শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

জগন্নাথধামে চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধান রহস্য


   জগন্নাথধামে চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধান রহস্য:

প্রণব কুমার কুণ্ডু

 

 ফেসবুক থেকে       শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু



রানা চক্রবর্তী একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন৷


জগন্নাথধামে চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধান রহস্য:

(তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আমি গবেষক নই সুতরাং এ লেখার কোনও কথা আমার কথা নয়। লেখক পরম শ্রদ্ধেয় ড.শান্তিকুমের দাশগুপ্ত ও নির্মলনারায়ণ গুপ্ত, এঁরা দুজনেই চৈতন্যগবেষক। তাঁদেরই গবেষনার ফসল ‘পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, প্রকাশক-রত্নাবলী, কলকাতা।

উক্ত গ্রন্থ থেকে বিষয় অবিকৃত রেখে কখনও ভাষা ও বানান পরিবর্তন, কখনও সম্পাদনা করে তাদের কথা আমার ভাষায়, আবার কখনও তাঁদের কথা হু-বহু তাঁদেরই ভাষায় তুলে দিলাম। গবেষনামূলক এ লেখার প্রশংসা গবেষক লেখকদ্বয়েরই প্রাপ্য। লেখক আন্তরিক শ্রদ্ধাসহ কৃতজ্ঞ রইল গ্রন্থলেখক ও তাঁর পরিবার এবং প্রকাশকের কাছে।)
● ছবিতে- নদীয়া জেলার নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরে (মহাপ্রভু বাড়ি), শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বিতীয় স্ত্রী, শ্রীমতী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী কর্তৃক নির্মিত, স্থাপিত ও পূজিত, দারু (নিম) কাঠের তৈরী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর বিগ্রহ।

নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরেই নিত্য পূজিত হন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত মহাপ্রভুর মূর্তি। কথিত রয়েছে, যে মূর্তি বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী নির্মাণ করান চৈতন্যদেবের জীবিত কালেই। সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেবের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর আর কখনও দেখা হয়নি। কথিত আছে, বিরহকাতর বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চৈতন্যদেবের একটি মূর্তি নির্মাণ করান। সেই বিগ্রহের সেবাপুজো নিয়েই তিনি বাকি জীবন কাটান। চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এর তিন বছর পরে ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয় যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি। মূর্তির পাদপীঠে খোদাই করা আছে “১৪৩৫ শক, বংশীবদন”। অনুমান, বংশীবদন নামের এক শিল্পী এই মূর্তির রূপকার। সারা বিশ্বের বৈষ্ণবভক্ত নবদ্বীপে ছুটে আসেন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত এই ধামেশ্বর মহাপ্রভুর টানে।

বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী জীবিত কালে ওই বিগ্রহের পুজোর জন্য বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর নবদ্বীপের গঙ্গার তীরে কালো পাথরের মন্দির নির্মাণ করান। কালের গ্রাসে সে মন্দির গঙ্গা গর্ভে চলে যায়।

নবদ্বীপের বর্তমান মহাপ্রভু মন্দিরের ইতিহাস প্রসঙ্গে গোস্বামী বংশজাত অধ্যাপক প্রদ্যোতকুমার গোস্বামী তাঁর “নবদ্বীপের সমাজ এবং সংস্কৃতি” বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখছেন, “১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন মহাপ্রভুর মধ্যাহ্ন ভোগের পর মহাপ্রভুর মন্দিরে প্রবেশ করে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী অপ্রকট হলেন।” ওই বই অনুসারে বিগ্রহের সেবাপুজোর দায়িত্ব পেলেন ভ্রাতুষ্পুত্র মাধবাচার্য। তাঁর মৃত্যুর পর পুজোর দায়িত্ব বর্তায় জ্যেষ্ঠপুত্র ষষ্ঠীদাসের উপর। এই সময় থেকেই সমস্যা শুরু হল। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ মহাপ্রভুর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার করেন। শক্তির উপাসকেরা মহাপ্রভু মূর্তি পুজোর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। এমনকি তৎকালীন নদিয়ারাজের কাছে অভিযোগ জানান। এই অবস্থায় অন্য ভায়েরা মহাপ্রভুর মূর্তি পুজোর অধিকার ত্যাগ করলে ষষ্ঠীদাস মালঞ্চপাড়ায় একটি পর্ণকুটিরে গোপনে ওই মহাপ্রভু মূর্তির সেবা পুজোর ব্যবস্থা করেন। “নবদ্বীপের সমাজ এবং সংস্কৃতি” বই অনুসারে, মহাপ্রভুকে পুজো করার অপরাধে গোস্বামীরা সমাজচ্যুত হলেন। তখন নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার এবং মহাপ্রভু মূর্তি রক্ষার তাগিদে দক্ষিণা কালিকার মূর্তিস্থাপন করে পুজো করতে লাগলেন। কালী মন্দিরের নীচে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে ঘিয়ের প্রদীপ দিয়ে মহাপ্রভুর সেবা পুজো করতে লাগলেন কোনও রকমে।”

কিন্তু সে সময়ে মালঞ্চপাড়া ভাগীরথীর জমা জলে বছরের বেশির ভাগ সময়ে জলাকীর্ণ হয়ে থাকত। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে পরম বৈষ্ণব দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ তোতারাম দাস বাবাজীর তৎপরতায় তৈরি হয় একটি পশ্চিমদ্বারী মন্দির। সেখানেই শুরু হয় মহাপ্রভু বিগ্রহের সেবা পুজো। কিন্তু এই মন্দির আয়তনে ছিল অত্যন্ত ছোট। অবশেষে ১৮২৮ সালে ভাগ্যকুলের জমিদার গুরুপ্রসাদ রায়ের অর্থানুকূল্যে ওই পশ্চিমদ্বারী মন্দিরের পাশেই গড়ে ওঠে বর্তমানের দক্ষিণদ্বারী মন্দিরটি।

যাদবাচার্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাধবাচার্য এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁর দুই পুত্র দশ আনা-ছয় আনা ভাগে সেবাইত হন এবং এ হিসাব অনুযায়ী বংশপরম্পরায় এ মূর্তি সেবিত হয়ে আসছেন। বর্তমানে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ পুরুষ এঁর সেবাইত এবং প্রায় ১৫০-১৭৫ জন সেবাইত সুনির্দিষ্ট অংশভেদে এ সেবাকার্য নির্বাহ করেন।

দেড়শত বছর পূর্বে কাছাড় থেকে আগত ভুবনেশ্বর সাধু ভক্তদের আর্থিক সহায়তায় বর্তমান সুদৃশ্য রৌপ্য সিংহাসনটি নির্মাণ এবং দোলমঞ্চ ও রাসমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমান সেবাইতগণ ‘বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতি’ গঠন করে ওই বিগ্রহের সেবা-পূজার কাজ পরিচালনা করছেন।



রানা চক্রবর্তী

জগন্নাথধামে চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধান রহস্য:
● ছবিতে- নদীয়া জেলার নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরে (মহাপ্রভু বাড়ি), শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বিতীয় স্ত্রী, শ্রীমতী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী কর্তৃক নির্মিত, স্থাপিত ও পূজিত, দারু (নিম) কাঠের তৈরী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর বিগ্রহ।
নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরেই নিত্য পূজিত হন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত মহাপ্রভুর মূর্তি। কথিত রয়েছে, যে মূর্তি বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী নির্মাণ করান চৈতন্যদেবের জীবিত কালেই। সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেবের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর আর কখনও দেখা হয়নি। কথিত আছে, বিরহকাতর বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চৈতন্যদেবের একটি মূর্তি নির্মাণ করান। সেই বিগ্রহের সেবাপুজো নিয়েই তিনি বাকি জীবন কাটান। চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এর তিন বছর পরে ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয় যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি। মূর্তির পাদপীঠে খোদাই করা আছে “১৪৩৫ শক, বংশীবদন”। অনুমান, বংশীবদন নামের এক শিল্পী এই মূর্তির রূপকার। সারা বিশ্বের বৈষ্ণবভক্ত নবদ্বীপে ছুটে আসেন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত এই ধামেশ্বর মহাপ্রভুর টানে।
বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী জীবিত কালে ওই বিগ্রহের পুজোর জন্য বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর নবদ্বীপের গঙ্গার তীরে কালো পাথরের মন্দির নির্মাণ করান। কালের গ্রাসে সে মন্দির গঙ্গা গর্ভে চলে যায়।
নবদ্বীপের বর্তমান মহাপ্রভু মন্দিরের ইতিহাস প্রসঙ্গে গোস্বামী বংশজাত অধ্যাপক প্রদ্যোতকুমার গোস্বামী তাঁর “নবদ্বীপের সমাজ এবং সংস্কৃতি” বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখছেন, “১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন মহাপ্রভুর মধ্যাহ্ন ভোগের পর মহাপ্রভুর মন্দিরে প্রবেশ করে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী অপ্রকট হলেন।” ওই বই অনুসারে বিগ্রহের সেবাপুজোর দায়িত্ব পেলেন ভ্রাতুষ্পুত্র মাধবাচার্য। তাঁর মৃত্যুর পর পুজোর দায়িত্ব বর্তায় জ্যেষ্ঠপুত্র ষষ্ঠীদাসের উপর। এই সময় থেকেই সমস্যা শুরু হল। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ মহাপ্রভুর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার করেন। শক্তির উপাসকেরা মহাপ্রভু মূর্তি পুজোর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। এমনকি তৎকালীন নদিয়ারাজের কাছে অভিযোগ জানান। এই অবস্থায় অন্য ভায়েরা মহাপ্রভুর মূর্তি পুজোর অধিকার ত্যাগ করলে ষষ্ঠীদাস মালঞ্চপাড়ায় একটি পর্ণকুটিরে গোপনে ওই মহাপ্রভু মূর্তির সেবা পুজোর ব্যবস্থা করেন। “নবদ্বীপের সমাজ এবং সংস্কৃতি” বই অনুসারে, মহাপ্রভুকে পুজো করার অপরাধে গোস্বামীরা সমাজচ্যুত হলেন। তখন নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার এবং মহাপ্রভু মূর্তি রক্ষার তাগিদে দক্ষিণা কালিকার মূর্তিস্থাপন করে পুজো করতে লাগলেন। কালী মন্দিরের নীচে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে ঘিয়ের প্রদীপ দিয়ে মহাপ্রভুর সেবা পুজো করতে লাগলেন কোনও রকমে।”
কিন্তু সে সময়ে মালঞ্চপাড়া ভাগীরথীর জমা জলে বছরের বেশির ভাগ সময়ে জলাকীর্ণ হয়ে থাকত। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে পরম বৈষ্ণব দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ তোতারাম দাস বাবাজীর তৎপরতায় তৈরি হয় একটি পশ্চিমদ্বারী মন্দির। সেখানেই শুরু হয় মহাপ্রভু বিগ্রহের সেবা পুজো। কিন্তু এই মন্দির আয়তনে ছিল অত্যন্ত ছোট। অবশেষে ১৮২৮ সালে ভাগ্যকুলের জমিদার গুরুপ্রসাদ রায়ের অর্থানুকূল্যে ওই পশ্চিমদ্বারী মন্দিরের পাশেই গড়ে ওঠে বর্তমানের দক্ষিণদ্বারী মন্দিরটি।
যাদবাচার্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাধবাচার্য এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁর দুই পুত্র দশ আনা-ছয় আনা ভাগে সেবাইত হন এবং এ হিসাব অনুযায়ী বংশপরম্পরায় এ মূর্তি সেবিত হয়ে আসছেন। বর্তমানে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ পুরুষ এঁর সেবাইত এবং প্রায় ১৫০-১৭৫ জন সেবাইত সুনির্দিষ্ট অংশভেদে এ সেবাকার্য নির্বাহ করেন।
দেড়শত বছর পূর্বে কাছাড় থেকে আগত ভুবনেশ্বর সাধু ভক্তদের আর্থিক সহায়তায় বর্তমান সুদৃশ্য রৌপ্য সিংহাসনটি নির্মাণ এবং দোলমঞ্চ ও রামমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান সেবাইতগণ ‘বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতি’ গঠন করে ওই বিগ্রহের সেবা-পূজার কাজ পরিচালনা করছেন।
শ্রী চৈতন্য জীবনের অন্ত্যপর্ব (১৫১৫-১৫৩৩) দিয়েই শুরু করা যাক মহাপ্রভুর রহস্যেভরা দেহাবসান কথা।
১৫১৫ সাল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর – নীলাচল থেকে শ্রীচৈতন্যের বৃন্দাবন গমন।
১৫১৬ সাল মার্চ-এপ্রিল – বৃন্দাবন-প্রয়াগের পর কাশীতে অবস্থান।
মে – পুরী প্রত্যাবর্তন। নীলাচল থেকে রূপের গৌরযাত্রা। সনাতনকে শিক্ষাদান।
১৫১৬ – ১৮ সাল – কাশীতে চৈতন্য কর্তৃক সন্ত কবিরের শবদেহ গঙ্গায় বিসর্জন।
(আনুমানিক) প্রতাপরুদ্র-কৃষ্ণদেব রায়ে সন্ধি স্থাপন। বিজয়নগর অধিপতি কৃষ্ণদেব রায়ের শ্রীচৈতন্যচরিত্রমহিমা অবগতি।
১৫২০ সাল (আঃ) – পুরীতে নানক-চৈতন্য সাক্ষাৎকার।
১৫২৬ সাল – পুরীতে চৈতন্য-শিবানন্দ সাক্ষাৎকার। শিবানন্দপুত্র কর্ণপূরের জন্ম সম্ভাবনায় চৈতন্য কর্তৃক ভাবী সন্তানের ‘পুরীদাস’ নামকরণ।
১৫২৬-২৭ সাল (আঃ) – গোস্বামীদের প্রচার পরিদর্শনে শ্রীচৈতন্যের দ্বিতীয়বার বৃন্দাবন গমন।
১৫২৭-২৮ সাল – ওড়িশী পঞ্চসখার অন্যতম জগন্নাথ দাসের চৈতন্যশরণ গ্রহণ।
১৫২৯ সাল – চৈতন্যদেবকে দক্ষিনী ভক্তদের দক্ষিণ ভারতের দুটি গ্রাম দান। শ্রীচৈতন্যের দক্ষিণ ভ্রমণ (আঃ)।
১৫৩৩ সাল – পুরীতে শ্রীচৈতন্য ও বালক পুরীদাস সাক্ষাৎকার। পুরীতে শ্রীচৈতন্য ও শঙ্করদেব সাক্ষাৎকার। চৈতন্য তিরোভাব।
শ্রীচৈতন্য জীবনের শেষতম বিষ্ময়কর ও রহস্যজনক ঘটনা তাঁর দেহাবসান। পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব আন্দোলনের এক ও অদ্বিতীয় প্রাণপুরুষ ছিলেন মহাপ্রভু। কিভাবে এবং কেমন করে তিনি দেহত্যাগ করলেন তা আজও গভীর রহস্যেভরা। এটি একটি গভীর ও ব্যাপক অনুসন্ধানের বিষয়।
মহাপ্রভুর দেহাবসান প্রসঙ্গে কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘চৌদ্দশতপঞ্চান্নে হৈলা অন্তর্ধান’ (আদি’১৩) , এটুকু বলেই খালাস হয়েছেন। কখন কিভাবে কোথায় ‘হৈলা অন্তর্ধান’ সে সম্পর্কে আর একটা কথাও তিনি খরচ করেননি।
শ্রীচৈতন্যের তিরোভাব রহস্যে সম্পূর্ণ নীরব থেকেছেন বৃন্দাবনদাসও। মহাপ্রভুর এ ব্যাপারে নানান ধরণের পরস্পর বিরোধী কথা বলেছেন কথা বলেছেন তাত্ত্বিকেরা। কারও মতে, ঈশ্বরের অবতার ছিলেন শ্রীচৈতন্য। সাধারণ মানুষের মতো লৌকিক মৃত্যু তাঁর হলে পারে না। কেউ বলেছেন, পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ বিগ্রহের মধ্যে অন্তর্হিত হন তিনি। কারও মতে, সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলীন হয়ে যান তিনি।
এখন কথা হল, বৃন্দাবনদাস বা কৃষ্ণদাস কি আদৌ নীরব ছিলেন এ ব্যাপারে? ড. বিমানবিহারী মজুমদার ও ড. সুকুমার সেনের মত হল, ‘চৈতন্যভাগবতের পরিসমাপ্তি অত্যন্ত আকস্মিক’। অতএব বৃন্দাবনদাসের মূল পুথির শেষ পর্যায় শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর বর্ণনা ছিল না, একথা তেমন জোর দিয়ে বলা চলে না। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ প্রসঙ্গেও একই কথা বলা যায়।
এবার কৃষ্ণদাস কবিরাজের কথা। শুধুমাত্র বেদনাদায়ক বলেই কি মহাপ্রভুর লোকান্তরের বর্ণনা তিনি দেননি ? কৃষ্ণদাস ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী। তিনি জানতেন, মহাপ্রভুর প্রকটলীলার পরেও আছে তাঁর অপ্রকটলীলা। কোনও তাত্ত্বিকের কাছেই প্রকট থেকে অপ্রকটে উত্তরণ খুব একটা বেদনাদায়ক হতে পারে না। কারণ, তত্ত্বজ্ঞানী ভক্ত প্রভুর ইচ্ছা মেনে নিয়ে তাঁর মহিমময় অপ্রকট লীলারসও উপভোগ করতে পারেন অনায়াসে।
দেবকল্প মানুষের লৌকিক মৃত্যুর সম্ভাব্যতা প্রসঙ্গে বলা যায় যে, প্রাচীন অবতারদের জীবনকথা ভুলে যান এই সব মতবাদীরা। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও মৃত্য সম্পর্কে এতটুকুও অলৌকিকতা নেই ভাগবতে। নিতান্ত লৌকিক ভাবে তাঁর জন্ম হয় বসুদেবের ঔরসে দেবকীর গর্ভে। লৌকিক মৃত্যু হয় জরা ব্যাধের তীরের আঘাতে। এতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গৌরব ও মহিমা একটুও হ্রাস পেয়েছে কি? পায়নি। সুতরাং শ্রীচৈতন্যের লৌকিক মৃত্যু বর্ণনায় ভাগবতভক্ত বৈষ্ণবরা ক্ষুব্ধ হবেন, এমনটা ভাববার অবকাশ নেই।
শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর প্রসঙ্গে বাস্তব বিবরণ দিয়েছেন চৈতন্য জীবনীকারদের অনেকে। যেমন আছে জয়ানন্দের চৈ.ম. উত্তরখণ্ডে –
‘আষাঢ় বঞ্চিতা (পঞ্চমী?) রথ বিজয় নাচিতে।
ইটাল বাজিল বাম পায় আচম্বিতে।।…
নরেন্দ্রের জলে সর্ব পারিষদ সঙ্গে।
চৈতন্য করিল জলক্রীড়া নানারঙ্গে।।
চরণে বেদনা বড় ষষ্টি দিবসে।
সেই লক্ষে টোটাএ শয়ন অবশেষে।।
পন্ডিত গোসাঞ্জিকে কহিল সর্বকথা।
কালি দশ দন্ড রাত্রে চলিব সর্বথা।।…
মায়া শরীর থাকিল ভূমে পড়ি।
চৈতন্য বৈকুণ্ঠ গেলা জম্বুদ্বীপ ছাড়ি।।’
মহাপ্রভুর এই লৌকিক লোকান্তরের বর্ণনা দেওয়ায় জয়ানন্দকাব্যকে নিষ্ঠাবান বৈষ্ণবরা অনাদর করে থাকেন বলে বলা হয়ে থাকে। এখন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব বলতে কাকে ধরা হবে এবং তাঁর মাপকাঠিই বা কি, বর্তমানের সমালোচকদের এই জাতীয় ধারনার ভিত্তিটাই বা কি তা বোঝা যায় না।
নিত্যানন্দবংশাবতংশ সিদ্ধান্ত বাচস্পতি শ্যামলাল গোস্বামীপ্রভু ৪২১ চৈতন্যাব্দে (১৯০৭ সাল) প্রকাশিত তাঁর ‘শ্রীশ্রীগৌরসুন্দর’ গ্রন্থে জয়ানন্দের পরিবেশিত তথ্যটি গ্রহণ করেছিলেন পরম সমাদরে। গ্রন্থের সমাপ্তিতে গোস্বামীপ্রভু লিখেছেন,
‘একদিন রথাগ্রে নৃত্য করিতে করিতে প্রভুর পদনখে আঘাত লাগিল। উক্ত আঘাতকে ছল করিয়া প্রভু লোকলীলা সংবরণের অভিলাষ করিলেন।’ (পৃষ্ঠা ৬৩৫)
সুতরাং চৈতন্য তিরোভাবের বাস্তব একটি কারণ জয়ানন্দর কাব্যে নির্দেশিত হওয়ায় গোঁড়া বৈষ্ণব সমাজে তাঁর কাব্যটি আদৃত হয়নি, এমত ঠিক নয়। এই জাতীয় বিচার বিভ্রাটের গোড়ার কথা তত্ত্বজ্ঞান, তত্ত্বাভিমান। এইসব তত্ত্বাভিমানীরা মনে করেন মহাপুরুষের লৌকিক মৃত্যু হলে তাঁর মহিমা ক্ষুন্ন হয়। এঁরা ভুলে যান ‘কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা’, এক্ষেত্রে ‘নর’ অর্থে মানুষই উদ্দিষ্ট। নরলীলায় কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল মানুষের মতো, মানবীমায়ের গর্ভে, মৃত্যুও হয়েছিল সাধারণ মানুষের মতো। স্পষ্টভাবে এই কথাটাই বলা হয়েছে মধ্বাচার্য্য সম্প্রদায়ে।
এবার চৈতন্যচরিতে দৃষ্টি ফেরান যাক লোকান্তর বর্ণনার দিকে। লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল আছে –
আষাঢ় মাসের তিথি সপ্তমী দিবসে। নিবেদন করে প্রভু ছাড়িয়া নিশ্বাসে ।
সত্যত্রেতা দ্বাপর সে কলিযুগ আর। বিশেষতঃ কলিযুগে সংকীর্তন সার।।
কৃপা কর জগন্নাথ পতিত পাবন। কলিযুগ আইল এই দেহ ত শরণ।।
এবোল বলিয়া সেই ত্রিজগত রায়। বাহু ভিড়ি আলিঙ্গন তুলিল হিয়ায়।
তৃতীয় প্রহর বেলা রবিবার দিনে। জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে।।
গুঞ্জাবাড়ীতে ছিল পাণ্ডা যে ব্রাহ্ম। কি কি বলি সত্বরে সে আইল তখন।।
বিপ্রে দেখি ভক্ত কহে শুনহ পড়িছা। ঘুচাহ কপাট প্রভু দেখি বড় ইচ্ছা।।
ভক্ত আর্তি দেখি পড়িছা কহয়ে কখন। গুঞ্জাবাড়ীর মধ্যে প্রভুর হৈল অদর্শন।।
সাফাতে দেখিল গৌর প্রভুর মিলন। নিশ্চয় করিয়া কহি শুন সর্বজন।।।
এবোল শুনিয়া ভক্ত করে হাহাকার। শ্রীমুখচন্দ্রিমা প্রভুর না দেখিব আর।।…
শ্রীপ্রতাপরুদ্র রাজা শুনিল শ্রবণে। পরিবার সহ রাজা হরিল চেতনে।।“
[রাধানাথ কাবাসী সম্পাদীত চৈ.ম. : শেষখণ্ড, ৩১০-৩১৯]
ঈশান নাগরের ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থের কথায় –
‘একদিন গোরা জগন্নাথে নিরখিয়া। শ্রীমন্দিরে প্রবেশিল ‘হা নাথ’ বলিয়া।।
প্রবেশ মাত্রেতে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল। ভক্তগণ মনে বহু আশঙ্কা জন্মিল।।
কিছুকাল পরে স্বয়ং কপাট খুলিল। গৌরাঙ্গাপ্রকট সভে অনুমান কৈল।’
(একবিংশ পরিচ্ছেদ)
নরহরি চক্রবর্তী চৈতন্য অন্তর্ধানের স্থান নির্ণয় করে ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে লিখেছেন, মামুঠাকুর নরোত্তমকে বলছেন –
‘ওহে নরোত্তম এই স্থানে গৌরহরি । না জানি পন্ডিতে কি কহিল ধীরি ধীরি।।
প্রবেশিলা এই গোপীনাথের মন্দিরে। হৈলা অদর্শন পুনঃ না আইলা বাহিরে।।’
(অষ্টম পরিচ্ছেদ)
ওড়িশী সাহিত্যেও চৈতন্য তিরোধান সম্পর্কে বিচিত্র মুল্যবান তথ্য আছে।
শ্রীচৈতন্যের ওড়িশী পাঁচজন শিষ্য বা পঞ্চসখার অন্যতম ছিলেন অচ্যুতানন্দ।
তিনি শ্রীচৈতন্যের জগন্নাথঅঙ্গে লীন হওয়ার কথা লিখেছেন –
‘চৈতন্য ঠাকুর মহানৃত্যকার রাধা রাধা ধ্বনি কলে।
জগন্নাথ মহাপ্রভু শ্রীঅঙ্গে বিদ্যুন্ প্রায় মিশি গলে।।’
(শূন্যসংহিতা/১)
অচ্যুতানন্দ অন্যত্র লিখেছেন –
কল্পবট মূলে নীল সুন্দর গিরিরে
সুন্দর রূপরে বিজে শঙ্খচক্র করে।।
চিহ্নিলে চৈতন্য যে ব্রহ্মান্ড কর্তা হরি।
কলারে কলা মিশিলা নাহিলা সে বারি।।
(শূন্যসংহিতা , তৃতীয় অধ্যায়, প্রথম ভাগ)
জগন্নাথ চরিতামৃত কাব্যে দিবাকর দাস লিখেছেন –
‘মহাপ্রভু – বিচার কোলে হৃদয়র। এ কলিকাল বলীয়ার।
থিবার উচিত নুহই। নিজধামকু যিবি মুহি।
এমন্ত ভাবি শ্রীচৈতন্য। শ্রীজগন্নাথ অঙ্গে লীন।।
গোপন হোইলে স্বদেহে । দেখি কাহার দৃষ্টি নোহে।।
পূর্বে যহিরু আসিখিলে। লেউটি সে অঙ্গে মিশিলে।।’
চৈতন্যভাগবতে ঈশ্বরদাস লিখেছেন, চন্দনযাত্রার সময় ভাবাবিষ্ট শ্রীচৈতন্য জগন্নাথকে চন্দন দেওয়ার সময় চন্দনপাত্র পড়ে যায় তাঁর হাত থেকে। সেই সময় মহাপ্রভু প্রবেশ করেন শ্রীজগন্নাথের বিস্তৃত শ্রীমুখে। লীন হয়ে যান জগন্নাথ বিগ্রহের গর্ভে।
ঈশ্বরদাস তাঁর গ্রন্থের শেষে ৬৫ অধ্যায়ে লিখেছেন, জগন্নাথমন্দিরের মুক্তিমণ্ডপে ‘চৈতন্যভাগবত’ পাঠ শুনে সকলে যখন গ্রন্থাকারের প্রশংসা করেছেন সেই সময় মহাপ্রভুর সন্ন্যাসীপার্ষদ বসুদেব তীর্থ উপস্থিত ভক্তবৈষনব্দের কথা মানলেন না, বললেন –
‘প্রভু অঙ্গে চৈতন্য মিশি। তীর্থঙ্ক মনকু ন আমি।।
বৈষ্ণবে প্রমাণ করন্তি। সন্ন্যাসী কেভে ন মানন্তি।।’
মণ্ডপের এক প্রান্তে ঈশ্বরদাসকে দেখতে পেয়ে তিনি বললেন, শ্রীচৈতন্য লীন হয়েছেন জগন্নাথঅঙ্গে, একথা তুমি লিখলে কেন?
‘শ্রীজগন্নাথ অঙ্গে লীন। কাহু লেখিল এ বচন।’
তখন আর কোনও কথা আসে না ঈশ্বরদাসের মুখে। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীকার করে জানালেন, শ্রীগুরুবচনে একথা লিখছেন। তত্ত্বজ্ঞানের দিক থেকেই ধরতে হবে এ ঘটনা।
‘বোলিই শুণিমা গোঁসাই। চিত্তকু বোধ যাউ নাহি ।
তহিঁ কি প্রবোধ কহিবি। সমস্তে শুণ আত্মা ভাবি।
এথকু শ্রীগুরুবচন। শূন্যে দর্শন তত্ত্বজ্ঞান।
দর্শনে প্রভু আজ্ঞা হোই । সভারে শূন্যে শুনিলই।’
জগন্নাথদেবের অঙ্গে মহাপ্রভুর লীন হয়ে যাওয়ার কথা মন্দিরের ভিতর থেকে কেউ উচ্চস্বরে ঘোষণা করলএ তা আকাশবাণী বলে ধরা যেত। তত্ত্বের দিক থেকে একথা মানা যেতে পারে। চৈতন্যকে জগন্নাথদেবের অভিন্ন বলে মনে করলে জগন্নাথে চৈতন্যের লীন হওয়া তত্ত্বের দিক থেকে গ্রহণ করতে বাধা নেই। এটাও আত্মার সঙ্গে তাঁর আত্মার মিলন। প্রশ্ন হল, তাহলে চৈতন্যের মায়াশরীরের কি হল এবং সেটা গেল কোথায় ? ঈশ্বরদাস জানিয়েছেন,
‘শ্রী জগন্নাথ কলেবর। একাত্মা একাঙ্গ শরীরে।
সমস্তে এমন্ত দেখন্তি। মায়া শরীর ন জাণন্তি।।
চৈতন্য পিন্ড সিংহাসন। দেখন্তি ত্রৈলোক্য মোহন।
ক্ষেত্র পালঙ্কু আজ্ঞা দেই। এ পিণ্ড নিঅ বেগ কই।।
অন্তর্ক্ষে নেই গঙ্গাজল। মেলিণ দিঅ ক্ষেত্রপাল।।
শ্রীজগন্নাথ আজ্ঞা পাই। অন্তর্ক্ষে মেলে শব বহি।।
গঙ্গারে মেলি দেলে শব। সে শব হোইলাক জীব ।
চৈতন্য রূপ প্রকাশিলে। গঙ্গারে লীন হোই গলে।।
কেহু ন জানে এহু রস। ভক্তঙ্ক মুখরে প্রকাশ।।
লেখন নাহি শাস্ত্র পোথা। অত্যন্ত গুপ্ত এহু কথা।।
এহা ন জাণি বিদুজন। য়েকা জাণন্তি সংকর্ষণ।।
সুসাধু জ্ঞানী এ জাণন্তি। গতানুগতিকু বিস্মরন্তি।।’ (৬৫ অধ্যায়)
অর্থাৎ জগন্নাথের সামনেই পড়েছিল মহাপ্রভুর দেহ। তখন জগন্নাথদেবের আজ্ঞায় শবদেহ অন্তরীক্ষে (কাঁধে করে?) বহন করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় (প্রাচী নদীতে) বিসর্জন দেওয়া হল। এসব অত্যন্ত গোপন কথা। একথা জানতেন একমাত্র সুসাধু জ্ঞানীরা কিন্তু কালক্রমে লকে বিস্মৃত হল একথা।
ঈশ্বরদাস ৬৪ অধ্যায়ে লিখেছেন, প্রভু জগন্নাথদেবের গায়ে চন্দনলেপন করলে জগন্নাথ আনন্দে মুখ ব্যাদান করলেন। সেই সময় মুখগহ্বরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন মহাপ্রভু। তখন চৈতন্যের রূপ পরিগ্রহ করলেন দেব জগন্নাথ। এসব শুনে ক্রোধের আর সীমা রইল না। যেমন,
‘রাজন ক্রোধ কে কহিব।
তাহা জানিলে বাসুদেব।’
বাসুদেব ( জগন্নাথ ) নিজেই তখন রাজা প্রতাপরুদ্র ও প্রভু নিত্যানন্দকে বললেন,
‘তো দুহুঁ ক্রোধ দূর কর
চন্দন যাত্রা মোর সার।’ (৬৪ অধ্যায়)
রাজা বাইরে এসে সান্ত্বনা দিলেন সকলকে। ‘ক্রোধ’ সম্বরণ করলেন সকলে। ‘সমস্তে ক্রোধ সাম্ভালিলে।’
ওড়িয়া কবি ছিলেন গোবিন্দ। তাঁর প্রণীত সংস্কৃত চৈতন্যচরিত ‘গৌরকৃষ্ণোদয়’ কাব্যে অষ্টাদশ সর্গে লিখেছেন, মাঘ মাসে মহাপ্রভু স্বধামে প্রস্থানে ইচ্ছুক হলেন – ‘অভুৎ যাত্রূকামঃ স্বধাম’। ফাল্গুনের শুক্লা একাদশীতে তিনি ‘একনিষ্ঠো বভূব’। সমুদ্রতীরে কুটীরে তিনি সমাধি মগ্ন হলেন। পাঁচদিন কাটল এইভাবে। পঞ্চম দিনে সন্ধ্যাবেলায় সমাধি ভেঙে উঠে তিনি ডেকে পাঠালেন সকলকে। শ্রীকৃষ্ণ-নাম গান শুরু হল। একটি শ্লোক আবৃত্তি করলেন মহাপ্রভু। তারপরই ‘ক্ষোণীং ত্যক্ত্বা ক্ষণরুচিরিবান্তর্দধে গৌরকৃষ্ণঃ’- ক্ষণপ্রভার মতো অন্তর্হিত হলেন গৌরকৃষ্ণ।
প্রসিদ্ধ ওড়িয়া কবি ছিলেন সদানন্দ কবি সূর্য ব্রহ্ম। তাঁর প্রেমতরঙ্গিনী কাব্যে মহাপ্রভুর অন্তর্ধান প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘অষ্ট চালিশ বরষে অন্তর্ধান টোটা গোপীনাথ স্থানে।’ (৩৬অধ্যায়)
চৈতন্যের অন্তর্ধান বিষয়ে এই সব তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে অন্তর্ধান স্থান কাল ও ধরন সম্পর্কে নানাজনের নানা মত। স্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত –
১. জগন্নাথ মন্দির বলেছেন অচ্যুতানন্দ, দিবাকর দাস, ঈশ্বর দাস, ঈশান নাগর।
২. গুন্ডিচা বাড়ি একথা লোচন দাসের।
৩. টোটা (গোপীনাথ?) বলেছেন জয়ানন্দ।
৪. গোপীনাথের মন্দির নরহরি ও সদানন্দর কথা।
৫. সমুদ্রতীরে কুটীর বলেছেন গোবিন্দ।
সময় তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন মত –
১. বৈশাখ মাস, সন্ধ্যা
২. বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া একথা ঈশ্বর দাসের।
৩. আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী রাত দশটা বলেছেন জয়ানন্দ।
৪. আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী, রবিবার বেলা তৃতীয় প্রহর লোচনদাসের কথা।
৫. ফাল্গুনি পূর্ণিমা, সন্ধ্যাবেলা বলেছেন গোবিন্দ।
দেহাবসানের ধরন সম্পর্কে বিভিন্ন মত –
১. প্রতাপরুদ্রের উপস্থিতিতে জগন্নাথ অঙ্গে লীন হওয়া বলেছেন অচ্যুতানন্দ।
২. সবার অলক্ষ্যে জগন্নাথ বিগ্রহে বিলীন হওয়া একথা দিবাকর দাসের।
৩. জগন্নাথের হা-করা মুখের মধ্যে অদৃশ্য হওয়া বলেছেন ঈশ্বর দাস।
৪. বাঁ পায়ে মারাত্মক আঘাতের ফলে মৃত্যু জয়ানন্দর কথা।
৫. গুন্ডিচা বাড়িতে অদৃশ্য হওয়া এবং জগন্নাথ অঙ্গে লীন হওয়া বলেছেন লোচনদাস।
৬. জগন্নাথ মন্দিরের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হওয়া একথা ঈশান নাগরের।
৭. ভক্ত অনুগামীদের সামনে সমুদ্রতীরে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো অন্তর্হিত হওয়া বলেছেন গোবিন্দ।
শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের স্থান কাল ও ধরন নিয়ে নানান মতের প্রেক্ষিতে একটা সিধান্ত অবধারিত এসে পড়ে যে, বর্ণনার কোনওটিই সম্পূর্ণ সত্য নয়, কোনও কোনও কথা আংশিক সত্য হলেও হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার একেবারে নিশ্চিত, চৈতন্যে অনুগামীরা মহাপ্রভুর দেহ পাননি। ভক্তিসিধান্ত সরস্বতীর দক্ষিণ-ভারতীয় শিষ্য ড. সম্বিদানন্দ যথার্থ বলেছেন,
“সবচেয়ে হতোবুদ্ধিকর প্রশ্ন হল, তাঁর দেহের কি হল? তাঁর অনুগামী ভক্তরা কি তাঁর দেহ হাতে পেয়েছিল? এ ব্যাপারে কিছু বলা খুবই কঠিন। শ্রীচৈতন্যের প্রায় প্রতিটি পার্ষদের দেহ অতিযত্নে সমাহিত হয়েছে এবং সমাধির উপর মন্দির তুলে নিত্য পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছে।… রাজা হয়ত তাঁর ভগবান শ্রীচৈতন্যের দেহের উপর আরেকটি জগন্নাথ মন্দির তুলতেন। অনুগামী ভক্তরা সে সমাধিকে চোখের মণির মত রক্ষা করত ও পুজো করত। যে ঘরটিতে তিনি থাকতেন, সে ঘরখানি (গম্ভীরা)- তে আজও হাজার হাজার হিন্দু অনবরত আসছেন শ্রদ্ধা ও প্রীতি অর্ঘ্য নিয়ে; ঘরখানিই পূজার সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। তাঁর সমাধি থাকলে, তা হতো শোকার্ত রাজার মস্ত সান্ত্বনার স্থল। তাঁকে হারিয়ে তাঁর শত শত পার্ষদের অনেকে অসহনীয় শোকে কাঁদতে কাঁদতে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন, চৈতন্য-সমাধি তাদেরও হত মস্ত বড় সান্ত্বনা।’’ (Sri Chaitanya Mahaprabhu, 1st edn.pg.215-6)
এমনটা কি হতে পারে যে, মহাপ্রভুর দেহ হাতে পেয়েছিল রাজা প্রতাপরুদ্রর শক্তিশালী কোনও প্রতিপক্ষ, যে বা যারা সিংহাসন দখল করার ইচ্ছাপোষণ করত প্রতাপরুদ্রকে সরিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্য খুনও করতে পারত। এমনকি রাজার শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে ইতস্তত করত না? এরকম ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের পক্ষে যুদ্ধে পরাজয় এবং জাতির সামরিক মর্যাদাহানির জন্য রাজা প্রতাপরুদ্রের জনগণকে বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা অথবা সমস্ত কিছুর জন্য রাজা ও শ্রীচৈতন্যকে দায়ী করা কি সেকালে সত্যিই অসম্ভব ছিল?
এ জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে হলে অবহিত হতে হবে চৈতন্য যুগের ঐতিহাসিক পটভুমি সম্পর্কে।
শ্রীচৈতন্য ১৫১০ সালে এসেছিলেন পুরীতে। সেই সময় ওড়িশার রাজা ছিলেন প্রতাপরুদ্র। বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ছিলেন যুদ্ধে লিপ্ত। কৃষ্ণদেব রায় ১৫০৯ সালে সিংহাসনে বসার সময় থেকেই উভয় রাজ্যের মধ্যে ছোটখাট যুদ্ধ বিগ্রহ চলছিল। এ কারণে ১৫০৯ সাল থেকেই প্রতাপরুদ্র ছিলেন দক্ষিণে। ১৫১০ সালের প্রথমদিকে শ্রীচৈতন্য তীর্থপর্যটনে বেড়িয়ে মোটামুটি উপকূল ভাগ ধরে পুরী থেকে কন্যাকুমারী হয়ে পৌঁছেছিলেন দ্বারকায়। সেখান থেকে তিনি নর্মদার তীর বরাবর হয়ে পুরীতে ফিরে আসেন ১৫১২ সালে।
তার আগেই, প্রতাপরুদ্রের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের সেনাদল অতিক্রম করে ওড়িশার উত্তর সীমানা। এ সম্পর্কে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক N.B.Roy তাঁর ‘Ala-ud-din Hussain Shah’ প্রবন্ধে লিখেছেন –
“জগন্নাথ মন্দিরের নথি ‘মাদলা পাঞ্জী’তে আছে, ১৫০৮-০৯ সালে আরাম্বাগ জেলার মন্দারণশিবির থেকে বেড়িয়ে শাহ ইশমাইল গাজী বিদ্যুৎগতিতে যাজপুর-কটকে অভিযান চালিয়ে বহু হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে পুরী পর্যন্ত এগিয়ে যান। এই যুদ্ধজয়ের স্মারকমুদ্রায় যাজনগর ওড়িশার উল্লেখ করা হয়। মুসলমান সেনাদলের এই আকস্মিক অভিযানের খবর পেয়ে গজপতি প্রতাপরুদ্র তাঁর দক্ষিণ অভিযান থেকে ফিরে আসেন এবং আগ্রাসী মুসলিমবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে আরামবাগের নিকট মন্দারণ পর্যন্ত চলে আসেন। বিজয়ী ওড়িয়াবাহিনী মন্দারণ দুর্গ অবরোধ করে কিন্তু গোবিন্দ বিদ্যাধর নামক জনৈক উচ্চপদস্ত রাজকর্মচারীর বিশ্বাসঘাতকতায় শেষ পর্যন্ত দুর্গ টি অধিকার করতে ব্যর্থ হয়।’’
অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের কথা, “গোবিন্দ কটক দুর্গের অধ্যক্ষ ছিল। উড়িষ্যার পতনের জন্য যে বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী আংশিকভাবে দায়ী, তাদের প্রধান এই গোবিন্দ।’’
‘‘Govinda was the commandant of the fort of Cuttack. He was the first of that group of traitors who were partly responsible for the fall of Orissa.” (The Gajapati Kings of Orissa)
প্রতাপরুদ্র বিশ্বাসঘাতক বিদ্যাধরকে শাস্তি দেননি, তাকে উচ্চতর পদ ও ধন সম্পদ দান করে তার মন জয় করতে চেয়েছেন। ‘মাদলা পাঞ্জী’ তে আছে “বহুত সুকৃত তাহাঙ্কু রাজা বলে।কনক স্নাহান করাইলে, বিদ্যাধর পদরে রাজা তাহাঙ্কু সাড়ী দেলে, পাত্র কলে। তাহাঙ্কু মুলে রাজা রাজ্যভার দেলে।’’ (মাদলা পাঞ্জী, প্রাচী সংস্করণ, পঃ ৫২-৫৩)
রাজা তাকে কনক-স্নান করিয়ে ‘রাজা’র পদ দান করলেন। ‘রাজ্যভার’ কথাটির অর্থ অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায় করেছেন ‘সমগ্র রাজ্যের ভার’ (Medieval Vaishnavism in Orissa, Pg. 173) এবং বলেছেন মাদলা পাঞ্জীর এ তথ্য অনৈতিহাসিক। এ বিষয়ে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে, যাতে দেখা যায়, সমগ্র রাজ্যের নয়, কলিঙ্গ প্রদেশ বা রাজ্যের ভার দেওয়া হয়েছিল বিদ্যাধরকে।
বিজয়নগরাধিপতি কৃষ্ণদেব রায়ের গুরু শ্রী ব্যাসরায়ের সংস্কৃত জীবনী ‘শ্রীব্যাসযোগিচারিতম’ (রচনাকাল আঃ ১৫৩৫ সাল) গ্রন্থে বিদ্যাধর পাত্রকে ‘কালিঙ্গাধিপতি’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে – ‘বিদ্যাধর পাত্র নামা কলিঙ্গাধিপতি’ (পঞ্চম অধ্যায়)। এতে বলা হয়েছে – কালিঙ্গাধিপতি বিদ্যাধর পাত্র কৃষ্ণদেব রায়ের নিকট একটি দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ পাঠিয়েছিলেন। গুরু শ্রীব্যাসরায় অতিদ্রুত ওই গ্রন্থের একটি সুন্দর ভাষ্য রচনা করলে কৃষ্ণদেব রায় চমৎকৃত হন। ‘শ্রীব্যাসযোগিচরিতম’ এর সম্পাদক B. Venkoba Rao এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, কলিঙ্গাধিপতির উল্লেখের ধরন দেখে বোঝা যায় কলিঙ্গযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে – “The manner of the reference to the lord of Kalinga shows that the Kalinga war was then over.” (Introduction, Para 132)
বিদ্যাধর পাত্র কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ঠিক কোন সময়ে এই ধরণের যোগাযোগ করেছিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য শ্রীযুক্ত রাওয়ের মত নিশ্চিত হওয়া যায় না। বিদ্যাধরের মতো উচ্চাকাঙ্খী ও অভিসন্ধিপরায়ণ ব্যাক্তির পক্ষে কলিঙ্গযুদ্ধ চলার সময়ও কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে চলা অসম্ভব নয়। বিদ্যাধরের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রতাপরুদ্রের পক্ষে মন্দারনদুর্গ দখল করা সম্ভব হয়নি। কলিঙ্গযুদ্ধের হতাশাব্যাঞ্জক ফলাফলের পিছনেও কলিঙ্গাধিপতি বিদ্যাধরের প্রতাপরুদ্র-বিরোধী ভূমিকা থাকা অসম্ভব নয়।
কলিঙ্গযুদ্ধে কৃষ্ণদেব রায় ১৫১৪ সালে দখল করলেন উদয়গিরি। ১৫১৫ সালে জয় করলেন গুন্তুর জেলার কোন্ডবীডু। তিনি রাজপুত্র বীরভদ্রকে বন্দি করে এগিয়ে এলেন সীমহাচলম্ পর্যন্ত। অপমানজনক শর্তে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন প্রতাপরুদ্র। গোদাবরীর দক্ষিণে সমস্ত রাজ্য তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল। এইভাবে ওড়িশার রাজনৈতিক মর্যাদা হ্রাসের পিছনে চৈতন্য বা তাঁর ধর্ম কতটা দায়ী অথবা আদৌ দায়ী কিনা তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ওড়িয়া জাতির সামরিক দক্ষতা হ্রাসের জন্য চৈতন্য প্রচারিত ধর্ম ওই ধর্মের প্রতি রাজা প্রতাপরুদ্রের অনুরাগকে দায়ী করেছেন। সাম্প্রতিক কালেও ওড়িশার বিদ্বৎ সমাজের একাংশ ওড়িশার রাজনৈতিক স্বাধীনতালোপের জন্য দায়ী করে থাকেন চৈতন্যকে। অথচ দেশকে যারা ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল, সেই বিশ্বাসঘাতক গোবিন্দ বিদ্যাধর বা অন্যান্যদের ভূমিকা সম্পর্কে তারা একটি কথাও বলেন না।
ওড়িশার ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই গোবিন্দ বিদ্যাধর অত্যন্ত হীনচরিত্রের মানুষ ছিল। প্রতাপরুদ্রের অনুগ্রহে অর্থ ও ক্ষমতা লাভ করে সে ১৫৪০ সালে প্রতাপরুদ্রের মৃত্যুর পরেই তাঁর দুই পুত্র কালুয়া দেব (১৫৪০-৪১) কে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে। আবার বিদ্যাধরের নাতি নরসিংহকে হত্যা করে তাঁর সেনাপতি মুকুন্দদেব হরিচন্দন সিংহাসনে বসে। এইভাবে গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতে দেশ ও জাতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পুর্বোক্ত পন্ডিতেরা এদিকে না তাকিয়ে রাখালদাসের মন্তব্যটিকে নির্বিচারে গ্রহণ করে ওড়িয়া জাতির পতনের জন্য চৈতন্য ও চৈতন্যধর্মকে দায়ী করে থাকেন।
তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, গোবিন্দ বিদ্যাধর বা তার সমগোত্রীয় কেউ চৈতন্যকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু তৎকালীন ওড়িশার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ থেকে একথা জোর দিয়ে বলা চলে যে, সেকালে শ্রীচৈতন্য অধিকাংশ ওড়িশাবাসীর উপাস্য হয়ে উঠলেও (১) জনগণ ও রাজার উপর তাঁর ক্রমবর্ধমান প্রভাবে কিছু সংখ্যক মানুষ আশঙ্কিত হয়েছিল। (২) ‘জগন্নাথ দারুব্রহ্ম আর চৈতন্য ছিল তাঁর সচল বিগ্রহ’ – এই জাতীয় প্রচার জগন্নাথসেবকদের একাংশের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, (৩) চৈতন্য ও তাঁর সহচরদের জাতিভেদ বিরোধী প্রচার ও ক্রিয়াকর্ম ব্রাহ্মণ পুরোহিত সম্প্রদায়ের জীবিকায় এবং সামাজিক মান মর্যাদায় ঘা পড়েছিল, দলিত সাপের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছিল তারা এবং (৪) বিদ্যাধরের সঙ্গে অভিসন্ধি পরায়ণ রাজনীতিক ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এইসব বিক্ষুব্ধ ধর্মান্ধদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, এটাই স্বাভাবিক, এই অশুভ আঁতাতের মধ্যেই সম্ভবত নিহিত আছে শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের মূল কারণ।
ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমির এই পরিচয়ের ভিত্তিতে চৈতন্যতিরোভাবের বিবৃতিগুলি আর একবার পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
জয়ানন্দ চৈতন্যের দেহাবসানের একটা বাস্তবানুগ বিবরণ দিয়ে বলেছেন তাঁর মায়া শরীর টোটার মাটিতে পড়ে ছিল। কিন্তু তাঁর কথামত সত্যই যদি এই ঘটনা গদাধর পণ্ডিতের সামনে ঘটত, তাহলে চৈতন্যের শবদেহের সদ্গতি বা সমাধিবিষয়ে বঙ্গীয় বৈষ্ণবদের নিশ্ছিদ্র অজ্ঞতা সম্ভবপর হতো না। উপরন্তু শ্রীকৃষ্ণের বাঁ পায়ে জরাব্যাধের শরাঘাত এবং চৈতন্যের বাঁ পায়ে ‘ইটাল’ বা ইটের টুকরোর আঘাত এতে যেন কৃষ্ণ-চৈতন্য সমীরণের তত্ত্বটিকেই বড় করে তুলে ধরেছেন জয়ানন্দ।
লোচনদাস বলেছেন, চৈতন্য নিজ-জনদের বাইরে রেখে মন্দিরে প্রবেশ করা মাত্র ‘তখন দুয়ারে নিজ লাগিল কপাট’। ভক্তদের থেকে তাকে এইভাবে কি বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয়েছিল? উপরন্ত লক্ষনীয়, মন্দিরের ভিতর থেকে একজন ‘পড়িছা’ বা পুরোহিত ঘোষণা করল জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্য বিলীন হয়ে গেছেন। তখন ভক্তবৃন্দ, রাজগুরু কাশী মিশ্র এবং অন্যান্য অনেকে বিলাপ করতে লাগলেন। রাজা স্বয়ং এ সংবাদ শুনে মুর্ছিত হয়ে পড়লেন, কিন্তু চৈতন্যের পার্থিবদেহ সম্পর্কে কেউ অনুসন্ধান করলেন না। জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার সংবাদটি ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কূটকৌশলী কোনও চক্রের চতুর পরিকল্পনার অস্তিত্ব কি অসম্ভব? জগন্নাথের ‘সচল বিগ্রহ’ কে জগন্নাথ আত্মসাৎ করেছেন, ‘সচল বিগ্রহ’ বাদী ভক্তরা একথা অস্বীকার করতে পারবেন না এবং জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার পর মায়া শরীরের খোঁজখবর করা নিতান্ত অশাস্ত্রীয় ও অধার্মিক ব্যাপার হবে, সম্ভবত এই ছিল চতুর চক্রের চিন্তাধারা।
ঈশান নাগর বলেছেন –
‘প্রবেশ মাত্রেতে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল।
ভক্তগণ মনে বহু আশঙ্কা জন্মিল।।’
এই আশঙ্কার কারণ কি? আবার মন্দিরদ্বার খোলা মাত্র ‘গৌরাঙ্গাপ্রকট সভে অনুমান কৈল’। এরই বা কারণ কি? তবে কি সেই অশুভ ঘটনার পূর্ভাবাস কেউ কেউ পেয়েছিলেন?
ওড়িয়া গ্রন্থগুলিতে এই বিগ্রহে লীন হওয়ার তত্ত্বই সমর্থিত হয়েছে। ঈশ্বরদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ অনুসারে সেকালের একটি মাত্র মানুষ, বাসুদেব তীর্থ, এর সত্যতায় সন্দিহান হয়ে প্রকাশ্যে মুক্তিমণ্ডপে এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক করেছিলেন। অবশ্য তখন চৈতন্য তিরোভাবের পর অন্তত ‘একশ’ বছর কেটে গেছে (অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতে ঈশ্বরদাস সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগে ‘চৈতন্যভাগবত’ রচনা করেন। ড.বিমানবিহারী মজুমদারের হিসাব অনুসারে ঈশ্বরদাসের গ্রন্থ চৈতন্য তিরোভাবের ১৫০/১৭৫ বছর পরে লিখিত হয়)। এই কাল ব্যবধানেই সম্ভবত ঈশ্বরদাসকে দিয়েছিল সেই নিরাপত্তা যার ভিত্তিতে তিনি চৈতন্যের পার্থিবদেহের পরিণতি সম্পর্কে অলৌকিকতার মোড়কে মুড়ে কিছু বাস্তবতথ্য পরিবেশনে সাহসী হয়েছেন। ঈশ্বরদাসের মতে, লোকলোচনের অন্তরালে পুরী থেকে বহু দূরে নদীগর্ভে বিসর্জন দেওয়া হয় চৈতন্যের পাথির্বদেহ। তাঁর মতে প্রতাপরুদ্র এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না। তিনি বলেছেন, তিরোধানের খবর পেয়ে রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন, ‘রাজন ক্রোধ কে কহিব’। চৈতন্যতিরোধানের পিছনে কোনও অপরাধমূলক চক্রান্ত না থাকলে রাজা ক্রুদ্ধ হলেন কেন? সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে রাজাকে গোপন করা হল কেন? ঈশ্বরদাসের বিবরণীতে স্পষ্ট আভাস মেলে, রুদ্ধদ্বার মন্দিরমধ্যে চক্রান্তকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদেরই কেউ কেউ যখন জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্যের বিলীন হওয়ার কথা ঘোষণা করতে থাকে, তখন অন্যেরা গোপনে সে দেহ বহন করে নিয়ে বিসর্জন দেয় বহূ মাইল দূরে কোনও নদীতে।
ঈশ্বরদাস বলেছেন, তিনি তাঁর গুরুর কাছে চৈতন্যদেহ বিসর্জনের ‘অত্যন্ত গুপ্ত এহু কথা’ শুনেছেন। চৈতন্য তিরোধানের পর ঈশ্বরদাসের কাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ এক-দেড়শ বছর একথা গুপ্ত রইল কিভাবে? হয়তো এর আগে যারা জানতেন, রাজদণ্ডের ভয়ে তাঁরা একথা প্রকাশ করতেন না। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী কেউ এসবের মূলে না থাকলে এমন নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা এবং সমকালীন ভক্ত কবিদের চৈতন্যদেহ বাঁ চৈতন্যসমাধি সম্পর্কে এমন লৌহ কঠিন নীরবতা সম্ভব হত না। এসবই আবার প্রতাপরুদ্রের পুত্রহন্তা, সিংহাসন দখলকারী ও ভোই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ বিদ্যাধরের দিকে সন্দেহের তির ফলকটি সঞ্চালিত করে।
শ্রীচৈতন্যের কয়েকশো বছর আগে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা শ্রীরামানুজ বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন পুরীতে। তাঁকেও যে বিষম পরিণতির সন্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁর প্রমাণ আছে ‘প্রপন্নামৃত’ সংস্কৃত গ্রন্থে। এতে বলা হয়েছে, ‘শ্রীজগন্নাথদেব শ্রীরামানুজস্বামীকে ‘একরাত্রে পুরুষোত্তম থেকে কূর্মতীর্থে টেনে ফেলে দিয়েছিলেন’ (চৈতন্যচরিতামৃত, গৌড়ীয় মঠ সং, অমৃতপ্রবাহভাষ্য, মধ্য ৭/১১৩)। এই কিংবদন্তীর তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, জগন্নাথক্ষেত্রে রামানুজ ধর্ম প্রচার করতে এলে তাঁর সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল জগন্নাথসেবকদের সঙ্গে। ‘টেনে ফেলে দেওয়া’ কথাটির মধ্যে সেই বিরোধ ও বর্জনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ওড়িশা বাসিদের উপর রামানুজের তুলনায় চৈতন্যের প্রভাব ছিল নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। জনগনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা মনে রেখে তাই ষড়যন্ত্রকারীদের অনেক অনেক ভেবেচিন্তে মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়েছে গোপনে। আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথি অন্তর্ধানের সময় হলে বুঝতে হবে, রথযাত্রা উৎসবে যখন দেশের মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত তখন তাদের সেই ব্যস্ততারই সুযোগ নিতে চেয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা।
পরিষেশে অসংকোচে বলা যায়, শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্যের যবনিকা সম্পূর্ণ উন্মোচিত করার মতো নিশ্চিন্ত কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি আজও। এ আলোচনায় উদ্দেশ্য হল অন্তর্ধানের পিছনে অপরাধমুলক ক্রিয়াকাণ্ডের সম্ভাব্যতা বিচার করা। তৎকালীন সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল তা আদৌ অসম্ভব ছিল না।
‘ভারতের সাধক’ তৃতীয় খণ্ডে শঙ্করনাথ রায় শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে। আষাঢ় মাস। বেলা তখন প্রায় তৃতীয় প্রহর। এক দিব্য ভাবাবেশে আবিষ্ট হইয়া প্রভু জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। নাটমন্দিরে গরুড় স্তম্ভের নীচে প্রতিদিন গিয়া দাঁড়ান, যুক্ত করে ভাবতন্ময় অবস্থায় পুরষোত্তম বিগ্রহের চিন্ময় রূপসুধা পান করেন, নয়নজলের ধারায় সারা দেহ ভিজিয়া যায়। কিন্তু আজ কেন তিনি সরাসরি মূল বেদীকোঠায় ঢুকিয়া পড়িলেন? কেন এই অদ্ভুত ব্যতিক্রম?
ভক্তগণ সবিস্ময়ে তাঁহার কাণ্ড লক্ষ্য করিতেছেন। হটাৎ এক সময়ে অন্তগৃহের দ্বার বন্ধ হইয়া গেল। সবাই বাহিরে, ভিতরে রহিলেন শুধু প্রভু আর তাঁহার শ্রীজগন্নাথ।
সন্মুখে বিরাজিত পরম জাগ্রত দারুব্রহ্ম, শ্রীচৈতন্যের ধ্যানের ধন, ‘ঈশ্বর পরমঃ কৃষ্ণ’-এর দিব্যি শ্রীবিগ্রহ। ভাবোদ্বেল প্রভু হুঙ্কার দিয়া সেদিকে ধাবিত হইলেন।
বাইশ বৎসর পূর্বে, প্রথম দর্শনের দিনটিতে এমনি আত্মহারা এমনি পাগলপারা হইয়া এই পুরুষোত্তম বিগ্রহকে কোলে নিতে তিনি ছুটিয়াছিলেন। সেদিন ঘটিয়াছিল নীলাচল-লীলার উদ্বোধন। আজ আবার এ কোন পর্ব? একই নিত্যলীলায় প্রবেশের সূচনা?
এইদিনও শ্রীবিগ্রহকে চৈতন্য তাঁহার বুকে তুলিয়া নিতে গেলেন। মূহূর্তমধ্যে এক মহা অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়া গেল। চিরতরে তিনি হইলেন অন্তর্হিত।
বহু খোঁজাখুঁজিতেও প্রভুর মরদেহের সন্ধান আর পাওয়া যায় নাই। অগণিত ভক্তের ব্যাকুল অনুসন্ধান, উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্রের আপ্রাণ প্রয়াস, সব কিছু সেদিন ব্যর্থ হয়। এ রহস্যময় অন্তর্ধান চিরদুর্বোধ্য রহিয়া যায়।’’
(তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আমি গবেষক নই সুতরাং এ লেখার কোনও কথা আমার কথা নয়। লেখক পরম শ্রদ্ধেয় ড.শান্তিকুমের দাশগুপ্ত ও নির্মলনারায়ণ গুপ্ত, এঁরা দুজনেই চৈতন্যগবেষক। তাঁদেরই গবেষনার ফসল ‘পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, প্রকাশক-রত্নাবলী, কলকাতা।
উক্ত গ্রন্থ থেকে বিষয় অবিকৃত রেখে কখনও ভাষা ও বানান পরিবর্তন, কখনও সম্পাদনা করে তাদের কথা আমার ভাষায়, আবার কখনও তাঁদের কথা হু-বহু তাঁদেরই ভাষায় তুলে দিলাম। গবেষনামূলক এ লেখার প্রশংসা গবেষক লেখকদ্বয়েরই প্রাপ্য। লেখক আন্তরিক শ্রদ্ধাসহ কৃতজ্ঞ রইল গ্রন্থলেখক ও তাঁর পরিবার এবং প্রকাশকের কাছে।)


🌿🌼🌿🌼🌿🌼🌿🌼🌿🌼🌿🌼🌿



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন