পাকিস্থানের প্রাথমিক ইতিহাস
শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডূ
পাকিস্তানের মাদারে মিল্লাত ফাতেমা জিন্নার শেষ পরিনতিঃ আইয়ুবের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ফাতেমা জিন্নাকে হত্যার অভিযোগে মামলা
বোন ফাতেমা ছিলেন ভাই পাকিস্তানেরর জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নার সব কর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং সহায়তাকারী । স্ত্রী রতন বাই মারা যাওয়ার পর তার এক মাএ কন্যা সন্তান দিনাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেন ফুফু মিস ফাতেমা জিন্নাহ।দিনা পরবর্তীতে বাবা ও ফুফুকে ত্যাগ করে পার্সি ছেলেকে বিয়ে করে ঘর ছাড়েন।পাকিস্তান হাসিলের পর জিন্নাহ সাহেব রাজত্ব পেলে বোন ফাতেমা কয়েক মাস রাজকীয় সুবিধা ভোগ করেছিলেন তবে পুরো জীবদ্দশায় যা ভোগ করেছেন তার তুলনায় ওটা কয়েক মুহুর্তের মতো ।
এই লেখার মূল সূত্র করেছি মিস ফাতেমা জিন্নাহর নিজের লেখা বই MY BROTHER কে এবং তৎকালীন পাকিস্থানি পত্র পত্রিকা এবং আরো কিছু সূত্র কে সঙ্গে নিয়ে । সঙ্গত কারণে জান কি দুশমন ভারতের কোনো তথ্যসূত্র দেওয়া হয় নি ।
মিস ফাতেমা জিন্নাহকে ছবিতে যতটুকু দেখছি বা কিছু দুর্লভ ভিডিও দেখে যা বুঝতে পারছি তাতে তার গঠন একহারা এবং তার ভাই জিন্নাহর মতোই ছিল । তিনি ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দন্ত বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন(আজকের দিনে দাতের ডাক্তার এর প্রাথমিক স্নাতক ডিগ্রী) , ওটা খুব সম্ভবত কলকাতা মেডিকেল কলেজ হতে পারে যাই হোক এর উপর আর বিস্তারিত গেলাম না । অতপর ভাই জিন্নাহর সাথে রাজনৈতিক কর্মকান্ডেই তাকে দেখা যায় ।মহিলাদের অধিকার এবং নিজের এই দাতের ডাক্তার হওয়ার সুবাধে বিশেষ কাজ করার দায়িত্ব নিজেই পেয়েছিলেন বলে দেখতে পাই । ১৯৪০ এর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের কাজে বিশেষত মুসলমানদের আলাদা ভুখন্ডের দাবির কাজে তার স্বক্রিয় ভুমিকা দেখতে পাই । পরবর্তিতে মানে ১৯৪৬ এ তৎকালীন অবিভক্ত পাঞ্জাবে নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার পর (অবিভক্ত বাংলা আর পাঞ্জাব ছাড়া অন্য কোথাও জিন্নাহ সুবিধা করতে পারেন নি) সর্বপ্রথম মুসলিম লীগ হয়ে উঠলো পাকিস্থান সৃষ্টির আন্দোলনের প্রধান রাজনৈতিক মুখ । এরপর সেই অনন্ত শোকের দেশ ভাগ এবং জিন্নাহর ১৩ মাসের রাজত্ব লাভের পর তার জীবনের বাকি ২০ বছর হয়ে ওঠে অভিশাপ ।পাঠক আমি এই অভিশাপ কে তার জীবনের দুর্বহ পরিস্থিতি বা যে যন্ত্রনা পেয়েছেন ওটা বলতে বলেছি ,আবার কেউ ওটা কোনো ঐশী কিছু ভাববেন না !
: (মিস ফাতেমা জিন্নাহর বই এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র থেকে )
জিন্নাহ পাকিস্থান হওয়ার পর বছর খানেকের বেশি কিছু বেচে ছিলেন ,ওই সুখকর সময়ের মধ্যেই অশনি সংকেত দেখতে শুরু করেন ফাতেমা । তার লেখা বিতর্কিত বই থেকে দেখতে পাই তিনি অভিযোগ করেছেন পাকিস্থানের প্রথম প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত এবং বাকিদের উপর । তার ভাষ্য অনুযায়ী, তার ভাই জিন্নাহ তাকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন যে, এই লিয়াকত আর বাকিরা তাকে দেখতে আসে না ,আসে তার মৃত্যু হতে আর কত দেরী ওটা দেখতে । প্রসঙ্গত পাকিস্থান হওয়ার কিছু আগে থেকেই এবং তার পরে জিন্নাহ আর বাকিরা জেনে যান যে তার দুরারোগ্য (সে সময়ে প্রাণঘাতী ) টিবি রোগ হয়েছে ।
জিন্নাহ নিজের তৈরী দানব এর সমন্ধে জেনেছিলেন একদম পাকিস্থান তৈরির পরপর । সে ঐতিহাসিক অগাস্ট ১১ তারিখের উদার মুসলিম দেশের যে ধারণা দিয়ে ভাষন দিয়েছিল ওটা তার দলের ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী এবং অন্যরা সম্পাদনা করেছিল সুবিধামতো অংশটুকু রেখে । প্রসঙ্গত আজো জিন্নার পুরো ভাষন যা ধারণ করা হলেও ওটা উদ্ধার করতে পারে নি ।পরে নিতে হয়েছে ভারতীয় রেডিও বিভাগ থেকে । জাতির জনকের প্রতি কি অসামান্য কৃতজ্ঞতা !
এরপর জিন্নাহ তার সুসময়ের সঙ্গীদের সম্যক পরিচয় পেলেও আর তখন কিছু করার ছিল না ।বোতলের দৈত্য তখন তার কাজ শুরু করে দিয়েছে । ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য নিয়ে বালুচিস্থান থেকে ফেরার সময় অসুস্থ এবং মৃতপ্রায় হয়ে গেলে পথে পরে থাকে বেশ কিছু ঘন্টা দুঃসহ গরমে ।একটি এম্বুলেন্স ও পাঠাতে অনেক সময় নেওয়া হয় ইচ্ছাকৃত ভাবেই । এরপর মৃতপ্রায় জিন্নাহ কে হাসপাতালে আনা হয় এবং মারা যায় সেপ্টেম্বর ১১,১৯৪৮ এ । চরম অবহেলা পেয়ে নিজের ভুল বোঝার শিক্ষা আর বাস্তবে কাজে লাগানোর সময় পান নি এই লোকটি ।
এরপর মিস ফাতেমার নরক যন্ত্রনা শুরু, তার ভাই মারা যাওয়ার পর তাকে রেডিও বা অন্য মিডিয়াতে বলতে দেওয়া হয় নি , শেষে ১৯৫১ তে পাকিস্থান রেডিও তে জিন্নাহর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে যাও অনুমতি দেওয়া হয় কিন্তু তার ভাষনে যখন জিন্নাহর মৃত্যুর আগের অবহেলা এবং এই সম্পর্কিত নিন্দা বলতে দেখে তার ভাষন বন্ধ করে দেয় তৎকালীন পাকিস্থানের সামরিক আর বেসামরিক ক্ষমতাভোগী মানুষেরা । উহু,আমি বলছি না ,বলছে আরো একটি বই যার লেখক খালিদ আহমেদ তৎকালীন রেডিও পাকিস্থানের প্রধান শরিফুদ্দিন পীরজাদা কে সূত্র করে এই কথা বলছেন আর এর একই প্রতিধ্বনি করছে আরো কিছু তথ্যসূত্র যা নিচে দিয়েছি ।
এরপর ফাতেমার অন্তরালে চলে যাওয়া আর তারপর বছর আটেক বাদে লেখেন এই আলোচিত বই যা প্রকাশের অধিকার পায় নি বহু বছর ।অবশেষে ১৯৮৭ তে যখন মুক্তি পায় তখন তার অনেক গুলো পাতা প্রকাশ হয় নি ।কারন ? সেই পুরনো খেলা । মূল ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের স্বরূপ প্রকাশ হয়ে যাচ্ছিল যে ! একই ভাবে আজকের র আর আইএসএই এর প্রধানদের লেখা বই ও একই কারণে ঝামেলা তৈরী করেছে ।ভাবুন,এই বইটি মিস ফাতেমা জিন্নাহ লিখেছিলেন ১৯৫৫ সালে আর প্রকাশ হয় ৩২ বছর পরে ! ততদিনে আর ফাতেমা জিন্নাহ পৃথিবীতে নেই । এই বই ব্যান করার জন্য সামনের প্রতিষ্ঠান কে ছিল ? আরো হাস্যকর এই ইতিহাস, ওটা ছিল কায়েদ এ আজম বিশ্ববিদ্যালয় । ভাবুন, ইতিহাসের এবং ভাগ্যের কি পরিহাস !কারন কি ছিল ? কারন ছিল সেই সময়ে প্রধান মন্ত্রী এবং জিন্নাহ ঘনিষ্ঠ লিয়াকত আলী সমন্ধে তার ওই বই এ এদের কার্যকলাপ মানে জিন্নাহর মৃত্যুর জন্য তাদের অপেক্ষা ইত্যাদি কথা আছে ওটা পাকিস্থান তৈরীর ভাবমূর্তির সাথে ঠিক যায় না অতএব .....
১৯৫৮ থেকে আয়ুব খান ক্ষমতায় এবং আমেরিকা আর পশ্চিমার চোখে আদরের সম্পদ । মজার বিষয় হলো আয়ুব খান যখন ইস্কান্দার মির্জা কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে তখন ফাতেমা ওই ঘটনা কে স্বাগত জানায় ! পরবর্তিতে এই আয়ুব তাকে আবার অন্তরালে পাঠাতে একটুও দেরী করেন নি । যাই হোক,আয়ুব আমেরিকার আশির্বাদ ধন্য হয়ে ঠিক করেছিল এক অতুল কীর্তি স্থাপন করবে আর ওটা করার জন্য একটাই রাস্তা, তা হলো কাশ্মির ! এরজন্য একটি সহি জিহাদ আর তারপর স্বপ্ন ভঙ্গ এবং অর্থনীতির স্বরূপ প্রকাশ । আয়ুব খান বাধ্য হয়ে ১৯৫৮ থেকে আরোপ করা মার্শাল ল তুলে এক অদ্ভুত নির্বাচনের ঘোষনা করে মানে যোগ্য নির্বাচকের এক নির্দিস্ট জনগনের দ্বারা ক্ষমতার নির্ধারনের খেলা খেলে ।
এই সময়ে ভুট্টোর প্রয়াসে তৎকালীন পাকিস্থানি বামপন্থী (হ্যা ,তারা ছিল তখনো আলোচনাতে )এবং ধর্মীয় শক্তি আর ডানপন্থী সব বিরোধী মিলে একটি মঞ্চ তৈরী করে যার নাম COP(combined opposition parties) আর সর্বসম্মতিক্রমে খাড়া করেন আয়ুবের বিপক্ষে প্রার্থী ।এই প্রার্থী হয় আমাদের আলোচ্য সেই ফাতেমা জিন্নাহ , মূলত ভুট্টোর চেষ্টায় অন্তরাল থেকে আবার প্রকাশ্যে আসেন ফাতেমা জিন্নাহ । এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, এই নির্বাচনে তাকে আয়ুবের বিরুদ্ধে খাড়া করতে মুখ্য ভুমিকা নিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের শেখ মুজিবুর রহমান,উত্তর পশ্চিম সীমান্তের খান আব্দুর গফ্ফর খান ,ওয়ালী খান প্রমুখ যারা পরবর্তিতে প্রত্যেকেই আজকের পাকিস্থানের কাছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত!
টাইম ম্যাগাজিনের কাগজে আয়ুব সরাসরি ফাতেমা জিন্নাহ কে ভারত এবং আমেরিকার এজেন্ট বলে ঘোষনা করেন। পাঠক খেয়াল করুন, একই অভিযোগ এইদিকেও পাবেন এবং এখনো শুনতে পাবেন! কি বিশ্বাস হচ্ছে না ? তা হলে সম্পর্কিত ছবি এবং সূত্র নিচে দিয়েছি দেখে নিন । দেশের মাতৃরুপের কি মহান সম্মান !
আয়ুব খানের ‘বিশেষ নাগরিকদের নির্বাচন ‘ প্যাচ কষে জয়লাভ সুনিশ্চিত ভেবে থাকলেও এবং সার্বিক রিগিং আর সন্ত্রাস চালালেও দেখা গেল ফাতেমা জিন্নাহ তাকে তৎকালীন পাকিস্থানের প্রধান দুই শহর করাচি আর ঢাকাতে পরাজিত করে ।এ ছাড়া সিন্ধ এর হায়দ্রাবাদ এ ও আয়ুব হারে আর কোনক্রমে জেতে পেশোয়ারে ।সার্বিক ভাবে অবশ্য এই স্বৈর শাসক জিতে যায় ক্ষমতার প্রয়োগে। অতপর এই নির্বাচন কে প্রহসন বলে আখ্যা দিয়ে বিরোধীরা এটি প্রত্যাখ্যান করে আর আন্দোলন চলতে থাকে । এই পর্যায়ে আবার ফাতেমা জিন্নাহ অন্তরালে চলে যায় ।
এই অন্তরালে চলে যাওয়ার এক বছর পরে ৭১ বছর বয়েসে জুলাই এর নয় তারিখে ১৯৬৭ সালে মারা যায় ফাতেমা জিন্নাহ । সরকারী ঘোষনা অনুযায়ী তার মৃত্যু হৃদরোগে হয়েছিল বলা হলেও গল্প ওতেই শেষ না !
ফাতেমা জিন্নাহর ভাতুস্পত্র আকবর পিরভাই ভারত থেকে আসেন এবং মৃতদেহ দেখে অভিযোগ করেন তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে । এই সংক্রান্ত একটি মামলাও করেন । ওটার সত্যতা আছে বলেই মনে করি কারন এই মামলা তৎকালীন হাইকোর্ট নিতে স্বীকার করে এবং যা দেখছি তাতে তার শরীরে এবং পেটে ক্ষত ছিল আর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বলে বলা হয়েছে । এই মামলা করতেও সেই শত্রু ভারতের নাগরিকের দরকার হলো !আর মামলা শুরু হলো ১৯৭২ এ তবে আজো শেষ হয় নি,কেন ? ওটা জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই !
মজার জিনিস দেখুন, সেই ‘অসহিষ্ণু ‘ ভারতের নাগরিক জিন্নাহর ভাতুস্পুত্র সাহস করে মামলা করতে অথচ ওই পবিত্র দেশের কেউ করে না । এই কথা কেন এইদিকের কোনো ‘ আলোকপ্রাপ্ত ‘ কেউ ভাবে না ? ওটাই বড় চিন্তার তাই না ?
এতেই শেষ না, ফাতেমার অন্তেষ্টি নিয়েও চলে প্রচুর ঝামেলা ।তার নামাজে জানাজা পড়ানো হয় দুই জায়গায়,একবার রাইসগাও আর একবার পোলো গ্রাউন্ড,কারন ? সেই শিয়া এবং সুন্নি নিয়ে বিভাজন । ফাতেমা শিয়া ছিলো যে !
এরপর এই গোপন করা নিয়ে বিক্ষোভ এবং এতে রাস্তায় আগুন,মানুষের উপর গুলি বর্ষন আর বেশ কিছু মৃত্যু হয় । তৎকালীন সরকার তাকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী জিন্নাহর কবরের পাশে কবর দিতে রাজি না হয়ে মেওয়াশাহ বলে অন্যত্র কবর দিতে চায় । যাই হোক শেষ পর্যন্ত তার কবর জিন্নাহর পাশে হয় আর আরো পরিহাস হলো তার আজীবন শত্রু লিয়াকত এর দেহ ও কবরে আছে ওই একই করাচির কবরস্থানেই ! Ajijul Shahji.
তথ্যসূত্র :
১. টাইম এর ভারতের এজেন্ট হওয়ার অভিযোগের সূত্র : http://content.time.com/…/mag…/article/0,9171,830952,00.html
২. ফতেমার মৃত্যু এবং সেই সময়ের আরো কিছু বিবরনhttps://en.dailypakistan.com.pk/…/miss-jinnah-the-forgotte…/
৩. তাকে ভারতের এজেন্ট ইত্যাদি বলার উপর আরো কিছু সূত্রhttps://dailytimes.com.pk/1226…/remembering-fatima-jinnah-2/
৪. জিন্নাহর মৃত্যু পরবর্তী রেডিও ভাষন না দিতে দেওয়ার সূত্রhttps://www.dawn.com/news/1159181
৫. নিষিদ্ধ পাতার সূত্র https://www.dawn.com/…/the-deleted-bits-from-fatima-jinnahs…
৬. ফতেমার ওই ভাষন এর সেন্সর এর সূত্রhttps://www.dawn.com/news/1162928
৭. তার বইটির উড়িয়ে দেওয়া পাতার বিস্তারিত পাবেন এই সুত্রেhttps://www.dawn.com/…/the-deleted-bits-from-fatima-jinnahs…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন