শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নালন্দা


   নালন্দা

  ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন        প্রণব কুমার কুণ্ডু

নালন্দা = নালম + দা
নালম ---> পদ্মফুল যা জ্ঞানের প্রতীক
দা ---> দান করা।
“নালন্দা” শব্দের অর্থ “জ্ঞান দানকারী”। প্রথম অবস্থায় নালন্দা ছিল একটি বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধধর্ম চর্চার কেন্দ্র। পরবর্তীতে নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা উপলব্ধি করেন যে ধর্মচর্চার পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত ইত্যাদিরও চর্চার প্রয়োজন উন্নত জাতি গঠনের জন্য। তাঁদের উৎসাহে বৌদ্ধ বিহারটি ক্রমে রূপ নেয় সর্বাঙ্গীন শিক্ষাচর্চা কেন্দ্রের। গুপ্ত সম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন। মূলত গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্তের আমলেই এই মহা বিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাটগণ পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান। ৪২৭ বা ৪৫০ খৃষ্টাব্দে স্থাপিত হওয়ার পর প্রায় ৮০০ বছর ধরে জ্ঞান বিতরন করে গেছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।
নালন্দা ছিল সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রবেশ করতে গেলে আজকের দিনের মতোই কঠিন পরীক্ষায় বসতে হত। শোনা যায় প্রতি দশ জনে তিন জন সেই পরীক্ষায় পাশ করত। ছাত্র সংখ্যা ছিল আন্দাজ দশ হাজার। শিক্ষক দুই হাজার । ৫:১ এর ঈর্ষনীয় ছাত্র - শিক্ষক অনুপাত।
নালন্দা ছিল সত্যিকারের "বিশ্ববিদ্যালয়"। ভারতবর্ষের সীমা অতিক্রম করে পশ্চিমে সুদূর ইরান, ইরাক, তুরস্ক, গ্রীস থেকে; উত্তরে হিমালয় পেরিয়ে চীন থেকে; উত্তর ও পূর্বে সাগর পেরিয়ে জাপান, ইন্দোনেশিয়া থেকে জ্ঞান পিপাসু আসত নালন্দায়। সম্পূর্ণ অবৈতনিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল খরচ বহন করার জন্য উদার বৌদ্ধ শাসকরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ২০০ গ্রামকে উৎসর্গ করেছিলেন। চিনতে পারার সুবিধার্থে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরী করে গ্রাম গুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছিল অনান্য গ্রাম থেকে। এই সব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্য দ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচের যোগান আসত।
প্রাচীর বেষ্টিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল এলাকায় শ্রেনীকক্ষ, ছাত্রাবাস, শিক্ষকাবাস, সুরম্য উদ্যান, বীথি, দিঘি ইত্যাদি তো ছিলই; তার সাথে ছিল বিশ্বের অহংকার, সুবিশাল তিনটি গ্রন্থাগার।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন পন্ডিত শীলভদ্র। বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম।
তারপর নেমে এল কালো দিন।
১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী এল নালন্দায়। লক্ষ্য একটাই, ইসলামের প্রসার। প্রচার নয় প্রসার। নালন্দার বৌদ্ধ ভিক্ষু, ছাত্র, শিক্ষক কেউ যখন ধর্মান্তরিত হতে রাজি হল না, তখন শুরু হল হত্যালীলা। তার আক্রমনের বর্বরতা সম্পর্কে পারস্য ইতিহাসবিদ মিনহাজ “তাবাকাতে নাসিরি” গ্রন্থে লিখেছেন “হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করে খিলজী”। এরপর আগুন লাগিয়ে দেয় লাইব্রেরীর ভবনগুলোতে। লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমান এত বেশী ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বইগুলো পুড়ে ছাই হতে। জনশ্রুতি আছে ছয় মাস সময় লেগেছিল সব বই পুড়তে। বর্বর খিলজী শুধু নালন্দাকে পোড়ায়নি, শুধু ছাত্র শিক্ষক ভিক্ষুদের হত্যা করেনি, সে শেষ করে দিয়েছে এক জাতির তথা সমগ্র পৃথিবীর এক রত্নকে। অতীত ভারতের অমূল্য রত্ন চিরতরে হারিয়ে গেল নরপিশাচের উন্মাদনায়।
তারপর খিলজী এল সোনার বাংলায়। যার ফলশ্রুতি আজকের মৌলবাদী বাংলাদেশ। সে এক অন্য কলঙ্কময় অধ্যায়।
ভারত আজও বহন করে চলেছে বর্বর খিলজীর চিহ্ন, কোনো সভ্য দেশে যা চিন্তাই করা যায় না। নালন্দা সংলগ্ন রেলওয়ে স্টেশনের নাম "বখতিয়ারপুর"! নরাধম বর্বর খিলজীর চিহ্ন সমূলে উপড়ে ফেলে সেখানে চাই বাঙালীর গর্ব আচার্য শীলভদ্র বা মহাজ্ঞানী পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের নামে শহর, স্টেশন। কোনো বাঙালী বুদ্ধিজীবি কি দাবি জানাবেন?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন