হুল দিবস.....

Jyotsna Soren

পরাধীন ভারত বর্ষের নিষ্পেষিত জাতি আদিবাসী জনজাতি..৷ সভ্যতার শুরু থেকে সংগ্রামী জীবনের পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাঁদের ৷ কখনও বন্য পশুর হাত থেকে রক্ষা পেতে, কখনো অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে...আবার কখনো বা জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার তাগিদে ৷ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নিরিহ ও শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আদিম জনজাতি সাঁওতালদের কথা বলা-ই যায় ৷ কিন্তু সেই আপাত নিরীহ মানুষ যখন হাতিয়ার তুলে নেন তখন পিছু হঠবার প্রশ্ন থাকেনা ৷ তবু প্রশ্ন থেকেই যায়..কেন তাঁরা নিরবিচ্ছিন্ন জীবনে হাতিয়ার তোলেন ?? কেনই বা বন্দুকের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে "হুল" ঘোষনা করেন ??
বিহার,ছোটনাগপুর, উড়িষ্যা ,পশ্চিমবঙ্গ সহ মালভূমের অনেক টা অংশ জুড়ে ছিল আদিম জন জাতির বাস ৷ অরন্য সঙ্কুল পরিবেশে শুরু হয়েছিল তাদের জীবন যাত্রা ৷ আরন্যক জীবনে বসবাসের পাশাপাশি বন কেটে বসতি ও কৃষিকাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলল সেই অনুর্বর জমিন ৷
অতি অল্পেতেই তুষ্ট বন্য জীবনে তাঁরা বেশ সুখেই ছিলেন ৷ পাহাড়ের কোলে .জোনাক জলা সন্ধ্যায়.. শাল ,মহুয়া, পিয়ালের গন্ধ নিয়ে বাতাসে ভেসে আসত বাঁশের বাঁশরী সুর ৷ ধিতাং ধিতাং মাদলের বোলে রাত ভারি হতো ৷ মোহময়ী জ্যোৎস্না রাতে আরন্যক ভানুমতী রা হয়ে উঠত রাত পরী ৷ সে বড় সুখের দিন ছিল ৷
বসন্তের সেই মাতাল হাওয়া- য় কাল হলো আরন্যক জীবনে ৷ প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ অনাবাসী দের পদভারে পঙ্কিল হলো বন্যজীবন ৷লোভাতুর ভিনদেশী রা পাড়ি জমাতে লাগলো সেই মুক্তাঞ্চলে ৷ ছলে বলে কৌশলে সেই "দিকু রা" ভূমিপুত্রদের জীবন অতিষ্ঠ করতে লাগলো ৷
একদিকে শোষন শাষন অন্যদিকে আইনি মার প্যাচ..সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত হতে লাগলো আদিবাসী জনজীবন ৷ এতদিন যে অরন্য ভূমি ছিল ভূমিপুত্রদের শৈশবের খেলাঘর, যৌবনের তপোবন.. স্বরূপ, সেখান থেকে উচ্ছেদ করার আইনি নোটিশ পাঠানো হলো.. 'দামিনী কোড'', দামিনী কোহ .র মাধ্যমে ৷ পার্বত্য অঞ্চলের পাদ দেশ থেকে বিতাড়ন করার পাশাপাশি সেই অরন্য কন্যাদের ডাগর গতরের দিকে চোখ সব পশুরূপী মানুষ পিশাচ দের ৷ আর থেমে থাকা নয় ,দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো ভূমি পুত্রদের ! জনজাতির নেতা হিসেবে উঠে এলেন বেশ কয়েক জন যোদ্ধা ..সিধু ,কানু, চাঁদ ,ভৈরো মুর্মু সহ দুই বোন ফুলো ও ঝানো ...৷
" সারজম গিরা" (শাল গাছের ছোট ডালের পাতা বিশেষ ভাবে মুড়ে দেওয়া হয় )যার অর্থ আমন্ত্রন ৷ বিশেষ বিশেষ বিষয় নিয়ে যখন গ্রাম্য সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না তখন দেশ দেশান্তের মানুষের কাছে খোলা দরবার এর আহ্বান জানানো হয় ৷)
ভগনা ডিহি গ্রামে মিলিত হলেন আদিবাসী জনজাতি ! (বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনা , বারহাইতের কাছাকাছি) ইংরেজ সহ 'দিকু' দের বিরূদ্ধে... অত্যাচার, অনাচার এর বিরুদ্ধে সেদিন গর্জে উঠেছিলেন প্রায় 30 হাজার আদিবাসী , অ - আদিবাসী মানুষজন ৷ বেসরকারী মতে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি ৷
অত্যাচার , অনাচার,শাষন শোষনের বিরুদ্ধে সেই
প্রথম স শস্ত্র গণ আন্দোলন ৷
যে সব কারনের জন্য মুলত আদিবাসীরা 'হুল' অর্থ্যাৎ 'বিদ্রোহ ঘোষনা করেছিল তা হলো ..
যে অরন্যাঞ্চল ছিল ভূমিপুত্রদের একচ্ছত্র অধিকার সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয় 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের 'ফলে ৷ সেই সাথে জঙ্গল কেটে যে জমি তাঁরা উর্বর করেন সেখানেই তাঁদের ক্রীতদাসের মতো খাটানো হয় ৷
ব্রিটিশ মুদ্রা প্রচলনের ফলে সহজ সরল নিরক্ষর আদিবাসীদের ঠকাতে লাগলো মুনাভালোভী জোতদার, জমিদার,ও মহাজনী সুদ কারবারী রা৷
আদিবাসীদের উৎপাদিত ফসল ও সম্পদ আত্মসাৎ করতে লাগলো ৷
দমন পীড়ন নীতি কায়েম করা ,সুবিচার না পাওয়া , কুচক্রীদের হাতে হাত মেলানো..সব মিলিয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে ৷

------------
দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ দানা বাধেঁ ,গণবিদ্রোহের চেহারা নেয় ৷ ১৮৫৫ সালের ৩০ শা জুন" হুলের"-কারনে নজরে আসেন ভূমিপুত্র রা ৷
তৎকালিন ইংরেজ সরকারের তদানীন্তন ম্যাজিষ্ট্রেট এডন সাহেবের নেতৃত্বে আদিবাসীদের অভিযোগ সম্পর্কে খতিয়ে দেখা হয় , এবং আদিবাসীদের দাবী মেনে 'ডুমকা' জেলা কেবল মাত্র আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৷ বর্তমান সাঁওতাল পরগণা জেলা ৷
সাঁওতাল মাঝি ,পারগানা কর্তৃক শাষনব্যবস্থা কে মান্যতা দেওয়া , এবং ১৮৫৫ সালে "বেঙ্গল টেনান্সি এক্ট "-অনুযায়ী সরকারের অনুমতি ব্যাতিত আদিবাসীদের জমি জায়গা হস্তান্তর করা যাবে না ৷

১৮৫৫ এর "হুল বিদ্রোহ "ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে..৷ ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতারের পরোয়ানা জারি করল সিধু কানুর নামে ৷ ১৮৫৬ সালের ২৭ শে জানুয়ারী পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন সিধু কানুর দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব ৷ শুরু হলো পুলিশি অকথ্য অত্যাচার...৷ গ্রামবাসীদের ওপর নেমে আসে অত্যাচারী খড়গ ৷ নির্মম অত্যাচার সইতে না পেরে তাঁরা গোপন আস্তানার সন্ধান দেয় ৷ রাতের অন্ধকারে হানা দিয়ে সিধুকে গুলিতে ঝাঁঝরা করা হয় ৷ কানু কে পরের সপ্তাহে বধ্যভূমিতে কুকুরের মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয় ৷ অবসান হলো একটা যুগের ..অগ্নিপুত্রদের জীবনের গাঁথা দিয়ে লেখা হলো ইতিহাসের প্রথম গণ বিদ্রোহ ৷
স্বাধীনতার প্রথম বিদ্রোহ প্রতক্ষ্য ভাবে ১৮৫৫ সালের ৩০ শা জুন কে ধরা না হলেও পরাধীন ভারতবর্ষের অবহেলিত জন জাতির এই গণবিদ্রোহ স্বাধীনতার বীজ বুনে দিয়েছিল ৷ অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দান তৈরী করেছিল ৷ স্বাধীনোত্তর ভারত বর্ষের ইতিহাসে সেই অসভ্য জাতিরা মাইলফলক ৷ পরবর্তী কালে যা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মানসিক রসদ জুগিয়ে ছিল ৷
স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আজও অবহেলিত সেই বিদ্রোহী ভূমিপুত্রদের আত্মত্যাগ ৷ ইতিহাসের ১৫ টি লাইনে সীমাবদ্ধ সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা ৷ যে বিদ্রোহ স্বাধীনভারতের উত্থানের দলিল বলা যায়, সেই বিদ্রোহ কে আঞ্চলিকতার তকমায় বেঁধে রাখায় প্রয়াস ৷
বর্তমান সরকার ৩০ শা জুন কে "সেকসনাল হলিডে" ঘোষনা করে তাঁর দায় সেরেছেন ৷
বিপ্লবী সিধু, কানু,চাঁদ ভৈরব, ফুলো, ঝানো(দুই বোন) সেই লড়াইয়ের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হোক ৷
"সিধু কানহু ডহর "নয় আমরা চাই ৩০ শা জুন কে আদিবাসী জনজাতির সংগ্রামী ইতিহাসের দলিল হিসেবে সরকার স্বীকৃতি দিক ৷ " সেকসনাল হলিডে" নয় আদিবাসী জনজাতির ত্যাগ কে মর্যাদা দিন ৷



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন