বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক অশোকবিজয় রাহা


  কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক অশোকবিজয় রাহা 

  ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন            প্রণব কুমার কুণ্ডু



প্রণব কুমার কুণ্ডু













কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক
অশোকবিজয় রাহা (জন্মঃ- ১৪ নভেম্বর, ১৯১০ - মৃত্যুঃ- ১৯ অক্টোবর, ১৯৯০) (সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান অনুযায়ী)

দেশবিদেশের বহু সাহিত্যপত্র এবং সংকলন গ্রন্থে কবির প্রায় পঞ্চাশটির মতো কবিতা হিন্দী, ইংরেজী, ফরাসী ও স্পেনীয় ভাষায় মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন অশোকবিজয় এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও একসময় সজনিকান্ত দাসের শনিবারের চিঠিতে তাঁর ‘ভানুমতীর মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের ভূয়সী প্রসংশা করেন; রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তরুণ চাঁদ বলে অভিহিত করে লিখেছিলেন..."আকাশের চেয়ে আলোক বড়, /মাগিল যবে তরুণ চাঁদ/রবির কর শীতল হয়ে/করিল তারে আশীর্বাদ।"-অশোকবিজয় রাহার কবিতার চরাচর জুড়ে নিসর্গ প্রকৃতির চিত্রবর্নণা, যেখানে নৈঃশব্দ্যটুকুও ভরে যায় মায়াপ্রকৃতির বিস্ময়ে। মায়াতরু” কবিতাটি রচনার দ্বারা এই রূপদক্ষ কবির কাব্যরচনায় শিল্পকর্মের নিদর্শন পাওয়া যায়।
কবি শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্গত ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে ভুমিষ্ঠ হন। তাঁর পিতার নাম বঙ্কবিহারী রাহা, পেশায় ইনি ছিলেন কাছাড়ের চা বাগানের কর্মী এবং মাতার নাম হল ব্রহ্মময়ী দেবী। পিতা চা বাগানের কর্মী ছিলেন বলে এই খ্যাতনামা কবির শৈশবকাল কাছাড়ে আদিম বনানী পরিবেশে অতিবাহিত হয়। এই খ্যাতনামা কবি কৈশোরে কাকার নিকটে শ্রীহট্ট শহরে আগমন করে এই শহরেরই মধ্যস্থিত ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই শহরের মধ্যস্থিত মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে আই. এ., কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 1931 সালে অনার্সসহ বি. এ. এবং 1947 সালে বাংলা সাহিত্যে এম. এ. পাশ করেন। এই খ্যাতনামা কবি 1932 সাল থেকে 1951 সাল পর্যন্ত শ্রীহট্ট এবং করিমগঞ্জের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও অধ্যাপনা করে অবশেষে 1951 সালে বাংলার অধ্যাপক হিসাবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। দীর্ঘ চব্বিশ বছর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র - অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করার পর 1974 সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহন করে শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীতে নিজের তৈরী” সুরাহা” নামক বাসভবনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বসবাস করছেন। এইস্থানেই কবির দেহাবসান হয়।

এই শ্রদ্ধেয় কবি 1966 সালে বিশ্বভারতীর প্রতিনিধি হিসাবে সোভিয়েট ল্যাণ্ড নেহেরু অ্যাওয়ার্ড কমিটির আমন্ত্রণে রাশিয়ায় গমন করে রবীন্দ্রনাথ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভাষণ প্রদান করেন। এই শ্রদ্ধেয় কবি কিশোর বয়সেই কাব্যরচনা আরম্ভ করেন, তার রচিত প্রথম কবিতা শ্রীহট্ট থেকে প্রকাশিত” কমলা” পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। এই শ্রদ্ধেয় কবির রচিত দুইটি কাব্যসংকলন” ডিহাং নদীর বাঁকে” এবং” রুদ্রবসন্ত” শ্রীহট্ট থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 1941 সালে প্রকাশিত হলে কলকাতার কাব্যরসিক সমাজ বিস্মিত ও চমকিত হয়। 1942 সালে কবি বুদ্ধদেব বসু তার “এক পয়সার সিরিজে” এই শ্রদ্ধেয় কবির দ্বারা রচিত” ভানুমতীর মাঠ” প্রকাশ করে এই কবিকে একবারে প্রথম সারির কবি হিসাবে অভিনন্দিত করেন। এই প্রথিতযশা কবি দশটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। সেই কাব্যগ্রন্থগুলির নাম হল -- ডিহাং নদীর বাঁকে (1941), রুদ্রবসন্ত (1941), ভানুমতীর মাঠ (1942), জল - ডম্বরু পাহাড় (1945), রক্তসন্ধ্যা (1945), শেষচুড়া (1945), উড়োচিঠির ঝাঁক (1951), যেথা ঐ চৈত্রের শালবন (1961), ঘন্টা বাজে : পর্দা সরে যায় (1981) এবং পৌষফসল (1983)। জীবনানন্দের জগৎ, রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা, গীতিকাব্যে রবীন্দ্রপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি এই প্রথিতযশা কবির উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। এই মহামান্য কবির রচিত” বাণীশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ” একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ। এই মহামান্য কবি তার কাব্যগুলিতে নদী, পাহাড়, অরন্য ও প্রকৃতির অপরূপ শোভারাশির বর্ণাঢ্য চিত্র অঙ্কন করেছেন। অভিনব রূপকল্প নির্মাণে বাংলা সাহিত্যজগতে এই মহামান্য কবির সমকক্ষ কবি খুব একটা চোখে পড়ে না।

একটি সন্ধ্যা
বেতারে কার সেতার বাজে, বাংলা খবর শেষ,
শুনে শুনে পথ দিয়ে যাই, মনে সুরের রেশ,
মফস্বলের শহরতলি খানিকটা বন –ঘেঁষা,
ঝোপে ঝাড়ে সন্ধ্যা নামে বুনো গন্ধে মেশা,
বাঁকের মোড়েই হঠাৎ আসে রাঙা মাটির টিলা
ওর পিছনে উঁকি মারে পাহাড়টা একশিলা,
শেয়াল-ডাকা রাত্রি আসে যেই আসি ওর কাছে,
বাদুরগুলো ঝাপটা মারে কাক-ডুমুরের গাছে,
মাথার উপর ডাকল পেঁচা, চমকে উঠি—আরে!
আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে!
~~~~০০০~~~~
শীত-রাত
গ্রাম-বুড়ী কাঁথামুড়ি খড়ের ধোঁয়ায়
নাক ডেকে ঘাড় গুঁজে বেজায় ঘুমায়,
পথঘাট ঘুমে কাঠ, কোথা নেই সাড়া,
এক পায়ে ঘুম যায় গাছপালা খাড়া,
ঝোপে ঝোপে শেয়ালেরা সব চুপচাপ,
শিশিরের ফোঁটাগুলি ঝরে টুপটাপ,
ইঁদুরের বাদুড়ের নেই খুট্খাট,
একধারে শুয়ে আছে ধান-কাটা মাঠ।
বটগাছে কেঁদে ওঠে শকুনের ছা
জেগে উঠে পাখসাট মারে তার মা,
একা একা কুয়াশায় এই শীত-রাতে
কানা চাঁদ ভাঙা এক লণ্ঠন হাতে
আদম পুরের দিকে চালিয়েছে পা।
~~~~০০০~~~~
মায়াতরু
এক যে ছিল গাছ
সন্ধ্যে হলেই দু হাত তুলে জুড়ত ভূতের নাচ।
আবার হঠাৎ কখন
বনের মাথায় ঝিলিক মেরে মেঘ উঠত যখন
ভালুক হয়ে ঘাড় ফুলিয়ে করত সে গরগর
বিষ্টি হলেই আসত আবার কম্প দিয়ে জ্বর।
এক পশলার শেষে
আবার কখন চাঁদ উঠত হেসে
কোথায়-বা সেই ভালুক গেল, কোথায়-বা সেই গাছ,
মুকুট হয়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ হীরার মাছ।
ভোরবেলাকার আবছায়াতে কাণ্ড হত কী যে
ভেবে পাইনে নিজে,
সকাল হল যেই
একটিও মাছ নেই,
কেবল দেখি পড়ে আছে ঝিকিরমিকির আলোর
রুপালি এক ঝালর।
~~~~০০০~~~~
একটি চলচ্চিত্র
জানালায় বসে বসে দেখি চেয়ে চেয়ে
ছোট্ট তারাটি নামে মেঘ-সিঁড়ি বেয়ে,
সেতারের দ্রুত তালে নাচে তার পা,
সন্ধ্যার সরোবরে ধুয়ে যাবে গা,
চোখে মুখে হাসি তার করে ঝলমল,
ছোট ছোট হাত দুটি ভারী চঞ্চল,
ঝলকায় মণিহার, চমকায় দুল,
দুটি গালে নাচে তার ফুরফুরে চুল,
সিঁড়ি বেয়ে নেমে নেমে এলো শেষ ধাপ,
হাত তুলে এইবার জলে দিল ঝাঁপ,
একটু সাঁতার কেটে ডুব দিল- টুপ,
সন্ধ্যার সরোবর একেবারে চুপ।
~~~~০০০~~~~
ভাঙল যখন দুপুরবেলার ঘুম
ভাঙল যখন দুপুরবেলার ঘুম
পাহাড় দেশের চারদিকে নিঃঝুম
বিকেলবেলার সোনালি রোদ হাসে
গাছে পাতায় ঘাসে।
হঠাৎ শুনি ছোট্ট একটি শিস,
কানের কাছে কে করে ফিসফিস?
চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি,
এ কী !
পাশেই আমার জানলাটাতে পরীর শিশু দুটি
শিরীষগাছের ডালের পরে করছে ছুটোছুটি।
অবাক কান্ড- আরে !
চারটি চোখে ঝিলিক খেলে একটু পাতার আড়ে !
তুলতুলে গাল, টুকটুকে ঠোঁট, খুশির টুকরো দুটি
পিঠের পরে পাখার লুটোপুটি,
একটু পরেই কানাকানি, একটু পরেই হাসি-
কচি পাতার বাঁশি-
একটু পরেই পাতার ভিড়ে ধরছে মুঠি-মুঠি
রাংতা আলোর বুটি।
এমন সময় কানে এলো পিটুল পাখির ডাক,
একটু গেল ফাঁক-
~~~~০০০~~~~
সমুদ্র স্বপ্ন
হঠাৎ সমুদ্র থেকে লাফ দিয়ে ওঠে এক চাঁদ
‘কি আশ্চর্য ! দেখো দেখো !
(সুজাতার দু’চোখে বিস্ময়!)
‘এমন প্রকান্ড চাঁদ দেখেছ কখনো?’
(সুজাতার দু’চোখের তারা
কী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে !)
‘এমন প্রকান্ড চাঁদ?- না তো !’
(হঠাৎ চাঁদের দিকে গলুই ফেরাই)
সত্যিই সেদিন
সমুদ্রে চাঁদের স্বপ্ন, সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে চাঁদ,
চাঁদের চেয়েও বড়ো আরেক বিস্ময়
ছিল তার দুটি চোখে
আমি তা দেখেছি !
সে দিনের রূপালি জ্যোৎস্নায়
ছিপ ছিপ দাঁড় ফেলে ফেলে
জলের ঝালর ছিঁড়ে ছিঁড়ে
চলে গেছি বহু দূরে – সুজাতা জানে নি কিছু তার,
সুজাতার চোখে ছিল চাঁদ,
আমারো দুচোখে ছিল আরো এক স্বপ্নজাল-ফাঁদ
দুজন দুখানে বন্দী !
সে-সমুদ্র, সেই চাঁদ কত দূরে চলে গেছে আজ !
একবার গলুই ফেরাই,
নিরেট চাঁদের মুখে চাই,
কী ঠান্ডা পাথর চাঁদ! বরফের মতো সাদা মুখ !
এ-চাঁদের মুখে চেয়ে সমুদ্র পাথর হয়ে গেছে।
বহুক্ষণ চুপ করে দেখি,
(সমুদ্র পাহাড় চাঁদ স্থির হয়ে আছে
পাথরে খোদাই,
দেহের শ্রায়
রক্তে ঝিঁঝিঁ ডাকে!)
হঠাৎ একটগু দূর ও দিকের খাঁড়ির কিনারে
যেখানে সমুদ্র জলে ডুবে আছে পাহাড়ের লেজ-
কারা হাসে?
(কারা যেন আসে, )
ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয় কথা,
একটু পরেই
ডানা-মেলা সাদা হাঁস-ছুটে আসে ছোটো সে শাম্পান !
‘দেখো, দেখো, কী সুন্দর চাঁদ !
এমন প্রকান্ড চাঁদ দেখেছ কখনো ?’
তরল রূপালি কন্ঠে সুর বাজে জলের মতন-
ডানা-মেলা সাদা হাঁস তীর বেগে উড়ে যায় দূরে !
দাঁড় হাতে চুপ করে থাকি
নিরেট চাঁদের মুখোমুখি
ঈশ্বরের মতো বোবা !
~~~~০০০~~~~
এরা
গেরুয়া পথের ধারে একদল তামাটে মানুষ
পাথরে হাতুড়ি পেটে এই সারা চৈত্রের দুপুর,
ধূলা শুঁকে শুঁকে এসে চেয়ে যায় একটি কুকুর,
পাশ দিয়ে ছেঁড়া-ছাতা হেঁকে যায় ‘সেলাই-বুরুশ’।
বিশাল মোটর এক দিয়ে যায় ধমক প্রচুর,
হঠাৎ ঝলকে চোখে কোনো এক সোনার ঈগল,
চিলের চিৎকার মেশা ঝলসানো রোদের পিতল
ভাঙা বাসনের ডাকে দিয়ে যায় ঝন ঝন সুর।
দিনের উজ্জ্বল ভিড় একবার গিয়েছে সকালে,
আরবার দেখা দেবে বিকেলের সোনালি আলোয়,
এদের হাতুড়ি পেটা তখনো চলছে একতালে
আকাশের ইঁটের রঙ যতক্ষণ ধূসর না হয়,
তারপর ঘাম যত ঝরে ঝরে রয়েছে কপালে
শেষবার মুছে যাবে খালি হাতে বাদামী চেটোয় !
~~~~০০০~~~~
মাঝরাতে
মাঝরাত
অন্ধকার ঘর
দেওয়াল ঘড়ির ঠক ঠক
টেবিলে আবছা বুদ্ধমূর্তি।
ঘুম আসে না তা
শুয়ে শুয়ে ভাবে প্রবাসের দিনটা
ভোরবেলা কোথা থেকে এসেছিল সেই ফুটফুটে শিশু-
দরজা দিয়ে বাড়িয়েছিল টুকটুকে মুখ?
চোখে ভাসে আমবাগানের সেই কিশোর
কাঠবেড়ালীর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে সমস্ত সকাল,
দুপুরবেলা এসেছল সেই তরুণ-তরুনী
ছেলেটির হাত বাঁশি, মেয়েটির কানে শিরীষফুল
যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে দুজনে-
এরা সব গেল কোথায়?
আর বিকেলবেলার সেই দরবেশ
সারঙ্গী বাজিয়ে গেয়েছিল একটা ভজন
কী যেন ছিল কথাগুলি-
আর ভাবতে পারে না সে
শরীরে একটা ঝিমঝিম অবসাদ
মাথার ভিতরে ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশা
বুদ্ধমূর্তিটা মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে
ক্ষীণ হয়ে আসছে ঘড়ির শব্দ
জানালায় চুপ করে চেয়ে আছে কালপুরুষ।
~~~~০০০~~~~
গলির মোড়ে
ছেঁড়া চট, ফুটো মগ, ভাঙা সানকি
পাশে হাঁ করে পড়ে আছে এক চামড়া ঢাকা কঙ্কাল
থমকে দাঁড়াই
চুপ করে ভাবি;
পথের ধার পথেই শোধ
কবে শোধ হবে ওর কাছে মানুষের ঋণ?
বড়ো রাস্তায় ট্রাফিকের ভীড়
অবিরল জনস্রোত
বিকেলের ভাটার টান, -
হঠাৎ এ কী,
আমি কি সত্যি দেখছি?
ওর টাকরায় চিকচিক করছে পড়ন্ত রোদ
হাঁ-করা মুখে একটা অদ্ভুত হাসি
অদ্ভুত, অদ্ভুত হাসি-
ও কি শুনতে পাচ্ছে একালের মৃত্যুঘন্টা?
~~~~০০০~~~~
প্রতীক্ষা
একটি আলোর পাখি ধরা দেবে বলে
বসে আছি।
বিকালের দেবদারু গাছে
জড়ালো সোনার জাল-
কিছু সুতো জড়ায়েছে মেঘে
কিছু ঘাসে।
একপাশে মেহেদির ছায়া
চুপিসারে বুকে হাঁটে,
বুটি-কাটা পেয়ারার ডালে
লেগে আছে লাল গিরগিটি,
বাখারি বেড়ার গায়ে পিলপিল পিঁপড়ের সারি।
টিক টিক চলেছে সময়...
হঠাৎ পাখার ঝটপট
কান পেতে চারদিকে চাই
গেটের কিনারে
দুলে ওঠে জুনিপার গাছ
একটু পরেই
ক্রোটনের ঝোপ থেকে ছুটে আসে খিলখিল হেসে
একটি মিকির মেয়ে
চোখে মুখে খুশির ঝলক
বুকে দুটি তিতিরের ছানা।
~~~~০০০~~~~
নেপথ্য সংলাপ
দৃশ্যপট ; বিকেলের নির্জন খোয়াই। পিছনে র ক্তরঙের আকাশ। দূরে একটা মাথাভাঙা তালগাছ। কুশীলবঃ দুটি অদৃশ্য কন্ঠস্বর।
কী খবর?
ভাল।
হাসছ যে?
চোরাই পথে ঢুকে পড়েছিলাম ওদের ঘাঁটিতী।
সেঁধিয়ে গিয়েছিলাম ওদের বুদ্ধির গোড়ায়
নেড়ে দিয়ে এলাম কলকাঠি।
তারপর?
আর ভাবতে হবে না আমাদের
এবার নিশ্চিন্ত।
বলো কী?
কী হারে বাড়ছে ওদের সংখ্যা, জানো?
জানি; ওটা বাইরের ছবি
ভিতরে উলটো পাকে ঘুরছে চাকা
ওরা ফিরে যাচ্ছে পিছনের দিকে।
তার মানে?
এখন ওরা ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির, গর্তে সাপ।
ওরা আজ ডানা মেলে উড়ছে আকাশে
সে খবর রাখো?
সে তো চোখেই দেখে এলাম
দিনরাত শূন্যে টহল দিচ্ছে রাক্ষুসে শকুন
শুধু নিচের আকাশে নয়
ল্যাজের ঝাপটায় ঠেলে উঠছে মহাকাশে।
তবে?
তাতে কী?
ওদের নিজের মধ্যেই চলেছে রেষারেষি
শুরু হয়ে গেছে খেয়োখেয়ির পালা।
সত্যি তাই?
ঠিকই বলছি।
কিন্তু থাক, সে কথা, - একটা কান্ড হয়েছে এদিকে।
কী শুনি।
সেই আদ্যিকালের আপেলের বিচি
এখনো গিজগিজ করছে এদের পেটে
সেগুলো চাঙা করে এসেছি এবার।
ফল হয়েছে তাতে?
বিলক্ষণ,
এখন ঘরে-বাইরে পথে-ঘাটে-
বুঝেছি।
ওহো, ভুল হয়ে গেছে একটা-
কী হলো?
এসব অন্ধকারে মানায় ভাল, - যাই
সূর্যটাকে নিবিয়ে আসি।‘
হঠাৎ হু হু কর ছুটে যায় একটা দমকা হাওয়া। উপর থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে একটা কালো পর্দা। কিছুক্ষণ সব চুপ। একটু পরে শুরু হয় ঝিঁঝির ঐকতান।
দুর্বোধ্য
লোকটা কেন যে এল
কেন চলে গেল
বোঝাই গেল না,
রেখে গেল একমুঠো ছাই
সেও হুস হাস
নিয়ে গেল দমকা বাতাস।
~~~~০০০~~~~
ভানুমতীর মাঠ
জ্বলন্ত ঘাসের শিখা- ধূ ধূ লাল সূর্যাস্ত-আগুন, -
ধসানো ইটের পাঁজা একাধার অট্টহাসি হাসে,
চারদিকে পোড়া মাটি-খাঁ খাঁ করে দুর্ভিক্ষের মাঠ,
একধারে ছায়া ফেলে ভাঙা-পাড় নদীর কঙ্কাল।
ভাঙা মন্দিরের গায়ে বটের ঝাঁকড়া মাথা থেকে
হঠাৎ টিকির মতো উড়ে যায় আগুনের পাখি,
আকাশের ডিমে বসে ডাকে এক অদ্ভুত টিট্রিভ,
মাটির ঢিবির গায়ে জ্বলে ওঠে তুবড়ির আলো।
পৃথিবীর হৃদপিন্ড এইখানে ডিমি ডিমি বাজে
পড়ো জমি স্বপ্ন দেখে চষা মাঠ ফসলের ক্ষেত,
মরা নদী উড়ে চলে স্ফীত পালে জলের যৌবনে
দূর থেকে ভেসে আসে মসৃণ দিনের কোন সুর।
পৃথিবীর হৃদপিন্ডে শুনি বসে বহু রূপকথা,
এইখানে একদিন হাড় থেকে হবে মায়াপুরী,
উজ্জ্বল বৃষ্টির হাসি একরাশি ঝরাবে হঠাৎ-
নূতন আলোর বীজে বোনা হবে নূতন ফসল।
সেদিন বিকেলবেলা এইখানে নদীর কিনারে
যে-সকল ছেলেমেয়ে চোখে মুখে ছড়াবে আলোক
রামধনু-রঙ-আঁকা মুঠি মুঠি তাদের ঝিনুক
দু’হাতে ছিটায়ে যাবে-হবে চন্দ্রমল্লিকার বন।
অপরূপ রূপকথা- তবু বসে কান পেতে শুনি-
এইখানে ভানুমতী মন্ত্র পড়ে জাদুকাঠি হাতে,
ছায়া হয়ে একদিন মিলায়েছে অনেক দানব,
হাড়ের বিছানা-লে রাক্ষসেরার গিয়েছে লুকায়ে।
ইটের পাঁজার ধারে সব শেষে এসেছিল যারা
তারাও ইঁটের গায়ে মিশে গেছে অট্টহাসি হয়ে,
ঘুমায় ঢিবির নিচে সিংহাসনে বত্রিশ পুতুল,
নূতন কালের তা’রা অন্তরীক্ষে কোলাহল করে।
~~~~০০০~~~~
ব্যক্তমধ্য
ব্যাপারটা কী?
কোথাও কিছু নেই
হঠাৎ ছোট একটা বিন্দু
তারপর বিরাট আকার
প্রচন্ড হুংকার –
‘অয়মহম ভো।‘
তারপর আবার ছোট একটি বিন্দু
তারপর কিছু নেই।
~~~~০০০~~~~


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন