সোমবার, ৯ জুলাই, ২০১৮

ওঁ


        ওঁ




Chinmoy Bose           ফেসবুক থেকে অংশভাগ করেছেন 
                                                 প্রণব কুমারকুণ্ডু


"ওম"
-----------------

অ (A), উ (U) এবং ম(M) এই ত্র্যক্ষর (তিন অক্ষর) মিলে এক ‘ওম্’ সৃষ্টি হয়েছে। ‘অ’ মানে ব্রম্ভা, ‘ও’ মানে বিষ্ণু, আর ‘ম’ অর্থে শিব। এককথায়, ওম হল এই ত্রিশক্তির বা ত্রিদেবের সমাহার। ‘অ’ হল সৃষ্টি বা ক্রিয়েটিং শক্তি, ‘উ’ হল স্থিতি বা সাস্টেনিং শক্তি আর ‘ম’ হল ধ্বংসের শক্তি। এই ওঁ থেকে পরমেশ্বরের অনেক নাম সূচিত হয়। যেমন-‘অ’-কার থেকে বিরাট, অগ্নি এবং বিশ্ব প্রভৃতি; ‘উ’-কার থেকে হিরণ্যগর্ভ, বায়ু এবং তৈজস প্রভৃতি; ‘ম’-কার থেকে ঈশ্বর, আদিত্য এবং প্রাজ্ঞ প্রভৃতি নাম সূচিত ও গৃহীত হয়। প্রকরণানুসারে এই সকল যে পরমেশ্বরেরই নাম তাহা বেদাদি সত্যশাস্ত্রে সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে (সত্যার্থপ্রকাশ : পৃঃ ১। ‘‘ওম খং ব্রহ্ম’’ \ ১\ যজুঃ অ. ৪. ম. ১৭\)। ৮ম সংস্করণের সুবলচন্দ্র মিত্র সংকলিত ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’-এর ৩২০ পৃষ্ঠায় ‘ওঁ’-এর ব্যখ্যায় বলা আছে, ‘‘ওংকার, প্রণব, আদ্যবীজ।’’ পরে ৩২১ পৃষ্ঠার ১ম কলামে ‘ওম’-এর অর্থ লেখা আছে ‘‘প্রণব, বিষ্ণুশিবব্রহ্মাত্মক বীজমন্ত্র; স্বীকার; মঙ্গল; আরম্ভ; অপাকরণ। অব (রক্ষা করা)+ম কর্তৃ; অথবা অ (বিষ্ণু)+ উ (শিব)+ম (ব্রহ্মা), সমাহার দ্বন্দ্ব সমাসে সন্ধি করিয়া পদটি নিষ্পন্ন হইয়াছে।’’
মানব জীবনের শুরুতে একটি শিশু যখন কথা বলা শুরু করে, প্রথমে অ-অ উচ্চারন করে। এর কিছু পরে উ-উ বা ও-ও (প্লুতস্বরে) উচ্চারণ শেখে। এর পরে মা, মা-মা বলে ডাকা শুরু করে। এক শিশু ॐ দিয়েই কথা বলা শুরু করে। কেবল হিন্দু নয়, সারা বিশ্বই শিশুদের ভীষণ পবিত্র ভাবে তার নিষ্পাপ উপস্থিতিতের জন্য। শিশুর মধ্যে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান।

আমরা যদি ভিন্ন ভাবে দেখি, GOD তেও একই সত্যের প্রকাশ (G= Generative power, O=Operative power and D= Destructive power)।

বিভিন্ন ভাষায় ধর্মে প্রকাশ
--------------------
বিভিন্ন উপনিষদ, বেদ, গীতা ও অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রে সর্বত্রই ওঁ-কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কঠোপনিষদ মতে, ওঁ-কার পরব্রহ্ম। মুণ্ডক উপনিষদে ওঁ-কার অবলম্বনে ঈশ্বর উপাসনার কথা বলা হয়েছে। অথর্ববেদের গোপথব্রাহ্মণের একটি কাহিনি অনুসারে দেবরাজ ইন্দ্র ওঁ-কারের সহায়তায় দৈত্যদের পরাস্ত করেন। এই কাহিনির অন্তর্নিহিত অর্থ, ওঁ-কারের বারংবার উচ্চারণে মানুষ তার পাশব প্রবৃত্তি জয় করতে সমর্থ হয়। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, তিনি সকল অক্ষরের মধ্যে ওঁ-কার। মৃত্যুকালে ওঁ-কারের উচ্চারণে পরম সত্য লাভ হয়। পতঞ্জলির যোগসূত্র-এ ওঁ-কারকে ঈশ্বরের প্রতীক বলে বর্ণিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ওঁ-কারের স্মরণ ও উচ্চারণে সমাধি লাভ করা যায়। এটি কেবল হিন্দু দর্শনের সর্বোচ্চ ঈশ্বর, ব্রহ্মের বাচক বোধক শব্দ নয়। এই ধর্মের প্রতিটি সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়, ছাড়াও হিন্দু ধর্ম থেকে সৃষ্টি হওয়া বৌদ্ধ, জৈন্য, শিখদের (ੴ ) কাছে এটি পবিত্র প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হয়। এই প্রতীকের দেবনাগরী রূপ ॐ, চীনা রূপ (pinyin – ǎn), কিম্বা সরল চীনাঅক্ষরে (pinyin – wēng), এবং তিব্বতীয় রূপ ༀ। ভারতের উত্তরে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারে ॐ সেখানে ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়। ওঁ- কার বাংলায় এবং ঔঁ-কার সংস্কৃতিতে। শ্রী শ্রী স্বামী স্বরুপানন্দ পরমহংসদেব বলেছেন- “ওঁ, ওম, ঔং, অউম, ঔঁ” এই পাঁচ প্রকার উচ্চারণের মধ্য বস্তুগত বা অর্থগত কোনো পার্থক্য নেই। এই শব্দ ক্রিশ্চানিটিতে ‘আমেন’ এ পরিবর্তীত হয়েছে পরবর্তী কালে।

বিভিন্ন দেশে প্রকাশ
----------------
ॐ লেখা মুদ্রা বা পুঁথি পূর্বএশিয়ার নানান দেশের প্রাচীন সভ্যতায় পাওয়া যেত। ওমকে উনালোম বা ওউম হিসাবে ডাকা হয় থাইল্যান্ডে। বিভিন্ন সরকারি কাজে বা পতাকায় এর উপস্থিতি রাজা চতুর্থ রামের (r. 1851–1868) সময়ে দেখা যায়। শ্রীলঙ্কার Anuradhapura যুগের মুদ্রায় (প্রথম থেকে চতুর্থ শতকে)) ॐ দেখা যেত। মেডিয়াভেল ভাস্কর্য্যেও বা শিল্পেও এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

শরীরের সাতচক্রে ওঁ-এর প্রভাব
-------------------------
ওঁ বা ॐ বা ওম হল একটি প্রকৃতির বা ব্রম্ভান্ডের আদিম শব্দ। এই শব্দ সমগ্র ব্রম্ভান্ড থেকে আমাদের শরীরের কোষের মাইক্রোটিউবিউলসে অনুরণিত হয়।অনেকে মনে করেন, ৪১৭ হার্জের মধ্যে এই ‘ওম্’ শব্দের এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে, যা দিয়ে শরীর-মন থেকে সকল নেগেটিভ শক্তি, যেমন ক্লান্তি, মর্মপীড়া, শোক, অবসাদ, দূর হয়। তবে ॐ এর শক্তি কেবল ৪১৭ হার্জে সীমাবদ্ধ নেই। ॐ যখন লেখা হয়, এই অ, উ, ম এর অ হল কনসাস স্টেট, উ হল ড্রিম স্টেট, ম হল ড্রিমলেস স্লিপ স্টেট আর অ,উ,ম এর সাথে চন্দ্রবিন্দু যোগ করা হলে, একসাথে চতুর্থ এক স্টেট বা তাদেরকে ছাপিয়ে নূতন এক স্টেটে উন্নীত হওয়া বোঝায়।

ॐ উচ্চারণে দেহের সাতটি চক্র জাগরিত এবং পরষ্পরের সাথে সংযুক্ত হয়। আমাদের দেহের নিম্নাঙ্গে, তলপেটে, নাভিতে, হৃদয়ে, কণ্ঠে, দু চোখের মাঝে ও মাথার ওপরে আছে সাতটি চক্রের অবস্থান। চক্রগুলো হলো, মূলাধার চক্র, স্বাধিষ্ঠান চক্র, নাভিচক্র, হৃদচক্র, বিশুদ্ধ চক্র, আজ্ঞা চক্র ও সহস্রার চক্র। প্রতিটি চক্রের সাথে দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়িত। যখন যে চক্রে দিব্যশক্তি খেলা করে তখন সে চক্রের ওপর ভাল-মন্দ দুরকমের প্রভাব পড়ে। যেমন, বিশুদ্ধ চক্রে খেলা করলে কথা বলার শক্তি ও গানের সুরধারা আসে। আবার সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা ও মন খারাপ হয়ে থাকে। এভাবে অন্যান্য চক্রের ওপরও প্রভাব ফেলে থাকে।
ওঁ উচ্চারণে বিশেষত ব্রম্ভতালুতে অবস্থিত সহস্রার চক্র খুলে যায়। তখন ঈশ্বরের অবস্থান সেখানে অনুভূত হয়। ঈশ্বরের সাথে সংযুক্তি সাধন করে। এই চক্রেরা তখন কিছু বর্ণের বা রঙের সৃষ্টি করে। তখন ব্যক্তি নিজের আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হন।
দেহে ত্রিশক্তির অবস্থান
------------------
আমাদের নিজের মধ্যেও এই তিন শক্তি লুকিয়ে আছে। আমাদের দেহের মাঝেও সবসময় কিছু না কিছু সৃষ্টি হচ্ছে সৃষ্টির জন্য। নূতন কোষ, চুল। তেমনি সততই এরা মারা যাচ্ছে। তেমন কিছু না কছু রয়েই যাচ্ছে। আমাদের স্মৃতি কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। এটাই অপারেটিং বা সাস্টেনিং পাওয়ার বা স্থিতি শক্তি।
****বিশ্বব্রম্ভান্ডে উপস্থিতি এবং শরীরে প্রভাবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।*****
১৯৫২ সালে বিজ্ঞানী উইনিফ্রেড সুম্যান (Winifried Schumann) এ পৃথিবীর ৭.৮৩ হার্জে একটি স্বাভাবিক কম্পাঙ্ক খুঁজে পান। এটি ঠিক যেন পৃথিবীর হৃদস্পন্দন। অনেক বিজ্ঞানী এই সুম্যান কম্পাঙ্ককের মাধ্যমে পৃথিবীর তড়িৎ-চুম্বকীয় আবহ এবং পৃথিবীতে বসবাসকারী সকল জীবকুলের জৈব-তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সম্পর্ক খুঁজে পান। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, মোবাইল, স্মার্ট মিটার থেকে যে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নির্গত হয়, তা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে শরীরের সাম্যের বিঘ্ন ঘটায়। মস্তিষ্কের মেলাটোনিনের ক্ষরণ ব্যাহত করে। আরো নানা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই সুম্যান তরঙ্গ কেবল এই পৃথিবীর নিজস্ব তরঙ্গ নয়, সেই তরঙ্গেই সকল জীবকুল অনুরণিত হয়। ডাক্তার আঙ্কেরমুলার সর্বপ্রথম সুম্যান তরঙ্গ আর মস্তিষ্কের আলফা তরঙ্গের সম্পর্ক আবষ্কার করেন। এই গবেষণা ডঃ সুম্যানের কাছে আনলে, সুম্যান তার পিএইচডির ছাত্র, হারবার্ট কোনিগকে (Herbert König) এই নিয়ে গবেষণা করতে বলেন। পরবর্তীকালে কোনিগ সুম্যান তরঙ্গ আর ব্রেন ওয়েভ এর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন ইসিজির মাধ্যমে। উনি দেখান যে, ৭.৮৩ হার্জের এর সুম্যান তরঙ্গ মস্তিষ্কের আলফা এবং থিটা কম্পাঙ্কের মধ্যেই অবস্থিত।
আধুনিক চিকিৎসায় ওষুধ বানাতে একটা বিষয় মাথায় রাখা হয়, মলিকুলার লেভেলে আমাদের শরীর হল পরমাণুর ভাইব্রেটিং সিস্টেম। যার মাধ্যমে আমরা শব্দকে গ্রহণ করতে পারি ও প্রেরণ করতে পারি। আমরা শব্দের মাধ্যমেই আমাদের শরীরে কম্পন পাঠিয়ে আরোগ্যলাভ করতে পারি এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন অংশের পুননির্মাণ করতে পারি। এই কম্পাঙ্কের সাহায্যে ইথারিক প্যাটার্ণ পালটে অসুস্থতার মানসিক কারণের আরোগ্যলাভ করাতে পারি। প্রতিটি মানুষের/জীবের নিজস্ব কম্পাঙ্ক (ভাইব্রেসনাল ফ্রিকুএন্সি) আছে। অসুখের সময়, শক্তির বা কম্পাঙ্কের ওষুধগুলো ব্যবহার করে আরোগ্যলাভ সম্ভবপর হয়।
এই 'ওম' শব্দের মাধ্যমেই শরীরের সাত চক্রের মধ্যে ব্রম্ভতালুতে অবস্থিত সহস্রার চক্র জাগরিত করার চাবি কাঁঠিটি লুকিয়ে আছে। আর, সুম্যান ফ্রিকোয়েন্সি অনেকটা ওম এর মত শুনতে হয়, যা দিয়ে আধ্যাত্মিক উন্মেষ সম্ভবপর বলে বিশেষজ্ঞগন দাবী করেন।
ॐ এর সিমাটিক্স
-------------
সিমাটিক্সের মাধ্যমে শব্দবিজ্ঞানে শব্দের জ্যামিতিক বিন্যাস দেখা হয়। পাতলা মেম্ব্রেন বা প্লেটের উপরিতল খুব মিহি দানা বা বালি বা জল দিয়ে ঢেকে রেখে তাতে কোনো নির্দিষ্ট শব্দ প্রয়োগ করে শব্দ তরঙ্গের দ্বিমাত্রিক বিস্তার দেখা হয় জল বা বালির বিন্যাসের মাধ্যমে। ১৯৩০সালে জার্মান বিজ্ঞানী ডঃ হান্স জেনি (Dr. Hans Jenny) তা আবিষ্কার করেন। ওম এর চিত্র সিমাটিক্স করলে তার ভারসাম্য যুক্ত বিন্যাস দেখা যায়।
বস্তুত, কেবল পৃথিবীর জন্য নয়, সূর্যের থেকেও ওম শব্দ তৈরি হয়। এ শব্ধ রেকর্ড করা যায় না, কিন্তু সূর্যের করোনাল লুপের ভাইব্রেসনের অনুপ্রস্থ (গিটারের তারের মত) আর অনুদৈর্ঘ্য (বাঁশির মত) কম্পন স্যাটেলাইট ইমেজ আর ভিডিও ইমেজ থেকে তৈরি করেছেন। সংগ্রহ করা ইমেজ থেকে সেই সূর্যের সেই ভাইব্রেসনকে শোনাযায়, এমন কম্পাঙ্কে কনভার্ট করা হয়েছে। তা কিছুটা ওম এর মত শোনায়। তবে সাতদিন ধরে সংগ্রহ করা ভাইব্রেসনকে কিছু সেকেন্ডের শব্দে পরিণত করা হয়েছে।

সংগৃহীত।

সুত্র-ইন্টারনেট ( আকাশতথ্য )।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন