ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়
ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিককার কথা। সিমুলিয়ার বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ কৃষ্ণচন্দ্র নান তাঁর এমএ পরীক্ষার্থী পুত্র কার্তিকচন্দ্রের গৃহশিক্ষক হিসেবে পেলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক তেজী শিক্ষককে। সে যুগের রীতি অনুসারে, গৃহশিক্ষক ভবানীচরণ ছাত্রের বাড়িতে থেকেই তাকে পড়াশোনা করাতেন। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ছিন্ন হয়নি ওই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। সে দিনের সেই শিক্ষক হলেন স্বদেশি যুগের সাংবাদিক-সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। শুধু সেই ছাত্রই নয় তাঁর উত্তরপুরুষরা নিজেদের উদ্যোগে ব্রহ্মবান্ধবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন পাথরের ফলক বসিয়ে। ব্রহ্মবান্ধবের বিশাল কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়িটি।
ব্রহ্মবান্ধবের পৈত্রিক নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম হুগলি জেলার খন্যান গ্রামে ১৮৬১-র ১১ ফেব্রুয়ারি (ওই একই বছরে জন্মগ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার)। গ্রামের পাঠশালা ও হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলের পাঠ শেষ করে কলকাতার জেনারেল অ্যাসেম্বলিস ইনস্টিটিউশনে (এখনকার স্কটিশ চার্চ কলেজ) ভর্তি হয়ে সহপাঠা হিসেবে পেলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তকে। কিন্তু কলেজের গণ্ডী ভাল লাগলো না ভবানীচরণের। সৈনিক হবার বাসনায় গেলেন গ্বালিয়রে। বাড়ির লোক জানতে পেরে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে ভর্তি করে দিলেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে (এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ)।
জন্মসূত্রে হিন্দু ভবানীচরণের ধর্ম সম্পর্কে অসীম কৌতুহল ছিল। পড়াশোনার পাঠ শেষ হতে না হতে কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে ভবানীচরণ নববিধান ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন। পরে একে একে প্রোটেস্ট্যান্ট ও রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের এই দুই শাখাতেই দীক্ষিত হয়ে ধর্মপ্রচারের কাজে যুক্ত হন। নিজের দেওয়া নতুন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় নামেই পরিচিত হন তখন থেকে। ঘুরে বেড়ান সিন্ধু প্রদেশ, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে। ১৯০০-এ কলকাতায় ফিরে প্রাক্তন ছাত্র কার্তিকচন্দ্রের সহায়তায়, তাঁর ১৮ বেথুন রো-এর বাড়ি থেকে নতুন করে প্রকাশ করলেন ক্যাথলিকদের মুখপত্র ‘সোফিয়া’ পত্রিকা। সেখানে একটি সংখ্যায় ব্রহ্মবান্ধব প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ (‘World-Poet’) আখ্যা দেন। প্রকাশ করেন ‘টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি’ নামে আরও একটি পত্রিকা। ওই বাড়িতেই স্থাপন করলেন ‘আয়তন’ নামে এক গুরুকুল। ওই সময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় রবীন্দ্রনাথের, পরে তা পরিণত হয় গভীর সখ্যে।
১৯০১-এ স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাবে আবার হিন্দুধর্মে ফিরে এসে ইউরোপে যান বেদান্তধর্ম প্রচার করতে। সেখান থেকে ফিরে, তিনি গেলেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, ব্রহ্মচর্য আশ্রম গঠনের কাজে যুক্ত হতে। শান্তিনিকেতনে গিয়ে তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ অভিধায় সম্বোধিত করেন। কিছু কাল সেখানে অধ্যাপনা করার পর আবার কলকাতায় ফিরে উঠলেন বেথুন রো-এর বাড়িতেই। সেই সময়ে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সারা বঙ্গদেশ উত্তাল। শিক্ষকতা ছেড়ে দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করলেন ব্রহ্মবান্ধব।
১৯০৪ থেকে তিনি পাকাপাকিভাবেই কলকাতায়। ১৮ বেথুন রো-র বাড়ি তখন ব্রহ্মবান্ধবের কার্যালয়। ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ঠিকানা থেকে প্রকাশ হল ‘সন্ধ্যা’ নামে এক পত্রিকা। তার পর ‘করালী’। সেগুলিতে একেবার সহজবোধ্য ভাষায় দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুললেন তিনি
ব্রহ্মবান্ধব ব্রিটিশদের ‘ফিরিঙ্গি’ বলতেন। তাঁর তীব্র ফিরিঙ্গী-বিরোধী বিভিন্ন প্রবন্ধের ফলে রাজরোষে পড়ল সন্ধ্যার প্রেস ও কার্যালয়। তার পর থেকে সন্ধ্যার প্রেসের ঠিকানা পরিবর্তন হয় বেশ কয়েকবার। আস্তানা পাল্টে ব্রহ্মবান্ধবও গিয়ে উঠলেন ৮ শিবনারায়ণ দাস লেনে ‘রাজমন্দির’ বাড়ির (এখন সেটি বিদ্যাসাগর কলেজের মাঠ হিসেবে পরিচিত) মেসে। বাড়িটি ছিল স্বদেশিদের আস্তানা। কিছু কাল পরে আবার উঠলেন কার্তিকচন্দ্রের বাড়িতে। সেই শেষ। অল্প দিন পরেই ‘এখন ঠেকে গেছি প্রেমের দায়’, ‘সিডিশনের হুড়ুম দুড়ুম ফিরিঙ্গির আক্কেল গুড়ুম’ ও ‘বাছা সকল নিয়ে যাচ্ছেন শ্রীবৃন্দাবন’ প্রবন্ধ তিনটির জন্য রাজদ্রোহের মামলা আরম্ভ হল। বিচার চলাকালীন হার্নিয়া রোগে আক্রান্ত হন তিনি। বেথুন রো-এর বাড়ি থেকেই তাঁকে ভর্তি করা হল ক্যাম্পবেল হাসপাতালে (এখনকার নীলরতন সরকার হাসপাতাল)। অস্ত্রোপচারের পর ১৯০৭-এর ৭ অক্টোবর সেখানেই মারা যান তিনি।
লেখক:গৌতম বসুমল্লিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন