রূপাঞ্জন গোস্বামী

 ১৯৯৯, প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর পাকিস্তান সফরের তিন মাসের মধ্যেই, পিছন থেকে ছুরি মারলো পাকিস্তান। ভারত পাকিস্তানের সীমান্তরেখা পেরিয়ে কাশ্মীরের ঢুকে পাক সেনা দখল করে নিল, প্রবল তুষারপাতের জন্য ভারতীয় সেনাদের ছেড়ে যাওয়া ঘাঁটিগুলি। পাক সেনার মূল লক্ষ ছিল ১ডি জাতীয় সড়ককে দখল করে লাদাখকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের স্কার্দু শহর থেকে কার্গিলের দূরত্ব মাত্র ১৭৩ কিলোমিটার। স্কার্দু থেকে পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা খুবই সহজ। নির্বিঘ্নে পাকিস্তান দখল করে নেবে সিয়াচেন গ্লেসিয়ার। যেটি নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তুমূল লড়াই চলছে দশকের পর দশক। শ্রীনগর থেকে ২০৫ কিলোমিটার দূরে, লাদাখের লেহ যাওয়ার পথে আপাত শান্ত গ্রাম কার্গিল হয়ে উঠলো এক রক্তক্ষয়ী রণাঙ্গণ। পাক হানাদারদের তাড়াতে শুরু হল ভারতীয় সেনা বাহিনীর ‘অপারেশন বিজয়’

শুরু হলো অপারেশন বিজয়

তখন পালামপুরে

হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকার মিষ্টি পাহাড়ি শহর পালামপুর। হোলির ছুটিতে বাড়ি এসেছে ভিকি ওরফে লেফটেন্যান্ট বিক্রম বত্রা। গভর্নমেন্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল গিরিধারীলাল বত্রা ও স্কুল শিক্ষিকা কোমলকান্তের সন্তান। যমজ দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট ভাই বিশালের থেকে ১৪ মিনিটের বড় ভিকি ওরফে বিক্রম। ছোটবেলা থেকেই স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় বিক্রম। স্কুলে সে অলরাউন্ডার। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। দুর্দান্ত স্পোর্টসম্যান। নাটক, গান, বিতর্ক, আবৃত্তি,আঁকা, সবেতেই চৌখশ। উত্তর ভারতের সেরা এনসিসি ক্যাডেট। ক্যারাটেতে গ্রিন বেল্ট হোল্ডার। জাতীয় স্তরের টেবল টেনিস প্লেয়ার। কিন্তু বিক্রম ছোট বেলা থেকেই ভীষণ দেশভক্ত। তার বড় ইচ্ছা, তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। তাই হংকং এর মার্চেন্ট নেভি কোম্পানি্র দামী চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৯৬ সালে, বিক্রম লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করলেন ভারতীয় মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে।

ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রার জন্মভূমি পালামপুর (হিমাচল প্রদেশ)
“অর্থ জীবনের মোক্ষ নয়, আমি দেশের জন্য এর চেয়েও বড় কিছু করতে চাই। অসামান্য কিছু, অসাধারণ কিছু” ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা।
প্রত্যেকবার পালামপুরে ফিরে বিক্রম স্থানীয় নদীর ধারে বন্ধুদের সঙ্গে নিউগাল কাফেতে কফি খান। এক বিকেলে কফি খেতে খেতে এক বন্ধু বলেছিলেন,” ভিকি, কাশ্মীরে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, কে জানে কখন তোকে ডেকে পাঠায়। সাবধানে থাকিস ভাই।  বেলজিয়াম থেকে সদ্য কম্যান্ডো কোর্স করে আসা ২৪ বছরের লেফটেন্যান্ট বিক্রম বত্রা হেসে বলেছিলেন“হয় তেরঙ্গা উড়িয়ে ফিরব। নয়তো ওই তেরঙ্গাতেই জড়িয়ে ফিরবI কিন্ত, ফিরে অবশ্যই আসবI”

ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা ও তাঁর বান্ধবী ডিম্পল চিমা

 “ইয়ে দিল মাঙ্গে MORE”

বন্ধুর আশঙ্কাই সত্যি হলো।  বিক্রমের ইউনিট ১৩ জম্মু-কাশ্মীর রাইফেল, কার্গিল যুদ্ধে যাওয়ার অর্ডার পেল। পুনঃদখল করতে হবে পাক সেনার দখল করা পয়েন্ট ৫১৪০।  জম্মু কাশ্মীরের দ্রাস সেক্টরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বতশৃঙ্গ । ১ জুন (১৯৯৯) লেফটেন্যান্ট বিক্রমকে ডিউটিতে জয়েন করতে বলা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল যোগেশ কুমার জোশী। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোশির সঙ্গে বিক্রমের মিটিং-এ ঠিক হলো ডেল্টা টিমের ‘বিজয় সঙ্কেত‘। আশ্চর্যজনক ভাবে লেফটেন্যান্ট বিক্রম ‘বিজয় সঙ্কেত’ হিসেবে বেছে নিলেন ‘পেপসি’র বিজ্ঞাপনের লাইন,” ইয়ে দিল মাঙ্গে more”। যা পরে বিজ্ঞাপনটির চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে।

পয়েন্ট ৫১৪০
১৯ জুন, রাত ৮.৩০ পয়েন্ট ৫১৪০ শৃঙ্গের দিকে এগোতে লাগল ডেল্টা আর ব্রাভো কমান্ডোরা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর রকেট আর মর্টার বৃষ্টির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বিক্রম এগোতে লাগলেন পয়েন্ট ৫১৪০ এর শিখরের দিকে। ব্রাভো কমান্ডোরা তাঁদেরকে দেওয়া টার্গেট, পাকিস্তানি বাঙ্কারটি উড়িয়ে দিলেন ২০ জুন, ভোর ৩,৩০ মিনিটে  কিন্তু পয়েন্ট ৫১৪০ জয় এখনও অনেক দূরের পথ। লেফটেন্যান্ট বিক্রম বত্রা ঠিক করলেন পিছন থেকে আক্রমণ করে চমকে দেবেন শত্রুকে। পাকিস্তানে ফেরার পথ বন্ধ করে দেবেন। শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে, বিক্রম নিজে তিনটে রকেট ছুঁড়লেন পূর্ব দিকের বাঙ্কারগুলিতে। তারপর, তিনি ও তাঁর ডেল্টা কমান্ডোরা খাড়া পাহাড় বেয়ে গিরগিটির মতো উঠে চললেন রাতের আঁধারে।

পাক বাঙ্কারে গোলা বর্ষণ করছে ভারতীয় আর্টিলারি
প্রথম পাক বাঙ্কারটির কাছে পৌঁছে, বিক্রম দু’টো গ্রেনেড ছুঁড়লেন। মোক্ষম আঘাত। নিস্তব্ধ হয়ে গেলো পাক মেশিনগান। পালটা গ্রেনেড ছুঁড়ে, গুলি করতে করতে ছুটে আসছে তিন পাক সেনা। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে আঘাত লেগেছে বিক্রমের। সেই অবস্থাতেই  চিত হয়ে শুয়ে, ছুটে আসা তিন পাক সেনাকে একাই গুলি করে মারলেন বিক্রম। একে বারে করমর্দনের দূরত্ব থেকে। ডেল্টা ফোর্স এগোতে লাগলো পাক আর্মির পরের বাঙ্কারের দিকে। এটা ধ্বংস করতে পারলেই ভারত পুনঃদখল করবে পয়েন্ট ৫১৪০। সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিক্রম আর তাঁর ডেল্টা ফোর্স। এ বার খতম হলো আট পাকিস্তানি সেনা ।

দখল করা পাক মেশিনগান নিয়ে ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা (ছবির ডান দিকে)
ভারত দখলে নিল পয়েন্ট ৫১৪০ এবং একজনও ভারতীয় সেনা এই অভিযানে নিহত হননি। ২০ জুন, ভোর ৪,৩৫ মিনিটে  ইথার তরঙ্গে, বেসক্যাম্পে ভেসে এলো বিক্রমের গলা, “ইয়ে দিল মাঙ্গে more!”  অসামান্য বীরত্বের জন্য ক্যাপ্টেন পদে প্রমোশন হলো বিক্রমের। লেফটেন্যান্ট বিক্রম বত্রা থেকে হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা। ভারতের সেনাপ্রধান বেদ প্রকাশ মালিক, স্বয়ং বিক্রমকে অভিনন্দন জানালেন। সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রার নাম। টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ভেসে উঠলো বিক্রমের সরল অথচ প্রত্যয়ী হাসিমাখা মুখ। বোকাবাক্সর দৌলতে তাদের ‘জানি-দুশমন’ শের-শাহকে ( যুদ্ধে বিক্রমের সাংকেতিক নাম) চিনে গেলো পাকিস্তানও।
২০ জুন, পালামপুরের বাড়িতে এলো ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রার স্যাটেলাইট কল,
বাবা, আমি শত্রুর পোস্ট দখল করেছি, আমি ভালো আছি। 
-বেটা, আমি তোমার জন্য গর্বিত। ভগবান তোমাকে তোমার কাজের জন্য আশীর্বাদ করুন।

ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রার বাবা ও মা

 ‘পয়েন্ট ৪৮৭৫’

৩০ জুন ১৩ জম্মু-কাশ্মীর রাইফেল চলে এল মুশকো উপত্যকায়। এ বার দখল করতে হবে ১৭০০০ ফুট উঁচু পয়েন্ট ৪৮৭৫।এই শৃঙ্গটি বরফ ঢাকা। শত্রুর কাছে পৌঁছাতে হবে ৮০ ডিগ্রী খাড়া ওয়াল বেয়ে। এবং শৃঙ্গটি সারাক্ষণ ঘিরে থাকে ঘন কুয়াশা। পাকিস্তানি সেনা ১৬০০০ ফুট উচ্চতায় ওঁত পেতে আছে। পয়েন্ট ৪৮৭৫ শৃঙ্গটি থেকে পাক সেনা ভারতের ‘গান পজিশন’, সেনা ছাউনি ও ‘ট্রুপ মুভমেন্ট’-এর ওপর অনায়াসে নজর রাখছে এবং হামলা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যেই এ জন্য ভারতের প্রচুর জওয়ান শহিদ হয়েছেন।

পয়েন্ট ৪৮৭৫
৪ জুলাই, সন্ধ্যা ৬টার সময় ১৩ জম্মু-কাশ্মীর রাইফেলের আর্টিলারি গর্জে উঠলো। সারারাত ভারতীয় সেনার ১৫৫ মিমি বোফোর্স হাউইটজার কামান, ১০৫ মিমি ফিল্ড গানমাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারগুলি এক মিনিটের জন্যও ঘুমালো না। রাত ৮,৩০ মিনিটে  আলফা আর ব্রাভো কোম্পানির কম্যান্ডোরা এগোতে লাগলেন পয়েন্ট ৪৮৭৫ শৃঙ্গের দিকে।ভারতীয় আর্টিলারির ‘কভার ফায়ার’-এর আড়ালে। কিন্তু ওপরে থাকা শত্রু সেনার সুবিধাজনক পজিশনের জন্য এগোতে পারছেন না কম্যন্ডোরা। ৫ জুলাই সকাল ১০,১৫ নাগাদ  মেজর গুরপ্রীত সিংয়ের নেতৃত্বে আক্রমণে নামলো  চার্লি  কম্যান্ডোরা। তিন বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে বেলা ১ টা নাগাদ ভারতীয় সেনা দখল করলো পয়েন্ট ৪৮৭৫।
কিন্তু  ফ্ল্যাট টপ নামে পয়েন্ট ৪৮৭৫ লাগোয়া শৃঙ্গ থেকে গুলি করছে পাক সেনারা। ফ্ল্যাট টপ জয় না করলে পয়েন্ট ৪৮৭৫ ধরে রাখা অসম্ভব। ৬ জুলাই বিকেলে ফ্ল্যাট টপ জয় করলেন ভারতীয় সেনারা।  ক্যাপটেন বিক্রম বত্রা তখন মুশকো নালার পাশে ফেলা টেন্টে । স্লিপিংব্যাগের ভেতর শুয়ে আছেন, প্রবল জ্বরে আর ক্লান্তিতে প্রায় বেহুঁশ। তাঁর কমান্ডিং অফিসার তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন টেন্টে শুয়ে থাকতে।

যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা ( ছবির বাম দিকে )
কিন্তু প্রবল ভাবে প্রতি আক্রমণে ফিরে এলো পাক বাহিনী। ভারতীয় বাহিনীকে বেকায়দায় পেয়ে দ্রুত উঠে আসতে লাগলো তারা । এবার বুঝি পয়েন্ট ৪৮৭৫ আবার পাকিস্তান দখল করে নেবে  ক্যাপ্টে বিক্রম বত্রা নিঃশব্দে বেসক্যাম্প থেকে বাইনোকুলারে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন। পাক সেনার হাতে ভারতীয় সেনার পরাজয় ও প্রচুর ভারতীয় সেনার নিশ্চিত মৃত্যু তিনি নিজের চোখে দেখতে পারবেন না। তিনি গেলেন তাঁর কমান্ডিং অফিসারের কাছে অনুমতি নিতে। বললেন “I’LL GO UP SIR.”।  শরীরে শত্রুর স্প্লিন্টারের ক্ষত, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ক্যাপ্টেন  বিক্রম বত্রার। কমান্ডিং অফিসারের বারণ করলেন, কিন্তু বিক্রম বত্রা ক্রমাগত অনুরোধ করে যেতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রার সাহস আর জেদ দেখে তাঁর ব্যাটেলিয়নের অনেক সৈন্য স্বেচ্ছাসেবক হতে চাইলেন। কমান্ডিং অফিসারের আদেশ অমান্য করলে জেল বা কোর্ট-মার্শাল অনিবার্য। তবুও তাঁরা তাঁদের আহত স্যারের সঙ্গে যুদ্ধে যাবেন।

“শের শাহ আসছে”

বেসক্যাম্প ছেড়ে যুদ্ধে নামার আগে ক্যাপটেন বিক্রম বত্রা ও তাঁর সহযোগী ডেল্টা কোম্পানির ২৫ জন সেনা দুর্গা মন্দিরে প্রার্থনা করলেন। ঘন কালো রাতে শের-শাহ বিক্রমের শার্দূলরা আরোহণ শুরু করলো। ওপর থেকে ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত ভারতীয় বাহিনীর আনন্দ উল্লাসের আওয়াজ ভেসে এলো। তাঁরা ওয়ারলেস সেটে খবর পেয়েছেন  “শের শাহ আসছে‘”। পাকিস্তানিরাও এই ওয়ারলেস মেসেজ ধরে ফেললো। তারা ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা ওরফে শের শাহকে চেনে। পাকিস্তানি সেনাকে চূর্ণ করে দ্রাসের পয়েন্ট ৫১৪০ এর প্রথম উঠে এসেছিলেন মূর্তিমান বিভীষিকা বিক্রম বত্রা।

শেষ যুদ্ধের আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি কার্গিলের শের শাহ
ওয়ারলেস মারফৎ পাক সেনারা  বিক্রম বত্রাকে অবজ্ঞার সুরে বলে, “শেরশাহ তু আয়া, আপনে কে লিয়ে একবার ভি নেহি শোচা!!!  বিক্রম বত্রা  প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন” হামলোগকা বাত ছোড়, আপনি মওত কা শোচ”।  এর পরেও পাক সেনা তামাশা করেছিলো বিক্রম বত্রার সঙ্গে। বলেছিলোমাধুরী দীক্ষিতকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিলে তারা লড়াই ছেড়ে দেবে। ক্যাপ্টেন বাত্রার উত্তর দিয়েছিলেন, “মাধুরীজি তো বিজি হ্যায়। ম্যায় আতা হুঁ।”
বিক্রম বত্রার আসায় অনুপ্রাণিত ভারতীয় সেনা ৬ জুলাই রাতে দুর্ধর্ষ ভাবে লড়াই করলো। পাকিস্তানি সেনার খুব কাছে চলে এলো। একেবারে মৌখিক গালিগালাজের দূরত্ব। উড়ে আসছে উর্দু ভাষার গালি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশুদ্ধ হিন্দি গালি উড়ে যাচ্ছে রাইফেলের গুলি নিয়ে। ক্যাপ্টেন বত্রা দেখলেন, ভারতীয় বাহিনীকেই আক্রমণে গিয়ে ধ্বংস করতে হবে পয়েন্ট ৪৮৭৫ এর উত্তরে থাকা পাকিস্তানি বাঙ্কার । নাহলে আবার পয়েন্ট ৪৮৭৫ হাত ছাড়া হয়ে যাবে। বিক্রম তাঁর টিম নিয়ে এ বার এক ভয়াবহ আক্রমণে নামলেন ।

যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দেওয়া বিক্রম

ক্যাপ্টেন  বিক্রমদের ঘিরে আছে ঘন কুয়াশা। তারই মধ্যে বিক্রম সরীসৃপের দক্ষতায় হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলেন পাকিস্তানের মেশিনগানের কাছে। যেটা ভারতীয় সেনাদের ফাঁদে ফেলে মারছে।  মেশিনগানের কাছে গিয়ে গ্রেনেড ছোঁড়েন। ধ্বংস হয় মেশিনগান। মারা পড়ে পাঁচ পাকিস্তানি সেনা। না থেমে বিক্রম এগিয়ে যান পাক আর্মির পরের পজিশনে। অনুচ্চ স্বরে বলেন, BOYS FOLLOW ME“।  ১৬০৮৭ ফুট উচ্চতায় এক অতিমানবীয় লড়াই লড়ছেন আহত, অসুস্থ, ক্লান্ত, অবসন্ন ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটা পর একটা শত্রু বাঙ্কার ধ্বংস করতে করতে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর পিছনে এগিয়ে আসছে ভারতীয় সেনা। ৭ জুলাই ভোর হওয়ার আগেই বিক্রমের বাহিনী আরও দুটি পাকিস্তানি মেশিনগান ধ্বংস করে পৌঁছে গেলো সবচেয়ে মারাত্মক পাক বাঙ্কারটির সামনে। কিন্তু তখন দিনের আলো ফুটে গেছে।
মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে, তাঁর ব্যাটেলিয়নের রণহুঙ্কার, ‘দুর্গা  মাতা কি  জয়” বলে সোজাসুজি আক্রমণ  করলেন মেশিনগান পয়েন্টটিকে। তাঁর  AK-47 আগ্নেয়গিরির মতো আগুন ছেটাতে লাগলো। তাঁর টিমের বাকি দুজন, সুবেদার রঘুনাথ সিং এবং আর্টিলারি অবজারভেশন অফিসার মেজর ভাট  ‘সাপোর্টিং ফায়ার‘ করতে লাগলেন। বিক্রমের সারা গায়ে পাক গ্রেনেডের স্প্লিণ্টার লাগলো আবার।  নতুন করে ঝরতে লাগলো তাজা হিমাচলী রক্ত। এই অবস্থাতেও বিক্রম  ঢুকে পড়লেন শত্রু ডেরায়। তাঁকে দেখে চমকে উঠলো শত্রুপক্ষ। কিছু বোঝার আগেই তিনজন পাক সেনা  ঝাঁঝরা হয়ে গেলো বিক্রমের AK-47 -এর ‘ব্রাশ‘ ফায়ারে।
বাকি দুজন পাক সেনার একজন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বিক্রমের ওপরে ছুরি নিয়ে। বিক্রমের এক ঘুসিতে তার নাক থেঁতলে গেলো। সে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রমের বেয়নেট পাকিস্তানি সেনাটির পাকস্থলী ছিন্নভিন্ন করে দিলো।  আরেকজন পাক সেনা তাঁকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু ক্যারাটের গ্রিন বেল্ট বিক্রম, মারলেন এক সপাট আছাড়। পাহাড়ের গভীর খাত গড়িয়ে নেমে গেলো ঘাড় ভাঙা পাকিস্তানি সেনার নিথর শরীর।  আরেকটু এগিয়ে বিক্রম দেখতে পেলেন,  একটি পোস্টে মেশিনগান নিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে বসে আছে চার পাকিস্তানি সেনা। একাই আক্রমণ করলেন আবার। গ্রেনেড আর গুলিতে একাই নিকেশ করে দিলেন চার পাকিস্তানি সেনাকেই।
হটাৎ বিক্রমের টিমের এক জুনিয়র অফিসার আহত হলেন। গ্রেনেডের আঘাতে  তাঁর পা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে প্রায়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। বিক্রম কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। পাক সেনা এই সময় রণক্লান্ত বিক্রমের সঙ্গে একটি মনস্তাত্বিক খেলা খেলল। তারা ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা’কে রাগিয়ে দেবার জন্য চেঁচিয়ে বললো, ” শের শাহ নাম রাখনেসে কোই শের নেহি বন জাতে”।
বোল্ডারের পিছনে বসে থাকা সুবেদার রঘুনাথ বিক্রমকে বললেন,’ স্যার ম্যায় উস্ কো ইভ্যাকুয়েট করুঙ্গা“। ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, “ নেহি, তুম বাল-বাচ্চেদার হো। তুমকো লোট না হোগা“। সর্বাঙ্গে বইছে রক্তবন্যা। বাটরা উঠে দাঁড়ালেন শত্রুর গুলির সামনে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সহযোগী যোদ্ধার জীবন বাঁচাতে। ছুটে আসছে শত্রুর গুলি। অতর্কিতে বুকে এসে লাগল পাকিস্তানি স্নাইপারের গুলি, একই সঙ্গে মাথায় লাগলো পাক গ্রেনেডের স্প্লিন্টার। জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে চিৎকার করলেন বিক্রম, ” জয় মাতাদি“। আহত সহযোদ্ধার পাশে শেষ ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লেন ভারত মায়ের বীরপুত্র ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা
পাঁচ হাজার অমর শহিদের রক্তের বিনিময়ে কার্গিল যুদ্ধ জিতে গিয়েছিল ভারত। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মুখোমুখি হয়ে  অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগ প্রদর্শনের স্বীকৃতস্বরূপ শহিদ ক্যাপটেন বিক্রম বাত্রাকে ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক পদক পরমবীর চক্র (মরণোত্তর) দেওয়া হলো।

ভিকি ফিরলেন পালামপুরে

বন্ধুকে দেওয়া কথা রাখলেন ভিকি। তেরঙ্গায় জড়িয়েই পালামপুরে ফিরে এলেন শহিদ বিক্রম বত্রা। বিক্রমের চিতা জ্বলছে। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন সন্তানহারা মা। পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলেন বিক্রমের বাবা। অশ্রুহীন চোখে ভারত জননী বলেছিলেন,”  এই কারণেই বুঝি ভগবান আমাকে যমজ পুত্র দিয়েছিলেন। একজনকে পাঠানো হয়েছিল আমার জন্য। আরেকজনকে দেশের জন্য”

” কর চলে হাম ফিদা জান ও তন সাথীয়োঁ, আব তুমহারে হাওয়ালে ওয়াতন সাথীয়োঁ “
আজ আমরা যখন নীল আকাশের নীচে আমাদের জাতীয় পতাকা উড়তে দেখি। গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। কিন্তু মনে রাখবেন,“আমাদের জাতীয় পতাকা বাতাসে ওড়ে না, ওড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেওয়া প্রতিটি ভারতীয় সৈনিকের শেষ নিঃশ্বাসে”। 
904SHARES
Comments