শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বুদ্ধদেব বসু


   বুদ্ধদেব বসু

    ফেসবুক থেকে         শেয়ার করেছেন             প্রণব কুমার কুণ্ডু

কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক এবং সম্পাদক
বুদ্ধদেব বসু (জন্মঃ- ৩০ নভেম্বর, ১৯০৮ - মৃত্যুঃ- ১৮ মার্চ, ১৯৭৪)
অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরী করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় সমানে লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্যের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে স্বাগত বিদায় গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র-পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
জন্ম
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয় কুমিল্লায়। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর পিতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘন্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয় কুমারী ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ-মাতামহীর কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। পুলিশ অফিসার বা দারোগা চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন তাঁর পিতামহ। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়।
১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০ -এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৩১ খৃষ্টাব্দে তিনি ঢাকা পরিত্যাগ করে কলকাতায় অভিভাসন গ্রহণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯৩৪ সালে খ্যাতিমান লেখিকা প্রতিভা বসু'র (বিবাহ-পূর্বঃ প্রতিভা সোম) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
কর্ম জীবন
অধ্যাপনার মাধ্যমেই তাঁর কর্মময় জীবন শুরু। জীবনের শেষাবধি তিনি নানা কাজে-কর্মে ব্যাপৃত রেখেছেন। শিক্ষকতাই ছিল জীবিকা অর্জনে তার মূল পেশা। কর্মময় জীবনের শুরুতে স্থানীয় কলেজের লেকচারের পদের জন্য আবেদন করে দু'বার প্রত্যাখ্যাত হলেও ইংরেজি সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য পরিণত বয়সে তিনি আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। বাঙলা ভাষার তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার ক্ষীণস্রোতকে তিনি বিস্তৃত ও বেগবান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫২ সালে দিল্লী ও মহিশূরে ইউনেস্কোর প্রকল্প উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসু তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
এছাড়াও, তিনি উচ্চ মানের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বুদ্ধদেব বসু প্রভুগুহ ঠাকুরতা, অজিত দত্ত প্রমূখকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। এ সময় ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২৭ - ১৯২৯ পর্যন্ত সচিত্র মাসিক 'প্রগতি' (১৯২৭) মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন এবং 'কল্লোল' (১৯২৩) গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কলকাতায় বসবাসকালে তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ১৯৩৫ সালে ত্রৈমাসিক কবিতা (আশ্বিন ১৩৪৪) পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পঁচিশ বছরেরও অধিককাল তিনি পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা সম্পাদনা করে আধুনিক কাব্যআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তৃতীয় বর্ষ ১ম সংখ্যা (আশ্বিন ১৩৪৪) থেকে বুদ্ধদেব ও সমর সেন এবং ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (চৈত্র ১৩৪৭) থেকে বুদ্ধদেব বসু একাই এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায়, সদিচ্ছায়, অনুশাসনে এবং নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বাংলা কবিতা তার যথার্থ আধুনিক রূপ লাভ করে। এটি কবি বুদ্ধদেব বসুর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশে কবিতা পত্রিকার ভূমিকা দূরসঞ্চারী। আধুনিক বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি, প্রসার ও তা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে কবিতার তুলনারহিত।
১৯৩৮ সালে হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে ত্রৈমাসিক চতুরঙ্গ সম্পাদনা করেন। ১৯৪২ সালে ফ্যাসীবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের আন্দোলনে যোগদান করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একজন সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু'র গদ্য ও পদ্যের রচনাশৈলী স্বতন্ত্র ও মনোজ্ঞ। রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক কাব্য ধারার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। গদ্যশিল্পী হিসেবে সমধিক সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতময়তা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর গদ্যের বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সমালোচনামূলক সাহিত্য রচনায়ও মৌলিক প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্য গঠনের ভঙ্গী গ্রথিত করে বাংলা ভাষাকে অধিকতর সাবলীলতা দান করেন তিনি।
বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন,
“ আধুনিক বাংলা-সাহিত্যের যে অধ্যায়কে বলা হয় 'কল্লোল যুগ' সেই অধ্যায়ের তরুণতম প্রতিনিধি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে যখন 'কল্লোল' প্রকাশিত হয় তখন বুদ্ধদেবের বয়স মাত্র পনেরো। কলকাতায় কল্লোল (১৩৩০) এবং কালিকলমে'র (১৩১৩) মতো ঢাকায় 'প্রগতি' ছিল সে যুগের আধুনিকতার মুখ্য বার্তাবহ। গ্রন্থকার হিসেবে বুদ্ধদেবের জীবনে ১৯৩০ সালটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই বৎসরেই তাঁর বন্দীর বন্দনা (কাব্য), সাড়া (উপন্যাস), অভিনয় নয় (ছোট গল্প-সঙ্কলন) প্রকাশিত হয়। তখন তিনি সবেমাত্র একুশ বৎসর অতিক্রম করেছেন। ”
সাহিত্যে অবদান
ছাত্রজীবনে ঢাকায় তিনি যে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন প্রৌঢ় বয়সেও সেই এক্সপেরিমেন্টের শক্তি তাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর প্রথম যৌবনের সাড়া এবং প্রাক-প্রৌঢ় বয়সের তিথিডোর উপন্যাস দু'টি দুই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। তাঁর চল্লিশোর্ধ বয়সের রচনাগুলোর মধ্যে - গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত নানা চিরায়ত সাহিত্যের উপমার প্রাচুর্য্য দেখা যায়। অতি আধুনিক উপন্যাসের গীতিকাব্যধর্মী উপন্যাস রচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। রচনার অজস্রতা এবং অভিনব লিখনভঙ্গীর দিক দিয়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর উপন্যাসে যে ঘাত-প্রতিঘাত ও মানবিক প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেছেন, তাতে মনঃস্তত্ত্বের বিশ্লেষণের পরিবর্তে কাব্যোচ্ছাসের প্রাধান্য বিদ্যমান। অকর্মণ্য, রডোড্রেনড্রন গুচ্ছ, যেদিন ফুটল কমল প্রভৃতি উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু কাব্যপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিথিডোর, নির্জন স্বাক্ষর, শেষ পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি উপন্যাস নতুন জীবন-সমীক্ষা-রীতির পরিচয়বাহী।
বুদ্ধদেব বসু'র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পৃথিবীর প্রতি (১৯৩৩) 'বন্দীর বন্দনা'র পরিপূরক গ্রন্থ। উভয় গ্রন্থেই শরীরী প্রত্যয়ে প্রেমের অভিব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে। কিছুটা স্বাদের ব্যতিক্রম এসেছে - 'কঙ্কাবতী' (১৯৩৭) কাব্যগ্রন্থে। পদ ও বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তির সাহায্যে একটি ধ্বনি আবর্ত নির্মাণ করে বুদ্ধদেব বসু যৌবনের আনন্দগানকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক কবিকুলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। সুকুমার সেনের ভাষায় -
“ তাঁর লক্ষ্য ছিল আধুনিক কবিতার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং 'আধুনিক' কবিতা লেখকদের পক্ষ সমর্থন করা। ”
সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে সমালোচনামূলক সাহিত্যে তাঁর সাফল্য সমপর্যায়ের। তিনি বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্যগঠনের ভঙ্গী সুপ্রসিদ্ধ করেছেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতমগ্নতা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা বুদ্ধদেব বসু'র গদ্যের বৈশিষ্ট্য। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, সম্পাদনা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে বসু'র প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫৬টি।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পত্তনে যে কয়েকজনের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় বুদ্ধদেব বসু তার মধ্যে অন্যতম। তাকে কল্লোল যুগ-এর অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলা কবিতায় আধুনিক চিন্তা-চেতনা এবং কাঠামো প্রবর্তনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্যক পরিচয় ছিল। ফলে ইউরোপীয় এবং মার্কিন সাহিত্যের কলা-কৌশল বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতায় তার বাড়ির নাম রেখেছিলেন কবিতাভবন যা হয়ে উঠেছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান। ১৯৩০-এর দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকটি দশক সাহিত্য পরিমণ্ডলে তার প্রভাব ছিল অবিসংবাদিত। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তিনি কাজ করেছেন।
জীবনের শেষের দিকে তিনি নাট্যকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তপস্বী ও তরঙ্গিনী, কলকাতার ইলেকট্রা ও সত্যসন্ধ, কালসন্ধ্যা, পুনর্মিলন, অনামী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ প্রভৃতি নাট্যকাব্য বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন শিল্পরূপে জন্ম দিয়েছে। জগদীশ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন,
“ বস্তুত শুধু নিজে অজস্র রূপ ও রীতির কবিতা লিখেই নয়, সহযাত্রী এবং উত্তরসূরি আধুনিক কবি সমাজকে কবি মর্যাদায় সমুন্নীত করে কবিতা সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু একালের বাংলা কাব্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন। ”
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
কবিতাঃ
মর্মবাণী (১৯২৫), বন্দীর বন্দনা (১৯৩০), পৃথিবীর পথে (১৯৩৩), কঙ্কাবতী (১৯৩৭), দময়ন্তী (১৯৪৩), দ্রৌপদীর শাড়ি (১৯৪৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩), শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর (১৯৫৫), যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮), দময়ন্তী: দ্রৌপদীর শাড়ি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৬৩), মরচেপড়া পেরেকের গান (১৯৬৬), একদিন: চিরদিন (১৯৭১), স্বাগত বিদায় (১৯৭১)
উপন্যাসঃ
সাড়া (১৯৩০), সানন্দা (১৯৩৩), লাল মেঘ (১৯৩৪), পরিক্রমা (১৯৩৮), কালো হাওয়া (১৯৪২), তিথিডোর (১৯৪৯), নির্জন স্বাক্ষর (১৯৫১), মৌলিনাথ (১৯৫২), নীলাঞ্জনের খাতা (১৯৬০), পাতাল থেকে আলাপ (১৯৬৭), রাত ভর বৃষ্টি (১৯৬৭), গোলাপ কেন কালো (১৯৬৮), বিপন্ন বিস্ময় (১৯৬৯), রুক্‌মি (১৯৭২)
গল্পঃ
অভিনয়, অভিনয় নয় (১৯৩০), রেখাচিত্র (১৯৩১), হাওয়া বদল (১৯৪৩), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৫৯), একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু (১৯৬০), হৃদয়ের জাগরণ (১৩৬৮), ভালো আমার ভেলা (১৯৬৩), প্রেমপত্র (১৯৭২)
প্রবন্ধঃ
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি (১৯৩৫), কালের পুতুল (১৯৪৬), সাহিত্যচর্চা (১৩৬১), রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য (১৯৫৫), স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭), সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৩), প্রবন্ধ-সংকলন (১৯৬৬), কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)
নাটকঃ
মায়া-মালঞ্চ (১৯৪৪), তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬), কলকাতার ইলেক্ট্রা ও সত্যসন্ধ (১৯৬৮)
অনুবাদঃ
কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭), বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা (১৯৭০), হেল্ডালিনের কবিতা (১৯৬৭), রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা (১৯৭০)
ভ্রমণ কাহিনীঃ
সব-পেয়েছির দেশে (১৯৪১), জাপানি জার্নাল (১৯৬২), দেশান্তর (১৯৬৬),
স্মৃতিকথাঃ
আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩), আমার যৌবন (১৯৭৬)
সম্পাদনাঃ
আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৬৩)
নদী-স্বপ্ন – বুদ্ধদেব বসু
কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটোকথা শোনা দিকি
এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবেকি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে
আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকেহবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার- না, আমি একা ল’ব মাথা পেতে।
নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবলঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামী? সোনালী? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়
শুয়ে’ শুয়ে’ – মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই?
কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান ক’রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতেফুর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বে তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ’লো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পালতুলে দাও।
আমর দু’জন দেখি ব’সে ব’সে আকাশ কত না নীল,
ছোট পাখি আরো ছোট হ’য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গোলা, সূর্য লুকালো জলেরতলার ঘরে,
সোনা হ’য়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হ’লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ’লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।
ইলিশ
আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।
মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।
দায়িত্বের ভার
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,
যা-কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার-
সব যেন, বৃহদরণ্যের মতো তর্কপরায়ণ
হয়ে আছে বিকল্পকুটিল এক চতুর পাহাড়।
সেই যুদ্ধে বার বার হেরে গিয়ে, মরে গিয়ে, মন
যখন বলছে; শুধু দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা তার
সবচেয়ে নির্বাচিত, প্রার্থনীয়, কেননা তা ছাড়া আর
কিছু নেই শান্ত, স্নিগ্ধ, অবিচল প্রীতিপরায়ণ-
আমি তাকে তখন বিশ্বস্ত ভেবে, কোনো-এক দীপ্ত প্রেমিকার
আলিঙ্গনে সত্তার সারাত্সার করে সমর্পণ-
দেখেছি দাঁড়িয়ে দূরে, যদিও সে উদার উদ্ধার
লুপ্ত করে দিল ভাবা, লেখা, পড়া, কথোপকথন,
তবু প্রেম, প্রেমিকেরে ঈর্ষা করে, নিয়ে এলো ক্রূর বরপণ-
দুরূহ, নূতনতর, ক্ষমাহীন দায়িত্বের ভার।
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
প্রত্যহের ভার
যে-বাণীবিহঙ্গে আমি আনন্দে করেছি অভ্যর্থনা
ছন্দের সুন্দর নীড়ে বার বার, কখনো ব্যর্থ না
হোক তার বেগচ্যুত, পক্ষমুক্ত বায়ুর কম্পন
জীবনের জটিল গ্রন্থিল বৃক্ষে; যে-ছন্দোবন্ধন
দিয়েছি ভাষারে, তার অন্তত আভাস যেন থাকে
বত্সরের আবর্তনে, অদৃষ্টের ক্রূর বাঁকে-বাঁকে,
কুটিল ক্রান্তিতে; যদি ক্লান্তি আসে, যদি শান্তি যায়,
যদি হৃত্পিণ্ড শুধু হতাশার ডম্বরু বাজায়,
রক্ত শোনে মৃত্যুর মৃদঙ্গ শুধু; … তবুও মনের
চরম চূড়ায় থাক সে-অমর্ত্য অতিথি-ক্ষণের
চিহ্ন, যে-মূহূর্তে বাণীর আত্মারে জেনেছি আপন
সত্তা বলে, স্তব্ধ মেনেছি কালেরে, মূঢ় প্রবচন
মরত্বে; খন মন অনিচ্ছার অবশ্য বাঁচার
ভুলেছে ভীষণ ভার, ভুলে গেছে প্রত্যহের ভার।
ব্যাঙ
বর্ষায় ব্যাঙের ফুর্তি। বৃষ্টি শেষ, আকাশ নির্বাক;
উচ্চকিত ঐকতানে শোনা গেল ব্যাঙেদের ডাক।
আদিম উল্লাসে বাজে উন্মুক্ত কণ্ঠের উচ্চ সুর।
আজ কোনো ভয় নেই- বিচ্ছেদের, ক্ষুধার মৃত্যুর।
ঘাস হল ঘন মেঘ; স্বচ্ছ জল জমে আছে মাঠে
উদ্ধত আনন্দগানে উত্সবের দ্বিপ্রহর কাটে।
স্পর্শময় বর্ষা এল; কী মসৃণ তরুণ কর্দম!
স্ফীতকণ্ঠ, বীতস্কন্ধ- সংগীতের শরীরী সপ্তম।
আহা কী চিক্কণ কান্তি মেঘস্নিগ্ধ হলুদে-সবুজে!
কাচ-স্বচ্ছ উর্ধ্ব দৃষ্টি চক্ষু যেন ঈশ্বরের খোঁজে
ধ্যানমগ্ন ঋষি-সম। বৃষ্টি শেষ, বেলা পড়ে আসে;
গম্ভীর বন্দনাগান বেজে ওঠে স্তম্ভিত আকাশে।
উচ্চকিত উচ্চ সুর ক্ষীণ হলো; দিন মরে ধুঁকে;
অন্ধকার শতচ্ছিদ্র একচ্ছন্দা তন্দ্রা-আনা ডাকে।
মধ্যরাত্রে রুদ্ধদ্বার আমরা আরামে শয্যাশায়ী,
স্তব্ধ পৃথিবীতে শুধু শোনা যায় একাকী উত্সাহী
একটি অক্লান্ত সুর; নিগূঢ় মন্ত্রের শেষ শ্লোক-
নিঃসঙ্গ ব্যাঙের কণ্ঠে উত্সারিত- ক্রোক, ক্রোক, ক্রোক।
রূপান্তর
দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু,
রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে।
ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা,
বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী,
মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা।
জাগো, হে পবিত্র পদ্ম, জাগো তুমি প্রাণের মৃণালে,
চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান ক্ষমায়,
ক্ষণিকেরে কর চিরন্তন।
দেহ হোক মন, মন হোক প্রাণ, প্রাণে হোক মৃত্যুর সঙ্গম,
মৃত্যু হোক দেহ প্রাণ, মন।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা
আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পড়ো না, কথা বলেও নষ্ট করো না এই রাত্রি-
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।
কেননা কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হয়ে গেছে,
কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই;
তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল-
অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন।
কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন,
তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু?
বলো না ‘সুন্দর’, বলো না ‘ভালোবাসা’, উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না
নিজেদের-
শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে।
আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই,
যার উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে,
যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ-
নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন।
আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।
দেখবে কেমন ছোটো হতেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধরে যায়,
যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর, যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো
অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ-
সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত,
যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়,
রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ-
যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব
সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে,
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়-
সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের।
আমাকে ভুল বোঝো না। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ,
প্রাণ কত বিপন্ন।
কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান,
যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর
মৃত্তিকায়-
চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত।
তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি,
আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া?
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের-
যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।
নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক,
যারা ভোলো নি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে,
রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য
এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা :
আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ-
সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে
নিশান।
মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে
শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার।
স্টিল্ লাইফ
সোনালি আপেল, তুমি কেন আছ? চুমো খাওয়া হাসির কৌটোয়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে?
ঠাণ্ডা, আঁটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়?
এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র। হেমন্তের যেন অন্ত নেই।
গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে।
তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে
থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার। কিন্তু শুধু এই?
তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে
আসে ভারী-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা
থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে
ছুঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে
হয়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা-
যা দেখে, হঠাৎ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হতে
কোনো মৃতার প্রতি
‘ভুলিবো না’ - এত বড় স্পর্ধিত শপথে
জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।
তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে
ব্যপ্ত হোক। তোমার মুখশ্রী-মায়া মিলাক, মিলাক
তৃণে-পত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলে-স্থলে, আকাশের নীলে।
শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে
জ্বেলে রাখি এই রাত্রে - তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে।
বিদ্যাসুন্দর
বলতে পারো, সরস্বতীর
মস্ত কেন সম্মান?
বিদ্যে যদি বলো, তবে
গণেশ কেন কম যান?
সরস্বতী কী করেছেন?
মহাভারত লেখেন নি।
ভাব দেখে তো হচ্ছে মনে,
তর্ক করাও শেখেন নি।
তিন ভুবনে গণেশদাদার
নেই জুড়ি পাণ্ডিত্যে
অথচ তার বোনের দিকেই
ভক্তি কেন চিত্তে?
সমস্ত রাত ভেবে ভেবে
এই পেয়েছি উত্তর-
বিদ্যা যাকে বলি, তারই
আর একটি নাম সুন্দর।
প্রেমের কবিতা
শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
শুধু নয় কঙ্কণে ক্ষণে ক্ষণে ঝংকার
আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।
শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন।
-কিছু তার দ্বন্দ্ব, কিছু তার ছন্দ।
পুষ্পের নিশ্বাস, রেশমের শিহরণ,
রক্তের রক্তিমা, কনকের নিক্কণ।
গন্ধের বাণী নিয়ে পরশের সুরকার
অঙ্গের অঙ্গনে আনলো যে-উপহার-
সে-তো শুধু বর্ণের নহে গীত-গুঞ্জন।
-কিছু তার স্বর্ণ, কিছু তার স্বপ্ন।
বিলাসিত বলয়ের মত্ত আবর্তন,
মূর্ছিত রজনির বিদ্যুৎ-নর্তন।
বিহ্বল বসনের চঞ্চল বীণা তার
উদ্বেল উল্লাসে আঁধারের ভাঙে দ্বার-
সে কি শুধু উদ্দাম, উন্মাদ মন্থন।
---কিছু তার সজ্জা, কিছু তার লজ্জা।
শুধু নয় দু’জনের হৃদয়ের রঞ্জন,
নয়নের মন্ত্রণা, স্মরণের অঞ্জন।
রঙ্গিণী করবীর গরবিনী কবিতার
জাদুকর-তির্যক ইঙ্গিত আনে যার,
সে কি শুধু দেহতটে তরঙ্গ-তর্পণ।
-কিছু তার দৃশ্য, কিছু বা রহস্য।
এসো শুভ লগ্নের উন্মীল সমীরণ
করো সেই মন্ত্রের মগ্নতা বিকীরণ,
যার দান বিরহের অনিমেষ অভিসার,
মিলনের ক্ষণিকার কণ্ঠের মণিহার;---
সেথা বিজ্ঞানিকের বৃথা অণুবীক্ষণ।
---কিছু তার জৈব, কিছু তার দৈব।
শেষের রাত্রি
পৃথিবীর শেষ সীমা যেইখানে, চারিদিকে খালি আকাশ ফাঁকা,
আকাশের মুখে ঘুরে-ঘুরে যায় হাজার-হাজার তারার চাকা,
যোজনের পর হাজার যোজন বিশাল আঁধারে পৃথিবী ঢাকা।
(তোমার চুলের মতো ঘন কালো অন্ধকার,
তোমারি আঁখির তারকার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
বিশাল আকাশ বাসনার মতো পৃথিবীর মুখে এসেছে নেমে,
ক্লান্ত শিশুর মতন ঘুমায় ক্লান্ত সময় সগসা থেমে;
দিগন্ত থেকে দূর দিগন্তে ধূসর পৃথিবী করিছে খাঁ-খাঁ।
(আমারি প্রেমের মতন গহন অন্ধকার,
প্রেমের অসীম বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
নেমেছে হাজার আঁধার রজনি, তিমির-তোরণে চাঁদের চূড়া,
হাজার চাঁদের চূড়া ভেঙে-ভেঙে হয়েছে ধূসর স্মৃতির গুঁড়া।
চলো চিরকাল জ্বলে যেথা চাঁদ, চির-আঁধারের আড়ালে বাঁকা
(তোমারি চুলের বন্যার মতো অন্ধকার,
তোমারি চোখের বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )
এসেছিল যত রূপকথা-রাত ঝরেছে হলদে পাতার মতো,
পাতার মতন পীত স্মৃতিগুলি যেন এলোমেলো প্রেতের মতো।
---রাতের আঁধারে সাপের মতন আঁকাবাঁকা কত কুটিল শাখা
(এসো, চলে এসো; সেখানে সময় সীমাহীন
হঠাৎ ব্যথায় নয় দ্বিখণ্ড রাত্রিদিন;
সেখানে মোদের প্রেমের সময় সীমাহীন,
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
অনেক ধূসর স্বপনের ভারে এখানে জীবন ধূসরতম,
ঢালো উজ্জ্বল বিশাল বন্যা তীব্র তোমার কেশের তম,
আদিম রাতের বেণিতে জড়ানো মরণের মতো এ-আঁকাবাঁকা।
(ঝড় তুলে দাও, জাগাও হাওয়ার ভরা জোয়ার,
পৃথিবী ছাড়ায়ে সময় মাড়ায়ে যাবো এবার,
তোমার চুলের ঝড়ের আমরা ঘোড়সাওয়ার---
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )
যেখানে জ্বলিছে আঁধার-জোয়ারে জোনাকির মতো তারকা-কণা,
হাজার চাঁদের পরিক্রমণে দিগন্ত ভরে উন্মাদনা।
কোটি সূর্যের জ্যোতির নৃত্যে আহত সময় ঝাপটে মাথা।
(কোটি-কোটি মৃত সূর্যের মতো অন্ধকার
তোমার আমার সময়-ছিন্ন বিরহ-ভার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
তোমার চুলের মনোহীন তমো আকাশে-আকাশে চলেচে উড়ে
আদিম রাতের আঁধার-বেণিতে জড়ানো মরণ পঞ্জে ফুঁড়ে,---
সময় ছাড়ায়ে, মরণ মাড়ায়ে---বিদ্যুৎময় দীপ্ত ফাঁকা।
(এসো চলে এসো যেকানে সময় সীমানাহীন,
সময়-ছিন্ন বিরহে কাঁপে না রাত্রিদিন।
যেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
নবযৌবন
(এটি অগ্রন্থিত কবিতা)
বেদনায় রাঙা মোর দগ্ধ বুক ভরি
যুগ হতে যুগান্তর ধরি
কী গান উঠেছে বাজি, কী সঙ্গীত তুলিয়াছে তান
কোন্ মহামায়া মন্ত্র তুলিয়াছে নিত্য নব গান,
কী সঙ্গীত উঠিয়াছে ধ্বনিয়া
মর্ম-মাঝে রণিয়া-রণিয়া,
ওগো মহাকাল,
হে সুন্দর, নিষ্ঠুর, ভয়াল
তোমার ললাট ’পরে লেখা হয়েছিল যদি,
নিরবধি
বয়ে চলা ফল্গুধারা সম
ছিন্ন-তন্ত্রী এই বীণা মম
তোমার বুকের ’পরে জাগাইয়াছে যদি প্রতিধ্বনি
সে কথায় জেগে যদি উঠেছে অবনী,
তবে ওই ভীষণ মৌনতা
কেন আজ টুটিল তা?
কেন আজ ভেঙে গেল যুগান্তের শৃঙ্খল কঠিন?
প্রসন্ন নবীন
উদিল প্রভাত
অকস্মাৎ,
পোহাইল যেন দীর্ঘ দুঃখ-বিভাবরী,
কেটে গেল মরণ-শর্ব্বরী।
আর ভয় নাই, নাই ভয়,
জীবনে-মরণে আজ, প্রভূ মোর, হোক তব জয়!
এনেছে যৌবন তার
বিচিত্র সম্ভার;
বসন্তের ফুলদল হাতে লয়ে এসেছে সে
নব অতিথির বেশে।
তারে আজ করিনু বরণ,
তাহার পরশ পেয়ে ধন্য হল আমার মরণ,
ধন্য হল দুঃখ-দগ্ধ ক্লান্ত বিভাবরী,
তাই বক্ষ তরঙ্গিত করি,
উঠিয়াছে আনন্দ-হিল্লোল,
চিরন্তন সঙ্গীত কল্লোল
বক্ষে বাজে শঙ্খধ্বনি-সম,
নিরূপম
উচ্ছ্বাসের উন্মত্ত ধারায়,
জীবনের সূত্রগুলি আচম্বিতে কখন হারায়!
চিরদিনকার পাওয়া যৌবন আমার
লহ নমস্কার!
তুমি রুদ্র, তুমি ভয়ঙ্কর,
তাই তুমি অমন সুন্দর।
প্রবালের মতো তব রাঙা ওষ্ঠাধরে
চুম্বন আঁকিয়ে দিতে জন্ম-জন্মান্তরে
সাধ মোর;
অন্ধতার ঘোর
রাত্রির আকাশ সম সুনিবিড় কেশ,
ঊষার উদয় সম চক্ষে তব আনন্দ-উন্মেষ,
বক্ষে তব নবজন্ম আশা
মুখে তব বিশ্বসৃষ্টি ভাষা
সারা দেহে লীলায়িত গভীর বেদন
অনন্ত জীবন আর নিবিড় মরণ
নমি তোমা বার বার, হে আমার অনন্ত যৌবন।
...........


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন