মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

নখের কিছু সমস্যা


নখের কিছু সমস্যা
শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডু


প্রণব কুমার কুণ্ডু






নখের যত্ন কতটা জরুরি

নখের বিভিন্ন অসুখের বিষয়ে জানার আগে নখের গঠন সম্বন্ধে জেনে নিলে বুঝতে সুবিধে হবে। আমাদের নখ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। সবাই নখ বলতে যে শক্ত জিনিসটাকে চিনি, সেটার নাম নেল প্লেট। এই নেল প্লেটের তলায়, অর্থাৎ নখ উঠে গেলে যে অংশটা দেখা যায়, তাকে বলে নেল বেড। নখের সামনের দিকের অংশ, যেটা ব্যবহার করে আমরা চুলকাই, তার নাম ফ্রি মার্জিন। নখের পিছনে চামড়ার সঙ্গে জুড়ে থাকা অংশের কিছুটা জায়গা ভাঁজ হয়ে থাকে। একে বলে কিউটিক্যাল। বুড়ো আঙুলে এই কিউটিক্যালের জায়গায় নেল প্লেটের ওপর একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি সাদা-ফ্যাকাসে দাগ দেখতে পাওয়া যায়। এর নাম লিনিউলা। বুড়ো আঙুল ছাড়াও অনেকের অন্যান্য আঙুলেও লিনিউলা দেখা যায়।
নখের তলায় রয়েছে অসংখ্য অত্যন্ত সংবেদনশীল স্নায়ু। প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টিতে ওই স্নায়ুগুলি নখের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। ওই স্নায়ুগুলি খোলা অবস্থায় থাকলে ছোটখাট ধাক্কাতেও প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড় হতো! সেক্ষেত্রে সাধারণ কোনও কাজ করাও সম্ভব হতো না। শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘থার্ড ডিগ্রি টরচারে’ ওই জায়গায় সুচ ফুটিয়ে দেওয়ার কথাও শোনা যায়। এবার শরীরের এমন গুরুত্বপূর্ণ অংশের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধান সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক—
 নখের ফাঙ্গাল ইনফেকশন— এই সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত নাম অনিকোমাইকোসিস বা টিনিয়া আঙ্গুয়াম। ফাঙ্গাল ইনফেকশনে সাধারণত নখের ফ্রি মার্জিন জায়গাটি ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। দৈর্ঘ্যে নখটা একটু ছোট হয়ে পিছনের দিকে সরে আসে। বেশি জল ঘাঁটাঘাঁটি করলে এই সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এছাড়া ক্যান্সার, এইচআইভি বা অন্য কোনও জটিল রোগের ওষুধের কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেও এই রোগ হতে পারে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জায়গায় লাগানোর ওষুধের পাশাপাশি খাওয়ার ওষুধও দেওয়া হয়।
 নখকুনি— এটাও এক ধরনের ফাঙ্গাল ইনফেকশন। এই রোগের পিছনে রয়েছে ক্যানডিডা নামের ফাঙ্গাস। এই রোগের বিজ্ঞানসম্মত নাম হল প্যারোনিকিয়া। এক্ষেত্রে নখের পিছনের কিউটিক্যাল অংশটি লাল হয়ে ফুলে যায়, পুঁজ জমে, ব্যথা হয়। ধোপার কাজ করেন, সারাদিন জল ঘাটাঘাটি করেন, ডায়াবেটিস রয়েছে— এমন মানুষের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এই সমস্যার মূল দু’টি ধরন রয়েছে। প্রথমটি অ্যাকিউট, দ্বিতীয়টি ক্রনিক। অ্যাকিউট সমস্যায় জায়গাটি লাল হয়ে ফুলে গিয়ে, পুঁজ জমে, ভীষণ ব্যথা হয়। এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও থাকে। তাই অ্যাকিউট সমস্যায় লাগানোর ওষুধের পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিকও দিতে হয়।
ক্রনিক রোগে ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন থাকে না। জায়গাটা ফুলে থাকে, ব্যথা সামান্য কম হয়। এক্ষেত্রে অ্যান্টি ফাঙ্গাল জাতীয় ওষুধ দিতে হয়। বারংবার নখকুনির সমস্যা দেখা দিলে একবার অবশ্যই ডায়াবেটিস নির্ণয় পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার। সেই টেস্টের রিপোর্টে রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি আসলে ডায়াবেটিসের চিকিৎসাও করতে হবে।
 ইনগ্রোয়িং টো নেল— অনেকেরই পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ বাঁকা থাকে। এমন সমস্যা আঁটসাট জুতো ব্যবহারের কারণে হয়। আবার পায়ের নখের দু’ধার সঠিকভাবে গোল করে না কাটার জন্যও এই সমস্যা হতে পারে। এক্ষেত্রে নখের দুই ধার কেটে একদম মাংসের মধ্যে ঢুকে যায়। খুব ব্যথা হয়। প্রায় হাঁটা-চলা করাই যায় না। এই রোগের চিকিৎসায় সার্জারির মাধ্যমে মাংসের ভিতরে থাকা নখ কেটে বাদ দিতে হয়।
 ভঙ্গুর নখ— দীর্ঘসময় ডিটারজেন্ট দিয়ে কাজ, ঘন ঘন নেল পলিশ ও নেল পলিশ রিমুভার ব্যবহার, থাইরয়েডের কিছু অসুখ ইত্যাদি কারণে নখ ভীষণ ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। চট করে ভেঙে যায়। এই সমস্যা সমাধানে প্রথমে রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে হয়। তারপর অবশ্যই সেই কারণটির সমাধান করতে হবে। পাশাপাশি কিছু নখের ওষুধও দেওয়া হয়।
 ত্বকের রোগ থেকে— ত্বকের রোগ একজিমায় আক্রান্ত অনেকেরই নখ এবড়ো খেবড়ো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে একজিমা রোগের মূল চিকিৎসা চলার পাশাপাশি নখে লাগানোরও কিছু ওষুধ দেওয়া হয়।
অনেক সোরিয়াসিস আক্রান্ত রোগীর নখের মধ্যে ছোট ছোট গর্ত তৈরি হয়। দেখলে মনে হবে, কেউ যেন নখের মধ্যে ছোটছোট আলপিন দিয়ে ফুটো করে দিয়েছে। এই রোগের ক্ষেত্রেও একজন ত্বক বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়।
 নখ দিয়ে যায় অন্য রোগ চেনা— প্রায়ই আমরা নখদর্পণ কথাটি বলে থাকি। এই কথাটির ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকেই হয়ে আসছে। বল হয়, প্রাচীন কালের মুনি-ঋষিরা নাকি কোনও ব্যক্তির নখ দেখেই তাঁর ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন। ব্যক্তির ভবিষ্যৎ জেনে যাওয়ার বিষয়টি বিজ্ঞানের ভাষায় অত্যুক্তি হলেও, এই কথাটি একদমই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নখ দেখে চিকিৎসকরা বেশ কিছু অসুখ সম্বন্ধে অনায়াসে অনুমান করে নিতে পারেন।
ফুসফুসে ক্যান্সার, হার্টের কিছু অসুখ বা অন্য কোনও ক্রনিক অসুখ থেকে নখের সমস্যা হতে পারে। আসলে প্রত্যেকটি মানুষের নখের পাশ থেকে তাকালে নেল প্লেট ও চামড়ার মধ্যে একটি কোণ লক্ষ করা যাবে। এই কোণটি ১২০ থেকে ১৩০ ডিগ্রির মতো। এক্ষেত্রে সেই কোণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই নির্দিষ্ট জায়গাটি ফুলে ড্রাম স্টিকের মতো দেখায়। এই সমস্যাকে ক্লাবিং বলে। আবার শরীরে মারাত্মক রক্তাল্পতা থাকলে বা জন্মগতভাবে অনেকের নখ চামচের মতো দেখতে হয়ে যায়। এই সমস্যার নাম কয়েলোনিকিয়া। অপরদিকে জন্ডিস রোগে নখের রং হলুদ হয়ে যায়। এটাও একটা রোগলক্ষণ।
কোনও ব্যক্তি এরকম কোনও সমস্যা নিয়ে ত্বক বিশেষজ্ঞের কাছে আসলেই তিনি রোগীকে সোজাসুজি নির্দিষ্ট চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই অবস্থায় মূল অসুখটির সঠিক চিকিৎসা হলেই নখের সমস্যা সাধারণত কমে যায়।
 নেল পলিশ ও বিভিন্ন সমস্যা— নখের সৌন্দর্য বাড়াতে নেল পলিশের ব্যবহার ক্রমে বেড়েই চলেছে। হালফিলের ফ্যাশানে সেই সঙ্গে জুড়েছে ‘নেল-আর্ট’ ট্রেন্ড। নখের মধ্যে বিভিন্ন রঙের নেল পলিশের সাহায্যে তৈরি হচ্ছে অসাধারণ সব নক্সা। তবে নেল পলিশের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি নখের সমস্যায় আক্রান্তের সংখ্যাও কিছুটা বেড়েছে। নেল পলিশ থেকে সাধারণত নখের দুই ধরনের সমস্যা হয়— ভঙ্গুর নখ এবং কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস। ভঙ্গুর নখের কথা আগেই বলা হয়েছে, এবার কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক। আসলে অনেকের নেল পলিশের বিভিন্ন উপাদানে অ্যালার্জি থাকে। এটা নেল পলিশের রঙ এবং গন্ধ থেকেও হতে পারে। এই অ্যালার্জির বিষয়টি আগে থেকে জানা যায় না। এই সমস্যা সস্তা বা দামি ব্র্যান্ডের ওপর নির্ভর করে না। যে যেই উপাদানে অ্যালার্জিক, সেই উপাদানটি সস্তা বা দামি যে কোনও নেল পলিশে থাকলেই অ্যালার্জি হবে। অনেক সময় কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিসের অদ্ভুত এক সমস্যা নিয়ে মানুষ ত্বক বিশেষজ্ঞের কাছে আসেন। এক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি একদমই ছোট মেয়ে অনবরত চোখ চুলকাচ্ছে। তখন চিকিৎসক বাচ্চার অভিভাবককে জিজ্ঞেস করেন, মেয়েকে নেল পলিশ লাগান কি? শতকরা ৯০ ভাগ সময়ই অভিভাবকের উত্তর থাকে, হ্যাঁ লাগানো হয়। এটাও একধরনের কনট্যান্ট ডার্মাটাইটিস। এই সমস্যায় বাচ্চা নেল পলিশ লাগানো নখ দিয়ে চোখ চুলকে ফেলে। বাচ্চার চোখের পাতায় সেই থেকে অ্যালার্জি দেখা দেয়। বাচ্চা ক্রমাগত চোখ চুলকাতে থাকে। এই সমস্যা সমাধানে চিকিৎসা চলার পাশাপাশি নেল পলিশ ব্যবহারও ছাড়তে হয়।
 নখের যত্নে— জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নখ বাড়তে থাকে। ঠিক তেমনই অনেক শিশুর জন্ম মুহূর্তেই নখ বড় অবস্থায় দেখা যায়। তাই নখের যত্নে একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে। প্রথমত, নখ বড় হলে কেটে ফেলাই মঙ্গল। কোনও কারণে আচমকা বড় নখ ভেঙে গেলে রক্তারক্তি পর্যন্ত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত নখ পরিষ্কার করুন। নখের নীচে ময়লা জমলে দেখতে যেমন খারাপ লাগবে, ঠিক তেমনই খাওয়ার সময় সেই ময়লা শরীরের ভিতরে গিয়ে নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া নখের নীচে স্কেবিস বা চুলকানির জীবাণু বাসা বেঁধে অসুখটি সারাতেও সমস্যা করে। তৃতীয়ত, নেল পলিশ ও নেল পলিশ রিমুভার ব্যবহার করুন সাবধানে। প্রতিদিন এগুলি ব্যবহার করলে সমস্যা দেখা দিতেই পারে। চতুর্থত, বেশি জল ঘাঁটাঘাঁটি, ডিটারজেন্টের ব্যবহার থেকে নখের সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। তাই এসব কাজকর্মে একটু রাশ টানাই ভালো। পঞ্চমত, নখের রঙে বা গঠনে কোনও পরিবর্তন দেখলে সতর্ক হয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। এটা কোনও সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। এছাড়া নখের ইনফেশনকে বেশিরভাগ মানুষই গুরুত্ব দেন না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়। কারণ, নখের ইনফেকশন যে কোনও সময় মারাত্মক আকার নিতে পারে। তাই সমস্যা বাড়লে প্রথমেই সচেতন হয়ে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

লিখেছেন সায়ন নস্কর।

বর্তমান ২৯/১১/২০১৮  থেকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন