রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শিকাগো বিজয়

শিকাগো বিজয়

শিকাগো বিজয়  ১২৫         তাপস বসু


সৌজন্যে   অনির্বাণ বেরা                   সকলের সাথে ভাগ করে নিতে চাইছেন               প্রণব কুমার কুণ্ডু
সৌজন্যে ফেসবুক
১৮৯০ থেকে ১৮৯৩ সালের মে মাস। ওই তিনটে বছর ভারতপথিক বিবেকানন্দের সামনে এক অজানা জানালা খুলে দিয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন এক অন্য ভারতকে। একদিকে পরাধীনতার বেড়ি পরা শোষিত-বঞ্চিত মানুষ... যাঁরা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে কুশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কারের অতলে।
চিরখিদে যাঁদের চিরসঙ্গী। আর অন্যদিকে, ব্রিটিশদের দাসানুদাস হয়ে থাকা মুষ্টিমেয় রাজা-জমিদাররা। বিত্ত-বৈভবের জমকালো পোশাক গায়ে চাপিয়ে যারা উদাসীন সাধারণ মানুষের প্রতি। অস্থির... চঞ্চল... ভোগে মত্ত।
কখনও বা স্বার্থসিদ্ধির খাতিরে তাদেরও অত্যাচার নেমে আসছে ওই মানুষগুলোর উপর। পার পায়নি ভারতীয় নারীসমাজও। যা দেখে স্বামীজির উপলব্ধি হৃদয় ভেদ করে প্রকাশিত হয়েছিল—‘ভারতের জাতীয় জীবনের দু’টি মহাপাপ হলো—সাধারণ মানুষকে অবহেলা করা এবং নারীজাতির প্রতি চূড়ান্ত অসম্মান প্রদর্শন।’ অথচ প্রাচীন ভারতবর্ষের ধর্মদর্শন তো কখনই তা শেখায়নি! সে যে বারেবারে ঘোষণা করেছে, মানুষই অমৃতের সন্তান—অনন্ত শক্তি তার মধ্যে বিরাজমান। সে-ই পরমাত্মা... পরম ব্রহ্মের অংশ। তাহলে কেন এই দুর্দশা দেশমাতৃকার? কেন এই অসহায়তা তার সন্তানের? নতুন করে জাগিয়ে তুলতে হবে এই ভারতকে। নিশ্চিহ্ন করতে হবে শোষক-অত্যাচারীদের। অস্থির হয়ে উঠলেন বিবেকানন্দ। উপায় খুঁজে পাওয়ার প্রবল বাসনা নিয়ে পৌঁছে গেলেন কন্যাকুমারিকার শিলাখণ্ডে। তিন দিন, তিন রাত নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানে ছিলেন সেখানে। লক্ষ্য ছিল একটাই, কীভাবে হবে মুক্তি... দেশের উত্তরণ। সে ছিল ভারতমাতার ধ্যান। পথের হদিস মিলল সেখানেই। পাশ্চাত্যের পথ ধরে ফিরে আসতে হবে এই ভারতেরই মাটিতে। এদেশের আদর্শ, উন্নত ধর্মদর্শন, আধ্যাত্মিকতার কথা তুলে ধরতে হবে পাশ্চাত্যের মানুষের সামনে। আর সেখান থেকে তুলে আনতে হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্বনির্ভরতা।
রামনাদের মহারাজ ভাস্কর সেতুপতির কাছে অনুষ্ঠেয় শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের কথা প্রথম জানতে পেরেছিলেন বিবেকানন্দ। স্থির করে নিয়েছিলেন, যেতে হবে এখানেই। এগিয়ে এসেছিল মূলত দক্ষিণ ভারত। যুবশিষ্যদের সংগ্রহ করা টাকায় কেনা হয়েছিল পোশাক। আর সঙ্গী ছিল দেশকে অন্তর থেকে দেখার অনুভূতি। ১৮৯৩ সালের ৩১ মে বোম্বাই (বর্তমান মুম্বই) থেকে জাহাজে পাড়ি দিলেন শিকাগোর উদ্দেশে। ২৫ জুলাই সন্ধ্যা ৭টায় কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে পৌঁছালেন বিবেকানন্দ। তারপর ট্রেনে চেপে শিকাগো পৌঁছালেন ৩০ জুলাই, সকাল ১১টায়। বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের তারিখ সঠিক জানতেন না তিনি। পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রায় ছ’সপ্তাহ আগে। আর তখন থেকেই একের পর এক বাধা।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষে সে সময় দেশজুড়ে এমনিতেই সাজ সাজ রব। শিকাগো পৌঁছে এক অন্য পরিবেশে পড়ে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন বিবেকানন্দ। সঙ্গে সামান্য টাকা। প্রায় মাস দেড়েক সেই টাকায় থাকা খাওয়া অসম্ভব। জামা কাপড়ও শীতের দেশের উপযোগী নয়। বেশ ঠান্ডাও পড়তে শুরু করেছে। দক্ষিণ ভারতীয় শিষ্য-যুবক বন্ধুদের কাছে টেলিগ্রাম করে এই অবস্থার কথা জানানো ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। বিরোধী থিওজফিস্টরা বিবেকানন্দের এই অবস্থার কথা জেনে তখন আনন্দে প্রায় লাফাচ্ছে। ‘এইবার শয়তানটা মরতে চলেছে’ জাতীয় কথাবার্তাও প্রচার হচ্ছে জোরকদমে। স্বামীজি যখন প্রথমবার ভ্যাঙ্কুভার থেকে শিকাগো যাচ্ছিলেন, তখন কানাডিয়ান প্যাসিফিক ট্রেনে আলাপ হয়েছিল মিসেস কেটি স্যনবর্নের সঙ্গে। তাঁর দেওয়া কার্ড সম্বল করেই বিবেকানন্দ পৌঁছে গেলেন মেটকাফে স্যনবর্নের খামারবাড়িতে ‘ব্র্যাজিমোডেজে’। এখানেই পরিচয় হল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিক ভাষার অধ্যাপক হেনরি রাইটের সঙ্গে। রাইট ও তাঁর স্ত্রীর সূত্রেই শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে বিবেকানন্দ বেশ কয়েকটি ঘরোয়া সভা এবং নারী সংশোধনাগারের সদস্যাদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে, আমেরিকান স্যোশাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
অর্থ সংকটে পড়েই স্বামীজির শিকাগো থেকে বস্টনে আসা। কিন্তু বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের আগেই বস্টন ও তার আশপাশের অঞ্চলের মানুষের কাছে বিবেকানন্দের কথা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অনিন্দ্যকান্তি চেহারা, বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব, আর অগাধ পাণ্ডিত্য...। শ্রীমতী রাইট তাঁর সারল্যে এতটাই অভিভূত ছিলেন যে, তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন সন্তানস্নেহে। রাইট তাঁর সতীর্থদের সঙ্গে বিবেকানন্দকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন—‘আমদের সমস্ত পণ্ডিত অধ্যাপকদের পাণ্ডিত্যের সমষ্টির চাইতে ইনি অধিক পাণ্ডিত্যের অধিকারী।’
এবার বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন (World parliament of religion) শুরুর দু’দিন আগেই শিকাগো পৌঁছে গেলেন বিবেকানন্দ। রাইট তাঁকে একটি পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন। পাশাপাশি থাকার জন্য ঠিকানা লেখা একটি চিঠিও। কিন্তু পথে সেটি হারিয়ে যাওয়ায় আবার বিপর্যয়। শিকাগোয় ডিয়ারবর্ন স্টেশনে পৌঁছে প্রবল ঠান্ডায় মালগাড়ির ওয়াগনে রাত কাটানো, খাবারের অভাব...। ক্ষুধার্ত বিবেকানন্দ যখন পথের ধারে ক্লান্ত হয়ে চলার শক্তি প্রায় হারিয়েছেন, তখন তরুণ সন্ন্যাসীকে চিনে নিলেন মিসেস জর্জ হেল। প্রায় ডেকেই আলাপ করলেন তিনি। নিয়ে গেলেন বাড়িতে। সম্মেলনের কর্তাব্যক্তিদের কাছেও নিজেই নিয়ে গেলেন বিবেকানন্দকে। মিসেস হেল বিবেকানন্দের কাছে ‘মাদারচার্চ’ আর মিস্টার হেল ‘ফাদার পোপ।’ বিপরীত গোলার্ধের অনাত্মীয় এই পরিবারের সঙ্গে পূর্বজন্মের কোন সংযোগ ছিল বলেই মনে করতেন বিবেকানন্দ।
ধর্ম মহাসম্মেলনের আর এক উদ্যোক্তা ছিলেন মিস্টার লায়ন। তিনি আর তাঁর স্ত্রী সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের মধ্যে একজনকে আতিথ্য প্রদানের সুযোগ চেয়েছিলেন আয়োজকদের কাছে। সেই সূত্রেই বিবেকানন্দ তাঁদের বাড়িতে পৌঁছান। মিশিগান অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়িতে পৌঁছে বিবেকানন্দের মনে হয়েছিল, তিনি যেন নিজেরই বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন... সেই স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা। বক্তৃতা করে যা অর্থ উপার্জন করতেন, তার সবটাই স্বামীজি গুনেগেঁথে রাখার জন্য দিয়ে দিতেন মিসেস লায়নকে।
১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সালের বেলা ১০টায়। শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের সূচনা হল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে। উপস্থিত চার্লস ক্যারল বনি, চার্লস এইচ হেনরোটিন, মিসেস পামার, ক্যার্ডিনাল গিবন্‌স প্রমুখ বহু খ্যাতনামা মানুষ। বেজে উঠেছিল দশটি ঘণ্টা। নির্মীয়মাণ আর্ট ইনস্টিটিউটে নির্ধারিত তিন হাজার দর্শকের বাইরে আরও প্রায় সমসংখ্যক দর্শক। সব মিলিয়ে সেদেশের সুশিক্ষিত সমাজের বাছাই করা ৬-৭ হাজার নরনারী... আর মঞ্চের উপর পৃথিবীর সর্বজাতীয় পণ্ডিতের সমাবেশ। ব্রোঞ্জ আর মর্মরমূর্তিতে সজ্জিত সেই মঞ্চ। প্রার্থনা সংগীত শুরু হল সমবেত কণ্ঠে,
“Praise God from whom all blessings flow/ praise him all creatures below/ praise him above you heavenly hosts/praise father, son and holy ghost.”
বিবেকানন্দ ধ্যান সমাহিত ভঙ্গিতে শুনছিলেন প্রথমদিনের প্রথমার্ধের সব বক্তাদের কথা। সন্ন্যাসীর বেশ, গেরুয়া উষ্ণীষে অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হল যথাসময়ে... পরপর চারজনের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ; আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান হল আর্ট প্যালেসে সেই তরুণ সন্ন্যাসী উপস্থিত সকলকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে আমার আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতাগণ’ কয়েকপল নিস্পন্দ সবাই। এ তো অশ্রুতপূর্ব! শুরু হল করতালি... চলল কয়েক মিনিট ধরে। প্রায় সাত হাজার দর্শক-শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন সেদিন। হাতে ছিল না কোনও লিখিত ভাষণের নোট। শ্রোতাদের আন্তরিক অভিনন্দনের প্রতিক্রিয়ায় আবেগে কিছুক্ষণের জন্য আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন বিবেকানন্দ। প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, প্রাচীন ভারতবর্ষের ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতি সবচেয়ে উদার, সেই ভারতবর্ষের মানুষ রূপে আমি গর্বিত। ভারতবাসী এবং ভারতীয় হিন্দুদের (সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা বৈদিক-পৌরাণিক-লৌকিক ধর্মানুসারী) পক্ষ থেকে আমি উপস্থিত সুধীবৃন্দকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, এই মহতী সভায় যোগদান ও বক্তৃতার সুযোগ দেওয়ার জন্য। ওই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের চিরায়ত উদারতার কথা স্মরণ করিয়ে যুগে-যুগান্তরে, কালে-কালান্তরে বিভিন্ন ধর্ম-গোত্র-বর্ণের মানুষকে গ্রহণ-সহন-সম্মিলনের মধ্য দিয়ে (Acceptance, Tolerance, Assimilation) ভারতবাসীর এগিয়ে চলার মন্ত্র ঘোষণা করেছেন তিনি। প্রথম দিনের বক্তৃতার অভিজ্ঞতার কথা বিবেকানন্দের প্রিয় শিষ্য আলাসিঙ্গাকে লিখেছেন, ‘যখন আমি আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ বলে সভাকে সম্বোধন করলাম, তখন দু’মিনিট ধরে এমন করতালি ধ্বনিত হতে লাগল যে, কানে যেন তালা ধরে যায়;... পরদিন সব খবরের কাগজ বলতে লাগল, আমার বক্তৃতাই সেদিন সকলের প্রাণে লেগেছিল।... সেই দিন থেকেই আমি একজন বিখ্যাত লোক হয়ে পড়লাম, আর যেদিন হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে আমার বক্তৃতা পাঠ করলাম, সেদিন হলে এত লোক হয়েছিল যে, আর কখনও সেরকমটি হয়নি।’ বিবেকানন্দ এই চিঠিতে সংবাদপত্রের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন... ‘মহিলা মহিলা কেবল মহিলা—সমস্ত জায়গা জুড়ে, কোণ পর্যন্ত ফাঁক নেই।’ বস্তুতপক্ষে, ওই অপূর্ব ভারতীয় সন্ন্যাসী যখন সভাগৃহে উপস্থিত সবাইকে ‘ভগিনী’ও ‘ভ্রাতা’ সম্বোধন করেন তখন প্রায় বেশিরভাগ মানুষই ব্যারিকেড ভেঙে পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন বিবেকানন্দের কাছে। উদ্দেশ্য, একটু স্পর্শ করবেন তাঁকে। সেই উদার প্রাণকে ছুঁতে চেয়ে কি তীব্র সে আকুতি! লস এঞ্জেলসবাসিনী শ্রীমতী ব্লজেট সে দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,... ‘অজস্র মহিলা সামনের বেঞ্চগুলি টপকে স্বামীজির নিকটবর্তী হয়। আমি তখন মনে মনে বললাম,... ‘বাছা, যদি এই আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারো, তবে বুঝবো তুমি স্বয়ং ঈশ্বর।’ স্বামীজি বলেছিলেন, কোনও সংকীর্ণতা বা মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারতবর্ষ বা ভারতবাসী যে কোনওদিন আবদ্ধ ছিল না। ‘শিবমহিম্নস্তোত্র’ এবং ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ থেকে দৃষ্টান্ত দিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ হেনেছিলেন বিবেকানন্দ। ঘোষণা করেছিলেন, পৃথিবীর সব ধর্মই একই সত্যে এসে মিলিত হয়েছে। সেই সত্যটি হল যথার্থ মনুষ্যত্বের উন্মোচন। এবিষয়ে আপন আপন ধর্ম নিয়ে অহংকার, স্বার্থবোধ, ঔদ্ধত্য সাজে না। তা সমর্থনও করা যায় না। সাম্প্রদায়িকতা, আর ধর্মীয় উন্মাদনায় এই ধরাতল বারবার রক্তাক্ত হয়েছে। আগামী প্রজন্মের জন্য, নতুন বিশ্বের জন্য সে ছিল বিবেকানন্দের এক সাবধানবাণী।
আগামী দিনগুলিতে এই নবীন সন্ন্যাসীর থেকে আরও অনেক কিছু শোনার প্রত্যাশা নিয়ে সেদিন ফিরে গিয়েছিলেন শ্রোতারা। সহজ-সরল বাচনভঙ্গি, ইংরেজি উচ্চারণ (আইরিশ অ্যাকসেন্টে), পরিচিত ঘটনা ও পরিবেশ থেকে উদাহরণ টেনে জটিল বিষয়কে সেদিন সহজবোধ্য করে তুলেছিলেন বিবেকানন্দ। ছ’টি ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে। বক্তৃতার তারিখগুলি ছিল—১১, ১৫, ১৯, ২০, ২৬ এবং ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সাল। ১১ সেপ্টেম্বর শুধু শিকাগো নয়—সমগ্র আমেরিকা ও পৃথিবী ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ে পদার্পণ করেছিল। ১৫ সেপ্টেম্বরের ভাষণের বিষয় ছিল, ধর্মীয় ঐক্য ও ভ্রাতৃভাব। ১৯ সেপ্টেম্বরে শ্রোতারা হিন্দুধর্ম সম্পর্কে এক মনোজ্ঞ বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা শুনলেন। লিখিত দীর্ঘ এই বক্তৃতায় এসেছিল ঐতিহ্য পরম্পরার কথা। ২০ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতবাসীর সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করেন। ২৬ সেপ্টেম্বরের বিষয় ছিল হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্পর্ক। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীজি। ধর্মীয় সন্ত্রাস ও মৌলবাদী সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, পারস্পরিক সম্প্রীতি, উদারতাই পারে ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিনাশ করতে। তারিখ ছিল ১৫ এবং ২৭ সেপ্টেম্বর। কুয়োর ব্যাঙের সঙ্গে সমুদ্রের ব্যাঙের তুলনা করে কূপমণ্ডুকতা ও উদারতার প্রসঙ্গটি তুলে ধরে বললেন, ‘সংকীর্ণ ভাবই আমদের মতভেদের কারণ। আমি একজন হিন্দু... আমি আমার ক্ষুদ্র কূপে বসে আছি এবং তাকেই সমগ্র জগৎ বলে মনে করছেন। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীও নিজের ক্ষুদ্র কূপে বসে আছে ও তাকেই সমগ্র জগৎ বোধ করছেন। মুসলমানও সেই কূপমণ্ডুকতার চক্রে ঘুরে ফিরছেন।’ কূপের মতো সংকীর্ণ মনোভাব সরিয়ে মানসিক উদারতা সবথেকে জরুরি।
যে হিন্দুধর্ম নিয়ে বিবেকানন্দ বক্তৃতা করেছেন, তা বৈদান্তিক ধর্ম-দর্শন। সেখানে মানুষই প্রথম ও শেষ কথা। মানুষই যে ঈশ্বর, একথা জোর দিয়ে বলেছিলেন তিনি। প্রতিটি জীবনের মধ্যে ‘শিব’-এর অবস্থান। ‘শিব’ হল সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের সম্মিলিত রূপ। ধর্মের মাধ্যমে সেই সত্যকে খুঁজে ফিরতে হবে। বিবেকানন্দ তাই পরে বলতে পেরেছিলেন—‘জীবে প্রেম করে যেই জন/সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। গভীর বিশ্বাস থেকে, সংবেদী মানবপ্রেম থেকে উঠে এসছিল তাঁর এই চিন্তা। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য যে সর্বাংশে সঠিক নয়, সে প্রসঙ্গও তুলে ধরেছিলেন তিনি। যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, খ্রিস্ট ধর্মপ্রচারকরা মানুষের মহত্ত্বকে ছোট করে দেখতে চেয়েছেন। পাপ-পুণ্য সম্পর্কে নানা নির্দেশনা ছিল তাদের। বিবেকানন্দ মানুষকে চিহ্নিত করেছেন অমৃতের সন্তান রূপে। মানুষ ভুল করতে পারে। হাজার ত্রুটি-বিচ্যুতি তাঁর জীবনে ঘটতে পারে। কিন্তু সেটিই শেষ কথা নয়। মানুষই পারে নিজেকে উত্তরণের দিকে নিয়ে যেতে। সে কখনই কোনও ঘটনা বা পরিবেশের প্রেক্ষিতে হারিয়ে বা ফুরিয়ে যেতে পারে না... নষ্ট হয়ে যেতে পারে না। হাজার বছরের অন্ধকারও দূর হয়ে যেতে পারে ছোট্ট আলোর দীপনে। গৌতম বুদ্ধ যে বলেছেন ‘আত্মদীপো ভব’, অর্থাৎ নিজেই প্রদীপের মতো উজ্জ্বল হবে মানুষ... এই কথা ছিল বিবেকানন্দেরও। শিকাগোয় শোনা গিয়েছিল তারই অনুরণন। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা ভারতে সর্বত্র গির্জা নির্মাণ করো, কিন্তু, প্রাচ্যে সর্বাধিক অভাব তো ধর্ম নয়! ধর্ম তাদের প্রচুর পরিমাণে আছে। ভারতের কোটি কোটি আর্ত নরনারী শুষ্ককণ্ঠে কেবল দু’টি অন্ন চাইছে, তারা শুধু অন্নই চাইছে; আর, আমরা তাদের প্রস্তরখণ্ড দিচ্ছি। ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শন শাস্ত্র শেখানোর অর্থ হল তাঁকে অসম্মান, অপমান করা।... শিবরূপী জীব যদি অভুক্ত থাকে, তবে ধর্ম-দর্শন চর্চা-আধ্যাত্মিকতা নিরর্থক হয়ে পড়ে। সকলেই যদি পরম ব্রহ্মের অংশ হয়, তবে প্রাচুর্য যাঁদের আছে, তাঁদের নিঃসন্দেহে অনাহারক্লিষ্টের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।’ স্বামীজির চূড়ান্ত আগ্রহ ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সম্মিলনে। অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা মানুষজনের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষালাভের, অর্থাৎ বেঁচে থাকার প্রাথমিক চাহিদাগুলি পরিপূরণ সম্ভব।
শেষদিন। বিদায়ী ভাষণে উপস্থিত সকলের কাছে বিবেকানন্দ উদার আহ্বান জানিয়ে বললেন, ‘প্রত্যেক ধর্ম যখন একই সত্যে উপনীত, তখন কারোর নিজের ধর্ম পরিত্যাগের প্রয়োজন নেই।’ চমৎকার সমাধান। আজকের ধর্ম-সংঘাত সমস্যার সমাধানে। সবশেষে তিনি বলেছেন যে, ‘এই সম্মেলনে নানা আলোচনা, এত ভাব বিনিময় সত্ত্বেও কারো যদি মনে হয় যে তাঁর ধর্মই টিকে থাকবে এই পৃথিবীতে এবং অন্যান্য ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র।’ স্বামীজির সিদ্ধান্ত তাই ‘বিবাদ নয়, বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ। মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।’
দুঃখের বিষয় হল, শিকাগো বক্তৃতার ১২৫ বছর পরেও সভ্যতাবিনাশী সংকট হার মানেনি। ধর্মীয় সন্ত্রাস ভিন্ন ভূমিকায় দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। চলছে হিংসার বিরুদ্ধে হিংসা। তবে সমস্যা-সংকটের সমাধান বিবেকানন্দের পরামর্শ ছাড়া সম্ভব নয়। সেটি বুঝতে পেরেছে বিশ্বের নানা ধর্মের মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ শিকাগোর মিশিগান অ্যাভিনিউয়ের নাম পরিবর্তন করে বিবেকানন্দের নামে করেছেন। সম্প্রতি রাস্তাটির নতুন নামকরণ হয়েছে ‘বিবেকানন্দ ওয়ে’। ‘ওয়ে’ শব্দটিও তাৎপর্যপূর্ণ। বিবেকানন্দের পথই তো মুক্তির পথ! সেদিন শিকাগোর মহাসম্মেলনে সেই তরুণ সন্ন্যাসীর কাছে সকলে নতজানু হয়েছিল সুস্থ-সুন্দর-বাসযোগ্য পৃথিবীর লক্ষ্যে। এই প্রয়াস তো ব্যর্থ হওয়ার নয়... ব্যর্থ হওয়ার নয় বিবেকানন্দের শিক্ষা। শ্রীরামকৃষ্ণের সেই উক্তি—‘নরেন শিক্ষে দেবে। যখন ঘরে বাহিরে হাঁক দিবে।’ সেই শিক্ষা আমরা কতটা গ্রহণ করব, তার সিদ্ধান্ত কিন্তু আমাদেরই।
লেখক: বিশিষ্ট বিবেকানন্দ গবেষক এবং বাংলা সাহিত্যের বরিষ্ঠ অধ্যাপক

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্যগুলি
Amarnath Chakraborty অসাধারণ 👌👌👌👌

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর3 ঘণ্টা
মুছে ফেলুন
Pranab Kumar Kundu অসম্ভব ভালো !

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর4 মিনিট
পরিচালনা করুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন