মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

এসাসিন্স বা নিজারী ইসমাইলি গোষ্ঠীর কাহিনী অথবা মধ্যযুগের জঙ্গি কর্মকান্ডের কথন

এসাসিন্স বা নিজারী ইসমাইলি গোষ্ঠীর কাহিনী অথবা মধ্যযুগের জঙ্গি কর্মকান্ডের কথন
শেয়ার করেছেন :- প্রণব কুমার কুণ্ডু

 
 
 
 
Pushpal Roy এতে BoiPoka (বইপোকা)
 

 

এসাসিন্স বা নিজারী ইসমাইলি গোষ্ঠীর কাহিনী অথবা মধ্যযুগের জঙ্গি কর্মকান্ডের কথন
 
এই ভয়াবহ এবং মধ্যযুগের ত্রাসের গোষ্ঠীর নামেই আজকে ইংরেজিতে আত্মঘাতী কোনো আততায়ী জঙ্গি কে নামকরণ করা হয়েছে।এদের এই নামকরণের পিছনে আছে এক পরিচিত মাদকের নামের।এই আত্মঘাতী ভয়ানক এক দল তৈরী হয়েছিল হাসিস নামের এক মাদকের প্রয়োগের মাধ্যমে।আরবি শব্দে হাসিসি/আল হাসাসুন ইত্যাদির থেকে আসা এই কথার মানে হাসিস সেবী বোঝানো হয়।পরবর্তীতে ইউরোপীয় ক্রুসেডের অভিযান করতে আসা খ্রিস্টান সেনাদের এই হাসিসির পরিবর্তে রূপ হয়েছে ল্যাটিনে এসাসিনাস(assassinus) হিসেবে আর পরবর্তিতে আমরা ইংরেজিতে এই এসাসিন(assassin)নাম পেয়েছি।আজকের দুনিয়াতে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণে হত্যাকারী কে এই নামে ডাকা শুরু হয়।
এই কুখ্যাত গোষ্ঠীর ইতিবৃত্ত :
এই গোষ্ঠী এসেছে ইসলামের এক শিয়া সম্প্রদায়ের উপশাখার থেকে।এদের ইসমাইলি গোষ্ঠী বলা হতো।হ্যাঁ ,আজকের ইসমাইলি গোষ্ঠীর একটি শাখা ছিল এই লোকগুলো।এই ত্রাসের সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অবসান হয় মঙ্গোলদের হাতে ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি।এর আগে প্রায় আড়াইশো বছর এরা সন্ত্রাসের রাজত্ব আর একের পর এক হত্যা চালিয়েছে আজকের সিরিয়া এবং ইরানের নানান জায়গায়।যা বলছিলাম,এই গোষ্ঠীর কাজ একই রকম ভাবে পূর্বপরিকল্পিত আর নির্দিষ্ট লক্ষ্যের মানুষকে ধরে হতো তাই সেই সময়ের বিশাল সেনা বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করার কোনো বড় কাজের দরকার হতো না।এরা হয় ফাঁকাতে পেয়ে অথবা কোনো উৎসব বা উপলক্ষে ভিড়ের মধ্যে মানুষের মধ্যে ঢুকে মূল লোকটিকে হত্যা করতো।উদ্দেশ্য সেই একটাই,আজকের মতো একই,ধর্মীয় বা রাজনৈতিক এক বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধন করা।
কেন মাদকের প্রয়োজন ?
একই ভাবে, যা আজকের সন্ত্রাসবাদী তাদের আত্মঘাতী গোষ্ঠীর জন্য প্রয়োগ করে।অর্থাৎ একটা একমুখী চিন্তার এবং এক অলীক বিশ্বাস কে মানুষের মধ্যে গেঁথে দিয়ে তাঁকে দিয়ে এই কাজ করানো।আবার আগেই ভেবে বসবেন না স্রেফ আক্রমণ করার সময়েই ওই মাদক সেবন করিয়ে করানো হতো।এর প্রয়োগের পিছনে বেশ ভালো ভাবেই পরিকল্পনা করা হতো।এই মাদকসেবী লোকদের ক্ষেত্রে আজো যা দেখা গিয়েছে তা হলো এরা সুস্থ স্বাভাবিক যৌক্তিক পথে আর চলতে পারে না।একই সাথে একটা অদম্য ইচ্ছা চরিতার্থ করার মানসিকতা ও তৈরী হয় এই মানুষদের মধ্যে।সোজা কথায় মানুষকে নিছক একটি জীবিত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো এদের মিথ্যা এক প্রতিশ্রুতি কে মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে ঠিক যে ভাবে আজকেও এই ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গি আত্মঘাতী তৈরির কারবারে ব্যবহার করে।এই ‘মেরে মরবো’ গোছের একবগ্গা ধারণা তৈরী করে প্রায় অপ্রতিরোধ্য এক আততায়ীর দল তৈরী করেছিল এই ইসমাইলি গোষ্ঠী যাঁকে মোঙ্গলদের সার্বিক অভিযানে খতম করার আগে অন্য কেউ নিষ্ক্রিয় করতে পারেনি কয়েকটি শতক!
শুরুর কাহিনী :
উপরে যেমন বলেছি,এক শিয়া মুসলমানদের উপশাখা এই ইসমাইলি গোষ্ঠীর সূচনা হয় অষ্টম খ্রিস্টাব্দে(৭৬০ ইংরেজি সালে)ইমামতির উত্তরাধিকারী নিয়ে ঝামেলার সময়ে।যাঁরা একটু আধটু খবর রাখেন এই ইসলামের মূল দুই গোষ্ঠীর বা শাখার বিষয়ে তাঁরা জানেন যে নবি মহম্মদের মৃত্যুর পরবর্তীতে একটা বিভাজন আসে। সুন্নি বা মূলধারার থেকে প্রাচীন পারস্যের বা আজকের ইরানের এক সদ্য ইসলাম গ্রহণ করা মানুষদের মধ্যে এক মত পার্থক্য শুরু হয়।এর কারণ,এই শিয়া মতের অনুসারীরা মহম্মদের পরবর্তীতে মোহাম্মদের বংশধরের মধ্যে তাদের পথ প্রদর্শক বেছে নেওয়ার এক মতবাদ শুরু করে আর ওটা আবার সংখ্যা গুরু সুন্নি অনুসারীদের কাছে গ্রাহ্য ছিল না।শিয়া গোষ্ঠীর পথ প্রদর্শক বা ইমাম বেছে নেওয়ার সূত্রে এক ইমাম ইসমাইলের পরবর্তী উত্তরাধিকারী বেছে নেওয়ার সময় এক সমস্যার সৃষ্টি হয়।ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল সাদিকের ভাই না তার ছেলে এই জায়গা পাবে তাই নিয়ে বিবাদ শুরু হয়।এই ইসমাইলি গোষ্ঠী চেয়েছিল উত্তরাধিকারী এই লোকটির ভাই ইসমাইল কে করা হোক করা হোক কিন্তু অন্য শিয়া গোষ্ঠী এর বদলে তার ছেলে মুসা আল কাজিম কে ওই জায়গায় বসায়।এক পর্যায়ে এই গোষ্ঠী সরাসরি খিলাফতকে অস্বীকার করে আর নিজেরাই উত্তর আফ্রিকার তীরবর্তী অঞ্চলের দেশ গুলো ধরে নিজেদের খিলাফত শুরু করে।আব্বাসীয় খলিফা অনুগত সুন্নিরা এবং বিভাজিত শিয়া গোষ্ঠী এদের পথভ্রষ্ট গোষ্ঠী বলে মনে করতো।
পরবর্তীতে এই ইসমাইলি গোষ্ঠী আবার আরো শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়।দশম শতকের সময়ে ফাতেমীয় খলিফা শাসক যখন এই ইসলামিক শাসন পরিচালনা করছিল,এই সময়ে ক্ষমতার বা উত্তরাধিকারীর বিবাদে বা আরো সোজাসুজি বললে মুসলমান সমাজে একাধিপত্য পাওয়া নিয়ে বিভাজনের কারণে পূর্ব দিকের মানে আজকের ইরানের দিকের গোষ্ঠী তাদের নেতা বা খলিফা আবু মানসুর নিজার এর নেতৃত্বে নিজারিও গোষ্ঠী তে আলাদা হয়ে যায়।এই গোষ্ঠী ছিল অতীব জঙ্গি আর আলোচ্য এসাসিন এর উৎপত্তি এদের থেকেই হয়।

এই নরহত্যার শুরু হয় মিশরের থেকে ইরানে আগত এক ধর্ম গুরু হাসান ইবন আল সাব্বাহর মাধ্যমে।এই লোকটি ইরানে নিজের ডেরা বানিয়ে একটি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দল তৈরী করে একদল অনুগত কে নিয়ে।এরা তার প্রতি আনুগত্য এবং নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য গুরুর এবং কাজের প্রতি অখন্ড আনুগত্য দেখাবে এই শর্তে কাজ করা শুরু করে অতীব সহিংস উপায়ে।রীতিমত প্রশিক্ষণ আর এই গোষ্ঠীর মধ্যে নানান পদ আর কাজের ভাগ করে একটি মধ্যযুগীয় সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কাজ শুরু করে এই ধর্মগুরু।
এই সময়ে ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যে চলা দশকের পর দশকের ক্রুসেড বা ধর্ম যুদ্ধে খ্রিস্টান আর মুসলিম পক্ষের মধ্যে ক্রুসেডের একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যেই এই গোষ্ঠীর কাজ শুরু।খ্রিস্টান সেনা বা তাদের মাথাদের কাছে এক আতঙ্কের কারণ হয়ে যায় এই গোষ্ঠী আর এর মাথা।এই নিজারী জঙ্গি গোষ্ঠী উত্তর সিরিয়ার তৎকালীন ক্রুসেডের রণাঙ্গনের সীমান্তে জাবাল আনসারিয়া  অঞ্চলে বেশ অনেকগুলো পাহাড়ের উপরের দুর্গ দখল করে নিজেদের ডেরা বানায়।এর মধ্যে,সিরিয়ার দুর্গ ভিত্তিক মাসায়েফ নগর কে রাজধানী করে এই নাজারী গোষ্ঠী।
দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময়ে(১১৪৭-৪৯ খ্রিস্টাব্দে)তৎকালীন জার্মান রাজা কনরাড তৃতীয় আর ফ্রান্সের রাজা সপ্তম লুই মিলিত ভাবেও ওই অঞ্চল মানে এডেসা মুসলিমদের থেকে দখল করতে ব্যর্থ হয়।এই সার্বিক যুদ্ধের সময়ে এই মিলিত খ্রিস্টান সেনাদের সার্বিক হার এই নিজারি গোষ্ঠী কে এই অঞ্চলে প্রায় খোলা ময়দান দিয়ে দেয় নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়িয়ে একাধিপত্য কায়েম করতে।মজার কথা হলো এরা খ্রিস্টান সেনার মাথাদের নানান সময়ে কর প্রদান বা বিরুদ্ধ সুন্নি গোষ্ঠিকে আক্রমণ করে ক্রুসেডের খ্রিস্টান পক্ষকে এক অর্থে সাহায্য ও করছিল।ত্রয়োদশ শতকের মধ্যেই এই গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা করে ঘাঁটি তৈরী হয় মিশর,সিরিয়া,ইয়েমেন এবং দক্ষিণ ইরাকে বা দক্ষিণপূর্ব ইরানে আর আমাদের এই দিকের আফগানিস্তানে।খেয়াল করুন,সেই একই ধরণের একটা সন্ত্রাসবাদী কারবার খালি সময় আর কুশীলব আলাদা।একটা সার্বিক ধোঁয়াশা ছিল এদের বিষয়ে, এদের কাজ কারবার এতোই গোপনীয় যে গুজব আর কল্পনার উপর ভর করেই এদের সমন্ধে খবর ছড়ায়।প্রত্যেকটি ঘাঁটি অবশ্য নানান দুর্গ বা পাহাড়ের অঞ্চলে হয়েছিল যাতে সহজে এদের পাল্টা আক্রমন করা না যায়।এই সময়ে এদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি বৃদ্ধ কে চিহ্নিত করা হয়।শেখ রাশিদ আল দিন্ ছিল এই গোষ্ঠীর সেই পাহাড়ের দুর্গে বসে থাকা মাথা।এই লোকটির বা ওই সময়ের এই এসাসিন গোষ্ঠীর সদর দফতর হয়েছিল
ক্যাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে বর্তমান ইরানের আলমুট দুর্গ।পাহাড়ের উপরে এই দুর্গ ছিল এই গোষ্ঠীর প্রথমদিকের মানে একাদশ শতকে নিজেদের কারবার শুরু করার সময়ের দখল করা দুর্গ।এই জায়গাটি এতটাই দুর্গম ছিল ওই সময়ে যা ওটা কে ঈগলের বাসা ও বলা হতো।
এই এসাসিনদের রণ কৌশল :
উপরে যেমন বলেছি,এদের সুবিধে ছিল যে এরা কোনো সেনাবাহিনী গঠন করে আক্রমন করতো না।ছোট ছোট আত্মঘাতীর দল আক্রমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো ছুরি বা ওই ধরণের হাতিয়ার।মূল লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছাতে এরা ভিক্ষুক বা সন্ন্যাসীর(ওই সময়ের ফকির বা দরবেশ)ছদ্মবেশ ধরতো। আজকের সন্ত্রাসবাদী আক্রমনের মতোই এরাও ভিড়ের জায়গা বা কোনো উৎসবের সময়ে অনেক বেশি মানুষের মনে নিজেদের ছাপ ফেলতে আক্রমন করতো।হ্যা,আজকের মতোই এই আক্রমন করার পর এরা নিজেরাও জানতো যে আর প্রাণে বাঁচবে না।মানে এই লোকগুলো আত্মঘাতী আততায়ী বা আজকের ওই ফিদায়েন গোষ্ঠীর রূপ হিসেবে কাজ করতো।
এই ফিদায়েন বা আত্মঘাতী বাহিনী এই শেখ রাশিদ আল দিন্ এর জন্য প্রাণ দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকতো। পশ্চিমের বা আজকের মানুষ এই গোষ্ঠীর উপরে জানতে পারে ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকের অভিযাত্রী মার্কো পোলোর পর্যটনের সময়ের লেখা থেকে।এছাড়া একই সত্যতা উঠে এসেছিল ওই সময়ের এক চৈনিক সরকারী কর্মী এবং পর্যটক চ্যাং এর ঝিন সি বলে একটি পর্যটন বর্ননা থেকে।এই শেখ রাশিদ আল দিন্ কে সংক্ষেপে আলাদিন বলে ডাকা হতো।
কি ভাবে এই আত্মঘাতী বাহিনী তৈরী করতে কাজ করেছিল এই শেখ রাশিদ ?
এই কর্মকান্ড থেকেই আজকের ইসলামী জঙ্গি তৈরির একই সূত্র আপনি পাবেন।ওই আলোচিত দুর্গের পাশেই ছিল পাহাড়ে ঘেরা একটি সুন্দর উপত্যকা।এতে লোকটি একটি অপরূপ বাগান বানিয়েছিল যাতে ওই সময়ে যত রকম ফল পাওয়া যেত তার একটি বাগিচা বানিয়েছিল।একই সাথে সুগন্ধি ছড়ায় এমন সব গাছ দিয়েও ভরিয়ে দিয়েছিল ওই জায়গা।নানান আকারের প্রাসাদের মতো ঘর বাড়ি ও তৈরী করেছিল এই জায়গায়।এর সাথে এনে রেখেছিল সুন্দরী সব মেয়ে আর অন্য সেবকদের যাদের কাজ ছিল সেই সময়ের নানান বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চিত্তাকর্ষক গান বা অন্য আমোদ পরিবেশন করা।কাদের জন্য? একদল কিশোর বা যুবক যাদের এই শেখ 'তৈরী' করতো আত্মঘাতী বাহিনী বানানোর জন্য।হাসিস সেবন করিয়ে আধা চেতনায় এই জায়গায় এনে এদের একটি ইসলামী ধর্মের বেহেস্ত মানে জন্নত দর্শন আর উপভোগের সুযোগ করে দিয়ে মগজ ধোলাই করতো এই লোকটি।বলা হতো, এই বিনোদন ঐশী পদ্ধতিতে এই ধর্মগুরু এদের জন্য তৈরী করেছে যাতে বাস্তবিক অভিজ্ঞতা হয়।আর ওই আত্মঘাতী হামলা করে মারা গিয়ে শহীদ হলে এই উপভোগ অনন্ত হবে। ভাবুন,কি সুচারু এক পরিকল্পনা।পাচ্ছেন কি আজকের সাথে কোনো মিল ?
এই মগজ ধোলাই করার কিশোর বা যুবকদের ওই নিজের তৈরী জন্নতে দিন চার পাঁচেক রাখার পরে আবার এদের অজান্তে একই ভাবে আচ্ছন্ন করে নিয়ে আসতো নিজের কাছে।এই অজ্ঞ মানুষগুলো যখন তাদের এই সময়ের অভিজ্ঞতার সমন্ধে তাকে বলতো তখন তার উত্তর ছিল সে তাদের জন্নত দর্শন করিয়েছে।ইসলামের পথে তার দেখানো জেহাদে অংশ নিলে তাদের এই জন্নত পাওয়ার দরজা খুলে যাবে অনন্ত কালের জন্য তাদের মৃত্যুর পরে।
কিছু উল্লেখযোগ্য হত্যাকান্ড:
এদের নানান হত্যাকাণ্ডের মধ্যে প্রধানতম কয়েকটি হচ্ছে, একাদশ শতকের ইরাকের বাগদাদের এক শাসক বা নিজাম আল মূলক কে খতম করা।এছাড়া ভিন ধর্মী মানে খ্রিস্টান ধর্মের মাথা রেমন্ড দ্বিতীয়,ত্রিপোলির এক ধনাঢ্য জমিদার যারা ক্রুসেডের সময় খ্রিস্টান পক্ষকে সাহায্য করেছিল তাদের খুন করা।ত্রিপোলির ওই লোকটিকে মারার পরে ওই অঞ্চলে এক সার্বিক খুনোখুনি শুরু হয় কে এই মানুষটিকে মেরেছে তার ঝগড়ায়। এরপরে জেরুসালেমের নতুন নিযুক্ত এক রাজা কে দ্বাদশ শতকে দু দল এসাসিন একই সাথে এক রাতে আক্রমন করে খুন করে।এই ক্ষেত্রে এই আততাতয়ীরা সন্ন্যাসীর বেশে তৎকালীন ক্রুসেডের প্রধান ইংল্যান্ডের রিচার্ডের একটি নকল চিঠি দেখানোর অছিলায় তার দেহরক্ষী দলের থেকে আলাদা করে এই কাজ করে।এই সময়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে আরো একটা বিশেষ জিনিস হতে থাকে।এই ঘাতকরা এতটাই দক্ষ হয়ে ওঠে যে অনেক সময় হত্যাকারীকে সনাক্ত করাও মুশকিলের হতে থাকে।এর কারন এরা ঘটনার বেশিরভাগ জায়গা গুলো ভিড়ের মধ্যে বেছে নিচ্ছিল।এই সময়েই মসুল এর এক মাথা মওদুদ কে হত্যা করে যখন সে দামাস্কাস এর জামা মসিজদ থেকে নামাজ পড়ে সবার মধ্যে বেরিয়ে আসছিল।এই ক্ষেত্রে অবশ্য আততায়ী ধরা পড়ে যায়, ভিখারির বেশে মওদুদের কাছে ভিক্ষা চাওয়ার অছিলায় তার পেটে ছুরি মেরে মেরে ফেলার পরে।জনতা এই ঘাতক কে মাথা কেটে পরে পুড়িয়ে এর দেহ শেষ করে দেয় তবে এই আত্মঘাতী দল কত যে খুন করে চলেছিল তার কোনো ইয়ত্তা কেউ খুঁজে পায় না।এছাড়া এরা মক্কা নগরীর প্রশাসক কে মারতে গিয়ে তার মতোই দেখতে তার ভাইপো কে খুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এই এসাসিন বা আত্মঘাতী ঘাতক গোষ্ঠী আবার সেই সময়ে প্রচারের আলোতে আসে যখন এই ক্রুসেডের মুসলমান বাহিনীর নেতা সালাদিন কে প্রায় হত্যা করার কাজ করতে যায়।এই লোকটি মিশরের আর সিরিয়ার ওই সময়ের অধিপতি ছিল।সেই সময়ে নানান গোষ্ঠির বা সুন্নি মতের বাইরের ইসলামী গোষ্ঠীগুলোকে ক্রুশে হত্যা করার ফরমান দেওয়ার পরে এই ঘাতক গোষ্ঠীর কাছে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।প্রথমে ১১৭৫ এ ১৩জনের একটি দল চেষ্টা করে যদিও এরা সালাদিনের কাছে যাওয়ার সুযোগ পায় নি।এরপরে ১১৭৬ এ চার জনের একটি দল সালাদিনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় আর তার বর্মের উপর আঘাত আর তার মুখে ছুরি চালালেও প্রাণ হানির কাজ করতে পারে নি।স্বাভাবিক ভাবেই সালাদিনের দেহরক্ষীরা এদের ঐখানেই কতল করে।
এরপরে সালাদিন এদের পাল্টা আক্রমন করতে এদের ঘাঁটি মাসায়েফ আক্রমন করে দুর্গটিকে অবরোধ করে।মজার কথা হলো এই অবরোধ এক সপ্তাহ পরেই তুলে সালাদিন চলে যায়।এর কারন হিসেবে বলা হয় , এক রাতে ওই আত্মঘাতী দলের কোনো একজন বা একাধিক লোক এর তাঁবুতে ঢুকে সালাদিনের মাথার বালিশের নিচে একটা ছুরি রেখে যায় তাকে না মেরে।ইঙ্গিত দিয়ে যায় যে ইচ্ছা করলেই তারা তাকে খুন করতে পারে।একই ভাবে সেই সময়ের আলেপ্পো আর এডেসা নগরীর শাসক নুরুদ্দিনকে ও শাসিয়ে যায় এই গোষ্ঠী।আরো একটি কাহিনী প্রচলিত যে ওই আত্মঘাতী গোষ্ঠী সালাদিনের খাওয়ার একটি কেকে বিষ মিশিয়ে একটা চিঠিতে ওটা লিখেও যায় যে তাকে তাঁরা চাইলেই খতম করে দিতে পারে।আরো একটি কাহিনী প্রচলিত যে এই ঘাতকদের এক ধর্মীয় প্রতিনিধি সালাদিনের কাছে গিয়ে তার সব থেকে অনুগত দুই দেহরক্ষীকে প্রশ্ন করে যে ওই ইসমাইলি গুরুর আদেশে কি এই দুই দেহরক্ষী তাদের সুলতান কে খতম করবে? উত্তর আসে হ্যা!কাহিনী যাই হয়ে থাক,একটা বিষয় যে এই গোষ্ঠী নানান ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকে গিয়েছিল।
এরপরে সালাদিন একটি আপোষ করার চুক্তি করে এই গোষ্ঠীর সাথে।একই সাথে এই সময়ে নানান ধর্মের বা গোষ্ঠীর সব মাথা বা রাজারা নিজেদের উপরের পোশাকের ভিতরে সুরক্ষার বর্ম পরিধান করা শুরু করে। খোদ সালাদিন তাবুতে না থেকে আলাদা কাঠের বহন যোগ্য ঘর সঙ্গে নিয়ে নানান যুদ্ধের জায়গায় যাওয়া শুরু করে আর একান্ত পরিচিত কেউ না হলে তাকে তার কাছে আসতে দেওয়া বন্ধ করে।পাঠক,সন্ত্রাসের সেই সময়ের রূপ সমন্ধে ধারণা পেলেন?
এসাসিন বা এই গুপ্তঘাতকদের অন্তিম পরিণতি
প্রবাদ আছে , লোহা দিয়েই লোহা কাটা যায়।ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি প্রবল পরাক্রান্ত মঙ্গোলরা যখন পরিচিত সব অঞ্চলেই তাদের আধিপত্য বজায় করছে ঠিক ওই সময়ে মোঙ্গি খান ,এই মঙ্গোল সাম্রাজ্যের ওই সময়ের সম্রাট তার ছোট ভাই হালাকু খান কে ইরানের প্রধান করে সাম্রাজ্য পশ্চিমে বিস্তার করতে বলে। হালাকু সফল ভাবে একের পর এক দেশ জয় করে আর পথে এই এসাসিনদের ঘাঁটি গুলো শেষ করতে থাকে।এসাসিন বা এই ইসমাইলি গোষ্ঠী একটা বড় ভুল করেছিল মঙ্গোলদের কয়েকটি সেনা প্রধানদের উপরে এর আগে গুপ্ত ঘাতক দিয়ে হামলা করিয়ে।এর আগে ইরানের চাগতাই অঞ্চলের প্রধানের উপরে হামলা করার সময়েই এদের খতম করার জন্য ভেবে নেয় মঙ্গোলরা।একসময়ে অপরাজেয় ভাবা এই এসাসিনদের হালাকু খান হারিয়ে দেয় ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে।শুধু তাই না,এদের একের পর এক কুখ্যাত ডেরা মানে দুর্গ ও দখল করতে থাকে এই হালাকু।
এই সাফল্যের কারণ ও সেই প্রযুক্তির উন্নতি।সেই সময়ে যুদ্ধের জন্য চলে আসে বিশেষ যুদ্ধ গুলতি যা আজকের মিসাইলের মতো অগ্নি বর্ষণ বা সামগ্রিক ধ্বংস সাধন করতে সক্ষম ছিল।মঙ্গোলরা এদের দুর্গে হামলা করতে আসে পাশের পাহাড়ে ওই গুলতি বা শক্তিশালী বিশেষ ধনুক দিয়ে টানা আক্রমন করা শুরু করতো। হালাকু এক পর্যায়ে এদের প্রধান ঘাঁটি আলমুট এর দুর্গ পর্যন্ত দখল করে নেয়।
এক পর্যায়ে এদের পালের গোদা ওই রুকন আল দ্বীন কে ধরে ফেলে আর ওই দুর্গ গুলোর পাশে নিয়ে ভিতরে থাকা বাকি জঙ্গি লোকদের মনবল ভেঙে দেয়। এরপরেই ওই আল দ্বীন কে কান ধরে নিয়ে যায় মঙ্গোল রাজধানী কারাকোরাম এ। মঙ্গোল রাজা জন সমক্ষে এই লোকটির দুর্দশা দেখিয়ে আবার ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়।ফেরার পথে এই আল দ্বীন কে কতল করিয়ে দেয় কোনো রাজনৈতিক সমাধানের তোয়াক্কা না করেই প্রসঙ্গত এই আল দ্বীন নিজেও একই কাজ করে এসেছিল আর তার পরিণতি ও হয়েছিল নিজের পথেই। মোঙ্গি খান কে হত্যার জন্য এই আল দ্বীন নিজেও এর আগে প্রায় চারশো বার ঘাতক বাহিনী পাঠিয়েছিল সুতরাং মঙ্গোলরা এর পাল্টা ব্যবস্থা নেবে ওতে কোনো আশ্চর্যের কি?মঙ্গোলরা শত্রুর শেষ রাখতো না।
মঙ্গোলরা চরম নির্মম তাই এই মাথা কে সরিয়ে দেওয়ার পরে একের পর এক আত্মঘাতী ইসমাইলি এই গোষ্ঠীর দুর্গ দখলের সময়ে দুর্গে থাকা লোকদের মানে স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে খতম করে দেয় আর যে কটি ভাগ্যবান কোনো ভাবে বেঁচে যায় তাদের ভাগ্যে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া হয় পরিণতি।এক পর্যায়ে পুরো পারস্যে এরা নির্মূল হয়ে যায়।দু একটি দুর্গ সিরিয়ায় ধরে রাখতে পারলেও পরবর্তীতে এই নিজারি ইসমাইলি গোষ্ঠীর ওই সব দুর্গ আক্রমন করে মিশর আর সিরিয়ার সেই সময়ের সুলতান আল জাহির এবং ওই জায়গাগুলো ও হাতছাড়া হয়।মোটামুটি ১২৭০ এর মধ্যে প্রায় সব দুর্গ এদের হাতছাড়া হয়ে যায়। মঙ্গোলরা যদিও এদের মূল দুর্গের মানে আলমুট দুর্গের গ্রন্থাগারের পুঁথিগুলো ধ্বংস না করলেও পরবর্তীতে এই অঞ্চলের মূল সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায় এইগুলো পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।এর ফলে এদের কার্যপদ্ধতি বা অন্য বিশ্বাস ইত্যাদির উপরে আজকের ইতিহাসবিদ বা সম্পর্কিত পন্ডিতদের গবেষণার কোনো অবকাশ থাকে না।
এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি, অনেক সহি মানুষের বড় ঘৃণার জায়গা এই ভারত কিন্তু এর পরেও এই ইসমাইলি গোষ্ঠীর একটি অংশ কে নিজের ভূমিতে আশ্রয় দিয়েছে,যে ভাবে অন্য সব ধর্মের মানুষ এই সর্বংসহা দেশে আশ্রয় পেয়েছে।
আজকের নিজারি ইসমাইলি গোষ্ঠীর মানুষরা কিন্তু একদম অন্য ধরণের।এদের ধর্মীয় মাথা যেমন প্রিন্স শাহ করিম বা বিখ্যাত আগা খান(এক দুই করে অনেক ক্রমিকে এখন চতুর্থ ) বরং দানবীর বা অনেক দেশের কাছে এই টাকা পাওয়ার কারণে বেশ সম্মানের লোক।
লেখাটির মূলত বর্ননামূলক হলেও একটা অন্তর্নিহিত বার্তা আছে,অনেক পাঠকের ধারণা যে এই আজকের সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি বোধহয় স্যাম চাচা বা তার গোষ্ঠির কারণেই হয়।না,একদম ভুল, বাগদাদী থেকে অন্য যত প্রাণী আছে তাদের শুরুর জন্য কাল্পনিক বা অন্য ধর্মের মানুষের উপরে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হলো উটপখির মতো মুখ ঢুকিয়ে নিজের সাথে প্রতারণা করা।আমার অল্প বুদ্ধিতে যা বুঝি তা হলো,কিছু স্নেহান্ধ মানুষ যেমন বলে “আমার কালু বা কলিমুদ্দিন বড় ভালো লোক,পাশের বাড়ির সামু বা সামসুদ্দিন ওকে খারাপ করেছে” এদের জন্য একটাই কথা,ভুবন তৈরী করলে ভুবনের মাসি হিসেবে আপনার কান আগে কাটবে সেই ভুবন।সুতরাং আত্মপ্রবঞ্চনা বা অন্য কে প্রবঞ্চনা করার অভ্যেস ত্যাগ করুন।
লেখার তথ্যসূত্র :
১. স্বল্পে বর্ণিত এদের ইতিহাস http://www.historyworld.net/wrldhis/PlainTextHistories.asp…
২. এই সুত্রে ও দেখতে পারেন তবে আমি এই সূত্র ঠিক মিলিয়ে দেখি নি https://www.nationalgeographic.com/…/nizari-ismaili-muslim…/
৩. এই জায়গায় ও দেখতে পারেন https://www.thoughtco.com/history-of-the-assassins-hashshas…
৪. আরো কিছু https://www.historynet.com/holy-terror-the-rise-of-the-orde…
৫. ভালো বর্ননা আর কিছু ছবির সূত্র এই জায়গা ছিল https://todayinhistory.blog/tag/nizari-ismaili/
 
 
 
   কুমার কুণ্ডু
প্রণব কুমার কুণ্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন