কালাপাহাড়
শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু।
কালাপাহাড়
------------
------------
মুর্শিদকুলি খাঁর মতই ব্রাহ্মণকুলে জন্ম হয়েছিল কালাচাঁদ রায়ের। একটাকিয়ার জমিদার বংশে। মাতৃকুল ছিল পরম বৈষ্ণব।
সংস্কৃত শাস্ত্রে পণ্ডিত, অস্ত্রবিদ্যায় বীরোচিত গুণের অধিকারী।
গৌড় বাদশাহের দরবারে রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছিল কালাচাঁদ। আর প্রাসাদ-সংলগ্ন বাসভবন থেকে প্রতিদিন মহানন্দায় স্নান করতে যাবার সময় নবাবকন্যা দুলারী অপেক্ষা করত সুদর্শন সুপুরুষ ব্রাহ্মণ যুবকের দর্শন পাবার আশায়।
বলিষ্ঠ রূপবান চেহারা, গলায় উপবীত, হাতে স্বর্ণময় কোষা, সুকন্ঠে সঙ্গীতস্তোত্র। পিছনে চলত ছাতাবরদার।
বাদশাহ এবং বেগম বুঝলেন, এই হিন্দু যুবকের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একমাত্র কন্যাকে অসুখী করতে চাননি তাঁরা। তাই কালাচাঁদ রায়কে বললেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দুলারীর পাণিগ্রহণ করো।
কালাচাঁদ অসম্মত হল।
বাদশাহ ক্রোধান্ধ হয়ে তাকে হত্যা করার আদেশ দিলেন।
জল্লাদ এগিয়ে এল কর্তব্যপালনের জন্যে।
আর সেই মুহুর্তে সপ্তদশী নবাবকন্যা মর্মর জাফরির আড়াল থেকে ছুটে এসে বললে, আগে আমায় হত্যা করো, তারপর আমার স্বামীর অঙ্গ স্পর্শ করবে।
মুগ্ধ হল কালাচাঁদ। বিস্মিত হল রূপবতী যবনীর দুঃসাহস দেখে।
দুলারীকে বিবাহ করতে সম্মত হল। কিন্তু ধর্মত্যাগ করতে নয়। মুসলমানীকে বিবাহ করলেই বিধর্মী হতে হবে কেন, এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেল না কালাচাঁদ। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ধর্না দিল, দেবতার প্রত্যাদেশ জানবার জন্যে। শ্রীমন্দিরের পুরোহিতকুল, কালাচাঁদের আত্মীয়-স্বজন সকলেই অপমানিত করল তাকে। সমাজপতিরা বললে মুসলমানীকে বিবাহ করে ধর্মত্যাগী হয়েছে কালাচাঁদ।
সামাজিক অনুশাসনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কালাচাঁদ একদিন নিজেই অত্যাচারী হয়ে উঠল। প্রতিজ্ঞা করল, ভারতবর্ষ থেকে হিন্দুধর্মের উচ্ছেদ সাধন করবে।
স্বেচ্ছায় এবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল সে, নামকরণ হল মহম্মদ ফরমুলি।
হিন্দু ভারত কেঁপে উঠল কালাপাহাড়ের নামে।
জগন্নাথের প্রত্যাদেশ জানবার জন্যে একদিন পূরীধামে ধর্না দিতে গিয়ে অপমানীত হয়েছিল কালাচাঁদ। তাই শাহি ফৌজের অধিনায়ক হয়ে প্রথমেই উৎকল ধ্বংস করতে এগিয়ে গেল কালাপাহাড়। দেবমূর্তি অপবিত্র করল, বলপ্রয়োগে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করল হিন্দু প্রজাদের। হিন্দু নারীর সতীত্ব আর কৌমার্যের অহংকার টলে পড়ল লালসামত্ত শাহি ফৌজের আক্রমণে।
বনাগ্নির মতই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তাদের অত্যাচার। অভিযানের পর অভিযান। মুসলমান সমাজও শঙ্কিত হল, ব্যাথায় কাতর হল হিন্দুর প্রতি কালাপাহাড়ের অত্যাচার দেখে।
কালাপাহাড়ের শাহি সৈন্য শুধু দেবমূর্তিই নয়, নারীলাঞ্ছনাতেও তৎপর হয়ে উঠল। হিন্দু নারীর ধর্ম বিনষ্ট করার উৎসাহে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠল শাহি ফৌজ।
মন্দিরের পর মন্দির ধ্বংস করে অত্যাচারের আগুন জ্বালিয়ে বারাণসীতে পৌঁছল কালাপাহাড়। একটির পর একটি প্রাচীন দেবমন্দির ধ্বংস করে শেষে বারাণসীর কেদারেশ্বর-লিঙ্গ অপবিত্র করার নির্দেশ দিল।
বিধর্মীর চিৎকার তুলে ছুটে গেল সৈন্যরা।
এমন সময় রোরুদ্যমানা বৈধব্যের রূপ নিয়ে কালাপাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়াল এক শুভ্রবাস বিধবা রমনী ! কালাচাঁদ রায়ের মাতুলানী।
শ্বেতবসনা কাসিবাসিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল দেবদ্রোহী কালাচাঁদ। মনে পড়ল, এই মাতুলানীর স্নেহ আর মমতায় শৈশব কাটিয়েছে সে, মাতৃত্বে লালন করেছে তাকে এই বিধবা শুচিতা।
শুনল কালাচাঁদ। তারই লালসামত্ত সৈন্যের দল বিধবার ধর্ম বিনষ্ট করেছে।
অবলা এক নারীর উন্মাদ এক হতাশার দৃষ্টিতে বিবেক ফিরে পেল কালাপাহাড়। তার চোখের সামনে বিষপান করে অভিশাপ দিতে দিতে মৃত্যুবরণ করল বিধবা।
অনুশোচনা দেখা দিল তার মনে। অত্যাচার বন্ধ করার নির্দেশ দিল কালাপাহাড়। রক্ষা পেল কেদারেশ্বর-লিঙ্গ, রক্ষা পেল হিন্দু ধর্ম।
আর কালাপাহাড় ??
পরদিন প্রত্যূষে শাহিরক্ষীর দল খুঁজে পেল না কালাপাহাড়কে। তন্নতন্ন করে, চতুর্দিকে তল্লাসি পাঠিয়েও হদিস মিলল না।
হয়ত সন্ন্যাসী হয়েই হিমালয়ের কোনও অজ্ঞাত গুহায় প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টায় লোকচক্ষুর আড়ালেই মৃত্যু হল তার, হয়ত বা গঙ্গাগর্ভে আত্মহত্যা করল অনুশোচনায়।
কালাপাহাড়ের প্রকৃত ইতিহাস কেউই জানে না। গ্রাম্য কিম্বদন্তীর মধ্যেই তা আবদ্ধ হয়ে আছে।
সংস্কৃত শাস্ত্রে পণ্ডিত, অস্ত্রবিদ্যায় বীরোচিত গুণের অধিকারী।
গৌড় বাদশাহের দরবারে রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছিল কালাচাঁদ। আর প্রাসাদ-সংলগ্ন বাসভবন থেকে প্রতিদিন মহানন্দায় স্নান করতে যাবার সময় নবাবকন্যা দুলারী অপেক্ষা করত সুদর্শন সুপুরুষ ব্রাহ্মণ যুবকের দর্শন পাবার আশায়।
বলিষ্ঠ রূপবান চেহারা, গলায় উপবীত, হাতে স্বর্ণময় কোষা, সুকন্ঠে সঙ্গীতস্তোত্র। পিছনে চলত ছাতাবরদার।
বাদশাহ এবং বেগম বুঝলেন, এই হিন্দু যুবকের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একমাত্র কন্যাকে অসুখী করতে চাননি তাঁরা। তাই কালাচাঁদ রায়কে বললেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দুলারীর পাণিগ্রহণ করো।
কালাচাঁদ অসম্মত হল।
বাদশাহ ক্রোধান্ধ হয়ে তাকে হত্যা করার আদেশ দিলেন।
জল্লাদ এগিয়ে এল কর্তব্যপালনের জন্যে।
আর সেই মুহুর্তে সপ্তদশী নবাবকন্যা মর্মর জাফরির আড়াল থেকে ছুটে এসে বললে, আগে আমায় হত্যা করো, তারপর আমার স্বামীর অঙ্গ স্পর্শ করবে।
মুগ্ধ হল কালাচাঁদ। বিস্মিত হল রূপবতী যবনীর দুঃসাহস দেখে।
দুলারীকে বিবাহ করতে সম্মত হল। কিন্তু ধর্মত্যাগ করতে নয়। মুসলমানীকে বিবাহ করলেই বিধর্মী হতে হবে কেন, এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেল না কালাচাঁদ। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ধর্না দিল, দেবতার প্রত্যাদেশ জানবার জন্যে। শ্রীমন্দিরের পুরোহিতকুল, কালাচাঁদের আত্মীয়-স্বজন সকলেই অপমানিত করল তাকে। সমাজপতিরা বললে মুসলমানীকে বিবাহ করে ধর্মত্যাগী হয়েছে কালাচাঁদ।
সামাজিক অনুশাসনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কালাচাঁদ একদিন নিজেই অত্যাচারী হয়ে উঠল। প্রতিজ্ঞা করল, ভারতবর্ষ থেকে হিন্দুধর্মের উচ্ছেদ সাধন করবে।
স্বেচ্ছায় এবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল সে, নামকরণ হল মহম্মদ ফরমুলি।
হিন্দু ভারত কেঁপে উঠল কালাপাহাড়ের নামে।
জগন্নাথের প্রত্যাদেশ জানবার জন্যে একদিন পূরীধামে ধর্না দিতে গিয়ে অপমানীত হয়েছিল কালাচাঁদ। তাই শাহি ফৌজের অধিনায়ক হয়ে প্রথমেই উৎকল ধ্বংস করতে এগিয়ে গেল কালাপাহাড়। দেবমূর্তি অপবিত্র করল, বলপ্রয়োগে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করল হিন্দু প্রজাদের। হিন্দু নারীর সতীত্ব আর কৌমার্যের অহংকার টলে পড়ল লালসামত্ত শাহি ফৌজের আক্রমণে।
বনাগ্নির মতই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তাদের অত্যাচার। অভিযানের পর অভিযান। মুসলমান সমাজও শঙ্কিত হল, ব্যাথায় কাতর হল হিন্দুর প্রতি কালাপাহাড়ের অত্যাচার দেখে।
কালাপাহাড়ের শাহি সৈন্য শুধু দেবমূর্তিই নয়, নারীলাঞ্ছনাতেও তৎপর হয়ে উঠল। হিন্দু নারীর ধর্ম বিনষ্ট করার উৎসাহে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠল শাহি ফৌজ।
মন্দিরের পর মন্দির ধ্বংস করে অত্যাচারের আগুন জ্বালিয়ে বারাণসীতে পৌঁছল কালাপাহাড়। একটির পর একটি প্রাচীন দেবমন্দির ধ্বংস করে শেষে বারাণসীর কেদারেশ্বর-লিঙ্গ অপবিত্র করার নির্দেশ দিল।
বিধর্মীর চিৎকার তুলে ছুটে গেল সৈন্যরা।
এমন সময় রোরুদ্যমানা বৈধব্যের রূপ নিয়ে কালাপাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়াল এক শুভ্রবাস বিধবা রমনী ! কালাচাঁদ রায়ের মাতুলানী।
শ্বেতবসনা কাসিবাসিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল দেবদ্রোহী কালাচাঁদ। মনে পড়ল, এই মাতুলানীর স্নেহ আর মমতায় শৈশব কাটিয়েছে সে, মাতৃত্বে লালন করেছে তাকে এই বিধবা শুচিতা।
শুনল কালাচাঁদ। তারই লালসামত্ত সৈন্যের দল বিধবার ধর্ম বিনষ্ট করেছে।
অবলা এক নারীর উন্মাদ এক হতাশার দৃষ্টিতে বিবেক ফিরে পেল কালাপাহাড়। তার চোখের সামনে বিষপান করে অভিশাপ দিতে দিতে মৃত্যুবরণ করল বিধবা।
অনুশোচনা দেখা দিল তার মনে। অত্যাচার বন্ধ করার নির্দেশ দিল কালাপাহাড়। রক্ষা পেল কেদারেশ্বর-লিঙ্গ, রক্ষা পেল হিন্দু ধর্ম।
আর কালাপাহাড় ??
পরদিন প্রত্যূষে শাহিরক্ষীর দল খুঁজে পেল না কালাপাহাড়কে। তন্নতন্ন করে, চতুর্দিকে তল্লাসি পাঠিয়েও হদিস মিলল না।
হয়ত সন্ন্যাসী হয়েই হিমালয়ের কোনও অজ্ঞাত গুহায় প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টায় লোকচক্ষুর আড়ালেই মৃত্যু হল তার, হয়ত বা গঙ্গাগর্ভে আত্মহত্যা করল অনুশোচনায়।
কালাপাহাড়ের প্রকৃত ইতিহাস কেউই জানে না। গ্রাম্য কিম্বদন্তীর মধ্যেই তা আবদ্ধ হয়ে আছে।
----- রমাপদ চৌধুরী (লালবাঈ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন