রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১৮

বৈষ্ণবাচার্য মধ্ব ও রামানুজের দার্শনিক মত ও ভক্তি-সাধন পদ্ধতি


বৈষ্ণবাচার্য মধ্ব ও রামানুজের  দার্শনিক মত ও ভক্তি-সাধন পদ্ধতি


অংশভাগ করেছেন             প্রণব কুমার কুণ্ডু


অমৃতকথা 

বৈষ্ণবাচার্যগণের দার্শনিক মত ও ভক্তি-সাধন পদ্ধতি

বৈষ্ণবাচার্যগণ সকলেই একবাক্যে ভক্তিযোগে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর উপাসনার মাহাত্ম্যকীর্তন করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে ভক্তি পঞ্চম— পুরুষার্থ। এই মহাপুরুষগণের দার্শনিক বিচারে পার্থক্য থাকিলেও তাঁহাদের প্রবর্তিত ভক্তিমূলক উপাসনা পদ্ধতি প্রায় একই প্রকার। বিশেষ এই যে, কেহ শান্ত, কেহ দাস্য, কেহ বাৎসল্য এবং কেহ মধুরভাবে ভগবানের উপাসনার উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন।

আচার্য মধ্ব প্রচারিত দার্শনিক মত দ্বৈতবাদ স্বতন্ত্রসত্তাবাদ সবৈষ্ণববাদ বা পূর্ণপ্রজ্ঞদর্শন নামে অভিহিত এবং তাঁহার স্থাপিত সম্প্রদায় ব্রহ্মসম্প্রদায় চতুর্মুখসম্প্রদায় বা মাধ্বসম্প্রদায় নামে পরিচিত। মধ্ব দ্বৈতবাদের প্রথম প্রচারক না হইলেও এই মতবাদ তাঁহারই নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। বৈষ্ণবাচার্য শ্রীচৈতন্য বল্লভ নিম্বার্ক প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের উপর এই আচার্যের মতবাদের প্রভাব সুস্পষ্ট।

মধ্বাচার্য জগতের মূলসত্তাকে স্বতন্ত্র ও অস্বতন্ত্র নামক দুই ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন।
স্বতন্ত্র-সত্তা  এক, অদ্বিতীয়, সর্বব্যাপী, সকল বিষয়ে পূর্ণ, অপরিবর্তনীয়, স্বয়ম্ভূ ও নিত্য। তিনি বিষ্ণুরূপে উপাসিত।

আর অস্বতন্ত্র-সত্তা  দেব ঋষি নর প্রমুখ জীব ও ভৌতিক পদার্থ। তাঁহারা পরিবর্তনশীল ও অনিত্য, কিন্তু মিথ্যা নহেন, পরন্তু সত্য।
চেতন ও অচেতন সর্ববিধ অস্বতন্ত্র সংজ্ঞিত জীব ও পদার্থমাত্রই সকল। বিষয়ে স্বতন্ত্র বিষ্ণুর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।

 অস্বতন্ত্র হইতে সম্পূর্ণ পৃথক স্বতন্ত্র-তত্ত্ব কী প্রকারে সর্বব্যাপী হইতে পারেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে মধ্ব বলেন, স্বতন্ত্র বিষ্ণু অস্বতন্ত্র জীব ও পদার্থ সমূহের কারণ হইয়াও দেশ-কাল-পাত্রাতীত। এজন্য তাঁহার সর্বব্যাপিত্ব সর্বাবস্থায় অক্ষুণ্ণ।

মধ্বাচার্যের মতে এই দৃশ্যমান জগৎ পরিবর্তনশীল অর্থাৎ অনিত্য হইলেও সত্য। ইহা ভ্রমকল্পিত বা মিথ্যা নয়।

কারণ সত্যসংকল্প ঈশ্বরের সৃষ্ট জগৎ মিথ্যা হইতে পারে না। মায়াধীশ ঈশ্বর সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ ও নিত্যমুক্ত, কিন্তু তাঁহার সৃষ্ট জীব অল্পশক্তিমান অল্পজ্ঞ ও জন্মমৃত্যু পাশবদ্ধ এবং সর্বপ্রকারে তাঁহার সম্পূর্ণ অধীন।

মধ্ব-সিদ্ধান্তে ঈশ্বর প্রভু, জীব তাঁহার দাস। তাঁহার মতে জগতে পঞ্চবিধ ভেদ বিদ্যমান,
যথা:
(১) ঈশ্বরে ও জীবে ভেদ,
(২) ঈশ্বরে ও জড়বস্তুতে ভেদ
(৩) জীবে জীবে ভেদ
(৪) জীব ও জড়বস্তুতে বা চেতন ও অচেতনে ভেদ
(৫) এক জড়বস্তু হইতে অপর জড়বস্তু এবং ইহাদের বিভাগ-সমূহে ভেদ।
তিনি বলেন, এই পঞ্চবিধ ভেদ বা স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করিয়া ইহাদের অভেদ বা একত্ব সম্ভব নয়।

মধ্বের মতে বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর সান্নিধ্যে নিত্যকাল বাস অথবা বিষ্ণুর সালোক্যলাভই মুক্তি।

তিনি দাস্যভক্তিযোগে শ্রীবিষ্ণুর পূজা বন্দনা সেবা অংকন (তিলক ধারণ) শ্রবণ মনন নামজপ স্বাধ্যায় ধ্যান ও ভজনাদিকে মুক্তির উপায় বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন।



বৈষ্ণবাচার্য রামানুজের ব্যাখ্যাত দার্শনিক মতের নাম বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এবং তাঁহার প্রবর্তিত সম্প্রদায়ের নাম শ্রীসম্প্রদায়। তিনি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রচারক হইলেও প্রবর্তয়িতা নহেন। কারণ, ‘মহাভারত’ ‘ব্রহ্মসূত্র’ ‘বিষ্ণুপুরাণ’ প্রভৃতিতে এই মতবাদ দৃষ্ট হয়। রামানুজের মতে চিৎ (জীব), অচিৎ (দৃশ্যমান জড়জগৎ), ঈশ্বর (পরমাত্মা) এই তিনই অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান স্বপ্রকাশ বিশ্বপতি পুরুষোত্তম বাসুদেবের রূপ। বাসুদেবই বেদান্তবেদ্য পরমব্রহ্ম। তিনি নিজেই নিজের সৃষ্টির উপাদান ও নিমিত্তকারণ। নিজরূপে নিমিত্তকারণ ও অংশরূপে উপাদানকারণ জীব ও জগৎ তাঁহার শরীর; এজন্য তিনি জীবজগদ্‌঩বিশিষ্ট। চিৎ ও অচিৎ উভয়ের সহিত তাঁহার ভেদ অভেদ ভেদাভেদ এই তিন সম্বন্ধই বিদ্যমান।


স্বামী সুন্দরানন্দের যোগচতুষ্টয় থেকে
সূত্র
'বর্তমান'
৫ জুলাই ২০১৮l

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন