প্রবচন- শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী গুরুমহারাজ
জড় জীবন ও আধ্যাত্মিক জীবন
প্রবচন- শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী গুরুমহারাজ
বিভিন্ন প্রকার জীবেদের মধ্যে রয়েছে পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ এবং এই
সমস্ত জীব সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে মানুষ সমাজ। যখন জীব মনুষ্য শরীর
প্রাপ্ত হয় তখন সে একটি মস্ত বড় সুযোগ লাভ করে। সেই সুযোগটি হচ্ছে সে তার
চেতনাকে বিকশিত করে ভগবানকে জানতে পারে যেটা আর কোন জীবরে মধ্যে সম্ভব নয়।
এই বিভিন্ন স্তরের জীবদের চেতনা অনুসারে তাদের বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করা
হয়েছে। কিছু জীবের চেতনা আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে। যেমন–গাছপালা।
সূর্যরূপ কৃষ্ণের কিরণ লাভ করলে, শ্রীগুরুদেব রূপ জলের আশ্রয়ে থাকলে এবং
সূর্যের কিরণ রূপ কৃষ্ণের করুণা বা কৃষ্ণের প্রতি উন্মুখ হলে তার সেই চেতনা
বিকশিত হতে পারে। তাই আমরা এখানে সহজেই দেখতে পাই যে, মানুষের চেতনা আর
পশুদের চেতনার মধ্যে পার্থক্য তখনই সধিত হয় যখন মানুষ ভগবানের দিকে উন্মুখ
হয়। তা না হলে মানুষ একটি পশু। বৈদিক শাস্ত্রে তাই বলা হয়েছে যে, যতক্ষণ
পর্যন্ত না মানুষ ভগবন্মুখী হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মানুষ বলে গণনা করা যায়
না, তাকে বলা হয় নরাধম। শরীরটি মানুষের ঠিকই কিন্তু তার চেতনাটি মানুষের
স্তরে আসেনি। নরের অধম অর্থাৎ নরের স্তর থেকে তারা অধম স্তরে রয়েছে। অতএব
মানুষকে তখনই মানুষ বলে গণনা করা যায়, যখন মানুষ ভগবন্মুখী হয়, কেননা তখনই
তার চেতনা বিকশিত হতে শুরু করে। তা না হলে মানুষও সেই সঙ্কুচিত স্তরে থেকে
যাবে। বৈদিক শাস্ত্রে বা বেদান্ত সূত্রে তাই বলা হয়েছে “অথাতো ব্রহ্ম
জিজ্ঞাসা” অর্থাৎ এখন যেহেতু তুমি মনুষ্য শরীর লাভ করেছ তাই তোমাকে ব্রহ্ম
সম্বন্ধে জানতে হবে, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব উপলব্ধি করতে হবে, ভগবানের সঙ্গে
তোমার নিত্যসম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে। এই বৈদিক সংস্কৃতিই হচ্ছে ভারতের
বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের পার্থক্যটি কোথায়? পৃথিবীতে তো
অনেক দেশ রয়েছে তার মধ্যে এই ভারত-ভূমিকে কেন পবিত্র ভূমি বা ধর্মক্ষেত্র
বলে বিবেচনা করা হচ্ছে? তার কারণ এই ভারতবর্ষে বৈদিক সংস্কৃতির অনুশীলন হয়,
এই ভারত-ভূমিতে যারা মনুষ্য জন্ম লাভ করে তারা ভগবদ্ তত্ত্ব জ্ঞান লাভের
একটি মস্ত বড় সুযোগ পায়। তাই এই ভারত-ভূমিকে এক বিশেষ পবিত্র ভূমি বলে
বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ভারত শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘ভা’ মানে যোগী আর ‘রত’
হচ্ছে যে স্থানের বা যে ভূমির মানুষেরা জ্ঞানের জ্যোতিতে রত সেই দেশটিকে
বলা হয় ভারতবর্ষ। জ্যোতি বলতে প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের আলোককেই বোঝানো হয়। এই
যে সাধারণ বৈদ্যুতিক অলো বা আগুনের আলো এটা ঠিক প্রকৃত আলোক নয়, প্রকৃত
আলোক হচ্ছে জ্ঞানের আলোক এবং এই যে বিশেষ স্থানটি এই স্থানের মানুষদের
জ্ঞানের আলোক রত থেকে সেই আলোকে উদ্ধাসিত হওয়াই কর্তব্য। কিন্ত দুর্ভাগ্য
বশত আজকের ভারতবাসীরা সেই কাজটি করছে না, তারা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ
করছে, তারা পাশ্চাত্যের আবর্জনাগুলি সংগ্রহ করছে। তার ফলে আজকের এই দেশের
যে কি অবস্থা হয়েছে তা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন।
জড়বাদ আর অধ্যাত্মবাদ দুটি বিপরীত ধর্মীয় বস্তু। জড়বাদের বাইরে চাকচিক্য
রয়েছে কিন্তু সেই বস্তুটি অন্তসারশূণ্য। জড়বাদের বাইরের চাকচিক্য দেখে
লালায়িত হয়ে মানুষ তার পেছনে সুখ ভোগের জন্য ছোটে, কিন্তু চরমে তারা দুঃখ
ছাড়া আর কিছু পায় না। আর অধ্যাত্মবাদ বা ধর্মের পথ অবলম্বন করলে, বা
ভগবানের শরণাগতির পথ অবলম্বন করলে প্রথম দিকে হয়তো একটু কষ্ট হয় কিন্তু তার
পরিণতিটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক। এখন আপনারা বিচার করুন কোন্ পথটি আপনারা
গ্রহণ করবেন? যার প্রথমে চাকচিক্য এবং সুখের ইঙ্গিত রয়েছে, হাতছানি রয়েছে,
কিন্তু চরমে সেটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটি রূপ নিয়ে আমাদের সর্বনাশ সাধন করে
সেই পথটি গ্রহণ করবেন? না যে পথটি গ্রহণ করলে আমাদের পরম কল্যাণ সাধিত হয়?
প্রাথমিক শুরু স্তরে সেই পথটি হয়তো একটু কঠিন, একটু কষ্টদায়ক বলে মনে হতে
পারে কিন্তু চরমে তা আমাদের নিত্য আনন্দ প্রদান করবে। সরল কথায় বলা যায় যে,
জড় সুখভোগের যে জীবন তা প্রথমে অমৃতের মতো বলে মনে হয় কিন্তু চরমে সেটি
বিষে পরিণত হয়। আর আধ্যত্মিক জীবনটি প্রথমে বিষবৎ মনে হতে পারে কিন্তু চরমে
তা আমাদের অমৃততত্ত্ব দান করে। এখন আমাদের বিবেচনা করতে হবে আমরা কোন্
পথটি গ্রহণ করব। দুর্ভাগ্যবশত আজকের জগতে যে শিক্ষাব্যবস্থা তাতে আধাত্মিক
জীবনের কোন রকম শিক্ষা নেই, তারা সমস্ত জড় বিষয় নিয়েই মেতে রয়েছে, জড় বিষয়
নিয়েই নানা রকমের শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে, জড় বিষয় নিয়েই নানা রকম গবেষণা
হচ্ছে। কিন্তু এই জড়ের অতীত জড়াতীত যে চিন্ময় জগৎ রয়েছে সেই জগতের কোন
আলোচনা বা শিক্ষা আজকে হচ্ছে না, এটি আমাদের চরম দুর্ভাগ্য।
ভারতবর্ষের মানুষেরা আজ আর জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হতে অনুপ্রাণিত হচ্চে
না, তারা অন্ধকারের গভীরতম প্রদেশে ঝাঁপ দিচ্ছে। তারই ফলে আজ কেবল
ভারতবর্ষেই নয় সারা পৃথিবীতে এই দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে, কারণ এই যে জ্ঞানের
আলোক সেই জ্ঞানের আলোক এই ভারতবর্ষই পৃথিবীকে দান করতে পারে। যেহেতু
ভারতবাসীরা সেই কর্তব্যটি সম্পাদন করছে না তাই আজ সারা পৃথিবী অজ্ঞানের
অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে।
তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সমস্ত ভারতবাসীদের বললেন–“ভারত-ভূমিতে হইল মনুষ্য
জন্ম যার, জন্ম সার্থক করি কর পরোপকর”। এই ভারত ভূমিতে যারা মনুষ্য জন্ম
লাভ করেছে এবং যারা করবে তারা যেন তাদের জন্ম সার্থক করে পরাপকার ধর্মটি
গ্রহণ করে। নিজের স্বার্থ চিন্তায় মগ্ন না থেকে কি করে অন্য সকলের মঙ্গল
হবে সেই উদ্দেশ্য সাধনে তারা যেন ব্রতী হয়। সেই পরোপকারের ধর্মটি কিরকম?
সেকথা বিশ্লেষণ করে মহাপ্রভু বললেন–“যারে দেখ তারে কহ কৃষ্ণ উপদেশ, আমার
আজ্ঞায় গুরু হইয়া তার’ এই দেশ।” তুমি যাকে দেখ, যার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ
হয়, যার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয় তাকে তুমি কৃষ্ণ উপদেশ দাও, কৃষ্ণ যে
উপদেশগুলি দিয়েছেন সেই উপদেশটি দাও, ভগবদ্গীতায় ভগবান যেকথা বলেছেন সে কথা
তাদের শোনাও, শ্রীমদ্ভাগবতে ভগবান সম্বন্ধে যে কথা বলা হয়েছে সেই কথাগুলি
তুমি তাদের শোনাও। এই দায়িত্বটি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রতিটি ভারতবাসীকে
দিয়ে গেছেন এবং ভারতবাসীরা যদি তাদের সেই কর্তব্যটি সম্পাদনে ব্রতী হন,
সচেষ্ট হন তাহলে কেবল ভারতবর্ষেরই নয় আজকের সারা পৃথিবীর এক আমূল পরিবর্তন
সাধিত হবে। দেহাত্মবুদ্ধিতে আচ্ছন্ন থেকে জীবন যাপন করলে চরমে কি লাভ হবে?
দেহটির মৃত্যু যখন হবে তখন এই দেহটিকে নিয়ে আমরা যা কিছু করেছিলাম তা সব
শেষ হয়ে যাবে।
এই সূত্রে আমার একটি ঘটনা বা একটি স্থানের কথা মনে পড়ে। ইটালিতে রোম শহরে
যেটি হচ্ছে খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের মূল পীঠস্থান ভ্যাটিকান। ঐটি রোমান
ক্যাথলিকদের মূল পীঠস্থান। সেখানে একটি গীর্জা আছে, আজ থেকে প্রায় চোদ্দ
পনেরোশ বছর আগে সেই গীর্জাটি স্থাপিত হয়েছিল। সেই গীর্জার যারা পুরোহিত বা
প্রিষ্ট তাদের মৃত্যুর পর দেহটি রেখে দেওয়া হয়। তাদের দেহ আমাদের মতো
পোড়ানো হয় না। আর এই সমস্ত পুরোহিত বা প্রিষ্টদের দেহাবশেষ অর্থাৎ
অস্থিগুলি সেখানে জমিয়ে রাখা হয়। তাহলে আপনারা ভেবে দেখুন হাজার হাজার
মানুষের অস্থি গত চোদ্দ/পনেরোশ বছর ধরে সঞ্চিত হয়েছে কত মানুষের অস্থি
সেখানে থাকতে পারে। আবার সেই সমস্ত অস্থি দিয়ে তারা নানা রকম নক্সা করেছে।
হাড়ের ফুল, হাড় দিয়ে নানা রকম সমস্ত সাজ সজ্জা করা হয়েছে। আর সেটা দেখে যখন
বেরোনো হয় বা বেরোবার মুখে একট কঙ্কাল রয়েছে অর্থাৎ মাথা, পাঁজর, হাত, পা
এই সমস্ত হাড়গুলি সমন্বিত একজন সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এবং তার পাশেই লেখা
রয়েছে–“তুমি আজ যা, একসময় আমি তা ছিলাম, আর আমি এখন যা একদিন তুমি তাতে
পরিণত হবে।” একদিন আমরা সকলেই একটি কঙ্কালে পরিণত হব। আমাদের দেহের চরম
পরিণতি তাই, একদিন সব শেষ হয়ে যাবে।
এই যে চামড়া, মাংস, মেদ যেগুলিকে আমরা দেহের সৌন্দর্য বলে মনে করছি, যাকে
আমি আমার দেহ বলে মনে করছি, যাকে আমরা স্বরূপ বলে মনে করছি মৃত্যুর পর
সেগুলি সব হয় পচে গলে যাবে, তা নয়তো ক্রিমি কীটেরা খাবে, শকুনি কুকুরের
ভক্ষণ হবে, আর যদি আগুনে পোড়ানো হয় তাহলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেগুলি ভস্মে
পরিণত হবে। এখন এই যে অনিত্য দেহটি। এই দেহটা নিয়ে ব্যস্ত থাকাটা কি
বুদ্ধিমানের কাজ? না। কিন্তু জড়বাদে এই দেহটি সব, এই দেহের ভিতরে যে একটি
আত্মা রয়েছে এবং সেই আত্মার উপস্থিতির ফলে যে এই দেহটি সজীব রয়েছে সে কথা
তারা বিচার করে না, করতে পারে না। এখন পাশ্চাত্যের সভ্যতা হচ্ছে সেই সভ্যতা
যেখানে আত্মার স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, কেবল দেহ সর্বস্ব জীবন যাপন। কিন্তু
আমাদের দেশে সকলেই জানে যে, আত্মাই হচ্ছে আমাদের স্বরূপ এবং দেহটি হচ্ছে
সেই আত্মার একটি আবরণ। এই যে আমি আছি, আমি বেঁচে আছি, এই আমিত্ব বোধটি কোথা
থেকে আসছে? আত্মা থেকে আসছে, চেতনা থেকে আসছে। চেতনা আসছে কোথা থেকে?
চেতনা আসছে আত্মা থেকে। যেহেতু চেতনাটি দেহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তাই
আমরা দেহটি সম্বন্ধে সচেতন এবং দেহটিকে আমার স্বরূপ বলে মনে করছি। কিন্তু
যখন আমরা ঘুমিয়ে পড়ি তখন আমার দেহে চেতনা থাকে না, কিন্তু আমি থাকি। ঘুমিয়ে
যখন স্বপ্ন দেখি তখন কে দেখে? মন বুদ্ধি অহংকার দিয়ে গঠিত সূক্ষ্ম শরীর,
সেই সূক্ষ্ম শরীরে আমরা স্বপ্ন দেখি। আর এই জড় শরীরটি সম্বন্ধে বলা হয়েছে
একটি স্থুল শরীর। মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ এই পাঁচটি স্থুল পদার্থ দিয়ে
এই স্থুল শরীরটি গঠিত হয়েছে। এখন আমাদের এই স্থুল এবং সূক্ষ্ম শরীরের
উর্ধ্বে যে আত্মা সেই আত্মা থেকেই চেতনা আসছে এবং সেই আত্মাই হচ্ছে আমার
আমি। এই আত্মাকে জানার জন্য যে চেষ্টা সেই চেষ্টাকে বলা হচ্ছে আধ্যাত্মিক
অনুশীলন বা অধ্যাত্ম চেতনা। আধি আত্মিক অর্থাৎ আত্মার সম্বন্ধীয় যে চেতনা
সেটি হচ্ছে অধ্যাত্ম জ্ঞান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন