হিন্দুত্ব বনাম গরুর মাংস খাওয়া...
ফেসবুক থেকে রূপক রায়-এর লেখা শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু
গত ২৭.১১.২০১৬ তারিখে, বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটের এক অনুষ্ঠানে খাসির মাংস ব'লে হিন্দুছাত্রদেরকে গরুর মাংস খাওয়ানো হয়েছিলো, আবারও গত ১৪ এপ্রিল, ২০১৭ তে পহেলা বৈশাখের দিন সেই একই কাজ করা হয়েছিলো; নিজের অজান্তে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে কেউ কেউ এই হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে যে, তাদের ধর্ম বুঝি নষ্ট হয়ে গেছে বা জাত চলে গেছে! যারা এই ধরণের হীনম্মন্যতায় ভুগছে বা বা ভুগবে, তাদের হীনম্মন্যতাদূর করতে ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে আমার এই পোস্ট-
গরুর মাংস খেলে হিন্দুদের জাত যায়, না ধর্ম নষ্ট হয় ?
গরুর মাংস নিয়ে হিন্দুদের খুব ঘৃণা এবং নাক সিটকানি, দুটোই আছে। কেউ কেউ মনে করে গরুর মাংস খেলেই তাদের ধর্ম চলে যাবে। হিন্দুদের এই যে মানসিক দুর্বলতা, এটারই সুযোগ নেয় মুসলমানরা এবং যেকোনো কৌশলে হিন্দুদেরকে গরুর মাংস খাইয়ে তারা এটা প্রমান করার চেষ্টা করে বা এটা ব’লে মেন্টাল চাপে ফেলার চেষ্টা করে যে, তুই তো গরুর মাংস খেয়ে ফেলেছিস, তুই আর হিন্দু নাই, এখন তুই মুসলমান হয়ে যা। সেই হিন্দুও মনে মনে ভাবে, ঠিকই তো, জাত তো আমার চলেই গিয়েছে এবং এই ভাবনাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো মুসলমান হয়েও গিয়েছে।
ঠিক এই জাতীয় একটি ঘটনাই ঘটেছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই পূর্ব পুরুষদের মধ্যে। তারা দুই ভাই কোনো এক মুসলমান শাসকের রাজসভায় কাজ করতো, এই শাসক সম্ভবত বর্তমানের বাগেরহাট এলাকার বিখ্যাত খান জাহান আলী ।
যা হোক, একবার রমজান মাসে রোযা থাকা অবস্থায় ঐ মুসলমান শাসক নাকের কাছে একটি লেবু নিয়ে গন্ধ শুকছিলো। এমন সময় ঐ দুই ভাই তাকে বলে যে, জাঁহাপনা, শাস্ত্রে আছে ‘ঘ্রাণেই অর্ধভোজন’, আপনি তো নাকের কাছে লেবু নিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছেন, আপনার তো রোযা নষ্ট হয়ে গেলো।’ মুসলমান শাসক বলে, ও তাই ?
এরপর ঘ্রাণেই অর্ধভোজন, হিন্দুশাস্ত্রের এই বাণীর ফাঁদে ফেলে তাদেরকে মুসলমান বানানোর একটি প্ল্যান ঐ শাসক করে ফেলে।
একদিন রাজসভায় সবাইকে ছুটি দিয়ে, আরও কাজ আছে ব’লে ঐ দুই ভাইকে থাকতে বলে ঐ মুসলমান শাসক। শাসক ও দুই ভাই বসে আছে, এমন সময় সেখানে শাসকের ইঙ্গিত মতো এক পাচক সদ্য রান্না করা গরম গরুর মাংসের একটি বিশাল পাত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় এবং সাথে সাথে সেই ঘর গরুর মাংসের গন্ধে ভরে যায়। দুই ভাই বলে উঠে, জাঁহাপনা এ কী হলো, এ কী হলো ? জাঁহাপনা বলে কিছুই হয় নি, তোমরা বলেছিলে না, ঘ্রাণেই অর্ধভোজন? তো এই গরুর মাংসের ঘ্রাণ তো তোমরানিয়েই নিয়েছো, মানে অর্ধভোজন তোমাদের হয়েই গেছে, আর তোমরাই তো বলো গরুর মাংস খেলে হিন্দুদের জাত থাকে না, তো জাত তো তোমাদের গিয়েছেই, এখন পূর্ণ ভোজন সেরে মুসলমান হয়ে যাও। দুই ভাই দেখলো মহা বিপদ এবং যুক্তিও ঠিক, তাদের যুক্তি এবং বিশ্বাসের কাছেই তারা ধরা খেয়ে গেছে, তাছাড়া ঐ মুসলমান শাসকের উপরও তাদের আর কথা বলার কোনো যুক্তি বা ক্ষমতা নেই, এককথায় তাদের আর কোনো উপায় নেই। এরপর তারা মুসলমান হয়ে যায় বা হতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের হিন্দুরা কোনো মুসলমানদের বাড়িতে কোনো উৎসব উপলক্ষে ভাত খেয়েছে বা কোনো মুসলিম হোটেলে, যে হোটেলে গরুর মাংস রান্না হয়, সেরকম হোটেলে খাবার খেয়েছে, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে গরুর মাংস খায় নি, এটা হতেই পারে না। মুসলমানরা হিন্দুদের জন্য যতই আলাদা করে রান্না করুক, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, হিন্দুরা যে নিষ্ঠা নিয়ে আলাদাভাবে আমিষ ও নিরামিষ রান্না করে, সেই নিষ্ঠা নিয়ে কোনো মুসলমান, হিন্দুদের জন্য আলাদা বাসনপত্রে রান্না করবে।দেখা গেলো, কোনো অনুষ্ঠানে হিন্দুদের জন্য হয়তো খাসি বা মুরগী রান্না হচ্ছে, সেই একই অনুষ্ঠানে মুসলমানদের জন্য রান্না হচ্ছে গরু, তাহলে আপনি নিশ্চিত থাকুন যে, যে পাত্রে, যে হাতা বা খুন্তি দিয়ে গরুর মাংস রান্না করা হয়েছে, সেই একই পাত্রে, সেই একই হাতা বা খুন্তি দিয়ে মুরগী বা খাসির মাংসও রান্না করা হয়েছে। তার মানে এভাবে আপনি পরোক্ষভাবে গরুর মাংস খেতে বাধ্য হয়েছেন, হন বা হচ্ছেন। আমি এর সব কিছুই জানি, তারপরও সামাজিকতা রক্ষার খাতিরে সেসব অনুষ্ঠানে এ্যাটেন্ড করতে বাধ্য হই, তার মানে অনেকের মতো আমিও পরোক্ষভাবে গরুর মাংস খেতে বাধ্য হয়েছি, হই বা হচ্ছি।
এরপর যারা মুসলিম ফ্যামিলিতে টিউশনি করেন, তারাও নাস্তার নামে নানাভাবে গরুর মাংস খেতে বাধ্য হন বা খান, অনেক সময় সেটা আপনি বুঝতে পারেন, অনেক সময় পারেন না। কিন্তু যারা খাওয়ায় তারা ঠিকই জানে আপনাকে তারা কিভাবে গরুর মাংস খাওয়াচ্ছে? আবার অনেক সময়, অনেক মুসলিম ফ্যামিলির লোকজন ঠিক মতো জানেই না যে, হিন্দুরা গরুর মাংস খায় না, তাই অনায়াসে তারা খাবারের টেবিলে হিন্দুদের সামনে গরুর মাংস সার্ভ করে। আপনি জিজ্ঞেস না করলেই আপনার কেল্লা ফতে। আবার যেসব বাসায় কাজের মেয়ে থাকে, তারাই সাধারণত টিচারদের নাস্তা টাস্তা দেয়, তারাও এসব ব্যাপারে খুব একটা এ্যালার্ট থাকে না, তারাও অনায়াসে হিন্দুদের সামনে গরুর মাংসের তৈরি খাবার দিয়ে যায়। অনেক সময় সন্দেহ হলে জিজ্ঞেস করাও অসুবিধার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, এই ভাবনা থেকে যে, জিজ্ঞেস করলে- কে, কী ভাববে ? আর জিজ্ঞেস করার পরও যদি আপনাকে বলা হয়, এটা গরুর মাংস নয়, কিন্তু ওটা প্রকৃতপক্ষে গরুরমাংসই ছিলো, তখন আপনি কী করবেন, নাস্তা না খেয়ে চলে আসবেন, তাহলে ঐ বাসায় আপনার অবস্থান কী দাঁড়াবে ? আপনি কি ওখানে আর টিউশনি করতে পারবেন ?
আমি এই সব ধরণের পরিস্থিতির শিকার। ঈদ উপলক্ষে মুসলিমদের বাড়িতে খেয়ে যেমন পরোক্ষভাবে গরুর মাংস খেয়েছি, তেমনি মুসলিম হোটেলে খেতে বাধ্য হয়েও পরোক্ষভাবে খেয়েছি, আবার মুসলমানদের বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েও পরোক্ষভাবে খেয়েছি। আমার এক মুসলিম ছাত্রী তো একবার ঈদের মধ্যে খেতে দিয়ে সরাসরি গরুর মাংসের বাটিই সামনে এনে দিয়েছিলো, আমি সাধারণতভাবে মুরগীর মাংস ছাড়া খাই না, তো মুরগীর সব ধরণের মাংসের মধ্যেই হাড় থাকে, কিন্তু সাধারণত গরু ও খাসির মাংসে হাড় থাকে না। এজন্য হাড় না দেখলেই বুঝতে পারি যে এটা মুরগীর মাংস নয়, তখনও বুঝতে পারলাম, বললাম, এটা কিসের মাংস। বললো, গরুর। আমি গরুর মাংস খাই না বলায় বাটিটা নিয়ে চলে গেলো। তো যে বাসায় একসাথে সবকিছু রান্না হয়েছে, সেখান থেকে আপনি শুধু বিরিয়ানী বা মুরগীর মাংস খাচ্ছেন, আর পরোক্ষভাবে গরুর মাংস খাচ্ছেন না, তা কি সম্ভব ? ওরা কি আপনার জন্য আলাদা করে রান্না করেছে, না করে ? আলাদা ভাবে হয়তো রান্না করে মুরগীর মাংস, কিন্তু সেটা গরুর হাড়ি পাতিল বা একই বাসনপত্রে।
আরেক বাসায় একবার আমাকে গরুর কলিজাসহ রান্না করা মোটর ডাল আর রুটি খেতে দিয়েছিলো। বাসার কাজের মেয়ে এটা দিয়ে গেছে। যদিও কলিজা চেনার কোনো উপায় নেই, কিন্তু দেখেই আমার সন্দেহ হলো, এর আগে একবার ছাত্রকে মাংস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রতিদিন কি এসব জিজ্ঞেস করা মানায় ? ভাববে, স্যার আমাদেরকে বিশ্বাস করে না, ছাত্রের বাসায় নিজের অবস্থান পড়ে যাবে। তাই ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে, শুধু শুধু শুকনো কয়েকটা রুটি খেলাম আর ঐ কলিজা ডালে পানি ঢেলে রেখে দিলাম। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, জিজ্ঞেস করলে বলবো, কলিজা আমার ভালো লাগে না। এভাবে কোনোরকমে সিচুয়েশনটা কভার আপ করবো। কিন্তু ছাত্র কিছু জিজ্ঞেস করলো না, কাজের মেয়েটা এসে কলিজা ডালে পানি ঢালা দেখে বললো, ও মা, আমার খেয়ালই নেই যে স্যার গরুর মাংস খায় না। খাবেন না তো বলবেন, পানি ঢেলে দিয়েছেন কেনো ? মনে মনে বললাম, যাক বাঁচা গেলো। গরুর মাংস খেলে আমার তো কিছু হতো না, কিন্তু মুসলমানরা তো ছোটলোক আর ছোট মনের মানুষ, তারা যে হিন্দুকেই কাছে পেতো, তাকেই আমার ঐ গরুর মাংস খাওয়ার কাহিনী ব’লে তার মনে কষ্ট দিতো। কারণ, এমন কোনো মুসলমান নেই যার কাছে কোনো একজন হিন্দুর গরুর মাংস খাওয়ার কোনো গল্প নেই। সবক্ষেত্রেই গল্পটা এরকম, দুজন মিলে কোন এক জায়গায় গরুর মাংস খেয়েছে, তারপর হিন্দুটা, মুসলমানটাকে বলেছে, ভাই কাউকে যেন বলিস না, শুনলে কিন্তু সমাজ থেকে আমাক বের করে দিবে। সেই মুসলমানও তখন প্রতিজ্ঞা করেছে, বলবো না, তুই খা। কিন্তু মুসলমানের পেটে সেই গল্প কি হজম হয় ? তারা যখনই চান্স পায় সেই গল্প অন্য হিন্দুকে শোনায়। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, খাওয়ার সময় সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো কাউকে না বলার, গল্প বলার সময় সেটা তার আর মনে থাকে না এবং এইভাবে যে সে ওয়াদাভঙ্গকারী হচ্ছে, সেটাও তার হিন্দুর গরুর মাংস খাওয়ার গল্প বলার জিহাদী জোশে আর মনে থাকে না।
সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, সব মুসলমানের কাছেই হিন্দুদের গরুর মাংস খাওয়ার একটি গল্প আছেই। উদ্দেশ্য আর কিছু্ই নয় এইসব গল্প দিয়ে হিন্দুদেরকে মেন্টালি চাপে ফেলে তাদেরকে কষ্ট দেওয়া। এর প্রতিষেধক হিসেবে আমার এক স্বল্পকালীন বন্ধু আমাকে একবার একটা উপায় বলেছিলো, যখনই কোনো মুসলমান কোনো হিন্দুর গরুর মাংস খাওয়ার গল্প শোনাবে, তখনই সেই মুসলমানকে কোনো এক মুসলমানের শুয়োরের মাংস খাওয়ার গল্প শোনাতে হবে। সেটা মিথ্যা হলেও কোনো প্রব্লেম নেই। কারণ, যেসব মুসলমান আপনাকে হিন্দুদের গরুর মাংস খাওয়ার গল্প শোনায়, মনে রাখবেন তার বেশির ভাগই মিথ্যা। দু চার জন যে খায় না, তা বলছি না, দু চার জন খায়, আর সেই দু চারজনের গল্প মুসলমানদের মুখে মুখে গিয়ে সেটা দাঁড়ায় দু চার শো তে।
ছাত্রের বাসায় পড়াতে গিয়ে গরুর মাংসের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমাকে আর একজন বলেছিলো একটা উপায়ের কথা। এর সাথে অবশ্য ত্যাগ জড়িত। সবার পক্ষে এটা সম্ভব কি না জানি না। কারণ, হিন্দুরা মাংস কম খায় বলে মাংসের প্রতি তাদের একটা দুর্বলতা থাকে, আর এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাংসই হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার। যা হোক, সে বলেছিলো, আমি যখন কোনো মুসলমানের বাসায় টিউশনি পাই, তখন প্রথম দিনেই বলে দিই, আমি কোনো মাংস খাই না। সুতরাং আমাকে যা ই নাস্তা দেন, তাতে যেন কোনো মাংস না থাকে। বাসর রাতে বেড়াল মারার মতো শুরুতে বলা সব কথাই মানুষ গুরুত্বের সাথে নেয়, তার কথাও সবাই গুরুত্বের সাথে নিতো, এরপর তাকে আর কখনো গরুর মাংস নিয়ে প্রব্লেমে পড়তো হতো না বা এখনও হয় না।
আমি যে কথা বলতে চাইছি, তা হলো, খাবার দাবারের মধ্যে কোনো ধর্ম নেই। আপনি যা কিছুই খান না কেনো বা কোনো পরিস্থিতির কারণে খেতে বাধ্য হোন না কেনো কিছুতেই আপনার ধর্ম যাবে না বা আপনার ধর্ম নষ্ট হবে না। কারণ, ধর্ম হলো মনের ব্যাপার। অনেক মুসলমান আছে যারা কোনো কারণে গরুর মাংস খায় না, তাই বলে তারা কি হিন্দু ? অবশ্যই নয়। আবার অনেক মুসলমান আছে যারা শুয়োরসহ হারাম অনেক কিছু খায়, তাই বলে তারা কি মুসলমান নয় ? আসলে মন ঠিক থাকলে কারো কোনো ক্ষমতা নেই আপনার ধর্ম নষ্ট করার, সে আপনাকে যা ই খাওয়াক না কেনো ? তবে হিন্দু শাস্ত্রে যেহেতু গরুর মাংস খেতে নিষেধ করা হয়েছে, তাই এটা স্বেচ্ছায় আপনার খাওয়া উচিত নয়। ধর্মীয় কারণ বাদ দিলেও এর সামাজিক ও বাস্তব কারণ হলো- গরু হত্যা মানে দুধের উৎসকে ধ্বংস করা এবং কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় জমি চাষ ব্যাহত হওয়া, আর অন্যদিকে শুধু গরুর মাংসই নয়, যেকোনো লাল মাংস বা রেডমিট ভয়ঙ্কর সব রোগ-ব্যাধির বাহক। তাই গরুর মাংস না খাওয়ার মানে হলো নিজেকে নানা রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখা।
এবার স্বামী বিবেকানন্দের একটা গল্প শুনুন, স্বামীজী যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন শিকাগোর ধর্মসভায় যোগ দিতে, তখন তিনি যাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন, তারা কি তাকে স্বামীজীর ইচ্ছা মতো খাবার রান্না করে দিতো ? নিশ্চয় নয়। শুধু তাই নয়, খ্রিষ্টান পরিবারে অঢেল চলে গরু, শুয়োরসহ সবধরণের মাংস। ফলে ঐসব পরিবারে সাধারণত যেসব খাবার রান্না হতো স্বামীজী গরু শুয়োর সমৃদ্ধ ঐসব খাবার সবই খেতো। কিন্তু তাতে স্বামীজীর হিন্দুত্ব নষ্ট হয়েছে, না জাত গিয়েছে ? স্বামীজী যে কাজের জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন ঠিক সেই কাজ করে আবার ভারতে ফিরে এসেছিলেন, গরু ও শুয়োরের মাংস তার কোনো ক্ষতি করতে পারে নি। কিন্তু ভারতে ফিরে তিনি তো আর এসব নিষিদ্ধ মাংস খান নি। এ জন্যই হিন্দুশাস্ত্রের নির্দেশ, “যস্মিন দেশ যদাচার” অর্থাৎ- যেমন দেশ, তেমন আচার। শুধু তাই নয়, স্বামীজী কোনো দিনই নিরামিষ ভোজী ছিলেন না। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি মাছ মাংস খেয়ে গেছেন। আপনি, আমি কি তার চেয়ে বড় হিন্দু ?
তাই বিপদে পড়ে বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে বা না জেনে যদি গরুর মাংস খেয়েই থাকেন, আর সেটা নিয়ে যদি আপনার কোনো অপরাধবোধ বা হীনম্মন্যতা থেকে থাকে ? তাহলে সেই অপরাধবোধ ও হীনম্মন্যতা এখনই ঝেড়ে ফেলুন; কারণ আপনার জাত নষ্ট হয় নি আর ধর্মও যায় নি, আপনি হিন্দু ছিলেন আর হিন্দুই আছেন।
১৯৪৬ সালে নোয়াখালির হিন্দু নিধনের সময়, দাঙ্গা কবলিত এলাকার প্রায় সব হিন্দুকে জোর করে মুসলমান বানানো হয়েছিলো, শুধু তাই নয় তাদেরকে তাদেরই বাড়ির গরু জবাই করে সেই গরুর মাংস জোর করে খাওয়ানো হয়েছিলো। এতে তারা ভেবেছিলো তারা মুসলমান হয়ে গেছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হলে উদ্ধারকারী হিন্দুরা যখন তাদেরকে উদ্ধার করতে যায়, তখন তারা বলেছিলো, বাবু, আমাদেরকে মুসলমান বানানো হয়েছে, জোর করে আমাদেরকে গরুর মাংস খাওয়ানো হয়েছে, হিন্দু সমাজ কি আমাদেরকে আবার গ্রহন করবে ? সেই সময় রামকৃষ্ণ মিশন থেকে একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বলা হয়েছিলো,
“পরিস্থিতির শিকার হয়ে কেউ যদি নিষিদ্ধ খাদ্য খায়, তাতে তার ধর্ম নষ্ট হয় না।”
এই কথা বলা আছে, গীতা মাহাত্ম্যের ৩৪ ও ৩৫ নং শ্লোকে,
অনাচারোদ্ভবং পাপমবাচ্যাদি কৃতঞ্চ যৎ।
অভক্ষ্যভক্ষজং দোষমস্পর্শস্পর্শজং তথা।। ৩৪
অভক্ষ্যভক্ষজং দোষমস্পর্শস্পর্শজং তথা।। ৩৪
জ্ঞানাজ্ঞানকৃতং নিত্যমিন্দ্রিয়ৈর্জনিতঞ্চ যৎ।
তত সর্বং নাশমায়াতি গীতাপাঠেন ততক্ষণাৎ।।৩৫
তত সর্বং নাশমায়াতি গীতাপাঠেন ততক্ষণাৎ।।৩৫
এর অর্থ - অনাচার অর্থাৎ যে সব কাজ করতে শাস্ত্রে নিষেধ আছে, সেগুলো করলে, যা বলা উচিত নয় তা বললে, যা খাওয়া উচিত নয়, তা খেলে বা স্পর্শ করলে যে পাপ হয় তা গীতাপাঠ মাত্রই বিনষ্ট হয়।
সুতরাং আপনার মনে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে যদি কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে, গীতাপাঠ করে নিজেকে পবিত্র করেন, সকল বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে।
যা হোক, ছাপানো বইয়ে তারা যখন এই কথা দেখে তখন আবার তারা দলে দলে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে। রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে, আমার দৃষ্টিতে, এই একটি কাজ তারা হিন্দু সমাজের পক্ষে করেছিলো, আর সর্বধর্ম সমন্বয়ের যা করেছে বা এখনও করছে সব হিন্দু সমাজের বিপক্ষে, এই কারণে বর্তমানে হিন্দু সমাজের সবচেয়ে ক্ষতিকারক সংগঠন এই রামকৃষ্ণ মিশন।
পরোক্ষভাবে অনেক হিন্দুই যে গরুর মাংস খেয়েছে বা খেতে বাধ্য হয়েছে এবং এখনও খাচ্ছে তার বর্ণনা তো উপরেই দিলাম; তাছাড়া অনেক হিন্দু আছে, যারা না জেনেই গরুর মাংস খেয়ে পরে তা জানতে পেরেছে, যদি এমন ঘটনা আপনার জীবনে ঘটে থাকে আর তা নিয়ে যদি আপনার মনে কোনো খটকা লেগে থেকে থাকে যে, আমার ধর্ম আছে, না নাই ? তাহলে আমার এই ঘটনাটি আপনার মনে শুধু সাহসই জোগাবে না, আপানার মনের সেই খটকাও দূর করবে।
এক বাসায় টিউশন করতাম, সেই বাসায় খুব ভালো করেই জানতো যে আমি হিন্দু এবং গরুর মাংস খাই না। তারপরও নিজেদের ভুলেই কি না জানি না, একদিন পিঠা জাতীয় কি যেন আমাকে নাস্তা হিসেবে দিয়ে গেছে, অনেক সময় পিঠার ভেতরে অনেক কিছু থাকে, আর কী থাকে সেটা তো আর দেখা যায় না, আমিও কিছু দেখতে না পেয়ে খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু তার ভেতরে যে গরুর মাংস আছে, সেটা জানতো আমার ছাত্র, কিন্তু আমাকে গরুর মাংস খাওয়ানোর জন্য সে তা চেপে গিয়েছে আর আমিও তা খেয়ে ফেলেছি; কিন্তু কোনো হিন্দুকে গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনা মুসলমানের পক্ষে কি চেপে রাখা সম্ভব ? তাই পরদিন আমি জানতে পারি সেই ঘটনা। কিন্তু তাই বলে আমি সেটা নিয়ে খুব বেশি বিচলিত হই নি এবং এখনও নই এই কারণে যে, আমি জানতাম স্বামী বিবেকানন্দও আমেরিকায় গিয়ে পরিস্থিতির শিকার হয়ে, না জেনে নয়, স্বেচ্ছায়, গরুর মাংস খেয়েছিলো, কিন্তু তাতে তার যে হিন্দু মন, তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয় নি; আর আমি তো স্বেচ্ছায় নয়, না জেনে খেয়েছি।
যা হোক, আজও বাংলার কোনো হিন্দু, নিজেকে স্বামী বিবেকানন্দের চেয়ে যেমন বড় হিন্দু মনে করে না। ঠিক তেমনি, বর্তমানে বাংলায় যত জীবিত হিন্দু আছে, যারা আমার লেখার মাধ্যমে আমার সম্পর্কে জানে, তাদের কারো এই ক্ষমতা ও দুঃসাহস নেই যে, সে নিজেকে আমার চেয়ে বড় বড় হিন্দু বলে দাবী করতে পারে। আমার কাছে বড় হিন্দুত্বের মাপকাঠি মানে- মাথার চুল কামিয়ে ফেলা, গেরুয়া পোষাক পড়া, নিরামিষ খাওয়া, সারাক্ষণ মালা জপা আর নাক থেকে কপাল পর্যন্ত বড় করে তিলক কাটা- নয়; আমার কাছে হিন্দুত্বের মাপকাঠি হলো- যে ব্যক্তি, হিন্দুধর্ম ও সমাজ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবে এবং যে ব্যক্তি হিন্দুধর্ম ও সমাজকে যেকোনো আগ্রাসন ও আক্রমনের হাত থেকে বাঁচাতে চায়- সে ই হলো আমার বিচারে সবচেয়ে বড় হিন্দু। আমার লেখা ছয় মাস ধরে রেগুলার পড়ার পর, কারো যদি মনে হয়, কর্ম ও জ্ঞানে আপনি আমার চেয়ে বড় হিন্দু, তাহলে দয়া করে আমার ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে জানাবেন, আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহন করবো; কারণ, সেরকম একটি গুরু আমিও খুঁজছি, যে গুণে ও জ্ঞানে আমার চেয়ে বড় হিন্দু।
এত কিছুর পর আমি যদি নিজেকে এত বড় হিন্দু বলে দাবী করতে পারি, এ্যাকসিডেন্টলি আপনি যদি গরুর মাংস খেয়েও থাকেন, আপনি নিজেকে হিন্দু বলে মনে করতে পারবেন না কেনো ? আগেই বলেছি, খাবারের মধ্যে কোনো ধর্ম নেই, ধর্ম আছে বা থাকে মনে, আপনার সেই মন যদি ঠিক থাকে, তা হলে না জেনে খাওয়া গরুর মাংস আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারে নি আর পারবেও না। তাই ঝেড়ে ফেলুন সংস্কার আর জোরে বলুন-
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
জয় হিন্দ।
জয় হিন্দ।
From: Krishna kumar das
দারুণ
উত্তরমুছুন