শনিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৮

মসলিন


   মসলিন 
                 
   শেয়ার করেছেন                      প্রণব কুমার কুণ্ডু।




মসলিনের অনেক রকম কিংবদন্তি শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। মসলিন শাড়ি এত সূক্ষ্ম যে দেশলাইয়ের বাক্সে এঁটে যায়, আংটির ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারে। আর শুনেছি, ব্রিটিশরা মসলিন কারিগরদের আঙুল কেটে দিয়েছিল, তাই এটা হারিয়ে গেছে, এখন আর নেই। সেসব শুনে খুব আফসোস হতো। এমন একটি ঐতিহ্য আমরা হারিয়ে ফেললাম! একপর্যায়ে মনে এই প্রশ্নও জাগল, এই কিংবদন্তির মসলিন কি আসলেই ছিল? তবে কোনো দিনও ভাবিনি, মসলিন আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় আমি যুক্ত হব। যখন সুযোগ হলো, তখন একান্তভাবে এই কাজে সম্পৃক্ত হলাম।
শুরুর কথা
‘মনে হয়, একটা মাকড়সার জাল...এতই সূক্ষ্ম যে হাতে ধরলে প্রায় বোঝা যায় না, কী ধরেছি হাতে।’
-জাঁ-বাপতিস্ত তাভের্নিয়ে, সপ্তদশ শতকের ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী ও পরিব্রাজক, ১৬০৫-১৬৮৯
২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শরিফউদ্দীন আহমদ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্রিকলেন সার্কেল আয়োজিত একটি সেমিনারে বক্তব্য দেন। হোয়াইট চ্যাপেলে আয়োজিত সেমিনারটির বিষয় ছিল ‘মসলিন: দ্য ফেমাস টেক্সটাইলস অব বেঙ্গল’। সেই সেমিনারে অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টেপনি কমিউনিটি ট্রাস্ট। স্টেপনি ট্রাস্ট লন্ডনের বাঙালিদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত। মসলিনের ব্যাপারে জানতে পেরে তারা উৎসাহী হয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্টেপনি ট্রাস্ট লন্ডনে একটি এক্সিবিশন করে। ‘বেঙ্গল টু ব্রিটেন’ ছিল প্রদর্শনীর নাম। বাংলার মসলিন কীভাবে ব্রিটেনে পৌঁছাল সে কথা এবং মসলিনের সৌন্দর্য ও মিথগুলো সেখানে তারা তুলে ধরেছিল।
২০১৩ সালের নভেম্বরে স্টেপনি ট্রাস্টের সঙ্গে আমার দেখা হলো। দৃকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত হয়ে তারা প্রস্তাব দেয়, দৃক যেন তাদের প্রদর্শনীটি বাংলাদেশে নিয়ে যায়। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, মসলিনের ব্যাপারে তাদের কাছে কী কী তথ্য আছে? প্রদর্শনী উপলক্ষে ছাপানো একটি বই তারা আমাকে দেয়। বইটি পড়ে মসলিনের ব্যাপারে অনেক কিছু জানার সঙ্গে সঙ্গে মনে অনেক রকম প্রশ্নও জাগল। বইয়ে মসলিনের মিথ, এর সৌন্দর্যের দিকটি ছিল। কিন্তু মসলিন কীভাবে তৈরি হতো, কারা বানাত, কীভাবে এই শিল্প শেষ হয়ে গেল, আর বর্তমানে এর অবস্থাই বা কী—এ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা হলো না। আমি ভাবলাম, শুধু মসলিনের সৌন্দর্য নয়, এর পেছনের অন্য গল্পগুলোও তো জানা দরকার। জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যাপারে তাদের কাছে আর কোনো তথ্য আছে কি না? তারা জানাল, এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া কঠিন। প্রদর্শনীতে যে কাপড়গুলো তারা দেখিয়েছিল, সেগুলো মসলিন নয়। এখনকার তাঁতিদের তৈরি থান কাপড়ের ওপর ব্যবহার করা মসলিনের নকশা ওগুলো। নকশাগুলো তারা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি জাদুঘর থেকে, যেখানে মসলিনের কাপড় সংরক্ষিত আছে।আমার মনে হলো, মসলিনের ঐতিহ্যের ব্যাপারে আরও বিশদভাবে জানার প্রয়োজন আছে। স্টেপনি ট্রাস্টকে বললাম, দৃক যদি এটা এভাবেই বাংলাদেশে নিয়ে যায়, তাহলে অনেক প্রশ্ন উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রে কেউ হয়তো প্রশ্ন করেনি, কিন্তু বাংলাদেশে করবে। প্রশ্ন উঠবে, মসলিন নিয়ে প্রচলিত গল্পটির আরও যে দিকগুলো আছে, সেগুলো কোথায়? মসলিন নিয়ে বাংলাদেশের গল্পটা যেন আমরা বলতে পারি, সে জন্য আরও তথ্য দরকার। বাংলাদেশে এসে আমি দৃকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করলাম। সবাই খুব উৎসাহ দিলেন। তাঁরা আরও বললেন, এর আগে দৃক ছবি (আলোকচিত্র) নিয়েই বিশেষত কাজ করেছে। তাই এই ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।
২০১৪-এর এপ্রিল মাস থেকে আমরা মসলিন নিয়ে গবেষণা শুরু করি। প্রথমেই চার-পাঁচজনের একটি ছোট দল গঠন করি। তারপর সবাই মিলে উপস্থিত তথ্যগুলো এক জায়গায় এনে কাজ ভাগ করে নিই। এই সাংগঠনিক কাজ করে আমরা চলে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। সেখানকার তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শরিফউদ্দীন বললেন, যে প্রশ্নগুলো আমি করছি, সে ব্যাপারে আমার আরও অনেক পড়াশোনা করা উচিত। কিছু বইয়ের খোঁজ তিনি দিলেন। সংগ্রহ করে দিলেন জেমস টেলরের একটি বই ‘আ স্কেচ অব দ্য টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ঢাকা’ (১৮৪০)। তাঁর কথাতেই এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমিতে গেলাম। বাংলা একাডেমিতে গিয়ে দেখি, তারা জামদানির ওপর অনেক গবেষণা করছে। বাংলাদেশ ক্র্যাফটস কাউন্সিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ড. ইফতেখার ইকবালের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ সম্পন্ন করেছে। সেখানে জামদানি ও মসলিন সম্পর্কে সুন্দরভাবে অনেক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় সহায়তা করেছে।তখন ক্র্যাফটস কাউন্সিলের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। প্রথমে কথা বলি ড. হামিদা হোসেনের সঙ্গে। হামিদা আপার বই ‘দ্য কোম্পানি উইভারস অব বেঙ্গল ১৭৫০-১৮১৩’ (তাঁর পিএইচডি থিসিসের অংশ) আমাকে ২০০ বছর আগের তাঁতের জগৎ সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা দেয়। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল করিমের বই ‘ঢাকাই মসলিন’ পড়ে দেখলাম। বইটি অত্যন্ত তথ্যবহুল। মসলিনের ওপর এত তথ্য আছে, এটা আমার জানা ছিল না। আর কী কী তথ্য থাকতে পারে-এখন সেটি আমাকে খুঁজে দেখতে হবে। ক্র্যাফটস কাউন্সিলের রুবি গজনবী জামদানি ও নীল চাষ নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। চন্দ্র শেখর সাহা বুনন নিয়ে মাঠে কাজ করছিলেন। টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির স্থাপন করেছেন মুনিরা ইমদাদ। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে, বাংলাদেশে মসলিন সম্পর্কে কতটুকু তথ্য আছে, তার একটা ধারণা পেলাম। তারপর যাই জাতীয় জাদুঘরের লাইব্রেরিতে। সেখানে রাখা দুটি মসলিনের কাপড় দেখার সুযোগ হলো। কথা বললাম সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। খোঁজ করি ইউনেসকোতেও।
সবার সঙ্গে কথা বলে, বই পড়ে দেখলাম, মসলিনের তুলা ছিল অন্য তুলা থেকে ভিন্ন। সেই তুলাগাছ আবার কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় জন্মাত। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে গেলাম। কিন্তু ২৪০ বছরে বাংলাদেশের নদীর গতিপথ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, তাই পারসো, যেখানে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট ম্যাপিং হয়, সেখানেও গেলাম। পুরোনো মানচিত্রগুলো সংগ্রহ করলাম। ইতিহাসের পুরোনো বই ঘাঁটতে হলো।‘সোনারগাঁ একটা শহর, শ্রীপুর থেকে ছয় লীগ দূরে, যেখানে সমগ্র ভারতের সেরা এবং সূক্ষ্মতম কাপড় পাওয়া যায়।’
-র‌্যালফ ফিচ, ইংরেজ ব্যবসায়ী ও পরিব্রাজক, ১৫৫০-১৬১১
মসলিনের প্রাচীন নাম মলমল। আমরা এত দিনে যে তথ্য জোগাড় করেছি বিভিন্ন উৎস থেকে, তাতে বুঝতে পারলাম, যে তুলায় মসলিন হয়, সেই তুলার গাছ এখন আর নেই। কিন্তু চিন্তা করলাম যে বাংলাদেশে সেই নদী তো আছে। বাংলার সেই মাটিও আছে, তাই ২০১৪-এর মে মাসের দিকে আমরা নৌকা নিয়ে গাজীপুরের কাপাসিয়ার থেকে রওনা দিলাম। নদীর ধারে গ্রামগুলোতে থেমে থেমে সেখানকার লোকজনকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই গাছ দেখেছে নাকি, মসলিন সম্পর্কে কিছু শুনেছে নাকি, কিছু মনে আছে নাকি। এই করতে করতে আমরা ময়মনসিংহ পর্যন্ত চলে গেলাম। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। সেখানে তাঁরা যেসব তুলা নিয়ে কাজ করছেন, সেগুলোর নমুনা জোগাড় করলাম। পরের মাসে একইভাবে ঢাকা থেকে বরিশাল পর্যন্ত নৌপথে যেতে হলো। এই পুরো ৫০০ কিলোমিটারের বেশি পথে যেখানেই দেখেছি একটু ভিন্ন তুলার গাছ আছে, সেগুলোর নমুনা সংগ্রহ করেছি।
ঢাকায় ফিরে এসে আমরা তাঁতের কাপড়ের ডিজাইনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বললাম। বিবি রাসেলের বিবি প্রডাকশনস, প্রবর্তনা, সাপুরা, আড়ং—এদের সঙ্গেও আলাপ শুরু হলো। তাদের কাছে কী তথ্য আছে, সেটা জানতে চাইলাম। বেশির ভাগ তথ্য জামদানির বিষয়ে পাওয়া গেল। এরপর আমরা জামদানির যেসব কারিগর আছেন, তাঁদের কাছে গেলাম। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), তাঁত বোর্ড, জামদানিপল্লির অনেক তাঁতির কাছে গেলাম। তাঁতিদের পেছনের ইতিহাস, আগের বংশে কেউ মসলিন বুনেছেন কি না, মসলিন সম্পর্কে কতটুকু তাঁরা জানেন—এসব নিয়ে খোঁজখবর চলতে থাকল।
এরপর ২০১৪-এর মেতে তুলাগাছের খোঁজে আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে পুরস্কার ঘোষণা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে যোগাযোগ করি। কারণ, ছাত্ররা ফিল্ড ট্রিপে গিয়ে বিভিন্ন গাছের খোঁজ করে থাকে।এর ফলে আমরা নানা ধরনের তুলার চারা পেলাম। তবে সেগুলো সঠিক গাছ কি না, বুঝতে পারছিলাম না। তখন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সেই চারা তাদের দিলাম। অনেক আগ্রহ প্রকাশ করল তারা এবং বোর্ডের পাইলট ফার্ম রংপুর ও গাজীপুরে চারাগুলো লাগাল। একই সঙ্গে কিছু চারা দৃকের উদ্যোগে লাগানোর ব্যবস্থা হলো। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে কৃষি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আমাদের এই কার্যক্রম সম্পর্কে খুলে বললাম।
বাংলাদেশে গবেষণার কাজ অক্টোবর মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এত দিনের গবেষণা থেকে বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশের তাঁতিরা বাজারের প্রবল চাপের মধ্যে আছেন। তাঁরা এখন যে জামদানি বুনছেন, যদিও সেটি বিলুপ্ত মসলিনেরই একটি ধারা, কিন্তু তা তৈরি হচ্ছে অনেক মোটা সুতা দিয়ে। এই জামদানি প্রাচীনকালের নকশা ও সূক্ষ্মতা সংরক্ষণ করছে না। মসলিন নিয়ে দেশে যে তথ্যগুলো আছে, তার ভেতরেও বেশ কিছু জায়গায় অস্পষ্টতা আছে, আর প্রকাশিত তথ্যে বাংলাদেশের উল্লেখ ন্যূনতম।
মসলিনের গল্পে বাংলাদেশ নেই!
‘একটা সময় ছিল ঢাকার সাতগাঁও এলাকা থেকে রপ্তানি করা মসলিন কাপড় পরতেন রোমান নারীরা, তখন বাংলার মসলা ও অন্যান্য জিনিসও মিসর হয়ে রোমে পৌঁছাত। এসব বস্তু অত্যন্ত সমাদৃত ছিল এবং প্রচুর দামে বিক্রি হতো।’
-জোয়াখিম জোসেফ আ কাম্পোস, ‘হিস্ট্রি অব দ্য পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল’, ১৮৯৩-১৯৪৫
আমি আবার বিলেতে চলে এলাম। এখানকার কিউ গার্ডেনে যে নমুনাগুলো আছে, সেগুলো দেখার চেষ্টা করলাম আবার। তার জন্য গবেষক হিসেবে কিউ গার্ডেনে আবেদন করতে হলো। অনুমতিও মিলল। ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ব্রিটিশ মিউজিয়াম—সেখানে বসে বসে তাদের কাছে যেসব পুরোনো বই আছে, সেগুলো পড়া শুরু করলাম। স্টেপনি ট্রাস্টের সঙ্গে মসলিনের প্রদর্শনীর জন্য কাজ করেছিলেন ‘ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট’ জাদুঘরের সোনিয়া অ্যাশমোর, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মসলিনের ওপর তাঁর একটি বই আছে। এখানে আরও যেসব জাদুঘর আছে-ব্রাইটন মিউজিয়াম, ন্যাশনাল হেরিটেজ মিউজিয়াম, বাথ মিউজিয়াম, পাউইসকাসল, জেন অস্টিন মিউজিয়াম, ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম—চার-পাঁচ মাস ধরে সব কটিই দেখি আমি।এই পর্যায়ে প্রচুর তথ্য পেয়েছি। সেগুলো সাজানোও আছে। এই তথ্যগুলো থেকে যে গল্প পাওয়া গেল, সেটা লেখা হয়েছে পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। বাংলাদেশের কোনো গল্প সেখানে নেই। কেউ সেখানে আমাদের গল্প তুলে ধরেনি। কিন্তু তাদের গল্পটা চ্যালেঞ্জ করা দরকার। বলা দরকার, এ গাছটি আমাদের ছিল। ব্রিটিশরা অন্য জায়গায় গাছ লাগিয়ে চেষ্টা করেছিল মসলিন তৈরি করতে, কিন্তু পারেনি। মসলিনের মতো সূক্ষ্ম কাপড় ভারতের অল্প কিছু জায়গায়ও হতো, কিন্তু সবচেয়ে ভালো যেটা, যার সুনাম চীন, পারস্য, তুরস্ক, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটা ছিল আমাদের মসলিন, ঢাকায় তৈরি মসলিন।
ভারতে অনেক তাঁত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ হলো। তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য দর্শন শাহ (উইভার্স স্টুডিও), রুবী পাল চৌধুরী (আর্টিসানা), জাসলিন ধামিজ (কারু ইতিহাসবিদ) ও মায়াঙ্ক কাউল (কারু গবেষক)।
গল্পটা পাল্টাতে হলে তাদের তথ্য জেনে আমাদের তথ্যগুলোকে প্রমাণসহ পুনঃস্থাপিত করতে হবে। একই সঙ্গে দেখাতে হবে যে মসলিন বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঠিকই, তবে আমাদের কারিগরদের যে দক্ষতা ছিল, সেটা এখনো আছে। তাহলে এটা চ্যালেঞ্জ হয়ে গেল দুদিক থেকে। একদিকে তত্ত্বীয় জ্ঞানগুলোকে এক জায়গায় করা। অন্যদিকে তাঁতিদের সঙ্গে কাজ করে সূক্ষ্ম সুতা বুননের সামগ্রিক ব্যবস্থার আয়োজন করা। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে আমি দেশে ফিরে আসি। ঠিক করি, দুদিক থেকেই এবার এগোব। একদিকে দেশের তাঁতিদের গল্পটা বুঝিয়ে বলা, অন্যদিকে নতুন করে মসলিন তৈরির চেষ্টা-দুটোই করব আমরা।
এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। ফ্রান্সে একধরনের তথ্য পাওয়া গেল। ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, তুরস্কেও মসলিনের তথ্য আছে। ভাবিনি, সুইজারল্যান্ডে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে, কিন্তু পাওয়া গেল। তা ছাড়া ভারত, যুক্তরাষ্ট্র তো আছেই। মসলিন কত দূর ছড়িয়েছিল এবং কত ধরনের নকল তৈরি করা হয়েছিল-এসব দেশে গিয়ে জানতে পারলাম। মানুষ কতভাবে এর সম্পর্কে লিখেছে, এটাকে ব্যবহার করেছে, এ নিয়ে কত ব্যবসা হয়েছে! একসময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ৭৫ ভাগ মুনাফা এসেছে কেবল মসলিন থেকেই। আবার এই কাপড়ের আদান-প্রদানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছে কত-গল্পের মাধ্যমে, ছবির মাধ্যমে সেগুলো বলা হয়েছে। বুঝতে পারলাম, এটা শুধু বাংলাদেশ আর ব্রিটেনের গল্প না, এটা বিশ্বের গল্প।ভারতকে তখন বিশেষভাবে জানাবোঝার দরকার হলো। কারণ, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে তাঁতি ও সুতা কাটুনিরা ভারতে চলে গেছে। আমি মুর্শিদাবাদ, কালনা, ফুলিয়া, কলকাতা, দিল্লি, জয়পুর—বিভিন্ন জায়গায় গেলাম। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। কলকাতার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেনে যেসব প্রাচীন তুলাগাছের নমুনা ছিল, সেগুলো দেখলাম। সেখানে কিছু পেইন্টিং আছে, মসলিন কাপড় আছে, সেগুলো দেখলাম। আর পেলাম জন ফোর্বস ওয়াটসনের একটা বই দ্য টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অব ইন্ডিয়া, যেখানে মসলিনের অনেকগুলো নমুনার কথা আছে। মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়িতে প্রথম মসলিনের সূক্ষ্ম কাপড় দেখি। আংটির ভেতর দিয়ে সে মসলিন চলে যায়! তারপর দিল্লিতে ন্যাশনাল হ্যান্ডিক্র্যাফটস অ্যান্ড হ্যান্ডলুম মিউজিয়ামে মসলিনের পুরো সংগ্রহটি কয়েক দিন ধরে দেখলাম। কলকাতা আর জয়পুরে মসলিনের ব্যক্তিগত সংগ্রহ আছে, সেখানে প্রাচীনকালের প্রকৃত মসলিন হাতে ধরে দেখার সুযোগ হলো। ৭০০-৮০০ কাউন্টের ঢাকাই মসলিন সেসব। অসাধারণ অভিজ্ঞতা! মসলিনের কাপড়গুলো যেন এ পৃথিবীর জিনিস নয়। এ যেন সুতা নয়, এ যেন আলো! এর আগে বিভিন্ন জাদুঘরে মসলিন কেবল কাচের বাইরে থেকে চোখে দেখেছি, ধরে দেখিনি।
ভারতের সুতা কাটুনিরা এখনকার তুলার ২০০-৩০০-৪০০-৫০০ কাউন্টের সূক্ষ্ম সুতা তৈরি করে এখন। বাংলাদেশে সেটা হয় না। কাউন্ট যত বেশি, সুতা তত সূক্ষ্ম। যা-ই হোক, ভারতে ওই তুলার সঙ্গে দিলাম আমাদের কিছু তুলা, যেগুলো বিভিন্ন গ্রাম থেকে আমরা সংগ্রহ করেছিলাম। তুলা উন্নয়ন বোর্ডে যেগুলো চাষ হচ্ছিল। এগুলো মসলিনের তুলা নয়, আবার সাধারণ তুলার চেয়ে আলাদাও। তবুও সেগুলোকে কাটুনি করতে বলে দিলাম। যে সুতা তারা কাটল, দেশে ফিরে এলাম তা নিয়ে।
তাঁতিদের তৈরি করা
‘স্বীকার করতে হয় ঢাকার “বোনা বাতাস” সবচেয়ে উৎকৃষ্ট।’
-জন ফোর্বস ওয়াটসন, লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত কার্যালয়ের প্রতিবেদক, ১৮২১-১৮৯২মসলিনের গবেষণার চেয়েও কষ্টকর ছিল তাঁতিদের এই কাপড় বুননের জন্য রাজি করানো। প্রথমে মসলিনের গল্প শুনে তারা খুব উৎসাহ দেখাল, কিন্তু সুতা দেখার পর বেঁকে বসল। এত সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে তারা কখনোই কাজ করেনি। আমরা প্রথমে এনেছিলাম ২০০ ও ৩০০ কাউন্টের সুতা। এরা করে কেবল ৬০ কাউন্টের সুতার শাড়ি। তাঁতিরা বলল, এই সুতা তৈরির কাজ, যাকে ‘পাইরি’ করা বলে, সেটাই শেষ করা যাবে না। তাঁত পর্যন্তই নেওয়া যাবে না। তার আগেই ছিঁড়ে যাবে। এরপর আমি অনেকভাবে অনেক তাঁতির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মাত্র ৫-৬ জন টিকল। প্রত্যেকেই কিছুদিন পর ছেড়ে দেয়, আবার ধরে। এভাবে কয়েক মাস চলে গেল। ঠিক করলাম, এদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো যারা, তাদের সব খরচ আমরা দেব। এটা করার পরে তারা চেষ্টা করছিল, কিন্তু হচ্ছিল না।
তারপর আমি আবার কিছু তথ্য পেলাম। মসলিনের সুতা নিয়ে ব্রিটিশ আমলে কিছু কিছু গবেষণা হয়েছিল, সেই গবেষণায় তারা লিখে গেছে, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৈদ্যুতিক প্রভাব সুতার ওপর কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে আমরা আবার তাঁতিদের সঙ্গে বসলাম।
কিন্তু মাত্র একজন তাঁতি, আল আমিন, প্রচণ্ড ধৈর্য ও চেষ্টা দিয়ে লেগে রইলেন। তিনি ধাপে ধাপে এগোচ্ছিলেন। তাঁর কাছে তাঁতের সূক্ষ্ম শানা নেই। শানার ভেতর দিয়ে সুতা কাপড় বোনার জন্য আসে। শানা যত সূক্ষ্ম হবে, কাপড়ও তত সূক্ষ্ম হবে। তারা ব্যবহার করে ১৪০০ মাত্রার শানা, কিন্তু আমরা জানি সবচেয়ে সূক্ষ্ম মসলিন তৈরি হতো ২৫০০ থেকে ৩০০০ মাত্রার শানা দিয়ে। সেই শানার খোঁজে নামলাম আবার। অনেক জায়গায় খুঁজে এক পরিবার পেলাম, যারা সূক্ষ্ম শানা তৈরি করে। আগে তারা বেদে ছিল। তারা প্রথমে বলল, যে বাঁশ দিয়ে এমন শানা করা যায়, তেমন বাঁশই পাওয়া যায় না আজকাল। অনেক খুঁজে সেই বাঁশ জোগাড় করা হলো। প্রথমে ১৮০০ মাত্রার শানা পর্যন্ত করা গেল, এটা করতে তেমন অসুবিধায় পড়তে হয়নি। ২০০০ থেকে ঝামেলা শুরু হলো। ক্রমশ ২০০০-এ গেলাম। তারপর ২৫০০, শেষমেশ ২৮০০-তে পৌঁছাতে পেরেছি।
সেই শানা নিয়ে আবার আল আমিনের সঙ্গে বসলাম। তাঁর ঘরের চাল পাল্টে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হলো। আর্দ্রতা যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে চেষ্টাও করা হলো। একসময় দেখা গেল, সুতা বুনতে গিয়ে যে সমস্যা হয়, তার কিছু কিছু আল আমিন নিজেও সমাধান করতে পারেন। তিনি বোনার কাজ আস্তে আস্তে করে যাচ্ছিলেন।
এর পাশাপাশি আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিয়েছি। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর খুব উৎসাহিত করলেন। তিনি জাতীয় জাদুঘরের সঙ্গে কাজ করার জন্য যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। আরও বললেন, যদি মসলিন সম্পর্কে আমরা নতুন যা জানলাম, সেটা মানুষকে জানানো যায়, সঙ্গে মসলিন তৈরির পদ্ধতি যদি ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে একটি প্রদর্শনী হতে পারে। মসলিনের গল্পটা মানুষকে নতুন করে বলা গেলে, মানুষকে মসলিন সম্পর্কে জানাতে পারলে, দেখাতে পারলে খুব ভালো হবে। এরপর আড়ংয়ের সঙ্গে আলাপ করলাম। আমাদের লক্ষ্য হয়ে গেল জানা থেকে বলা ও করা। তখন বই প্রকাশ, মসলিন প্রদর্শনী, একটি সাংস্কৃতিক ও মসলিনভিত্তিক ফ্যাশন শো, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ, কর্মশালা ও সেমিনার করার পরিকল্পনা নিলাম। এটা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের কথা। সিদ্ধান্ত নিলাম, এই বছরের বাকি সময়ের মধ্যে সবগুলো কাজ করে ফেলব।আমরা কিন্তু উৎসাহ পেলাম বিলেতে এসে। যখন আমাদের গল্প নিয়ে ব্রিটেনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিউ গার্ডেনে ও এখানকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম, বেশ সাড়া পেলাম। তারা আমাদের বই দেখে, প্রদর্শনী দেখে, রোজমেরি, সোনিয়াদের সঙ্গে কথা বলার পর সাহায্য করতে এগিয়ে এল। আমাদের তথ্যগুলো দেখে নিশ্চিত হলো যে এগুলোর যথার্থতা আছে। তাই তারা সরাসরি মসলিন নিয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার গবেষণা শুরু করে দিয়েছে। অনতিবিলম্বে আমাদের সেটা করা উচিত।
আদি মসলিনের কাছাকাছি
‘ভারতীয়রা সোনার কাজ করা উৎকৃষ্ট মানের মসলিনের কাপড় পরত, কতগুলোতে ভরা ফুলের নকশা ছিল।’
-মেগাস্থিনিস, গ্রিক ঐতিহাসিক, ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দরবারের প্রতিনিধি, খ্রিষ্টাব্দ ৩৫০-২৯০
মসলিনের আদি গাছের নাম ছিল ফুটি কার্পাস, বৈজ্ঞানিক নাম ‘গসিপিয়াম আরবোরিয়াম ভার নেগলেক্টা’ (Gossypium Arboreum Var Neglecta)। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটিশরা কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান বসিয়েছিল। যেমন ভারতের নাগপুরে সে দেশের সবচেয়ে বড় তুলা উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে এ ধরনের তুলারই প্রায় ১৯০০ প্রজাতি আছে। আমরা দুই জায়গা থেকে এই তুলার কতগুলো প্রজাতি আনলাম। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে যে বীজগুলো বেছে এনেছিলাম, সেগুলোর কিছু নিলাম। গবেষণার একপর্যায়ে এসে একটি প্রজাতিতে দেখা গেল, আদি মসলিনের কাছাকাছি একটি জাতের সন্ধান আমরা পেয়ে গেছি। আদি মসলিনের গাছ ফুটি কার্পাসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। এক. সাধারণ তুলাগাছে পাতার আঙুল তিনটি, ফুটি কার্পাসের পাঁচটি। দুই. গাছের কাণ্ড লালচে হয়। তিন. গাছের উচ্চতা সাধারণ তুলাগাছের মতো নয়, একটু কম। চার. তুলা খুব বেশি হয় না ও পুরো ফুটে যাওয়ার পর নিচের দিকে মুখ করে থাকে (এখনকার বেশির ভাগ তুলা সাধারণত ওপরের দিকে মুখ করে থাকে), ফলে মসলিনের তুলা বৃষ্টিতে নষ্ট হয় না। পাঁচ. বছরে দুবার ফসল দেয় এ তুলাগাছ। এসব বৈশিষ্টে্যর খুব কাছাকাছি মিলে গেল আমাদের নতুন গাছের জাতটা।আমাদের মাথায় ছিল, তুলা উন্নয়ন বোর্ডে গাছগুলো লাগালে সেখান থেকে ফল না-ও আসতে পারে। কারণ ফুটি কার্পাস লাগানো হতো মেঘনা, শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে। আর মসলিন সুতা দিয়ে কাপড় বোনার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি তুলা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই নতুন জাতের ফুটি কার্পাসের তিন ধরনের প্রজাতির চারা আমরা শীতলক্ষ্যা নদীর ধারের জমিতে লাগালাম। ঠিক প্রাচীনকালে যে পদ্ধতিতে মসলিনের চাষ হতো, সেভাবে। আমাদের মাথায় এও ছিল, প্রায় ২০০ বছর আগে যখন মসলিন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তখনকার পরিবেশ এখন তো আর নেই। তাই একেবারে আদি মসলিনের তুলা ফিরে পাওয়া হয়তো কখনোই যাবে না। কিন্তু তার কাছাকাছি তো আমরা যেতে পারি।
মসলিনের তুলা চাষের পদ্ধতি অনুযায়ী প্রাকৃতিকভাবে তুলার চাষ হলো। সেখান থেকে তুলা ও পাতা নিয়ে আমরা আবার বিলেতে চলে এলাম ডিএনএ বিশ্লেষণের জন্য। এখানে কিউ গার্ডেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও দৃকের যৌথ উদ্যোগে মসলিন নিয়ে নতুন পর্যায়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে এটি। গসিপিয়াম আরবোরিয়াম ভার নেগলেক্টার নামে কিউ গার্ডেনে মসলিনের তুলার কয়েকটি ধারা আছে। সেগুলোর ডিএনএর সঙ্গে আদি মসলিনের কাছাকাছি নতুন যে তুলা পেয়েছি আমরা, তার নমুনার তুলনা করা হচ্ছে এখন। একেবারে কোষের পারমাণবিক পর্যায় থেকে-ফাইবার লেংথ, ফাইবার টুইস্ট, ফাইবার স্ট্রেংথ কী রকম, সেগুলো দেখা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন নামকরা অধ্যাপকের অধীনে পুরো কাজটি শুরু হয় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অনিবার্য কারণে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপকের নাম প্রকাশ করছি না। মে মাসে প্রথম পরীক্ষার ফলাফলে আমরা দেখলাম, দুই তুলার মধ্যে মিল আছে শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ। এই পরীক্ষাটা আরও কয়েকবার হবে। এটিই গবেষণার প্রথম পর্যায়।
ফুটি কার্পাসের আরও প্রায় ৯-১০টি প্রজাতি আছে। সেগুলোর সব নিয়ে গভীরভাবে এই গবেষণার দ্বিতীয় পর্যায় আমরা শুরু করব। এ পর্যায়ে কিউ গার্ডেন থেকে সংগৃহীত ৯-১০টি নমুনা, কলকাতা থেকে সংগৃহীত ৫-৬টি প্রাচীন নমুনা এবং বাংলাদেশের তুলার ধরনগুলো পরীক্ষা করে দেখা হবে। এটা আগামী আগস্ট নাগাদ শুরু হবে। এ ব্যাপারে যে অর্থ লাগছে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ই দিচ্ছে। কিউ গার্ডেন সহায়তা করছে। দৃক তাদের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। বাংলাদেশের তুলা উন্নয়ন বোর্ড ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ রাখছি। আমরা চাইছি, আমাদের মসলিনের যে গল্প, সেটা যেন একটি বাস্তব রূপ পায়। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পায়। ঠিক যেমন আমাদের তাঁতিরা আদি মসলিন না হলেও, বুননের দিক থেকে মসলিনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তেমনি গাছটাও যেন আদি ফুটি কার্পাসের কাছাকাছি চলে যেতে পারে, আমরা সে চেষ্টাই করছি।তা ছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া থেকেও আমাদের বইটি নিয়ে নানা আলোচনা ও কথাবার্তা চলছে। আমরা আমাদের বানানো মসলিনকে বলছি ‘নতুন মসলিন’। আমরা আগের তুলা থেকেই ভারতে সূক্ষ্ম সুতা বানাচ্ছি। উৎসবে আমরা ২০০ ও ৩০০ কাউন্টের দুটি মসলিন শাড়ি উপস্থাপন করেছিলাম। এরপর ২৫০ ও ৩০০ কাউন্টের আরও কিছু মসলিন বানিয়েছি। সবশেষ বানিয়েছি ৩৫০ কাউন্টের মসলিন শাড়ি। সেটি চলে গেছে বছরব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীটি হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারের হুইটওর্থ গ্যালারিতে। শুরু হয় ২০১৭ সালের ২০ মে, শেষ হবে ২০১৮ সালে ৩ জুন। সঙ্গে থাকছে মসলিন নিয়ে বাংলাদেশের গল্পটি, বই ও আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের একটি বিবরণ। আমাদের পরিকল্পনায় আরও অনেক কিছু করার আছে এ নিয়ে। আমাদের এই পুরো মসলিন যাত্রা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শেষ হয়েছে। এটাকেও বিভিন্ন জায়গায় দেখাতে চাই।
এখন আমরা নতুন মসলিনের তুলা থেকে সুতা কাটুনির পর্যায়ে চলে যেতে চাই। নদীর ধারে ছোট আকারে প্রাকৃতিকভাবে তুলা চাষের চেষ্টা করছি। যদি ইতিবাচক কিছু পাই, তাহলে আমরা আরও বড় আকারে চাষের কথা ভাবব। প্রচুর পরিমাণে তুলা আমাদের প্রয়োজন হবে, যদি এটা থেকে কিছু বানানোর কথা ভাবি। শেষমেশ কী হবে, আশা করি, সেটা নির্ভর করবে সরকারি ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ওপর।
আমরা জোর দিচ্ছি তাঁতিদের দক্ষতা তৈরিতেও। তাঁদের হাত পাকা না করলে মসলিনের কাছাকাছি তুলা পাওয়া গেলেও কোনো লাভ হবে না। মসলিন উৎসবের জন্য মাত্র একজন তাঁতি, আল আমিন ২০০ ও ৩০০ কাউন্টের দুটি শাড়ি তৈরি করেছিলেন। তিনি সর্বশেষ ৩৫০ কাউন্টের শাড়িটি করেছেন। এখন ২০০ কাউন্টের শাড়ি বুনতে পারেন, এমন আরও ৬ জন তাঁতি আছেন। আল আমিনকে দেখে তাঁরা উৎসাহিত হয়েছেন।মসলিনের জিআই-স্বত্ব (জিওগ্রাফিকাল ইনডিকেশন) দাবিও আমাদের মাথায় আছে। এ ক্ষেত্রে ভারত আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। খুবই খুশির খবর, ক্র্যাফটস কাউন্সিলের উদ্যোগে ভারতের সঙ্গে অনেক লড়াই করে জামদানির জিআই-স্বত্ব ইউনেসকো থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে। সরকার প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনও করেছে। আরও ভিন্ন জিনিস নিয়ে সরকার চিন্তা করছে, এটা আশাব্যঞ্জক। মসলিন নিয়ে জানামতে এখনো কেউ আবেদন করেনি। তবে কোনো আবেদন করতে হলে আগে দেখাতে হবে যে বর্তমানে এটার বুনন হচ্ছে। দেখাতে হবে, এটি একটি জীবিত কারুশিল্প। আমাদের কাছে যে পরিমাণ তথ্য আছে, তারপরে এখন মসলিন যদি নিয়মিত উৎপাদনব্যবস্থার ভেতরে চলে আসতে পারে, তাহলে এর জিআই দাবি করা যাবে।
সব যাত্রার শুরু আছে, আবার শেষও আছে। মসলিন ফিরে পাওয়ার পথে অনেক ঘোরপ্যাঁচ থাকলেও আমাদের উদ্দেশ্য অবিচল ছিল। আমরা চেয়েছি, ঔপনিবেশিক ধারাবিবরণী থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের মহৎ কারুশিল্পীদের দক্ষতার গাথা প্রচার করতে। প্রথম পর্যায়ে আমরা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছি মসলিনের সঙ্গে আমাদের দেশ, মানুষ আর মাটির সম্পর্ককে। এরপর আমরা চাই যুগযুগান্তরের সাফল্য একত্র করে মসলিনের পুরোনো ও নতুন নমুনাসহ এর কাহিনি দেশের ভেতরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করতে ।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আমাদের উদ্দেশ্য ত্রিমুখী। এক. এই কিংবদন্তির কাহিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ও আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া (সে কারণেই আমরা শিশুদের জন্য গ্রাফিক বই প্রকাশ করেছি। শিশু একাডেমির কাছে আবেদন করেছি বইটি বিতরণের জন্য)। দুই. মসলিনের তুলাগাছের বিশেষত্ব বৈজ্ঞানিক উপায়ে নির্ধারণ করে বাংলার নদীর ধারে মসলিন তুলার চাষ ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালানো। তিন. আমাদের স্বপ্ন বাংলাদেশে তাঁত বুননের মাত্রা বাড়িয়ে ৪০০-৫০০ কাউন্টের শাড়ি বোনা।
আমাদের কাছে মসলিন-সম্পর্কিত যেসব ঐতিহাসিক তথ্য আছে, সেগুলো জাতীয় জাদুঘরকে দিয়ে দিতে চাই। তবে তার জন্য যথাযথ জায়গা ও একজন পৃষ্ঠপোষক লাগবে। এরপর আমরা মনে করব, আমাদের যাত্রা সফলভাবে শেষ হয়েছে। তখন দৃক আবার নতুন কাজে জড়িত হবে। মসলিনের মশাল হস্তান্তর হবে।
এই পর্যায়ের যাত্রায় জিআই নিবন্ধনকরণ, মসলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন আর নতুন গবেষণার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে এবং দেশের কারুশিল্প সংস্থাগুলোকে। দৃকে ধারণকৃত সব জ্ঞানভান্ডার, পদ্ধতিবিদ্যা এবং সহায়তা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মোচিত থাকবে।‘উপমহাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে বোনা কাপড় মসলিন।’
-আবুল হাসান ইয়ামিন-উদ-দিন খুসরাও, চতুর্দশ শতকের ভারতীয় সুফি কবি ও পণ্ডিত, ১২৫৩-১৩২৫
মসলিন হারিয়ে যাওয়ার পর এখন আমরা সেটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের এমন অনেক সম্পদ আমাদের এখনো আছে, যেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। একবার হারিয়ে গেলে সেটাকে ফিরিয়ে আনা যে কত কষ্টের কাজ, সেটা মসলিন দিয়েই আমরা বুঝতে পারি। তাই বিলুপ্তপ্রায় সম্পদগুলো সংরক্ষণ করা, ধরে রাখার জোরদার চেষ্টা করা দরকার এখন। আমাদের জিডিপি ৭ বা ৮ ভাগ, এর ভেতরে কিন্তু আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ব্যাপারগুলো নেই। আমাদের তৈরি পোশাক কারখানা অনেক টাকা আয় করছে, এটা কিন্তু বিশ্বে আমাদের কোনো পরিচয় তৈরি করছে না। বিদেশের অনেকে বলে, দেশটা তো একটা দরজির কারখানা। আমরা আমাদের পরিচয় পাই রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন-জয়নুল-কামরুল থেকে, আমাদের নাটক থেকে, জামদানি থেকে। এ ব্যাপারগুলোকে, যেগুলোকে ইউনেসকো বলে ইনট্যানজিবল হেরিটেজ, এর মূল্য সবাই মিলে ধরে রাখা উচিত।
বিদেশে এমন অনেক জাদুঘর আছে, যার উদ্যোক্তা ছিলেন বড় বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসার বাইরে তাঁরা জাদুঘরগুলো করেছেন। আমাদের দেশে তৈরি পোশাক কারখানার সমিতিগুলোয় যাঁরা আছেন, তাঁরা হাতের এই কারুশিল্পকে কেন যেন আধুনিক ভাবেন না। এখানে যেহেতু যন্ত্রের ব্যাপার নেই, তাই যেন এটা প্রযুক্তি নয়, আধুনিক নয়। কিন্তু দুটোকে মিলিয়ে একটা কিছু করা, এটা এখনো হচ্ছে না। বাইরের দেশগুলোতে মানুষ নিজেদের পরিচয় নির্মাণ করে, মসলিনের মতো তাদের এমন ঐতিহ্যকে কীভাবে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরে, আমরা দেখেছি। একটি উন্নত জাতি নির্মাণের পথে আমরা যেহেতু আছি, সে ক্ষেত্রে আমাদেরও আত্মপরিচয় নির্মাণ করার সময় এসে গেছে। আমাদের মনে রাখা উচিত, মসলিন শুধু কিংবদন্তির কাপড় নয়, এটা কিংবদন্তি সৃষ্টিকারী বাংলাদেশের মানুষের প্রতীক।

#সাইফুল ভাই।

শনিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৮

কালাপাহাড়


   কালাপাহাড়


   শেয়ার করেছেন              প্রণব কুমার কুণ্ডু।

কালাপাহাড়
------------
মুর্শিদকুলি খাঁর মতই ব্রাহ্মণকুলে জন্ম হয়েছিল কালাচাঁদ রায়ের। একটাকিয়ার জমিদার বংশে। মাতৃকুল ছিল পরম বৈষ্ণব।
সংস্কৃত শাস্ত্রে পণ্ডিত, অস্ত্রবিদ্যায় বীরোচিত গুণের অধিকারী।
গৌড় বাদশাহের দরবারে রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছিল কালাচাঁদ। আর প্রাসাদ-সংলগ্ন বাসভবন থেকে প্রতিদিন মহানন্দায় স্নান করতে যাবার সময় নবাবকন্যা দুলারী অপেক্ষা করত সুদর্শন সুপুরুষ ব্রাহ্মণ যুবকের দর্শন পাবার আশায়।
বলিষ্ঠ রূপবান চেহারা, গলায় উপবীত, হাতে স্বর্ণময় কোষা, সুকন্ঠে সঙ্গীতস্তোত্র। পিছনে চলত ছাতাবরদার।
বাদশাহ এবং বেগম বুঝলেন, এই হিন্দু যুবকের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একমাত্র কন্যাকে অসুখী করতে চাননি তাঁরা। তাই কালাচাঁদ রায়কে বললেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দুলারীর পাণিগ্রহণ করো।
কালাচাঁদ অসম্মত হল।
বাদশাহ ক্রোধান্ধ হয়ে তাকে হত্যা করার আদেশ দিলেন।
জল্লাদ এগিয়ে এল কর্তব্যপালনের জন্যে।
আর সেই মুহুর্তে সপ্তদশী নবাবকন্যা মর্মর জাফরির আড়াল থেকে ছুটে এসে বললে, আগে আমায় হত্যা করো, তারপর আমার স্বামীর অঙ্গ স্পর্শ করবে।
মুগ্ধ হল কালাচাঁদ। বিস্মিত হল রূপবতী যবনীর দুঃসাহস দেখে।
দুলারীকে বিবাহ করতে সম্মত হল। কিন্তু ধর্মত্যাগ করতে নয়। মুসলমানীকে বিবাহ করলেই বিধর্মী হতে হবে কেন, এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেল না কালাচাঁদ। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ধর্না দিল, দেবতার প্রত্যাদেশ জানবার জন্যে। শ্রীমন্দিরের পুরোহিতকুল, কালাচাঁদের আত্মীয়-স্বজন সকলেই অপমানিত করল তাকে। সমাজপতিরা বললে মুসলমানীকে বিবাহ করে ধর্মত্যাগী হয়েছে কালাচাঁদ।
সামাজিক অনুশাসনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কালাচাঁদ একদিন নিজেই অত্যাচারী হয়ে উঠল। প্রতিজ্ঞা করল, ভারতবর্ষ থেকে হিন্দুধর্মের উচ্ছেদ সাধন করবে।
স্বেচ্ছায় এবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল সে, নামকরণ হল মহম্মদ ফরমুলি।
হিন্দু ভারত কেঁপে উঠল কালাপাহাড়ের নামে।
জগন্নাথের প্রত্যাদেশ জানবার জন্যে একদিন পূরীধামে ধর্না দিতে গিয়ে অপমানীত হয়েছিল কালাচাঁদ। তাই শাহি ফৌজের অধিনায়ক হয়ে প্রথমেই উৎকল ধ্বংস করতে এগিয়ে গেল কালাপাহাড়। দেবমূর্তি অপবিত্র করল, বলপ্রয়োগে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করল হিন্দু প্রজাদের। হিন্দু নারীর সতীত্ব আর কৌমার্যের অহংকার টলে পড়ল লালসামত্ত শাহি ফৌজের আক্রমণে।
বনাগ্নির মতই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তাদের অত্যাচার। অভিযানের পর অভিযান। মুসলমান সমাজও শঙ্কিত হল, ব্যাথায় কাতর হল হিন্দুর প্রতি কালাপাহাড়ের অত্যাচার দেখে।
কালাপাহাড়ের শাহি সৈন্য শুধু দেবমূর্তিই নয়, নারীলাঞ্ছনাতেও তৎপর হয়ে উঠল। হিন্দু নারীর ধর্ম বিনষ্ট করার উৎসাহে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠল শাহি ফৌজ।
মন্দিরের পর মন্দির ধ্বংস করে অত্যাচারের আগুন জ্বালিয়ে বারাণসীতে পৌঁছল কালাপাহাড়। একটির পর একটি প্রাচীন দেবমন্দির ধ্বংস করে শেষে বারাণসীর কেদারেশ্বর-লিঙ্গ অপবিত্র করার নির্দেশ দিল।
বিধর্মীর চিৎকার তুলে ছুটে গেল সৈন্যরা।
এমন সময় রোরুদ্যমানা বৈধব্যের রূপ নিয়ে কালাপাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়াল এক শুভ্রবাস বিধবা রমনী ! কালাচাঁদ রায়ের মাতুলানী।
শ্বেতবসনা কাসিবাসিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল দেবদ্রোহী কালাচাঁদ। মনে পড়ল, এই মাতুলানীর স্নেহ আর মমতায় শৈশব কাটিয়েছে সে, মাতৃত্বে লালন করেছে তাকে এই বিধবা শুচিতা।
শুনল কালাচাঁদ। তারই লালসামত্ত সৈন্যের দল বিধবার ধর্ম বিনষ্ট করেছে।
অবলা এক নারীর উন্মাদ এক হতাশার দৃষ্টিতে বিবেক ফিরে পেল কালাপাহাড়। তার চোখের সামনে বিষপান করে অভিশাপ দিতে দিতে মৃত্যুবরণ করল বিধবা।
অনুশোচনা দেখা দিল তার মনে। অত্যাচার বন্ধ করার নির্দেশ দিল কালাপাহাড়। রক্ষা পেল কেদারেশ্বর-লিঙ্গ, রক্ষা পেল হিন্দু ধর্ম।
আর কালাপাহাড় ??
পরদিন প্রত্যূষে শাহিরক্ষীর দল খুঁজে পেল না কালাপাহাড়কে। তন্নতন্ন করে, চতুর্দিকে তল্লাসি পাঠিয়েও হদিস মিলল না।
হয়ত সন্ন্যাসী হয়েই হিমালয়ের কোনও অজ্ঞাত গুহায় প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টায় লোকচক্ষুর আড়ালেই মৃত্যু হল তার, হয়ত বা গঙ্গাগর্ভে আত্মহত্যা করল অনুশোচনায়।
কালাপাহাড়ের প্রকৃত ইতিহাস কেউই জানে না। গ্রাম্য কিম্বদন্তীর মধ্যেই তা আবদ্ধ হয়ে আছে।
----- রমাপদ চৌধুরী (লালবাঈ)



রাহুল দেববর্মণ


   রাহুল দেববর্মণ

   শেয়ার করেছেন                   প্রণব কুমার কুণ্ডু
সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার
রাহুল দেববর্মণ (জন্মঃ- জুন ২৭, ১৯৩৯ -মৃত্যুঃ- জানুয়ারি ৪, ১৯৯৪)
জানুয়ারি ৩, ১৯৯৪। নতুন একটা ছবির ক্লাইম্যাক্স নিয়ে উত্তেজনায় সন্ধেটা ভরপুর। প্রোডিউসার ডিরেক্টরের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা ধরে মিটিং। এ বার বেরোতে হবে, সান্তাক্রুজে শক্তি সামন্তের বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন। সাড়ে ন’টা নাগাদ প্রোডিউসার বেরিয়ে গেলেন। এ বার বাড়ির মানুষটিও বেরোনর পালা। ক্যালেণ্ডারের পাতায় দিন বদলে হল ৪ জানুয়ারি। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরলেন মানুষটি। দারোয়ানকে পঞ্চাশ টাকা বকশিস দিলেন গাড়িটা একটু পার্ক করে দেওয়ার জন্যে, বোধ হয় শরীরটা ঠিক লাগছিল না। রোজকার মতো ঘরের ৪০ ইঞ্চি টিভিটায় বিবিসি দেখতে বসলেন। কিন্তু শরীরটা কেমন করছে। কাউকে ডাকা দরকার। রাত আড়াইটায় ঘরের বেলটা বেজে উঠল। ছুটে এল কাজের লোকেরা। তিনি শুয়ে আছেন, জিভ বেরিয়ে গিয়েছে। কাজের লোক, কাছের লোক সুদাম চটপট মুখে সরবিট্রেট স্প্রে করে দিলেন। ড্রাইভার রমেশ অ্যাম্বুল্যান্স ডাকলেন। সেক্রেটারি ভারত এক জন ডাক্তার নিয়ে এলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ করলেন। অ্যাম্বুল্যান্স এসে গেল তিনটে চল্লিশে।
শচীন দেববর্মন আর মীরা দেববর্মনের ঘরে জন্ম হয়েছিল এক ছেলের। তখন তার ডাক নাম ঠিক হল টুবলু। পঞ্চম নামটা তার হবে আরও কিছু দিন পরে। সে নাকি সব সময়েই কাঁদত পঞ্চম স্বরে। আর একটা গল্পও আছে। বাবা ‘সা’ গাইলেই ছেলে নাকি ‘পা’ গাইত। তাই অশোককুমার তার এই নামটা দিয়েছিলেন। পঞ্চমের কেরিয়ারের প্রথম দিকে পাঁচ সংখ্যাটা কিন্তু সত্যি লাকিও হয়েছিল। ‘তিসরি মঞ্জিল’ (১৯৬৬) ছিল তাঁর সুর করা পঞ্চম ছবি।
ছবি হবে ‘তিসরি মঞ্জিল’। শাম্মি কপূরের পছন্দের সুরকার শঙ্কর জয়কিষাণ এবং ও পি নায়ার। শাম্মি এলেন শুনে দেখতে ‘আর ডি’ ব্যাপারটা কী। প্রথম বলটাই ওয়াইড। পঞ্চম সবে একটা নেপালি সুর গেয়েছেন, (যে সুর থেকে পরে তৈরি হবে ‘দিওয়ানা মুঝসে নহী’)
শাম্মি বললেন, ‘স্টপ স্টপ’। এটা আমি জয়কিষাণকে দিয়ে করিয়ে নেব, আর একটা কুছ সুনাও। নার্ভাস পঞ্চম বাইরে গিয়ে সিগারেটে দুটো টান দিয়ে এলেন। এসে গাইলেন পর পর তিনটে সুর, ‘ও মেরে সোনা...’, ‘আ যা আ যা...’ এবং ‘ও হাসিনা জুলফোঁ ওয়ালি...’-র গান তিনটের জন্যে। আবার শাম্মি দুম করে থামিয়ে দিলেন তাঁকে। বললেন, আরে তুম পাস হো গয়ে হো। আহা কী গান ‘ও হাসিনা জুলফোঁ ওয়ালি...’! আর এই সব গান তৈরিই তো পঞ্চমের জীবন।
আর ডি’র গানের পেছনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন তাঁর দলের সঙ্গীরা, যেমন কারসি লর্ড, মনোহারি সিংহ, ভানু গুপ্তা আর আরও অনেকে। আর ডি’র সঙ্গীতের মূল ব্যাপারটাই ছিল নিয়ম ভাঙা এক প্রাণের স্পন্দন। ‘ও হাসিনা...’র কথা ধরুন, ৮০ জন শিল্পীকে ব্যবহার করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৪০ জন বাজিয়েছিলেন বেহালা। আজকের দিনের মতো ট্র্যাকের কারিগরি ছিল না। একসঙ্গে এতগুলো বাদককে ব্যবহার করা, কী কাণ্ড! শুধু কী বাদ্যযন্ত্র। মোটর গাড়ির ইঞ্জিন, পেডেস্টাল পাখা, কী না চলবে তাঁর গানে। তৈরি হবে জাদু।
বীর সাংভি একটি লেখায় বলেছিলেন যে, দুনিয়া জুড়ে ষাটের দশককে যৌবনের দশক বলে বাড়াবাড়ি করা হয়। ভারতে কিন্তু যৌবনের দশক বলতে সত্তরের দশক। আর সত্তরের দশক মানেই পঞ্চমের দশক।
ফিয়াট গাড়িতে বসে থাকা তিন জন পুরুষই মহিলাটিকে লক্ষ করল। হাল্কা নীল শাড়ি, সানগ্লাস, খোঁপায় ফুল আর হাতে সাদা ব্যাগ। মুম্বইয়ের কোলাবা কজওয়ের রিগ্যাল সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ফোনে তো সেই রকমই কথা হয়েছিল। দু’জন পুরুষ টুক করে গাড়ি থেকে নেমে হাওয়া। তৃতীয় জন গাড়িটা বেসমেন্টে পার্ক করে এগিয়ে গেলেন মহিলার দিকে। কিছু কথা হল, তার পর দু’জনে ঢুকে গেলেন হলে। হলে যে ছবিটা চলছিল তার নাম ‘গোল্ড ফিঙ্গার’। জেমস বণ্ডের ছবি। ছবির আগে বিজ্ঞাপন চলছিল। তখনই মহিলা হঠাৎ হল থেকে উঠে বেরিয়ে গেলেন আর ফিরে এলেন না।
গল্পটা এ বার খুলে বলা দরকার। পুরুষ তিন হলেন, পঞ্চম, শচীন ভৌমিক আর মনোহারি সিংহ। ক’দিন আগেই পঞ্চম লক্ষ্মীকান্ত আর প্যারেলালের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে বম্বের কিছু কলেজ ছাত্রীরাও ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। তাদের এক জন এসে পঞ্চমের অটোগ্রাফ চায় ও পায়। বম্বেতে ফিরে সে পঞ্চমকে ফোন করে বলে সে-ই সেই অটোগ্রাফ শিকারি, পঞ্চম কি তার সঙ্গে ‘গোল্ড ফিঙ্গার’ দেখতে যাবেন? হলের বাইরে মেয়েটি নিজের নাম বলেছিল রীতা পটেল। তার পর এই কাণ্ড!
ছবির বণ্ডের মতোই পঞ্চম ও তাঁর বন্ধুরা লেগে পড়লেন রীতার সন্ধানে। মেয়েটি অ্যাম্বাসাডার চালিয়ে এসেছিল। তখন বম্বেতে ফিয়াটের রাজত্ব। এ ছাড়াও সে বলেছিল, সে নির্মলা নিকেতন নামে চার্চ গেটের একটা হোম সায়েন্স কলেজে আসে। জায়গাটা পঞ্চমের ভালই চেনা, কারণ তাঁর ফেভারিট ‘গে লর্ড’ রেস্তোরাঁটা ওর কাছেই।
ধরা পড়লেন রীতা। জানা গেল, রাহুল দেববর্মনকে সিনেমা হলে টেনে আনবেন, এই বেট জিতে যাওয়ার পর (হলের আনাচেকানাচে বন্ধুরা ছিল) তিনি চলে যান। কিন্তু চলে গেলেই তো হবে না। আবার ধরা পড়তে কতক্ষণ! জমে উঠল প্রেম। আর কয়েক মাস পরে মালাবার হিলস-এ এক বন্ধুর বাড়িতে গোপনে বিয়েও হয়ে গেল দু’জনের। বিয়েটা সুখের হয়নি। শচীনকর্তা বউমাকে মেনে নিলেও শোনা যায় শাশুড়ির সঙ্গে জমেনি রীতার।
কিন্তু এর খুঁটিনাটি তো আর পাঁচটা জীবনের মতো। এই জীবনের কান্না হাসিগুলোকে ‘হাম বেওয়াফা হরগিজ ন থে’ করে তুলতে পারেন ক’জন? ক’জন আমাদের বুকের মধ্যে বাজাতে পারেন ‘এ কেয়া হুয়া ক্যায়সে হুয়া, কব হুয়া’? আবার অ্যারেঞ্জমেন্টে পুরে দিতে পারেন আনন্দের সুর— সব ছক ভেঙে। জীবনে সুখ আর দুঃখ মেশামেশি— তাকে ও ভাবে আলাদা করা যায় না— এই আশ্চর্য বোধকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন প্রাণভাসি বানভাসি সুরের কাঠামোয়?
সত্তর জুড়ে শুধুই যেন পঞ্চম। সেই সময়টা যে কী দারুণ সময় তাঁর সুরের সঙ্গীদের। এই সময় কোনও এক জ্যোতিষী রাহুলকে বলেছিলেন, গান না গুনতে, কাজ না গুনতে। তাই তিনি শুধু গুনগুনই করে গিয়েছেন, যোগ-বিয়োগ-ভাগ করেননি কখনও। তাঁর এই সময়কার সুরের এক সঙ্গী এই সময়টার কথা মনে করতে গিয়ে বলেন, তখন আমরা দিন নেই, রাত নেই শুধু সুর নিয়ে আছি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না ক’টা গান রেকডিং হল, ক’টা বাকি। শুধু একটা পাগলামো থেকে আর একটাতে ছুটে চলা। একটা চ্যালেঞ্জ পার করে আর একটা। সে যে কী সময় গিয়েছে! অনেক দিন পরে, ১৯৮৫-র পর যখন শুকিয়ে আসবে কাজের ধারা, কাছের বন্ধুরাও ছেড়ে চলে যাবেন তাঁকে, তখন অনেক দুঃখে একটা হিসেব করবেন রাহুল। বলবেন, পর পর ২৯টা ফ্লপ গেছে আমার। একটা সময় ছিল, যখন আমার সন্ধ্যা শুরু হত মধ্য রাতে। শেষ হত সকালে গিয়ে। বাইরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত প্রোডিউসারদের গাড়ি। এখন সন্ধ্যা শুরু হয় সূর্য ডুবতে ডুবতেই, শেষও হয়ে যায় তখনই। বাড়ির বাইরে আর গাড়ির ভিড় থাকে না। কিন্তু সে কথা তো তিনি আগেই জানতেন, নইলে কী করে সুর দিয়েছিলেন সেই গানে, ‘জিন্দেগি কি সফর মে গুজর যাতে হ্যায় জো মকান ও ফির নাহি আতে...’। প্রোডিউসারদের গাড়ি না থাক, আমরা তো থেকে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে। এখনও তো ভালবাসায় ‘করবটে বদলতে রহে সারে রাত হম। আপ কী কসম। আপ কী কসম।’
১৯৬৫। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ। নতুন দুটো দেশই ১৮ বছরের হল। ঘরের ছেলেরা যুদ্ধে গেছে, ও দিকে কাশ ফুটছে, চালচিত্রে ফুটে উঠছে ছবি। রথের দিনে মাটি পড়ছে খড়ে। পুজোর তিন সপ্তাহ আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হল, সৈনিকরা ফিরল ঘরে। বাংলায় সে বার পুজোর গানে এলেন আর ডি বর্মন। কিন্তু তেমন কিছু হল না। এর পর ১৯৬৭-তে এল ‘এক দিন পাখি উড়ে’, ‘আকাশ কেন ডাকে’ আর তার পর ‘মনে পড়ে রুবি রায়’। মনে রাখতে হবে, এই সময়ের কলকাতা খাদ্য আন্দোলনের কলকাতা, নকশাল আন্দোলনের কলকাতা, কংগ্রেসের বদলে প্রথম যুক্তফ্রন্ট আসার কলকাতা। এই কলকাতার মুড ছিল আলাদা। আর তখনও আর ডি’কে খোলাখুলি গ্রহণ করতে পারেনি বাঙালি। শান্তিনিকেতন, ডোভার লেন আর বামপন্থীদের সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির নানান অনুশাসনের ফাঁকে রাহুলের গান ছিল আর এক ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত। সে নাকি বড় চটুল, বড় পশ্চিমি, বড় অনৈতিক! ভারতীয়দের অনেকের ভারতীয় হয়ে বেড়ে ওঠার আনন্দে যে সামিল হতে পারিনি আমরা বাঙালিরা, যার ফল সব সময় আমাদের পক্ষে ভাল হয়নি, তার একটা লক্ষণ বোধ হয় এই সময় আমাদের রাহুলকে গ্রহণ করার ব্যর্থতার মধ্যে ফুটে উঠেছিল। আমরা যৌবনকে ‘রাজনৈতিক’ করতে গিয়ে বোধ হয় তাঁর বহুমুখী সহজাত দিকগুলোকে অস্বীকার করেছিলাম। যাক গে, সে বিষাদের গল্প আজ থাক। বরং দুটো মজার তথ্য জানা যাক। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ গানটা লিখেছিলেন শচীন ভৌমিক, তিনি নিজের জীবনে ছবি রায় বলে একটি মেয়ের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, কাজেই রুবির আসল নাম ছবি। রেকর্ডটার উল্টো পিঠে ছিল ‘ফিরে এসো অনুরাধা’ গানটি। অনেকেই ভেবেছিলেন দাগ দিয়ে চলে গেল কে এই অনুরাধা? শচীন বলেছেন, অনুরাধা কোনও মেয়ের নাম নয়, তাঁর লেখা প্রথম চিত্রনাট্যটি ছিল ‘অনুরাধা’ নামের ছবিটির জন্য লেখা। তাই এই নামটা বসিয়েছিলেন!
‘কাটি পতঙ্গ’ ছবিতে ‘আকাশ কেন ডাকে’ ফিরে এল ‘ইয়ে শাম মস্তানি’ হয়ে। তার পাশে থাকল ‘ইয়ে জো মহব্বত হ্যায়...’। জানি, আপনারা অনেকেই কাগজ থেকে চোখ তুলে একটু লক্ষ্যহীন ভাবে তাকাচ্ছেন, যেটা আসলে নিজের ভেতর তাকানো, আর সুরগুলো গুনগুন করে নিচ্ছেন এক বার। এটা তো বার বার হতেই থাকে।
বনফুলের ভাই পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় বনফুলের ‘হিংয়ের কচুরি’ গল্প নিয়ে ছবি বানালেন, ‘নিশিপদ্ম’। সুর দিলেন নচিকেতা ঘোষ। ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’ গানের জন্য মান্না দে জিতলেন তাঁর দ্বিতীয় জাতীয় পুরস্কার। শক্তি সামন্ত ছবিটি হিন্দিতে বানাতে চাইলেন— ‘অমর প্রেম’। সুরকার কে? রাহুল দেববর্মন। শক্তি সামন্ত বলেছেন, ছবির কাজ করার সময় পঞ্চম মিউজিক রুমে ঢুকত সকাল ন’টায়, বেরোত রাত ন’টায়। বাবার গলায় শোনা ‘বেলা বয়ে যায়’ গানটি অনুপ্রেরণা জোগালো, ‘রায়না বিত জায়ে’ গানটির। গান শুনে মদনমোহন ফোন করে অভিনন্দন জানালেন শচীন দেবকে। বাবা সবিনয়ে জানালেন, এই গানটির সুর তাঁর নয়, তাঁর ছেলের। মদনমোহনের ঠিক বিশ্বাস হল বলে মনে হল না। তোড়ি আর খামাজ— এই দুই সুরের মিশাল গানটিতে। খামাজ পঞ্চমের প্রিয় সুর। বার বার তিনি ফিরে ফিরে আসেন এই সুরে। ‘রায়না বিত জায়ে’ মুগ্ধ করল অনেককেই। আরতি মুখোপাধ্যায় শুনলেন, মাল্লিকার্জুন মনসুর এই সুরটি গুনগুন করছেন। বিস্মিত আরতিকে এই পণ্ডিত জানালেন, কী অনায়াসে নোটগুলোকে মিলিয়েছে বলো তো? আম জনতার কাছে চিঙ্গারি হয়ে উঠল জীবনের সেই মুহূর্তগুলোর গান, যেগুলোকে আমরা বয়ে বেড়াই। এই গান আমাদের একলা ছাদে বা জানলায় দাঁড় করিয়ে সেই বোধগুলোকে একটা ভাষা দেয়, এক ধরনের তর্পনের শক্তি দেয়, যা নইলে এ জীবনভার অসহ হয়ে উঠত।
গল্পটা টুকরো টুকরোই বলা যায়। জীবনটাই তো টুকরো টুকরো। পঞ্চমের, তাঁর সুরের যাত্রার, আমাদের। আশা আর পঞ্চম। গান বেঁধে দিয়েছিল বন্ধনহীন গ্রন্থি। একটি সাক্ষাৎকারে আশা বলেন, ৭ মার্চ ১৯৭৯ সালে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে সাক্ষী ছিলেন লতা, কিশোর, ভারতী মঙ্গেশকর (হৃদয়নাথের স্ত্রী) ও বন্ধু বাবুভাই দেশাই। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য কিশোর নাকি সপন চক্রবর্তীর ক্যামেরা থেকে ফিল্মটা খুলে নেন। শচীন ভৌমিক আবার অন্য কথা বলেন। তিনি বলেন, বিয়ে কোনও দিন হয়নি। আশা পঞ্চমকে দার্জিলিঙের এক মন্দিরে নিয়ে গিয়ে মালা বদল করেছিলেন। কোনও রেজিষ্ট্রি না, ছবি নেই। যাক গে, তাঁদের গানে গানে উচ্ছ্বসিত, আনন্দে উদ্ভাসিত মিলনের বাইরে অন্য প্রমাণ আমাদের কী দরকার? তাঁদের গানগুলোর উত্তরাধিকার পেতে তো আমাদের উইলের প্রবেট নিতে হয়নি। আর কী চাই।
পঞ্চমের খুব খারাপ সময়ে আর ডি পাগল বিধু বিনোদ চোপড়া, পঞ্চমকে দেবেন ‘পারিন্দা’ ছবির সুরের ভার। আমরা আবার পাব অসাধারণ কিছু সুর। বিধু লিখছেন, এক দিন ‘পেয়ারকে মোড়পে’ গানটার রেকর্ডিংয়ের পর রেনু সালুজা, বিনোদ প্রধান আর আমি রাস্তায় বেরিয়ে এসে গানটা গুনগুন করে গাইছি। হঠাৎ দেখি পঞ্চমদা ওঁর সেই ফিয়েট গাড়িটা করে বেরোচ্ছেন। আমাদের দেখে উনি নামলেন, গান ধরলেন। একটু লোক জন জড়ো হল। তখন পঞ্চমদা বললেন, না রে চল, লোকগুলো ভাববে আমার এমন অবস্থা একেবারে রাস্তায় গাইছি।
পঞ্চমের জীবন আর গানের মেশামেশি দিনলিপি, যা আবার একটা দেশের জীবনগান হয়ে ওঠে, লেখা সহজ নয়। সেই কাজটা অসাধারণ ভাবে করেছেন, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য আর বালাজি ভিত্তল। গানগুলোর বিশ্লেষণ পড়লেই বোঝা যায় এই দু’জনও এই গানের ভেতর ডুব দিয়ে তার মুক্তোগুলোকে চেনার চেষ্টা করেন। তাঁদের ধন্যবাদ, রাহুলের জীবন আর তার সঙ্গে আমাদের নিজেদের জীবনের তীব্র অনুভূতিগুলোকে আর এক বার ফিরিয়ে আনার জন্যে। রাহুলের মতো মানুষরা ফুরান না, বেঁচে থাকেন নিজেদের সুরলোকে। সেই সুরলোকে বিশ্বাস রাখার জন্য পরলোকে বিশ্বাস করার দরকার নেই।
সৌজন্যেঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ বৈশাখ ১৪১৮ রবিবার ১ মে ২০১১
...........


আরও প্রতিক্রিor Ba

সোমনাথ মন্দির, নেহরু, ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ


সোমনাথ মন্দির, নেহরু, ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ






Shared by                     Pranab Kumar Kundu.


Ramprasad Goswami

গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরে’র কারণে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রয়াত ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের কি হাল হয়েছিল, -- আজ আপনাদের সে বিষয়ে কিছু জানানো অবশ্যই দরকার। সত্যি কথা বলতে কি, ডঃ প্রসাদ’কে এর জন্যে বিরাট মূল্য চোকাতে হয়।

জওহরলাল যে সোমনাথ মন্দিরের বিপক্ষে ছিলেন, -- কথাটা কমবেশি সকলেই প্রায় জানাই ছিল। অতএব সর্দার প্যাটেল গান্ধী’জীর শরণাপন্ন হলেন। কোনমতে সেখান থেকে সম্মতি আদায় করেই তিনি হাত লাগালেন মন্দিরের পুনঃনির্মাণে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! কাজ শেষ হবার আগেই মৃত্যু হল তাঁর।

সর্দার’জীর মৃত্যুর পর, তাঁর এই অসমাপ্ত কাজের ভার গিয়ে পড়ে, শ্রদ্ধেয় শ্রী কে এম মুন্সী’র উপর, অন্যদিকে যিনি আবার ছিলেন নেহেরুর ক্যাবিনেট মন্ত্রীও । ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়েছে গান্ধী’জীর-ও।

গান্ধী-প্যাটেলের মৃত্যুর পর এই ইস্যু’তে নেহেরুর বল্গাহীন বিরোধী সুর ক্রমশঃই তীব্রতর হতে শুরু করে। চড়তে থাকে তিক্ততার পারদ। তেমনই একটি মিটিং-এ তো একবার মুন্সী’কে কড়া ধমক’ই দিয়ে বসেন নেহেরু! তাঁর বিরুদ্ধে ‘হিন্দু-পুনরুত্থানবাদ’ তথা ‘হিন্দুত্ববাদ’ প্রচারের তকমা লাগিয়ে তীব্র ভর্ৎসনাও করেন তিনি। কিন্তু মুন্সী’জীও তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তাঁর চাঁছা-ছোলা বক্তব্য – সর্দার প্যাটেলের অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাধা করবেন-ই করবেন! তাছাড়া মুন্সী ছিলেন নিজেও একজন গুজরাটি, অতএব,  তাঁর পক্ষে এই বিষয়টিও মন্দির নির্মাণে গতি আনতে সহায়তা করে।

অতঃপর মন্দির নির্মান সমাপ্ত হলে, তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ’কে শুভ-দ্বারোদঘাটনের জন্য সসম্মানে আমন্ত্রণ জানান। রাজেন্দ্রপ্রসাদও অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে উক্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতে স্বীকৃত হন। কিন্তু এই খবরে বেঁকে বসেন নেহেরু। জল এতদূর গড়ায় যে, স্বয়ং নেহেরু চিঠি লিখে ডঃ প্রসাদ’কে সোমনাথ মন্দিরের উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে নিষেধ করে দেন। কিন্তু এবারে রুখে দাঁড়ালেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। নেহেরুর রক্তচক্ষু’কে আমল না দিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন সোমনাথ মন্দিরে। শুধু উপস্থিত হওয়াই নয়, সেখানে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে দিলেন এক জবরদস্ত ভাষণ।

মারাত্মক ঝটকা খেলেন নেহেরু। তাঁর আঁতে লাগল ঘা! এটিকে তিনি নিজের নৈতিক পরাজয় বলে হজম করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু বিনিময়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ’কেও বড়ো গুনাগার গুনতে হল, কারণ এরপর থেকে নেহেরু তাঁর সঙ্গে যে ধরণের নজিরবিহীন অভব্য আচরণ শুরু করেন, তা ভাবলে আজও বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়!

সোমনাথ মন্দিরের তরজা’কে কেন্দ্র করে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও নেহেরুর ব্যক্তিগত সম্পর্কে এতটাই তিক্ততার সৃষ্টি হয় যে, রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁকে দিল্লীতে থাকার মত একটি ঘর পর্যন্ত বরাদ্দ করতে অস্বীকার করেন নেহেরু। অথচ রাজেন্দ্রবাবু লেখালেখি পছন্দ করতেন, তার বড় শখ ছিল, বৃদ্ধ বয়সে জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি দিল্লীর বুকেই বই-টই লিখে কাটান। নেহেরুর মত মানুষের কি এমন’টা করা উচিৎ ছিল? একজন ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি’র যা যা সম্মান বা অধিকার পাবার কথা ছিল, তা’র সব কিছু থেকেই ওই ভদ্রলোকটিকে বঞ্চিত করা হয়। অগত্যা নিরুপায় প্রসাদজী’ তাঁর আদি নিবাস পাটনায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু সেখানেও তাঁর নিজস্ব কোন সংস্থান ছিল না। না ছিল টাকা-কড়ি, না কোন বাড়ি-ঘর। আর অন্যদিকে পাটনা’তে যথেষ্ট সংখ্যক সরকারী বাংলো বা আবাসন থাকা সত্ত্বেও নেহেরুর নিষ্ঠুরতায় সে সব জায়গায় তাঁর থাকা খাওয়ার নুন্যতম সুযোগ-ও তিনি হারালেন।

শেষমেশ পাটনার সদাকৎ আশ্রমের একটি আলো-বাতাসহীন বদ্ধ কুঠুরিতে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে। না, তাঁকে দেখভাল করার মতও কেউ ছিল না; ছিল না কোন ডাক্তার!

ধীরে ধীরে শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগল, ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতির। আবদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে ক্রমশঃ দেখা দিল শ্বাসকষ্ট। সারা দিন ধরে দমকে দমকে কাশির সঙ্গে উঠতে লাগল কফ। কিন্তু হায়! তিনি ছিলেন অসহায়!! দেশের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুবাদে দ্বারে দ্বারে সাহায্যের জন্য ভিক্ষা করাও যে তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব। অন্যদিকে, রাজেন্দ্রপ্রসাদের পাটনা আসার পর থেকে তিনি কেমন আছেন, বা তাঁর কি ভাবে চলছে? – ইতিহাস সাক্ষী, চক্ষুলজ্জার খাতিরে নেহেরু একবারও সে খবর নেবার প্রয়োজন বোধ করে দেখলেন না।

শুধু নেহেরুই নন, সেদিন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি’র অসুস্থতার খবর পাবার পরও এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যিনি... নূন্যতম চিকিৎসার সুবিধাও তাঁর কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছিলেন!

বিহারে তখন কংগ্রেসেরই রাজত্ব, সুতরাং বলাইবাহুল্য কোন এক অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ডঃ রাজেন্দ্রবাবু সুচিকিৎসা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে চিরবঞ্চিত রইলেন। পাশাপাশি ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রইল তাঁর প্রতি নানা নির্দয় অমানবিক আচরণের। কার নির্দেশে এসব ঘটেছিল সেদিন?

ডঃ প্রসাদের কফ-কাশির সমস্যা ছিল। তাই প্রায়ই পাটনার মেডিক্যেল কলেজে তিনি চিকিৎসা করাতে যেতেন। সেখানে, আর দশজন সাধারণ রোগীর মতোই তাঁর চিকিৎসা হত। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন,... সেখানে যে মেশিনটি’তে তাঁর চিকিৎসা হত, সেটিকেও পর্যন্ত দিল্লী পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা যায়। অর্থাৎ রাজেন্দ্রবাবুকে প্রকারান্তরে তিলে তিলে মারার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত ভাবেই সম্পন্ন করা হয়েছিল।

একবার শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে সদাকৎ আশ্রমে গিয়ে পৌঁছান। উদ্দেশ্য, দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি তথা সংবিধান সভার অধ্যক্ষ কেমন আছেন তা স্বচক্ষে পরিদর্শন করা। কিন্তু হায়! এ কি দেখছেন নারায়ণ? রাজেন্দ্রপ্রসাদের অবস্থা দেখে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান! তাঁর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। তাঁর ভাবনাতেই আসে না, কি বলবেন তিনি? আর একমূহুর্তও অপেক্ষা না করে তিনি তাঁর অফিসারদের নির্দেশ দেন, প্রসাদজী’র কামরাখানিকে যাতে অবিলম্বে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। সেই মত কাজও হয় তুরন্ত। কিন্তু রাজেন্দ্রবাবু আর বেশি দিন বাঁচেন নি। সেই ঘরেই ১৯৬৩’র ২৮শে ফেব্রুয়ারী তাঁর দেহান্ত হয়।

ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের মৃত্যুর পরেও নেহেরুর ক্ষোভ প্রশমিত হয় নি। শান্ত হতে পারেননি তিনি। তাই প্রসাদজী’র অন্ত্যেষ্টি’তে পর্যন্ত যোগ দিতে নেহেরু অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। আর সম্ভবত সেই কারণেই, রাজেন্দ্রপ্রসাদের শেষ যাত্রার দিন তিনি পাটনা থেকে বহু দূরে রাজস্থানে’র জয়পুরে চলে যান। শুধু কি তাই? রাজস্থানের তৎকালীন রাজ্যপাল, ডঃ সম্পূর্ণানন্দ’জী এই উপলক্ষে পাটনা আসতে চাইলে, স্বয়ং নেহেরু তাঁকে সেখানে যেতে বারণ করেন!

“এটা কি ভাবে সম্ভব? যে, দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন কোন রাজ্যে অবস্থান করছেন; আর সে রাজ্যের রাজ্যপালই অনুপস্থিত”! – দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির অন্তিম যাত্রায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সে দেশেরই কোন এক অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের কাছে সেদিন নেহেরুর তরফে এমনই বার্তা প্রেরিত হয়েছিল। অতয়েব এরপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্পূর্ণানন্দ’জীকে তাঁর পাটনা সফর বাতিল করতে হয়।

ভাবছেন এখানেই শেষ?
- না বন্ধুরা, আরও আছে। নেহেরু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, তথা বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের উত্তরসুরী ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ’কেও একই কারণে পাটনা সফর বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ডঃ রাধাকৃষ্ণাণ সে কথায় কর্ণপাত না করে সোজা রাজেন্দ্রপ্রসাদের অন্ত্যেষ্টিস্থলে পৌঁছে দেশের মানরক্ষা করেন।

আজ আর হয়তো দিল্লী’র রাজঘাটের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে সেদিনের নেহেরুর বর্বর আচরণের স্মৃতিচারণ করার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই আছে। তবে এটাও তো ঠিক যে, মহাত্মা গান্ধী’র সৌধের পাশে সঞ্জয় গান্ধী’র মত লোকও জায়গা পেতে পারে, কিন্তু ঠাঁই মেলে না – স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি’র মত মানুষের! এই দেশে তাদের ইজ্জত মেলা ভার!!

- তবে হ্যাঁ, এটা নিঃসঙ্কোচে মনে হতেই পারে যে, এদেশের যাবতীয় মহত্ত্ব আর বলিদানের কপিরাইট কেবল এক গান্ধী-নেহেরু পরিবারের জন্যেই চিরকালীন সংরক্ষিত...!!!

................ ছিঃ !!!!



মন্তব্যগুলি
Upasana Banerjee
Upasana Banerjee Neheru akta joghonno choritro o manosikotar lok. Or jnyo desh vag hoyeche. Or jnyo Pakistan somosya. Or jnyo pak odhikrito kashmir bole akta jayga toiri hoyeche.




Shared by
Pranab Kumar Kundu.

বুধবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৮

মহাকর্ষ ( মাধ্যাকর্ষণ ), অভিকর্ষ ও মহাবিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য


    মহাকর্ষ ( মাধ্যাকর্ষণ ), অভিকর্ষ ও মহাবিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য


    শেয়ার করেছেন                                                          প্রণব কুমার কুণ্ডু।

প্রশ্নঃ মহাকর্ষ।জড় বস্তুর পরস্পর আকর্ষণ, মাধ্যাকর্ষণ, gravitation. ও অভিকর্ষ, ভূকেন্দ্রাভিমুখে জড় পদার্থের আকর্ষণ, gravitational attraction,  শক্তি সম্পর্কে হিন্দুশাস্ত্র কী বলে ??
এ বিষয়ে হিন্দু বিজ্ঞানীদের কোন অবদান আছে কি???

উত্তর:
আধুনিক বিশ্বে অনেকের ধারণা, মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ শক্তি,  নিউটন প্রথম আবিষ্কার করেছেন। 

তবে অনেকেই জানেন না,  যে, এ বিষয়ে হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থে, বেদে, স্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

সবিতা যন্ত্রৈঃ পৃথিবী মরভণাদস্কম্ভনে সবিতা দ্যামদৃংহৎ।
অশ্বমিবাধুক্ষদ্ধু নিমন্তরিক্ষমতূর্তে বদ্ধং সবিতা সমুদ্রম ॥ 

ঋগ্বেদ, ১০/১৪৯/১

অনুবাদ: সূর্য রজ্জুবৎ আকর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।

নিরাধার আকাশে দ্যুলোকের অন্যান্য গ্রহকেও,  ইহা সুদৃঢ় রাখিয়াছে।
অচ্ছেদ্য আকর্ষণ রর্জ্জুতে আবদ্ধ, গর্জনশীল গ্রহসমূহ নিরাধার আকাশে অশ্বের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতেছে।


দেখুন, আকাশ যে ‘নিরাধার’, এবং ‘রজ্জুবৎ আকর্ষণ’,  অর্থাৎ মহাকর্ষ ( বা মাধ্যাকর্ষণ ) শক্তির দ্বারাই যে সেই নিরাধার আকাশে,  সূর্য ও গ্রহসমূহ নিজ অক্ষরেখায় সুদৃঢ় রয়েছে --
এখানে সেকথা বলা হয়েছে।


বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক ধর্মগ্রন্থে, আকাশকে স্পষ্টভাবে ‘পৃথিবীর ছাদ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ এই সব ধর্মমতের জন্মেরও হাজার বছর পূর্বে, বেদে আর্য ঋষিগণ আকাশকে ‘নিরাধার’,  অর্থাৎ পৃথিবীকে ও গ্রহসমূহকে শূন্যে ভাসমান বলে,  ঘোষণা করেছিলেন।


আরও লক্ষণীয়, মহাকর্ষ শক্তিতে আবদ্ধ গ্রহসমূহ, যে নিরাধারে অর্থাৎ, মহাশূন্যে স্থির নয়, বরং পরিভ্রমণ করছে, নিজ কক্ষপথে --এই তত্ত্বও আবিষ্কার করেছিলেন বৈদিক ঋষিগণ। এমনকি সূর্য নিজেও, যে তার নিজস্ব কক্ষপথে চলছে সেই অত্যাশ্চর্য গূঢ় বিজ্ঞানও আলোচিত হয়েছে নিম্নের মন্ত্রে :
আকৃষ্ণেন রজসা বর্তমানো নিবেশয়ন্নমৃতং মর্তঞ্চ।
হিরণ্ময়েন সবিতা রথেনা দেবো যাতি ভুবনানি পশ্যন্ ॥ 

ঋগ্বেদ, ১/৩৫/২

অনুবাদ: সূর্য আকর্ষণযুক্ত পৃথিব্যাদি লোক-লোকান্তরকে সঙ্গে রাখিয়া, নশ্বর-অবিনশ্বর উভয় পদার্থকে নিজ নিজ কার্যে নিযুক্ত রাখিয়া এবং মাধ্যাকর্ষণ অর্থাৎ, মহাকর্ষ রূপে,  রথে চড়িয়া যেন সারা লোকান্তর দেখিতে দেখিতে গমন করিতেছে।


খুব অবাক হতে হয়, পৃথিবী যেমন চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে, সেইরকম, সূর্যও যে তার গ্রহ-উপগ্রহসমূহকে সঙ্গে নিয়ে,  নিজের কক্ষপথে গমন করছে -- এই গভীর জ্ঞানও,  পবিত্র বেদে আলোচিত হয়েছে।


মহাবিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য
(১১৫০ খ্রি:) তাঁর ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ নামক জ্যোতিঃশাস্ত্রের, গোলাধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন--


“আকৃষ্টি শক্তিশ্চ মহীতয়া যৎ স্বস্থং স্বাভিমুখী করোতি।
আকৃষ্যতে তৎ পততীব ভাতি সমে সমন্তাৎ কুবিয়ং প্রতীতিঃ॥”


অর্থাৎ “সর্ব পদার্থের মধ্যে এক আকর্ষণ শক্তি বিদ্যমান রহিয়াছে, যে শক্তি দ্বারা পৃথিবী,  আকাশস্থ পদার্থকে নিজের দিকে লইয়া আসে।
যাহাকে ইহা আকর্ষণ করে তাহা পতিত হইল বলিয়া মনে হয়।”


অর্থাৎ প্রাচীন ঋগ্বেদ শাস্ত্রের পাশাপাশি,  ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করলেও হিন্দু বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫), বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭) জন্মেরও কমপক্ষে পাঁচশত বছর পূর্বে,  মহাকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করে তাঁর গ্রন্থ, ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’তে আলোচনা করে গিয়েছেন!!!




গাংনাপুরের দেবগ্রাম


   গাংনাপুরের দেবগ্রাম

   শেয়ার করেছেন                                   প্রণব কুমার কুণ্ডু।

সমাজ বিবর্তন ও পুরাতত্ত্বের আলোকে নদীয়া জেলার এক বিলুপ্ত জনপদ-- দেবল রাজার গড় বা দেবগ্রাম।
একটি অদ্ভুত কিন্তু অবহেলিত জায়গা হচ্ছে দেবগ্রাম, জীবন্ত প্রত্নক্ষেত্র বলা যায়।এখানে ধানজমিতে চাষ করতে গেলে, লাঙ্গলের ডগায় উঠে আসে কোন সেই প্রাচীন, সম্ভবত পাল যুগের মূর্তি বা জলপ্রদীপ, সেন যুগের ঘর গেরস্থালির হাঁড়ি- কুঁড়ি অথবা সুলতানি আমলের সুরাপাত্র, হুঁকো, কলসি ইত্যাদি।মাটির সামান্য নিচেই অসংখ্য মৃৎপাত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নল পুকুর, বিল পাড়া, পন্ডে পাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে।এইসব জায়গায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মাড়িয়ে যেতে হয় হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক সামগ্রী।পুকুর খুঁড়লে বেরিয়ে আসে বিশাল বিশাল পাথরের ব্লক, প্রাচীন ইট, সে ইট বিভিন্ন প্রকারের, ছোট থেকে শীল পাটার চেয়েও বড়।
এখানকার চাষিরা, জনমজুরেরা, সাধারণ মানুষেরা, বুঝে উঠতে পারছেন না,  এই যে জিনিসগুলি উঠে আসছে, সেগুলি নিয়ে কি করবে তাঁরা।কিন্তু এটুকু তাঁরা খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন, এসব জিনিষ অতি প্রাচীন, যতক্ষণ না সরকার বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করছে, ততদিন এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
শুনলে আশ্চর্য হবেন,  গ্রামের মানুষেরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে একটা আস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা বানিয়ে ফেলেছেন।এদের সঙ্গে আছেন কয়েকজন উৎসাহী তরুণ ও যুবক যেমন ডা: বিশ্বজিৎ রায়, সঞ্জয় ভৌমিক, অনির্বান বসু, দেবজিৎ বিশ্বাস ইত্যাদি।
প্রতিদিনই কেউ না কেউ, কিছু না কিছু জিনিষ দিয়ে যাচ্ছে, এতে করে সংগ্রহশালায় আর নতুন করে কিছু রাখার স্থান অকুলান হয়ে গেছে।
সমগ্র দেবগ্রামবাসীরা অতিশয় উৎসাহী এই ঐতিহাসিক সম্পদ গুলি বাঁচাতে, কিন্তু বিদ্যোৎসাহী পন্ডিতেরা এবং পুরাতাত্ত্বিক কর্তৃপক্ষ এগিয়ে না এলে এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না।দরকার বিজ্ঞান সম্মত খনন, সংরক্ষণ এবং বিশেষজ্ঞের মতামত।
এখানে পৌঁছাতে গেলে, সরাসরি চাকদহ বা রানাঘাট স্টেশনে এসে নেমে, যাওয়া যায়।ডা: বিশ্বজিৎ রায়-এর ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন , দেবগ্রাম নিয়ে অবহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।আশায় রইলাম দেবগ্রামে একদিন চন্দ্র কেতুগরের মতন কর্মকান্ড শুরু হবে।
এখানে চাষিরা জমির মধ্যে যেসব জিনিষ পেয়েছেন, তার গুটিকয়েক ছবি তুলে ধরছি।এগুলি তাঁদের সংগ্রহশালায় রাখা আছে।
এই দেবগ্রাম, গাংনাপুর-এর দেবগ্রাম ! পলাশী'র আগের দেবগ্রাম নয় !