শুক্রবার, ১৩ জুলাই, ২০১৮

কুড়ি লাখ বৌদ্ধ সন্ন‍্যাসির হেরিটেজ গোরস্থান ৮১৬ খৃষ্টাব্দ থেকে, জাপানের অকুনিয়নে।


    কুড়ি লাখ বৌদ্ধ সন্ন‍্যাসির হেরিটেজ গোরস্থান ৮১৬ খৃষ্টাব্দ থেকে, জাপানের অকুনিয়নে।


    ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন :               প্রণব কুমার কুণ্ডু



কুড়ি লাখ বৌদ্ধ সন্ন‍্যাসির হেরিটেজ গোরস্থান ৮১৬ খৃষ্টাব্দ থেকে ,,জাপানের অকুনিয়নে।

অয়াকাইয়ামা পাহাড়টা বেশ বড়। সেই পাহাড় টপকে আমাদের গাড়ি যখন গোরস্থানে ঢুকছি তখন সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে । গোরস্থানের ভেতরে গাড়ি যাবার ব‍্যাবস্থা নেই। তাই গোধূলির আলোতে পাথুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। আমাদের হাতে লন্ঠন। কেননা ইলেকট্রিক আলোর ব‍্যবস্থা নেই।অন্ধকার নামার ভয়ে আগেই লণ্ঠন জ্বালানো হয়েছে। চারপাশের ছাতা আকৃতির পাইন গাছ এবং বিষাক্ত হেমলক লতার ঝোপে সাপের কিলবিলে অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। আমরা কিছুটা ভীত, আবার কিছুটা উত্তেজিতও। হাঁটছি খুব সাবধানে। মোহগ্রস্থের মত এগুচ্ছি ১২শ’ বছরের পুরনো এক অরণ্যের দিকে। যত ভেতরের দিকে যাচ্ছি আলো তত কমছে। হাঁটার সময় লণ্ঠনের আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেই কম্পিত আলো গিয়ে পড়ছে বহু প্রাচীন সব কবরের গায়ে, ছায়া সরে যাচ্ছে ধূপ সুবাসিত কাঠে কিংবা পাথরে খোদাই করা মুখের অবয়বে। মনে হচ্ছে গোরস্থানের অন্ধকার জায়গাগুলো থেকে কেউ নিঃশব্দে নজর রাখছে আমাদের উপর। সেটা হওয়া খুবই সম্ভব। কারণ এই গোরস্থান সাধারণ কোনো গোরস্থান না। এটা জাপানের সবচেয়ে বড় অকুনিয়ন গোরস্থান। কুয়াশাচ্ছন্ন এবং ঘন শেওলায় ভর্তি প্রায় দুই কিমি লম্বা এই গোরস্থানে কুড়ি লাখ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কবর হয়েছে। মৃত সন্ন্যাসীরা বহু বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে এখানে। তারা বুদ্ধ হয়ে আবার পুনর্জন্ম লাভ করবে পৃথিবীতে এমনটাই কথা রয়েছে। এই গোরস্থানের সূচনা হয়েছিল ৮১৬ খ্রিস্টাব্দে। বলা হয়, এর প্রত্যেকটা ইঞ্চি পবিত্র। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো পবিত্র অনুভূতি আমাদের ভেতরে হচ্ছে না, বরং অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথে কেমন যেন একটা ছমছমে অনুভূতি হচ্ছে...... অকুনিয়ন গোরস্থান জাপানের পাহাড়ি অয়াকাইয়ামা অঞ্চলের প্রাচীন গ্রাম কয়া-সানে অবস্থিত। জায়গাটি জাপানের কি পর্বতমালার অনেকগুলো পবিত্র স্থানের মধ্যে একটা। ইউনেস্কো এই জায়গাটিকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর তালিকায় স্থান দিয়েছে। প্রায় ১৫শ বছর আগে আধুনিক আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান অঞ্চল থেকে সন্ন্যাসীরা গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের গোড়া পত্তন করেছিলেন জাপানে। কয়া-সান অঞ্চলকে শিংগন বৌদ্ধধর্মের উপকেন্দ্র হিসেবে ধরা যেতে পারে। শিংগন বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে পূর্ব এশিয়ার গুটি কয়েকটি টিকে থাকা তান্ত্রিক ধারার ধর্ম। এই ধারাতে ‘মিক্ক্য’ (বজ্রযান) নামের একটা রহস্যজনক বিদ্যার চর্চা করেন সন্ন্যাসীরা এবং এই গুপ্ত বিদ্যার কথা শুধু মুখে মুখে বলে যান পরবর্তী প্রজন্মের বিশ্বস্ত সন্ন্যাসীদের কাছে। ৮০৫ খ্রিস্টাব্দে এই ধর্ম চর্চা জাপানে প্রথম চালু করেন কবি ও বৌদ্ধ মাস্টার কুকাই। তার আরেক নাম কোবো-দাইশি। তিনি ট্যাঙ ডায়ন্যাস্টির সময়ে চীনের জিয়ানের সন্ন্যাসীদের সাথে থেকে এই ধর্ম চর্চা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে জাপানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা হয়ে ওঠেন। গোরস্থানের একেবারে শেষ প্রান্তে তার মন্দির। এই মন্দিরে অনন্তকালের জন্য ধ্যান মগ্ন অবস্থায় রয়েছেন তিনি। তার ধ্যানের একটাই উদ্দেশ্য- জীবিত প্রাণকে দেহের খাঁচা (জরা-ব্যাধি) থেকে মুক্তি দেয়া। অন্যকথায় বলতে গেলে তিনি মৃতের মুক্তির সাধনা করছেন। কয়া-সানের পাহাড়ি অঞ্চল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানকার মন্দিরগুলোতে ইচ্ছা করলে দর্শকরা সন্ন্যাসীদের সাথে থাকতে পারবেন। পর্যটকদের নিরামিষ খাবার এবং ধ্যান করার উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেন সন্ন্যাসীরা। আধুনিক নগর জীবন যাদের মন বিষিয়ে দিয়েছে তারা এখানে খুঁজে পাবেন প্রশান্তিময় জীবন। কয়া-সানে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে জাপানের বুলেট ট্রেন। টোকিও থেকে বুলেট ট্রেন নানকাই লাইনে চড়ে বসলে ৫ ঘণ্টা লাগবে ওসাকার নাম্বা স্টেশানে পৌঁছাতে। এখানে পৌঁছালেই চোখে পড়বে সবুজ ঘাসে মোড়া পাহাড় ভর্তি চেরি ফুলের গাছ। এখানকার গেস্ট হাউসগুলোও অনেকটা নবম শতকের দালানের আদলে তৈরি। ভ্রমণের একেবারে শেষ ধাপে রয়েছে বৈদ্যুতিক তারের ট্রাম (কেবল কার) ভ্রমণ। এই ট্রাম পাহাড়ের ৮০০ মিটার উচ্চতায় নিয়ে যাবে মাত্র পাঁচ মিনিটে।তবে আমরা কোচে গিয়েছিলাম। ঊর্ধ্ব গমনের সাথে সাথেই আধুনিক জগতের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে মন। মনে হবে, মর্তলোক ছেড়ে স্বর্গলোকে আরোহণ করা হচ্ছে। বলা হয়, কয়া-সান পাহাড়ের ৮টি চূড়া উপর থেকে দেখতে অনেকটা পদ্ম ফুলের মত। আমরা জানি না ব্যাপারটা সত্যি কিনা, কিন্তু এখানে আসার পর এর কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ি প্রকৃতি দেখে বোঝা গেলো প্রথম দিককার সন্ন্যাসীরা কেন জায়গাটিকে আধ্যাত্মিক চর্চার জন্য আদর্শ জায়গা বলে বেছে নিয়েছিলেন। এখানে সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে আছে, শুধু উড়ে বেড়াচ্ছে ঠাণ্ডা দমকা বাতাস। বৌদ্ধরা দারিদ্র্যতাকে মহান আখ্যায়িত করে যে রকম বড় বড় কথা বলে, সেটা আধ্যাত্মিক অন্বেষণের খোঁজে আসা পর্যটকদের জন্য খাটবে না। পর্যটকদের জন্য গলায় ছুরি। হোটেল ভাড়া, খাবার দাবার এবং ধ্যান করার খরচ প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার টাকা। এটা স্রেফ ডাকাতি। তাছাড়া সেকিশো ইন নামের যে হোটেলে আমাদের থাকতে দিয়েছিল সেটাও দেখতে আহামরি কিছু না। তবে হোটেলের যে কক্ষে আমাদের থাকতে দেয়া হয়েছিল সেটা অনেক পুরনো ধাচের অভিজাত একটা কামরা। এরকম নির্জন প্রাচীন কামরায় এমনিতেই ধ্যান করতে ইচ্ছা হয়। যে রাতে কয়া – সানে পৌঁছেছি তার পরদিন আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম সেখানকার ১১৭টি মন্দির এবং সন্ন্যাসীদের মঠ। সেখানকার প্রধান বৌদ্ধ মন্দিরের নাম হচ্ছে ড্যানজো গরান কমপ্লেক্স। এখানেই সন্ন্যাসীরা পর্যটকদের ধ্যান করার প্রশিক্ষণ দেয়। এই কমপ্লেক্সে নবম দশকের একটি সিন্ধুরবর্ণ বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। জাপানের বেশিরভাগ জায়গাতেই যে অস্পষ্ট জেন বৌদ্ধ মন্দিরগুলো রয়েছে, সেগুলোর চেয়ে এই মন্দিরের পার্থক্য আছে। এখানকার মন্দিরগুলো অনেকটা তিব্বত, নেপাল এবং ভুটান ধাঁচের। সকাল বেলা মন্দির দেখা শেষ করে শেষ বিকেলে বের হলাম গোরস্থানের উদ্দেশ‍্যে। অকুনিয়ন গোরস্থান যেন ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে আছে বহুবছর, আমরা তার আঁচ পাচ্ছি শুধু। গোরস্থানের ভেতরে যে পাথরের মূর্তিগুলো রয়েছে সেগুলো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জিজো বোসাতসুর। বিভিন্ন আকৃতিতে তাকে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। বলা হয়, কেউ যদি তার সন্তান হারিয়ে ফেলে, তাহলে এই মূর্তির উপরে একটুকরো লাল কাপড় রেখে গেলে জিজো সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তানের দেখভাল করেন। সেই কারণেই বোধ আমরা দেখলাম চারপাশে হাজার হাজার কাপড় পড়ে রয়েছে, মৃদু বাতাসে উড়ছে, পাক খাচ্ছে। এই গোরস্থান নির্বাণ লাভের গোরস্থান। এটা যেন যেন সমগ্র মানব জাতিকে নির্বাণ দেয়ার জন্য জমা করে রেখেছে তাদের সমস্ত দুঃখ দুর্দশা। এটা যেন মানুষের দুঃখ কমানোর জায়গা। কারো দুঃখ বেড়ে গেলে সে এই জায়গায় এসে কিছুটা দুঃখ রেখে যাবে, হালকা করে যাবে নিজেকে। সৌন্দর্য অনেক রকম হয়, এই গোরস্থানের সৌন্দর্য হচ্ছে বেদনা। আমরা গোরস্থানের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। এখানে রয়েছে মাস্টার কুকাইয়ের দরগা। দরগার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, কারণ ১০ হাজার ঝুলন্ত লণ্ঠন একসাথে জ্বলে এখানে। এর মধ্যে ২টি লণ্ঠন ১০৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে একটানা জ্বলছে। আমরা দরগার ভেতরে ঘুরতে শুরু করলাম...ভেতরে কাঠের কারুকাজ করা, তার ভেতরে আলো জ্বলছে ধিকি ধিকি......... মন্দির দেখার পর অন্ধকারে আমরা যখন চুপচাপ ফিরছিলাম হোটেলের পথে তখন কেন জানি গোরস্থানের অন্ধকারকে একটুও ভয় করছিল না। আগের মত গা ছমছম করছিল না মোটেও। আলো এবং অন্ধকারের মধ্যকার তফাৎ যেন আর পীড়া দিচ্ছিল না আমাদের। আমরা যেন বুঝতে শুরু করেছি গৌতম বুদ্ধ কেন বলেছিলেন, ‘Be a light unto yourself’, অর্থাৎ নিজের ভেতরে আলো জ্বালো, সেই আলো কখনো নিভবে না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন