শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সনাতন হিন্দুধর্মে বিবাহ প্রথা

 

সনাতন হিন্দুধর্মে বিবাহ প্রথা



শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডু













" হিন্দু ধর্মে বিবাহ " !
--------------------------
"বিবাহ" শব্দটি বি-পূর্বক বহ্ ধাতু ও ঘঞ্ প্রত্যয়যোগে গঠিত =বি+বহ্ +ঘ্ অঞ্ ( ঘ্ এবং ঞ্ লোপে অবশিষ্ট অ)= বি +বহ্ +অ( উপধা দীর্ঘ)= বি+বাহ্ +অ =বি+বাহ=বিবাহ ৷ বহ্ ধাতুর মানে বহন করা ৷ এবং "বি" উপসর্গের অর্থ বিশেষরূপে ৷অর্থাৎ বিশেষভাবে বহন করা ৷ মানব সভ্যতার প্রথম লগ্নে বিবাহ বন্ধন বলে কিছু ছিল না ৷ মনে করা হয় তখন প্রচলিত ছিল Pomiscuty অর্থাৎ গোষ্ঠীর সব পুরুষ সব মহিলার সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হত ৷ পৃথিবীর সব দেশে এই মেলামেশাকে তখন প্রশাংসার দৃষ্টিতেই দেখা হত ৷এরপর নির্দিষ্ট পুরুষ ও মহিলার মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক হতে থাকলেও বিবাহের বাইরের যৌনাচারে কোন বাধা ছিল না ৷ প্রাচীন ভারতে উদ্দালকের ছেলে শ্বেতকেত(অরুণি)এই রীতিকে জঘন্য বলে সনাতনী সমাজে বিয়ের প্রচলন করেন ৷ তিনি বিবাহ বহির্ভূত স্বচ্ছন্দ বিহার বন্ধ করে নর-নারীর দাম্পত্য সম্পর্কে আস্থার সূচনা করেন ৷ উপনিষদে একে বলা হয়েছে অজ্ঞতা থেকে আত্ম ও সত্যের জ্ঞানে যাত্রা ৷বৈদিক যুগে অন্তর্বিবাহ (Endogamy) ও বহির্বিবাহ(Exogamy) র চল থাকলেও একগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ হয় ৷ নিকট সম্পর্কের মধ্যে বিয়ের অপকারিতা বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে ৷ উচ্চজাতির পুরুষ ও নিম্নজাতির নারীর অনুলোম (Kypergamy) এবং উল্টোটা প্রতিলোম ( Hypogamy)সম্পর্কেও বলা হয়েছিল ৷ অন্যান্য দেশে ও সমাজে এভাবে কোন না কোন মহাপুরুষ বিবাহ রীতির সূচনা করেছিলেন ৷ চীনে রাজা কাফাউ -লি ( Fou -Li) ও ল্যাপল্যান্ডে নজারভিস ও আটজিস বিবাহ রীতির প্রবর্তন করেছিলেন বলে জানতে পারি ৷ আসলে সেযুগে পুরুষের কাজ ছিল শিকার ও খাবার সংগ্রহ ৷নারীর কাজ ছিল তাকে সাহায্য করা এবং সন্তান প্রতিপালন করা ৷ এভাবে সৃষ্টি হয় বিবাহ রীতির ৷বিয়ে হল সহমিলন ৷মহাভারতে পড়েছি পান্ডু তাঁর স্ত্রী কুন্তীকে বলছেন আগেকার দিনে মহিলাদের তাদের স্বামী বা কোন আত্মীয়পরিজনের সাথে থাকতে হত না ৷ তারা নিজেদের মত আনন্দ করত ৷সেসময় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে সহবাস প্রচলিত ছিল ৷ যম -যমুনার কাহিনীতে বোঝা যায় ৷তবে ঋকবেদে (১০/১০/১২) তে এই কাহিনী বলে বোনের সাথে সহবাসকে পাপ বলা হয়েছে ৷ অন্যদেশেও ছিল একই ব্যাপার ৷ ৪২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রকাশিত গ্রীক বিয়োগান্ত নাটক Sophocles এর Oedipus এ পড়েছি অডিপাস অজান্তে বাবা Laius কে হত্যা করে গর্ভধারিনী মাকে বিবাহ করেছিলেন ৷ পরে অবশ্য মা বিষয়টি জেনে ফেলায় আত্মহত্যা করেন ৷ তবে , এখনও বিভিন্ন ধর্মে ও সমাজে মামা ভাগ্নি , পিসি ভাইপো , মাসি বোনপো এবং তুতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত আছে ৷ সম্পত্তি সহ নানা কারণে এসব প্রথা তৈরী হয়েছিল ৷ ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে ৷ বিবাহ মনুষ্য সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান ৷ যে প্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে ধর্ম ৷দেশের আইন ও সমাজের প্রচলিত বিধি একে প্রভাবিত করেছে ৷যা ধর্ম , দায়িত্ব , অর্থ ও কাম অনুসরণ করে ৷প্রাচীন বিশ্বে এফ্রোডাইট ,,ইরোস , ফ্রিজ ,হথর ,হেরা ,জুনো , ওয়েস্টা প্রমুখ প্রেম , বিবাহ ও যৌনতার দেবদেবী ছিলেন গ্রীক, রোমান , নর্স ও মিশরীয় সভ্যতায় ৷ আমরা জগজ্জননী পার্বতীকে ও শিবকে এবং প্রজাপতি ব্রহ্মাকে বিবাহের দেবতা হিসাবে দেখি ৷বিয়েতে স্বামী -স্ত্রী শুভ দৃষ্টি বিনিময় করি ৷
প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋকবেদে (৯/৬৭/১০-১২) সুশ্রী রমনীর জন্য প্রার্থনা দেখা যায় ৷হিন্দু বিয়ে সামাজিক চুক্তি নয় ৷সনাতন ধর্ম সেই যুগ থেকে নারী পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে ৷ পরে পরাধীনতা সহ নানা কারণে হিন্দু নারীকে অবগুন্ঠিত করে গৃহবন্দী করা হয়েছে ৷ এজন্য মধ্যযুগে নারীর অধিকার হরনের নানা গ্রন্থ ও কাহিনী হিন্দু সমাজে ঢুকে গিয়ে সনাতনী সমাজকে পিছিয়ে দিয়েছে ৷ বেদে(১০/৮৬/২২) এ " উদীর্স্বাতো বিশ্ববাসো নমসেলামহে ত্বা ৷ অন্যামিচ্ছ প্রফর্ব্যং সং জায়িং পত্যা সৃজ"( তুমি যাও ও অবিবাহিত নারীকে তোমার অর্ধাঙ্গিণী কর ও তাকে সমান অধিকার প্রদান কর।মন্ত্রটি পড়লেই বৈদিক যুগে সনাতনী নারীর সর্বোচ্চ অবস্থান বোঝা যাবে ৷ সহধর্মিনী অর্থাৎ স্ত্রীকে বাদ হিন্দুর কোন ধর্মকর্ম সম্পন্ন হয় না ৷ অথর্ববেদে মোহিনী মন্ত্রে প্রেম সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কথা বলে লেখা হয়েছে স্ত্রী বাড়ীর শোভা ৷ হিন্দু ধর্মে বিয়ে শুধু যৌন মিলনের জন্য নয় ৷ স্বামী -স্ত্রীর বন্ধন হল অন্যতম প্রধান সংস্কার ৷বিশুদ্ধিকরণের জন্য দশবিধ সংস্কার আছে তার শেষ সংস্কার বিবাহ ৷ কনেকে বরের হাতে সম্প্রদান করে বলা হয় তোমার ধর্মীয় কাজ আমার মেয়ের সাথে করো ৷ তাই , স্ত্রীকে বলে সহধর্মিনী ৷হিন্দু বিবাহের দুটি আচার বৈদিক ও লৌকিক ৷ বিভিন্ন ভাষাভাষী ও এলাকায় বিবাহের স্ত্রী বা লৌকিক আচারের তফাৎ থাকলেও বৈদিক আচার মন্ত্র , বরণডালা , গাঁটছড়া বাঁধা , সিঁদুর বা মঙ্গল সূত্র , মালা দান , সাত পাক ঘোরা (সপ্তপদী) , অগ্নি সাক্ষীর মত একতা দেখা যায় ৷আইবুড়ো ভাত , দধিমঙ্গল , অধিবাস , নান্দীমুখ , ঘট ডোবানো , গায়ে হলুদ ,বর বরণ , বধুবরণ ,ছাদনা তলা , সম্প্রদান , শয্যাতুলুনি ,বাসর জাগা , বাসি বিয়ে , কনে বিদায় , কুশন্ডিকা ,পাণিগ্রহণ , ধৃতিহোম , লাজহোম ,কালরাত্রি , ফুল শয্যা , বউভাত প্রভৃতি আচারে বিভিন্নতা দেখা যায় ৷ স্বামী -স্ত্রীর বন্ধন আমৃত্যু থাকার এমনকি জন্ম জন্মান্তরের বন্ধনের কথাও বলা হয় ৷ অবশ্য বিচ্ছেদের কিছু কারণও বলা আছে ৷বিয়ের মাধ্যমে হিন্দু নারীর গোত্রান্তর ঘটে ৷ পিতৃকুলের বদলে স্বামীকুলের গোত্র গ্রহণ করে ৷এভাবে দুটি ভিন্ন মানুষ অভিন্ন হয়ে নিজেদের বংশ এগিয়ে নিয়ে যায় ৷হিন্দু বিয়ে প্রাচীন আটটি ধারা রয়েছে ৷ ব্রাহ্ম , প্রজাপত্য , আর্য্য , দৈব্য , গান্ধর্ব্য , অসুর , রাক্ষস ও পৈশাচ ৷
যদিও ব্রাহ্ম্য ধারাটিই সাধারনে হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য ৷প্রথম চাররকম বিয়ে হয় বিভিন্ন মন্ত্রে ৷ গরিব বৈষ্ণবদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিকৃতির সামনে কন্ঠি বদল করে বিয়েরও চল আছে ৷ঋক , সাম ও যজুঃ বেদ অনুসারে হিন্দু বিয়ের নিয়মে কিছু পার্থক্য দেখা যায় ৷
অগ্নিকুন্ড সাক্ষী রেখে সাত পাকের প্রথম পাকে স্বামী তাঁর স্ত্রী ও তাদের ভাবী সন্তানের দায়িত্ব বহনের এবং স্ত্রী তার পরিবারের দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দেন ৷ দ্বিতীয় পাকে উভয়ে যেকোন পরিস্থিতিতে অন্যের পাশে থাকবে , তৃতীয় পাকে দুজনেই সংসার প্রতিপালন ও রক্ষার জন্য অর্থ উপার্জনের ,চতুর্থে বর সব দায়িত্ব বৌয়ের হাতে তুলে দেওয়ার , পঞ্চম পাকে উভয়ে একত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার , ষষ্ঠ পাকে একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার ও সত্য কথা বলার এবং সপ্তম বা শেষ পাকে সারাজীবন বন্ধু হয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন ৷
এখন বিদ্যালয়ে যৌনশিক্ষার প্রচলন হয়েছে ৷ বড়দের , বন্ধুদের , বৌদি , জামাই বাবুর কাছে , আমাদের মত চিকিৎসক ও মনোবিদের কাছে আসে এবং নানা জায়গায় বিয়ের আগে যৌনশিক্ষা লাভ হয় ৷ বৈদিক যুগেও যৌন শিক্ষার বিষয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা জানতে পারি ৷কুমারী ঘোষা চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদের কাছে গিয়েছিলেন ," জনিষ্ট ঘোষা পতয়ৎ কনীনকো বি চারু হন্বীরু বৌ দংসনা অনু ৷ অস্মৈ বীয়ন্তে নিবনের সিন্ধোবোহস্মা অহ্নে ভবতি তৎপতিত্বনম্ "( ঋকবেদ -১০/৪০/৯০) ৷
আমাদের সনাতনীরা বিয়ের সময় ছান্দগ্য ব্রাহ্মণের মন্ত্রটি বলি ," আমার হৃদয় তোমার হোক , তোমার হৃদয় হোক আমার ৷ আমি আমাকে তোমায় দিলাম , তোমার তোমাকে আমার করলাম "৷ এই সুন্দর পবিত্র মন্ত্রটি সংস্কৃতে বলি ,"যদ্যেত হৃদয়ং তব , তদস্তু হৃদয়ং মম ৷
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব "!
( আজ আমার বড় ভাগ্নির বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে লেখাটি দিলাম ৷ আমার "সনাতনী কৃষ্টিকথা " বইতে হিন্দুর বিভিন্ন আচার পার্বণ ও ধর্মীয় বিষয় তুলে ধরেছি ৷ আশাকরি আপনারা বইটি পড়বেন ৷ বইটি পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে আনন্দিত হবো ৷)
॰॰॰॰॰॰॰ ডাঃদীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷
৯৭৩২২১৭৪৮৯

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন