শনিবার, ৭ জুলাই, ২০১৮

সিঁদু-কানুর সংগ্রামের ইতিহাস


      সিঁদু-কানুর সংগ্রামের ইতিহাস


      শেয়ার করেছেন           প্রণব কুমার কুণ্ডু




Rajib Roy Choudhury    ফেসবুক থেকে


সিঁদু-কানুর সংগ্রামের ইতিহাস আজও চরম অবহেলিত কেন ? শুধু আদিবাসী বলে ?
ছত্রপতি শিবাজী, রানা প্রতাপ, সুভাষ চন্দ্র, গান্ধি, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম ইত্যাদি ছোট-বড় দেশ নায়কদের কাহিনী ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও বীর নায়ক সিঁদু-কানুর সংগ্রামের ইতিহাস ও সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা আজও বড় অবহেলা, অনাদরে রয়ে গেল। অথচ শোষন, বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে মহান সিঁদু-কানু সহ আদিবাসীদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ শুধু ভারতের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।সাঁওতাল বিদ্রোহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে হলেও এটা ছিল মূলত উচ্চবর্ণীয় জমিদার, জোতদার, অসৎ ব্যবসায়ী ও সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে। কেন এই বিদ্রোহ তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো ---
বাংলা, বিহার, উড়িশার সবচেয়ে বড় উপজাতি ছিলেন সাঁওতালরা। পতিত, অনাবাদী জমি কঠোর শ্রম দিয়ে সাঁওতালরা আবাদি ও উর্বর করে তোলেন।ফলে এদের হাতে ছিল নিজস্ব জমি- জায়গা।দীর্ঘদিন ধরে সাঁওতালরা এই অঞ্চলে সুখে শান্তিতে নিজেদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে নিয়ে বসবাস করছিলেন।কিন্তু 1793 সালে "চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে"র ফলে সাঁওতালদের জমি তথাকথিত উচ্চবর্ণের জমিদার, জোতদারদের হাতে চলে যায়।ফলে সরল সাঁওতালদের উপর শুরু হয় উচ্চবর্ণের জমিদার, জোতদারদের শোষন ও অত্যাচার। অবশেষে শান্তিপ্রিয় সাঁওতালরা জমিচ্যুত ও ভূমিচ্যুত হয়ে বিহারের হাজারিবাগ, মানভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, ওড়িশা থেকে বাংলা ও বিহারের সীমান্তবর্তী পার্বত্য এলাকা "দামিন-ই-কোহি" অঞ্চলে চলে আসেন এবং বিহারের ভাগলপুর থেকে বাংলার বীরভূম পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন।তাঁরা পুনরায় আবার অমানবিক পরিশ্রমে জঙ্গল পরিস্কার করে বসতি স্থাপন করেন এবং পতিত জমি চাষ-আবাদ করে সোনার ফসল ফলিয়ে নতুন জীবন শুরু করেন। কিন্তু চির বঞ্চিত, চির অবহেলিত সাঁওতালদের জীবনে এই সুখ বেশীদিন স্থায়ী হল না। তাদের ভাগ্যাকাশে আবার নেমে এলো উচ্চবর্ণীয় জমিদার, জোতদার, সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার, শোষনের ভয়ঙ্কর কালো মেঘ।এই নতুন অঞ্চলে পুনরায় আবার জমিদারেরা সাঁওতালদের উপর উচ্চহারে খাজনা চাপায়।খাজনা না দিতে পেরে সাঁওতালরা সুদখোর মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে সর্বশান্ত হতে থাকেন। ধীরে ধীরে একদিকে যেমন জমির মালিকানা হারাতে থাকেন, অপর দিকে উচ্চবর্ণীয় জমিদার ও তার কর্মচারী, জোতদার, মহাজনদের দ্বারা সাঁওতাল নারীদের ইজ্জত-সম্মানের উপর এবং আদিবাসী সংস্কৃতির উপর আঘাত নেমে আসে। এই সকল কারনে আদিবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।কিন্তু এবার সরল প্রান সাঁওতালরা এই অঞ্চল ছেড়ে চলে না গিয়ে উচ্চবর্ণীয় জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে রুক্ষে দাঁড়ালেন।আর সমগ্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলেন মহান বীর সংগ্রামী সিঁদু-কানু দুই ভাই সহ চাঁদ মুর্মু, ভৈরব মুর্মু, ডোমন মাঝি প্রমুখ।1855 সালের 30 জুন "হুল" ঘেষনা হল।এই বিদ্রোহে সাঁওতালদের সঙ্গে সমগ্র আদিবাসী সমাজ সহ বিস্তীর্ণ এলাকার কামার, কুমার, তাঁতি, ছুঁতার, দরিদ্র মুসলমান সহ নিন্মবর্ণের প্রান্তিক কৃষকেরা যোগদান করেন।
এই বিদ্রোহে সিঁদু-কানুর নেতৃত্বে আদিবাসীদের কাছে প্রথমে তিন বার জমিদার, জোতদাররা চূড়ান্ত পরাজিত হয়। পরাজিত হয়ে অবশেষে তারা আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের ভুল বুঝিয়ে ও মিথ্যা কথা বলে তাদের পক্ষে এনে ইংরেজদের দিয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করায়। তা সত্বেও জমিদার, জোতদার ও ইংরেজদের যৌথ বাহিনীর মেজর "বরোজ" সিঁদু-কানুর নেতৃত্বে আদিবাসীদের কাছে চূড়ান্ত ভাবে পরাজিত হয়। অবশেষে এর পরের যুদ্ধে বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে আদিবাসীরা পরাজিত হন। কিন্তু এই জয় তারা সহজে পায়নি।দীর্ঘ এক বছর পাঁচ মাসের এই যুদ্ধে ইংরেজদের হাতি-ঘোড়া সমন্বিত, আধুনিক কামান, বন্দুক সুসজ্জিত বিশাল বাহিনীর কাছে সাঁওতালরা পরাজিত হন।তবে এটা মূলত যুদ্ধ ছিল না, ছিল হিংসাত্বক হত্যালীলা।ঐ সকল বিস্তীর্ণ আদিবাসী অঞ্চলের পথ-ঘাট রক্তে ভিজে গিয়েছিল, যেখানে সেখানে আদিবাসী নর-নারী-শিশুর লাস পড়ে ছিল।পুড়ানো বা কবর দেওয়ারও কেউ ছিল না। 175 টি আদিবাসী গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। প্রায় 33 হাজার আদিবাসী সাঁওতাল এই যুদ্ধে নিহত হয়। সিঁদুকে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় এবং কানু,চাঁদ ও ভৈরব মুর্মু সহ অন্যান্যদের ফাঁসি দেওয়া হয়। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও গবেষক ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁর "History of India" গ্রন্থে বলেছেন --" পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজলেও এমন নৃশংস, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা জানা যায় না। এটি যুদ্ধ ছিল না, ছিল হত্যালীলা। স্বাধীনতার এই যুদ্ধে যত সংখ্যক আদিবাসী নর-নারী শহীদ হয়েছে, ভারতের সমগ্র স্বাধীনতার যুদ্ধেও তার অর্ধেক সংখ্যক মানুষ শহীদ হয়নি" ( পাতা- 226)।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলন ও গনসংগ্রামের নাম সাঁওতাল বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ছিল আদিবাসী ভূমিপুত্রদের "জমি রক্ষার" আন্দোলন বা "কৃষক আন্দোলন"। 2009 সালের 31 মার্চ থেকে 2-রা এপ্রিল জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত "রাষ্ট্রসংঘে"র বাৎসরিক অধিবেশনে ভারতের আদিবাসী জনজাতিদের নিয়ে বিশেষ আলোচনা চক্র চলে।সেখানে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব বান্ কি মুন "সাওতাল বিদ্রোহ" নিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য রাখেন -- যার ফলে এই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বিশ্বে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।তিনি বলেন --" সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু মাত্র ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে সীমিত নেই। ইহা ছিল পৃথিবীর প্রথম সর্ববৃহৎ 'কৃষক বিদ্রোহ"(RU-32/G)। রাষ্ট্রসংঘের এই অধিবেশনে ঘোষনা হয়--- "সাঁওতাল বিদ্রোহে নিহত শহীদদের সম্মানে প্রতিবছর রাষ্ট্রসংঘের সদর দপ্তর সহ 184 টি রাষ্ট্রসংঘ অন্তর্ভূক্ত দেশ 'হুল দিবস' পালন করবে"। সেই মতো 2010 সাল থেকে রাষ্ট্রসংঘের 184 টি দেশ 'হুল দিবস' সম্মানের সহিত পালন করে। কিন্তু খুবই দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, এইসব সংবাদ ভারতের মনুবাদী রাজনৈতিক দলগুলি ও মনুবাদী মিডিয়া প্রচার প্রসারের আলোকে তো আনেই না বরং যতটা সম্ভব চেপে রাখার চেষ্টা করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহে আদিবাসী নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহন করেন এবং পুরুষদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সমানে যুদ্ধ করেন।নেতৃত্ব দেন সিঁদু কানুর বোন ফুলমনি।এই বিদ্রোহে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অত্যাচার নেমে আসে সাঁওতাল নারীদের উপর।প্রায় 12 হাজার মহিলা ও যুবতী ধর্ষিতা হন এবং তিন হাজার নারী ধর্ষন সহ খুন হন। তাই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জন মিল তাঁর "History of British India" গ্রন্থে বলেন -- "ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে সাঁওতাল নারীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী এবং গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ইতিহাসে তারা বঞ্চিত ও অনাদৃত রয়ে গেল। ফুলমনির আত্মত্যাগের কথা ভুলবার নয়" (পাতা- 163)। তাই নিদারুন দুঃখ ও বেদনার সাথে বলতে হয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা, সরোজিনী নাইডু ইত্যাদিদের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হলেও ফুলমনিদের কথা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে, পাঠ্যপুস্তকে কোথাও ঠাঁই পায় নি। শুধু আদিবাসী বলে ? বর্ণবাদী ভারতবর্ষ আদিবাসীদের সম্মান না জানালেও সারা বিশ্ব কিন্তু তাদের সে সম্মান জানিয়েছেন। 2010 সালের 2-রা মে অক্সফোড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক গবেষনা মূলক আলোচনা অনুষ্ঠানে কর্তৃপক্ষ ঘোষনা করেন --" সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রথম 'গন-নারী আন্দোলন হিসাবে খ্যাত"(সূত্র- অক্সফোড নিউজ, মে মাস সংখ্যা, 2010)।
তাই বড়ো দুঃখের সাথে বলতে হয়, সাঁওতাল বিদ্রোহ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও স্বাধীনতার 71 বছরে বর্ণবাদী শাসক ও মনুবাদী রাজনৈতিক দলগুলি এই বিদ্রোহকে প্রচারের আলো থেকে অনেকদূরে সরিয়ে রেখেছে।তাইতো ভারতের ব্রাহ্মন্যবাদী ঐতিহাসিকেরা সাঁওতাল বিদ্রোহ ও সিঁদু-কানু-ফুলমনির কথা তুলে ধরে না, পাঠ্যপুস্তকেও এদের কথা অত্যন্ত অবহেলায়, যৎসামান্য তুলে ধরা হয়।এখনো পর্যন্ত এদের নামে সরকার কোন মেমোরিয়াল, মিউজিয়াম, গবেষনাগার গড়ে তোলে নি।সবচেয়ে বড় যন্ত্রনার কথা হলো, সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মৃতিচিহ্ন গুলি উপযুক্ত রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে ও অবহেলায় সমস্ত নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আদিবাসীরা সিঁদু-কানুর সেই সংগ্রাম ও আদর্শ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছেন। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে ভারতের মাটিতে সর্বপ্রথম উচ্চবর্ণের জমিদার, জোত দারদের বিরুদ্ধে "জমি রক্ষার" আন্দোলনে ও নারীর সম্মান বাঁচাতে আদিবাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।বিখ্যাত ঐতিহাসিক-গবেষক অনীল শীল তাঁর 'নিন্ম বর্ণের ইতিহাস' গ্রন্থে বলেছেন --" ভারতের প্রথম জমিরক্ষা আন্দোলনের নাম সাঁওতাল বিদ্রোহ "। অথচ বর্তমান কালে শিল্প-কলকারখানার নামে, মিথ্যা উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের জমি নির্বিচারে দখল হয়ে যাচ্ছে। আর দিনের পর দিন আদিবাসী ভূমিপুত্ররা নীরব দর্শক হয়ে উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক দল গুলির মুখের দিকে চেয়ে আছে।অথচ সংবিধানের 46, 288, 338, 339, 340 নং ধারায় বাবা সাহেব ডঃ বি. আর. আম্বেদকর আদিবাসীদের " জমি-অরন্য ও সম্মান " রক্ষার অধিকার পরিস্কার ভাবে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।অথচ উচ্চবর্ণের শাসকদের কাছ থেকে সেই অধিকার ভারতের মূলনিবাসী বহুজনেরা বুঝে নিতে পারছে না। উচ্চবর্ণের কুৎসা ও মিথ্যা প্রচারের ফলে "অরন্যের অধিকার" আজ তাঁরা হারাতে বসেছে। তাই এখন দরকার সিঁদু-কানুর মতো অকুতোভয় বীর নেতার আবির্ভাব, যিনি সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আদিবাসী-বহুজনদের সমস্ত অধিকার ফিরিয়ে আনবেন।।

( লেখক -- প্রশান্ত রায়)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন