বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

শতাব্দভিত্তিক বিশ্বের ইতিহাস পরিক্রমা


   শতাব্দভিত্তিক বিশ্বের ইতিহাস পরিক্রমা



   ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন         প্রণব কুমার কুণ্ডু


শতাব্দভিত্তিক বিশ্বের ইতিহাস পরিক্রমা

প্রথম শতাব্দ:
৬৪ – রোম নাগরী অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত হয়।
৬৫ – চীনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ও প্রচার শুরু হয়।
৭০ – পবিত্র নাগরী জেরুজালেম ধ্বংস হয়।
৭৯ – ভিসুভিয়াসের প্রচন্ড অগ্ন্যুৎপাত ও লাভা উদগীরণ ঘটে এবং ইতালীর প্রাচীন নাগরী পাম্পেই ধ্বংস হয়ে যায়।
৮০ – বাষ্পীয় শক্তি, হাইড্রোলিক সূত্র এবং বর্গমূলের সূত্র আবিষ্কৃত হয়।
৯০ – কম্পাস আবিষ্কৃত হয়।

দ্বিতীয় শতাব্দ
১০৫ – চীনে প্রথম কাগজ প্রস্তুত করা হয়।
১০৬ – রোম সম্রাজ্য বিস্তার ঘটে।
১২২ – হাড্রিয়ান প্রাচীর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

তৃতীয় শতাব্দ
২২০ – চীন তিনটি পৃথক রাজ্যে ভেঙে যায়
২৮০ – চীন পুনরায় একত্রিত হয় চী রাজতন্ত্রের অধীনে।
২৯৩ – রোম সম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম এ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
৩০০ – চীনে চা পানের প্রথা চালূ হয়।
চতুর্থ শতাব্দ
৩১০ – আলজেবরা বা বীজগণিতের উন্নয়ন ঘটে। এর বিকাশ সাধন করেন দিওফানতাস।
৩২০ – চীনে ক্যালিওগ্রাফির উন্নয়ন শুরু হয়।
৩২১ – রোম সম্রাজ্যে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি বা বিশ্রামবার হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
৩৫০ – মধ্য আমেরিকায় মায়ান নগর রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ঘটে।
৩৯২ – রোম সম্রাজ্যের পূর্ব অংশে খ্রিষ্টান ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পঞ্চম শতাব্দ  পঞ্চম শতাব্দকে আলকেমি যুগ বলা হয়।
৪০০ – ইস্টার দ্বীপে শিলা পাথরের ভাস্কর্য তৈরি শূরু হয়।
৪০১ – জাপানের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস রেকর্ড করা শুরু হয়।
৪১০ – রোম নাগরী লুণ্ঠিত হয় এবং আলকেমি যুগ শুরু হয়।
৪৩৯ – কার্থেজ নাগরী দখল করা হয়।
৪৫০ – সিলে কালির ব্যবহার শুরু হয়।
৪৭৬ – রোম সম্রাজ্যের পূর্বাংশের পতন ঘটে।
৪৭৮ – জাপানে শিন্টোবাদ ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়।
৪৭৯ – বৌদ্ধ ধর্মকে চীনের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়।

ষষ্ঠ শতাব্দ :
৫৭০ – মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জন্ম।
৫৮৯ – চীনে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং সুই রাজতন্ত্রের অধীনে পুনঃএকত্রিত হয়।

সপ্তম শতাব্দ  ইসলাম ধর্মের প্রসারের যুগ।
৬১০ – হযরত মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াত লাভ করেন এবং চীনে গ্রান্ড খাল খনন কাজ সম্পন্ন হয়।
৬১৯ – চীনে প্রথম আর্কেস্ট্রা দল গঠিত হয়।
৬৩৩ – হযরত মুহাম্মদ (সা) ইন্তেকাল করেন।
৬৪৪ – চীন কোরিয়া দখল করে।
৬৫০ – চীনে অশ্ববন্ধনী আবিষ্কৃত হয়।
৬৫১ – পবিত্র কুরআনকে লিখিত রূপ দেওয়া হয়।***???
৬৭০ – আরবরা উত্তর আফ্রিকার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
৬৮৫ – জাপান বৌদ্ধ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে।
৬৯১ – জেরুজালেমে বিখ্যাত পাথরের গম্বুজ নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
অষ্টম শতাব্দ
৭০৫ – দামেস্কের ঐতিহাসিক মসজিদের কাজ শুরু হয়।
৭৫৪ – ইউরোপের রাজার স্বর্গীয় অধিকার বা ডিভাইন রাইট ঘোষণা দেওয়া হয়।
৭৭০ – মধ্যপ্রাচ্যে সর্বপ্রথম পাবলিক ফার্মেসী খোলা হয়।
৭৭৮ – রোমে সমবেতভাবে প্রশংসাগীতি গাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।
৭৮৭ – ইউরোপে স্ক্যান্ডিনেভীয় জলদস্যুরা একটি বড়সড় হামলা চালায়।
নবম শতাব্দ
৮০০ – শার্লিম্যান পবিত্র সম্রাজ্য পশ্চিম রোমান সম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন।
৮১১ – ইন্দোনেশিয়ায় বার্বাদুর নামের মন্দির নির্মিত হয়।
৮২১ – চীন তিব্বত দখল করে নেয়।
৮৪৫ – চীনের বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের কালো অধ্যায় শুরু হয়।
৮৫০ – আরব বণিকেরা নৌযানে চীনে পৌছান।
৮৬০ – মধ্যপ্রাচ্যে কারিগরি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্ক্যান্ডিনেভীয় জলদস্যুরা আইসল্যান্ডে হানা দেয়।

দশম শতাব্দ নগর পত্তনের শতাব্দ/তাস আবিষ্কারের শতক/বারুদ আবিষ্কারের শতক/আরব্য রজনীর শতাব্দ
৯৩৩ – যাজক বা পাদরির উদ্ভব ঘটে।
৯৫০ – চীনে তাসের খেলা প্রচলন হয়। মুসলিম বিশ্বে আরব্য রজনীর কাহিনী সংকলিত হয়।
৯৬৯ – মিশরের রাজধানী কায়রোর পত্তন ঘটে।
৯৭৬ – ইতালির ভেনিস নাগরির পত্তন ঘটান সেন্ট মার্কস।
৯৮৯ – রাশিয়ায় খ্রিষ্টান ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়।
৯৯৪ – ভারতের রাজধানী দিল্লী প্রতিষ্ঠিত হয়।
একাদশ শতাব্দ
১০০০ – চীনে বারুদ আবিস্কৃত হয়। নিউজিল্যান্ডে পলিনেশীয়দের আগমন ঘটে।
১০১০ – জাপানের জনপ্রিয় লোকগাঁথা গেনজি শিকিবোর প্রচলন ঘটে।
১০২৪ – চীনে সর্বপ্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন ঘটে।
১০৬৬ – নরম্যান ইংল্যান্ড জয় করেন।
১০৯৫ – প্রথম ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়।
১০৯৯ – প্রথম ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ শেষ হয়।
দ্বাদশ শতাব্দ
১১৪৪ – ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো গির্জা তৈরি হয়।
১১৬১ – চীন যুদ্ধে প্রথম বারের মতো গোলাবারুদ ব্যবহার করে।
১১৭০ – ম্যাগনেটিক কম্পাস আবিষ্কৃত হয়।
১১৮০ – ইউরোপে উইন্ডমিল বা বায়ুচালিত কলের ব্যবহার শুরু হয়।
১১৯১ – জাপানে চা পানের প্রচলন শুরু হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দ
১২০০ – চীনে সর্বপ্রথম কামান ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়।
১২০২ – ইউরোপে আরবীয় ও হিন্দু গণনা রীতির প্রচলন শুরু হয়।
১২১৫ – ম্যাগনাকার্টা অনুমোদিত হয়। চেঙ্গিস খান তার সম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান।
১২২৯ – ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার বিচার করার জন্য আদালত গঠিত হয়।
১২৪০ – চীন ও ইউরোপের মধ্যে সর্বপ্রথম যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
১২৭৫ – জগদ্বিখ্যাত ও ইতিহাসখ্যাত পর্যটক মার্কো পেলো চীনে পৌছান।
১২৯০ – ইতালিতে চশমা আবিষ্কৃত হয়। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গঠিত বণিক সভার উন্নয়ন ঘটে।

চতুর্দশ শতাব্দ
১৩০০ – সমগ্র ইউরোপে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, যা ইতিহাসে ব্লাক ডেটস হিসেবে পরিচিত। গোলা কামানের ব্যবহার শুরু হয়।

পঞ্চদশ শতাব্দ  নৌপথ আবিষ্কারের শতাব্দী
১৪০৬ – চীনে সম্রাটের জন্য রাজপ্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
১৪৩১ – কিংবদন্তী ফরাসি রমণী জোয়ান অব আর্ক এর আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তাকে ডাইনি অপবাদে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
১৪৩৩ – চীন তার পররাষ্ট্রনীতিতে একলা চলো নীতি গ্রহণ করে।
১৪৪৫ – গুটেনবার্গ জার্মানিতে স্থানান্তরযোগ্য ধাতব টাইপ মেশিন বা মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন।
১৪৫২ – জগদ্বিখ্যাত মোনালিসা চিত্রের চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি জন্মগ্রহণ করেন।
১৪৫৫ – গুটেনবার্গের ছাপাখানায় প্রথম বাইবেল মুদ্রিত হয়।
১৪৮৯ – জর্মানিতে (+) যোগ আর (-) চিহ্নের আবিষ্কার হয়।
১৪৯২ – কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন।
১৪৯৮ – ভাস্কো দা গামা ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন।

ষোড়শ শতাব্দ  মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার শতাব্দ
১৫০২ – জার্মানিতে ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়।
১৫১৯ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন ঘটে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে প্রথম ক্রীতদাস আনা হয়।
১৫২৬ – বাবর পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদীতে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন।
১৫৩৪ – ইংল্যান্ডের রাজা অস্টম হেনরি গির্জার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
১৫৪৩ – পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরো।– কোপার্নিকাস এ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে প্রথম তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়।
১৫৫৫ – তামাক চাষের প্রচলন হয।
১৫৬৬ – ইংল্যান্ডে সমান  ( = )  চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়।
১৫৬৯ – জলপথ, স্থলপথ, মহাদেশ, দেশ, সাগর, মহাসগর প্রভৃতি সবকিছু চিহ্নিত করে জার্মানিতে প্রথম সমন্বিত মানচিত্র আবিষ্কৃত হয়।
১৫৮২ – মাস সপ্তাহ, দিন নির্ধারণ ও নির্ণয় করে রোমে ক্যালেন্ডারের প্রচলন শুরু হয়।
১৫৯১ – ইতালিতে থার্মোমিটার আবিষ্কৃত হয়।
সপ্তদশ শতাব্দী
১৬০০ – বিট্রিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী গঠিত হয়।
১৬০২ – ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী গঠত হয়।
১৬০৫ – ভারতের অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণমন্দির নির্মিত হয়।
১৬০৮ – ইতালির বিজ্ঞানী গ্যালিলিও অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন।
১৬১০ – ঢাকায় সর্বপ্রথম সুবা বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয়।
১৬১৪ – স্কটল্যান্ডে উচ্চতর গণিতের অত্যাবশ্যকীয় সূত্র বা সংকেত লগারিদম আবিস্কৃত হয়।
১৬২১ – রোমে ১ জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় তামাকের চাষ শুরু হয়।
১৬৩৩ – জাপান তার পররাষ্ট্র নীতিতে বিছিন্নতাবাদী নীতি গ্রহণ করে।
১৬৪৪ – চীনে কিয়াং রাজতন্ত্রের অধীনে মাঞ্চু শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৬৫০ – ইটালিতে চাদেঁর মানচিত্র অঙ্কিত হয়।
১৬৫৯ – ইতালিতে প্রথম আইসক্রিম তৈরি হয়।
১৬৬২ – আগ্রার তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
১৬৬৫ – লন্ডনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে বিখ্যাত জাদুঘরটি ভষ্মীভূত হয়।
১৬৬৭ – নাট্যকার মিল্টনের অমর মহাকাব্য প্যারাডাইস লস্ট প্রকাশিত হয়।
১৬৯০ – কলকাতা নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে।
অষ্টাদশ শতাব্দ
১৭০১ – ইংল্যান্ডে শস্য ভাঙার কল আবিষ্কৃত হয়।
১৭০২ – যুক্তরাজ্যের প্রথম ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি কোরেন্ট প্রকাশিত হয়।
১৭৪২ – সুইজারল্যান্ডে তাপমাত্রা মাপার জন্য সেলসিয়াস স্কেল ব্যবহৃত হয়।
১৭৫০ – ইউরোপে শিল্প বিল্পব সুচনা হয়।

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন

বাঙালির পদবি


  বাঙালির পদবি


  ফেসবুক থেকে           শেয়ার করেছেন          প্রণব কুমার কুণ্ডু


বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালির পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে হয়। অধিকাংশ ব্যক্তি নামের শেষে একটি পদবী নামক পুচ্ছ যুক্ত হয়ে আছে। যেমন উপাধি, উপনাম কিংবা বংশসূচক নামকে সাধারণ ভাবে পদবী বলা হয়। বাঙালির মূল নামের শেষে বংশ ,পরিবার, পেশা, বসতিস্থান ইত্যাদির পরিচয়বাহী উপনাম ব্যবহারের রীতি প্রচলিত রয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক পদবীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রেই জমি ও হিসাব সংক্রান্ত পদবী। তবে এই সমস্ত পদবীর বেশির ভাগই বংশ পরস্পরায় চলে আসলে ও বর্তমানে পদবীর সমাজ গত মূল্য নেই বললেই চলে। ইতিহাসের দিন বিচার করলে দেখা যাবে পদবী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঙালি মুসলমানের পরিচয় ও মর্যাদাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ড. মোহাম্মদ হাননান এর ভাষায়- ‘বাঙালি হিন্দু সমাজের বহুল কথিত ছত্রিশ জাতের মতো মুসলমান সমাজের সাধারণভাবে বর্ণভেদের সামাজিক, রাষ্ট্রিক, এমনকি অর্থনৈতিক মূল্য নেই বটে, (কতকক্ষেত্রে ধর্মগত মূল্য রয়েছে। তবে সেটা পীর এবং মুরীদানের ক্ষেত্রে মাত্র), তথাপি বাঙালি মুসলমান সমাজের বিকাশের প্রাথমিক দিনগুলিতে এই পদবী চেতনা জাত-ভেদ ও সামাজিক মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতো। সুতরাং পদবী মাহাত্ম্য ও তার তাৎপর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে জাত ও শ্রেণী চেতনা। বাঙালি মুসলমান সমাজের একটা বড় সময় পার হয়েছে এই মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্বে, যে দ্বন্দ্বে অঙ্গার হয়েছে বাঙালি হিন্দু সমাজ। তবে হিন্দু সমাজের মতো মুসলমান সমাজের মনস্তত্বে পদবীর কৌলীন্য বড় একটা প্রসার লাভ করতে পারেনি ইসলামের মৌলিক আদর্শের কারণেই, যেখানে রক্ত ও বর্ণে সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দান করা হয়েছে।
হিন্দু সমাজে কৃষ্ণ বর্ণের শুদ্রের পৌরহিত্যে পুজা সম্পন্ন না হতে পারলেও মুসলমান সমাজে শুদ্রের পরেও এমনকি অন্ত্যজের ইমামতিতেও নামাজ পড়তে বাধা নেই। সেদিক থেকে পদবী কৌলীন্যের স্বৈরতন্ত্র বাঙালি মুসলমান সমাজে শেকড় গেড়ে বসে মহীরুহ হয়ে উঠবার সুযোগ পায়নি।
শিশু কাল থেকেই একজন বাঙালি পদবীর স্পর্শে আপন জনের সমাদর লাভ করে বলে পদবী চেতনা সকলের মনে প্রাচীন একটা সংস্কারগত রীতির আভাস দেয়। মনে হয় যুগযুগ তার বংশ গৌরব বা অগৌরব সবকিছুই বংশ পরম্পরায় পায়ে পায়ে এসেছে তার নিজের সময় পর্যন্ত”।
অষ্টম শতকে বাংলাদেশে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার পর গ্রাম সভা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা সাধারণ একজনকে সম্রাট পদে বসিয়ে দিয়ে ছিলেন, যার নাম ‘গোপাল’। কিন্তু এই গোপালের নামের শেষাংশ ধরে রাখবার প্রচেষ্টায় উত্তরাধিকাররা ক্রমান্নয়ে সকলেই নামের শেষে গোপাল এর ‘পাল’ অংশকে পদবী হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন, পরে তাই ঐতিহাসিক পাল বংশের সূত্রপাত ঘটায়।আবার বল্লাল সেনের আমলে ছত্রিশটি জাত সৃষ্টি করে ছত্রিশটি আলাদা মর্যাদা তৈরি করা হয়েছিল। সমাজে এভাবে ছত্রিশটি প্রধান পদবীর ও সৃষ্টি হয় পেশাগুনে গুণে। এর পর ৩৬টি জাতে আরো শত রকম বিভাজন ঘটে এবং শত শত পদবীর সৃষ্টি হয় বাংলার সমাজে। এই সব শত শত পদবীর উত্তরাধিকারত্ব লাভ করেছে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালি বৌদ্ধ, বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান। তাই তো দেখি চৌধুরী, তালুকদার, বিশ্বাস, মজুমদার, খান, মলি, মুন্সি, সরকার, সরদার প্রভৃতি প্রায় সকল পেশাগত সামাজিক পদবী রয়েছে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে প্রায় সমানভাবে।
বাঙালি হিন্দু বা মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান অথবা বৌদ্ধ সমাজে পদবী এসেছে বিচিত্রভাবে। ব্যক্তি বিশেষের নাম থেকে যেমন বংশ পদবীর ব্যবহার হয়েছে, তেমনি পদবী এসেছে বিভিন্ন পেশা থেকেও। শিক্ষক, সৈনিক, কারুশিল্পী, বণিক, রাজকর্মচারী, রাষ্টীয় উপাধি, গ্রাম অঞ্চল বাসী ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সামাজিক পদবীর সৃষ্টি হয়েছে এবং নির্বিচারে তার ব্যবহারও হয়েছে।
প্রাচীন যুগে অর্থাৎ হিন্দু আমলে এবং মধ্যযুগের মোঘল-পাঠান শাসনামলে ও আধুনিক কালের শাসনামলে পদবীসমূহ কম-বেশি সংস্কারকৃত হয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত হয়েছে। তবে কিছু পদবী আছে, যা বাঙালি সমাজে শুধু হিন্দুশ্রয়ী, কিছূ পদবী একান্তই মুসলমানী, আবার বেশ কিছু পদবী হিন্দু - মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়েই নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়। শেখ, সৈয়দ, চৌধুরী প্রভৃতি বংশ পদবী বাঙালি মুসলমান সমাজকে আশরাফ এবং আতরাফ এইদুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিল। একদা এই তথাকথিত আশরাফ সম্প্রদায়,  বাঙালি মুসলমান সমাজে শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলেন। এদেশের সাধারণ মুসলমানকে বলা হতো আতরাফ যার আভিধানিক অর্থ নিচু সমাজ, নিচু বংশ- নিচু বর্গের লোক। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, একমাত্র পদবী চেতনাই বাঙালি মুসলমান সমাজে সীমিত অর্থে হলেও একটা সময় সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছিল।
সেদিক থেকে বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের একটি দীর্ঘ কাল পূর্বে পদবীই নির্ধারণ করে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক মর্যাদা। আর মজার ব্যাপার হলো অন্তত পদবীর পরিচিতিতে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু জাতি গত ঐতিহ্যের শিকড়কে খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মগত বিভাগের খোলসের বাইরে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের বংশগত ও পেশাগত ঐতিহ্যের গোড়ার কথা সন্ধান মেলে এই পদবী পরিচিতিতে। শেখ, সৈয়দ,মোগল, পাঠান, কাজী, গাজী, শাহ, মিঞা, মীর্জা, মোল্লা, খন্দকার ইত্যাদি কয়েকটি ভিনদেশী পদবী যা উপ মহাদেশে মুসলমান আগমনের সাথে জড়িত সে কয়টি পদবী বাদে বাংলার অধিকাংশ পদবীই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় সকল ধর্মে ও বর্ণে সুলভ।বাঙালির বংশ পদবীর বেশীর ভাগই এসেছে পেশা ও উপাধী থেকে, বাঙালির সমাজ বিন্যাসেও বংশ পদবীর রয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষ এক অসাধারণ চরিত্র। জমিদার শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের নব্য ধনীদার থেকেই। সুতরাং জমিদারের প্রতীক পদবী ‘চৌধুরী’ পরিচয় পাওয়া যায় বাংলার উভয় সম্প্রদায়েই। এমনকি বৌদ্ধ সম্প্রদায়েও চৌধুরী, পদবীর ব্যবহার রয়েছে।
বাঙালির জমি- জমা বিষয় সংক্রান্ত আরো কিছু পদবী যেমন- হালদার, মজুমদার, তালুকদার, পোদ্দার, সরদার, প্রামাণিক, হাজরা, হাজারী, মন্ডল, মোড়ল, মল্লিক, সরকার, বিশ্বাস ইত্যাদি বংশ পদবীর রয়েছে হিন্দু -মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্পদায়ের একান্ত রূপ। দুই সম্প্রদায়ের এই একই পদবীর ব্যবহার অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ। বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে এর ভূমিকা অসাধারণ ও প্রগতিবাহী, ‘ভূইয়া’ ও হিন্দু সমাজে ‘ভৌমিক’ নামে পরিচিত হয়েছে। যেমন- আনন্দ ভৌমিক।
খান বংশ পদবী, যার আগমণ কিনা সুদূর আফগান পাঠান মূলুক থেকে, তা একান্তভাবে মুসলমানদের বংশ পদবী হলেও অনেক সমাজেও ‘খান’ পদবী একেবারে দূলর্ভ নয়। ঠাকুর বংশ পদবী একান্তভাবে হিন্দুর পদবী বলে মনে হলেও প্রচুর বনেদী মুসলমানের রয়েছে ঠাকুর পদবী। বাঙালির হিন্দুর রয়েছে আলাদা ও স্বতন্ত্র পদবী যা একান্তভাবে তাদের অনেকটা গোত্রভূক্ত, বংশগত এবং কৌলিন্যের ও জাতিগত স্পর্শতা যুক্ত বলা চলে। বাঙ্গালির বর্ণ হিন্দু ব্রাক্ষণের জনপ্রিয় বংশ পদবী হচ্ছে বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ইত্যাদি। এ গুলো কতকগুলি গ্রাম গোত্রের নাম থেকে উদ্ভুত। বন্দ্যঘটি গ্রামের কুলীন ব্রাহ্মণরা প্রথম ব্যাচ শুরু করে ছিলেন বন্দ্যোপাধ্যায়, পদবীর। পরে তা আরো হরেক রকম ব্রাহ্মণের বংশপদবী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। চাটুতি বা শুধু মাত্র চট্ট শব্দ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে বাঙালির হিন্দু সমাজের চট্টোপাধ্যায় বংশ পদবীর। গাঙ্গুর বা গঙ্গ গ্রামের বসতি থেকে এসেছে গঙ্গোপাধ্যায় বংশ পদবী কিংবা মুকুটি বা মুখটি অঞ্চলের বসতিদের থেকে বিকশিত হয়েছে মুখোপাধ্যায় পদবী। ‘বাদড়’ গ্রাম থেকে ভাদুড়ী বংশ পদবীর জন্ম হয়ে ছিল।
‘পাল পদবীকে ইতিহাসের দিক থেকে হিন্দু পদবীর বলা যায় না। কারণ প্রাচীন ইতিহাসের বৌদ্ধ পাল বংশের রাজাদের থেকে পাল বংশ পদবীর বিকাশ। এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদগণ একমত হবেন যে, পাল রাজা গোপাল, রামপাল প্রমুখ থেকে পাল পদবী, পরে জাতিগত পদবী হিসেবে বিকশিত। তবে কুমার সম্প্রদায়ের লোকেরাও পাল পদবী ব্যবহার করে।
বাঙালি মুসলমানের শিক্ষক পেশার পদবী হলো-খন্দকার, আকন্দ, নিয়াজী ইত্যাদি। আর বাঙালি হিন্দুর শিক্ষক পদবী হচ্ছে দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চর্তুবেদী ইত্যাদি। টোলের কোন শিক্ষক বা উপধ্যায় কয়টি বেদ পড়েছেন তা থেকে শুরু হয়েছিল বিভিন্ন ‘বেদী’ নামক বংশ পদবীর।
মুসলমানদের ‘লোহানী’ পদবীর মতো হিন্দু সমাজের রয়েছে সাহানী পদবী। মনে করা হয় এই বংশ পদবী এসেছে সিন্ধু প্রদেশের সাহান অঞ্চল থেকে।বাঙালি মুসলমানের যেমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত আরবী-ইরানী প্রীতি রয়েছে, বাঙালি খ্রিস্টানেরও তেমনি রয়েছে ইংরেজ, পর্তুগীজ তথা পাশ্চাত্য প্রীতি। পৃথিবীর যে কোন ভূখণ্ডের ভাষা ও জাতীয়তায় মুসলমান হতে ধর্মগত বাধা না থাকলেও বাঙালি মুসলমানরা যেমন-আরবী-ফার্সীর প্রতি অতিরিক্ত প্রীতি দেখিয়ে থাকে, তেমনি বাঙালি খ্রিস্টানও দেখিয়ে থাকে পাশ্চাত্য প্রীতি। যেমন-বাঙালির মহাকবি মধুসূদন দত্ত হিন্দুত্ব ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে উনিশ শতকে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু এই মহান বাঙালিও বাঙালি চরিত্রের এতোটুকু স্খলন না ঘটিয়ে পিতৃ নামের আগে মাইকেল যোগ করেছিলন। দত্ত পদবী ত্যাগ করেননি তিনি, তবে দত্ত এর ইংরেজি উচ্চারণের বাংলা উচ্চারণ করতেন ডাট বলে। ফলে খ্রিস্টান মধুসূদনের নাম দাঁড়ায় মাইকেল মধুসূদন ‘ডাট’ বলে। বাঙালি খ্রিস্টানের ইতিহাস চার শত বছরের প্রাচীন। বিদেশী খ্রিস্টান পুরোহিত বাংলা দেশে তাঁদের ধর্ম যাত্রা উপলক্ষে বাঙালিদেরকে খ্রিস্টান ভূক্ত করতে থাকেন। তাদের নাম অথবা সেই পুরোহিত যে অঞ্চলের থেকে আগত সেই অঞ্চলের নামানুসারে খ্রিস্টান ধর্মের নতুন ভাবে দীক্ষিত বাঙালি পদবীর সমাবেশ ঘটাতে থাকেন। বাঙালি খ্রিস্টানের পদবীর মাহত্ম্য ও তাৎপর্য থেকে অনুধাবন করা যায়, যে সব পর্তুগীজ খ্রিস্টান ধর্মযাজক এদেশে এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্তুগালের বিভিন্ন দ্বীপের অধিবাসী। সম্ভবত কোন ধর্মযাজক কতজন বাঙালিকে ধর্মান্তরিত করেছেন তা চিহ্নিত করার জন্যেই দেশান্তরিত নতুন বাঙালি খ্রিস্টানের নামের সাথে এই অঞ্চলের নাম বিশিষ্ট পদবী যুক্ত করা হতো। বাঙালি খ্রিস্টানের ‘ডি কষ্টা’ পদবী বলতে কষ্টা দ্বীপের পর্তুগীজ ধর্মযাজক দ্বারা ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান বুঝতে হবে। ‘ডি রোজারিও’ পদবী মানে রোজারিও নামের দ্বীপ থেকে আগত ধর্ম যাজক দ্বারা খ্রিস্ট ধর্মে আলোকিত। ‘ডি’মানে এখানে ‘দ্বীপ’ বোঝানো হয়। গমেজ আর একটি বাঙালি খ্রিস্টানের বংশ পদবী। এর কোন তাৎপর্য পাওয়া যায় না। যেমন-বাঙালি বিশপ থিওটানিয়াস গমেজ।
প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্ব থেকেই বাঙালি বৌদ্ধের প্রাচীন ইতিহাস খুব ভাল করেই পাওয়া যায়। বুদ্ধদেবের মতাবলম্বী প্রাচীন এই বাঙালি নাগরিকদের নাম ও পদবী পরিচিতির প্রধান দলিল হচ্ছে চর্যাপদ, বৌদ্ধ গান ও দোহা। যে প্রাচীন বাঙালি বৌদ্ধ দার্শনিক সমগ্র এশিয়া মহাদেশ মাতিয়ে ছিলেন সেই যুগে, তার নাম ছিল শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর। এখানে কোনটি তার নাম, কোনটি খেতাব, কোনটি পদবী তা আবিস্কার করা সম্ভব নয়। আবার কাহ্নপাদ ছিলেন সব চেয়ে বেশী চর্যার লেখক। তাঁর নামের সাথে ‘পাদ’ শব্দ যুক্ত দেখা যায়। এই ‘পাদ’ কি পদকর্তার খেতাব, নাকি এটি কোন পদবীই, সে বিষয়ে এখনো কোন গবেষক সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। বর্তমানে বাঙালি বৌদ্ধের জনপ্রিয় পদবী হচ্ছে ‘বড়–য়া’। বাংলাদেশের বসবাসকারী অধিকাংশ বৌদ্ধের নামের সাথেই ‘বড়ুয়া’ পদবী যুক্ত দেখা যায়। ‘বড়–য়া’ অর্থ হচ্ছে সম্মানিত ব্যক্তি, আবার ধনী ব্যক্তিও। চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের পদবী যেমন এটি, তেমনি আসামের কোন কোন অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানের পদবীও রয়েছে ‘বড়–য়া’। বাঙালি বৌদ্ধের আরেকটি পদবী রয়েছে তা হলো ‘মুৎসুদ্দী’। এর অর্থ প্রধান কেরানী অথবা প্রতিনিধিও হতে পারে। অনেক গবেষক মনে করেন ‘মুৎসুদ্দী’ পদবীটি মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ী থেকে এসেছে। তাছাড়া বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে দেওয়ান, চৌধুরী ইত্যাদি পদবীর ব্যবহার রয়েছে।
বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় উপরোক্তদের ছাড়াও কিছু ক্ষুদ্র জাতি সমূহের কিছু পদবী রয়েছে। যেমন-চাকমা, দেওয়ান, রায় ইত্যাদি। উপজাতি চাকমা ক্ষুদ্র জাতির প্রধান পদবী হচ্ছে ‘চাকমা’। এছাড়া ‘খীশা’ পদবীর ব্যবহারও দেখতে পাই। বাঙালি গারো, সাওতাল, হাজং প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গুলি মধ্যে প্রচলিত রয়েছে বিচিত্র রকমের বংশ পদবী। এর মধ্যে স্রং, সাংমা, রুরাম, দারিং গাগ্রা প্রভৃতি পদবীর ব্যবহার লক্ষনীয়।
পরিশেষে বাঙালি মুসলমানের কিছু বিখ্যাত বংশ পদবীর ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। এই যেমন-শিকদার, সৈয়দ, শেখ, মীর, মিঞা, মোল্লা, দাস, খন্দকার, আকন্দ, চৌধুরী, ভুইয়া, মজুমদার, তরফদার, তালুকদার, সরকার, মল্লিক, মন্ডল, পন্নী, ফকির, আনসারী, দত্ত ইত্যাদি।
শিকদারঃ সুলতানি আমলে কয়েকটি মহাল নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিক। আরবি শিক হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ। এর সাথে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী। শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী। এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করতো বলে শিকদার উপাধী পেয়েছিল; সেই থেকে বংশ পরম্পরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে।
সৈয়দঃ সৈয়দ পদবী মূলত এসেছে নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা ও হযরত আলীর বংশধর থেকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সাথে কোনা যোগসূত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবহার করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও কুলীন মুসলমান বলে দাবি করে থাকেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবীর অপব্যবহার ও প্রক্ষাপণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ নন এবং পারিবারিক কোন কুলীন পদবীও নেই, অথবা পূর্ব পদবী ঐতিহ্য পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক বংশ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষে বাংলাদেশে সৈয়দ পদবী আরোপিতভাবে ব্যবহার শুরু করেছে। প্রচুর বাঙালি মুসলমান রয়েছে যারা পূর্ব ঐতিহ্যগত ভাবে সৈয়দ নন, অথচ তাদের নামের পূর্বে পদবীর পরিচয়বাহী সংক্ষিপ্ত শব্দ বা শব্দ গুচ্ছ যথা ‘এস-এম’ যুক্ত করে থাকেন। বস্তুত এস.এম হচ্ছে ‘সৈয়দ মোহাম্মদ’ অথচ ব্যবহারকারীরা অনেক সময়ই তা পুরোপুরি ভেঙে লেখেন না হয় তো ভয়ের কারণে। শেখঃ শেখ আরবি থেকে আগত পদবী। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবী শেখ। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্র প্রধান, তাকেই বলা হতো শেখ। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সরাসরি যাকে বা যাঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশ ধরও শেখ নামে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবী লাভ করতেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে যারা শেখ পদবী ধারণ করেন, তারা এ রকম ধারণা পোষণ করেন না যে, তারা বা তাদের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন সৌদী আরব থেকে। বাঙালি সৈয়দ পদবী ধারীদের থেকে শেখ পদবীধারীদের এখানে একটা মৌলিক তাৎপর্যগত পার্থক্য রয়েছে। শেখ পদবী গ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে ঐ পূর্বোক্ত চেতনা। নবীর হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আর্বিভাবের সাথে সাথে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন; ‘নও মুসলমান’ হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারাই শেখ পদবী ধারণ করে ছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বংশের উত্তর সূরীরাই শেখ পদবী ব্যবহার করে এসেছেন। এমনিতে অন্য ধর্মের লোকের কাছে মুসলমান মানেই শেখ বা সেক। বাংলায় শেখ পদবী তাই নানা ভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কেউ কেই শেখ কেউ সেক কিংবা কেউ বা শেখ এর রূপান্তর শাইখও ব্যবহার করে থাকেন।
মীরঃ মির বা মীর শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আরবি শব্দ ‘আমীর’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে মীর। সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। জিতে নেয়া বা জয়ী হওয়া অর্থে মীর শব্দের ব্যবহার হতো। তবে মীর বংশীয় লোককে সম্ভ্রান্ত এবং সৈয়দ বংশীয় পদবীধারীর একটি শাখা বলে গাবেষকরা মনে করেন।
মিঞাঃ মিঞা মুসলিম উচ্চ পদস্থ সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রম সূচক শব্দ। এক অর্থে সকল মুসলমানের পদবীই হচ্ছে মিঞা। বাঙালি হিন্দুর ‘মহাশয়’ এর পরিবর্তে বাঙালি মুসলমান মিয়া শব্দ ব্যবহার করে থাকে। ‘মিঞা’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। প্রভু বা প্রধান ব্যক্তি বুঝাতেও মিয়া শব্দের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে গ্রামীন প্রধান বা সর্দার অর্থের মিঞা পদবী হিসেবে বাঙালি মুসলমান সমাজে ঠাঁই পেয়েছে।মোল্লাঃ মোল্লা এবং মুন্সী বাঙালির দুটো জনপ্রিয় পদবী। তাদের প্রসার প্রায় দেশব্যাপী। বঙ্গীয় শব্দকোষ এ মোল্লা শব্দের অর্থ করা হয়েছে মুসলমান পুরোহিত। বস্তুত এভাবে মসজিদে নামাজ পরিচালনার কারণেও অনেকে মোল্লা উপাধি পেয়েছিল এবং তার পর থেকেই মোল্লা পদবীর ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে, মোল্লা হচ্ছে তুর্কি ও আরবি ভাষার মোল্লা থেকে আগত একটি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট মহাপন্ডিত ব্যক্তি। অন্য অর্থে মুসলিম পন্ডিত বা ব্যবস্থাপক বা অধ্যাপক হলেন মোল্লা। পরবর্তী কালে মসজিদে নামাজ পরিচারলনাকারী মাত্রই মোল্লা নামে অভিহিত হতে থাকে। এখান থেকেই সাধারণত বংশ পদবী হিসেবে তা ব্যবস্থার হওয়া শুরু হয়। তাঁরা সকল জ্ঞানের জ্ঞানী না হওয়া সত্ত্বেও মোল্লা পদবী ধারণ করে। যার ফলে ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ প্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে।
দাসঃ বাঙালি হিন্দু সমাজে দাস বা দাশ বংশ পদবীর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যে সমস্ত হিন্দু সম্পদায়ের মানুষ পদবীতে দাশ লেখেন তাদের পেশা ধীবর থেকে এসেছে বলে গবেষকরা মনে করেন। আর যারা দাস লেখেন তাদের পদবী স্রষ্টার ভূত্য চেতনা থেকে এসেছেন।
খন্দকারঃ মুসলিম সমাজের ফারসি শিক্ষক হিসেবে খোন্দকার বা খন্দকারের পরিচয় পাওয়া যায় । অন্য দিকে খোন্দকারের ’ পদবী এসেছে সামন্ত সমাজ থেকে পেশাজীবী হিসেবে। সাধারণ ভাবে খোন্দকার বা খন্দকার অর্থ হচ্ছে কৃষক বা চাষাবাদকারী । মনে করা হয় ‘ফারসি‘কনদহ ’ এর যার অর্থ কৃষি’সাথে‘কার যুক্ত হয়ে কনদহকার> খনদহকার>খন্দকার হয়েছে। ভিন্ন মতে, খন্দকারের মূল উৎপত্তি সংস্কৃত কন্দ> খন্দ যার অর্থ ফসল বলা হয়েছে। এই খন্দ এর সাথে কার যুক্ত হয়েও খন্দকার> খোন্দকার হতে পারে। এবং এতেও পূর্বের ‘খন্দকার’ শব্দের উৎসের অর্থের তারতম্য ঘটছে না। আবার ফারসি ভাষায়, খোন্দকার বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ শিক্ষক। সেখান থেকেও খোন্দকার পদবী আসা বিচিত্র কিছু নয়। অথবা খোন্দকার শব্দের যে ভিন্নভিন্ন অর্থ তার সবগুলো মিলিত তাৎপর্য থেকেই বিভিন্নভাবে খন্দকার পদবীর উৎপত্তি হয়েছে।**********
আখন্দঃ খন্দকার ও আখন্দ বা আকন সমার্থক। আখন্দ ও আকন নামে যে সব পদবী তাও সম্ভবত খন্দকার পদবীরই রূপভেদ। খন্দকার>আখন্দ> আকন হয়ে থাকতে পারে। আবার ফারসি আখুন্দ থেকেও আখন্দ এসে থাকতে পারে। যার অর্থ শিক্ষক। তবে আকন্দ এসেছে আখন্দ থেকেই।চৌধুরীঃ সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ। এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তগর্ত অঞ্চলের শাসক। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী হচ্ছে চৌধুরী।
আবার অনেকে মনে করেন ‘চৌথহারী’ যার অর্থ এক চতুথাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে ‘চৌধুরী’। সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে,‘চতুর’ যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ, তার সাথে যুক্ত হয়েছে ‘ধর’ (অর্থ ধারক) এবং এই দুয়ে মিলে হয়েছে ‘চৌধরী’ > আর তার থেকেই ‘চৌধুরী’। তবে তা মূলত হিন্দী ও মারাঠি শব্দ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে চৌধুরী বংশ পদবী ব্যবহার করা হয় এদেশে। বৃটিশ-ভারতের প্রায় সর্বত্র এ পদবীর অস্তিত্ব ছিল। কারণ চৌধুরী ছিল সামন্ত রাজার পদবী।
ভূঁইয়াঃ এই বংশ পদবীটি এসেছে খোদ ভূমির মালিকানা অর্থ থেকে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যে এ পদবীর প্রচলন আছে। বাঙালি হিন্দু সমাজে যাঁরাই ‘ভৌমিক’ বাঙালি মুসলমান সমাজে তারা ‘ভূঁইয়া’ হিসেবে পদবী ধারণ করেছেন। মূল সংস্কৃত শব্দ ভৌমিক > (প্রাকৃত) ভূমিকা > (বাংলা) ভূঁইয়া > থেকে ভূঁইয়া বা ভূঁঞা এসেছে। প্রাচীন বড় জমিদার বা সামন্ত রাজার উপাধিও ছিল ভূঁইয়া। প্রকৃত পক্ষে কুলীন বংশ পদবীই ছিল তা। আবার যে সব মানুষ আগে স্থান বিশেষে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি ও চাষাবাদের পত্তন করেছে তারা স্থানীয় জমিদার রাজার কাছ থেকে ভূঁইয়া নামে অভিহিত হয়ে ঐসব জমি জমার স্বত্ব লাভ করেছে।
মজুমদারঃ ‘মজুমদার’ পদবী মূল আসলে ‘মজুনদার’। এর মূল ফারসি শব্দ হচ্ছে ‘মজমু আনদার’। আজকের দিনে কালেকটরেট ভবনে যে জবপড়ৎফ শববঢ়বৎ রয়েছে, মোগল আমলে তারাই ছিল ‘মজুমদার। রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবী সংরক্ষিত ছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাংলাদেশে ‘মজুমদার’ পদবীর ব্যবহার লক্ষনীয়।
তরফদারঃ আরবি ‘তরফ’ এবং ফারসি ‘দার’ মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি। জমিদারের খাজনা আদায়ের মহালে তদারককারী কর্মচারী বা খাজনা আদায়কারীর উপাধী ছিল তরফদার। এই পদবী ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষরা এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন, সেখান থেকেই এই বংশ পদবী উৎপত্তি ও প্রচলন। অন্যমতে তরফদার তরফের রাজস্ব আদায়কারী লোক; গোমস্তা, দলের বা পক্ষের লোক। তরফের মালিক; পদবী বিশেষ। তালুকদারঃ আমাদের দেশে সুপরিচিত একটি বংশ পদবী। বাংলাদেশে জমিদারির পরই তালুক ভূ-সামাপত্তির একটি বিভাগ। মোগল ও বৃটিশ আমলে রাজস্ব ও ভুমি সংক্রান্ত বিষয়াদি থেকে যে সমস্ত পদবীর উৎপত্তি ও বিস্তার তার মধ্যে ‘তালুকদার’ হচ্ছে সবচেয়ে সম্মানীয় পদবী। ‘তালুক’ শব্দ থেকেও এই পদবীর মর্মাথ উপলব্ধি করা সম্ভব। আরবি শব্দ ‘তা’ আল্লুক’ যার অর্থ ভূ-সম্পত্তি এবং এর সাথে ফারসি ‘দার’ যুক্ত হয়ে (তা’আল্লুক+দার) ‘তালুকদার’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। যিনি জমিদার তিনিই হচ্ছে তালুকদার। তবে মনে হয় ‘ক্ষুদ্র জমিদার’ তা না হলে ‘জমিদার’ শব্দ থাকার পরও ‘তালুকদার’ শব্দের উৎপত্তি বা প্রচলন হতো না। প্রকৃত পক্ষে, যিনি তালুকদার, তিনি জমি ও ক্ষুদ্র ভূ-সম্পত্তি বন্দোবস্ত নিতেন সরকারের কাছ থেকেও যেমন, তেমনি জমিদারের কাছে থেকেও। ফলে তিনি হতেন উপজমিদার সেই অর্থেই এসেছে ‘তালুকদার’। বাঙালির ‘জমিদার’ শব্দ দিয়ে কোনো পদবী নেই, অথচ ছোট জমিদার ‘তালুকদার’ শব্দের পদবী রয়েছে। সাধারণত কয়েকটি গ্রাম বা কয়েকটি পরগণা নিয়ে এক একটি তালুকের সৃষ্টি। তালুকি স্বত্ব এক প্রকার ইজারা স্বত্বের মতো। এই স্বত্ব বংশানুক্রমে বর্তমান থাকতো খাজনা বাকি না পড়া পর্যন্ত তালুকিস্বত্ব বিনষ্ট হতোনা । আর তালুকের মালিক বা জোতদার নামে পরিচিত হতেন।
সরকারঃ ‘সরকার’ শব্দটি ফারসি থেকে আগত। এর অর্থ প্রভূ, মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা। অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারি ও সরকার। মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারিদের এ পদবী দেয়া হতো। মোট কথা প্রধান কর্মচারি এবং সম্পত্তি দেখাশুনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে সরকার বলা হতো। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যেই এ পদবীর ব্যবহার আছে।
মল্লিকঃ আরবি ‘মালিক’ বা ‘মলিক’ শব্দ থেকে এসেছে ‘মল্লিক’ বংশ পদবী। ফারসি মালিক শব্দজাত মল্লিক ভূম্যাধিকারী বা জোতদারের উপাধি। গ্রাম প্রধান বা সমাজের প্রধান ব্যক্তি মালিক। আবার লিপিকুশল রাজকর্মচারিকে মোগল আমলে মল্লিক বা সুলেখক আখ্যা দেয়া হত বলেও আমরা জানতে পারি। হয়তোবা সেই থেকে মল্লিক বংশ পদবী এসেছে।
মন্ডলঃ বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সমাজে সমান ভাবে ব্যবহৃত হয় মন্ডল পদবী। বাংলাদেশে অতীত কাল থেকে গ্রামের অনানুষ্ঠানিক এবং সাধারণ ভাবে সীকৃত গ্রাম- প্রধানকে বলা হয় মন্ডল। বাংলা মন্ডলরা আগে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মন্ডলীয় কাজ করে তারা অনেক অধিকার ভোগ করতেন। খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা কিংবা গ্রামীন বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে মন্ডলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন। কোন কোন সময় তাদের অধীনে পাটোয়ারি, তহসিলদার, চৌকিদার ইত্যাদি কর্মচারী কাজ করতেন। সরকার ও রায়তদের মধ্যবর্তী মানুুষ হিসেবে মন্ডলরা অধিক পরিচিত ছিল।
ফকিরঃ মুসলমানদের মধ্যে ‘সন্ন্যাসবৃত্তি’ থেকেইফকিরঃ মুসলমানদের মধ্যে ‘সন্ন্যাসবৃত্তি’ থেকেই এসেছে ‘ফকির’ পদবী। মরমী সাধকরা গ্রহণ করতেন ‘ফকির’ পদবী। এটি আরবি শব্দ, যার মূল অর্থ নি:স্ব। আবার আরবি ফকর শব্দের অর্থ দারিদ্র। এ থেকে ফকির শব্দের উৎপত্তি। ফকির এবং পার্শি দরবেশ ব্যক্তিগণ সাধারণত এদেশে ফকির নামে পরিচিত। বিশেষ কোন ধর্ম মতের একান্ত অনুসারী না হয়ে যারা সকল ধর্মের মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করেন তাদেরকেও ফকির বলা হয়। আবার সুফি বা বাউল তত্বের ধারকরাও ফকির।
ঠাকুরঃ বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দ্যোপধ্যায়ের মতে- ঠাকুর শব্দের মূল হচ্ছে (সংস্কৃত) ‘ঠাক্কুর’ তার থেকে > (প্রকৃত) ঠকুর > (বাংলা) ঠাকুর এসেছে। পদবীগত দিক থেকে তা ব্রাক্ষণের পদবী বিশেষ, এমনকি ক্ষত্রিয়েরও উপাধি এটি। মধ্য যুগের কাব্য ‘চৈতন্য ভাগবত’ উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন, তা বৈঞ্চবেরও উপাধি। যেমন, হরিদাস ঠাকুর। পাচক ব্রাক্ষণও এক প্রকার ঠাকুর বলে পরিচিত। তবে আহমদ শরীফ সম্পাদিত ‘সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’ বলছে, সংস্কৃত ঠক্কুর থেকে ঠাকুর আসলেও এর মূলে ছিল তুর্কী শব্দ। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়েই এই পদবী ব্যবহার করে।
এরকম শতাধিক বংশ পদবী রয়েছে আমাদের দেশে। সব বংশ পদবীর ইতিহাস লিখলে বিশাল আকৃতির বই হবে। আমি আর সে দিকে যেতে চাইনা। পরিশেষে বলতে চাই বাঙালির পদবীর ইতিহাস বৈচিত্র পথ ও মতের এক অসাধারণ স্মারক হিসেবে চিহিৃত। বাঙালি মুসলমানের পদবী ব্যবহারের উদ্যোগ খুব বেশি প্রাচীন না হলেও, তাতে কম করে হলেও হাজার বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাঙালির বংশ পদবী গুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু আঞ্চলিক পদবী, শুধু অঞ্চল থেকেই তার জন্ম ও ব্যবহার। কিছু পদবী রয়েছে একেবারে বাঙালির জাতীয়। সারা বঙ্গ জুড়েই তার প্রসার। কয়েকটি অবশ্য ধর্মীয় পদবী রয়েছে, যা হিন্দু-মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব। তবে জনপ্রিয় পদবী গুলির বেশির ভাগই ধর্ম নিরপেক্ষ এবং একান্ত ভাবে বাঙালির সম্পদ।

সাংখ্য দর্শন ও বেদান্ত দর্শন


সাংখ্য দর্শন ও বেদান্ত দর্শন


ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু


 "কতগুলি কারণে,  সংস্কৃত কলেজে,  বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয়। 
কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। 
তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়াতেই হবে,  তখন তার প্রতিষেধক হিসাবে ছাত্রদের ভাল ভাল ইংরাজি দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার।" --- ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় !

সূত্র : অপূর্ব মণ্ডল, ফেসবুক। ( উৎস:- বিদ্যাসাগর চরিত, পঞ্চম সংস্করণ, চতুর্থ অধ্যায়)।

মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বাংলাদেশকে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে রাজি মমতা






বাংলাদেশকে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে রাজি মমতা




বাংলাদেশকে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে রাজি মমতা।
উচ্ছ্বসিত হাসিনা !

পশ্চিমবঙ্গ এখন লোডসেডিং-এ কাহিল ! দিনে-রাতে, যখন-তখন লোডসেডিং ! কখনও ঘন্টাখানেকের বেশি সময় ধরে !

তারপরে আবার বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশকে বিদ্যুৎ দেওয়া !

বাংলাদেশ তো কেবল হিন্দুদের তাড়িয়ে যাচ্ছে... আর মুসলিম অনুপ্রবেশকারিদের পশ্চিমবঙ্গে ঢোকাচ্ছে... !

শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নালন্দা


   নালন্দা

  ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু

নালন্দা = নালম + দা
নালম ---> পদ্মফুল যা জ্ঞানের প্রতীক
দা ---> দান করা।
“নালন্দা” শব্দের অর্থ “জ্ঞান দানকারী”। প্রথম অবস্থায় নালন্দা ছিল একটি বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধধর্ম চর্চার কেন্দ্র। পরবর্তীতে নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা উপলব্ধি করেন যে ধর্মচর্চার পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত ইত্যাদিরও চর্চার প্রয়োজন উন্নত জাতি গঠনের জন্য। তাঁদের উৎসাহে বৌদ্ধ বিহারটি ক্রমে রূপ নেয় সর্বাঙ্গীন শিক্ষাচর্চা কেন্দ্রের। গুপ্ত সম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন। মূলত গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্তের আমলেই এই মহা বিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাটগণ পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান। ৪২৭ বা ৪৫০ খৃষ্টাব্দে স্থাপিত হওয়ার পর প্রায় ৮০০ বছর ধরে জ্ঞান বিতরন করে গেছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।
নালন্দা ছিল সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রবেশ করতে গেলে আজকের দিনের মতোই কঠিন পরীক্ষায় বসতে হত। শোনা যায় প্রতি দশ জনে তিন জন সেই পরীক্ষায় পাশ করত। ছাত্র সংখ্যা ছিল আন্দাজ দশ হাজার। শিক্ষক দুই হাজার । ৫:১ এর ঈর্ষনীয় ছাত্র - শিক্ষক অনুপাত।
নালন্দা ছিল সত্যিকারের "বিশ্ববিদ্যালয়"। ভারতবর্ষের সীমা অতিক্রম করে পশ্চিমে সুদূর ইরান, ইরাক, তুরস্ক, গ্রীস থেকে; উত্তরে হিমালয় পেরিয়ে চীন থেকে; উত্তর ও পূর্বে সাগর পেরিয়ে জাপান, ইন্দোনেশিয়া থেকে জ্ঞান পিপাসু আসত নালন্দায়। সম্পূর্ণ অবৈতনিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল খরচ বহন করার জন্য উদার বৌদ্ধ শাসকরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ২০০ গ্রামকে উৎসর্গ করেছিলেন। চিনতে পারার সুবিধার্থে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরী করে গ্রাম গুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছিল অনান্য গ্রাম থেকে। এই সব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্য দ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচের যোগান আসত।
প্রাচীর বেষ্টিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল এলাকায় শ্রেনীকক্ষ, ছাত্রাবাস, শিক্ষকাবাস, সুরম্য উদ্যান, বীথি, দিঘি ইত্যাদি তো ছিলই; তার সাথে ছিল বিশ্বের অহংকার, সুবিশাল তিনটি গ্রন্থাগার।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন পন্ডিত শীলভদ্র। বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম।
তারপর নেমে এল কালো দিন।
১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী এল নালন্দায়। লক্ষ্য একটাই, ইসলামের প্রসার। প্রচার নয় প্রসার। নালন্দার বৌদ্ধ ভিক্ষু, ছাত্র, শিক্ষক কেউ যখন ধর্মান্তরিত হতে রাজি হল না, তখন শুরু হল হত্যালীলা। তার আক্রমনের বর্বরতা সম্পর্কে পারস্য ইতিহাসবিদ মিনহাজ “তাবাকাতে নাসিরি” গ্রন্থে লিখেছেন “হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করে খিলজী”। এরপর আগুন লাগিয়ে দেয় লাইব্রেরীর ভবনগুলোতে। লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমান এত বেশী ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বইগুলো পুড়ে ছাই হতে। জনশ্রুতি আছে ছয় মাস সময় লেগেছিল সব বই পুড়তে। বর্বর খিলজী শুধু নালন্দাকে পোড়ায়নি, শুধু ছাত্র শিক্ষক ভিক্ষুদের হত্যা করেনি, সে শেষ করে দিয়েছে এক জাতির তথা সমগ্র পৃথিবীর এক রত্নকে। অতীত ভারতের অমূল্য রত্ন চিরতরে হারিয়ে গেল নরপিশাচের উন্মাদনায়।
তারপর খিলজী এল সোনার বাংলায়। যার ফলশ্রুতি আজকের মৌলবাদী বাংলাদেশ। সে এক অন্য কলঙ্কময় অধ্যায়।
ভারত আজও বহন করে চলেছে বর্বর খিলজীর চিহ্ন, কোনো সভ্য দেশে যা চিন্তাই করা যায় না। নালন্দা সংলগ্ন রেলওয়ে স্টেশনের নাম "বখতিয়ারপুর"! নরাধম বর্বর খিলজীর চিহ্ন সমূলে উপড়ে ফেলে সেখানে চাই বাঙালীর গর্ব আচার্য শীলভদ্র বা মহাজ্ঞানী পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের নামে শহর, স্টেশন। কোনো বাঙালী বুদ্ধিজীবি কি দাবি জানাবেন?

রামকৃষ্ণ


  রামকৃষ্ণ

  *** রামকৃষ্ণ***         ফেসবুক থেকে      শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু

***ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখনীয়:***

গৃহস্থ শিষ্য :– মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অক্ষয়কুমার সেন প্রমুখ;

ত্যাগী বা সন্ন্যাসী শিষ্য :– নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ), রাখালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), কালীপ্রসাদ চন্দ্র (স্বামী অভেদানন্দ), তারকনাথ ঘোষাল (স্বামী শিবানন্দ), শশীভূষণ চক্রবর্তী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী (স্বামী সারদানন্দ) প্রমুখ।
এছাড়া নারী ভক্তদের একটি ছোটো অংশও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। এঁদের মধ্যে গৌরী মা ও যোগীন মা উল্লেখযোগ্য। এঁদের কেউ কেউ মন্ত্রদীক্ষার মাধ্যমে তাঁর থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। তবে তপস্যার বদলে শহরে অবস্থান করে নারীসমাজের সেবাতেই তাঁদের উৎসাহিত করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসতে শুরু করেন - “কি মহারাজা কি ভিখারি, কি পত্রিকাকার কি পণ্ডিত, কি শিল্পী কি ভক্ত, কি ব্রাহ্ম কি খ্রিস্টান কি মুসলমান, সকল মতের সকল পেশার আবালবৃদ্ধ বণিতা”। জীবনীকারদের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন খুবই মিশুকে ও তুখোড় আলাপচারী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক নাগাড়ে বলে যেতে পারতেন – নিজের অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতার কথা, নানা গল্প; খুব সাধারণ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে চলতেন বেদান্তের দুর্বোধ্য তত্ত্ব; রসিকতা, গান বা অন্যদের নকল করারও মাধ্যমে আমোদ-প্রমোদেও পিছপা হতেন না। সকল শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধের মত টেনে রাখতেন তাঁর কাছে।
কিছু সন্ন্যাসী শিষ্য থাকলেও, তিনি সকলকে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে বলতেন না। আবার ত্যাগী শিষ্যদের সন্ন্যাসজীবনের জন্য প্রস্তুত করার মানসে তাদের জাতিনির্বিশেষে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষা করার নির্দেশ দিতেন। এঁদের তিনি সন্ন্যাসী জীবনের প্রতীক গৈরিক বস্ত্র ও মন্ত্রদীক্ষাও দান করেছিলেন।
COLLECTED*

বুদ্ধদেব বসু


   বুদ্ধদেব বসু

    ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন             প্রণব কুমার কুণ্ডু

কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক এবং সম্পাদক
বুদ্ধদেব বসু (জন্মঃ- ৩০ নভেম্বর, ১৯০৮ - মৃত্যুঃ- ১৮ মার্চ, ১৯৭৪)
অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরী করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় সমানে লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্যের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে স্বাগত বিদায় গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র-পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
জন্ম
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয় কুমিল্লায়। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর পিতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘন্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয় কুমারী ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ-মাতামহীর কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। পুলিশ অফিসার বা দারোগা চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন তাঁর পিতামহ। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়।
১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০ -এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৩১ খৃষ্টাব্দে তিনি ঢাকা পরিত্যাগ করে কলকাতায় অভিভাসন গ্রহণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯৩৪ সালে খ্যাতিমান লেখিকা প্রতিভা বসু'র (বিবাহ-পূর্বঃ প্রতিভা সোম) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
কর্ম জীবন
অধ্যাপনার মাধ্যমেই তাঁর কর্মময় জীবন শুরু। জীবনের শেষাবধি তিনি নানা কাজে-কর্মে ব্যাপৃত রেখেছেন। শিক্ষকতাই ছিল জীবিকা অর্জনে তার মূল পেশা। কর্মময় জীবনের শুরুতে স্থানীয় কলেজের লেকচারের পদের জন্য আবেদন করে দু'বার প্রত্যাখ্যাত হলেও ইংরেজি সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য পরিণত বয়সে তিনি আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। বাঙলা ভাষার তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার ক্ষীণস্রোতকে তিনি বিস্তৃত ও বেগবান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫২ সালে দিল্লী ও মহিশূরে ইউনেস্কোর প্রকল্প উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসু তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
এছাড়াও, তিনি উচ্চ মানের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বুদ্ধদেব বসু প্রভুগুহ ঠাকুরতা, অজিত দত্ত প্রমূখকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। এ সময় ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২৭ - ১৯২৯ পর্যন্ত সচিত্র মাসিক 'প্রগতি' (১৯২৭) মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন এবং 'কল্লোল' (১৯২৩) গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কলকাতায় বসবাসকালে তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ১৯৩৫ সালে ত্রৈমাসিক কবিতা (আশ্বিন ১৩৪৪) পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পঁচিশ বছরেরও অধিককাল তিনি পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা সম্পাদনা করে আধুনিক কাব্যআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তৃতীয় বর্ষ ১ম সংখ্যা (আশ্বিন ১৩৪৪) থেকে বুদ্ধদেব ও সমর সেন এবং ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (চৈত্র ১৩৪৭) থেকে বুদ্ধদেব বসু একাই এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায়, সদিচ্ছায়, অনুশাসনে এবং নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বাংলা কবিতা তার যথার্থ আধুনিক রূপ লাভ করে। এটি কবি বুদ্ধদেব বসুর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশে কবিতা পত্রিকার ভূমিকা দূরসঞ্চারী। আধুনিক বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি, প্রসার ও তা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে কবিতার তুলনারহিত।
১৯৩৮ সালে হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে ত্রৈমাসিক চতুরঙ্গ সম্পাদনা করেন। ১৯৪২ সালে ফ্যাসীবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের আন্দোলনে যোগদান করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একজন সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু'র গদ্য ও পদ্যের রচনাশৈলী স্বতন্ত্র ও মনোজ্ঞ। রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক কাব্য ধারার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। গদ্যশিল্পী হিসেবে সমধিক সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতময়তা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর গদ্যের বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সমালোচনামূলক সাহিত্য রচনায়ও মৌলিক প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্য গঠনের ভঙ্গী গ্রথিত করে বাংলা ভাষাকে অধিকতর সাবলীলতা দান করেন তিনি।
বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন,
“ আধুনিক বাংলা-সাহিত্যের যে অধ্যায়কে বলা হয় 'কল্লোল যুগ' সেই অধ্যায়ের তরুণতম প্রতিনিধি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে যখন 'কল্লোল' প্রকাশিত হয় তখন বুদ্ধদেবের বয়স মাত্র পনেরো। কলকাতায় কল্লোল (১৩৩০) এবং কালিকলমে'র (১৩১৩) মতো ঢাকায় 'প্রগতি' ছিল সে যুগের আধুনিকতার মুখ্য বার্তাবহ। গ্রন্থকার হিসেবে বুদ্ধদেবের জীবনে ১৯৩০ সালটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই বৎসরেই তাঁর বন্দীর বন্দনা (কাব্য), সাড়া (উপন্যাস), অভিনয় নয় (ছোট গল্প-সঙ্কলন) প্রকাশিত হয়। তখন তিনি সবেমাত্র একুশ বৎসর অতিক্রম করেছেন। ”
সাহিত্যে অবদান
ছাত্রজীবনে ঢাকায় তিনি যে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন প্রৌঢ় বয়সেও সেই এক্সপেরিমেন্টের শক্তি তাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর প্রথম যৌবনের সাড়া এবং প্রাক-প্রৌঢ় বয়সের তিথিডোর উপন্যাস দু'টি দুই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। তাঁর চল্লিশোর্ধ বয়সের রচনাগুলোর মধ্যে - গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত নানা চিরায়ত সাহিত্যের উপমার প্রাচুর্য্য দেখা যায়। অতি আধুনিক উপন্যাসের গীতিকাব্যধর্মী উপন্যাস রচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। রচনার অজস্রতা এবং অভিনব লিখনভঙ্গীর দিক দিয়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর উপন্যাসে যে ঘাত-প্রতিঘাত ও মানবিক প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেছেন, তাতে মনঃস্তত্ত্বের বিশ্লেষণের পরিবর্তে কাব্যোচ্ছাসের প্রাধান্য বিদ্যমান। অকর্মণ্য, রডোড্রেনড্রন গুচ্ছ, যেদিন ফুটল কমল প্রভৃতি উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু কাব্যপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিথিডোর, নির্জন স্বাক্ষর, শেষ পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি উপন্যাস নতুন জীবন-সমীক্ষা-রীতির পরিচয়বাহী।
বুদ্ধদেব বসু'র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পৃথিবীর প্রতি (১৯৩৩) 'বন্দীর বন্দনা'র পরিপূরক গ্রন্থ। উভয় গ্রন্থেই শরীরী প্রত্যয়ে প্রেমের অভিব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে। কিছুটা স্বাদের ব্যতিক্রম এসেছে - 'কঙ্কাবতী' (১৯৩৭) কাব্যগ্রন্থে। পদ ও বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তির সাহায্যে একটি ধ্বনি আবর্ত নির্মাণ করে বুদ্ধদেব বসু যৌবনের আনন্দগানকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক কবিকুলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। সুকুমার সেনের ভাষায় -
“ তাঁর লক্ষ্য ছিল আধুনিক কবিতার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং 'আধুনিক' কবিতা লেখকদের পক্ষ সমর্থন করা। ”
সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে সমালোচনামূলক সাহিত্যে তাঁর সাফল্য সমপর্যায়ের। তিনি বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্যগঠনের ভঙ্গী সুপ্রসিদ্ধ করেছেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতমগ্নতা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা বুদ্ধদেব বসু'র গদ্যের বৈশিষ্ট্য। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, সম্পাদনা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে বসু'র প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫৬টি।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পত্তনে যে কয়েকজনের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় বুদ্ধদেব বসু তার মধ্যে অন্যতম। তাকে কল্লোল যুগ-এর অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলা কবিতায় আধুনিক চিন্তা-চেতনা এবং কাঠামো প্রবর্তনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্যক পরিচয় ছিল। ফলে ইউরোপীয় এবং মার্কিন সাহিত্যের কলা-কৌশল বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতায় তার বাড়ির নাম রেখেছিলেন কবিতাভবন যা হয়ে উঠেছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান। ১৯৩০-এর দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকটি দশক সাহিত্য পরিমণ্ডলে তার প্রভাব ছিল অবিসংবাদিত। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তিনি কাজ করেছেন।
জীবনের শেষের দিকে তিনি নাট্যকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তপস্বী ও তরঙ্গিনী, কলকাতার ইলেকট্রা ও সত্যসন্ধ, কালসন্ধ্যা, পুনর্মিলন, অনামী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ প্রভৃতি নাট্যকাব্য বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন শিল্পরূপে জন্ম দিয়েছে। জগদীশ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন,
“ বস্তুত শুধু নিজে অজস্র রূপ ও রীতির কবিতা লিখেই নয়, সহযাত্রী এবং উত্তরসূরি আধুনিক কবি সমাজকে কবি মর্যাদায় সমুন্নীত করে কবিতা সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু একালের বাংলা কাব্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন। ”
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
কবিতাঃ
মর্মবাণী (১৯২৫), বন্দীর বন্দনা (১৯৩০), পৃথিবীর পথে (১৯৩৩), কঙ্কাবতী (১৯৩৭), দময়ন্তী (১৯৪৩), দ্রৌপদীর শাড়ি (১৯৪৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩), শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর (১৯৫৫), যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮), দময়ন্তী: দ্রৌপদীর শাড়ি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৬৩), মরচেপড়া পেরেকের গান (১৯৬৬), একদিন: চিরদিন (১৯৭১), স্বাগত বিদায় (১৯৭১)
উপন্যাসঃ
সাড়া (১৯৩০), সানন্দা (১৯৩৩), লাল মেঘ (১৯৩৪), পরিক্রমা (১৯৩৮), কালো হাওয়া (১৯৪২), তিথিডোর (১৯৪৯), নির্জন স্বাক্ষর (১৯৫১), মৌলিনাথ (১৯৫২), নীলাঞ্জনের খাতা (১৯৬০), পাতাল থেকে আলাপ (১৯৬৭), রাত ভর বৃষ্টি (১৯৬৭), গোলাপ কেন কালো (১৯৬৮), বিপন্ন বিস্ময় (১৯৬৯), রুক্‌মি (১৯৭২)
গল্পঃ
অভিনয়, অভিনয় নয় (১৯৩০), রেখাচিত্র (১৯৩১), হাওয়া বদল (১৯৪৩), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৫৯), একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু (১৯৬০), হৃদয়ের জাগরণ (১৩৬৮), ভালো আমার ভেলা (১৯৬৩), প্রেমপত্র (১৯৭২)
প্রবন্ধঃ
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি (১৯৩৫), কালের পুতুল (১৯৪৬), সাহিত্যচর্চা (১৩৬১), রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য (১৯৫৫), স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭), সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৩), প্রবন্ধ-সংকলন (১৯৬৬), কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)
নাটকঃ
মায়া-মালঞ্চ (১৯৪৪), তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬), কলকাতার ইলেক্ট্রা ও সত্যসন্ধ (১৯৬৮)
অনুবাদঃ
কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭), বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা (১৯৭০), হেল্ডালিনের কবিতা (১৯৬৭), রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা (১৯৭০)
ভ্রমণ কাহিনীঃ
সব-পেয়েছির দেশে (১৯৪১), জাপানি জার্নাল (১৯৬২), দেশান্তর (১৯৬৬),
স্মৃতিকথাঃ
আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩), আমার যৌবন (১৯৭৬)
সম্পাদনাঃ
আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৬৩)
নদী-স্বপ্ন – বুদ্ধদেব বসু
কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটোকথা শোনা দিকি
এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবেকি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে
আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকেহবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার- না, আমি একা ল’ব মাথা পেতে।
নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবলঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামী? সোনালী? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়
শুয়ে’ শুয়ে’ – মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই?
কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান ক’রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতেফুর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বে তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ’লো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পালতুলে দাও।
আমর দু’জন দেখি ব’সে ব’সে আকাশ কত না নীল,
ছোট পাখি আরো ছোট হ’য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গোলা, সূর্য লুকালো জলেরতলার ঘরে,
সোনা হ’য়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হ’লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ’লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।
ইলিশ
আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।
মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।
দায়িত্বের ভার
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,
যা-কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার-
সব যেন, বৃহদরণ্যের মতো তর্কপরায়ণ
হয়ে আছে বিকল্পকুটিল এক চতুর পাহাড়।
সেই যুদ্ধে বার বার হেরে গিয়ে, মরে গিয়ে, মন
যখন বলছে; শুধু দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা তার
সবচেয়ে নির্বাচিত, প্রার্থনীয়, কেননা তা ছাড়া আর
কিছু নেই শান্ত, স্নিগ্ধ, অবিচল প্রীতিপরায়ণ-
আমি তাকে তখন বিশ্বস্ত ভেবে, কোনো-এক দীপ্ত প্রেমিকার
আলিঙ্গনে সত্তার সারাত্সার করে সমর্পণ-
দেখেছি দাঁড়িয়ে দূরে, যদিও সে উদার উদ্ধার
লুপ্ত করে দিল ভাবা, লেখা, পড়া, কথোপকথন,
তবু প্রেম, প্রেমিকেরে ঈর্ষা করে, নিয়ে এলো ক্রূর বরপণ-
দুরূহ, নূতনতর, ক্ষমাহীন দায়িত্বের ভার।
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
প্রত্যহের ভার
যে-বাণীবিহঙ্গে আমি আনন্দে করেছি অভ্যর্থনা
ছন্দের সুন্দর নীড়ে বার বার, কখনো ব্যর্থ না
হোক তার বেগচ্যুত, পক্ষমুক্ত বায়ুর কম্পন
জীবনের জটিল গ্রন্থিল বৃক্ষে; যে-ছন্দোবন্ধন
দিয়েছি ভাষারে, তার অন্তত আভাস যেন থাকে
বত্সরের আবর্তনে, অদৃষ্টের ক্রূর বাঁকে-বাঁকে,
কুটিল ক্রান্তিতে; যদি ক্লান্তি আসে, যদি শান্তি যায়,
যদি হৃত্পিণ্ড শুধু হতাশার ডম্বরু বাজায়,
রক্ত শোনে মৃত্যুর মৃদঙ্গ শুধু; … তবুও মনের
চরম চূড়ায় থাক সে-অমর্ত্য অতিথি-ক্ষণের
চিহ্ন, যে-মূহূর্তে বাণীর আত্মারে জেনেছি আপন
সত্তা বলে, স্তব্ধ মেনেছি কালেরে, মূঢ় প্রবচন
মরত্বে; খন মন অনিচ্ছার অবশ্য বাঁচার
ভুলেছে ভীষণ ভার, ভুলে গেছে প্রত্যহের ভার।
ব্যাঙ
বর্ষায় ব্যাঙের ফুর্তি। বৃষ্টি শেষ, আকাশ নির্বাক;
উচ্চকিত ঐকতানে শোনা গেল ব্যাঙেদের ডাক।
আদিম উল্লাসে বাজে উন্মুক্ত কণ্ঠের উচ্চ সুর।
আজ কোনো ভয় নেই- বিচ্ছেদের, ক্ষুধার মৃত্যুর।
ঘাস হল ঘন মেঘ; স্বচ্ছ জল জমে আছে মাঠে
উদ্ধত আনন্দগানে উত্সবের দ্বিপ্রহর কাটে।
স্পর্শময় বর্ষা এল; কী মসৃণ তরুণ কর্দম!
স্ফীতকণ্ঠ, বীতস্কন্ধ- সংগীতের শরীরী সপ্তম।
আহা কী চিক্কণ কান্তি মেঘস্নিগ্ধ হলুদে-সবুজে!
কাচ-স্বচ্ছ উর্ধ্ব দৃষ্টি চক্ষু যেন ঈশ্বরের খোঁজে
ধ্যানমগ্ন ঋষি-সম। বৃষ্টি শেষ, বেলা পড়ে আসে;
গম্ভীর বন্দনাগান বেজে ওঠে স্তম্ভিত আকাশে।
উচ্চকিত উচ্চ সুর ক্ষীণ হলো; দিন মরে ধুঁকে;
অন্ধকার শতচ্ছিদ্র একচ্ছন্দা তন্দ্রা-আনা ডাকে।
মধ্যরাত্রে রুদ্ধদ্বার আমরা আরামে শয্যাশায়ী,
স্তব্ধ পৃথিবীতে শুধু শোনা যায় একাকী উত্সাহী
একটি অক্লান্ত সুর; নিগূঢ় মন্ত্রের শেষ শ্লোক-
নিঃসঙ্গ ব্যাঙের কণ্ঠে উত্সারিত- ক্রোক, ক্রোক, ক্রোক।
রূপান্তর
দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু,
রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে।
ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা,
বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী,
মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা।
জাগো, হে পবিত্র পদ্ম, জাগো তুমি প্রাণের মৃণালে,
চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান ক্ষমায়,
ক্ষণিকেরে কর চিরন্তন।
দেহ হোক মন, মন হোক প্রাণ, প্রাণে হোক মৃত্যুর সঙ্গম,
মৃত্যু হোক দেহ প্রাণ, মন।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা
আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পড়ো না, কথা বলেও নষ্ট করো না এই রাত্রি-
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।
কেননা কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হয়ে গেছে,
কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই;
তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল-
অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন।
কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন,
তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু?
বলো না ‘সুন্দর’, বলো না ‘ভালোবাসা’, উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না
নিজেদের-
শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে।
আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই,
যার উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে,
যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ-
নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন।
আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।
দেখবে কেমন ছোটো হতেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধরে যায়,
যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর, যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো
অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ-
সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত,
যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়,
রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ-
যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব
সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে,
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়-
সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের।
আমাকে ভুল বোঝো না। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ,
প্রাণ কত বিপন্ন।
কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান,
যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর
মৃত্তিকায়-
চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত।
তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি,
আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া?
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের-
যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।
নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক,
যারা ভোলো নি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে,
রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য
এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা :
আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ-
সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে
নিশান।
মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে
শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার।
স্টিল্ লাইফ
সোনালি আপেল, তুমি কেন আছ? চুমো খাওয়া হাসির কৌটোয়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে?
ঠাণ্ডা, আঁটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়?
এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র। হেমন্তের যেন অন্ত নেই।
গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে।
তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে
থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার। কিন্তু শুধু এই?
তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে
আসে ভারী-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা
থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে
ছুঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে
হয়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা-
যা দেখে, হঠাৎ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হতে
কোনো মৃতার প্রতি
‘ভুলিবো না’ - এত বড় স্পর্ধিত শপথে
জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।
তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে
ব্যপ্ত হোক। তোমার মুখশ্রী-মায়া মিলাক, মিলাক
তৃণে-পত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলে-স্থলে, আকাশের নীলে।
শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে
জ্বেলে রাখি এই রাত্রে - তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে।
বিদ্যাসুন্দর
বলতে পারো, সরস্বতীর
মস্ত কেন সম্মান?
বিদ্যে যদি বলো, তবে
গণেশ কেন কম যান?
সরস্বতী কী করেছেন?
মহাভারত লেখেন নি।
ভাব দেখে তো হচ্ছে মনে,
তর্ক করাও শেখেন নি।
তিন ভুবনে গণেশদাদার
নেই জুড়ি পাণ্ডিত্যে
অথচ তার বোনের দিকেই
ভক্তি কেন চিত্তে?
সমস্ত রাত ভেবে ভেবে
এই পেয়েছি উত্তর-
বিদ্যা যাকে বলি, তারই
আর একটি নাম সুন্দর।
প্রেমের কবিতা
শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
শুধু নয় কঙ্কণে ক্ষণে ক্ষণে ঝংকার
আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।
শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন।
-কিছু তার দ্বন্দ্ব, কিছু তার ছন্দ।
পুষ্পের নিশ্বাস, রেশমের শিহরণ,
রক্তের রক্তিমা, কনকের নিক্কণ।
গন্ধের বাণী নিয়ে পরশের সুরকার
অঙ্গের অঙ্গনে আনলো যে-উপহার-
সে-তো শুধু বর্ণের নহে গীত-গুঞ্জন।
-কিছু তার স্বর্ণ, কিছু তার স্বপ্ন।
বিলাসিত বলয়ের মত্ত আবর্তন,
মূর্ছিত রজনির বিদ্যুৎ-নর্তন।
বিহ্বল বসনের চঞ্চল বীণা তার
উদ্বেল উল্লাসে আঁধারের ভাঙে দ্বার-
সে কি শুধু উদ্দাম, উন্মাদ মন্থন।
---কিছু তার সজ্জা, কিছু তার লজ্জা।
শুধু নয় দু’জনের হৃদয়ের রঞ্জন,
নয়নের মন্ত্রণা, স্মরণের অঞ্জন।
রঙ্গিণী করবীর গরবিনী কবিতার
জাদুকর-তির্যক ইঙ্গিত আনে যার,
সে কি শুধু দেহতটে তরঙ্গ-তর্পণ।
-কিছু তার দৃশ্য, কিছু বা রহস্য।
এসো শুভ লগ্নের উন্মীল সমীরণ
করো সেই মন্ত্রের মগ্নতা বিকীরণ,
যার দান বিরহের অনিমেষ অভিসার,
মিলনের ক্ষণিকার কণ্ঠের মণিহার;---
সেথা বিজ্ঞানিকের বৃথা অণুবীক্ষণ।
---কিছু তার জৈব, কিছু তার দৈব।
শেষের রাত্রি
পৃথিবীর শেষ সীমা যেইখানে, চারিদিকে খালি আকাশ ফাঁকা,
আকাশের মুখে ঘুরে-ঘুরে যায় হাজার-হাজার তারার চাকা,
যোজনের পর হাজার যোজন বিশাল আঁধারে পৃথিবী ঢাকা।
(তোমার চুলের মতো ঘন কালো অন্ধকার,
তোমারি আঁখির তারকার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
বিশাল আকাশ বাসনার মতো পৃথিবীর মুখে এসেছে নেমে,
ক্লান্ত শিশুর মতন ঘুমায় ক্লান্ত সময় সগসা থেমে;
দিগন্ত থেকে দূর দিগন্তে ধূসর পৃথিবী করিছে খাঁ-খাঁ।
(আমারি প্রেমের মতন গহন অন্ধকার,
প্রেমের অসীম বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
নেমেছে হাজার আঁধার রজনি, তিমির-তোরণে চাঁদের চূড়া,
হাজার চাঁদের চূড়া ভেঙে-ভেঙে হয়েছে ধূসর স্মৃতির গুঁড়া।
চলো চিরকাল জ্বলে যেথা চাঁদ, চির-আঁধারের আড়ালে বাঁকা
(তোমারি চুলের বন্যার মতো অন্ধকার,
তোমারি চোখের বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )
এসেছিল যত রূপকথা-রাত ঝরেছে হলদে পাতার মতো,
পাতার মতন পীত স্মৃতিগুলি যেন এলোমেলো প্রেতের মতো।
---রাতের আঁধারে সাপের মতন আঁকাবাঁকা কত কুটিল শাখা
(এসো, চলে এসো; সেখানে সময় সীমাহীন
হঠাৎ ব্যথায় নয় দ্বিখণ্ড রাত্রিদিন;
সেখানে মোদের প্রেমের সময় সীমাহীন,
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
অনেক ধূসর স্বপনের ভারে এখানে জীবন ধূসরতম,
ঢালো উজ্জ্বল বিশাল বন্যা তীব্র তোমার কেশের তম,
আদিম রাতের বেণিতে জড়ানো মরণের মতো এ-আঁকাবাঁকা।
(ঝড় তুলে দাও, জাগাও হাওয়ার ভরা জোয়ার,
পৃথিবী ছাড়ায়ে সময় মাড়ায়ে যাবো এবার,
তোমার চুলের ঝড়ের আমরা ঘোড়সাওয়ার---
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )
যেখানে জ্বলিছে আঁধার-জোয়ারে জোনাকির মতো তারকা-কণা,
হাজার চাঁদের পরিক্রমণে দিগন্ত ভরে উন্মাদনা।
কোটি সূর্যের জ্যোতির নৃত্যে আহত সময় ঝাপটে মাথা।
(কোটি-কোটি মৃত সূর্যের মতো অন্ধকার
তোমার আমার সময়-ছিন্ন বিরহ-ভার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
তোমার চুলের মনোহীন তমো আকাশে-আকাশে চলেচে উড়ে
আদিম রাতের আঁধার-বেণিতে জড়ানো মরণ পঞ্জে ফুঁড়ে,---
সময় ছাড়ায়ে, মরণ মাড়ায়ে---বিদ্যুৎময় দীপ্ত ফাঁকা।
(এসো চলে এসো যেকানে সময় সীমানাহীন,
সময়-ছিন্ন বিরহে কাঁপে না রাত্রিদিন।
যেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
নবযৌবন
(এটি অগ্রন্থিত কবিতা)
বেদনায় রাঙা মোর দগ্ধ বুক ভরি
যুগ হতে যুগান্তর ধরি
কী গান উঠেছে বাজি, কী সঙ্গীত তুলিয়াছে তান
কোন্ মহামায়া মন্ত্র তুলিয়াছে নিত্য নব গান,
কী সঙ্গীত উঠিয়াছে ধ্বনিয়া
মর্ম-মাঝে রণিয়া-রণিয়া,
ওগো মহাকাল,
হে সুন্দর, নিষ্ঠুর, ভয়াল
তোমার ললাট ’পরে লেখা হয়েছিল যদি,
নিরবধি
বয়ে চলা ফল্গুধারা সম
ছিন্ন-তন্ত্রী এই বীণা মম
তোমার বুকের ’পরে জাগাইয়াছে যদি প্রতিধ্বনি
সে কথায় জেগে যদি উঠেছে অবনী,
তবে ওই ভীষণ মৌনতা
কেন আজ টুটিল তা?
কেন আজ ভেঙে গেল যুগান্তের শৃঙ্খল কঠিন?
প্রসন্ন নবীন
উদিল প্রভাত
অকস্মাৎ,
পোহাইল যেন দীর্ঘ দুঃখ-বিভাবরী,
কেটে গেল মরণ-শর্ব্বরী।
আর ভয় নাই, নাই ভয়,
জীবনে-মরণে আজ, প্রভূ মোর, হোক তব জয়!
এনেছে যৌবন তার
বিচিত্র সম্ভার;
বসন্তের ফুলদল হাতে লয়ে এসেছে সে
নব অতিথির বেশে।
তারে আজ করিনু বরণ,
তাহার পরশ পেয়ে ধন্য হল আমার মরণ,
ধন্য হল দুঃখ-দগ্ধ ক্লান্ত বিভাবরী,
তাই বক্ষ তরঙ্গিত করি,
উঠিয়াছে আনন্দ-হিল্লোল,
চিরন্তন সঙ্গীত কল্লোল
বক্ষে বাজে শঙ্খধ্বনি-সম,
নিরূপম
উচ্ছ্বাসের উন্মত্ত ধারায়,
জীবনের সূত্রগুলি আচম্বিতে কখন হারায়!
চিরদিনকার পাওয়া যৌবন আমার
লহ নমস্কার!
তুমি রুদ্র, তুমি ভয়ঙ্কর,
তাই তুমি অমন সুন্দর।
প্রবালের মতো তব রাঙা ওষ্ঠাধরে
চুম্বন আঁকিয়ে দিতে জন্ম-জন্মান্তরে
সাধ মোর;
অন্ধতার ঘোর
রাত্রির আকাশ সম সুনিবিড় কেশ,
ঊষার উদয় সম চক্ষে তব আনন্দ-উন্মেষ,
বক্ষে তব নবজন্ম আশা
মুখে তব বিশ্বসৃষ্টি ভাষা
সারা দেহে লীলায়িত গভীর বেদন
অনন্ত জীবন আর নিবিড় মরণ
নমি তোমা বার বার, হে আমার অনন্ত যৌবন।
...........