রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

#বঙ্গভাগের_সিলেটি_ইতিহাস


#বঙ্গভাগের_সিলেটি_ইতিহাস
ফেসবুক থেকে      শেয়ার করেছেন     প্রণব কুমার কুণ্ডু






সিলেট বা শ্রীহট্ট ছিল বাংলাভাষী কিন্তু আসামের অন্তর্গত। এই জেলার মানুষের কিছু সমাজতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ছিল এখানকার হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ ব্রিটেনে চলে গিয়েছিল । লন্ডনের কেনেরি হার্ফ এবং ব্রিক লেন অঞ্চল এদেরই অধ্যুষিত।
সিলেটে এদেরকে লন্ডনী বলা হত। বিদেশের সঙ্গে সংযোগ থাকার ফলে বা অন্য যে কোন কারণেই হোক সিলেটের মুসলিমরা কিছুটা আলাদা ছিল । সিলেটের হিন্দুরা শিক্ষায়-দীক্ষায় আরও অত্যন্ত অগ্রসর ছিল। সে সময় আসাম প্রদেশ কে তিন ভাগে ভাগ করা হতো ।

1. ব্রহ্মপুত্র বা আসাম উপত্যকা
2. পার্বত্য অঞ্চল
3.সুরমা উপত্যকা ।
সুরমা অঞ্চল বলতে প্রধানত কাছাড় ও সিলেট জেলা কে বোঝানো হতো । ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার তীরে প্রচুর খালি জমি পড়েছিল, প্রচুর অরণ্য সম্পদ ছিল ,খনিজ তেলও ছিল । ফলে এই উপত্যকায় অধিবাসীরা যাদের মধ্যে প্রধান বর্ণহিন্দু , অসমীয়া অহম, এবং গরিয়া মুসলিম সকলেই অসমীয়া ভাষী এবং এরা কেউ অঞ্চলের বাইরে যেতে উদ্যোগী হন নি । অপরপক্ষে জনসংখ্যার চাপে সিলেটি বাংলা ভাষী হিন্দুরা সুরমা উপত্যকার ছেড়ে চলে আসে এই উত্তরে।
সরকারি চাকরির বেশ খানিকটা অংশ এটা অধিকার করেছিল ।শিলং শহর জুড়ে এক সময় এই বাঙ্গালীদের আধিপত্য ছিল এবং এখনও শিলং এ প্রচুর সিলেটি হিন্দু বাস করে থাকেন ।অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল যেমন , গারো পাহাড় যা বর্তমানে মেঘালয় নামে পরিচিত , লুসাই পাহাড় যা বর্তমানে মিজোরাম নামে পরিচিত ও নাগা পাহাড় বা তুয়েনসাং যা বর্তমানে নাগাল্যান্ড নামে পরিচিত । সেই সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বহু সিলেটি হিন্দু বাস করতেন।
সুরমা উপত্যকার মানুষ এভাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আসার ফলে এই দুই শ্রেণীর মধ্যে মতান্তরে সৃষ্টি হয়েছিল ।এদের সঙ্গে সব থেকে বড় বিষয় ছিল ভাষায় প্রভেদ। অসমীয়া ও বাংলা ভাষা মোটামুটি একই লিপিতে লিখিত হলেও উচ্চারণ ও শব্দ সম্ভারের অনেকটাই আলাদা । এই মন অন্তর অনেক পরে সাময়িকভাবে উগ্র রূপ ধারণ করেছিল ।
আসামের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে অসমীয়া ভাষিদেরি প্রধান প্রাধান্য ছিল এবং এদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদৈল। বাংলাভাষী সিলেট থেকে এক সময় বিপিনচন্দ্র পালের মতো নেতারা উঠে এসেছিলেন।
পরবর্তীকালে বরদলৈ এর মাপের কোনো নেতা তৈরি হননি ।বাংলাভাষী নেতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন বসন্ত দাস, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ।
সিলেট আসামের অংশ, আসাম হিন্দু প্রধান হবার দরুন তার পাকিস্তান যাবার কোন প্রশ্ন ওঠেনা । তাহলে হঠাৎ করে সিলেট অঞ্চলে গণভোট বা রেফারেন্ডাম হলো কেন?
এর কু কৃতিত্ব টির হোতা হলেন মাউন্টব্যাটেন সাহেব। যদিও মুসলিম লীগের চাপেই তিনি তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।বিলাতের পার্লামেন্টে আটলি যে ঘোষণাটি 3 রা জুন 1947 তারিখে করেছিলেন তার মধ্যে সিলেট এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ভোট হবার ঘোষণা করা হয়েছিল । এই গণভোটের স্বপক্ষে মাউন্ট ব্যাটেনের যুক্তি ছিল আসাম অমুসলিম প্রধান হলেও, সিলেট জেলা নাকি মুসলিম প্রধান এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সংলগ্ন অতএব এখানে গণভোট হওয়া উচিত।
সিলেটের জনবিন্যাসের মধ্যে শ্রীমঙ্গল ও অন্যান্য অঞ্চলে চা বাগিচায় প্রচুর কর্মরত শ্রমিক ছিল। সাধারন হিন্দুর সংখ্যা ছিল 78 5004 , অনুসূচিত জাতি ছিল 26 7510 ,মুসলিম ছিল 18921 17, এবং চা শ্রমিক যারা বিভিন্ন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে এসেছিল তাদের সংখ্যা ছিল 144 876 অর্থাৎ মোট অমুসলিমের সংখ্যা ছিল 1 1973 90 মুসলিম জনসংখ্যার থেকে প্রায় 7 লক্ষ কম । কিন্তু কোন ভোট প্রক্রিয়ায় চা শ্রমিকদের তখন সম্পুর্ন বাদ রাখা হয়েছিল ।
আজ পর্যন্ত সিলেটের হিন্দুদের অনেকের ধারণা এই কাণ্ড আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈএর । তাঁর চক্রান্ত ছিল সিলেট যাতে পাকিস্তানে চলে যায়। বাকি আসাম অসমীয়া ভাষি প্রধান হয়ে থেকে যায়। কিন্তু চক্রান্তের কোন অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সিলেট গণভোট সম্পর্কে প্রামাণ্য রচনা খুব বেশি নেই ।তবে তার মধ্যে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বই একটি পাওয়া যায় , যাতে তিনি কিন্তু এই ধরনের কোন চক্রান্তের কথা লিখেন নি।
শুধু মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন , আসাম কংগ্রেসের কিছু নেতা ক্যাবিনেট মিশনের গ্রুপিং প্লান এর বিরোধিতা করার সময় এক অদ্ভুত বাঙালি আতঙ্কের পরিচয় দিয়েছিল । অবশ্য তিনি এটাও বলেছিলেন , বরদলৈ প্রমুখের বাঙালি আতঙ্ক যত না ছিল তার থেকে অনেক বেশি মুসলিম আতঙ্ক ছিল । কারণ গোপীনাথ বাবু চোখের সামনে দেখেছিলেন উপত্যকায় কিভাবে মুসলিম জনবিন্যাস বেশ বদলে যাচ্ছে।
এই লেখক এর পরিচিত আসামের গোয়ালপাড়া জেলার রামহরির চর নিবাসি ,অধুনা মার্কিন নাগরিক , দেবদাস ঘোষালের বয়ান অনুসারে ওই অঞ্চলে মুসলিমরা একটা ডান্ডার মাথায় রক্ত মাখা গরুর কর্তিত মুণ্ড নিয়ে মিছিল করত পাকিস্তান দাবির সমর্থনে । তাছাড়া যদি চক্রান্ত হয়েই থাকে তবে সে সময়কার আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাঙালি নেতা বসন্ত দাস কি করছিলেন ?তারা কেন এ নিয়ে হৈচৈ করেননি ?তাদের নিচেস্টতার প্রতিও অবশ্যই অঙ্গুলিনির্দেশ করতে হবে ।
বরঞ্চ ভি পি মেনন লেখার উপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী দেখিয়েছেন যে কংগ্রেস রেফারেন্ডাম কমিশনার স্টর্ক এর উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল যাতে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু স্টর্ক তাতে সম্মত হননি । বলেছিলেন, এরা ফ্লোটিং পপুলেশন ।
গণভোটের আরেক সমস্যা ছিল বর্ষা । ভোট হয় জুলাইয়ের 6 - 7 তারিখ। বর্ষায় সিলেট জেলা জলে ভাসে। এটা নিয়ে আসাম গভর্নর পর্যন্ত চিহ্নিত ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ব্যাটন 15 আগস্ট স্বাধীনতার দিন ঘোষণা করে ফেলেছেন তাই কোনো উপায় ছিল না ।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর লেখা থেকে জানতে পারা যায় , এই গণভোটের মুসলিম লীগ যে পরিমাণ তৎপরতা দেখিয়েছিল, যেভাবে মুসলিমরা নিজেদের দিকে জেতার জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালিয়েছিল কংগ্রেসের তরফ থেকে সে ধরনের কোনো রকম কোনো উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায়নি। এর দায়িত্ব আসাম কংগ্রেসের অসমীয়া নেতাদের উপর যতটা বর্তায় , বসন্ত দাস বৈদ্যনাথ মুখার্জি প্রমুখ বাঙালি তাদের উপর ঠিক ততটাই বর্তায়।
এমনকি প্রথম যাকে রেফারেন্ডাম কমিশনার হিসেবে ভাবা হয়েছিল সেই এইচ .সি. স্টক এ নিযুক্তি মুসলিম লীগের চাপে খারিজ করা হয় । এর কারন স্টক সাহেব প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধ বন্দী হয়েছিলেন এবং প্রচন্ড অত্যাচারিত হয়েছিলেন । ফলে তিনি মুসলিমদের অপছন্দ করতেন । জিন্না এর জন্য এম এ ইস্পাহানির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সভা ও প্রচার করেছিল। সে তুলনায় কংগ্রেস বিশেষ কিছু করেনি।
গনভোট শান্তিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ হয়নি। মুসলিম লীগের গুন্ডা শাখা মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের লোকেরা উত্তর ভারত থেকে সিলেট পৌঁছে গিয়েছিল এবং এত গুন্ডামি করেছিল যে স্থানীয় সব জাতির লোক উক্তত বোধ করেছিল। এরা প্রত্যেকে উর্দুভাষী ছিল। স্থানীয় ভাষা বলতে পারতোনা। এদের আনার কারণ সম্ভবত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্বেও লিগ জয় সম্পর্কে সন্দিহান ছিল ।
কারণ, 1. তখনো অনেক ভারতপন্থী মুসলমান ছিল।
2. আব্দুল মতলিব মজুমদারের নেতৃত্বে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সিলেটের ভারত ভুক্তিরপক্ষে ছিল।
3. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজে এসেছিলেন সিলেটে । জেলা চষে বেরিয়েছিলেন। তার প্রেরণায় সিলেটি হিন্দুরা দিল্লি বা বার্মা থেকে বিমানযোগে সিলেটে এসে গিয়েছিলেন ভোট দিতে।
কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মত মহান মানুষ যেমন ছিলেন হিন্দুদের মধ্যেও বেইমানি করার লোকের অভাব ছিল না ।
শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখতে পাই , যে তারা সিলেটের গণভোট জেতবার জন্য কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিল??? তার একটি তথ্য উল্লেখযোগ্য- যেখানে শেখ মুজিব নিজে লিখেছেন , "শহীদ সাহেবের অনুরোধে দানবীর রায়বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা বেশ হিন্দু হয়েও কয়েকখানা লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ।এই লঞ্চগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল মুসলিম লীগের কর্মী এবং পাকিস্তানের পক্ষে। শহীদ সাহেবের বন্ধু ছিলেন এই রায় বাহাদুর। তার কথা তিনি ফেলতে পারেননি শেষ।"
শেষ পর্যন্ত ভোটের ফল বের হলে দেখা গেল সিলেট পাকিস্থানে যাচ্ছে। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট পড়েছিল 2396 19 টি, ভারতের পক্ষে ভোট পড়েছিল 1840 41 । স্পষ্টতই বেশ কিছু মুসলিম ভোট ভারতের পক্ষে পড়েছিল এবং আব্দুল মজুমদারের যে সমস্ত সাপোর্টার ছিল তারাই এই ভোটগুলো দিয়েছিল । এর সঙ্গে যদি চা শ্রমিকদের ভোট যোগ হত তাহলে ফল ঘুরে যেত ।
জেলার চারটি থানা - রাতাবাড়ি ,পাথর কান্ডি , বদরপুর , করিমগঞ্জ থানার এক অংশ ভারতে রইল ।শ্রীমঙ্গল এবং বড়লেখা হিন্দু প্রধান ও ভারত সংলগ্ন হওয়া সত্বেও পাকিস্তানকে দেওয়া হলো ।
দেশের ভাগ এর ফলে দেশের উত্তর পূর্ব অঞ্চল , সাবেক আসাম , নেফা এবং ত্রিপুরা কার্যত বাকি ভারত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আসাম বলতে তখন আসাম, মেঘালয় , নাগাল্যান্ড, মিজোরামকে একত্রে বলা হত। নেফার বর্তমান নাম অরুণাচল প্রদেশ। এই যুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম যাতে মাত্র 3 শতাংশ মুসলিম ছিল তা পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ বলা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিমের সংখ্যা নগণ্য হলেও চট্টগ্রাম এর মধ্য দিয়ে ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম যাবার উপায় নেই।

তথ্যঃ শ্রদ্ধেয় তথাগত রায়ের রচিত শেষ পর্যন্ত দেশ ভাগ হল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন