রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

গৌরকিশোর ঘোষ



গৌরকিশোর ঘোষ
ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন                       প্রণব কুমার কুণ্ডু







সাহিত্যিক এবং সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক
গৌরকিশোর ঘোষ (জন্মঃ- ২২ জুন, ১৯২৩ – মৃত্যুঃ- ১৫ ডিসেম্বর, ২০০০)

তিনি রূপদর্শী ছদ্মনামে গল্প ও উপন্যাস রচনা করতেন। ১৯৭৬-তে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি ও সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ হলে রূপদর্শী নামে গৌরকিশোর ঘোষ দেশ ও আনন্দবাজার-এ অনেক ঝাঁঝালো লেখা লিখেছিলেন। এসব লেখার কারণে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ১৯৭৫ সালের 'মিসা' (MISA) অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ জন-নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে প্রেসিডেন্সি কারাগারে রাখে। সাংবাদিকদের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বহু নির্যাতন সহ্য করেও নিরন্তর সংগ্রামের ব্রতী ছিলেন। মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক চেতনার জন্যে সব মহলে জনপ্রিয় ছিলেন। পোশাক-আশাকে খুবই সাদাসিধে। রসবোধ ছিল প্রখর। ছিলেন পরোপকারী। তার সাহিত্য বাঙলার বিদগ্ধ পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে। আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করতেন তিনি। দেশ পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। আশির দশকে আজকাল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তিনি আজকালকে প্রথাগত একটি দৈনিক করতে চাননি। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর খবরকে তিনি নিয়ম করে প্রথম পাতায় কখনো দেননি। আজকাল-এ প্রায়ই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনই ফাস্ট লিড হিসেবে স্থান পেয়েছে। পত্রিকাজুড়েই ছিল অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ছড়াছড়ি। সেকালে কলকাতার খ্যাতনামা কলামিস্ট অবাঙালি হামদি বে সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের কলাম প্রকাশ করে তিনি চমক সৃষ্টি করেছিলেন। মালিকপক্ষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় গৌরকিশোর ঘোষ পরে পত্রিকাটি ছেড়ে দেন। আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষও তাঁকে আবার সসম্মানে আনন্দবাজার-এ ফিরিয়ে নেন। দেশ-মাটি-মানুষ ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ড 'প্রেম নেই' গ্রামীন মুসলিম জীবন নিয়ে সুবিশাল রচনা। দেশ পত্রিকায় এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে বের হয়। এছাড়া সাগিনা মাহাতো, জল পড়ে পাতা নড়ে, আনাকে বলতে দাও, আমরা যেখানে, লোকটা, রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য ইত্যাদি তার অন্যান্য গ্রন্থ। সাগিনা মাহাতো, তপন সিংহর পরিচালনায় চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার। গৌরকিশোর সৃষ্ট মজলিশি চরিত্রের নাম ব্রজদা। সাংবাদিকতার জন্যে তিনি ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার 'কো জয় উক' স্মৃতি পুরষ্কার এবং ১৯৮১ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কারে সম্মানিত হন। একই বছর মহারাষ্ট্র সরকারের পুরষ্কার, ১৯৯৩ সালে হরদয়াল হারমোনি পুরষ্কার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরষ্কার পান। তিনি ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার ও ১৯৮২ তে বঙ্কিম পুরষ্কার পান। কলকাতা মেট্রো রেলের নতুন প্রস্তাবিত চিংড়িহাটা স্টেশনটি গৌরকিশোর ঘোষের স্মৃতিতে রাখা হয়েছে। তাঁর উপন্যাস, ছোটগল্প, রম্যরচনা ও রাজনৈতিক কলাম নিয়ে কয়েক খণ্ডে গৌরকিশোর ঘোষ রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে।
জন্ম
তিনি বাংলাদেশের যশোর জেলায় হাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক পড়াশোনা করেন শ্রীহট্ট জেলার এক চা-বাগানে। স্কুলের পাঠ নদিয়া জেলার নবদ্বীপে। ১৯৪৫ সালে আইএস-সি পাশ করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ক্রমাগত পেশা বদলে গেছেন। প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, খালাসি, রেস্তরাঁয় বয়, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, ইস্কুল মাস্টার থেকে ভ্রাম্যমান নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার ইত্যাদি অসংখ্য কাজ করেছেন সাংবাদিক জীবনে প্রবেশের আগে পর্যন্ত।
...........
...হুগলির অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী পরিবারের কেউই স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি তাঁদের ‘তুলু’ এমন একটা কাজ করে বসবে! কড়া শাসনের যৌথ সংসারে ধনী ঘোষবাড়ির ধীরেন্দ্রনাথ ও সুধীরবালার ছয় সন্তানের তৃতীয় সন্তান তুলু। ভাল নাম শীলা। নবদ্বীপে মাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে প্রেমে পড়ল চালচুলোহীন দরিদ্র পরিবারের উড়নচণ্ডী ছেলে গৌরকিশোর ঘোষের। একদম চিঠির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রেম। বাড়ির সকলের সঙ্গে একলা একবগ্গা লড়াই করে শীলা এক দিন বাধ্য করালো এই অসম বিয়েতে মত দিতে। ১৯৫৬, ৮ কী ৯ মে। বাংলার পঁচিশে বৈশাখ, রেজিস্ট্রি বিয়ে হল। তেত্রিশ বছরের গৌরকিশোর একবস্ত্রে সাতাশ বছরের শীলাকে নিয়ে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে তুমুল আলোড়ন ফেলে।
এর পর থেকে সবটাই শীলা ঘোষের নিপুণ হাতের জীবনশিল্প। আনন্দবাজারের গৌরকিশোরের স্থায়ী চাকরির আগে পর্যন্ত অসম্ভব অনটনের সঙ্গে ভয়ংকর লড়াই। তার মাঝেই গড়ে তোলা একটি গোছানো সংসার। তৈরি করা তিন ছেলেমেয়েকে। দু’হাতে সামলানো সংসারের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন, বাঁধাগতের বাইরের মানুষ গৌরকিশোরকে।
অন্য দিকে শীলা ঘোষ সেই বিরল স্ত্রীদের একজন, যিনি তাঁর সাংবাদিক-সাহিত্যিক স্বামীর সমস্ত লেখা, ছবি, কাটিং করে সন-তারিখ দিয়ে সংরক্ষণ করে গেছেন। লেখক গৌরকিশোর ঘোষের সমস্ত ম্যানস্ক্রিপ্টের প্রথম অনিবার্য পাঠক ছিলেন তাঁর ‘তুলু’! গল্প-উপন্যাসের দু’প্যারা লিখে তুলুকে পড়িয়ে নিতেন গৌরকিশোর। জীবনের সমস্ত কাজে পরম নিশ্চিন্তি —‘তুলু আছে’।
শ্যামলা। লম্বা। দীর্ঘ চুল। লাবণ্যময়ী মুখশ্রী। বড় বড় পাতা-ছাওয়া আকর্ষণীয় চোখ। বরাবরের সাজ সিঁদুরের টিপ। তাঁতের শাড়ি। আর একমাত্র অলঙ্কার দু’হাতে দুটি মোটা শাখা। ম্যানিলায় ‘ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার নিতে স্বামীর সফরসঙ্গিনী ছিলেন ওই সাজেই।
১৯৭৫-এর এমার্জেন্সিতে ‘মিসা’য় বাড়ি থেকে গ্রেফতার হলেন গৌরকিশোর ঘোষ। তখন সে এক অন্য লড়াই! দুই নাবালিকা মেয়ে আর বৃদ্ধা শাশুড়ি নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। একমাত্র ছেলে তখন হস্টেলে। তা’ও সামাল দিলেন শীলা!
কোর্টে দৌড়োদৌড়ি করে মামলা লড়ে আদায় করলেন স্বামীর সঙ্গে জেলে দেখা করার অর্ডার। প্রচুর ছোটাছুটি করলেন স্বামীকে ‘রাজবন্দি’ স্টেটাস পাওয়ানোর।
বাসে করে দিনের পর দিন আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করা কম কষ্টের ছিল না। প্রায় এক বছর জেলে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি বন্দি মানুষটির সঙ্গে যে ভাবে প্রচণ্ড লড়াই করে আর বুদ্ধি খাটিয়ে যোগাযোগ করতেন, তা রোমাঞ্চকর রহস্য কাহিনিকেও হার মানায়। ছ’ছটা বছর প্যারালিসিসে ভুগে, কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গৌরকিশোরের। তার মধ্যেই তাঁকে তুলে কম্পিউটারে বসিয়ে ফের লেখা ধরানোর দুঃসাধ্য কাজটি করেন এই শীলা ঘোষ, অক্লান্ত সেবাযত্ন আর পরিশ্রমে।
১৫ ডিসেম্বর, ২০০০। সকালে স্ত্রীর মুখে একখানা আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে শেষ আদর করে বিকেলের দিকে চিরবিদায় নিলেন গৌরকিশোর। আরও বারোটা বছর তাঁর তুলু তাঁকে ‘বাঁচিয়ে’ রাখলেন একেকটা বিষয়ে সেমিনার অর্গানাইজ করে, তাঁর জন্মদিন পালন করে, নানা ভাবে তাঁকে প্রোজেক্ট করে, যাতে লোকের মনে তিনি ‘থাকেন’। শেষমেশ নিজে চলে গেলেন ঠিক বারো বছর পর ২০১২, ৪ সেপ্টেম্বর। (আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন